বেলাশেষে পর্ব-০৬

0
33

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৬

“চলুন পারমিতা। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
পারমিতা উঠে দাঁড়াল। পারমিতার ঘাড় ছুঁই ছুঁই বাউণ্ডুলে চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। পারমিতা আবারও ক্লান্ত পায়ে হেঁটে গেল বাড়ির আঙিনায়। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দুচোখ জুড়িয়ে, মন ভরে বাড়িটা দেখে নিল। বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সাহস হলো না। ছোটোবেলা থেকে যে রূপে বাড়িটা দেখে এসেছে। বাড়িটা আর সেই রূপে নেই। বাড়ির রঙ পাল্টেছে, রূপ বদলে গেছে। পারমিতার স্মৃতিতে আগের সাজানো গোছানো বাড়িটাই জীবন্ত হয়ে থাকুক। পারমিতা অশ্রুস্নিগ্ধ নয়নে বাড়িটা শেষবারের মতো মন ভরে দেখে নিল। তারপর ধীর পায়ে গাড়িতে উঠে বসল। প্রণয় পুরোটা সময় পারমিতাতেই মত্ত ছিল। এই মেয়েটা প্রতি ক্ষণে ক্ষণে প্রণয়কে মুগ্ধ করছে। বলতে বাঁধা নেই। পারমিতার দিকে তাকালে অন্যরকম অনুভূতি হয় প্রণয়ের। এই মন কেমন করা শিরশিরে অনুভূতি অনুভব হতো হৈমন্তীকে দেখলে, হৈমন্তীর সংস্পর্শে থাকলে। তারপর চারবছর পেরিয়ে গেছে। কোনো মেয়েকে দেখেই আর এমন অনুভূতি হয়নি। প্রণয় পারমিতার পাশে গিয়ে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। পারমিতা সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। নীরবতা ভেঙে প্রণয় বলল,
“আপনার কী খারাপ লাগছে পারমিতা?”
পারমিতা চোখ তুলে তাকাল। বুক ভরে দম নিয়ে ম্লান কণ্ঠে বলল,
“একটা মেয়েকে তার শেকড় থেকেই উপড়ে ফেলা হয়েছে। মেয়েটার মা মারা গেছে। মেয়েটাকে কেউ জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। এতবড় দেশ। অথচ এই দেশে মেয়েটার আপন বলতে আর কেউ নেই। ভাবতে পারেন? মেয়েটার কেমন লাগছে? আমার বুকের ভেতর জ্বলে যাচ্ছে। এত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না।”
প্রণয় ইতস্তত করে বলল,
“আপনার হাজবেন্ড আপনার খোঁজ-খবর নেয় না পারমিতা?”
পারমিতার চোখদুটো জ্বলে উঠল খুব অল্প সময়ের জন্য। প্রণয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“এক্স হাজবেন্ড।”
“আপনাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল কেন? সরি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেললাম।”
পারু ধীর কণ্ঠে বলল,
“শুরু থেকে বলি?”
“বলুন পারমিতা।”
“সে অনেক কথা কিন্তু। ধৈর্য হারা হবেন না তো?”
প্রণয় দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“না।”

পারমিতা বলতে শুরু করলো।

তখন আমার বয়স সতেরো বছর। শীতের ভোরে, নরম তুলতুলে বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে বেশ লাগে। মা শত ডাকাডাকি করলেও ওম ছেড়ে একদম উঠতে ইচ্ছে করে না। উপায় নেই। উঠতে হবে। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে, মাথায় ঝুঁটি বেঁধে, গায়ে একটা সুন্দর ফুল তোলা চাদর জড়িয়ে প্রাইভেট পড়তে যেতে হবে।
“পারু.. উঠ? আটটা বাজতে চলল!”
না..আর শুয়ে থাকা গেল না। সেই তখন থেকে মা ডেকেই চলেছে। আজ প্রাইভেটের পড়াটাও মুখস্থ হয়নি। নিশ্চয়ই স্যার আজও কান ধরে পারুকে দাঁড় করিয়ে রাখবে। রাতে কষ্ট করে পড়াটা মুখস্থ করে রাখলে এই চিন্তাটা করা লাগতো না। পারু আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। জানালা খুলে দিতেই শীত যেন জাঁকিয়ে ধরল পারুকে। গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। জানালায় উঁকি দিয়ে দেখল, সাদা সাদা কুয়াশায় চারপাশ ঢাকা। দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঘরের টিনের চাল বেয়ে কুয়াশার বিন্দু বিন্দু জল টপটপিয়ে পরছে। নাম না জানা কতগুলো পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। জামার ভেতরে লুকিয়ে রাখা ফোনটা ভাইব্রেট করছে। সম্ভবত অনিরুদ্ধদা ফোন দিয়েছে। পারু লেপটা গা থেকে সরিয়ে আস্তে করে বিছানা থেকে ওঠে গেল। রান্নাঘর পেরিয়ে বাথরুমে যেতে হয়। পারু বাথরুমে যেতে যেতে দেখল, ঠাম্মি রান্নাঘরে বসে একমনে সুপারি কাটছে। সামনে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ আর বাটিতে মুড়ি রাখা। সুপারি কাটার ফাঁকে ফাঁকে ঠাম্মি চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে খাচ্ছে। পারুও চায়ে মুড়ি, বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খুব পছন্দ করে।

পারু বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জলের ছিটা দিলো। তারপর গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছে জলের কল ছেড়ে দিয়ে, ফোনটা খুব সাবধানে জামার ভেতর থেকে বের করল। রিসিভ করে কানে চেপে ধরতেই অনিরুদ্ধর জাদুকরী কণ্ঠ ভেসে এলো।
“কী করছো জানপাখি? এত দেরি হলো কেন ফোন ধরতে? আমি খুব মিস করছিলাম তোমাকে।”
ইস, মানুষটা কী আকুল হয়ে পারুকে ”জানপাখি” বলে ডাকে। অনিরুদ্ধর কণ্ঠ শুনলে পারুর বুকের ভেতর নিঃশব্দে কাঁপন ধরে যায়। সারা গা হেমন্তের ধান পাতার মতো তিরতির করে কাঁপে। পারু ফিসফিস করে লুকোচুরি কণ্ঠে বলল,
“আমি বাথরুমে। তুমি এত ভোরে ফোন দিয়েছো কেন?”
“তোমার সাথে কথা না বললে আমার ভালো লাগে না পারু। তুমি প্রাইভেট পড়তে কখন যাবা?”
“একটু পরে।”
“আমি অপেক্ষায় থাকব।”

পারু ঘরে গিয়ে সব থেকে সুন্দর জামাটা পরলো। কোমর ছুঁই ছুঁই কুঁকড়ানো চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধল। টানা টানা দুচোখে মোটা করে কাজল পরল। কপালের মাঝখানে ছোট্ট একটা কালো টিপ পরে, শুষ্ক ঠোঁটে মেরিল লাগালো। পারুর মা আলোকপর্ণা দেবী খাবারের থালাটা পারুর মুখের সামনে ধরতেই বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল পারু। বলল,
“উফ, মা কতবার বলেছি না? এত সকালে কিছু খেতে ইচ্ছে করে না।”
“আজ ভাত করিনি। রুটি করেছি। একটা রুটি খেলে কিছুই হবে না। বলতে বলতে রুটি ছিঁড়ে রসের গুঁড়ে ভিজিয়ে পারুর মুখে গুঁজে দিল মা। পারু রুটি চিবুতে চিবুতে বইখাতা গোছাতে লাগল। কোনমতে অর্ধেক রুটি জল দিয়ে গিলে খেয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেল পারু।
সাদা কুয়াশায় তখনো পুরো রাস্তা ঢাকা। আজ শীতটা একটু বেশিই পরেছে। গায়ের চাদরেও শীত মানছে না। পারু যেতে যেতে তমালিকা পিসিকে হাঁক ছেড়ে ডাকল। তমালিকা পিসি পারুর বড় জেঠুর বড়ছেলের মেয়ে। পারুর এক বছরের বড়। পারু এবার ক্লাস টেনে পড়ে। তমালিকা পিসিও পড়ে ক্লাস টেনে। দুইজন একসাথেই স্কুলে যাওয়া-আসা করে। দুজন থাকেও সারাক্ষণ গলায় গলায়।
তমালিকার ঠান্ডা লেগেছে। গলা ভেঙে বসে গেছে। কথা বলতে পারছে না। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। তমালিকার মা অর্পা বউদি পারুকে দেখে বলল,
“তমার ঠান্ডা লেগেছে। আজ পড়তে যাবে না।”
“আচ্ছা বউদি।”
পারু একা একাই চলে গেল। মাকে যদি বলতো, তমালিকা পিসি আজ যাবে না। মা নিশ্চিত দাদাকে সাথে পাঠিয়ে দিতো। দাদা সাথে গেলে অনিরুদ্ধদার সাথে দেখা করতে পারতো না। ফলে মানুষটা খুব কষ্ট পেতো। রাগ করতো। পারুর সাথে দুদিন কথা বলতো না। মানুষটা কোনো কারণে পারুর সাথে কথা না বললে, পারু অস্থির হয়ে যায়। পারুর কিছুই ভাল লাগে না। সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। পুরো পাগল পাগল হয়ে যায় পারু। ইঁচড়েপাকা বয়সের প্রেমগুলো বোধহয় এমনই উত্তাল হয়। কিংবা এর পেছনেও অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। কারণ যাই হোক! পারু অনিরুদ্ধকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। অনিরুদ্ধ দিনকে রাত বললে পারু বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেয়। ওই মানুষটা যা বলে, তাই সঠিক মনে হয়।

“পারু..?”
পারু দুচোখ বুঁজে ফেলল। বুক ধুকপুক করছে। অনিরুদ্ধ আশেপাশে সর্তক দৃষ্টি বুলিয়ে পারুকে চট করে টেনে ধরে দোকানের ভেতরে নিয়ে গেল।

(চলবে)