বেলাশেষে পর্ব-২৫+২৬

0
21

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৫

সকালে পারমিতা স্বাভাবিক ভাবেই রনিতার সাথে কথা
বলল। যেন গতকাল রাতে কিছুই হয়নি। প্রণয় হাসপাতালে চলে গেছে। হিয়াকে খাবার খাইয়ে রেডি করে প্রণয়ের বাবার সাথে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছে পারমিতা। সারাবাড়িতে এখন ওরা তিনজন। পারমিতা রনিতা ও রেখা। রেখার কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে। সকালের জলখাবার খেয়ে ঘরে শুতে চলে গেছে। পারমিতা টুংটাং শব্দ তুলে এঁটো থালাবাটি গুছিয়ে রাখছে। কাজের মাসি ছুটিতে গেছে। আজ আসার কথা। না এলে এই কাজগুলো পারমিতাকেই করতে হবে। পারমিতা থালাবাটি গুলো বেসিনে রেখে এলো। রনিতা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে বসে টেলিভিশন দেখছিল। পারমিতাকে এইদিকে আসতে দেখে বলল,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“দেখে আসি হিয়ার দিদা কি করে।” রনিতার সামনে হৈমন্তীর মাকে মা বলে ডাকল না পারমিতা। রনিতা পারমিতার একহাত ধরে পাশে বসিয়ে দিল। বলল,
“বসো একটু। তোমার সাথে গল্প করি।”
“আগে হিয়ার দিদার ঘর থেকে ঘুরে আসি। তারপর আপনার সাথে গল্প করব।”
“আরেহ বসো তো। পরে যেও।”
পারমিতা বলল,
“কিছু বলার থাকলে বলুন?”
“বলবই তো। প্রণয় খুব সুন্দর করে আদর করতে পারে তাই না? একবার যে প্রণয়ের সাথে থাকে, সে জীবনেও প্রণয়কে ভুলতে পারবে না।”
“সাথে থাকে বলতে কি বোঝাতে চাচ্ছেন আপনি?”
রনিতা কেমন করে যেন হাসল। নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“আরেহ্…বুঝতে পারছ না? ওইসব কথা বলছি।”
পারমিতা সরাসরি বলল,
“অভিজ্ঞতা আছে নাকি?”
এবারও হাসল রনিতা। মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা গেল না। উত্তর হ্যাঁ না না। পারমিতা রনিতাকে আর একটু বাজিয়ে দেখতে বলল,
“বলুন সমস্যা নেই। যদিও আমার প্রণয়ের সাথে ঝগড়া চলছে।”
“কেন কেন? ঝগড়া করেছ কেন?” রনিতা খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল। পারমিতা বলল,
“গতকাল রাতে ঘুম ভেঙে দেখলাম, প্রয়ণ ঠিক এইখানটায় দাঁড়িয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সত্যি করে বলুন তো আপনার ভেতরে ঠিক কি চলছে?”
হঠাৎ রনিতার মুখটা চুপসে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি যখন জেনেই ফেলেছো আর কিছু লুকাব না। যদিও প্রণয় আমাকে বলতে বারণ করেছে। আমি একটা মেয়ে হয়ে তোমার সর্বনাশ করতে পারব না। তাই বলছি, হৈমন্তী মারা যাওয়ার পর আমি হিয়াকে দেখাশোনা করার জন্য বেশকিছু মাস এই বাড়িতে ছিলাম। সদ্য বউ মরা অল্প বয়েসী পুরুষমানুষ বুঝোই তো… আমার সাথে প্রথম প্রথম জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করতো প্রণয়। ডাক্তার মানুষ। বুদ্ধির তো শেষ নেই। আমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও আমাকে না জানিয়ে কখন ধারণ করেছে। আমি জানি না। যখনই তার ডাকে আমি সারা না দিতাম। আমার সংসার ভাঙার ভয় দেখিয়ে আমাকে রাজি করাতো। প্রণয়ের ভয়ে আমি এই বাড়িতে একদম আসতে চাইনি বিশ্বাস করো। শাশুড়ী মা বলল তুমি নাকি হুবহু দেখতে আমাদের হৈমন্তীর মতো। তাই তোমাকে দেখতে চলে এসেছি। তুমি শুনলে বিশ্বাস করবে নাকি জানি না পারমিতা। হৈমন্তী আমার নিজের বোনের মতো ছিল। ওর জীবনে এমন কোনো ঘটনা নেই যা আমি জানি না। আমি ওকে খুব স্নেহ করতাম। মন্দের ভালো ও বেঁচে থাকতে আমার সাথে কিছু করেনি প্রণয়। তাহলে আমি হয়ত আত্মহত্যাই করে ফেলতাম। এতগুলো দিন পর এখানে এসেছি। ভেবেছি প্রণয় নতুন বউ পেয়ে একটু শুধরেছে। কিন্তু না। আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ও একটুও শুধরায়নি। গতকাল রাতে ও আমাকে ভয় দেখিয়ে জোর পূর্বক আমার সাথে… কথাগুলো বলেই রনিতা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
পারমিতার খুব ক্লান্ত লাগছে। একটা মানুষ কীভাবে এতগুলো মিথ্যাকথা অকপটে বলে দিতে পারে। ওনার কি একটুও বুক কাঁপে না? পারমিতা বলল,
“হৈমন্তীর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েই ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন আপনি, তাই না?”
“তুমি আমাকে ভুল বুঝছ পারমিতা। আমি হয়ত তোমাকে বুঝাতে পারিনি।”
“চুপপপ…আর একটাও কথা বলবেন না আপনি। আপনার মতো কালসাপকে আমি গতকাল রাতেই চিনে ফেলেছি। অন্যের জামাইকে কীভাবে বিশেষ কায়দায় শরীর দেখিয়ে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে হয়। আপনাদের মতো বাজারি মেয়েদের বেশ জানা আছে।”
“ঠিক ভাবে কথা বলো। নিজের জামাই সামলে রাখতে পারো না। আবার আমাকে বড়ো বড়ো কথা শোনাচ্ছ।”
“আর একটা কথা বললে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এখুনি বাড়ি থেকে বের করে দেব। অভদ্র মহিলা।”
“এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না। তুমি আমাকে চোখ রাঙাচ্ছ। আসুক আজ প্রণয়! তোমার নামে নালিশ দেব আমি।”
“প্রণয় বাসায় আসার আগে আপনাকে বাড়ি থেকে বের করব আমি।”
“এটা আমার ননদের বাসা। তুমি কে এই বাসা থেকে আমাকে বের করার।”
“আমি আপনার ননদের সতীন। আর আপনার ননদের অবর্তমানে এই বাসার একমাত্র মালকিন আমি।”
“তাই নাকি! দুদিনের বউ তার আবার এত বড়ো বড়ো কথা।”
“আমার মুখ ছুটাবেন না। পরিণতি খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।”
“দাঁড়াও মাকে ডাকি। তুমি আমাকে কি কি বলে অপমান করেছ সব মাকে বলে দেব।”
পারমিতা হেসে ফেলল। বিদ্রুপের হাসি। বলল,
“ডাকুন প্লিজ..তারও জানা উচিত এতদিন আপনার মতো বিষাক্ত বউ নিয়ে ঘর করেছে তারা।”
“মা…মা একবার বসার ঘরে আসুন প্লিজ….প্রণয় এ কাকে বিয়ে করে এনেছে। তখন থেকে আমাকে যা-তা বলে অপমান করছে।”
রনিতার চিৎকার শুনে রেখা হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এলো। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে ওনি। ভীতু কণ্ঠে বলল,
“কি হয়েছে বড়ো বউমা? এভাবে চিল্লাচ্ছ কেন?”
রনিতা কেঁদে ফেলল। বলল,
“এই মেয়েটার ব্যবহার খুব খারাপ মা।”
“কেন কি করেছে, পারমিতা?”
“আমি শুধু বলেছিলাম, বসো আমার পাশে দুটো গল্প করি। আমাদের হৈমন্তী হুবহু তোমার মতো দেখতে ছিল। তোমাকে দেখলেও শান্তি লাগে। হৈমন্তীটা আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। তোমার কথা শুনে আমি একপলক দেখার জন্য ছুটে এসেছি। হৈমন্তীর শেষ চিহ্ন আমাদের ছোট্ট হিয়া। ওকে তুমি কখনো কষ্ট দিও না। সবসময় মাতৃস্নেহে আগলে রেখো।”
আমার কথাগুলো শুনে এই মেয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে। বলেছে, তার ঠেকা পড়েছে নাকি সতীনের মেয়েকে আগলে রাখবে। পারবে না সে। আর আমরা যেন ঘন ঘন এই বাড়িতে না আসি। তার অসুবিধা হয়। হিয়ার জন্য এত দরদ উথলে উঠলে হিয়াকে যেন সাথে করে নিয়ে যাই।”
পারমিতা রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে থরথর করে কাঁপছে। দুচোখ ফেটে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। বহুকষ্টে চেষ্টা করেও নিজেকে সংযত করতে পারল না। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে রনিতার গালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দিল। রেখা চমকে উঠল। মুখে হাত চেপে ধরে বড়ো বড়ো চোখ করে পারমিতার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইল। হুঁশ ফিরতেই বলল,
“পারমিতা…একদিনে এত অধঃপতন তোমার ছিঃ…”
পারমিতা রেখার দিকে ফিরেও তাকাল না। তীব্র
আক্রোশে রনিতাকে বলল,
“আর একটা মিথ্যা কথা বললে তোর জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব খারাপ মহিলা।”
রনিতা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। রেখার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখলেন তো মা এই মেয়েটা আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আমার গালে থাপ্পড় মারল। কি অপরাধ করেছি বলুন তো মা? এই মেয়ে আমাদের সাথেই এত খারাপ ব্যবহার করছে। আমরা চলে গেলে তো হিয়াকে মেরে গুম করে দেবে।”
রেখা আঁতকে উঠল। পারমিতার রাগে শরীর জ্বলছে। একটা মানুষ একের পর এক এত মিথ্যা কথা কীভাবে বলতে পারে? এত এত মিথ্যার পাহাড় ডিঙিয়ে সত্যি কথা বলতেই তো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে পারমিতা।
রেখা বলল,
“ছিঃ…ছিঃ..পারমিতা তোমার ব্যবহার এত খারাপ।”
“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”
“তাহলে ঠিকটা তুমিই বলো। নিজের চোখে দেখলাম তো তোমার ব্যবহার। আমার বড়ো বউমা তোমার বয়সে, মান্যে অনেক বড়ো। সামান্য একটা কথার জন্য তাকে তুমি আমার চোখের সামনে কীভাবে থাপ্পড় মারলে। আসলে তোমার ভেতরে ভদ্রতার ছিটেফোঁটাও নেই। এবার বুঝতে পারলাম তোমার প্রথম সংসার কেন টিকেনি।”
পারমিতা বলল,
“অনেক বলে ফেলেছেন এবার আমাকেও বলতে দিন।”
“কি বলবে তুমি, কি’বা বলার আছে তোমার? তোমার সাথে তো কথা বলতেই রুচিতে বাঁধছে আমার। আসুক প্রণয় বাসায়। প্রণয়কে বলে হিয়াকে আমি আজকেই নিয়ে যাব।”
“এই মহিলার জন্য আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন তো..ওকে সমস্যা নেই। চলে যাওয়ার আগে জেনে যান। আপনার বড়ো বউমা কতটা ভালো মানুষ। ওনি এতই ভালো মানুষ যে অন্যের স্বামীকে গভীর রাতে ডেকে নিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রাখে।”
“এসব কি বলছ তুমি? কাকে ধরেছে বড়ো বউমা?”
রনিতা শুকনো ঢোক চিপে রেখার একহাত ধরে ফেলল। বলল,
“ঘরে চলুন মা। আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।”
পারমিতা রেখার আরেক হাত ধরে ফেলল। বলল,
“ঘরে যাবে কেন? সাহস থাকে তো যা বলার এখানেই
বল? আমিও শুনি আর কি কি মিথ্যা বলতে পারিস তুই। তোকে তো আমি জুতা পেটা করে এই বাড়ি থেকে বের করব আজ।”
রেখা চাপা কণ্ঠে বলল,
“মুখ সামলে কথা বলো পারমিতা।”
পারমিতা তাচ্ছিল্য করে বলল,
“দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পোষার গল্পটা শুনেছিলেন তো মা? এই মহিলাও আস্ত একটা কালসাপ। যাকে আপনারা দুধকলা দিয়ে বছরের পর বছর পুষেছেন। বিনিময়ে আপনার একমাত্র মেয়ের মৃত্যুর কারণ হয়েছে এই মহিলা।”
পারমিতার কথাশুনে দুজনই চমকে উঠল। রেখা অস্ফুট স্বরে বলল,
“এসব কি বলছ তুমি?”

(চলবে)

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৬

“এসব কি বলছ তুমি?”
পারমিতা রনিতার দিকে ঘৃণাভরে তাকাল। রেখাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি ঠিকই বলছি।”
“হেয়ালি করো না পারমিতা। যা বলার সরাসরি বলো।” রেখার কণ্ঠে কম্পন স্পষ্ট টের পাওয়া গেল। পারমিতা বলল,
“আপনার বড়ো বউমা আপনাদের সামনে যতটা ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকে৷ বাস্তবে ওনি তার থেকেও শতগুণ খারাপ একজন মহিলা।”
“এই মেয়ে চুপপপ…একদম চুপ।” রনিতা চিল্লিয়ে উঠল। পারমিতা একটুও দমে গেল না। দ্বিগুণ স্বরে চিল্লিয়ে বলল,
“তুই চুপ কর। আর আমার সাথে তো ভুলেও গলাবাজি করার চেষ্টা করবি না। আজ তোর মুখোশ আমি টেনে খুলে ফেলব। কোথাও মুখ লুকানোর জায়গা পাবি না। ইতর মহিলা।”
রনিতা আবারও রেখার একহাত শক্ত করে চেপে ধরল। মরিয়া হলে বলল,
“আপনি ঘরে চলুন তো মা। এই মেয়ে আস্ত একটা পাগল। কি বলতে কি বলছে ওর মাথা ঠিক নেই।”
অপমানে পারমিতার গা চিড়বিড় করে উঠল। রনিতাকে বলল,
“আমি পাগল হই আর যাই হই, তোর মতো প্রতারক না। বিশ্বাসঘাতক।”
রেখা বলল,
“কি হচ্ছে কি! তখন থেকে কি নিয়ে কথা বলছ তোমরা? আমাকে স্পষ্ট করে বলোতো?”
পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার মুখের কথা তো আর বিশ্বাস করবেন না। আপনার প্রিয় বউমার মুখ থেকেই নাহয় আসল সত্য জানুন। একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি।”
রনিতা ভীতু কণ্ঠে বলল,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
পারমিতা একটু ভেবে রেখাকে বলল,
“আপনিও আমার সাথে চলুন।”
রনিতা কিছু বলার আগেই রেখাকে বগলদাবা করে ঘরে নিয়ে গেল পারমিতা। রনিতা কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। ওদের পিছুপিছু ছুটে গেল। রনিতাকে ঘরের বাইরে রেখে সশব্দে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিল পারমিতা। রনিতা বেশ নাটক বাজ। ভালো নখরা জানে। রেখাকে অডিও রেকর্ডটা হয়তো ভালো করে শুনতেই দেবে না। কোনো রকম রিস্ক নিতে চাইল না পারমিতা। রেখা ক্লান্ত শরীর খানা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বসল। পারমিতাও রেখার পাশে বসে নরম স্বরে বলল,
“এই ক্লিপটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনুন মা।” রেখা ফোনটা হাতে নিল৷ ফোনে রনিতার কণ্ঠ। খুব আবেগঘণ কন্ঠে চটপটে স্বরে প্রণয়ের সাথে কথা বলছে রনিতা। রেখার কৌতূহল ব্যাপক বেড়ে গেল। বাইরে থেকে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে রনিতা। কারো যেন দরজাটা খোলার কোনো তাড়া নেই।
পুরো রেকর্ডটা শুনতে শুনতে মুখে আঁচল গুঁজে কেঁদে ফেলল রেখা। ভয়, আতঙ্ক, হতাশা পুরোপুরি গ্রাস করে নিল রেখাকে। হৈমন্তীর সুখের সংসারে নীরবে, নিস্তব্ধে তার বড়ো বউমা ঠাণ্ডা মাথায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। না জানি মেয়েটা কত-না কষ্ট পেয়েছে। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। অথচ মুখ ফুটে কাউকে বলেনি মেয়েটা। ইশ, তিনি মা হয়ে কেন মেয়ের গোপন আর্তনাদের কথা বুঝতে পারল না। কেন মানুষ মানুষের সুখ সহ্য করতে পারে না? শুধুমাত্র হিংসাত্মক হয়ে কত জঘন্য একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে বড়ো বউমা। অথচ এই বউকে ওনি সব বউয়ের থেকে বেশি স্নেহ করেছে। নিজের সংসারের যাবতীয় জিনিস এই বউকেই দিয়েছে। হৈমন্তীটা তো কম ভালোবাসেনি তার বড়ো বউদিকে। কত গোপন কথা ছিল। যা কোনোদিন মায়ের কাছেও বলেনি অথচ বড়ো বউদিকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে বলে দিত। কখনো একটা জিনিস কিনেনি হৈমন্তী। যা কিনতো সব দুটো করে। একটা ও নিতো। একেকটা বড়ো বউমাকে দিতো। বিয়ের পরও এমন করত। এই নিয়ে মাঝে মাঝেই মেয়ের সাথে রেখা রাগ করত৷ হৈমন্তী মায়ের কথা শুনতো না। হৈমন্তীর সবকিছুতে ভাগ বসাতে বসাতে স্বভাব এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হৈমন্তীর বরকেও ছাড়েনি। হৈমন্তীর বর যখন বড়ো বউমার ডাকে সারা দেয়নি। তখনই নোংরা একটা খেলা খেলল। হৈমন্তীর চোখে প্রণয়কে খারাপ বানিয়ে নিজে মহান সাজল৷ আর বোকা মেয়েটা নিজের বরকে ভুল বুঝে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শুধু কষ্টই পেয়েছে। রেখা আর কিছু ভাবতে পারছে না। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চোখের জলে সবকিছু ঝাপসা দেখছে৷ এইকথা গুলো যদি বড়ো বউমা নিজের মুখে স্বীকার না করত তাহলে হয়ত পারমিতার মুখের কথা জীবনেও বিশ্বাস করত না রেখা। বিশ্বাস করবেই বা কীভাবে! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা। রেখা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। পারমিতার একহাত জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। পারমিতারও দুচোখ ভিজে উঠল৷ রেখার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল। বলল,
“শান্ত হন মা।”
“কি করে শান্ত হবো। আমার হৈমন্তী তো মারা যায়নি। ওকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। ইশ, না জানি প্রণয়কে ভুল বুঝে কত কষ্ট পেয়েছে আমার মেয়েটা। কত অশান্তি করেছে এই বন্ধ ঘরের ভেতরে। আমিই তো সহ্য করতে পারছি না। ও কীভাবে সহ্য করল। ও ভালো নেই এই কথাটা একবারও বলল না আমাকে।”
পারমিতা বলল,
“এই মহিলা খুব ডেঞ্জারাস। হিয়ার বাবা যদি সঠিক সময়ে ফোনে এই রেকর্ডটা না করত ওই মহিলা হয়তো আমার সংসারেও আগুন লাগিয়ে দিত। আমার সংসারটা শুরু হওয়ার আগেই ভেঙে যেত।”
রেখা হৈমন্তীর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল। বলল,
“তুমি চিন্তা করো না৷ ওই কালসাপ আমার এক মেয়ের সংসার ভেঙেছে। আমি বেঁচে থাকতে আমার আরেক মেয়ের সংসার কোনোদিনও ভাঙতে দেব না। যদি আর কখনো ও এই বাড়িতে আসার চেষ্টা করে আমি বলে গেলাম, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে তুমি।”

রেখা চোখের জল মুছে ঘরের দরজা খুলতেই দেখল, রনিতা দরজার পাশে ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ রেখাকে দেখে হকচকিয়ে গেল রনিতা। রনিতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রেখা ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দিল রনিতার গালে। বলল,
“ছিঃ…ছিঃ তুমি এতটা নিচে নেমে গেছো। তোমার কি ক্ষতি করেছিল আমার হৈমন্তী? ওর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কেন ওর পিঠে ছুড়ি মারলে তুমি? তোমার একবারও কি বুক কাঁপল না? মনে হলো না, যা করছ ভুল করছ, অন্যায় করছ, পাপ করছ৷”
রনিতা ঘাবড়ে গেল। চোখে-মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। ভীতু কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল,
“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন মা।”
রেখার খুব ক্লান্ত লাগছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল। বলল,
“আর কত মিথ্যা বলবে বড়ো বউমা। এত নিখুঁতভাবে অভিনয় করো। একটুও কি ক্লান্ত হও না?”
“আপনি আমার কথা শুনুন, ওই মেয়েটা আমার নামে মিথ্যা কথা বলে ভুল বুঝিয়েছে আপনাকে।”
“চুপ..একদম চুপ। আমি তো ওর কোনো কথা শুনিনি। আমি তোমার কথা শুনেছি। তোমার সাথে কথা বলতেও ঘৃণা লাগছে আমার৷ ছিঃ..ছিঃ..তুমি আমার বড়ো খোকার নামে এত বাজে বাজে কথা বললে কীভাবে! তুমি আমার মেয়ের সংসার ভেঙেছ৷ আমিও তোমার সুখের সংসার নিজের হাতে ভেঙে দেব। তখন হাড়ে হড়ে টের পাবে নিজের সংসার ভাঙার যন্ত্রণা কতটা ভয়ানক। আবারও বিয়ে দেব বড়ো খোকাকে আমি। তোমার মতো নষ্ট চরিত্রের বউয়ের দরকার নেই আমার ছেলের। যার সাথে এতগুলো বছর সংসার করেছ, যার বাচ্চার মা হয়েছ তার নামেই অন্যের কাছে বদনাম করছ। ছিঃ…
রনিতা কোনো উপায় না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আচমকা শাশুড়ির পা দুটো জড়িয়ে ধরল। বলল,
“আমি না হয়, না বুঝে একটা ভুল করেই ফেলেছি। আমার এত বড়ো ক্ষতি করবেন না মা।”
রেখা বিদ্রুপ করে বলল,
“এত বড়ো অন্যায় করার পরও বলছো, না বোঝে ভুল করেছো। আর কত নিচে নামবে তুমি? আর কত মিথ্যা বলবে?”
রনিতা শাশুড়ির পায়ে লুটিয়ে পড়ল। বলল,
“ শেষ একটা সুযোগ দিন মা। দয়া করুন… দয়া করুন আমাকে। হাত জোর করছি। ভিক্ষা দেন আমার সংসারটা। এই বয়সে কোথায় যাব আমি, স্বামী-সন্তান ফেলে। অন্তত আমার বাচ্চার দিকে তাকিয়ে হলেও আমাকে শেষ একটা সুযোগ দিন।”
“আমার বুক খালি করার সময় মনে ছিল না। তবুও তো তোমার বাচ্চা বেঁচে থাকবে। মন চাইলে যখন তখন দেখতে পারবে তুমি, মা ডাক শুনতে পারবে। অথচ আমার হৈমন্তীটা… ”
রেখা আবারও ঝরঝর করে কেঁদে দিল। রেখা মানতেই পারছে না তার বড়ো বউমার কোমল মুখের আড়ালে ভয়ংকর কুৎসিত একটা রূপ আছে।”
রনিতা শাশুড়ির পা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রেখার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জেদি কণ্ঠে বলল,
“আপনি যদি ভুলেও এই কথাগুলো আপনার বড়ো ছেলেকে বলেন আর আমার সংসার যদি সত্যি সত্যিই ভেঙে যায়। ভগবানের দিব্যি কেটে বলছি মা, আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে, আমার ছেলে-মেয়েকে সাথে নিয়ে আত্মহত্যা করব।”
রেখা স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকে হাত চেপে ধরল। পেট পাকাচ্ছে। গা গুলাচ্ছে। প্রচণ্ড বুক ব্যথা করছে। শরীরে ঘাম দিচ্ছে খুব। কি করবে বুঝতে পারছে না। রেখা পড়ে যেতে নিল। পারমিতা চট করে ধরে ফেলল। রেখা অস্ফুট স্বরে বলল,
“আমাকে একটু ঘরে দিয়ে আসো।”
যাওয়ার আগে রনিতাকে উদ্দেশ্য করে চাপা কণ্ঠে বলল,
“আর জীবনে কখনো যদি প্রণয়ের আশেপাশে তোমাকে দেখি কিংবা এই বাড়ির আশেপাশে দেখি। তাহলে আমিই তোমাকে নিজের হাতে ভয়ংকর শাস্তি দেব। এখুনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও তুমি।”
রেখা পারমিতার কাঁধে ভর দিয়ে ঘরে চলে গেল। রনিতা অতিরিক্ত রাগে ফুঁসছে। চাপা কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,
“দুইদিনের বউ হয়ে আমাকে অপমান করা। আমার এতবছরের লুকানো সত্যি শাশুড়ির সামনে প্রকাশ করে আমাকে অপদস্ত করা। বেশ আমিও মনে রাখলাম। সময় আসুক। হিয়াকে দিয়ে এর প্রতিশোধ তুলব আমি। যে মেয়ে আজ পারমিতাকে মা মা বলে মুখে ফেনা তুলছে। এমন একদিন আসবে। পারমিতার নাম শুনলেই ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নেবে হিয়া”
রনিতা চলে গেল।

(চলবে)