#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৯
দুপুরে প্রণয় পারমিতাকে রান্না করতে দিল না। আজ দুপুরে কি কি রান্না হবে কাজের মাসিদের বলে, প্রণয় পারমিতার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। পারমিতা ঘরে এসে বলল,
“কি করছেন কি? সবাই কি ভাববে।”
প্রণয় পারমিতার কাঁধে হাত রাখল। আর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“কেউ কিছুই ভাববে না।”
“দেখি ছাড়ুন। হিয়া কোথায় গেল!”
“পারমিতা?”
“বলুন?”
“হিয়াকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ভাত খাইয়ে ভাতঘুম পাড়িয়ে দাও।”
“আজ বোধহয় দুপুরে ঘুমাবে না হিয়া।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে।”
“হঠাৎ ওর ঘুম নিয়ে পড়লেন কেন?”
প্রণয় বলল,
“আমি আজ তোমার সারাজীবনের ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নেব। হিয়ার সামনে বুঝতেই তো পারছ। ও দেখলে কি ভাববে।”
পারমিতা একটু ভেবে বলল,
“দেখছি কি করা যায়।”
হিয়াকে পাওয়া গেল ব্যালকনিতে। ওর দিদার সাথে বসে বসে গল্প করছে। কখনো কখনো খুব শব্দ করে হাসছে। এই দৃশ্য দেখে পারমিতার মনটা জুড়িয়ে গেল। বলল,
“হিয়ামণি..?”
হিয়া চোখ তুলে পারমিতার মুখের দিকে তাকাল। বলল,
“কিছু বলবে মা।”
“কয়টা বাজে দেখেছ? চলো খেয়ে নেবে।”
“আমি তোমার সাথে খাব মা।”
“রাতে খেও আমার সাথে। এখন চলো, তোমাকে আমি নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দেব।”
হিয়া হেঁটে এসে মায়ের সামনে দাঁড়াল। পারমিতা চট করে হিয়াকে কোলে তুলে নিল। হিয়া ছোটো ছোটো দুইহাত দিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল। পারমিতা হিয়ার গালে চুমু এঁকে দিয়ে ওকে নিয়ে হেঁটে গেল। এই অপার্থিক সুন্দর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে রেখার এত ভালো লাগল। বলার মতো না। প্রণয় এতদিনে একটা কাজের কাজ করেছে। যোগ্য একটা মেয়েকে হিয়ার মা করে নিয়ে এসেছে।
পারমিতা গল্পচ্ছলে সময় নিয়ে হিয়াকে খাইয়ে দিল। তারপর ভাতঘুম পাড়িয়ে দিল। প্রণয়ের আবদারে একটা পাটভাঙা নতুন শাড়ি পরল পারমিতা। সিঁথি ভর্তি সিঁদুর পরে প্রণয়ের সাথে ড্রয়িংরুমে গেল। রেখা বসে বসে নিয়ম বলে দিল। প্রণয় ভাত কাপড়ের থালাটা পারমিতার হাতে তুলে দিল। পারমিতার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আজ থেকে তোমার সারাজীবনের ভাত কাপড়, সুখ-শান্তির দায়িত্ব আমি নিলাম পারমিতা। বিনিময়ে তুমি শুধু আমার মেয়েকে সারাজীবন মাতৃস্নেহে বড়ো করো।”
পারমিতার চোখ দিয়ে একফোঁটা নোনাজল মুক্তোর দানার মতো ঝরে পড়ল। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল পারমিতা।
যতই পারমিতার চেহারা হৈমন্তীর মতো হোক। তবে হৈমন্তী তো আর না। প্রণয়ের জীবনে এতগুলো দিন যে জায়গাটা হৈমন্তীর জন্য ছিল। আজকের পর থেকে সেই জায়গাটা পুরোপুরি পারমিতা দখল করে নিল। এই কথাটা মনে উদয় হতেই রেখার অদ্ভুত কষ্ট হলো। একদিন এমন করে হয়তো হৈমন্তীরও ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিয়েছিল প্রণয়। আজ কত সহজেই আবার নতুন করে পারমিতার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিল। আচ্ছা প্রণয়ের কি এখন আর হৈমন্তীর কথা একটুও মনে পড়ে না। যতই এই মেয়েটা হৈমন্তীর মতো দেখতে হোক। এই মেয়েটা তো আর হৈমন্তী না। সম্পূর্ণ অন্য একজন মানুষ। রেখা বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অসচেতন মনে শক্ত করে লাগাম টেনে ধরল। একটু আগে রেখার বড়ো বউমার সাথে ফোনে কথা হয়েছে। বড়ো বউমা তখন কি সব বলল। তখন থেকেই মূলত এইসব ভাবনা মাথায় কূট কূট করে কামড়াচ্ছে। আবার পারমিতার সহজ সরল মুখটা দেখলে সেই কুৎসিত ভাবনাগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। প্রণয় যেহেতু বিয়ে করেছে। সুখী হোক জীবনে। বিয়ে ছাড়াই বা আর কতদিন থাকতো ছেলেটা। রেখার আপন ছেলে হলে কি পারত ছেলেকে না বিয়ে দিতে। বরং আরও আগেই বিয়ে দিয়ে দিত। ওদের সুখের জীবনে রেখা কেন অশান্তির কারণ হবে। বড়ো বউমা টা একটু বেশি বেশিই বলে।
বিকালে প্রণয় জোর করে পারমিতা হিয়া, রেখা ও পরেশবাবুকে গাড়িতে করে ঘুরতে পাঠাল। সারা বাসায় ও একা রইল।
ওরা সবাই সন্ধ্যা ঘোর হতেই বাসায় ফিরে এলো। বাসায় এসে দেখল, প্রণয় পিসি নিয়ে বসেছে। শুধু পারমিতার সাথে বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হলো। দুজনেই লাজুক হাসল। রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই রেখা নাতনিকে বলল,
“দিদিভাই চলো, তুমি আজ আমার সাথে ঘুমাবে।”
হিয়ার মুখে হাসি। তবে মাথা নেড়ে দিদাকে না বলল। মায়ের একহাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমি মায়ের কাছে ঘুমাব।”
পারমিতা হেসে ফেলল। বলল,
“আমার হিয়ামণি আমার কাছেই ঘুমাবে। আপনি বরং গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
হিয়া মায়ের কথাটা চট করে ধরে ফেলল। বলল,
“তুমি দিদাকে আপনি বললে কেন মা? মেয়েরা কি মাকে আপনি বলে?”
পারমিতা হিয়ার গাল টেনে দিল। বলল,
“ওরে পাকা বুড়ি রে… তোমার দিদা তোমাকে কাছে নিয়ে ঘুমাতে চাচ্ছিল দেখেই তো আমি একটু রাগ দেখিয়ে আপনি বললাম তোমার দিদাকে।”
“কেউ রেগে গেলে কি তার সাথে আপনি করে কথা বলে মা?”
পারমিতা হিয়ার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“সবার রাগের ধরন আলাদা। তবে আমি রেগে গেলে আপনি করে বলি।”
“তুমি তো পাপাকেও আপনি করে ডাকো। তারমানে পাপার সাথেও তুমি রেগে আছো।”
“আমি ভীষণ রেগে আছি তোমার পাপার সাথে।”
“কেন রেগে আছো মা?”
“এই যে তোমার পাপা আরও আগে কেন তোমার কাছে আমাকে নিয়ে আসল না। আরও আগে আসলে তো আমার এত মিষ্টি একটা মেয়ের মুখে মা ডাক আরও আগে শুনতে পেতাম।”
“থাক বাবার ভুল হয়ে গেছে। বাবার সাথে আর রাগ করো না।”
ওদের মা-মেয়ের কথা শুনে, মুখ টিপে হেসে ফেলল প্রণয়। এই সুযোগে পারমিতার মুখ থেকে ‘তুমি’ ডাকটা আদায় করে নিতে হবে।
হিয়া ঘরে গিয়ে বলল,
“মা তুমি বিছানা রেডি করো। আমি বাথরুম থেকে আসি।”
পারমিতা বিছানা গোছাতে গিয়ে দেখল, বালিশের ভাঁজে একটা চিরকুট রাখা। কৌতূহলবশত চিরকুটের ভাঁজ খুলে পড়তে আরম্ভ করল পারমিতা। চিরকুটে লেখা,
“হিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে দুইপাশে কোলবালিশ দিয়ে দেবে। তারপর আলমারি খুলে দেখবে, প্রথম সারিতে একটা শাড়ির প্যাকেট রাখা আছে। শাড়িটা পরে পাশের ঘরে চলে আসবে। আমি অপেক্ষায় থাকব।”
প্রণয়…
পারমিতার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। লজ্জাও লাগছে খুব। মনের ভেতর অন্যরকম অনুভূতি। ততক্ষণে হিয়া চলে এসেছে। পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল হিয়া। বলল,
“পাপা এখনো আসছে না কেন?”
পারমিতা থতমত খেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“তোমার পাপা কাজ করছে। একটু পরে এসে যাবে। তুমি ঘুমাও।”
হিয়া কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল। পারমিতারও চোখটা লেগে এসেছিল। কাঁচা ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল পারমিতা। ফোনটা হাতে নিল। এই বাড়িতে আসার পর দিনই এই ফোনটা প্রণয় পারমিতাকে গিফট করেছে। প্রণয়ের ফোন। পারমিতা ফোন রিসিভ করল। প্রণয় গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“হিয়া এখনো ঘুমায়নি? তোমার আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন? আমি অপেক্ষা করছি তো।”
একরাশ ভালো-লাগায় পারমিতার মনটা ভরে গেল। আস্তে করে বলল,
“আমি আসছি।”
পারমিতা হিয়াকে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে আলমারি খুলে শাড়ির প্যাকেটটা বের করল। তারপর বাথরুমে চলে গেল। মাথায় শ্যাম্পু করে স্নান করল পারমিতা। মাথা মুছে, গামছা মাথায় পেঁচিয়ে ঘরে এসে শাড়িটা খুব যত্ন করে পরল পারমিতা। ভেজা চুলে সিঁথি করে মাথা ভর্তি চওড়া করে সিঁদুর পরল৷ কপালে বড়ো একটা লালটিপ পরল। হাতভর্তি চুড়ি পরে, পায়ে আলতা পরল। ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে গিয়েও কি মনে করে রেখে দিল। শুধু চোখে কাজল পরল। নিজেকে আয়নায় দেখে, খুব লজ্জা লাগছে। এইভাবে প্রণয়ের সামনে গিয়ে কীভাবে দাঁড়াবে পারমিতা। দুরুদুরু বুকে দরজা খুলে ধীর পায়ে হেঁটে গেল। যাওয়ার সময় ঘরের দরজাটা আস্তে করে বাইরে থেকে চাপিয়ে রেখে গেল। সারা বাড়ি নীরব নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। থেকে থেকে দেয়াল ঘড়ির ঘণ্টা বাজছে।
পারমিতা দরজায় আস্তে করে টোকা দিল। প্রণয় বোধহয় পারমিতার অপেক্ষাতেই ছিল। চট করে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। পারমিতাকে দেখে প্রণয়ের শরীর শিরশির করে উঠল। মুগ্ধ হয়ে পারমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
সৎবিং ফিরে পেয়ে পারমিতার ঠিক পেছনে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল প্রণয়। পারমিতার পিঠের সাথে প্রণয়ের বুক ঠেকে গেল। শরীর জুড়ে দুজনেই শিহরণ বয়ে গেল। নিঃশ্বাসের গতিবেগ বেড়ে গেছে। প্রণয়ের গরম উত্তপ্ত নিঃশ্বাস উপচে পড়ছে পারমিতার ঘাড়ে। প্রণয় একহাত দিয়ে পারমিতার চোখদুটো আলতো করে চেপে ধরল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“চলো আমার সাথে।”
(চলবে)
#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২০
পারমিতা বিস্ময় চেপে বলল,
“কোথায় যাব?”
প্রণয় পারমিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে গাঢ় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“স্বপ্নের বাসরে।”
পারমিতার সারা শরীর শিরশির করে উঠল।
প্রণয় পারমিতার চোখ বন্ধ করে কোথায় যেন নিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠল পারমিতা। প্রণয় আস্তে করে পারমিতার চোখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিল। বেশকিছুক্ষণ চোখ চেপে ধরে রাখার কারণে চোখে ঝাপসা দেখছে পারমিতা। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখদুটো ডলে নিল। চোখ তুলে ঘরের দিকে তাকাতেই অবাক বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল পারমিতা। প্রণয় এই কাণ্ড কখন করেছে। বুঝতে পারল না পারমিতা। ঘরটা কাঁচা ফুল দিয়ে এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। কাঁচা ফুলের সুন্দর সুভাসে চারপাশ মুখরিত। মোমদানিতে বড়ো একটা মোমবাতি জ্বলছে। মোমদানিটা বড়ো একটা জলের পাত্রে রাখা। জলের উপরে অজস্র গোলাপফুলের পাপড়ি ভেসে বেড়াচ্ছে। নিভু নিভু আলোতে ঘরের সৌন্দর্য শতগুণ বেড়ে গেছে।
প্রথম যেদিন এই বাড়িতে এলো। এই ঘরটায় পারমিতাকে থাকতে দিয়েছিল প্রণয়। সেই ঘরেই আজ ওদের বাসর সাজিয়েছে প্রণয়। প্রণয় তখনো পারমিতার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য নিচু হয়ে পারমিতার কাঁধে চিবুক রাখল। বলল,
“কি এত ভাবছ?”
“এই কাণ্ড কখন করেছেন?”
“তোমাদের ঘুরতে পাঠিয়ে লোক আনিয়ে করিয়েছি।”
“এসবের কি দরকার ছিল।”
“দরকার ছিল পারমিতা৷ প্রত্যেকটা মেয়েরই বিয়ে নিয়ে প্রচুর ফ্যান্টাসি ও স্বপ্ন থাকে। যে মুহূর্ত থেকে তোমার হাত ধরেছি। সেই মুহূর্ত থেকে তোমার সবকিছুর দায়িত্ব আমি নিয়েছি। তোমাকে আর কখনো আমি কষ্ট পেতে দেব না। জীবনে এতবেশি সুখী হবে তুমি। তোমার জীবনের খারাপ সময়ের কথা আর কখনো মনেই পড়বে না।”
পারমিতা চোখদুটো ছলছল করে উঠল। কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বলল,
“হিয়া একা আছে। ঘুম থেকে উঠে আমাকে না দেখতে পেলে খুঁজবে।”
“হিয়া সারারাতে আর উঠবে না।”
“যদি উঠে যায়। মেয়েটা ভয় পাবে তো।”
“বললাম তো হিয়ার ঘুম খুব গভীর। একবার ঘুমিয়ে পড়লে সারারাতেও তুমি ওকে ডেকে তুলতে পারবে না।”
পারমিতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে সারা ঘরে চোখ বুলাল৷ বলল,
“ঘরটা সাজানো খুব সুন্দর হয়েছে।”
প্রণয় পারমিতার চুলের ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে দিল। আবেশ জড়ানো কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,
“তোমার থেকে বেশি না।”
“কিছু বললেন?”
“না…”
প্রণয় পারমিতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে পারমিতার চোখের দিকে তাকাল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“আজ যদি তোমার কাছে কিছু চাই, দেবে আমাকে?”
“কি?”
প্রণয় নিচু কণ্ঠে বলল,
“তোমাকে আমি নিজের করে পেতে চাই পারমিতা।”
লজ্জায় চোখদুটো নিচের দিকে নামিয়ে নিল পারমিতা। শরীর কাঁপছে। মনটা খুব অশান্ত। প্রণয় পারমিতার একহাত টেনে নিল। পকেট থেকে একটা স্বর্ণের আংটি বের করে পড়িয়ে দিল পারমিতার বাম হাতের মধ্যেমা আঙুলে। তারপর গভীর ভাবে পারমিতার হাতের পাতায় চুমু এঁকে দিল। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল পারমিতা। প্রণয় বলল,
“তোমার নাকফুলটা খুলো?”
“আমি একা খুলতে পারি না।”
“আমি হেল্প করি?”
পারমিতা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। প্রণয় পারমিতার আর একটু কাছে চলে এলো। নাকফুলটা টেনে ধরে খুলতেই পারমিতা ব্যথায় চোখদুটো বুঁজে ফেলল। প্রণয় পকেট থেকে একটা ডায়মন্ডের নাকফুল বের করল। নাকফুলটা চিকচিক করছে। দেখতেও সুন্দর লাগছে। প্রণয় খুব যত্ন করে নাকফুলটা পারমিতার নাকে পরিয়ে দিল। তারপর দুইহাতে পারমিতার গাল আঁজলায় তুলে ধরে, কপালে চুমু খেয়ে বুকে টেনে নিল পারমিতাকে। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। পারমিতাও প্রণয়ের পিঠে হাত রেখে আঁকড়ে ধরল প্রণয়কে। পারমিতার নীরব সম্মতি পেয়ে প্রণয় আর একটুও দেরি করল না। চট করে কোলে তুলে নিল পারমিতাকে। পারমিতার কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিতেই আবেশে দুচোখ বুঁজে ফেলল পারমিতা।
প্রকৃতি আজ বড়ই অশান্ত। বোধহয় ঝড়বৃষ্টি হবে। জানালার ফাঁক গলে ঘরে বাতাস বইছে। জানালার পর্দা উড়ছে।বাতাসের তীব্রতায় মোমবাতি নিভু নিভু করছে। মোমবাতির নিভু নিভু আলোতে প্রণয় পারমিতাকে ভালোবেসে নিজের করে নিচ্ছে। মিশিয়ে দিচ্ছে অস্তিত্বের সাথে। বিচরণ করছে ভালোবাসার অন্য এক ভুবনে। যেখানে সুখ আছে, আনন্দ আছে, স্বস্তি আছে। নেই কোনো দুঃখ, কষ্ট।
ভালোবাসাবাসির চরম মুহূর্তে প্রণয় আবেগপ্রবণ হয়ে পারমিতাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে গাঢ় কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,
“হৈমন্তী.. আমার হৈমন্তী।”
চমকে উঠল পারমিতা। নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিল প্রণয়ের বাহুডোর থেকে। এই মানুষটা এতক্ষণ ঘোরের ভেতরে ছিল। পারমিতাকে হৈমন্তী ভেবেই বেসামাল হয়ে আদর করছিল। কি ভীষণ কান্না পেল পারমিতার৷ পারমিতাও তো ভালোবেসে অনিরুদ্ধকে বিয়ে করেছিল। একসাথে অনেকগুলো দিন থেকেছে। প্রণয়ের সদ্য করা আদরে একটুও তো মনে হয়নি। এটা প্রণয় নয় অনিরুদ্ধ। তাহলে এই মানুষটার কেন পারমিতাকে হৈমন্তী মনে হলো। মানুষটা কি এখনো ভুলতে পারেনি হৈমন্তীকে? নাকি পারমিতাকে হৈমন্তী ভেবে নিয়েছে? যতই ওদের একরকম চেহারা হোক। ওরা তো দুজন আলাদা একটা সত্তা। দুজনের মা আলাদা, জীবনধারা আলাদা। এমনকি কখনো দুজনের সামনাসামনি দেখাও হয়নি। তারপরও পারমিতার এত কেন খারাপ লাগছে? প্রণয়ের সবকিছুই তো পারমিতা মেনে নিচ্ছে। তাহলে এই বিষয়টা কেন মানতে পারল না? খুব সাধারণ একটা বিষয়। তারপরও পারমিতার এত কেন কষ্ট হচ্ছে? প্রণয়ের ঘোর কেটে গেল। হুঁশ ফিরতেই বলল,
“কি হলো?”
পারমিতা নিজেকে সামনে নিয়ে শাড়ি ঠিকঠাক করল। বলল,
“কিছু না। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আমি ঘুমাব।”
পারমিতা মিথ্যা করে বলল। প্রণয় আর পারমিতাকে বৈবাহিক সম্পর্কে যেতে জোর করল না। এখানেই থেমে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এখানেই ঘুমাও।”
পারমিতা উঠে যেতে যেতে বলল,
“না। সকালে হিয়া আমাকে না দেখলে অন্যকিছু ভাববে।”
পারমিতা চলে যেতে নিল। প্রণয় চট করে পেছন থেকে পারমিতার শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। বলল,
“তুমি কি কোনো কারণে আমার উপরে রাগ করেছ পারমিতা?”
পারমিতার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। কান্না গিলে ফেলে নিজেকে সামলে নিল। বলল,
“ না তো।”
“তাহলে এভাবে চলে যাচ্ছ কেন? এমন তো কথা ছিল না।”
“বললাম তো আমার মাথা ধরেছে।”
“আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে থাকলে সরি। আমি ইচ্ছে করে তখন হৈমন্তীর নাম ধরে ডাকিনি। তোমাদের চোহারা এতবেশি মিল। আমার তোমাকে দেখলে এখন আর মনেই হয় না হৈমন্তী মারা গেছে। মনে হয়, তুমিই হৈমন্তী। তাই তো তোমাকে বেখেয়ালে হৈমন্তী ডেকে ফেলেছি। বুঝতে পারিনি তুমি এত কষ্ট পাবে।”
মানুষটা পারমিতার মন খারাপের আসল কারণ ঠিক ঠিক ধরে ফেলেছে। ধরে ফেলবেই তো। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলে কথা। মানসিক টানাপোড়েন তো আর লোকটার চোখ থেকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না। পারমিতা ঘুরে দাঁড়াল। চোখ রাখল প্রণয়ের চোখে। বলব না বলব না করেও বলে ফেলল।
“যেদিন আমাকে মন থেকে পারমিতা বলে মেনে নিবেন। সেদিন আমার কাছে আসবেন। সেদিন আমার পুরো আমিটাকেই আপনার কাছে উৎসর্গ করে দেব।”
পারমিতা আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। চোখের জল মুছে হিয়ার কাছে ঘুমাতে চলে গেল। প্রণয় দুইহাতে মাথা চেপে ধরে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। মেয়েদের সাইকোলজি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না প্রণয়। পারমিতা হৈমন্তীর সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। এক ডেটে বিয়ে করতেও আপত্তি করেনি। অথচ সেই মেয়েটা তুচ্ছ একটা কারণে এত সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট করে দিয়ে অন্যঘরে চলে গেল। অথচ আজকের রাতকে ঘিরে প্রণয়ের কত আশা ছিল। হৈমন্তীর মৃত্যুর পর বছরের পর বছর একা থেকেছে প্রণয়। কখনো এতটা খারাপ লাগেনি। আজ পারমিতার প্রত্যাখান এতবেশি খারাপ লাগছে। বলার মতো না। অথচ পারমিতা চাইলেই আজকের রাতটা সারাজীবন মনে রাখার মতো একটা স্মরণীয় রাত হতে পারত। কেন পারমিতা প্রণয়কে বুঝে না? হেসে ফেলল প্রণয়। মাথা পুরো আউলিয়ে গেছে। এত অল্প সময়ে পারমিতা কীভাবে প্রণয়কে বুঝবে। পারমিতা তো আর হৈমন্তী না। হৈমন্তী… হৈমন্তী… হৈমন্তী। এই নামটা এতবেশি প্রণয়ের মাথায় ঘুরপাক খায়। সবসময় পারমিতার সাথে হৈমন্তীকে গুলিয়ে ফেলে প্রণয়। প্রণয় কি মনে করে ঘরটা বাইরে থেকে তালা মেরে হিয়ার কাছে চলে গেল। পারমিতা দরজাটা খুলে রেখেছে। প্রণয় ঘরে এসে দেখল, হিয়া ঘুমিয়ে আছে। পারমিতা হিয়ার একপাশে শুয়ে আছে। চোখদুটো বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি বুঝতে পারল না। প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিয়ার অন্যপাশে শুয়ে পড়ল। এককাত হয়ে সারাটা রাত পারমিতার ঘুমন্ত মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রণয়। এখন এই মুহূর্তে এই মেয়েটাকে কি ভীষণ কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। ইশ.. তা যদি এই মেয়েটা একটুখানি বুঝতো!
(চলবে)