#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৫
গভীর রাত। পারমিতার চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। প্রণয়ের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রীতিমতো মাথা ব্যথা করছে। স্বল্প পরিচিত একটা মানুষের সাথে হুট করে বিয়ের বন্ধনে জড়াতে মন সায় দিচ্ছে না। অনিরুদ্ধকে ভালোবেসে বিয়ে করার পর এত বিশ্রীভাবে পারমিতাকে ঠকিয়েছে। নতুন করে বিয়ের কথা ভাবতেও গা কাঁটা দিয়ে উঠে। আবার আপাদমস্তক প্রণয়কে দেখে, প্রণয়ের কথাগুলো শুনে, মানুষটাকে ভালোই মনে হয়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। তবে কেন যেন মন মানতে চায় না।
হিয়াটা ঘুমের ঘোরে পারমিতার গা ঘেঁষে শুলো। পারমিতার গায়ের ওম পেয়ে একহাত দিয়ে পারমিতাকে জড়িয়ে ধরল৷ পারমিতা চোখ তুলে হিয়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। মেয়েটা দেখতে খুব মিষ্টি। হিয়ার হাসি হাসি মুখটা দেখলে মন ভরে যায়। আলতো হাতে গাল টেনে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে। পারমিতা হিয়ার মাথায় হাত রাখল। হিয়া পারমিতার বুকে মুখ গুঁজে দিতেই পারমিতার মাতৃত্ব নারী সত্ত্বা জেগে উঠল।
হিয়াকে আলতো হাতে আঁকড়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল পারমিতা। এই মেয়েটা পারমিতার। শুধুই পারমিতার। অন্যকারো না। দুজন কোথাও গেলে কেউ ধরতেই পারবে না হিয়া অন্যকারো গর্ভে জন্ম নিয়েছে। দুজনের চেহারায় এতটাই মিল। এই মিলের রহস্য কি? বুঝতে পারে না পারমিতা। পারমিতা হিয়াকে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ কয়েকপা হেঁটে গিয়ে দেয়ালে বড়ো করে টাঙানো হৈমন্তীর ছবির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল৷ হৈমন্তীর পাশেই প্রণয় হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। প্রণয়ের একহাত হৈমন্তীর কাঁধে রেখেছে। দুজনকে একসাথে বেশ লাগছে৷ কিন্তু দেয়ালে টাঙানো ছবিটা হুবুহু পারমিতার। দুজনের চেহারার কোনোকিছুর অমিল নেই। সেম একরকম দেখতে। জমজ বোন দেখতে যেমন হয়। ঠিক তেমন। একটা অপরিচিত মানুষের সাথে এতবেশি মিল কীভাবে হতে পারে। একবার সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হলে ঠিকই কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করত পারমিতা। আফসোস মাথা ঠুকে মরে গেলেও সামনাসামনি দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিয়ার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বিয়ে করবে পারমিতা। শুধুমাত্র হিয়ার মুখ থেকে মা ডাক শোনার লোভে প্রণয়কেই বিয়ে করবে পারমিতা। কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। প্রণয়ের সাথে বিয়ে হলে, আরকিছু পাক আর না পাক নিজের একটা মেয়ে তো পাবে। যে মেয়েকে জন্ম না দিয়েও সময়ের সাথে সাথে মেয়ের আসল ও একমাত্র মা হয়ে উঠবে পারমিতা। ছোট্ট একটা জীবনে পারমিতা অনেক আঘাত সহ্য করেছে৷ অনেক দুঃখ সয়েছে। দরকার হলে আরও সইবে। তবুও একটা ফুটফুটে মেয়ের মা হওয়ার সুযোগ যখন এসেছে। এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করবে না পারমিতা। এই মেয়েটার জন্য সমস্ত কষ্ট হাসিমুুখে ঠিকই সয়ে যেতে পারবে। এই মেয়েটা তো পারমিতার আপন রক্তের সম্পর্কের কেউ না। তবুও প্রথম দেখায় এত কেন টান অনুভব করছে পারমিতা।
সকালে খাবার টেবিলে প্রণয়ের সাথে দেখা হলো। এই প্রথম প্রণয়কে সশরীরে দেখে কেন যেন লজ্জা লাগছে। হয়তো গতকাল রাতে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে এইকথা ভেবে।
পারমিতা অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে হিয়ার খাওয়ানোতে মনোযোগ দিল। মেয়েটা আদুরে কণ্ঠে প্রচুর কথা বলে। শুনতে বেশ লাগে। প্রণয় চুপচাপ খেয়ে উঠে ঘরে চলে গেল। আজ ছুটির দিন। সারাদিন বাড়িতেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দিল প্রণয়। বিকালে হিয়ার আবদারে ঘুরতে বের হলো। হিয়া পারমিতাকে ছাড়া কোথাও যাবে না। মেয়েটা পারমিতাকে দেখার পর থেকে চোখের আড়ালই করতে চাচ্ছে না। সারাক্ষণ পারমিতার ছায়া সঙ্গী হয়ে থাকে। পারমিতাকে যত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে পারবে ততই চিন্তা মুক্ত হবে প্রণয়। হিয়াটার পারমিতার প্রতি তীব্র আসক্তি হয়ে গেলে পারমিতাকে ছেড়ে থাকতেই পারবে না হিয়া। এই একটা ভয় মনে বাসা বেঁধেছে। এদিকে পারমিতাকে তো জোর করাও যায় না। মেয়েরা অনুভূতি প্রবণ হয় প্রবল। একটা সম্পর্কের থেকে বেরিয়ে অন্যএকটা সম্পর্কে জড়াতে ওদের অনেক সময় লেগে যায়। পারমিতা অনিরুদ্ধ নামের ছেলেটাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতো। ভালোবাসার মানুষটা যতই প্রতারক হোক। মন থেকে মুছে ফেলা এত সহজ না। পারমিতা সুস্থ হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। জোর দিয়ে কিছু বলাও যাবে না। কোনো সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়েও দেওয়া যাবে। ওর দুর্বল মস্তিষ্ক জোরজবরদস্তি হজম করতে পারবে না। আবারও মাথায় সমস্যা দেখা দেবে। এই ভয় থেকেও প্রণয় জোর দিয়ে কিছু বলতেও পারছে না। আবার পারমিতার আদলে গড়া হৈমন্তীকে এত কাছে পেয়েও দূরে দূরে থাকতে ভালো লাগছে না। খুব কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করছে।
ওরা গাড়ি নিয়ে ঘুরতে গেল। ঘুরতে ঘুরতে অনেকটা দূরে চলে গেল।
একটা পার্কের সামনে গাড়ি থামিয়ে তিনজনে গাড়ি থেকে নেমে পার্কের ভেতরে গেল। পারমিতা শাড়ি পরেছে। প্রণয় পারমিতার শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে জিন্সের সাথে টি-শার্ট পরেছে। হিয়াও সুন্দর একটা জামা পরেছে। হিয়া প্রণয়ের কোলে আর পারমিতা প্রণয়ের পাশে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে। হিয়া আর পারমিতা গল্পে মশগুল। প্রণয় খুব মনোযোগ দিয়ে মা-মেয়ের গল্প শুনছে আর মিটি মিটি হাসছে।
দুভার্গ্যবশত অনিরুদ্ধ তার বর্তমান স্ত্রীকে নিয়ে একই পার্কে এসেছে। দুজন কি একটা বিষয় নিয়ে যেন পার্কে এসেও প্রচণ্ড ঝগড়া করছে। আশেপাশের মানুষ ওদের দিকে কৌতূহল চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে দুজনের আসলে কি নিয়ে ঝগড়া লেগেছে। ঝগড়ার একপর্যায়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বউকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল অনিরুদ্ধ। বউটাও কম যায় না। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে আচমকা অনিরুদ্ধর পা কামড়ে ধরল। অনিরুদ্ধ পা ঝাড়া দিয়ে বউকে ফেলেই চলে যেতে নিল। কয়েক কদম হেঁটে যেতেই পারমিতাকে দেখে চমকে উঠল অনিরুদ্ধ।
পারমিতা যেন অনিরুদ্ধকে না দেখতে পারে চট করে ফুল গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল অনিরুদ্ধ। পারমিতা আগের থেকেও সুন্দরী হয়েছে। শাড়িতে কি দারুণ লাগছে পারমিতাকে। পাশের লোকটা কে? নিশ্চয়ই পারমিতার হাসবেন্ড। লোকটার কোলে আবার একটা বাচ্চাও দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল অনিরুদ্ধ। হুবহু পারমিতার চেহারা। ডাক্তার না বলেছিল, পারমিতা কখনো মা হতে পারবে না। তাহলে বাচ্চাটা হলো কীভাবে? পারমিতার বিয়ে হলো কবে, আর বাচ্চাই বা হলো কবে? লোকটার সাথে যে কয়বার দৃষ্টি বিনিময় করল সেই কয়বার লাজুক হাসল পারমিতা। বেশ সুখেই আছে পারমিতা। পারমিতার এত সুখই তো সহ্য হচ্ছে না অনিরুদ্ধর। একটা ভুলের জন্য পারমিতাকে হারিয়েছে অনিরুদ্ধ। ইশ, আবারও যদি পারমিতাকে নিজের করে পেত। এত সহজে তো পারমিতাকে ছাড়বে না অনিরুদ্ধ। আবারও ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক না কেন! নিজের করে ছাড়বে অনিরুদ্ধ। একবার কি সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? যদি পারমিতা ভয় পায়। না.. না ভয় পাবে কেন! পারমিতা তো অনিরুদ্ধকে ভালোবাসে। পুরোনো অনুভূতিকে জাগ্রত করলে আবারও অনিরুদ্ধকে ভালোবাসতে বাধ্য হবে পারমিতা। পাগল পাগল হয়ে অনিরুদ্ধর কাছেই ছুটে আসবে। এবার আর ভুল করবে না অনিরুদ্ধ।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অনিরুদ্ধর দু-চোখ জলে ভিজে উঠল। পারমিতা আগের থেকেও দেখতে সুন্দর হয়েছে। পারমিতার দিক থেকে চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না। ছুটে গিয়ে জাপ্টে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করছে খুব।
সারা বিকেল ঘুরে, রাতে বাইরে থেকে ডিনার করে তারপর বাসায় ফিরল ওরা। হিয়া গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। চলন্ত গাড়িটা রাতের আঁধার পেছনে ফেলে ছুটছে। হিয়ার আবদারে পেছনের সিটে পাশাপাশি দুজন বসে আছে। হিয়া কথা বলতে বলতে প্রণয়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপরই ওরা দুজন চুপচাপ বসে আছে। দুজন মানুষ জড়বস্তুর মতো কতক্ষণ বসে থাকা যায়। প্রণয় কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। বলল,
“হিয়াটা এই দুইদিনেই আপনার খুব বাধ্য হয়ে উঠেছে।”
উত্তরে পারমিতা একটুখানি হাসল। প্রণয় বলল,
“আমার মেয়েটা ছোটো হলে কি হবে। সবদিকেই তার নজর৷ আজ ওর সামনে আপনাকে দুইবার আপনি বলে সম্বোধন করেছি। দুইবারই ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। আমি আপনাকে ‘তুমি’ না ডেকে আপনি করে কেন ডাকছি।”
পারমিতা বলল,
“ওর ছোট্টো মনে কোনো সন্দেহ ঢুকতে দেবেন না। এখন থেকে আপনি আমাকে তুমি বলেই ডাকবেন।”
“অনুমতি দিচ্ছেন তাহলে?’’
পারমিতা অন্যদিকে তাকাল। প্রণয় নিঃশব্দে হাসল। বলল,
“বিয়ের কথা ভাবলে কিছু?”
পারমিতার বুকের মৃদু কম্পন স্পষ্ট অনুভব করল পারমিতা। আস্তে করে বলল,
“বিয়েটা কি হিয়ার সামনেই করবেন?”
পারমিতা এত সহজে এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে। এই ভাবনাটা স্বপ্নেও ছিল না। প্রণয়ের মনে সুখ সুখ অনুভূতি। মুখটা হাসি হাসি। এই প্রথম অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে পারমিতার একহাত ধরল। প্রণয়ের উষ্ণ স্পর্শে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল পারমিতা। লজ্জায় চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল। প্রণয়ের হাতের বাঁধন আর একটু শক্ত হলো। নিচু কণ্ঠে বলল,
“বিয়েটা হিয়ার সামনে করতে চাচ্ছি না। তাহলে ওর ছোট্ট মনে প্রশ্ন জাগবে।”
“তাহলে?”
“তাহলে আর কি! করব কোনো এক মন্দিরে।”
“হিয়াকে কি বলে বের হবো?”
“কিছু একটা বলে বের হতে হবে। তবে আমার একটা রিকুয়েষ্ট আছে। রাখবে পারমিতা?”
“রাখাল হলে অবশ্যই রাখব।”
প্রণয় বলল,
“পহেলা বৈশাখে আমার সাথে হৈমন্তীর বিয়ে হয়েছিল। আর দুটোদিন পর বৈশাখ। আমি চাচ্ছিলাম। একই ডেটে বিয়েটা করতে।”
পারমিতার মনটা খারাপ হয়ে গেল। অকারণ কেন যে মনটা খারাপ হলো। তাই বুঝতে পারল না পারমিতা। লোকটা একই ডেটে বিয়ে করতে চাচ্ছে নিজের মেয়ের কথা ভেবে। বিয়েটাই তো করছে শুধুমাত্র মেয়ের জন্য। পারমিতা একশো ℅ শিওর দিয়ে বলতে পারে, হৈমন্তীর চেহারার সাথে পারমিতার চেহারার মিল না থাকলে কোনোদিনও ডাক্তার প্রণয় পারমিতার মতো মেয়েকে বিয়ে করত না। লোকটা যে কারণেই হোক বিয়ে করে বউয়ের স্বীকৃিত দেবে। এইতো অনেক। তারপরও মনের কোথাও না কোথাও একটা খারাপ লাগা থেকে যায়।
প্রণয় সারাটা রাস্তা পারমিতার একহাত আঁকড়ে ধরে রাখল। একমুহূর্তের জন্যও হাতটা ছাড়ল না প্রণয়৷ এই বিশুদ্ধ স্পর্শটুকু ভালো লাগল পারমিতার। পারমিতা হাতটা সরিয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করল না।
বাসায় এসে যে যার রুমে গিয়ে, ফ্রেশ হয়ে পোশাক পাল্টে ঘুমিয়ে পড়ল।
হিয়ার চোখ ফাঁকি দিয়ে, বিয়ের ব্যবস্থা, কেনাকাটা করে ফেলল প্রণয়। বিয়ের কেনাকাটা অবশ্য হিয়াকে সাথে নিয়েই করেছে। যদিও হিয়া বিয়ের কথা জানে না। তবে মায়ের জন্য পাপা কেন ঘটা করে কেনাকাটা করছে তা জানে হিয়া। বাবাই বলেছে হিয়াকে। পারমিতার শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে হিয়ার জন্য সুন্দর একটা জামা কিনে দিল। নিজের জন্যও পাঞ্জাবি সহ আরও টুকটাক কেনাকাটা করে ফেলল প্রণয়।
একদিন পর বিয়ে। অথচ তার আগেই একটা ফোনকল
একটা ফোনকল। পারমিতার সবকিছু উলোটপালোট করে নিল। একদম মনের ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিল। অসময়ে ওই মানুষটা ফোন না দিলেই কি হতো না? কেন এতগুলো দিন পর পারমিতার সুখের জীবনে নতুন করে দুঃখ হয়ে ধরা দিতে চায় মানুষটা? কেন?
(চলবে)
#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৬
“পারমিতা চুপ করে থেকো না। কথা বলো প্লিজ?”
রাগ, দুঃখ, জেদে পারমিতা চোখের জলে সবকিছু ঝাপসা দেখছে। ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে রাখতেও খুব ক্লান্ত লাগছে। অনিরুদ্ধ অস্থির হয়ে বলল,
“তুমি কথা বলছ না কেন, পারু?”
“কেন ফোন দিয়েছ?”
“আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি পারমিতা। আমি তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি৷ তোমাকে ছেড়ে সুখে নেই আমি।”
“হঠাৎ এত ভালোবাসার কারণ? নাকি তোমার বর্তমান স্ত্রীর সাথেও ডিভোর্স হয়ে গেছে?” পারমিতা তাচ্ছিল্য করে কথাটা বলল।
অনিরুদ্ধ পারমিতার কটূক্তি একটুও গায়ে মাখল না। এখন উত্তেজিত হওয়া যাবে না। সময় নিয়ে পারমিতাকে বোঝাতে হবে। অনিরুদ্ধ বলল,
“আমি ভালো নেই পারমিতা। তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার কি যে কষ্ট হয়। তোমার কথা ভেবে নীরব চোখের জলে প্রতিরাতে বালিশ ভিজে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কত খুঁজেছি তোমাকে। আফসোস কোথাও তোমার সন্ধান পাইনি।”
“তাহলে এখন কীভাবে পেলে?”
এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর অনিরুদ্ধ দিতে পারল না। বলল,
“ডাক্তার না বলেছিল, তোমার বাচ্চা হবে না। তারপরও কীভাবে তোমার বাচ্চা হলো?”
পারমিতা চমকে উঠল। খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“সৃষ্টিকর্তা চাইলে সব সম্ভব।”
“স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই আছো তাহলে?”
“খুব সুখে আছি।”
“আমি সুখে নেই পারমিতা।”
“শোনো অনি, তুমি সুখে থাকার জন্যই আমাকে মাঝপথে ছেড়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি একে একে সব হারিয়েছি। তোমাকে আমি কোনোদিনও ক্ষমা করব না। এখন তুমি কীভাবে থাকবে না থাকবে সেটা তো আমার দেখার বিষয় না। ভুলেও আর কখনো আমাকে বিরক্ত করবে না। আমাদের দুজনের পথ অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছে।”
“আমি জানি, তুমি এখনো আমাকেই ভালোবাসো পারমিতা।”
“ভুল জানো তুমি। আমি তোমার মতো কাপুরুষকে ঘৃণা করি। প্রচণ্ড ঘৃণা করি তোমাকে। আর কখনো যদি আমাকে ফোন দিয়ে অকারণ ডিস্টার্ব করো। তাহলে তোমার বউকে বলে দেব আমি। আমি আর আগের বোকাসোকা পারমিতা নেই। আমার সংসারে তিল পরিমাণ অশান্তি করার চেষ্টা করলে, তোমার সংসারে আগুন লাগিয়ে দেব আমি। কাপুরুষ একটা।”
পারমিতা ফোনটা কেটে দিয়ে অনিরুদ্ধর নম্বরটা ব্লক লিস্টে ফেলে দিল। অনিরুদ্ধ হঠাৎ করে কেন পারমিতার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। তাই তো বুঝতে পারছে না পারমিতা। অনিরুদ্ধ এবার যতই ভালোবাসার মিথ্যা অভিনয় করুক। মরে যাবে। তবুও অনিরুদ্ধর পাতা ফাঁদে আর পা দেবে না। একবার নরক যন্ত্রণা ভোগ করে এসেছে পারমিতা। দ্বিতীয়বার আর ইচ্ছে নেই। অনিরুদ্ধ সত্যিটা জেনে যাওয়ার আগেই প্রণয়ের সাথে বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে। নাহলে আবারও এমন কিছু করবে অনিরুদ্ধ। হয়তো প্রণয়ই আর বিয়েটা করতে চাইবে না।
রাতে আর ঘুম হলো না। অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে
ভোরের দিকে চোখটা লেগে এসেছে। ঘুম ভাঙল প্রণয়ের ডাকে। পারমিতা কাঁচা ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। প্রণয় নিচু হয়ে পারমিতার একহাত আলতো করে ধরল। বলল,
“ভয় পেয়েছ?”
“একটু।”
“সরি। আসলে সকাল নয়টা বেজে গেছে। উঠে স্নান করে নাও। আমরা একটু পর বের হবো।”
পারমিতা বিছানার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হিয়া কোথায়?”
“ও তো অনেক আগেই উঠে গেছে। হয়তো ওর দাদুর সাথে আছে।”
“হিয়া কি খেয়েছে। ইশ, কি ঘুম ঘুমিয়েছি আমি।”
“নো প্রবলেম। সবদিন শরীর একরকম যায় না।”
পারমিতা বিছানা গুছিয়ে উঠতে উঠতে বলল,
“হিয়া কি খেয়েছে?”
“হ্যাঁ। আমি খাইয়ে দিয়েছি।”
“আচ্ছা। আপনি বসুন। আমি স্নান করে আসছি।”
প্রণয় একটা শাড়ির প্যাকেট পারমিতার হাতে দিল। বলল,
“এই শাাড়িটা পরে চটজলদি রেডি হয়ে নাও।”
“হিয়াকে কি বলে যাব?”
“হিয়াকে আমি ম্যানেজ করে ফেলেছি। নো টেনশন। ও একটুও আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না করবে না।”
“আচ্ছা।”
স্নান সেরে রেডি হতে গিয়ে দেখল, প্যাকেটে একটা লাল টুকটুকে জামদানি শাড়ি। শাড়িটা পারমিতা খুব যত্ন করে সময় নিয়ে পরল। প্রণয় অনেকগুলো সাজের সামগ্রী কিনে দিয়েছে। তবে খুব বেশি সাজলো না। ফ্রেসের সাথে মিলিয়ে ন্যাচরাল মেকাপ করল। ভেজা চুলগুলো ঢিলা করে হাত খোঁপা বাঁধল। প্রণয় রেডি হয়ে হাতঘড়ি পরতে পরতে ঘরে এলো। বলল,
“হলো তোমার?”
পারমিতা ঘুরে দাঁড়াতেই চার চোখের মিলন হলো। পারমিতাকে দেখতে দারুণ লাগছে। প্রণয় মুগ্ধ দৃষ্টিতে পারমিতার মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতর শিরশির করছে। মুহূর্তেই মনটা খুব অশান্ত হয়ে উঠল। পাঞ্জাবিতে প্রণয়কে দেখতে সুন্দর লাগছে। প্রণয়ের বয়স একটু বেশি হলেও বডি ফিটনেস সুন্দর। বয়স বোঝা যায় না। দেখতে বেশ লাগে। দুজন হিয়ার গালে চুমু খেয়ে, হিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কালী মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। গাড়িতে উঠে প্রণয় বলল,
“তোমার মাসিকে বিয়েতে আসতে বলেছ?”
পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
“বলেছিলাম।”
“কি বলল?”
“আসবে না।”
“মন খারাপ?”
“একটু।”
প্রণয় পারমিতার মাথায় হাত রাখল। বলল,
“মন খারাপ করো না। সময় করে একদিন গিয়ে তোমার মাসির কাছ থেকে আমরা আশীর্বাদ নিয়ে আসব।”
প্রণয় পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা গোপালফুল বের করে পারমিতার খোঁপায় যত্ন করে গুঁজে দিল। ফুলটা খোঁপায় গুঁজে দেওয়ার বাহানায় ঘাড়ে আলতো করে স্পর্শ করল। আবেশে কেঁপে উঠল পারমিতা। প্রণয় হাত সরিয়ে নিল।
বলল,
“এবার বেশি সুন্দর লাগছে।”
উত্তরে পারমিতা লাজুক হাসল।
মন্দিরে এসে দেখল, প্রণয়ের কিছু কলিগ ও বন্ধু এসেছে। ওদের সাক্ষী রেখে প্রণয়-পারমিতার বিয়েটা ভালো ভাবেই সম্পূর্ণ হয়ে গেল। প্রণয়ের দেওয়া সিঁদুর সিঁথিতে পরে পারমিতার অন্যরকম অনুভূতি হলো। কেঁদেই ফেলল মেয়েটা। এই প্রথম প্রণয় পারমিতার কাঁধ জড়িয়ে ধরল। নিচু কণ্ঠে বলল,
“কেঁদো না। জীবনে অনেক কষ্ট করেছ। আর একটু অপেক্ষা করো। খুব সুন্দর একটা স্বপ্নময়ী জীবন তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।”
প্রণয়ের যত্ন, একটু সান্ত্বনা শুনে
পারমিতার মনটা পুলকিত হলো খুব৷ চোখের জল মুছে প্রণয়ের বুকে মাথা রাখল। প্রণয়ের হাতের বাঁধন আর একটু শক্ত হলো। পারমিতার মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমু এঁকে দিল।
বাড়িতে ফিরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল। বাড়িতে গিয়ে দেখল, বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। অনেক লোকজন ইতিমধ্যে এসে গেছে। চারদিকে খাবারের ঘ্রাণে ম ম করছে। হিয়া কোথা থেকে ছুটে এসে পারমিতাকে জড়িয়ে ধরল। প্রণয় নিচু কণ্ঠে বলল,
“ঘরে যাও। পার্লারের লোকেরা সাজাতে চলে এসেছে।”
পারমিতা প্রশ্নবোধক চোখে প্রণয়ের দিকে তাকাল। প্রণয় পারমিতাকে আড়ালে নিয়ে গেল। নিচু কণ্ঠে বলল,
“আমি আর হিয়া প্রতিবছর আজকের দিনে আমাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে হৈমন্তীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কেক কাটি। যেহেতু তুমি এখন আমাদের মাঝে চলে এসেছ। হিয়ার আবদারে আজকে বড়ো করে অনুষ্ঠান করতে হলো। তবে শুধু হিয়া জানে, আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। আর সবাই আমাদের বিয়ের প্রোগ্রামেই এসেছে কিন্তু।”
আত্মতৃপ্তিতে পারমিতার মনটা ভরে গেল। পারমিতার প্রথম বিয়েটা হয়েছিল খুব সাদামাটা ভাবে। ছোটোবেলা থেকেই লাল টুকটুকে বউ সেজে বিয়ে করার খুব স্বপ্ন ছিল। পারমিতার স্বপ্নের মতো অনিরুদ্ধর সাথে বিয়েটা হয়নি দেখে আফসোসের শেষ ছিল না। অথচ সেই স্বপ্নটা শুধুমাত্র হিয়ার জন্য ঠিক ঠিক আজ পূরণ হবে। পারমিতা হিয়াকে জড়িয়ে ধরে, কপালে চুমু এঁকে দিল। তারপর মা-মেয়ে সাজতে চলে গেল। প্রণয় মা-মেয়ের গমন পথের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল,
“ওদের তুমি কখনো আলাদা করে দিও না ঠাকুর।”
(চলবে)