বেলাশেষে পর্ব-০৮

0
32

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৮

খুব বেশিদূর যেতে হলো না পরাগকে। অর্ধেক পথ গিয়েই পারমিতাকে পেয়ে গেল। পারমিতা অনিরুদ্ধর বাইকের পেছনে বসে ছিল। বোনের এত অধঃপতন দেখে রাগে, দুঃখে পরাগের গা জ্বলে গেল। অনিরুদ্ধ পরাগকে সাইড কাটিয়ে চলে আসত চাইল। পরাগের জন্য পারল না। জোরে ব্রেক কোষে বাইক থামিয়ে ফেলল। পরাগ রাগে কাঁপতে কাঁপতে অনিরুদ্ধর বাইক থেকে পারমিতাকে টেনে নামাল। তারপর ঠাস ঠাস করে গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। বোনের চুলের মুঠি ধরে বলল,
“বড্ড সাহস বেড়ে গেছে তোর তাই না? কাউকে কিছু না বলে কয়ে এই ছেলেটার সাথে কোথায় গিয়েছিলি তুই বল আমাকে? যদি তোর কোনো বিপদ হতো! তখন কে দেখতো তোকে?”
অনিরুদ্ধ বলল,
“ওকে ছাড়ুন।”
“চুপ শুয়োরের বাচ্চা। আর একটা কথা বললে জানে মেরে দেব তোকে। কোন সাহসে তুই আমার বোনকে নিয়ে গিয়েছিলি। বল কোন সাহসে?” পরাগ কথাগুলো বলতে বলতে পারমিতাকে ছেড়ে অনিরুদ্ধর শার্টের কলার চেপে ধরল। তারপর ধুমধাম কিল ঘুষি বসিয়ে দিল অনিরুদ্ধর বুকে, পেটে। পারমিতা কাঁদতে কাঁদতে পেছন থেকে পরাগকে দুইহাতে টেনে ধরল। পরাগ বহুকষ্টে রাগ কন্ট্রোল করে অনিরুদ্ধকে ছেড়ে দিয়ে পারমিতাকে নিয়ে গেল।

পারমিতা ভয়ে, লজ্জায় তখনো গুন গুন করে কাঁদছে। পরাগ পারমিতাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল,
“কতদিন ধরে চলছে?”
“(নিশ্চুপ।)”
“কথা বল পারমিতা।”
“(নিশ্চুপ।)”
পরাগ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পারমিতার সামনে বসল। বলল,
“ছেলেটা ভালো না। মেয়েলি কেসে ফেঁসে নিজের এলাকা থেকে জান বাঁচাতে পালিয়ে এসেছে। বোনের বাড়ি এসে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। শুধু তাই না। এক নম্বরের নেশাখোর। তুই যে ওর সাথে অতদূর চলে গেলি। ও তো আজ তোর বড়ো কোনো ক্ষতিও করতে পারত। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোর বয়স কম। ভুল করেছিস। যা হওয়ার হয়ে গেছে৷ এখন এই মুহূর্ত থেকে ভুলে যা ছেলেটাকে। আমি যেন আর কোনোদিনও ওর সাথে কথা বলতে না দেখি বা কিছু না শুনি। মা.. মা কোথায় তুমি?”
পরাগ মাকে ডাকতেই মা সামনে এসে দাঁড়াল। ভীতু কণ্ঠে বলল,
“কি হয়েছে?”
“দিনকাল ভালো না। সারাদিন সংসারের কাজকর্ম আর সিরিয়াল নিয়ে পড়ে না থেকে মেয়ের দিকেও একটু নজর দিও।”
পারমিতা দাদাকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আর কোনোদিনও অনিরুদ্ধর সাথে কথা বলবে না।”

অথচ রাতভর অনিরুদ্ধর সাথে মেসেজে প্রেমালাপ করল পারমিতা। এমনকি গভীর রাতে অনিরুদ্ধ পারমিতাকে দেখতে এলো। দুজন জানালার দুইপাশ থেকে দুজনকে মন ভরে দেখল, ফিসফিস করে গল্প করল। ভালোবাসা কিংবা প্রেমের তীব্র মোহে আটকে আছে পারমিতা। এই নিষিদ্ধ প্রেমের অনুভূতির কাছে জাগতিক সমস্ত কিছু তুচ্ছ মনে হয়। অনিরুদ্ধ যখন প্রথম প্রেম নিবেদন করল তখন সাথে সাথেই রাজি হয়ে যায়নি পারমিতা। পাক্কা দুইমাস অনিরুদ্ধকে নিজের পিছে পিছে ঘুরিয়েছে পারমিতা। অনিরুদ্ধর জেদি, পাগলাটে ভালোবাসার কাছে একসময় হার মেনে নিল পারমিতা। প্রথমবার মা যখন জানতে পারল। মা খুব অস্থির হয়ে গেল। পারমিতাকে কত ভাবে বুঝাল মা। দাদা-বাবা জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাতেও বিশেষ কোনো লাভ হলো না। পারমিতা তার সিদ্ধান্তে অনড়। তাতেও যখন কোনো কাজ হলো না। মা বলল, পরাগকে বলে দেবে। মায়ের ফাঁকা বুলিতে একটুও দমে গেল না পারমিতা। উল্টো মাকেই ভয় দেখাল। অনিরুদ্ধর কথা যদি ভুলেও বাবা কিংবা দাদা জানতে পারে তাহলে কুয়োতে ঝাঁপ দেবে পারমিতা। আলোকপর্ণা দেবী ভয় পেল প্রচুর। বড়ো আদরের একমাত্র মেয়ে তার। ছোটোবেলা থেকে বেশি আদরে আহ্লাদে মানুষ হয়েছে দেখে জেদটাও প্রচুর। যদি সত্যি সত্যিই কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসে। সেই ভয়ে মেয়েকে এক প্রকার নীরব সম্মতি দিল। তারপর আস্তে আস্তে ওনার কি হলো কে জানে! অনিরুদ্ধকে মন থেকেই মেনে নিল।

দুটোদিন পরাগের নজরবন্দি হয়ে রইল পারমিতা। এই দুটোদিন সাবধানেই থেকেছে। তারপর আবার আগের মতোই স্কুল ফাঁকি দিয়ে অনিরুদ্ধর সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতে লাগল। আরেকদিন দুজনকে হাতে নাতে ধরে ফেলল পরাগ। সেদিন পারমিতাকে ইচ্ছেমতো মারল। মুখে যা আসল তাই বলে বোনকে গালাগালি দিল। এমনকি পারমিতার বাবাও ঘটনাটা জেনে গেল। মেয়ের ব্যাপার নিয়ে স্ত্রীর সাথে প্রচণ্ড রাগারাগি করল। বাড়িতে এই নিয়ে বিরাট অশান্তি শুরু হলো। অনিরুদ্ধর জামাইবাবুর কাছে এই নিয়ে নালিশ দিয়েছিল পারমিতার বাবা। অনিরুদ্ধর জামাইবাবু কড়া কণ্ঠে বলে দিয়েছে। “ আগে ঘর ঠিক করেন। পরে পরের ছেলেকে বলতে আসবেন। আপনার বউ, মেয়ে, অনিরুদ্ধকে নিজেদের ঘরে ডেকে নিয়ে গেছে। ঘন্টার পর ঘণ্টা একসাথে বসে গল্প করেছে। তখন আপনার জাত যায়নি। এখন কেন আমাকে বলতে এসেছেন।”

এই কথা শোনার পর পরাগ ক্ষেপে গেল।
পারমিতাকে আর একা একা কোথাও ছাড়ত না। পরাগই নিয়ম করে স্কুলে দিয়ে আসত নিয়ে আসত। একদিন রাতে পারমিতার সাথে অনিরুদ্ধ দেখা করতে এলো। দুজন পেছনের বাগানে দেখা করছিল। এই খবর পরাগ যেন কীভাবে জানতে পারল। ও দোকানে ছিল। ওই ভাবেই বাইক টান দিয়ে ছুটে এলো। দাদাকে দেখে পারমিতা ভয়ে এক দৌড়ে ঘরে চলে গেল। অনিরুদ্ধকে ইচ্ছেমতো পিটালো পরাগ। তার একটু পরে দুই চারজন বাইক নিয়ে এসে পরাগকে মেরে রেখে গেল। মার খেয়ে হাসপাতালে তিন দিন ভর্তি ছিল পরাগ। পারমিতার কাছে যে মোবাইল আছে জানতে পেরে পরাগ ফোনটা জোর করে নিয়ে ভেঙে ফেলল। এমনকি অনিরুদ্ধর সাথে যেন কোনো ভাবেই যোগাযোগ না করতে পারে তারজন্য বাড়িতে কোনো ফোন রাখত না।
কত ঝগড়া, কত অশান্তি, করেও পারমিতাকে কিছুতেই আটকে রাখা সম্ভব হলো না। মাইর খেয়ে, দিব্যি খেয়েও শিক্ষা হলো না পারমিতার। সেই ঘুরেফিরে অনিরুদ্ধর সাথে ঠিকই গোপনে যোগাযোগ রাখে।
পারমিতার মাধ্যেমিক পরীক্ষার পর, কোনো উপায় না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। অনেক হয়েছে পড়াশোনা। আর পড়ানোর দরকার নেই। ভালো পাত্র দেখে পারমিতাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। বিয়ের কথা শুনে পারমিতা খাওয়া, ঘুম বন্ধ করে দিল। অনিরুদ্ধ যে খারাপ ছেলে একের পর এক প্রমাণ দিয়েও বিশেষ কোনো লাভ হলো না। পারমিতার ঘুরেফিরে একটাই কথা বিয়ে করলে অনিরুদ্ধকেই করবে।

ছেলে দেখতে আসার একদিন আগে, অনিরুদ্ধর হাত ধরে পালিয়ে গেল পারমিতা। সারা এলাকা চষে ফেলল। কোথাও পারমিতাকে পাওয়া গেল না। এদিকে অনিরুদ্ধও নাকি কোথাও নেই। কারো আর বুঝতে বাকি রইল না পারমিতা কার সাথে চলে গেছে। পারমিতার বাবা একমাত্র মেয়ের জন্য বুক চাপকে হাউমাউ করে কাঁদল। আলোকপর্ণা দেবীও খুব কাঁদছে। মেয়েটা যে এভাবে চলে যাবে। তিনি বুঝতেই পারেননি। কিংবা বুঝতে পেরেছিলেন। কাউকে কিছু বলেননি।

(চলবে)