#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১০
তিনমাস পর অনিরুদ্ধ রিহ্যাব থেকে ছাড়া পেল। এই তিনমাসে প্রায়ই অনিরুদ্ধর জন্য মাকে দিয়ে ভালো-মন্দ রান্না করে, অনিরুদ্ধর দাদাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতো পারমিতা। অনিরুদ্ধ রিহ্যাবে থাকাকালীন কারো সাথে অনিরুদ্ধকে দেখা করতে দেয়নি। তবে কেউ দেখতে চাইলে, সিসিটিভির ফুটেজে অনিরুদ্ধকে দেখতে পারতো। ও কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে। তবে সরাসরি দেখা করার সুযোগ হয়নি।
অনিরুদ্ধ ঘরে এসে দেখল, পারমিতা খাটে পা দুলিয়ে চুপটি করে বসে আছে৷ চোখদুটো ভেজা। অনিরুদ্ধ ছুটে গিয়ে পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। পারমিতার মাথায়, কপালে অজস্র চুমু এঁকে দিয়ে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আর কখনো আসবে না। আমি.. আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না৷ তুমি আমাকে ছেড়ে যাওনি পারমিতা৷”
এতগুলো দিন পর অনিরুদ্ধকে এত কাছে পেয়ে, অনিরুদ্ধর উষ্ণ স্পর্শ গায়ে মেখে পারমিতার কান্নার স্রোত বেড়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
“তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য তো তোমার হাত ধরিনি।”
কয়েকদিন অনিরুদ্ধর সাথে বেশ কাটলো। মনে হলো; অনিরুদ্ধ সত্যি সত্যিই ভালো হয়ে গেছে। তার কিছুদিন পরেই পারমিতার ভুল ধারণা ভেঙে গেল। আবারও তুচ্ছ কারণে ঝগড়া বাঁধিয়ে পারমিতার গায়ে নিয়মিত হাত তুলতে লাগল অনিরুদ্ধ। প্রায়ই আগের মতো রাত করে নেশা করে বাড়ি ফিরে। কোনো কোনো রাত তো বাড়িও ফিরে না। কত ঝগড়া, কত অশান্তি। কতবার অনিরুদ্ধর সংসার ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছে পারমিতা। দিনশেষে অনিরুদ্ধর পাগলামির কাছে হার মেনে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছে৷ কতবার বাবার বাড়ি চলেও গেছে পারমিতা। দুই/তিনদিন পর অনিরুদ্ধ পারমিতার হাতেপায়ে ধরে, দেয়ালে মাথা ঠুকে, মেয়েদের মতো হাউমাউ করে কান্না করে পারমিতাকে নিজের সংসারে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে অনিরুদ্ধ। তুচ্ছ কারণ নিয়ে ঝগড়া লাগলেও অনিরুদ্ধ এমন এমন জায়গায় মারে পারমিতাকে। লজ্জায় কাউকে দেখাতেও পারে না পারমিতা। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মারের কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। পারমিতার বাবা, দাদা কত ভাবে মেয়েকে বোঝায়। অনিরুদ্ধর সংসার ছেড়ে চলে আসতে। এতোকিছুর পরও কীসের টানে বার বার ছুটে যায় পারমিতা কে জানে! একবার অনিরুদ্ধর পিসাতো বোন ইন্ডিয়া থেকে অনিরুদ্ধদের বাড়ি বেড়াতে এলো। তখন অনিরুদ্ধ বাড়িতে থাকে না। তবে পারমিতা শাশুড়ির সাথে বাড়িতেই থাকে। মেয়েটার নাম প্রিয়া। মেয়েটা রাতে পারমিতার সাথেই ঘুমাতো। একদিন বাড়ি এসে, পারমিতার সাথে প্রিয়াকে ক্লোজ হয়ে বসে হাসাহাসি করতে দেখে, অনিরুদ্ধ সন্দেহ করল। সেদিন রাতে দুজনের বেশ কথা-কাটাকাটি হলো। প্রিয়া কিছুদিন বেড়িয়ে ইন্ডিয়া চলে যেতেই বড়ো ধরনের অশান্তি লেগে গেল বাড়িতে। অনিরুদ্ধ পারমিতার মাকে ফোন দিয়ে যা-তা বলল। প্রিয়ার সাথে নাকি পারমিতার অবৈধ সম্পর্ক হয়েছে। আরও কতকিছু বলে অপমান করল। এ-ও বলল,
“প্রিয়া মেয়েটা বেশি ভালো না। আগেও অনেক মেয়ের সংসার ভেঙেছে।”
আলোকপর্ণা দেবী আর চুপ থাকতে পারল না। বলল,
“ওরা দুজনই তো মেয়ে। ওরা আর কি করবে। তোমার মাথা ঠিক নেই অনি।”
অনিরুদ্ধ ভয়ংকর রেগে গেল। বলল,
“আপনাকে আর কি বলব, তা-ও বলি, মেয়ে তো কি হয়েছে। হাত আর পা থাকলে সব হয়।”
আলোকপর্ণা দেবীর গা গুলিয়ে উঠল। বলল,
“তোমার বোন ভালো না৷ তুমি তো আগে থেকেই জানো, জেনেও কেন ওদের একসাথে থাকতে দিয়েছ?”
এই প্রশ্নের উত্তর অনিরুদ্ধ দিতে পারল না।
অনিরুদ্ধর বোন এসে পারমিতাকে মুখে যা এলো তাই বলল। এ-ও বলল,
“তোমাদের শরীরে এত ঝাল। দুজনকেই নটি পাড়ায় রেখে আসব। সব ঝাল মিটে যাবে।”
পারমিতা কেঁদে ফেলল। অনিরুদ্ধ প্রায়ই রাত জেগে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে চ্যাট করে, কথা বলে। মেয়েদের সাথে দেখা করতে পর্যন্ত চলে যায়। এই দৃশ্য হাতেনাতে ধরে ফেলেছে পারমিতা৷ শুধুমাত্র নিজের দোষ ঢাকতে আজ এতবড়ো নোংরা একটা অপবাদ দিল অনিরুদ্ধ পারমিতাকে। এবং এ-ও বলল,
“পারমিতার সাথে সে আর সংসার করবে না। এসব মেয়েদের সাথে টাকা উড়িয়ে ফূর্তি করা যায়। সংসার করা যায় না।”
পারমিতার দাদা এসে পারমিতাকে নিয়ে গেল। বাবার বাড়িতে গিয়ে অনিরুদ্ধর সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিল পারমিতা। অনিরুদ্ধও আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করতো না। ধীরে ধীরে মানসিক ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠল পারমিতা। বাবা-দাদাকে ওদের দুজনের ছাড়াছাড়ি করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলল। এ-ও বলল, ও অনিরুদ্ধর নামে নারী নির্যাতনের কেস দেবে।
পরাগের উৎসাহে অনিরুদ্ধর নামে কেস ফাইল করা হলো। যেহেতু পারমিতার আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার পর ওদের কোর্টের মাধ্যেমে বিয়ে হয়েছিল। কোর্টের মাধ্যমে ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করতে বলল। পারমিতার বাবা পারমিতাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করল। সত্যিই কি ডিভোর্স দিতে চাও? নাকি জেদ থেকে এমন করছ? এখনো সময় আছে পারমিতা। ডিভোর্সের ব্যাপারে আর একটু ভেবে দেখলে হতো না?”
পারমিতা কারো কোনো কথা শুনলো না। সে কেসও দিল। ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই ও করল। তারপর পারমিতার কি হলো কে জানে! তার কিছুদিন পরে, কাউকে কিছু না বলে, একরাতে চুপি চুপি আবারও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। সে রাতে অনেক খুঁজেও পারমিতাকে কোথাও পাওয়া গেল না। পরের দিন জানা গেল। পারমিতা অনিরুদ্ধর সাথে চলে গেল। নারী নির্যাতনের কেস উঠিয়ে নিয়েছে। আর ডিভোর্সও দেবে না। অথচ পারমিতা চলে আসার পর বেশ কয়েকবার অনিরুদ্ধর দাদা, জামাইবাবু পারমিতাকে নিয়ে যেতে এসেছিল। তাদের কারো সাথেই পারমিতা যায়নি। হঠাৎ কি এমন হলো; অনিরুদ্ধর সাথে পালিয়ে গেল পারমিতা। তবে কি নিজের বশে রাখার জন্য আবারও পারমিতাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক করা হলো? জাদুর প্রভাবেই কি পারমিতা উভ্রান্তের মতো ছুটে গেল?
পারমিতার এই কাণ্ডে এলাকার মানুষ খুব ছিঃ..ছিঃ..করছে৷ নিজে থেকে বরকে ডিভোর্স দিতে চেয়ে, বরের নামে নারী নির্যাতনের মামলা করে আবারও কেন সেই বরের সংসারেই ফিরে গেল। সমাজে একটা নিয়ম আছে। পারমিতাকে দেখে বাকি আর পাঁচটা মেয়ে কি শিখবে। হয় সমাজ ত্যাগ করতে হবে নাহয় মেয়েকে ত্যাগ করতে হবে।
বুকে পাথর চেপে পারমিতাকেই ত্যাগ করল বাবা। একমাত্র মেয়ের শোকে আলোকপর্ণা দেবী দিন রাত কাঁদে। বোনের সাথে জেদ করে পরাগ সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আলোকপর্ণা দেবীর কাছ থেকেও ফোন নিয়ে নিয়েছে। যেন তিনিও কোনোভাবেই পারমিতার সাথে যোগাযোগ না করতে পারে।
পারমিতা গভীর ঘুমে কাঁদা৷ পাশে শুয়ে শুয়ে অনিরুদ্ধ ফোনে তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে নিচু শব্দে এডাল্ট কথা বলছে৷ পারমিতাকে কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ খাওয়ানা হয়েছে৷ এই ঘুম সহজে ভাঙবে না। পারমিতা নারী নির্যাতনের কেস দেওয়ার পর, অনেকগুলো দিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে অনিরুদ্ধকে। অনেক ভাবে পারমিতাকে বোঝানো হয়েছে৷ কিছুতেই ঘাড়ত্যাড়া জেদি মেয়েটা বুঝ মানছিল না। তার জন্যই তো পুরোনো কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে অনিরুদ্ধকে। টাকা একটু বেশি লাগলেও পারমিতা যে আবারও পাগল পাগল হয়ে অনিরুদ্ধর জীবনে ফিরে এসেছে। এই তো অনেক৷ তাছাড়া অনেক মেয়ের সাথেই প্রেমের পর শারীরিক সম্পর্ক করেছে অনিরুদ্ধ। কাউকে এতটা মনে ধরেনি। পারমিতার প্রতি অন্যরকম দূর্বলতা ছিল। কারণ অনিরুদ্ধই পারমিতার জীবনের প্রথম পুরুষ। কুয়াকাটায় পারমিতার সাথে প্রথম রাত কাটাতে গিয়ে বেশ বুঝেছে অনিরুদ্ধ। ভেবেছিল, পারমিতার বাবার অবস্থা ভালো। একটা মাত্র মেয়ে যেহেতু। নিশ্চয়ই বিয়ের পরে দুইহাত ভরে মেয়েকে দেবে। কিন্তু হলো তার উল্টোটা শালা..কিছুই দিল না। উহুঁ..কিছুই দিল না বলা ভুল হলো: অনিরুদ্ধকে স্বর্ণের চেইন দিয়েছে, আংটি দিয়েছে৷ পারমিতাকে স্বর্ণের চেইন, হাতে বালা, আংটি, কানের দুল দিয়েছে। সব মিলিয়ে তিন ভরির মতো স্বর্ণ দিয়েছে। যদিও অনিরুদ্ধর চেইন বিক্রি করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে নেশাদ্রব্য কেনার টাকা না থাকলে অস্থির হয়ে যায় অনিরুদ্ধ। কি রেখে কি বিক্রি করে তৃষ্ণা মেটাবে বুঝতে পারে না। তবে পারমিতার বাড়ি থেকে আরও অনেককিছু দেওয়া উচিত ছিল৷ অঢেল থাকা সত্বেও কেন যে দেয় না বুঝতে পারে না অনিরুদ্ধ। একদিন ঝগড়া লাগার পর পারমিতা অবশ্য বলেছিল, তোর মতো নেশাখোরকে আমার বাবা একটা পয়সাও দেবে না। তোকে না দিয়ে আমার ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখবে বাবা। তোকে দিয়ে তোর স্বভাব খারাপ করবে না।”
অনিরুদ্ধ ফোনে কথা বলা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
এভাবে পারমিতাকে কতদিন বশ মানিয়ে নিজের কাছে রাখতে পারবে তার কোনো ঠিক নেই। ইদানীং কি যে হয়েছে অনিরুদ্ধর। পারমিতা ভালো কথা বললেও অনিরুদ্ধর গায়ে সয় না। অসহ্য লাগে পারমিতাকে। তবুও কিছু করার নেই। কেস উঠিয়ে নিয়ে, পারমিতার পরিবার থেকে পারমিতাকে আলাদা করে তারপর রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলবে পারমিতাকে। যেন কোথাও পারমিতার যাওয়ার জায়গা না থাকে। ঘুরে-ফিরে আবারও অনিরুদ্ধর কাছেই ছুটে আসতে হয়।
(চলবে)