বেলাশেষে পর্ব-১৩+১৪

0
25

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৩

প্রণয় পারমিতাকে নিয়ে যখন বাসায় প্রবেশ করল। তখন মধ্যরাত। এতরাতে বাবার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করল না। প্রণয়ের কাছে চাবি ছিল। তালা খুলে সবগুলো লাইট জ্বালিয়ে দিল। পারমিতা পুরো বাসায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বাসাটা খুব সুন্দর। ছিমছাম পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। প্রণয় ইশারায় পারমিতাকে কাছে ডাকল। পারমিতা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। প্রণয় পারমিতার হাতে একটা তোয়ালে ধরিয়ে দিল। বলল,
“ওইদিকে বাথরুম। স্নান করে নিন। ফ্রেশ লাগবে।”
পারমিতা মাথা নেড়ে আচ্ছা বলল। পারমিতা কয়েক কদম হেঁটে যেতেই প্রণয় পিছু ডাকল। ইতস্তত করে বলল,
“এখানে একটু দাঁড়ান পারমিতা। আমি একটু আসছি।”

প্রায় চার মিনিট পর প্রণয় এলো। হাতে শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট। প্রণয়ের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। তারপরও শাড়িটা পারমিতার হাতে তুলে দিল। আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল,
“কিছু না মনে করলে, এই শাড়িটা আজ পরবেন পারমিতা?”
পারমিতা মানা করতে চেয়েও মানা করতে পারল না। বিবেকে বাঁধা দিল। মাথা নেড়ে বলল,
“পরব।”
প্রণয়ের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। পারমিতা প্রণয়ের হাত থেকে শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোট নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। প্রণয়ও এই ফাঁকে চট করে স্নান করে নিল।

পারমিতা স্নান সেরে বের হয়ে দেখল, প্রণয় ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে। পরনে টাউজার আর হাফহাতা গেঞ্জি। চুলগুলো ভেজা। বোধহয় স্নান করেছে। চোখে চশমা নেই। এক ধাক্কায় যেন বয়স অনেকটা কমে গেছে। দেখতে বেশ লাগছে। পারমিতা অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল। প্রণয় বেখেয়ালে একবার পারমিতার দিকে তাকাল। চোখের পলক পড়ল না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। একে তো গভীর রাত। তারউপর প্রণয়ের চাউনি অস্বাভাবিক। এসে থেকে আর কাউকে দেখতে পেল না পারমিতা। পারমিতার খুব অস্বস্তি লাগছে। ভয়ও লাগছে একটু একটু। প্রণয় যতই নামকরা ডাক্তার হোক। তবুও পুরুষ মানুষ তো। এই মুহূর্তে প্রণয়ের মনে যে পারমিতাকে নিয়ে অন্যকিছু চলছে না তার কি গ্যারান্টি। প্রণয় বোধহয় পারমিতার ভীতু মুখের দিকে তাকিয়ে, মনোভাব খুব সহজেই বুঝতে পারল। পারমিতার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রণয়। বলল,
“এতক্ষণ আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম পারমিতা। চলুন খেয়ে নেই।”
প্রণয় আগে আগে হেঁটে গেল। প্রণয়ের পিছু পিছু পারমিতা হেঁটে গেল। ড্রাইনিংয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল দুজনে। পারমিতা অনেকগুলো দিন পর তৃপ্তি করে ভরপেট ভাত খেলো। দুজনের খাওয়া শেষ হতেই প্রণয় নিজের রুমে পারমিতাকে নিয়ে গেল। ঘরের লাইট জ্বেলে দিতেই দেখল, একটা চার বছরের বাচ্চা কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। প্রণয় বলল,
“আমার মেয়ে হিয়া।”

পারমিতা গুটিগুটি পায়ে হিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। হিয়ার পাশে বসে, হিয়ার মাথায় হাত রাখল। মেয়েটা ঘুমের ঘোরে পারমিতাকে আঁকড়ে ধরল। পারমিতার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মনটা খুব অশান্তি। দুফোঁটা নোনাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চট করে মুছে নিল পারমিতা। এই ছোট্ট মেয়েটার চেহারার সাথে পারমিতার অনেক মিল। মনে হচ্ছে, অন্যকেউ না এই মেয়েটা পারমিতারই মেয়ে। পারমিতা হিয়ার কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিল। ঘুমন্ত হিয়া নড়েচড়ে শুলো। পারমিতা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখল, দেয়ালে প্রণয় আর প্রণয়ের স্ত্রীর বড়ো করে ছবি টাঙানো। তার পাশেই আলাদা হিয়ার বাঁধানো ছবি টাঙানো। প্রণয়ের স্ত্রীর দিকে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল পারমিতা। মনে হচ্ছে অন্যকেউ না। ওটা যেন পারমিতারই ছবি। দুজন মানুষের হুবহু মিল কীভাবে হতে পারে। ভেবে পায় না পারমিতা। এই ছবি ও পারমিতাকে একসাথে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। সবাই ভাববে পারমিতার ছবিই টাঙানো। প্রণয় ঘড়ি দেখে বলল,
“অনেক রাত হয়েছে। চলুন আপনাকে শোবার ঘর দেখিয়ে দেই।”
পারমিতার হিয়াকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এই মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই অন্যরকম অদৃশ্য টান অনুভব করছে পারমিতা।
আবার এইঘরে থাকতে চাইলে প্রণয় কি ভাববে, সেই ভেবে উঠে গেল পারমিতা।
প্রণয় পারমিতাকে শোবার ঘর দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলল,
“ঈশ্বর বাঁচিয়ে রাখলে, আগামীকাল দেখা হবে পারমিতা। আমার মেয়েটা আপনাকে দেখলে যা সারপ্রাইজ হবে না। বাবাও প্রচণ্ড অবাক হবে। শুধু একটাই রিকুয়েষ্ট পারমিতা। আমার মেয়েটাকে কখনো বুঝতে দেবেন না। আপনি ওর মা নয়। আমার বিশ্বাস আপনাকে দেখার পর, ও আপনাকেই মা বলে ডাকবে। এবং বিশ্বাস করবে আপনিই ওর মা।”

প্রণয় চলে যেতেই পারমিতা ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল। আজ সারাদিন গাড়িতে থাকার ফলে শরীর খুব ক্লান্ত। আপন ভাবনায় মত্ত থেকে কখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। বুঝতেই পারল না পারমিতা। ঘুম ভাঙল পাখির কিচিরমিচির শব্দে। ঘুম থেকে উঠে, জানালা খুলে দিতেই একফালি রোদ ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, আটটা বাজে। কি করবে না বুঝতে পেরে ঘরের দরজা খুলে চুপটি করে বসে রইল পারমিতা।

ছোট্ট হিয়ার ঘুম ভাঙতেই বাবাকে দেখে হেসে ফেলল। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে, কপালে চুমু খেল। বলল,
“গুড মনিং পাপা।”
প্রণয় আদর করে হিয়ার গালদুটো আলতো হাতে টেনে দিল। বলল,
“মনিং মা। তোমার জন্য অনেক বড়ো একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি সারপ্রাইজ পাপা?”
“বলব না। দেখাব। তার আগে চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নাও। সারপ্রাইজ দেখে, আবার খুশিতে কেঁদে ফেলো না মা।”
“ওকে পাপা।”

প্রণয় হিয়াকে কোলে নিয়ে গেল পারমিতার ঘরে। যাওয়ার আগে হিয়ার চোখদুটো আলতো হাতে চেপে ধরল। পারমিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আস্তে করে হিয়ার চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিল প্রণয়। ছোট্ট হিয়া জীবনে প্রথমবার মাকে সশরীরে দেখে, স্তব্ধ হয়ে গেল। মাকে এত কাছ থেকে দেখে, হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল হিয়া। বাবার কোল থেকে নেমে গিয়ে পারমিতার একহাত টেনে ধরল হিয়া৷ পারমিতা নিচু হয়ে হিয়ার সামনে বসতেই হিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল পারমিতার গায়ে। পারমিতার গলা দুইহাতে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে মেয়েটা। হিয়ার কান্না দেখে পারমিতাও কেঁদে ফেলল। প্রণয় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অনেক বুঝালো। হিয়ার কান্না একটু থেমে এলো। বলল,
“মা…কেন এতগুলো দিন আমাদের কাছ থেকে দূরে ছিলে তুমি। আমি পাপা কত কষ্ট পেয়েছি।”
হিয়ার কণ্ঠে মা ডাক শুনে, জীবনে প্রথমবারের মতো পারমিতার নারী সত্ত্বা পরিপূর্ণ হলো আজ। মনে হলো, এ মেয়ে অন্যকারো না। পারমিতার মেয়ে৷ সত্যিকারের মেয়ে।
হিয়াকে আঁকড়ে ধরল পারমিতা। বলল,
“মা আর কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবে না হিয়া। তোমার থেকে দূরে থেকে আমিও কি কম কষ্ট পেয়েছি। তোমার বাবা যদি আরও আগে আমাকে তোমার কাছে নিয়ে আসত। তাহলে আমরা কেউ কষ্ট পেতাম না। সব দোষ তোমার বাবার।”

প্রণয়ের বাবাও চলে এসেছে৷ পারমিতাকে দেখে তিনিও প্রচণ্ড অবাক হয়েছে। তিনি কিছু বলতে চাইলে প্রণয় ইশারায় বাবাকে চুপ থাকতে বলল। হিয়ার সামনে পারমিতার ব্যাপারে প্রণয় কথা বলতে চাইল না।

ওদের মা-মেয়ের অভিমান, অভিযোগের পরে দুজনের গলায় গলায় ভাব হয়ে গেল। একদিকে ছোট্ট হিয়া যেমন পারমিতার মাঝে সত্যিকারের মা খুঁজে পেল। অন্যদিকে পারমিতাও হিয়ার মাঝে নিজের মেয়েকে খুঁজে পেল। হিয়া আবদার করল। মায়ের হাত ভাত খাবে। পারমিতা হিয়াকে কোলে নিয়ে ভাত খাওয়াতে চলে গেল। এই সুযোগে প্রণয়ের বাবা পরেশ বাবু পারমিতার সম্পর্কে জানতে চাইল৷ প্রণয় একে একে বাবাকে সংক্ষেপে পারমিতার অতীত বর্তমান সবকিছু খুলে বলল। এ-ও বলল পারমিতাকে খুব শীঘ্রই বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেবে প্রণয়। বাবাও আর আপত্তি করল না। ছেলেটা তো বিয়ে করতে রাজিই হচ্ছিল না। নিজে থেকে যখন মুখ ফুটে বিয়ের কথা বলেছে, ছেলের পছন্দ মেনে নিলেন তিনি। তাছাড়া মেয়েটা কখনো মা হতে পারবে না। এই মেয়েটা হিয়াকে সারাজীবন মাতৃস্নেহে আগলে রাখবে। হিয়াও যখন প্রথম সাক্ষাৎতে পারমিতাকে মা বলে মেনে নিয়েছে। তার আর আপত্তি করা সাজে না। হৈমন্তীর আদলে গড়া এই মেয়েটা যেন একদিন সত্যি সত্যিই হৈমন্তী হয়ে উঠে। এই সংসারে যেন আবারও স্বর্গ সুখ নেমে আসে। তুমি দেখো ঠাকুর৷

চলবে

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৪

সারাদিন হিয়ার সাথে বেশ কাটল পারমিতার। হিয়াটা একমুহূর্তের জন্যও পারমিতাকে চোখের আড়াল করছে না। আবার যদি হিয়াকে ফেলে মা চলে যায় সেই ভয়ে। হিয়া সারাক্ষণ পারমিতাকে মা..মা বলে ডাকছে। হিয়ার কণ্ঠে মা ডাক বেশ উপভোগ করছে পারমিতা। এবং সেইসাথে অনুভব করল, জীবনে সুখী হওয়ার জন্য খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। প্রণয় বাসায় নেই৷ ডিউটিতে চলে গেছে। রাতে কখন বাসায় ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই। প্রণয়ের বাবাও চমৎকার একজন মানুষ। সারাদিন গল্প করল। সারা বাড়ি পারমিতাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। এই বাড়িতে দুজন কাজের মাসি আছে। তারাও বেশ আন্তরিক ব্যবহার করল পারমিতার সাথে। একদিনে এইবাড়ির মানুষগুলোকে আপন করে নিল পারমিতা। হিয়ার জন্য কাজের মাসির হেল্প নিয়ে নিজের হাতে রান্না করল পারমিতা। রান্না করার ফাঁকে কাজের মাসি ফিসফিস করে বলল,
“স্বামী, সন্তান, সংসার ফেলে এতদিন কোথায় ছিলেন?”
পারমিতা কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। তবে বেশ বুঝতে পারে ওনারা বেশিদিন ধরে কাজে আসেনি। পারমিতার সত্যিটা বলতে ইচ্ছে করে না। মিথ্যা করে বলে,
“কিছু ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমরা দুজন সেপারেশনে ছিলাম।”
কাজের মাসির কৌতূহল বেড়ে যায়। আরও কিছু জানতে চেয়েও পরেশবাবুকে এইদিকে আসতে দেখে থেমে যায়। কাজে মনোযোগ দেয়। পারমিতা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। সময় করে, এই ব্যাপারে প্রণয়ের সাথে কথা বলতে হবে।

প্রণয় আজকে রাত আটটার দিকে বাসায় ফিরল। একদিনে পারমিতা সবার সাথে এত আন্তরিক ভাবে মিশে যাবে প্রণয়ের ভাবনাতেও ছিল না। হিয়াকে এত আদর-যত্ন করতে দেখে, প্রণয়ের সত্যিই খুব ভালো লাগছে। হিয়াটা পারমিতার শাড়ির আঁচল ধরে সারাবাড়ি টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গুনগুন করে গল্প বলছে।
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসল। খাওয়ার পর্ব শেষে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বাঁধল বিপত্তি। হিয়াটা মাকে পেয়ে খুশিতে আজ ঘুমায়নি। পারমিতাকে জোর করে ঘরে নিয়ে গেল। বলল,
“মাঝখানে আমি শুবো। এইপাশে তুমি শুবে। অন্যপাশে পাপা শুবে।”
প্রণয় অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“তুমি আর তোমার মা ঘুমাও। আমার একটু কাজ আছে। কাজ সেরে আসছি।”
হিয়া জেদি কণ্ঠে বলল,
“আমি তোমাদের দুজনের মাঝখানে এখুনি ঘুমাব পাপা।”
প্রণয় একপলক পারমিতার দিকে তাকাল। লজ্জায় পারমিতার গা শিরশির করে উঠল। অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল৷ এদিকে হিয়া পাপার শার্টের কোণা টেনে ধরে রেখেছে। এখন কিছুতেই পাপাকে যেতে দেবে না।
প্রণয় কি করবে বুঝতে পারছে না। হিয়াকে যে কড়া কণ্ঠে ধমক দেবে। তাও পারছে না। মায়া হচ্ছে খুব। পারমিতার সাথে এক বিছানায় শুলে পারমিতা কি ভাববে। তাছাড়া এসব ঠিকও না। প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসল। বলল,
“তুমি মাকে নিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।”
হিয়া প্রণয়ের দিকে তাকাল। বলল,
“তুমিও আমাদের পাশে শুয়ে পড়ো। পাপা প্লিজ…’’
প্রণয় আবারও পারমিতার দিকে তাকাল। হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে বলল,
“আমার সত্যিই খুব দরকারি একটা কাজ আছে মা। তুমি এখন মায়ের সাথে ঘুমাও। একঘুম দিয়ে উঠে দেখবে, আমিও তোমাদের পাশে ঘুমিয়ে আছি।”
হিয়া সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“সত্যি তো পাপা?”
“তিন সত্যি মা।”
প্রণয় উঠে অন্যঘরে চলে গেল। যাওয়ার আগে নিচু কণ্ঠে পারমিতাকে বলে গেল,
“আমি পাশের ঘরে আছি। হিয়া ঘুমিয়ে গেলে একটু আসবেন প্লিজ। আপনার সাথে আমার কিছু দরকারি কথা আছে।”
পারমিতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। প্রণয় আর দেরি করল না। বসা থেকে উঠে চলে গেল। মানুষটা চাইলেই কিন্তু মেয়ের পাশে মেয়ের মন রাখতে শুয়ে পড়তে পারত। শুধুমাত্র পারমিতার কথা ভেবে অন্যঘরে চলে গেল। মানুষটার ব্যাক্তিত্ব পারমিতাকে মুগ্ধ করল। এত ভালো মানুষ সচরাচর দেখা যায় না।

হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দিল পারমিতা। হিয়া গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতেই পারমিতা আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করতে করতে পাশের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করল। নিচু কণ্ঠে বলল,
“আসব?”
প্রণয় যেন অপেক্ষাতেই ছিল। উঁচু কণ্ঠে বলল,
“আসুন প্লিজ।”

পারমিতা ঘরে যেতেই প্রণয় ইশারায় ব্যালকনি দেখিয়ে আগে আগে হাঁটতে লাগল। পারমিতা প্রণয়ের পেছন পেছন হেঁটে গেল। ব্যালকনিতে গিয়ে মুখোমুখি দুজন দাঁড়াল। আকাশে তারার হাঁট বসেছে। চাঁদের আলো উপচে পড়ছে। পাশেই হাসনাহেনার গাছ। বাতাসে হাসনাহেনার সুন্দর ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। প্রণয় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দুইহাত আড়াআড়ি ভাবে দুইপাশে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। পারমিতা ব্যালকনির দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আকাশের অর্ধ ডুবন্ত চাঁদের দিকে স্থির। প্রণয় কেঁশে গলা পরিষ্কার করে নিল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“পারমিতা…?”
পারমিতা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। একপলক প্রণয়ের চোখের দিকে তাকাল। খুব অল্প সময়ের জন্য দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো। ঠিক তখনই আচমকা ঝড়ো বাতাস উঠে এলো। বাতাসের তীব্রতায় ধুলোবালি উড়ছে। পারমিতা চোখমুখ বুঁজে ফেলল। খোঁপা বাঁধা চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে পড়ল। এলোমেলো চুলের ঝাপটায় চোখমুখ ঢেকে গেল। পারমিতা বেসামাল হয়ে চুলগুলো আয়ত্ত্বে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিল। প্রণয় মুগ্ধ দৃষ্টিতে পারমিতার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে পারমিতার চেহারার আদলে গড়া হৈমন্তীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর পিষে ফেলতে ইচ্ছে করছে খুব৷ বুকের ভেতর তোলপাড়। মনটা খুব অশান্ত। নিজের আবেগ কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছে না প্রণয়৷ অন্যদিকে তাকিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিল প্রণয়। এই মুহূর্তে একটা সিগারেট খেলে মানসিক টানাপোড়েন কিছুটা কমতো। কিন্তু এখন ধুমপান করার উপযুক্ত সময় না। বহুকষ্টে মনের রাশ শক্ত করে টেনে ধরল প্রণয়৷ স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় নিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার একটা রিকুয়েষ্ট রাখবেন পারমিতা?”
“কি কথা?”
প্রণয় দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই পারমিতা।”
পারমিতার বুকের ভেতর মৃদু কম্পন অনুভব হলো। চোখ তুলে তাকাল প্রণয়ের দিকে। নিচু কণ্ঠে বলল,
“আমি কখনো মা হতে পারব না।”
প্রণয় যেন আর একটু সাহস পেল। বলল,
“আপনি আমার হিয়ার মা হয়ে থাকবেন। জন্মের পর থেকে আমার মেয়েটা কখনো মায়ের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা পায়নি। আমিও সারাদিন ব্যস্ত থাকি। আপনাকে আমি কখনো কোনোকিছুর অভাব অনুভব করতে দেব না প্রমিস। বিনিময়ে শুধু আমার মেয়েটাকে মাতৃস্নেহে বড়ো করবেন।”
অনিরুদ্ধকে ভালোবেসে বিয়ে করার পর চরম ভাবে ঠকে গিয়ে বিয়ের প্রতি আর আগ্রহ কাজ করে না। বিয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা, ভীতি এসে গেছে। কোনো পুরুষ মানুষকেও আর মন থেকে বিশ্বাস হয় না৷ সেই ভীতি থেকে পারমিতা বলল,
“হিয়াকে মাতৃস্নেহে বড়ো করার জন্য কি আপনাকে বিয়ে করতেই হবে? বিয়ে না করে কি হিয়ার দায়িত্ব নিতে পারব না আমি?”
প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
“সে আপনি অবশ্যই পারবেন। তবে হিয়াটা রোজ রাতে বায়না করবে আমরা দুজন যেন ওর পাশে শুয়ে থাকি।
একদিন দুইদিন পাশ কাটিয়ে গেলেও প্রতিদিন তো পারব না। তাছাড়া হিয়া যেহেতু আপনাকে মা বলে মেনে নিয়েছে। আমাদের দুজনকে সবসময় দূরে দূরে থাকতে দেখলে, ওর ছোট্ট মনে প্রভাব ফেলবে। হয়তো একসময় বুঝেও ফেলবে আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী নয়। যদি কখনো বুঝে ফেলে ও মানসিক ভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়বে৷ আমাকে ভুল বুঝবে। হয়তো সামান্য একটা ভুলের জন্য আমাদের বাবা-মেয়ের মাঝখানে বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে। এই দূরত্বটাই আমি মানতে পারব না পারমিতা। তাছাড়া আপনাকে বিয়ে করে আমাদের সম্পর্কের বৈধতা দিতে চাচ্ছি। একসাথে থাকতে থাকতে কখনো যদি আমাদের মাঝে কিছু হয়ে যায়। আমরা যেন কেউ অনুশোচনা না করি। পাপবোধ না হয়। এখুনি উত্তরটা জানাতে হবে না আপনাকে। সময় নিন। ভাবুন। ভেবেচিন্তে আপনার সিদ্ধান্ত আমাকে জানাবেন। অনেক রাত হলো। এবার হিয়ার কাছে যান। ঘুমিয়ে পড়ুন। শুভ রাত্রি।”

চলবে