বেলাশেষে পর্ব-৩১+৩২

0
19

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ৩১

কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে পারমিতা। ইতিমধ্যে কয়েকবার দাঁত লেগে গেছে। যতক্ষণ হুঁশ থাকে ততক্ষণ নিজের বুক চাপকে আহাজারি করে কাঁদে পারমিতা।
প্রণয় কি করবে বুঝতে পারছে না। একদিকে মেয়েকে হারানোর তীব্র শোক। অপরদিকে পারমিতার অবস্থার অবনতি দেখে ভয় হচ্ছে প্রণয়ের। যদি আবারও মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে পারমিতা। পরেশবাবু একমাত্র আদরের নাতনিকে হারিয়ে কেমন পাগল পাগল হয়ে গেছে। প্রণয়ের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে বাবা ও পারমিতার সামনে মন খুলে কাঁদতেও পারছে না। লুকিয়ে লুকিয়ে অনেকক্ষণ হৈমন্তীর ছবি জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে প্রণয়। সেই দুপুরে মেয়েটা নিখোঁজ হয়েছে। এখন রাত বাজে বারোটা। অথচ কেউ মেয়েটার কোনো খোঁজ দিতে পারছে না। প্রণয় পুলিশকে জানিয়েছে। ছবি দিয়ে মাইকিং করা হয়েছে। যে হিয়াকে খুঁজে এনে দিতে পারবে তাকে একলক্ষ টাকা পুরুষ্কার দেওয়া হবে। কিছুতেই হিয়ার খোঁজ মিলছে না। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেও সন্দেহজনক কিছুই পায়নি। হিয়া স্কুল ছুটির পর, দুজন বান্ধবীর সাথে হেঁটে আসছিল। অর্ধেক পথ এসে মেয়েদুটো কি বলে যেন চলে গেল। অগত্যা হিয়া একাই স্কুল গেইট পার হয়ে গেল। যে মেয়েদুটোর সাথে হিয়া শ্রেনীকক্ষ থেকে বের হয়ে এসেছে। তাদের খুঁজে এনে প্রশ্ন করা হলো। তারা বলল, তাদের মা স্কুলের ভেতরে আমগাছতলায় বসে ছিল। তাই হিয়াকে বাই বলে চলে গেছে। আর হিয়ার দাদু প্রতিদিন স্কুল থেকে খানিকদূরে একটা টঙ দোকানে বসে চা খায়। সেখানেই হয়তো কাউকে না দেখে, দাদুকে খু্ঁজতে গিয়েছিল। যেহেতু টঙ দোকানে যেতে রোড পার হতে হয় না। তাই সাহস করে একাই গিয়েছিল হিয়া। সেই সুযোগে কেউ হয়তো ওকে অপহরণ করেছে। কিন্তু কে করতে পারে এইকাজ? কেউ যদি টাকার লোভে এইকাজ করে তাহলে তো এতক্ষণ ফোন দিয়ে মুক্তিপণ চাওয়ার কথা। প্রণয়ের মাথা কাজ করে না। হৈমন্তী মারা যাওয়ার পর, এই মেয়েটা ছিল প্রণয়ের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সারাদিন ডিউটি করে রাতে এসে যখন দেখত, মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। কী যে শান্তি লাগত প্রণয়ের। হিয়াটা ছোটো থাকতে খুব জ্বালাত। রাতে ট্যা ট্যা করে কাঁদত। মা প্রায়ই রেগে যেত। প্রণয় মেয়েকে কোলে নিয়ে সারাঘর হেঁটে বেড়াত আর গল্প করত। অবুঝ মেয়েটা চুপটি করে বাবার বুকে মাথা রেখে খুব মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেত। কতদিন মেয়েকে বুকে নিয়েই ঘুমিয়েছে প্রণয়। মেয়েটা বাবা বলতে পাগল। তার যত বায়না, কত আহ্লাদ, কত রাগ, অভিমান সব ছিল বাবার সাথে। এত আদরের মেয়েটাকে হারিয়ে কীভাবে এতটা শক্ত আছে প্রণয়? কথাটা মনে হতেই ফুঁপিয়ে উঠল প্রণয়। কেউ দেখে ফেলার আগে চোখের জল টুকু চট করে, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেলল। আজ পারমিতার সাথেও খুব খারাপ ব্যবহার করেছে প্রণয়। কড়া কণ্ঠে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দিয়েছে। পারমিতাকে এতবেশি কথা শোনানো ঠিক হয়নি। প্রণয়ই বা কি করবে! এতবড়ো একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কতক্ষণ মেজাজ ধরে রাখা যায়। ও তো রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। হিয়ার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে হৈমন্তীর বড়োবউদি রনিতাকেও সন্দেহ হয়। প্রণয় খোঁজ লাগিয়েছিল। মহিলা কোথাও যায়নি। বাপের বাড়িতেই আছে। দিনকাল ভালো না। পবিত্রা খুললেই কি সব বিভৎস নিউজ শোনা যায়। যদি হিয়ার কোনো বড়ো ক্ষতি করে ফেলে। প্রণয়ের বুকের পাঁজর ভেঙে গেল। কি করলে হিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাবে ঠাকুর? বাড়িতে অসুস্থ পারমিতাকে ফেলেই একা একা সারা এলাকা হিয়াকে হন্ন হয়ে খুঁজছে প্রণয়। প্রতিবেশীরাও হেল্প করেছে। কিন্তু কতক্ষণ তারা আর রাত জেগে সাথে থাকবে।

প্রণয়রের ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো রাত একটার পরে। একটা মহিলা কণ্ঠ। কণ্ঠটা বেশ চেনা চেনা লাগল। তবুও ভালো করে চিনতে পারল না প্রণয়।
“হ্যালো…হ্যালো..কে?”
“এত অস্থির হচ্ছ কেন?”
“কে আপনি?”
“আমাকে তো চিনবে না। তোমাকে এতরাতে কেন ফোন দিয়েছি তার কারণ বলি আগে!
ভদ্রমহিলা উঁচু কণ্ঠে কাকে যেন বলল,
“ তুই না তোর বাপের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলি নে কথা বল?”
একটা খুব পরিচিত মলিন কণ্ঠ কানে ভেসে এলো। ‘হিয়া’ প্রয়ণের বুকের রক্ত ছলকে উঠল। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“হিয়ামণি..”
হিয়ার কান্নারত কণ্ঠ ভেসে এলো।
“পাপা…আমাকে বাঁচাও…ওরা খুব পচা। আমাকে মেরে ফেলবে পাপা..
“কে.. কে তোমাকে মেরে ফেলবে মা? আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই। পাপা আছি তো। তুমি এখন কোথায় আছো? কার সাথে আছো মা? বলো..বলো পাপাকে।”
“আমি কাউকে চিনি না পাপা..আমাকে বাঁচাও প্লিজ..
“তুমি কার সাথে ওখানে গেছো? বলো পাপাকে?”
“মা….
হিয়া পুরো কথা শেষ করতে পারল না। কে যেন চট করে হিয়ার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে গেল। ফোনের ওপাশে হিয়ার আত্ম চিৎকার শোনা গেল। ভয়ে আতঙ্কে প্রণয়ের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। মহিলা ফোনটা কানে ধরে গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“হ্যালো.. আছো?”
“কে..কে? আপনি আমার মেয়েকে কেন আটকে রেখেছেন? ওকে ছেড়ে দিন প্লিজ..
“ মেয়েকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে, তাই না?”
“কি চাই আপনার? কত টাকা লাগবে? শুধু অংকটা বলুন। তবুও ওর গায়ে ফুলের টোকা দেবেন না আপনি।”
“ইশ, খুব টাকার গরম দেখানো হচ্ছে। কিন্তু প্রণয়বাবু আমি যে টাকা চাই না।”
“আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন প্লিজ..
“ তোমার মেয়েকে ছেড়ে দিলে কি দেবে আমাকে?”
“আপনি কি চান তাই তো বলছেন না।”
“বলব।”
“তো বলুন..?”
“ধরো, আমি যা চাইলাম তুমি আমাকে তা দিলে না। আগামীকাল তোমার মেয়ের মরাদেহ বস্তাবন্দি অবস্থায় একটা ব্রিজের নিচে কিংবা ডোবায় পাওয়া গেল কেমন হবে?”
প্রণয়ের বুকে ভয়, মুখে রাগ। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“খুন করে ফেলব আপনাকে আমি।”
“ইশ, এতো সহজ বুঝি। তোমার মেয়েকে জীবিত পাবে একটা শর্তে।”
“কী শর্ত?”
“ডিভোর্স দিতে হবে তোমার বউকে।”
প্রণয় হতভম্ব হয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল,
“অসম্ভব।”
“তাহলে আর কি তোমার মেয়ের মরামুখ দেখার জন্য প্রস্তুত হও।”
“খবরদার না। ওর গায়ে ফুলের টোকাও দেবেন না আপনি।”
“দেব..দেব। আর একটু অপেক্ষা করো। তার প্রমাণ আগামীকালই পাবে।”
“আমার বউ কি ক্ষতি করেছে আপনার?”
“তুমিই তো আমার বড়ো অশান্তির কারণ প্রণয়।”
প্রণয় প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলল,
“হৈমন্তীর বউদি।”
“এতক্ষণে চিনতে পারলে তাহলে..”
“হিয়াকে ছেড়ে দিন। ভুলে যাবেন না। ও কিন্তু শুধু আমার একার না হৈমন্তীও মেয়ে।”
“ভুলে যাইনি তো। আমার একটা পুরোনো রোগ কি জানো? কারো সুখ সহ্য হয় না। তুমি হৈমন্তীর সাথে সুখে ছিলে তাও সহ্য হয়নি। এখন পারমিতার সাথে সুখে আছো তাও সহ্য হচ্ছে না। তাছাড়া শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছি। আমার সন্তানদের আমার কাছে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র তোমার জন্য সব হারিয়ে নিঃস্ব আমি।”
“আমার জন্য না। আপনি নিজের দোষে সব হারিয়েছেন।”
“এত গলা উঁচু করে আমার সাথে কথা বলোনা প্রণয়। শুনতে ভালো লাগে না।”
“আমি আপনাকে জেলের ভাত খাওয়াব।”
“জেলে যাওয়ার আগে তোমার মেয়েকে নিজের হাতে খুন করে রেখে তবেই জেলে যাব।’’
আতঙ্কে প্রণয়ের মুখের রক্ত সরে গেল।

(চলবে)

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ৩২

প্রণয় ভয় জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“খবরদার, আপনি আমার মেয়ের গায়ে হাত দিবেন না।”
রনিতা কেমন করে যেন হাসল। কী বিদঘুটে হাসির শব্দ। বলল,
“দেব না। তুমি আমার কথা রাখো..
প্রণয়ের ভয় তখনো কাটেনি। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“কি..কি করতে হবে আমাকে?”
“বেশি কিছু না। শুধু তোমার বউকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। তাহলে তোমার আদরের মেয়েকে আমি অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেব।”
“আমি আপনার সবকথা শুনব। প্লিজ হিয়ার সাথে কিছু করবেন না আপনি।”
“চালাকি করার চেষ্টা করো না প্রণয়। মনে রেখো, তোমার আমাকে খুঁজে বের করতে লাগবে তিনঘণ্টা, আর আমার হিয়াাকে শেষ করতে লাগবে মাত্র তিন মিনিট। ঘণ্টা আর মিনিটের তফাত যদি বুঝো, তাহলে কোনো প্রকার চালাকি করো না। একদিন সময় দিলাম। একদিনের ভেতরে তুমি সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলো। একদিকে তুমি পারমিতাকে ডিভোর্স দেবে, অন্যদিকে আমি হিয়াকে তোমার কোলে ফিরিয়ে দেব। রাখি।”

রনিতা ফোন রেখে দিল। প্রণয়ের হাত খসে ফোনটা ফ্লোরে গড়িয়ে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে খাটে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ সময় নিল ধাতস্থ হতে। তারপর পুলিশকে ফোন দিয়ে হিয়াকে খুঁজতে মানা করে দিল। একবার উকিলের সাথেও কথা বলে নিল। তারপর একজনকে ফোন দিয়ে, নিচু স্বরে অনেকক্ষণ কথা বলল প্রণয়।
ফোনে কথা শেষ করে পারমিতার কাছে গিয়ে বসল। মেয়েটার অবস্থা শোচনীয়। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ কেঁদে বুক ভাসায়। মায়ার টান বড়োই গভীর। কে বলবে, হিয়া পারমিতার নিজের মেয়ে না। প্রণয় বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পারমিতার মাথায় হাত রাখল। পারমিতার গালে একফোঁটা নোনাজল পড়ল কি? প্রণয় চোখদুটো মুছে নিল। তারপর পারমিতার কপালে চুমু এঁকে দিল। পারমিতা ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে বলছে,
“হিয়ামণি…ও হিয়ামণি তুমি কোথায়? মা কষ্ট পাচ্ছে তো। তুমি ফিরে আসো তাড়াতাড়ি…
প্রণয়ের ভালো লাগছে না। খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। প্রণয় আর হাত গুটিয়ে বসে থাকল না। জামা পাল্টে কোথায় যেন চলে গেল।

ঘন্টা দুই পর রনিতা ফোন দিল। প্রণয় এতক্ষণ এই ফোনের অপেক্ষায় ছিল। রনিতার ফোন পেয়ে প্রণয়ের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি খেলে গেল। ফোন রিসিভ করতেই রনিতা চিৎকার করে উঠল। বলল,
“তোর এতবড়ো সাহস, তুই আমার ছেলে-মেয়েকে জিম্মি করেছিস।”
“আর কিছু বলবেন?”
“হিয়ার ভালো চাইলে এখুনি ছেড়ে দে ওদের।”
প্রণয় দ্বিগুন স্বরে চেঁচিয়ে বলল,
“ওদের ভালো চাইলে হিয়াকে এখুনি ছেড়ে দেন। ঘণ্টা দুই আগে, সেকেন্ডের হিসাবটা কিন্তু আপনিই করেছিলেন।”
“তোকে আমি নিজের হাতে খুন করব জানোয়ার।”
“কে কাকে খুন করবে সেটা তো সময় বলে দেবে। আপনার সন্তান যেমন আপনার কলিজা। আমার সন্তানও তেমন আমার কলিজা। আর আমার কলিজায় যে হাত দেবে তার কলিজা আমি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব। হিয়ার গায়ে যদি একটা ফুলের টোকাও লাগে। ভগবানের দিব্যি। আপনার ছেলেমেয়েকে আমি নিজের হাত খুন করব অবশ্যই আপনাকে ভিডিওকলে রেখে।”
ভয়ে রনিতার গলা শুকিয়ে এলো। বলল,
“আমি হাত জোর করছি ওদের ছেড়ে দে তুই।”
প্রণয় বলল,
“আর আমি আপনাকে একঘণ্টা সময় দিলাম। হিয়াকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ওর স্কুলের সামনে রেখে যাবেন। যদি একমিনিট এদিক-সেদিক হয়। বুঝতেই তো পারছেন কি হবে। আর একটা কথা! আমি কাপুরুষ নই। কারো কথায় ভয় পেয়ে কিংবা প্রবাহিত হয়ে আমার বউকে ডিভোর্স দিয়ে দেব। একটা বিপদ কাটানোর একশো একটা মাধ্যেম থাকে। সোজা পথে না হেঁটে, মাঝে মাঝে একটু ব্যাঁকা পথে হাঁটলেও ঠিকই বিপদ কাটানো যায়। আর আজকেই আমি কোর্টের মাধ্যেমেও বিয়েটা পাকাপোক্ত ভাবে সেরে ফেলব।”

প্রণয় ফোন রেখে দিল।
প্রণয়ের কথায় কাজ হলো। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর হিয়াকে স্কুলে গেইটে রেখে গেল রনিতা। পুলিশ বোধহয় কোথাও ওঁত পেতে ছিল। রনিতা হিয়াকে ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে রনিতাকে এরেস্ট করা হলো। রনিতা গলা ফাঁটিয়ে প্রণয়ের নামে একগাদা অভিযোগ করল। রনিতার ছেলে-মেয়েকে প্রণয় অপহরণ করেছে বার বার বলার পরও পুলিশ বিশ্বাস করল না। রনিতা বলল,
“আমার কথা বিশ্বাস নাহলে আমার হাজবেন্ডকে ফোন দিয়ে দেখুন, আমার ছেলে-মেয়ে নিখোঁজ।”
রনিতার কথায় পুলিশ বিরক্ত হলো ঠিকই তবে রনিতার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে রনিতার হাজবেন্ডকে ফোন দিয়ে ঘটনা সত্যি নাকি জিজ্ঞেস করল। ভদ্রলোক অস্বীকার করল। এবং জানাল, তাদের ছেলেমেয়ে কোথাও যায়নি। তার সামনে বসে বসে পড়ছে। পুলিশকে, ছেলেমেয়ের সাথে কথাও বলিয়ে দিল ভদ্রলোক।

প্রণয় হিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে, আদরে আদরে মেয়ের সারামুখ ভরিয়ে দিল। হিয়া বাবাকে দেখে ফুঁপিয়ে উঠল। বাবার বুকে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে দিল।

রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে রনিতার নিজের চুল এখন নিজেরই টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। চিৎকার করে বলল,
“ডাবল গেম খেললে, কাজটা তুমি মোটেও ভালো করলে না প্রণয়। এর খেসারত দিতে হবে তোমাকে। কঠিক ভাবে দিতে হবে।”
প্রণয়ের চোখে-মুখে একরাশ ঘৃণা। রনিতার খুব কাছে গিয়ে, চাপা কণ্ঠে বলল,
“আমাকে খেসারত দেওয়ার জন্য তো তোকে আগে জেল থেকে বের হতে হবে। দরকার হলে এই শহরের সবচেয়ে বড়ো উকিলের কাছে যাব আমি। তুই এত বড়ো অন্যায় করেও জেল থেকে কীভাবে বের হোস আমিও দেখব। হিংসা মানুষের পতনের মূল। তোর ভেতরের মারাত্মক হিংসা আজ তোকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। পুলিশ, ওকে এখুনি আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যান প্লিজ…

প্রণয় হিয়াকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। মেয়ের দিকে জলের বোতল বাড়িয়ে দিল। হিয়া অল্প একটু জল খেল। একটা টিস্যু দিয়ে প্রণয় খুব যত্ন করে হিয়ার চোখ-মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার মামী কি তোমাকে মেরেছে সোনা?”
“(নিশ্চুপ।)”
প্রণয় হিয়ার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল। বলল,
“ভয় নেই। সত্যিটা বলো পাপাকে?”
হিয়ার চোখ-মুখে চাপা আতঙ্ক। বিড়বিড় করে বলল,
“না। তবে..
“ তবে কি সোনা? চুপ করে থেকো না বলো পাপাকে?”
“মামী খুব পচা পাপা। আমাকে অনেক ব্যথা দিয়েছে। আর খুব খুব ভয় দেখিয়েছে।”
“কোথায় ব্যথা দিয়েছে সোনা?”
হিয়া বিড়বিড় করে প্রণয়কে কথাগুলো বলতেই রাগে প্রণয়ের মুখ লাল হয়ে গেল।
প্রণয়ের চোখে জল। মেয়ের আড়ালে চট করে চোখের জল মুছে ফেলল প্রণয়। কথা ঘুরিয়ে বলল,
“তোমার মা তোমার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
“পাপা…
“বলো সোনামণি?”
“মামী বার বার বলছিল, ওই মহিলা আমার আসল মা না। নকল মা। ওই মহিলাকে তুমি খারাপ উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছ। মা নাকি আমাকে আর আদর করবে না, ভালোবাসবে না। ওনার যখন নিজের বাচ্চা হবে, তখন আমাকে দেখতেই পারবে না। মামীর কথা আমি বিশ্বাস করিনি দেখে, মামী রেগে গিয়ে আমাকে খুব ব্যথা দিয়েছে পাপা পচা ব্যথা।”
“তোমার মামী মিথ্যা কথা বলেছে সোনা। ওনিই তোমার মা। নিজের মা। দেখো না দেয়ালে টাঙানো ছবি আর তোমার মায়ের চেহারা হুবুহু মিল৷ তাছাড়া তোমার মাকি তোমাকে কম ভালোবাসে? আর তুমি মন খারাপ করো না। তোমার মায়ের আর কখনো বাবু হবে না। তুমিই তোমার মায়ের একমাত্র সন্তান।”
“আমি মামীর কথা একটুও বিশ্বাস করিনি পাপা। কিন্তু মামী বার বার বলছিল, আমার মা নাকি আমার জন্মের সময় মারা গেছে। তাছাড়া আমার এই মা তো আমাদের সাথেও ছিল না। আমার নিজের মা হলে তো আমাদের সাথেই থাকার কথা ছিল।” হিয়ার চোখে-মুখে একরাশ কৌতূহল। প্রণয় বলল,
“বলোতো তোমার পাপা কীসের ডাক্তার?” হিয়া উত্তর দিল না।
প্রণয় আবারও বলল,
“তোমার পাপার কাজ কি?”
“পাগলকে ভালো করা।”
“তোমার জন্মের কিছুমাস পর, তোমার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। মাথার সমস্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল। কাউকে চিনতো না। সবাইকে তেড়ে আসত মারতে। আমি হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ধীরে ধীরে ঔষধ খেয়ে তোমার মা সুস্থ হলো। তোমার মা সুস্থ হওয়ার পর তোমার মাকে আবার বাড়িতে নিয়ে এলাম। এখন বুঝতে পারছ তো মা। কেন তোমার মা আমাদের সাথে থাকতো না। এই কথাগুলো তোমার মাকে আবার বলে দিও মা। তোমার মা খুব মন খারাপ করবে।”
“মা কেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল পাপা?”
“এটা একধরনের রোগ মা। আমাদের যেমন শারীরিক অসুখ হয়। তেমন মানসিক অসুখও হয়। প্রপার যত্নের অভাবে। আমরা শারীরিক অসুখকে গুরুত্ব দিলেও মানসিক অসুখকে খুব বেশি গুরুত্ব দেই না। যার ফলে ধীরে ধীরে রোগীর অবস্থা সিরিয়াস হয়ে যায়।”
“তাহলে মামী কেন বার বার মিথ্যা কথা বলছিল পাপা?”
“তোমার মামীও আর সুস্থ নেই মা। মনের দিক দিয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই এমন বানিয়ে বানিয়ে তোমাকে ভুল বোঝানোর জন্য মিথ্যা কথা বলেছে, তোমাকে ভয় দেখিয়েছে, ব্যথা দিয়েছে। একজন সুস্থ মানুষ কি কারো সাথে এমন করে, তুমিই বলো?”
হিয়া মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। প্রণয় বলল,
“আর কখনো স্কুল থেকে একা একা বের হবে না।”
“বের হতে চাইনি পাপা। গেইটের সামনে গিয়ে দেখছিলাম, দাদু টঙ দোকানে বসেছে নাকি! তখুনি মামী দূর থেকে হাতের ইশারায় ডেকে নিয়ে বলল,
“এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল। চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই।”
মামী আমাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠল। তারপর আমার হাতে কিছু চকলেট দিয়ে খেতে বলল। চকলেট খেতে খেতে আমার আর কিছু মনে ছিল না পাপা।”
“এরপর থেকে আমি তোমার মা ও দাদু বাদে বাড়ির বাইরে কেউ কিছু দিলে ভুলেও খাবে না। পরিচিত কেউ যদি কিছু দেয় হাতে রেখে দেবে। পরে ফেলে দেবে।”
“আচ্ছা পাপা।”

ওরা কথা বলতে বলতে গন্তব্যে পৌঁছে গেল। প্রণয় আগেই ফোনে বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে। হিয়াকে খোঁজে পাওয়া গেছে। তবে পারমিতা বোধহয় এখনো জানে না। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। পারমিতার জন্য প্রণয়ের খুব মায়া হয়। কি জানি, মেয়েটা কি কখনো সুখের মুখ দেখবে না।
হিয়া বাড়িতে পা রেখে মাকে চিৎকার করে ডাকতে লাগল। পরেশবাবু ছুটে এসে নাতনিকে কোলে তুলে নিল। হিয়া বলল,
“মা কোথায় দাদু?”
“ঘরে।”
“আমি মায়ের কাছে যাব।”
পরেশবাবু নাতনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। বলল,
“যাও।”
হিয়া ঘরে গিয়ে মাকে খুঁজে পেল না।

(চলবে)