বেলাশেষে পর্ব-২৯+৩০

0
13

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৯

প্রণয় ফোন না দিলেও অনিরুদ্ধ ঠিকই ফোন দিল পারমিতাকে। একটানা অনেকক্ষণ ফোনটা বেজে বেজে কেটে যাওয়ার পর অবশেষে বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করল পারমিতা। বলল,
“ফোন দিয়েছ কেন?”
“কেন আবার! তোমার সাথে কথা বলতে ফোন দিয়েছি।”
“তুমি কি শান্তিতে আমাকে সংসার করতে দিবা না?”
“আমার সাথে শান্তিতে সংসার করো।”
“অনিরুদ্ধ ভুলে যেও না তোমার বউ আছে।”
“তাতে কি! আচ্ছা তোমাকে সংসার করতে হবে না। তুমি শুধু আমাকে আগের মতো সময় দাও। চলো আমরা দেখা করি। তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে পারু।”
পারমিতা আর মেজাজ ধরে রাখতে পারল না। দাঁতে দাঁত চেপে বললশ
“তোকে আমি জুতাপিটা করব জানোয়ার।”
“আহ্…তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? জানি তো, আমাকে আদর করার জন্য তো আর আসবে না। জুতাপেটা করার জন্যই নাহয় আসো। তবুও আসো প্লিজ…আমি যে কি হারিয়েছি। এখন আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতেছি। তোমার মতো বউ পাওয়া সাত জনমের ভাগ্য৷ আফসোস সেই বউ ধরে রাখতে পারলাম না আমি।”
“সত্যি করে বলতো, তুই আমার ফোন নম্বর কোথায় পেয়েছিস?”
“এই যুগে সামান্য একটা ফোন নম্বর জোগাড় করা খুব বড়ো ব্যাপার নাকি?”
“তবুও কোথায় পেলি?”
“তোমার বর্তমান শ্বশুর খুব ভালো মানুষ। ওনার ফোন থেকেই নিয়েছি।”
পারমিতা চমকে উঠল। অস্ফুট স্বরে বলল,
“তোর ওনার সাথে পরিচয় হলো কীভাবে?”
“এতকিছু তো বলা যাবে না। আগে বলো, তুমি আমার সাথে দেখা করবে নাকি?”
পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিল। বলল,
“ওকে এত করে বলছ যখন অবশ্যই দেখা করব। তার আগে তোমার ফেসবুক আইডি থেকে আমাকে একটু নক দাও।”
“তোমার আইডির নাম কি?”
“পারমিতা।”
“হঠাৎ ফেসবুক থেকে নক দিতে বলছ কেন? তুমি চাইলে হোয়াইট অ্যাপে কথা বলতে পারি আমরা।”
“উঁহু…তুমি ফেসবুক থেকে নক দাও।”
“আচ্ছা, ফোন রাখো। দিচ্ছি।”

একটু পরে অনিরুদ্ধ পারমিতাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে হাই লিখে নক দিল। পারমিতা অনিরুদ্ধর প্রোফাইলে ঢুকে সারা প্রোফাইল চষে ফেলল। সারা প্রোফাইল জুড়ে ওদের কাঁপল ছবি। ওদের হাসিখুশি ছবি দেখে মনে হচ্ছে অনিরুদ্ধর মতো সুখী মানুষ এই দুনিয়ায় দুটো নেই। বউটাও কপাল গুনে এরকম বর পেয়েছে। অনিরুদ্ধর বউয়ের নাম দিশা। প্রায় সব জায়গায় বউকে মেনশন করে ছবি ক্যাপসন সহ পোস্ট করা। পারমিতা দিশার আইডিতে নক দিল। অনিরুদ্ধর ব্যাপারে অনেককিছু লিখে মেসেজ সেন্ট করে রাখল। আর অনিরুদ্ধর মেসেঞ্জারে ইচ্ছে করে লিখল,
“তুমি আমার সাথে আলাদা করে সময় কাটাতে চাও কেন অনি? তোমার বউ তোমাকে ভালোবাসে না?”
অনিরুদ্ধ লিখল,
“ভালোবাসার মানেই তো ও বুঝে না। বিয়ের পর একদিনও মানসিক শান্তি পাইনি। সারাক্ষণ ঝগড়া অশান্তি লেগেই থাকে। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লাগে, শুধু বলে, এটা নাই.. ওটা নাই। আমার বউয়ের খুব লোভ। তাছাড়া বিছানায় গেলে গুঁইসাপের মতো শুয়ে থাকে। না শারীরিক শান্তি দেয় আমাকে আর না মানসিক শান্তি দেয়। ওর মতো ডাইনী, ঝগরুটে, বেয়াদব মহিলা আমি জীবনে দুটো দেখিনি পারু। তাছাড়া তোমাকে প্রচণ্ড মিস করি। তোমাকে হারিয়ে তোমার গুরুত্ব বুঝেছি। তুমি কতটা জুড়ে ছিলে আমার জীবনে। তোমার সাথে প্রতিটা রাত কাটানোর দৃশ্য মনে পড়লে আবেশে ভেসে যাই আমি। তোমাকে খুব করে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। আদর করতে ইচ্ছে করে।”
পারমিতার গা গুলিয়ে উঠল। কথা বলার রুচি হচ্ছে না। তবুও উপায় নেই। নরম স্বরে কথা চালিয়ে গেল। আর ফটাফট ওদের কথোপকথনের স্কীনশট নিয়ে রাখল। তারপর কড়া কণ্ঠে অনিরুদ্ধকে লিখল,
“তোকে আমি ঘৃণা করি জানোয়ার। তুই আমার স্বামীকে ভুল বুঝিয়ে আমার সংসারের অশান্তির কারণ হয়েছিস। এখন দেখ কি করি আমি, আগুন লাগিয়ে দেব তোর সংসারে।”
অনিরুদ্ধ বুঝতে পারল না। এত মিষ্টি সুরে কথা বলতে বলতে হঠাৎ পারমিতা অগ্নিমূর্তি ধারণ করল কেন! বলল,
“কি হয়েছে তোমার পারু? এভাবে কথা বলছো কেন?”
“কি হয়নি তাই বল। তুই আমার জীবনে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমার জীবনটাকে পুরো নরক বানিয়ে রেখেছিস। একটা দিনও মানসিক শান্তিতে বাঁচতে দিসনি আমাকে।
০১৭৮৮৯৯**** এটা আমার বরের নম্বর। আমার বরকে ফোন দিয়ে বলবি, তুই আমাকে মানসিক চর্চার করিস। এবং আমি তোকে প্রচণ্ড ঘৃণা করি।”
কথাগুলো বলে অনিরুদ্ধকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ব্লক লিস্টে ফেলে দিল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল দিশার মেসেজের রিপ্লের।
পারমিতাকে নিরাশ করল না দিশা। প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পর দিশা মেসেজের রিপ্লে দিল। লিখল,
“আপনি কে? অনিরুদ্ধকে কীভাবে চিনেন?”
পারমিতা লিখল,
“আশেপাশে অনিরুদ্ধ আছে?”
“না।”
“তাহলে কল দেই আপনাকে? মেসেজে এত কথা বলা যায় না। আর আগে কিছু কলরেকর্ড ও স্কীনশট দেই। এগুলো আগে পড়ে নিন।”
পারমিতা গতকাল রাতে প্রণয়ের সাথে ভুলবোঝাবুঝির পর থেকে কলরেকর্ড অপশন অন করে রেখেছিল। ফোনে যা কথা হয়েছে এবং মেসেজে যা যা কথা হয়েছে। সবকিছু পাঠিয়ে দিল দিশার মেসেঞ্জারে। দিশা বোধহয় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ও ভাবতেই পারেনি অনিরুদ্ধ ভালোবেসে বিয়ে করার পর দিশার সাথে চিট করবে। দিশা এ-ও জানতো না পারমিতার সাথে এখনো সম্পর্ক রাখার জন্য মরিয়া হয়ে আছে অনিরুদ্ধ। অথচ ওরা সবাই পারমিতার নামে সারাক্ষণ গসিপ করে। প্রায়ই অনিরুদ্ধ বলে, পারমিতা অত্যন্ত লোভী, নাকটবাজ, এবং বহু পুরুষে আসক্ত একটা মেয়ে ছিল। ওদের বিয়ের আগে কতজনের সাথে পারমিতা রাত কাটিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। অনিরুদ্ধ সবকিছু জেনেশুনে ওকে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ এখন পারমিতার সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে ঘটনা উল্টো। এমন যদি সত্যি সত্যিই হয়। মেরে ফেলবে অনিরুদ্ধকে দিশা। তারপর নিজে মরবে। দিশা এতটাও মহান না।
দিশার এতদিনের বিশ্বাস ভরসা সব যেন এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। এতবড়ো প্রতারণা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না দিশা। ইশ, কি অভিনয়.. অথচ এতদিন জানতো পারমিতা নামের মেয়েটাই খারাপ ছিল। যারজন্য ঘরে বউ থাকতেও মানসিক শান্তির জন্য দিশার কাছে যেত। যদিও দিশা আগে জানতো না। অনিরুদ্ধর ঘরে বউ থাকতে দিশার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। শুধু জানত, বউয়ের চরিত্র খারাপ দেখে বিয়ের কিছুদিন পর ছেড়ে দিয়েছে। তারপর দিশার সাথে রিলেশন করেছে।
দিশাকে প্রমাণ স্বরূপ সবকথা খুলে বলল পারমিতা। এ-ও বলল,
পারমিতার বিবাহিত জীবনে অনিরুদ্ধ খুব অশান্তি করছে। ওদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এই নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি চলছে খুব। দিশা যেন নিজের স্বামীকে বেঁধে রাখে। নাহলে অনিরুদ্ধর নামে মামলা দিতে বাধ্য হবে পারমিতা।

প্রণয় এলো অনেক রাতে। ঘরে এসে দেখল, হিয়া বা পারমিতা কেউ ঘরে নেই। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে এসে কিছু্‌ক্ষণ বসে রইল। তারপর উঠে গেল। পাশের ঘরে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। দরজায় ধাক্কা দিল। নিচু কণ্ঠে বার কয়েক পারমিতাকে ডাকল। পারমিতা সারা দিল না। প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে গিয়ে শুলো। আশ্চর্যজনক ভাবে রাতে ঘুম হলো না প্রণয়ের। বেশি খারাপ লাগছে পারমিতার জন্য। ইশ, অন্যের কথা না শুনে পারমিতার কথা শোনা উচিত ছিল। তাহলে তো আর শুধু শুধু ভুল বুঝতো না পারমিতাকে। ওরই বা কি দোষ। অতরাতে অনিরুদ্ধ ফোন দিয়ে যেভাবে কথা বলছিল! প্রণয়ের জায়গায় অন্যকেউ থাকলেও পারমিতাকে ভুল বুঝতো। প্রণয়ের আজ বাড়িতে আসার ইচ্ছে ছিল না। ডিউটি শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিল। রাতটা চেম্বারে কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে। তখনই উড়ো ফোনকলটা এলো। ফোন রিসিভ করে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল প্রণয়। অনিরুদ্ধ ফোন দিয়েছে। এবং মুখে যা আসছে তাই বলছে পারমিতার নামে। যে মানুষটা একদিন আগেও পারমিতাকে ভালোবাসার কথা বলছিল, পারমিতার সাথে থাকার কথা বলছিল। সেই মানুষটা পারমিতার নামে কতগুলো কুৎসিত কথা বলে ফোন রেখে দিল। প্রণয়ের মস্তিষ্ক যখন ফাঁকা ফাঁকা। ভাবনাগুলো উলোটপালোট তখনই পারমিতা দুটো কলরেকর্ড ও কতগুলো স্কীনশট পাঠাল। সাথে ছোট্ট করে পারমিতা লিখেছে,
“আপনিই না বলেন চোখের দেখা সবসময় সত্যি হয় না। তাহলে সামান্য কয়েকটা কথার জন্য কেন আমাকে ভুল বুঝলেন? আর একটু অপেক্ষা করতে পারতেন। আমাকে ভুল ভাঙানোর একটা সুযোগ দিতে পারতেন। এভাবে দূরে সরে যাওয়া কোনো সমাধান হতে পারে না।
তবুও আপনি যখন আমাকে ভুল বুঝে এইপথ বেছে নিলেন। আমিও আপনার দেখানো পথেই হাঁটব।”
ওগুলো দেখে পারমিতাকে শুধু শুধু ভুল বোঝার অপরাধে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে গেল প্রণয়। আর এখানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। প্রথমে পারমিতাকে ফোন দিল। দেখল, নম্বর বন্ধ। খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে পারমিতার অভিমান ভাঙাতে হবে। ওকে আপন করে নেবে প্রণয়।
প্রণয় বাড়ি এসে দেখল,
পারমিতা আজ ওদের ঘরে ঘুমায়নি। হিয়াকে নিয়ে অন্যঘরে ঘুমিয়েছে। তা-ও আবার ভেতর থেকে ঘরের দরজা আটকে দিয়ে। কতবার দরজা খোলার জন্য অনুরোধ করল প্রণয়৷ অভিমানী মেয়েটা কথাই বলল না। প্রণয়ের ঘরে মন টিকছে না৷ আবারও উঠে গিয়ে পারমিতার দরজার সামনে অসহায়ের মতো দাঁড়াল। বলল,
“হিয়াকে ছাড়া আমার ঘুম হয় না পারমিতা। দরজাটা খুলে দাও। আমার মেয়েকে নিয়ে যাব।”
প্রায় মিনিট দশেক পর ঘরের দরজা খুলে দিয়ে প্রণয়ের সাথে কোনো কথা না বলে, বাথরুমে গিয়ে ঢুকল পারমিতা। প্রণয়ের এখন নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে। ঘরের দরজা খোলার কথা বলা যায়। কিন্তু বাথরুমের দরজা খোলার কথা তো আর বলা যায় না। উফ্.. এত অভিমান মেয়েটার৷ একটা ভুল নাহয় প্রণয় করেই ফেলেছে। ক্ষমা চাওয়ার তো সুযোগ দেবে।

অনেকক্ষণ পর বাথরুম থেকে বের হয়ে পারমিতা দেখল, ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। পারমিতা ঘরের লাইট জ্বেলে দিয়ে ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে সামনে ঘুরে চমকে উঠল। বিছানায় হিয়া নেই। অথচ প্রণয় সিংগেল সোফায় পায়ে পা তুলে বসে আছে। পারমিতা চোখে চোখ পড়তেই হেসে ফেলল প্রণয়।
পারমিতার খুব রাগ হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে চলে যেতে নিল। প্রণয় চট করে উঠে এসে পেছন থেকে পারমিতার একহাত ধরে ফেলল। মাথা পেছন দিকে ঘাড়ের সাথে এলিয়ে দিয়ে দুচোখ বুঁজে ফেলল পারমিতা। ক্লান্তি অবসাদে শরীর, মন ছেয়ে আছে। মনটা খুব অশান্ত। প্রণয় কয়েক পা হেঁটে এসে পেছন থেকে আচমকা জাপ্টে ধরল পারমিতাকে। পারমিতার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিল। পারমিতার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। হাতে-পায়ে শক্তি নেই। প্রণয় পারমিতার উন্মুক্ত ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“সরি বউ।”
আবেশে কেঁপে উঠল পারমিতা। সেই সাথে অঝরে নিঃশব্দে চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। পারমিতা হাত দিয়ে চোখের জল মুছে ফেলল। অভিমানী কণ্ঠে বলল,
“ছাড়ুন।”
প্রণয় আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জেদি কণ্ঠে বলল,
“উঁহু…ছাড়ব না।”
“আমি ঘুমাব।”
“সরি তো।”
“আমি আগামীকাল সকালে মাসির কাছে চলে যাব।”
প্রণয় পারমিতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। পারমিতার গালদুটো হাতের আঁজলায় তুলে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল,
“কোথায় যাবে বললে?”
“মাসির কাছে চলে যাব।”
“তুমি চলে গেলে আমাদের কি হবে?”
পারমিতা উত্তর দিল না। প্রণয় বলল,
“কোথাও যেতে দেব না তোমাকে।”
“আমি যাব।”
“হিয়া তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না।”
“দরকার হলে হিয়াকে সাথে নিয়ে যাব।”
প্রণয় হেসে ফেলল। পারমিতার নাকে নাক ঘষে বলল,
“তোমরা চলে গেলে আমার কি হবে?”
“কেন আপনি আরেকটা বিয়ে করবেন।”
প্রণয় আহত স্বরে বলল,
“নিজেও ভালোবাসো না আমাকে। আমাকেও ভালোবাসতে দাও না। কাছে যেতে দাও না। শুধু উল্টাপাল্টা কথা বলে আমাকে কষ্ট দাও। আর কষ্ট সহ্য করব না আমি। আমার অধিকার আমি আদায় করে নেব। দেখব, তুমি কীভাবে ছেড়ে থাকো আমাকে।”
প্রণয় পারমিতাকে আরও কাছে টেনে নিল। পারমিতার ঠোঁটে সময় নিয়ে চুমু এঁকে দিল। পারমিতা অধৈর্য হয়ে বলল,
“ছাড়ুন…ছাড়ুন বলছি, আমি হিয়ার কাছে যাব।”
প্রণয় পারমিতার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে গাঢ় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“আগে মেয়ের পাপাকে খুশি করো। তারপর মেয়ের কাছে যাবে।”
“আমি কিন্তু চিৎকার করব এখন?”
প্রণয় চট করে পারমিতাকে কোলে তুলে নিল। বিছানায় যেতে যেতে একচোখ টিপে বলল,
“যতখুশি করো চিৎকার। আই ডোন্ট কেয়ার।”
পারমিতা হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে লজ্জায় প্রণয়ের বুকে মুখ লুকাল।

এই নিস্তব্ধ রাতে চাঁদ তারাকে সাক্ষী রেখে পারমিতাকে আপন করে নিল প্রণয়। পারমিতা প্রথমে বাঁধ সেধেছিল। অবশেষে প্রণয়ের অতিরিক্ত আদর-ভালোবাসার কাছে হার মেনে নিতে বাধ্য হলো পারমিতা। পারমিতার দীর্ঘদিনের বুকে জমে থাকা দুঃখ – কষ্ট, হাহাকার চিরতরে ঘুচিয়ে দিয়ে ওই বুকে খুব গোপনে নিজের নাম লিখে দিল প্রণয়। আদরে, আবেশে নিজের অস্তিত্বের সাথে পারমিতাকে মিশিয়ে ফেলল প্রণয়। এই জন্মদুঃখিনী মেয়েটা এবার যেন সত্যিকারের সুখের মুখ দেখে ঠাকুর।

(চলবে)

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ৩০

সকাল থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। ভোরের দিকে প্রণয়-পারমিতা হিয়ার পাশে এসে শুয়ে পড়েছে। আজ বন্ধের দিন। প্রণয়ের ডিউটিতে যাওয়ার তারা নেই। সারা সকাল পড়ে পড়ে ঘুমাল প্রণয়। পারমিতা উঠতে চেয়েছিল। প্রণয় ইশারায় উঠতে মানা করল। আর একটু শুয়ে থাকতে বলল।
পারমিতা হিয়াকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। হিয়া জেগে গেল। এই প্রথম বাবা-মাকে হিয়ার পাশে শুয়ে থাকতে দেখে খুশিতে হেসে ফেলল হিয়া৷ পারমিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাদের ভাব হয়ে গেছে মা?’’
পারমিতা লজ্জা পেল। প্রণয়ের দিকে তাকানোর সাহস পেল না। প্রণয় মিটিমিটি করে ঠোঁট টিপে হাসছে। প্রণয় মুখে হাসি রেখেই বলল,
“ভাব তো হয়ে গেছে। তবে তোমার মা যে আমাকে তুমি করে বলে না।”
হিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে পাশ ফিরে প্রণয়ের দিকে তাকাল। কৌতূহলী হয়ে বলল,
“তাহলে মায়ের সাথে তোমার ভাব হলো কীভাবে?”
প্রণয় বিস্ময় খেল। পারমিতা চোখ গরম করে তাকাল প্রণয়ের দিকে। বিছানা থেকে উঠে যেতে যেতে হিয়াকে বলল,
“আমি স্নান করতে গেলাম। এসে যেন দেখি, তুমি ঘুম থেকে উঠে গেছো।”
প্রণয়ও উঠতে নিল। হিয়া ছোটো ছোটো হাত দিয়ে প্রণয়ের একহাত টেনে ধরল। ফিসফিস করে বলল,
“পাপা.. বললে না তো মায়ের সাথে তোমার ভাব হলো কীভাবে? আমি তো রাতে মায়ের সাথে পাশের ঘরে ঘুমিয়েছিলাম। এইঘরে আসলাম কখন?” হিয়ার
চোখে-মুখে একরাশ কৌতূহল।
প্রণয় আদর করে হিয়ার নাক টেনে দিল। বলল,
“হিয়ামণিকে ছাড়া যে আমার ঘুম হয় না। তাই রাতে ঘুমন্ত হিয়ামণিকে আমার ঘরে নিয়ে এসেছি। হিয়ার মাও হিয়াকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না। তাই আমাদের পেছন পেছন চলে এসেছে।”
“কাজটা তুমি ঠিক করোনি পাপা…মা এমনিতেই কীসের জন্য যেন তোমার উপর খুব রেগে আছে।”
“কীসের জন্য রেগে আছে তোমার মা আামার সাথে?”
‘তাতো জানি না। তবে মা লুকিয়ে লুকিয়ে খুব কাঁদছিল পাপা। তুমি যদি অন্যায় করে থাকো। অবশ্যই মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবে। মাকে আদর করে দেবে। তাই মায়ের রাগ মাটি হয়ে যাবে।”
“তোমার মায়ের সব রাগ মাটি হয়ে গেছে মামণি।”
“সত্যি?”
“তিন সত্যি।”
“মাকে কখনো কষ্ট দিবা না।”
“আচ্ছা মামণি।”

হিয়া বাবা-মায়ের সাথে বসে সকালের খাবার খেল। খাওয়া শেষ করে বলল,
“মা আইসক্রিম খাব।”
পারমিতা ডিপ ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম এনে সবাইকে দিল। সবাই খুব প্রংশসা করল। সত্যিই খেতে খুব ভালো হয়েছে। রেখার মুখটা শুকনো। আইসক্রিমের বাটিটা হাতে নিয়ে খাচ্ছে কম নড়াচড়া করছে বেশি। প্রণয় খেয়াল করে বলল,
“খাচ্ছেন না কেন মা?”
রেখা মলিণ হাসল। এক চামচ আইসক্রিম মুখে নিয়ে বলল,
“খাচ্ছি বাবা।”
পরেশবাবু রেখাকে বলল,
“বিকালে হিয়াকে নিয়ে হাঁটতে যাব বেয়াইন। রেডি থাকবেন।”
“আমি আজ বাড়ি যাব দাদা।”
“তা বললে হয় নাকি। এতদিন পর এসেছেন। নাতিনের কাছে কিছুদিন থাকুন। তারপর নাহয় যাবেন।”
রেখা প্রতিউত্তর করল না। তবে পারমিতা রেখার মন খারাপের কারণ ধরতে পারল না।

দুপুরের রান্নার আয়োজন করছিল পারমিতা। কাজের মাসি দুজন পারমিতার হাতে হাতে সবকাজ করে দিচ্ছে। রেখা এসে ড্রাইনিং রুমে চেয়ার টেনে বসল। বলল,
“কি করো পারমিতা?”
পারমিতা রেখাকে দেখে এগিয়ে এলো। মুখে হাসি টেনে বলল,
“রান্না করছি মা।”
“কি রান্না করছ?”
“মাটন। সাথে পেঁয়াজের ডাল, আমের চাটনি, পটল দিয়ে চিংড়ি মাছ আর হিয়ার জন্য মচমচে আলুভাজা।”
“এক গ্লাস জল দাও তো মা?”
পারমিতা জলের গ্লাস হাতে নিয়ে রেখার সামনে এসে দাঁড়াল। রেখা ইশারায় পারমিতাকে বসতে বলল। পারমিতা রেখার পাশে বসল। রেখার মলিণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার কি মন খারাপ মা?”
রেখা চোখের জল লুকানোর বৃথা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। বলল,
“ঘরের কথা কি আর বলব। আমার বড়োছেলে আমাকে ওর বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছে।”
পারমিতা বেশ অবাক হলো। বলল,
“কেন?”
“বড়ো বউমা আমার নামে একগাদা মিথ্যা কথা বানিয়ে বলেছে। এ-ও বলেছে, আমি ও-ই বাড়িতে গেলে সে সংসার করবে না। বাবার বাড়ি চলে যাবে।”
“কেন এমন করল ওনি আপনার সাথে?”
“ক্ষোভ থেকে।”
“আপনার আর দুই ছেলেকে কিছু বলেননি?”
“ওদের কথা আর কি বলব। এরিমধ্যে দুই বউকেও কান পড়া দিয়ে ফেলেছে বড়ো বউ। আমি এখন আপদ হয়ে গেছি। যদিও ওরা মুখে কিছু বলেনি। তবে আমি যে ওদের সাজানো সংসারে গিয়ে থাকব ওদের তেমন মত নেই।”
“আপনি এখানেই থেকে যান।”
রেখা হেসে ফেলল। পারমিতার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তা হয় না। নিজের বাড়ি ছেড়ে এখানে কেন পরগাছার মতো পড়ে থাকব আমি।”
“আপনি সব সত্যি কথা আপনার বড়ো ছেলেকে বলে দিন৷ যার জন্য আপনার সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তার আসল রূপ জানা উচিত।”
রেখা হাসল। তবে প্রতিউত্তর করল না।

বিকালে পরেশবাবুর সাথে সত্যি সত্যিই হাঁটতে গেল রেখা। পরেশবাবুর এ হাতের আঙুল ধরে রেখেছে হিয়া। পরেশবাবু একটা বেঞ্চে বসল। হিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“বেশি দূরে যেও না দিদিভাই। খেলা করো।”
হিয়া একঝাঁক বাচ্চাদের সাথে খেলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। রেখা বেঞ্চের পাশে দাঁড়ানো ছিল। পরেশবাবু রেখাকে বলল,
“বসেন বেয়াইন। সুখ-দুঃখের গল্প করি।”
রেখা ইতস্তত করে পরেশবাবুর পাশে বসল। পরেশবাবু বলল,
“ছেলের বউরা কেমন? ঠিকমতো খেতে দেয় তো আপনাকে?”
“দেবে না কেন!”
“আজকালকার যুগের ছেলেমেয়ে তো। আমাদের যুগের মতো একান্নবর্তী পরিবার পছন্দ করে না। খালি ছোটো সংসার খুঁজে।”
রেখা স্মিত হেসে বলল,
“নিজের হাতে ছেলেদের আলাদা সংসার করে দিয়েছি। একান্নবর্তী সংসারে পুরুষ মানুষ আরাম-আয়েশ সুখে-শান্তিতে থাকলে কি হবে! বউগুলোর যে কি জ্বালা। তা আর বলে শেষ করা যাবে না। সারাদিন গাদার খাটুনি খাটতে খাটতে বউগুলো না দুমুঠো পেটপুড়ে ভাত খেতে পারে। আর না স্বামীর সাথে আলাদা করে একটু সময় কাটাতে পারে। সবশেষে বড়ো কথা শরীরে অসুখ-বিসুখ বাসা বাঁধলেও একটু বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারে না।”
“এতকিছু করেও তো মন পেলেন না ছেলেদের।”
রেখা থতমত খেল। পূর্বের হাসির রেশ মুখে টেনে বলল,
“সবার তো আপনার মতো রাজ কপাল না। ভাগ্য গুনে ছেলে পেয়েছেন। এমন ছেলে লাখে একটা।”
পরেশবাবুর বুকটা গর্ভে ভরে গেল। বলল,
“তা বলতে পারেন। আমার ছেলেটা খাঁটি সোনা। একবার হলো কি শুনুন, প্রণয় সদ্য ডাক্তারি পাশ করে একটা সরকারি হাসপাতালে জয়েন্ট করেছে। চাকরির খুব বেশিদিন হয়নি। ওকে তিলে তিলে গড়ে তোলার পেছনে ওর মায়ের কতবড়ো অবদান এই ব্যাপারে একটা আর্টিকেল লিখে ফেলল। পরে দেশ ছেড়ে বিদেশের পত্র-পত্রিকায় পর্যন্ত ওর মাকে নিয়ে লেখা ছাপা হয়েছিল। ওর মা জীবনে প্রণয়ের হাত ধরে প্রথমবার মাতৃগর্ভা পুরুষ্কার পেল। মা-ছেলে কি যে খুশি। দুইজন দুইজনকে স্টেজে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল। আর আমি দর্শক সারিতে বসে চোখের জল মুছছিলাম। আসলে ছেলে-মেয়ের ক্যারিয়ার গড়ার পেছনে বাবা থেকেও মায়েরা বিশাল ভূমিকা পালন করে। আমি শুধু টাকা পয়সার দিকটা সামলেছি। আর প্রণয়ের মা দক্ষ হাতে সংসার সামলে ছেলেকে নিয়ে ছুটতো। এই স্কুল, প্রাইভেট, কোচিং, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। আফসোস মানুষটা আজ বেঁচে নেই। থাকলে প্রণয়ের এই বউ দেখে কি যে খুশি হতো। বউটা খুব লক্ষ্মী। রান্নার হাতও দারুণ। অমায়িক ব্যবহার।”
রেখার মনটা খারাপ হয়ে গেল। হৈমন্তী বেঁচে থাকতে পরেশবাবু এই গল্পটা অজস্রবার করলেও কখনো হৈমন্তীর তেমন প্রশংসা করেনি। কিংবা করেছে তবে রেখা শুনেনি।

সারা বাড়িতে এখন ওরা দুজন৷ বিকালে তেমন কাজ নেই। পারমিতা সবকিছু গুছিয়ে ঘরে এসে বসল। প্রণয় একটা গুরুত্বপূর্ণ কলে ছিল। ইশারায় পারমিতাকে কাছে ডাকল। পারমিতার খুব লজ্জা লাগছে। প্রণয় ফোনে কথা বলায় মনোযোগ দিল। প্রায় ৮মিনিট পর কথা বলা শেষ করে ফোন রেখে দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে পারমিতাকে কাছে টেনে নিল। আদুরে কণ্ঠে বলল,
“সারাক্ষণ এতো দূরে দূরে থাকো কেন?”
“কাছে এসে কি হবে?”
“ভালোবাসা-বাসি হবে।” প্রণয় গাঢ় কণ্ঠে ফিসফিস করে কথাটা বলতেই লজ্জায় গুটিয়ে গেল পারমিতা। চিবুক এসে গলার ভাঁজে ঠেকল। প্রণয় পারমিতার চুলের খোঁপা ছেড়ে দিল। চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে নাক ডুবিয়ে দিল চুলের ভাঁজে বলল,
“গতকাল কেঁদেছ কেন?”
“কোথায় কাঁদিনি তো।”
“মেয়ে যে বলল।”
পারমিতা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। প্রণয় পারমিতাকে বুকে টেনে নিল। বলল,
“মেয়ে আমাকে বলে দিয়েছে, তোমাকে যেন বেশি বেশি আদর করি।”
ইশ্…পারমিতা লজ্জায় প্রণয়ের বুকে মুখ লুকাল। বিড়বিড় করে বলল,
“মিথ্যা কথা।”
“সত্যি।”
বন্ধ ঘরে দুজনে খুনসুটিতে মেতে রইল অনেকক্ষণ। প্রণয় পারমিতাকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। পারমিতার মাথাটা প্রণয়ের বুকে এসে ঠেকল৷ পারমিতা প্রণয়ের বুকে আঁকিবুঁকি করে তখন রেখার বলা কথাগুলো প্রণয়কে বলল। প্রণয় পারমিতার মাথায় হাত রাখল। পারমিতা বলল,
“আপনি একটু মায়ের ব্যাপারটা দেখুন। ওনার দিকে তাকালে ভালো লাগে না। বড়ো মায়া হয়।”
“তুমি চিন্তা করো না। আমি দেখছি কি করা যায়।”

দুটোদিন বেশ কাটল। তারপরদিন রেখার বড়ো ছেলে রেখাকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। হঠাৎ বড়ো ছেলের কান্নার শব্দে ঘাবড়ে গেল রেখা। বার বার নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে বাবা?”
রেখার বড়ো ছেলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে রনিতার ব্যাপারে কতকিছু বলে গেল। যার সারমর্ম। ভদ্রলোক রনিতার ব্যাপারে সবকিছু জেনে গেছে। এখন এই নষ্টা চরিত্রহীনা বউ নিয়ে কিছুতেই সংসার করবে না ওনি। প্রয়োজনে নিজেকে শেষ করে দেবে। কোনো বিশ্বাসঘাতক, প্রতারকের জায়গা নেই তার জীবনে। ওই ডাইনীর কথা শুনে, মাকে ভুল বুঝার জন্য মায়ের কাছেও বার বার ক্ষমা চাইল হৈমন্তীর দাদা। এ-ও বলল, মা যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যায়।
রেখা কি করবে বুঝতে পারছে না। বাড়ি তো অবশ্যই যেতে হবে। তবে ওদের ভাঙা সম্পর্ক কীভাবে জোড়া লাগাবে তাই তো বুঝতে পারছে না। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বড়োখোকাকে কে এইকথা বলল কে জানে! যেই বলুক, প্রমাণস্বরুপ বলেছে। নাহলে কারো মুখের কথায় বউকে ভুল বুঝে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাত্র তার বড়ো ছেলে না। রেখার খুব হতাশ লাগছে। সত্যি কখনো গোপন থাকে না। তবে এত তাড়াতাড়ি ফাঁস হয়ে যাবে এটা মোটেও আশা করেনি রেখা। আপনমনে বিড়বিড় করে বলল,
“কাজটা তুমি মোটেও ঠিক করলে না পারমিতা।”

রেখাকে প্রণয় দিয়ে আসতে গেল। যদিও বাড়িতে যায়নি। রাস্তা থেকেই চলে এসেছে। রেখা অনেক অনুনয় বিনয় করেছে। কোনো লাভ হয়নি তাতে। প্রণয় বাড়িতে গেল না। হৈমন্তীদের বাড়িতে প্রণয়ের একমাত্র না যাওয়ার কারণ রনিতা। ওই মহিলা যেখানে থাকবে সেখানে প্রণয় নেই।

রনিতা কার কাছ থেকে যেন নম্বর জোগাড় করে ফোন দিল পারমিতাকে। কাঁদতে কাঁদতে মুখে যা আসল তাই বলে অভিশাপ দিল পারমিতাকে। এ-ও বলল,
রনিতা যদি সংসার করতে না পারে। ভগবানের দিব্যি পারমিতাকেও সংসার করতে দেবে না রনিতা। রনিতার
আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর শুনে পারমিতা ভড়কে গেল। পারমিতা তো জানে, এই পৃথিবীতে ভালো মানুষের থেকে খারাপ মানুষগুলোই বেশি ভালো থাকে। বেশি সুখে থাকে। মেয়েটা সবে একটুখানি সুখের মুখ দেখেছে।
পারমিতার সুখের সংসারে কারো যেন নজর যে না লাগে ঠাকুর।

ভাগ্য বোধহয় এবারও পারমিতাকে নিরাশ করল। প্রণয় প্রতিনিয়ত ভরসা দিল ঠিকই। কিন্তু পারমিতার মনের ভয় একটুও দূর হলো না। উল্টো ভয় মনের ভেতরে চেপে বসল।
দিনগুলো দিব্যি কেটে যাচ্ছে। রাত ফুরিয়ে ভোর হচ্ছে। ভোরের পরে বিষণ্ন দিনটা কেটে গিয়ে আবারও রাত নামছে। রেখার মুখে শুনেছে। রেখার বড়ো ছেলে রনিতাকে জোর করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। খুব শীঘ্রই ওদের ছাড়াছাড়ি হতে চলেছে। রনিতা তার বরের নামে কেস দিতে চেয়েছিল। ওদের ছাড়াছাড়ির পেছনে শক্তপোক্ত আসল প্রমাণ থাকার জন্য রনিতা সাহস পায়নি।

দিনটি মঙ্গলবার।
প্রণয় ডিউটিতে। হিয়া স্কুলে। পরেশবাবু নাতনিকে স্কুলে দিয়ে আজ আর বসে থাকেনি। তার শরীরটা খারাপ লাগছিল দেখে চলে এসেছে। বাড়িতে এসে পারমিতাকে বলল,
হিয়াকে যেন স্কুল ছুটির পর আনতে যায়। তার শরীর ভালো লাগছে না। একটু ঘুমাবে। পারমিতা হাতের কাজ শেষ করে আগে আগেই রেডি হয়ে নিল। তারপর হিয়াকে আনতে চলে গেল।
স্কুলে গিয়ে দেখল, এখনো ছুটি হয়নি। আরও দশ মিনিট পরে ছুটি হবে। পারমিতা হিয়ার ক্লাসের সামনে যেতে নিল। কে যে পিছু ডাকল পারমিতাকে। হিয়ার বান্ধবীর মা। বলল,
“চলুন এই দিকটায় গিয়ে একটু গল্প করি।”
পারমিতা স্মিত হেসে বলল,
“আগে হিয়াকে দেখে আসি।”
ভদ্রমহিলা পারমিতার হাত টেনে ধরল। একপ্রকার জোর করেই পারমিতাকে একটু দূরে আমগাছ তলায় নিয়ে গেল। এইখানটায় বেশ ঠাণ্ডা। বসার জায়গাও আছে। আরও অনেকেই এখানে বসে আছে। পারমিতা ভদ্রতা করে বসল। এই বসায় বুঝি কাল হলো পারমিতার।
ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে। পারমিতা বলল,
“আমি এবার যাই।”
ভদ্রমহিলা বলল,
“আর একটু বসুন না। ওরা এখানেই আসবে। অযথা গিয়ে লাভ নেই।”
“হিয়া জানে না। আমি এসেছি।”
মহিলাগুলো প্রচুর গল্পবাজ। বার বার একথায় সেকথায় আটকে দিচ্ছিল পারমিতাকে। এমন ভাবে পারমিতাকে প্রশ্ন করছিল। পারমিতার তারা থাকলেও উপেক্ষা করে চলে আসতে পারছিল না। ছুটির ঘণ্টা বাজার পর পাঁচ/সাত মিনিটের মতো বোধহয় দেরি হলো।
এসে দেখল, হিয়া নেই। পারমিতা হিয়ার ক্লাস রুমে গিয়েও হিয়াকে পেল না। এবার পারমিতার একটু ভয় ভয় করতে লাগল। লাইব্রেরিতে গেল। দপ্তরির কাছে জিজ্ঞেস করল কেউ নাকি ছুটির পর হিয়াকে দেখেনি। আশ্চর্য একটা মেয়ে এভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে নাকি? বুকের ভেতর ভয় বাসা বেঁধেছে। দূরুদূরু বুকে সারা স্কুল, মাঠ, চষে ফেলল পারমিতা। কোথাও হিয়াকে দেখতে পেল না। পরেশবাবুকে ফোন দিল।
“হিয়া কি বাড়ি চলে গেছে বাবা?”
“নাতো। কেন তুমি কোথায়?”
পারমিতা ঝরঝর করে কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“হিয়াকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না বাবা।”
পরেশবাবুর বুক ধড়ফড় করে উঠল। অস্থির হয়ে বলল,
“খুঁজে পাচ্ছ না মানে কি? দেখো ভালো করে আমি আসছি…”

(চলবে)