#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২১
খুব ভোরে পারমিতার ঘুম ভেঙে হকচকিয়ে গেল। পাশ ফিরে দেখল, প্রণয় হিয়ার পাশে ঘুমিয়ে আছে। মানুষটা কখন এই ঘরে এসেছে জানে না পারমিতা। রাতের কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। অত মোহনীয় একটা রাত কিছুতেই নষ্ট করতে চায়নি পারমিতা। এত অল্প সময়ে প্রণয়কে মন থেকে স্বামী মেনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল প্রণয়ের কাছে। এত আবেগঘন মুহূর্তে হঠাৎ প্রণয়ের মুখে হৈমন্তীর নাম শুনে থমকে গিয়েছিল পারমিতা। ওই মুহূর্তে প্রণয়ের মুখে হৈমন্তীর নামটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। কেন মেনে নেবে পারমিতা। ও তো রক্তে-মাংসে গড়া একটা মানুষ। আবেগ অনুভূতি ওর তো আছে৷ প্রণয় হৈমন্তীকে যতই ভালোবাসুক। যতই প্রণয়ের মনের ঘরে বসত করুক হৈমন্তী। তাতে তো পারমিতার কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিয়েছে পারমিতা। পারমিতার শুধু একটা জায়গায় ঘোর আপত্তি। প্রণয় কেন পারমিতার সাথে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে হৈমন্তীর নাম ধরে করুণ স্বরে ডাকল। তখন কি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল পারমিতা। তা যদি প্রণয় একটুখানি বুঝত। পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। মাথার এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে পরিপাটি করে খোঁপা বেঁধে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শাড়ির কুঁচকে যাওয়া কুঁচি ঠিকঠাক করে পরল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখল, রেখা বসে আছে। পারমিতাকে দেখে কাছে ডাকল। বলল,
“হিয়া দিদিভাই কি ঘুমে?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি স্নান করেছ?”
পারমিতা লজ্জা পেল। নিচু কণ্ঠে বলল,
“না।”
“স্নান করে নাও। তারপর একসাথে বসে চা খাব। নাকি আগে চা খেয়ে নেবে?”
“না..না। আগে স্নান করব তারপর..”
পারমিতা চলে গেল। রেখা পিছু ডেকে বলল,
“প্রণয় এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি?”
“না।”
“আচ্ছা যাও। তুমি স্নান করে আসো।”
পারমিতা স্নান করে ঘরে এসে দেখল, প্রণয় ঘুম থেকে ওঠে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। পারমিতা ভেজা গামছা মাথা থেকে টেনে খুলে ফেলল। সদ্য ভেজা চুলগুলো দিয়ে টপটপ করে জল ঝরছে। প্রণয় আয়নার দিকে তাকিয়ে একপলক পারমিতাকে দেখল। পারমিতাও বেখেয়ালে আয়নার দিকে তাকাল। দুজনের চোখে চোখ পড়তেই প্রণয় চোখ সরিয়ে নিল। প্রণয়ের মুখটাও মলিন। পারমিতার খারাপ লাগছে খুব। তবে কথা বলল না। আস্তে করে সরে গেল। বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু কণ্ঠে হিয়াকে ডাকতে লাগল পারমিতা। হিয়া উঠল না। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। পারমিতা আর ডাকল না। মাথা আছড়ে মুখে সানস্ক্রিন মেখে, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর পরল। কপালের মাঝখানে একটা লালটিপ পরে চা বানাতে চলে গেল। রান্নাঘরে কাজের মাসি সকালের জলখাবার বানাচ্ছে। পারমিতা দুইকাপ চা নিয়ে বসার ঘরে চলে গেল। রেখা তখনো বসে আছে। সামনে টেলিভিশন ছাড়া। তবে টেলিভিশন দেখছে না। অন্যদিকে তাকিয়ে কি যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছে।
“আপনার চা?’’
পারমিতার ডাকে রেখার ধ্যান ভাঙল। মুখে হাসি টেনে বলল,
“ বসো।”
পারমিতা রেখার পাশে বসল। রেখা চায়ে চুমুক দিল। বলল,
“চা’টা দারুণ হয়েছে। কে করেছে, তুমি?”
“হ্যাঁ।”
রেখা নড়েচড়ে বসল৷ বলল,
“কিছু মনে না করলে তোমাকে একটা কথা বলি পারমিতা?”
“বলুন।”
রেখা একপলক দরজার দিকে তাকাল। না কেউ আসছে না। ইতস্তত করে বলল,
“হিয়া দিদিভাই বড়ো হচ্ছে। ওর বিছানা আলাদা করে দিও পারমিতা। এতবড়ো মেয়েকে নিয়ে একসাথে ঘুমানো ঠিক না।”
এই কথার কি উত্তর দেবে, ভেবে পেল না পারমিতা। হিয়াটা পারমিতাকে ছাড়া ঘুমাতেই চায় না। আলাদা ঘরে শোবার কথা শুনলে প্রচণ্ড মন খারাপ করবে মেয়েটা। হয়ত পারমিতাকে ভুল বুঝবে।
রেখা জড়তা কাটিয়ে বলল,
“বুঝতেই তো পারছ, এখনকার ছেলেমেয়ে। অল্পতেই সব বুঝে যায়।”
মায়ের বয়সী একজন মানুষের সাথে এইসব ব্যাপারে কথা বলতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। পারমিতা বলল,
“হিয়া একা ঘুমাতে পারে না।”
“একা তো ঘুমাতে বলছি না। তুমি বরং ওর খাট আলাদা করে দিবে। ও যতক্ষণ জেগে থাকে তখন নাহয় একসাথে ঘুমালে। ও ঘুমিয়ে পড়লে তোমরা দুজন আলাদা খাটে ঘুমাবে।”
“ওনাকে বলতে হবে।”
রেখা পারমিতার একহাত আলতো করে ধরল। বলল,
“আমার কথায় কিছু মনে করো না পারমিতা। যতই হিয়া তোমাকে মা বলে জানুক। আমি তো জানি, তোমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। এই সময় এত বড়ো মেয়েকে নিয়ে একসাথে ঘুমানো ঠিক না।”
পারমিতা চুপ করে রইল। প্রণয় স্নান করে রেডি হয়ে এলো। রেখা বলল,
“হিয়া এখনো ঘুম থেকে উঠেনি?”
প্রণয় বলল,
“না।”
রেখা বলল,
“পারমিতা তুমি হিয়াকে ঘুম থেকে তুলে দাও।”
পারমিতা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ঘরে চলে গেল। হিয়াকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে, ফ্রেশ হতে বাথরুমে পাঠালো। একফাঁকে পারমিতা চট করে বিছানা গুছিয়ে ফেলল।
একসাথে সবাই জলখাবার খেতে বসল। গতকাল রাতের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রণয় একটাও কথা বলেনি পারমিতার সাথে। শুধু কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে। পারমিতাও কথা বলেনি। প্রণয় অন্যমনস্ক হয়ে খাবার খেলো। তারপর ব্যাগ আনতে ঘরে চলে গেল। প্রণয়ের বাবাও খেয়ে উঠে গেল। রেখা হিয়াকে বলল,
“দ্যাখো তো দিদিভাই তোমার পাপা কোথায় গেল?”
হিয়া একছুটে পাপার কাছে চলে গেল। ড্রাইনিং টেবিল ফাঁকা হতেই রেখা পারমিতার মলিণ মুখের দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”
পারমিতা মাথা নেড়ে বলল,
“কিছু না।”
“বলো আমাকে। গতকালও সবকিছু ঠিক ছিল। একরাতে কি এমন হলো ; যে দুজন দুজনের সাথে ভুলেও কথা বলছ না। চোখে চোখ পড়লে চোখ সরিয়ে নিচ্ছো।”
রেখার বিচক্ষণ চোখ ফাঁকি দিয়ে পারেনি ওরা। পারমিতার খুব হতাশ লাগছে। কি’বা বলবে। এসব গোপন কথা কি কাউকে বলা যায়।
“কি হলো পারমিতা?”
“কিছু না মা।”
হঠাৎ পারমিতার কণ্ঠে ‘মা’ ডাক শুনে থমকে গেল রেখা। চোখদুটো আবেগে ছলছল করে উঠল। পারমিতার মাথায় হাত রেখে মন ভরে আশীর্বাদ করল। বলল,
“স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখী হও।”
পারমিতা রেখার পায়ে হাত রেখে প্রণাম করল। রেখা বুকে জড়িয়ে নিল পারমিতাকে। পারমিতার মাথায় চুমু খেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“কতদিন পর আমার হৈমন্তীর মতো কাউকে জড়িয়ে ধরলাম। এই মেয়েটাকে তুমি সুখী করো ঠাকুর।”
পারমিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
“মা একটু ঘরে আসো তো।”
রেখা বলল,
“হিয়া দিদিভাই তোমাকে ডাকছে। যাও..
পারমিতা চলে গেল। ঘরে গিয়ে দেখল,
হিয়া খাটে পা দুলিয়ে বসে আছে। প্রণয় হিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাগ গুছাচ্ছে। পারমিতা হিয়ার কাছে গিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“কি হয়েছে হিয়ামণি?”
“তুমি পাপার সাথে কথা বলছ না কেন?”
পারমিতা চোখ গোল গোল করে হিয়ার দিকে তাকাল। বলল,
“এই কথা কে বলেছে তোমাকে?”
“পাপা বলেছে।”
পারমিতা প্রণয়ের দিকে তাকাল। প্রণয় ভুলেও ওদের দিকে তাকাল না। নিজের কাজ খুব মনোযোগ দিয়ে করতে লাগল। পারমিতার রাগ লাগছে খুব। এইকথা হিয়াকে কেন বলতে হবে। মানুষটার কি বুদ্ধি সুদ্ধি লোভ পেয়েছে। পারমিতা অভিমানী কণ্ঠে বলল,
“তোমার পাপাও তো আমার সাথে কথা বলছে না।”
হিয়া বলল,
“পাপা তোমার উপরে অভিমান করেছে।”
পারমিতা অস্ফুট স্বরে বলল,
“কি করেছি আমি?”
“পাপাকে ‘তুমি’ বলে ডাকো না কেন? এখন থেকে পাপাকে তুমি বলে ডাকবে।”
“আমি পারব না।”
হিয়া বড়োদের মতো বলল,
“পাপা নাহয় একটা ভুল করেই ফেলেছে। পাপাকে আর কষ্ট দিও না। দরকার পড়লে এখুনি সরি বলবে পাপা। পাপা… মাকে সরি বলো?”
প্রণয় পারমিতার সামনে এসে দাঁড়াল। পারমিতার চোখে চোখ রেখে বলল,
“সরি আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন ভুল হবে না। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।”
হিয়া পাশ থেকে বলল,
“একটা কান ধরলে বেশি সুন্দর হতো পাপা।”
প্রণয় সাথে সাথে নিজের একটা কান চেপে ধরল। বাপ-মেয়ের কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল পারমিতা। হাসিটা গিলে ফেলে অন্যদিকে তাকাল। হিয়া বলল,
“পাপা সরি বলেছে। এখন তুমি পাপাকে তুমি করে বলো?”
পারমিতা আপনমনে বিড়বিড় করে বলল,
“মেয়েকে এর ভেতরে ভালোই ট্রেনিং দিয়ে ফেলেছে। বলব না আমি ‘তুমি’ করে। মুখে বলল,
“পরে বলব হিয়ামণি।”
হিয়া অনুরোধ করে বলল,
“প্লিজ মা প্লিজ.. পাপাকে তুমি করে বলো। নাহলে পাপা খুব মন খারাপ করবে। কাজে একটুও মন বসবে না পাপার।”
“তোমার পাপা কাজ থেকে ফিরে আসুক। তারপর তুমি করে বলব।”
প্রণয় হিয়াকে বলল,
“তোমার মাকে প্রমিস করতে বলো।”
হিয়া বলল,
“মা প্রমিস করো পাপার হাতে হাত রেখে।”
হিয়া বলতে বলতে প্রণয় চট করে পারমিতার একহাত ধরে ফেলল। কেঁপে উঠল পারমিতা। প্রণয় গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“মেয়ে সাক্ষী রইল কিন্তু।”
প্রণয় মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল,
“বউ ‘আপনি’ করে ডাকলে কেমন অস্থির অস্থির লাগে। আর কথা না বললে তো দুনিয়া অন্ধকার।”
পারমিতা মুখটিপে হেসে ফেলল। মানুষটাকে যতটা কাটখোট্টা মনে হয়েছিল। মানুষটা সম্পূর্ণ তার বিপরীত।
বিষণ্ণ দুপুর। অসহ্য গরমে টেকা মুশকিল। হিয়াকে খাইয়ে ভাতঘুম পাড়িয়ে নিজেও হিয়ার পাশে শুলো। এখন আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। অবশ্য কাজ না করলেও চলে। তবুও চোখে দেখে কাজ না করলে নিজের কাছেই কেমন যেন লাগে। আজ গরম পড়েছে প্রচুর। অসলতা শরীরে বাসা বেঁধেছে। উঠে গিয়ে কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করছে না। পারমিতার সবে চোখটা লেগে এসেছিল। তখনি সেলফোনটা তারস্বরে বেজে উঠল। পারমিতার তন্দ্রা ভাব ছুটে গেল। হাত বাড়িয়ে ফোনটা কাছে টেনে নিল। স্ক্রীনে অপরিচিত নম্বর। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। আবারও বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করে কানে চেপে ধরল পারমিতা। ফোনের অপাশে অনিরুদ্ধর কণ্ঠ শুনে রাগে শরীর চিড়বিড়িয়ে উঠল। ফোনটা কেটে দিতে চাইল। অনিরুদ্ধ বলল,
“ফোন কেটো না পারমিতা। তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আছে।”
পারমিতা দাঁত চেপে বলল,
“আমার তোমার সাথে কোনো কথা নেই। ভুলেও আর কখনো আমাকে ফোন দেবে না।”
“আমি তোমার দাদার খোঁজ পেয়েছি পারমিতা।”
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল পারমিতা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“দাদা আর এইদেশে থাকে না। তুমি খোঁজ পেলেই বা কি!”
“ভুল জানো তুমি। তোমার দাদা এই দেশেই থাকে। তুমি চাইলে আমি তোমাকে তোমার দাদার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারি।”
(চলবে)
#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২২
“অসম্ভব।”
অনিরুদ্ধ বলল,
“অসম্ভব না। তুমি একবার এসেই দেখো।”
“কোথাও যাব না আমি।”
“একবার তোমার দাদার মুখোমুখি দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না? জানতে ইচ্ছে করে না ওনি কেন তোমাকে ঠকিয়েছে, প্রতারণা করেছে তোমার সাথে। কেন তোমাকে বঞ্চিত করেছে।” অনিরুদ্ধ ইমোশনালি কথাগুলো বলল। পারমিতা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। অনিরুদ্ধ মিথ্যা কথাও তো বলতে পারে। তবে মনে হচ্ছে না অনিরুদ্ধ মিথ্যা বলছে। পারমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“বেশ ঠিকানা দাও। আমি নিজে গিয়ে দেখে নেব।”
“আমি নিয়ে গেলে কি সমস্যা?”
“আমার বর থাকতে তোমার সাথে যাব কেন?”
“পারমিতা…”
“তোমার যদি এতই দরদ উথলে উঠে ঠিকানাটা আমাকে দাও। আমি সময় করে গিয়ে দেখে নেব।”
“তোমাকে ঠিকানা দিলে আমার কি লাভ?”
“ঠিকানা যখন দেবে না ফোন দিয়েছ কেন? আর শোনো অনি এখন আমার স্বামী-সন্তান সংসার আছে। ওর মতো প্রতারক দাদা আমার আর লাগবে না। আমি আর কখনো ওর মুখোমুখিও হতে চাই না। ও বা যারা আমার এই অবস্থা করেছে। একদিন এরথেকেও শতগুণ ভয়ানক অবস্থা ওর বা ওদের হবে। আর একটা কথা ময়লা বেশি ঘাটলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। আমি আর নতুন করে ময়লায় হাতই দিতে চাচ্ছি না।”
“তুমি শুধু অভিশাপ দিতেই জানো!”
পারমিতা অতি দুঃখে হেসে ফেলল। বলল,
“বাহ্…তোমরা একেকজন অভিশাপের কাজ করবে আর আমি দিলেই দোষ। আর কখনো আমাকে ফোন দেবে না। এবার যদি ফোন দাও। প্রমাণসহ তোমার বর্তমান বউকে বলে তোমার সংসারে অশান্তি লাগিয়ে দেব। শুধু আমি একাই জ্বলব কেন! যে যে আমার অশান্তির কারণ হবে তাদের সবাইকে একে একে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেব।”
কথাগুলো বলেই ফোনের লাইন কেটে দিল পারমিতা। তারপর অনিরুদ্ধর নম্বর ব্লক লিস্টে ফেলে রাখল।
ঘুমন্ত হিয়ার দিকে চোখ পড়তেই ধীর পায়ে এগিয়ে গেল পারমিতা। হিয়ার মাথায় আলতো করে বিলি কেটে দিয়ে বলল,
“এখন থেকে আমি আর অতীতের কথা ভাবব না। আমার বর্তমান নিয়ে সুখে থাকব। ভীষণ সুখে থাকব।”
পারমিতা হিয়ার কপালে চুমু এঁকে দিল। মেয়েটা যখন মা বলে ডাকে। তখন কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। এই মুহূর্তের জন্যও মনে হয় না। এই মেয়েটা অন্যকারো গর্ভে জন্ম নিয়েছে। শুধু মনে হয় ও পারমিতার মেয়ে। সুখে থাকার জন্য খুব বেশিকিছুর প্রয়োজন নেই। মানসিক শান্তিটাই বড়ো। তবে মনের ভেতর খচখচ করছে। একবার দাদার সাথে দেখা করতে পারলে ভালো হতো। দেখা হলে দাদার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করত কেন পারমিতাকে এভাবে ঠকাল। দাদা যদি বলত, পারমিতা হাসিমুখে সব সম্পত্তি দাদার নামে লিখে দিত। আচ্ছা মানুষ সম্পদ কতদিন ভোগ করতে পারে? ষাট, সত্তর, আশি অথবা একশো বছর। তারপর তো মরে যেতেই হবে। যদি কেউ বেঁচে থেকে সারাজীবন সম্পদ ভোগ করতে পারত। তাহলে নাহয় পৈতৃক সম্পদ নিয়ে এত কাড়াকাড়ি মেনে নেওয়া যেত। তা তো হবে না। প্রতিটা মানুষকেই নিদিষ্ট একটা সময়ে মরতে হবে। কেউ অমর না, এই পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকবে না। তবুও মানুষ কেন মানুষকে ঠকায়? প্রতারণা করে?
পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ব্যালকনিতে গিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। অলস দুপুর। ব্যালকনির মেঝেতে রোদ্দুর গাছের ছায়ার সাথে খেলা করছে। ব্যালকনি থেকে কয়েকহাত দূরে একটা বড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সারা গাছ লাল রঙা ফুলে ছেয়ে আছে৷ কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে কতগুলো চড়ুই পাখি বসে কিচিরমিচির করছে। পারমিতার সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তন্দ্রা ভাব এসে গেল। রেখা কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে ঠিক পায়নি পারমিতা। রেখা পারমিতার মাথায় হাত রাখল। বলল,
“শরীর খারাপ?”
পারমিতা মুখ তুলে রেখার দিকে তাকাল। বলল,
“না।”
“আজ আমার বড়ো বউমা রনিতা আসবে।”
“তাহলে তো ভালো-মন্দ কিছু রাঁধতে হবে।”
“এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। ওর আসতে আসতে সন্ধ্যা বা রাত হবে।”
“একাই আসবে?”
“হ্যাঁ। আমাকে নিতে আসবে আর তোমাকে দেখতে আসবে।”
পারমিতা বিনয়ের স্বরে বলল,
“আপনি আর কিছুদিন থাকুন। চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে।”
“দেখি বড়ো বউমা থাকে নাকি। ও থাকলে আরও কিছুদিন থাকব ইচ্ছে আছে।”
দুজন বেশকিছুক্ষণ গল্প করে রেখা মালা জপতে চলে গেল। আর পারমিতা রান্নাঘরে চলে গেল।
হৈমন্তীর বড়ো বউদি খুব গায়ে পড়া স্বভাবের। এসে থেকেই পারমিতাকে পরখ করে দেখল। তারপর গল্প করার বাহানায় পারমিতাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে একথা সেকথা বলতে বলতে নিচু কণ্ঠে বলল,
“প্রণয় তোমাকে বিছানায় কেমন সুখ দেয়?”
অস্বস্তিতে পারমিতার সারা গা কাটা দিয়ে উঠল। এই মহিলা এমন কেন? এই কথার কি উত্তর দেবে তাই তো পারমিতা বুঝতে পারছে না। রনিতা অবশ্য উত্তরের অপেক্ষাও করল না। আবার নতুন করে প্রশ্ন করল।
“সুখ রাতে কি দিল ও তোমাকে? শুধু সুখই দিয়েছে নাকি অন্যকিছুও দিয়েছে। তুমি তো একদম হুবহু হৈমন্তীর মতো দেখতে। তোমাকে আদর করতে করতে হয়ত প্রণয় হৈমন্তীর আসল সত্তাকেই ভুলে গেছে।”
এই মহিলার কথাবার্তা সুবিধার না। লুচ্চার ফিমেল ভার্সন এই মহিলা। মুখে কিছুই আটকাচ্ছে না। অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে কীভাবে কতটা ভদ্রতা মেইনটেইন করে কথা বলতে হয় তাও বোধহয় জানে না মহিলা। জ্ঞানের অভাব। এর সাথে কথা বলতেও রুচি হচ্ছে না। এই ডেঞ্জারাস মহিলার কথার হাত থেকে বাঁচতে কাজ আছে বলে পারমিতা পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
রাতে প্রণয় বাড়িতে ফিরে রনিতাকে দেখে মুখ কালো করে ফেলল। এই মহিলা এখানে আসাতে প্রণয় যে খুশি হয়নি। প্রণয়ের চেহারা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে। এই মহিলাকে দেখে প্রণয়ের এত অখুশি হওয়ার কারণ কি হতে পারে তাই তো বুঝতে পারল না পারমিতা। রাতে সবাই একসাথে খেতে বসল। রনিতা প্রণয়ের মুখোমুখি বসেছে। পারমিতা সবার পাতে খাবার বেড়ে দিয়ে হিয়াকে খাওয়াতে লাগল। হঠাৎ রনিতার দিকে চোখ পড়তেই দেখল রনিতা প্রণয়ের দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। পারমিতাকে দেখে চোখ সরিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল রনিতা।
খাওয়া শেষ করে একে একে সবাই উঠে চলে গেল। শুধু পারমিতা একা খাচ্ছে। প্রণয় পারমিতাকে সঙ্গ দিতে বসে আছে৷ ওদের বসে থাকতে দেখে রনিতা হাত ধুয়ে আবারও খাবার টেবিলে গল্প করার বাহানায় এসে বসল। প্রণয়কে বলল,
“তুমি না আগে খুব টেলিভিশন দেখতে। চলো আজ দেখি।”
“আমার আগামীকাল ডিউটি আছে। এখন ঘুমাব।”
“আরেহ্.. থাকুক ডিউটি আমি কি সারারাত তোমাকে জাগিয়ে রাখব নাকি?”
হিয়া বলল,
“বাবা আমি ঘুমাব।”
প্রণয় হিয়াকে কোলে তুলে নিল৷ ঘরে যেতে যেতে বলল,
“পারমিতা তুমি বরং আস্তেধীরে খেয়ে আসো। আমি এই ফাঁকে হিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে দেই।”
রনিতাও আর বসে থাকল না। একটা বাহানা খুঁজে প্রণয়ের পিছু পিছু চলে গেল।
হিয়া ঘুমিয়ে পড়তেই প্রণয়ের ঘরে গিয়ে গা ঘেষে বসল রনিতা। প্রণয় সরে যেতে চেয়েও পারল না। রনিতা চোখ রাঙিয়ে ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল,
“রাতে আমি বসার ঘরে অপেক্ষা করব। তুমি যদি না আসো তাহলে পারমিতাকে তোমার ব্যাপারে বলে দেব।”
প্রণয় আগুন চোখে রনিতার মুখের দিকে তাকাল। রনিতা হেসে ফেলল। তারপর বসা থেকে উঠে হেলেদুলে চলে গেল। পারমিতা ঘরে এসে দেখল, হিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রণয় পাশে আধশোয়া হয়ে ফোনে মুখ গুঁজে বসে আছে। পারমিতাকে দেখে ফোন রেখে দিল প্রণয়। বলল,
“ওই মহিলা কখন এসেছে?”
“সন্ধ্যায়।”
“ওই মহিলাকে একদম পাত্তা দেবে না তুমি। আর ভুলেও হৈমন্তীর মাকে থাকার জন্য রিকুয়েষ্ট করবে না। ওই মহিলা ডেঞ্জারাস। মানে মানে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই মঙ্গল।”
পারমিতা সরল মনে বলল,
“হ্যাঁ কথাও বলে যেন কেমন কেমন করে।”
প্রণয় কৌতূহলী হয়ে বলল,
“কি বলেছে?”
“আমি বলতে পারব না। মেয়েলি ব্যাপারে।”
প্রণয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল,
“ওহ্..”
তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই পারমিতার একহাত ধরে ফেলল প্রণয়। পারমিতাকে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। দুজন খুব কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। প্রণয় পারমিতার কপালে কপাল ঠেকিয়ে দুইগাল আঁজলায় তুলে ধরল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“মেয়ের সামনে কি প্রমিস করেছিলে।”
“কি?”
“ভুলে গেছো?”
“মনে নেই।”
প্রণয় আবেগঘন কণ্ঠে বলল,
“আমাকে আজ থেকে তুমি করে ডাকার কথা ছিল।”
পারমিতা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। প্রণয় পারমিতার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। বলল,
“বলবে না?”
“পরে।”
“কবে?”
“জানি না।”
“তুমি কিন্তু প্রমিস করেছিলে।”
“আমার ঘুম পাচ্ছে।”
“থাক বলতে হবে না।” প্রণয়ের কণ্ঠে স্পষ্ট অভিমান।
(চলবে)