#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১১
মাঝে মাঝে অনিরুদ্ধ পারমিতার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করে। আবার মাঝে মাঝে এত খারাপ ব্যবহার করে। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। পারমিতা ভেবে পায় না। ও কীসের টানে ছুটে এসেছে অনিরুদ্ধর কাছে। এই বাড়িতে আসার পরে, শাশুড়িমা কিছুদিন ভালো ব্যবহার করলেও এখন উঠতে বসতে কটুকথা শোনায় পারমিতাকে। পারমিতার বড়োজাও সারাক্ষণ পারমিতার নামে শাশুড়ির কান ভাঙানি দেয়। বেশ বুঝতে পারে পারমিতা। ওনাদের বউ – শাশুড়ির কূটচাল সহ্য করতে না পারলে অনিরুদ্ধকে বলে দেয় পারমিতা। অনিরুদ্ধ ওদের কিছু না বলে পারমিতাকেই বকা বাজি করে। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে পারমিতার গায়ে হাত তুলে অনিরুদ্ধ। এমন বিভীষিকাময় জীবন তো কখনো চায়নি পারমিতা। চেয়েছিল সুন্দর সাজানো গোছানো একটা জীবন। যে জীবনে সুখ থাকবে চিরস্থায়ী আর দুঃখ থাকবে ক্ষণস্থায়ী। অথচ হলো তার উল্টোটা। সেদিন বাবার বাড়ি থেকে চলে আসার পরে, বাড়িতে আর কারো সাথে কথা হয়নি। মাকে খুব মনে পড়ে। মায়ের নম্বরে ফোন দিলেও ফোন বন্ধ দেখায়। পারমিতা কতভাবে বাড়িতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারে না। সেদিন যে কাণ্ড ঘটিয়েছে বাড়িতে যে যাবে তারও উপায় নেই। কোন মুখে যাবে। সবাই তো পারমিতার থেকে মুখ ফুরিয়ে নিয়েছে। ইদানীং অনিরুদ্ধও খুব খারাপ ব্যবহার করে। পারমিতার প্রচুর জেদ চেপে যায়। এদের কাউকে সহ্য হয় না। অনিরুদ্ধ খুব সন্দেহবাজ একটা মানুষ। সন্দেহের বশে প্রায়ই পারমিতার সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে নেয়। তারপর গায়ে হাত তুলে। তুমুল মারধর করে। পারমিতা মার খেয়ে কৈ মাছের মতো কাতরাতে কাতরাতে বলে, “তুই নিজে খারাপ। তাই সবাইকেই তোর মতো খারাপ ভাবিস। আগে নিজে ভালো হ। নাহলে মিথ্যা অপবাদ আর সহ্য করব না। আমি সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে দেখাব তোকে। তোর মতো জামাইয়ের আমার দরকার নেই। কাপুরষ একটা।”
অনিরুদ্ধ পারমিতার টুঁটি শক্ত হাতে চেপে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“এতই যখন খারাপ আমি। আমার কাছে এসেছিস কেন?”
কেন যে পারমিতা অনিরুদ্ধর কাছে এসেছে। তাই তো ভেবে পায় না পারমিতা। আপনমনে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মাথা ব্যথা হয়ে যায়। ইদানীং রাতে এত ঘুম বেড়ে গেছে পারমিতার। ঘুমের জন্য সকালে উঠতে পারে না। তারজন্যও শাশুড়িমা খুব খারাপ ব্যবহার করে। বিয়ের আগেও ঘুম থেকে খুব ভোরে উঠার অভ্যাস ছিল পারমিতার। বিয়ের পর পরও ভোরেই উঠতো। কিন্তু শত চেষ্টা করেও এখন আর ভোরে উঠতে পারে না। মাথার ভেতরে কেমন যেন লাগে।
একদিন একটু জ্বর জ্বর লাগায় রাতে কিছুই খেলো না পারমিতা। মধ্যরাতে কারো কথার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাশে অনিরুদ্ধ শুয়ে শুয়ে কার সাথে যেন নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে ফোনে কথা বলছে। পারমিতা কান পেতে শোনার চেষ্টা করল কি বলছে অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধ কোনো এক মেয়ের সাথে গাঢ় কণ্ঠে এডাল্ট কথা বলছে। নিঃশ্বাসের শব্দ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। কথাগুলো শুনে পারমিতার কী ভয়ংকর অনুভূতি হলো। ইশ, এই বিদঘুটে অনুভূতির কথা যদি কাউকে বলে বোঝাতে পারত। ছিঃ..অনিরুদ্ধ তাহলে এখনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু পারমিতার সামনে মুখোশ পড়ে থাকে। পারমিতার কানদুটো গরম হয়ে উঠল। গা গুলিয়ে গলায় বমি এসে ঠেকল। এত কিছুর পরও এত বড়ো ধোঁকা, প্রতারণা মেনে নিতে পারল না পারমিতা। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। পারমিতার কান্নার শব্দে চমকে উঠল অনিরুদ্ধ। ফোনটা হাত খসে পড়ে গেল। পারমিতা কাঁদতে কাঁদতে উঠে গিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিল। অনিরুদ্ধ ভীতু কণ্ঠে বলল,
“তুমি ঘুমাওনি?”
পারমিতা মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। তারপর উভ্রান্তের মতো ছুটে এসে অনিরুদ্ধর ফোনটা কেড়ে নিয়ে আছড়ে ফেলল ফ্লোরে। অনিরুদ্ধ এক লাফে উঠে দাঁড়াল। যেন ফোন না ওকেই আছড়ে ফেলেছে পারমিতা। পারমিতা অনিরুদ্ধর শার্টের কলার খামচে ধরল। ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“কেন করলি আমার সাথে এত বড়ো প্রতারণা? অন্যকাউকেই যদি তোর ভালো লাগে আমাকে কেন ফিরিয়ে এনেছিস? চুপ করে থাকিস না। উত্তর দে?”
অনিরুদ্ধ কয়েক মুহূর্ত অনূভুতিয়শূণ্য হয়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েক খণ্ড হয়ে পড়ে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। হুঁশ ফিরতেই পারমিতার গায়ে কষিয়ে থাপ্পড় মেরে দিল। রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
“তুই আমার ফোনটা কেন ভাঙলি? তুই আমাকে যা বলার বলতি। কোন সাহসে আমার ফোন ভাঙলি?”
পারমিতা স্তব্ধ হয়ে গেল। এত বড়ো অপরাধ করার পরও অনিরুদ্ধর কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো ফোন ভাঙার অপরাধে পারমিতাকেই মারধর করছে৷ সেই রাতে প্রচুর ঝগড়া হলো দুজনের। ঝগড়ার একপর্যায়ে অনিরুদ্ধ বেদম পিটালো পারমিতাকে। অনিরুদ্ধর ঘুরেফিরে একটাই কথা কেন পারমিতা অনিরুদ্ধর এত দামি ফোনটা ভাঙল। অথচ এই মানুষটা যে পারমিতার মন ভেঙে কয়েক টুকরো করে দিয়েছে। তারজন্য কোনো অনুশোচনা নেই। এই প্রথম মরে যেতে ইচ্ছে করল। কার জন্য বেঁচে থাকবে পারমিতা?
ঝগড়ার একপর্যায়ে পারমিতার শাশুড়িমা ছুটে এলো। ভীতু কণ্ঠে বলল,
“দরজা খুল অনি, কি হয়েছে?”
দরজা খুলে দিতেই পারমিতা শাশুড়িমায়ের হাতখানা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সংক্ষেপে ঘটনা খুলে বলল। শাশুড়ি নামক মানুষটা কোথায় অনিরুদ্ধকে শাসন করবে। তা না করে উল্টো পারমিতাকেই বকাঝকা করল। বলল,
“কোন আক্কেলে তুমি ওর এত দামি ফোনটা ভেঙেছ? পুরুষ মানুষের একটু আধটু দোষ থাকেই। তুমি নিজে ভালো হয়ে চলো।”
“মা..! এতকিছুর পরও কিছু বলবেন না আপনার ছেলেকে?”
“কি বলব। তুমি নিজেও তো ভালো না। ভালো হলে তো আর বাপ-মায়ের মুখে চুনকালি দিয়ে আমার ছেলের হাত ধরে পালিয়ে আসতে পারতে না।”
“ও.. এখন সব দোষ আমার। আপনার ছেলে ধুয়া তুলসীপাতা।”
“গলা নামিয়ে মায়ের সাথে কথা বলো পারমিতা।”
“একদম কথা বলবে না তুমি। আগে যা হওয়ার হয়ে গেছে। বাবার বাড়ি চলে যাওয়ার পরে, কেন আমার হাত-পা ধরে নিয়ে এসেছিস আমাকে তুই?”
অনিরুদ্ধ রেগে গেল। আচমকা পারমিতার গলা চেপে ধরে বলল,
“তুই আমার নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছিস কেন? মিথ্যা মামলা না দিলে তো আর তোকে আনতাম না। আমার সংসার ভালো না লাগলে এখুনি আমার বাড়ি থেকে চলে যা তুই। তোর মতো বউ আমার লাগবে না।”
পারমিতা জোর করে অনিরুদ্ধর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল,
“তুই সহ তোর গুষ্টির সবাইকে এবার আমি জেলের ভাত খাওয়াব জানোয়ার।”
অনিরুদ্ধ ছুটে গিয়ে পারমিতার টুঁটি চেপে ধরল। অতিরিক্ত রাগে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। বলল,
“কেস দেওয়ার জন্য তোকে তো বেঁচে থাকতে হবে। যদি এই পৃথিবীর বুকে বেঁচেই না থাকিস৷ কেস দিবি কীভাবে? মাগি তোর জন্য জেলে যাব না আমি। জেলে যদি যেতেই হয়৷ তোকে মেরে তারপর যাব। মা…রান্নাঘর থেকে বটিটা নিয়ে আসো?”
ছেলের অগ্নিমূর্তি দেখে এই প্রথম পেয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। বলল,
“ছেড়ে দে অনি মরে যাবে তো।”
“মরুক। ওর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। বটিটা নিয়ে আসো মা।”
কোমর থেকে প্যান্টের বেল্ট খুলে ইচ্ছেমতো পারমিতাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলল অনিরুদ্ধ। মা প্রথমে একটু বাঁধা দিচ্ছিল দেখে, মাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা আটকে নিয়ে পিটালো। পারমিতা অতিরিক্ত মার খেয়ে আধমরা হয়ে গেল। রক্তাক্ত শরীর ফ্লোরে লুটিয়ে পড়তেই অনিরুদ্ধর হুঁশ ফিরল। হাঁটু মুড়ে পারমিতার সামনে বসে বলল,
“তুই যখন জেনেই গেছিস। আর লুকোচুরি করব না। এখন থেকে তোর সামনে বিভিন্ন মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলব। দরকাল পড়লে ঘরে এনেও তুলব।”
পারমিতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
পারমিতার অবস্থা বেগতিক দেখে, একজন হাতুড়ি ডাক্তার বাড়িতে আনা হলো; সে ট্রিটমেন্ট করে কিছু ঔষধ লিখে দিল আর বলল,
“অবস্থা খুব সিরিয়াস। যোনিপথ দিয়ে ব্লাড আসছে। যতদ্রুত সম্ভব হাডপাতালে ভর্তি করে দিন।”
অনিরুদ্ধ বুঝতে পারল না। হঠাৎ করে কেন এভাবে ব্লাড আসছে। কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। ভেবেছিল, ডাক্তারের ঔষধ খেয়ে বন্ধ হবে। তা-ও হলো না। সারাটাদিন ওইভাবেই পারমিতাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে বাড়িতে ফেলে রাখল ওরা৷ সন্ধ্যায় সবার টনক নড়ল। ব্লাড পড়া যদি না বন্ধ হয়। পারমিতা তো মারা যাবে। পারমিতাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। টেস্ট করে জানা গেল, পারমিতার পেটে দেড়মাসের বাচ্চা ছিল। নষ্ট হয়ে গেছে। এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ওকে বাঁচাতে হলে কম করে হলেও চার ব্যাগ রক্ত লাগবে।
এতকিছুর পরও পারমিতার বাবার বাড়ির কাউকে খবর দেওয়া হয়নি। ওরা অন্যকারো কাছে পারমিতার গুরুতর অবস্থার কথা জানতে পেরে সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে হাসপাতালে ছুটে এলো। পরাগ ডাক্তারের সাথে কথা বলে রক্তের ব্যবস্থা করে ফেলল। আলোকপর্ণা দেবী অঝরে কাঁদতে লাগলেন। পারমিতার অবস্থা এতটাই গুরুতর হয়ে গেছে। বাঁচাতে চাইলে জরায়ু কেটে বাদ দিতে হবে। কিন্তু অনিরুদ্ধ বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। কিছুতেই জরায়ু কাটতে দেবে না। পরাগ ক্ষেপে গেল। অনিরুদ্ধকে আড়াকে ডেকে নিয়ে চাপা কণ্ঠে শাসালো। ওদের হেয়ালির জন্য আজ যদি পারমিতার কিছু হয়ে যায়। ভগবানের দিব্যি অনিরুদ্ধকে নিজের হাতে খুন করবে পরাগ।
পরাগ যে ফাঁকা বুলি উড়াচ্ছে না। বেশ বুঝতে পারছে অনিরুদ্ধ। অন্তপর ওর কথা মেনে নিতে বাধ্য হলো।
পারমিতার অপারেশন সাকসেসফুলি হয়ে গেল। অনেকগুলো দিন ভুগতে হয়েছে পারমিতাকে। সেই ঘটনার পর আলোকপর্ণা দেবী নিজের সাথে মেয়েকে নিয়ে গেলেন। পরাগ অনেকবার ওদের নামে কেস করতে বলেছে। রাজি হয়নি পারমিতা। শুধু বলেছে। ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে। পারমিতা একটু সুস্থ হতেই ওরা আবারও নাটক করতে চলে এলো। বাড়ির বউকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। অনিরুদ্ধ পারমিতার পা দুটো জড়িয়ে ধরে সেকি মরা কান্না জুড়ে দিল। পারমিতার ননদ বলল,
যা হওয়ার হয়ে গেছে। পারমিতা যেন অনিরুদ্ধকে আর একবার সুযোগ দেয়। এবার সত্যি সত্যিই ভালো হয়ে যাবে অনিরুদ্ধ।
(চলবে)
#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১২
পারমিতা সবার সবকথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। পারমিতাকে এতটা চুপচাপ থাকতে দেখে, সবাই ভেবেই নিল। পারমিতা বোধহয় ওদের সবার কথা মেনে নিয়ে, আরও একবার সুযোগ দেবে অনিরুদ্ধকে। ফিরে যাবে অনিরুদ্ধর সংসারে৷ অনিরুদ্ধ পারমিতার একহাত তখনো মুঠো করে ধরে রেখেছে। পারমিতা অনিরুদ্ধর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টা করল না। অনিরুদ্ধ আরও একটু সাহস পেল। পারমিতার হাতখানা জড়িয়ে ধরে বলল,
“রেডি হও পারু। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন বের হবো।”
পারমিতা ধীর কণ্ঠে বলল,
“কোথায় যাব আমি?”
“কোথায় আবার! তোমার সংসারে ফিরে যাবে।”
পারমিতা তাচ্ছিল্য করে একটুখানি হাসল। ক্লান্ত ঝরা কণ্ঠে বলল,
“আমার সংসার!” আর কত নাটক করবে তোমরা?”
“তুমি আমার অনুভূতিকে নাটক বলতে পারো না পারু। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সাথে সংসার করতে চাই।”
“ভয় নেই। এবার আর আমি তোমার নামে কোনো মামলা দেব না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।”
“এসব কি বলছ তুমি, পারু?”
পারমিতা অনিরুদ্ধর চোখের দিকে শীতল চোখে তাকাল৷ অনিরুদ্ধ চোখদুটো অন্যদিকে সরিয়ে নিল। পারমিতা নিঃশব্দে হেসে ফেলল। বিদ্রুপের হাসি। বলল,
“যার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস নেই। সে নাকি আবার আমাকে ভালোবাসে হুহ্… শোনো অনি, আমি আর কখনো বাচ্চা জন্ম দিতে পারব না। শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি মা হওয়ার ক্ষমতা সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি। শুধু তাই নয়। তুমি আমার বাচ্চার খুনী। নিজের হাতে আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছ তুমি। আমি মা হয়ে কোনোদিনও তোমাকে ক্ষমা করব না। এই যে আমি তোমার সংসারে ফিরে গেলে তুমি যতই খারাপ হয় না কেন! একটা সময় পর, তোমারও বাবা হতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু আমি তোমার ইচ্ছে কোনোদিনও পূরণ করতে পারব না। লোকে দিনশেষে আমাকেই দোষ দেবে। আমাকেই হুল ফুটানো কথা দ্বারা তিলে তিলে শেষ করে দেবে। কেউ কিন্তু জানতে চাইবে না। বাচ্চা না হওয়ার পেছনে আসল দোষ কার৷ আমি নারী। দিনশেষে আমাকেই দোষীর কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করাবে। এখন তো তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে পরকীয়া করো। তখন প্রকাশ্যে পরকীয়া করলেও সবাই আমার দোষ দেবে। আমি বাচ্চা জন্ম দিতে পারব না। তাই তুমি অন্যের কাছে যাও। তোমারও তো বাবা হতে ইচ্ছে করে। বেচারা তোমার কি দোষ। এই সমাজ দিনশেষে আমাকেই দোষী করবে। দিনের পর দিন তোমার অবহেলা সহ্য করতে না পেরে আমি হয়তো জেদের বশে নিজেরই ক্ষতি করে বসব। অনেক ভেবে দেখলাম, জানো তো অনি। তোমার সংসারে ফিরে গেলে শুধু কষ্টই পেতে হবে। এই জীবনে কোনোদিন সুখের মুখ দেখব না। অনেক তো কষ্ট সহ্য করলাম। আর কত! আজ এই মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে মুক্তি করে দিলাম। ভয় পেও না। এবার আর তোমার নামে কেস করব না। আমি ভগবানের কাছে বিচার দিলাম। যে বা যারা আমাকে বিনাদোষে শাস্তি দিয়েছে। তারা যেন তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়৷ খুব শীঘ্রই তোমার কাছে ডিভোর্স নোটিশ পাঠানো হবে। যদি আবারও কেস না খেতে চাও। ভালোই ভালোই সাইন করে দিও। এবার আসতে পারো তোমরা।”
“আমি তোমাকে নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরব পারমিতা।”
পারমিতা নিজের হাতটা অনিরুদ্ধর হাত থেকে আস্তে করে ছাড়িয়ে নিল। হিম শীতল কণ্ঠে বলল,
“আমার সারাশরীরে তোমার দেওয়া মারের চিহ্ন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রিপোর্টেও আছে। এই প্রমাণগুলো নিয়ে থানায় গেলে কি হবে, একবারও ভেবে দেখেছ?”
অনিরুদ্ধ দমে গেল।
অনিরুদ্ধর মা অনেক বুঝিয়েও কোনো বিশেষ লাভ হলো না। ঠাণ্ডা মাথায় সবাইকে পারমিতার বিষাক্ত অতীত মনে করিয়ে দিয়ে অপমান করল পারমিতা।
অগত্যা তারা চলে যেতে বাধ্য হলো। পরাগ সময় নিল না। খুব শীঘ্রই ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে ফেলল। অনিরুদ্ধ সত্যি সত্যিই আপোষে সাইন করে দিল। পারমিতা ভেবেছিল অনিরুদ্ধ বোধহয় সাইন করবে না। আবারও পাগল পাগল হয়ে ছুটে আসবে পারমিতার কাছে। পারমিতাকে ভালোবেসে আপন করে নেবে। কিন্তু হলো তার উল্টোটা৷ অনিরুদ্ধ তো আর এলোই না। ওদের ডিভোর্সের কিছুদিন পরে, অনিরুদ্ধ বিয়ে করে ফেলল। পারমিতা কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল৷ ও বিশ্বাসই করতে পারল না। অনিরুদ্ধ ওকে ভুলে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নেবে৷ যে মেয়েকে অনিরুদ্ধ বিয়ে করেছে। সেই মেয়ের সাথেও নাকি প্রেমের সম্পর্ক করে বিয়ে করেছে৷ তাহলে এতদিন পারমিতার সাথে কি করেছিল? ভালোই যদি না বাসে, কেন মিছিমিছি ভালোবাসার অভিনয় করে পারমিতার সুন্দর জীবনটা নষ্ট করল। শুধু নষ্ট না। পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। পারমিতার এমন অবস্থা করে ছেড়ে দিয়েছে। পারমিতা যদি অনিরুদ্ধর সাথে জেদ করে নতুন করে জীবন শুরুও করে। কোনোদিনও মা হতে পারবে না। ওর জন্য অন্য একটা মানুষের জীবন শুধু শুধু নষ্ট হবে। জেনেশুনে তো এই ভুল জীবনেও করবে না পারমিতা। ঠাকুর কীসের শাস্তি দিচ্ছে পারমিতাকে? এমন বিভীষিকাময় জীবন তো পারমিতা চায়নি। এর থেকে মরে যাওয়াও ঢের ভালো ছিল। সারাদিন, রাত না ঘুমিয়ে, ঠিকমতো না খেয়ে, শুধু বসে বসে এইসব কথা একমনে ভেবে যায় পারমিতা।
হঠাৎ করেই একদিন পারমিতার বাবার মৃত্যু হলো। বাবার অকাল মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারল না পারমিতা। আস্তে আস্তে মানসিক রোগী হয়ে গেল।
কথাগুলো বলে বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল পারমিতা। চোখের জলে সবকিছু ঝাপসা দেখছে। ডাক্তার প্রণয় জলের বোতল পারমিতার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,
“কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে গেছে আপনার। গলাটা ভিজিয়ে নিন পারমিতা।”
পারমিতা জলের বোতল হাতে নিল। ছিপি খুলে ঢকঢক করে অর্ধেক বোতল জল খেলো। জল গলায় ঠেকে কেশে উঠল পারমিতা। ডাক্তার প্রণয় পারমিতার মাথায় হাত রাখল। বলল,
“মন খারাপ করবেন না পারমিতা। আপনার ভাগ্যে সংসার ছিল না। তাই হয়তো সংসার হয়নি। এর পেছনেও ভালো একটা কারণ থাকতে পারে জানেন! হয়তো অদূর ভবিষ্যতে চমৎকার কিছু আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। যা আপনি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেননি।”
পারমিতা চোখের জল মুছে বলল,
“আমার ভাগ্য খুব খারাপ। নাহলে আমার বাবা-মা কেন মারা যাবে। আমার দাদাই বা কেন সম্পত্তির ভাগ দেওয়ার ভয়ে আমাকে ফেলে পালাবে। আর কেনই বা ভালোবেসে বিয়ে করার পরও সংসার করতে পারব না।”
“আপনাকে কি বলে স্বান্তনা দেব। সেই ভাষা আমার সত্যিই জানা নেই। তারপরও বলি, ভগবান আপনার কাছ থেকে এতকিছু যখন নিয়েছে। এর বিনিময়ে দ্বিগুণ পরিমাণ আপনাকে ফিরিয়ে দেবে। আপনি এত সুখী হবেন জীবনে। আপনার সুখের কথা মনে পড়লে আনন্দে আপনার চোখে জল এসে যাবে। আমি মন থেকে প্রার্থনা করি, আপনার জীবনে সত্যিকারের দীর্ঘস্থায়ী সুখ আসুক৷ পরিপূর্ণ হোক আপনার জীবন।”
শরীর দূর্বল থাকার কারণে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল পারমিতা। বাকি পথটুকু প্রণয় মুগ্ধ দৃষ্টিতে পারমিতার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এত কাছ থেকে পারমিতার মুখের আদলে হৈমন্তীকে দেখে ওর গা শিরশিরে বিবশ অনুভূতি হচ্ছে। হিয়াটা পারমিতাকে দেখলে কি যে খুশি হবে। হয়তো অতিরিক্ত খুশিতে কেঁদেই ফেলবে মেয়েটা। আর বাবা! দারুণ শক পাবে। প্রণয়ও কি প্রথম দেখায় কম অবাক হয়েছিল!
গাড়িটা জোড়ে ব্রেক কষতেই প্রণয় হকচকিয়ে উঠল। প্রণয়ের ঘোর কেটে গেল। সামনে দিকে তাকিয়ে দেখল, ওরা গন্তব্যে চলে এসেছে। প্রণয় নিচু কণ্ঠে পারমিতাকে ডাকল। কাঁচা ঘুম ভেঙে পারমিতা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। ভীতু চাউনিতে প্রণয়ের দিকে তাকাল। প্রণয় ভরসা দিয়ে বলল,
“ভয় নেই পারমিতা। আমরা বাড়িতে এসে গেছি।”
এই প্রথম পারমিতা লাজুক হাসল। অবিকল হৈমন্তীর মতো। প্রণয়ের বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে গেল। অন্যদিকে তাকিয়ে বুকের বামপাশে হাত রাখল প্রণয়। স্পষ্ট অনুভব করল নিঃশ্বাসের গতিবেগ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। অনুভূতিরা মনের দোয়ার খুলে দিয়েছে৷ পারমিতাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে। এই পুড়া-কপালী জনম দুঃখী মেয়েটাকে সত্যিকারের সুখী করতে খুব ইচ্ছে করছে।
চলবে