#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ৩৫
প্রণয় এলো অনেক রাতে। হিয়া রাতে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ পরেশবাবু শোবার আয়োজন করছে। পরাগ একটানা অনেকক্ষণ বসে ছিল। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে, পারমিতা বার দুয়েক বলেছে, তোর যদি তারা থাকে আজ যেতে পারিস। অন্য একদিন এসে ‘ওর’ সাথে দেখা করে যাস। পরাগ মলিণ হেসে বলেছে,
“কোথায় যাব আমি! আমার আর যাওয়ার তাড়া নেই। আসুক তোর বর। ধীরেসুস্থে দেখা করে তারপর নাহয় যাব।”
উত্তরে পারমিতা আর কিছু বলেনি। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। রাতে পরেশবাবু পরাগের সাথে বসে অনেক্ষণ গল্প করার পর ঘড়ি দেখে পারমিতাকে বলল,
“অনেক রাত হলো বউমা, তোমার দাদাকে ওই ঘরটা দেখিয়ে দাও। বেচারা শুয়ে পড়ুক। প্রণয় কখন আসবে তাই নেই ঠিক। কতক্ষণ রাত জেগে থাকবে তোমার দাদা।”
পারমিতা ইচ্ছে ছিল না পরাগ এখানে থাকুক। কিন্তু শ্বশুরের কথা ফেলতে পারল না। কিংবা অবচেতন মনে ঔ চেয়েছিল পরাগ আজকের রাতটা এখানে থাকুক। পারমিতা পরাগের শোবার কথা বলতেই পরাগ আগেপিছে না ভেবেই বলল,
“আমি ঘুমাব। খুব ক্লান্ত লাগছে।”
পারমিতা আর দ্বিমত করেনি। দূরদেশ থেকে মাত্র তিনদিন হলো এসেছে পরাগ। এইদেশে এসে হয়তো ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। পারমিতা বিছানা ঝেড়ে দিয়ে বলল,
“শুয়ে পড়। হিয়ার পাপার সাথে আগামীকাল দেখা করিস।”
বাইরে প্রচুর পরিমানে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রণয় বাড়ির বাইরে থাকলে পারমিতার ঘুম হয় না। চিন্তা লাগে। যদিও প্রণয়ের সাথে গাড়ি আছে। কোথাও আসতে যেতে অসুবিধা হয় না। তবুও মানুষটা বাড়ির বাইরে থাকলে মাথার ভেতর অটোমেটিক এক ধরনের চিন্তা ভর করে। ইতিমধ্যে দুইবার ফোন দিয়ে ফেলেছে পারমিতা৷ প্রণয় বলল,
“আমার জন্য রাত জাগতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। আজ পেশেন্ট বেশি। আমার আসতে দেরি হবে।”
প্রণয়ের কথা শুনেনি পারমিতা। রাত জেগে বসে আছে। যেদিন রাতে ডিউটি থাকে সেদিনের হিসাব অন্য। তবে দিনে ডিউটি থাকলে ফিরতে একটু রাত হলেই চিন্তায় ঘুমই ধরে না পারমিতার। তাছাড়া শেষবার যখন প্রণয়ের সাথে কথা হলো। প্রণয় তখন গাড়িতে। নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। তোমার যদি সময় না কাটে একটু সাজুগুজু করো তো পারমিতা। নীল জামদানী শাড়িটা পরো। বৃষ্টি আমি আর তুমি।
আজ এ রাতে, তুমি আমারই সাথে, হাতে হাত রেখে,
শেষের গানের লাইনগুলো সুর করে বলল প্রণয়৷
“ইশ…”
পারমিতা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বুকের ভেতর রোমাঞ্চকর শিহরণ জাগানো উষ্ণ অনুভূতি।
পারমিতা প্রণয়ের কথা রাখল৷ এতরাতে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে স্নান করল। তারপর ভেজা চুল হালকা শুকিয়ে নিয়ে, খুব সুন্দর করে শাড়ি পরল। চুলগুলো সিঁথি করে ছেড়ে দিল। সিঁথি ভর্তি সিঁদুর পরল, কপালে নীল টিপ, চোখে গাঢ় করে কাজল টানল, ঠোঁটে ন্যুড কালারের লিপস্টিক পরল। তারপর আয়নার সামনে বসে, নিজের দিকে তাকিয়ে প্রণয়ের কথা ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি ফুটে রইল। মনটা বড়োই চঞ্চলা।
“পারমিতা…. “
প্রণয়ের কণ্ঠ কানে ভেসে আসতেই বুকের ভেতর দুরুদুরু করে উঠল। হাত-পা শিরশির করছে। আয়নায় নিজেকে দেখতেও লজ্জা লাগছে খুব। অন্যদিন হলে প্রণয়ের ডাক শুনে ছুটে যেত পারমিতা। আজ পা’দুটো অবশ হয়ে আসছে। এইঘর থেকে এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। প্রণয় ঘরে এসে ব্যাগ রাখতে রাখতে বলল,
“কি ব্যাপার.. আমার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে, ফোন দিয়ে না অস্থির করে ফেলছিলে। অথচ বাড়িতে এসে ডাকার পরও এগিয়ে গেলে না তো?”
পারমিতা চুপ করে হাতে কাপড়ের আঁচল প্যাঁচাতে লাগল। প্রণয় কথা বলতে বলতে একপলক পারমিতার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। বুকের ভেতর হৈমন্তের ধানপাতার মতো তিরতির করে কাঁপছে। প্রণয় স্বপ্নেও ভাবেনি৷ পারমিতা সত্যি সত্যি প্রণয়ের কথা রাখবে। শুনতে খারাপ লাগলেও একটা কথা সত্যি বিবাহিত জীবনে হৈমন্তী কোনোদিনও প্রণয়ের এককথা রাখেনি। একটা কথা অনেকবার বলার পর মন চাইলে রাখতো। নাহলে না। হৈমন্তী প্রচুর ঘুমকাতুরে ছিল। কোনোদিন প্রণয়ের জন্য রাত জেগে বসেও থাকেনি। অথচ বিয়ের পর পর প্রণয় খুব আশা নিয়ে থাকতো। ভাবতো বাড়িতে এসে দেখবে, হৈমন্তী খাবার টেবিলে প্রণয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বোধহয় ঘুমিয়ে যাবে। প্রণয় ডেকে তুলে দুজন একসাথে ভাত খাবে। আর এসে দেখত, হৈমন্তী ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আর মা বসে আছে। প্রণয় মনে মনে খুব হতাশ হতো। হৈমন্তীর মন খারাপ হবে দেখে, কখনো প্রণয়ের গোপন অভিযোগ গুলো মুখ ফুটে বলতো না। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেল। পরে আর খুব একটা খারাপ লাগত না। তবে পারমিতা মেয়েটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। পারমিতাকে যত কাছ থেকে দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে প্রণয়। পারমিতার মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রণয় খেয়াল করে দেখেছে, পারমিতাকে কোনো কথা কখনো একবার ছেড়ে দুবার বলতে হয় না। প্রণয়ের অল্পবয়সে বিয়ে নিয়ে, নিজের বউ নিয়ে যেমন ফ্যান্টাসি মনে কাজ করতো। পারমিতা ঠিক তেমন বউ। তবে এখন আর প্রণয়ের অল্প বসয় নেই। তবে মনটা বোধহয় তেমনই আছে। নাহলে পুরোনো কথাগুলো মনে পড়তেই এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে যাবে কেন প্রণয়। প্রণয় ধীর পায়ে পারমিতার খুব কাছে চলে এলো। যতটা কাছে এলে দুজনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ঠিক ততটা কাছে। বামহাতে গলার টাই ঢিলে করতে করতে পারমিতার কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল প্রণয়। পারমিতা তাল সামলাতে না পেরে প্রণয়ের বুকে দুইহাত রাখল। প্রণয় পারমিতার কপালে কপাল ঠেকিয়ে গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে বউ। একদম নেশা ধরে যাচ্ছে।”
পারমিতা একটা একটা করে প্রণয়ের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে নিচু কণ্ঠে বলল,
“চলো, ভাত খেয়ে নেবে।”
প্রণয় হাসল। পারমিতাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে, পারমিতার ঠোঁটে গভীর চুমু এঁকে দিল। ফিসফিস করে বলল,
“এখন ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না। অন্যকিছু…
প্রণয় পুরো কথা শেষ করতে পারল না। পারমিতা একহাত দিয়ে প্রণয়ের মুখ চেপে ধরে, লজ্জায় প্রণয়ের বুকে মুখ লুকাল। বলল,
“চুপ..
প্রণয় নিজের মুখ থেকে পারমিতার হাতটা সরিয়ে নিল। নেশা জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“ চলো..ওই ঘরে চলো।”
“তুমি আগে খেয়ে নাও..”
আবারও হাসল প্রণয়। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল,
“খাব তো..তবে ভাত না।”
প্রণয় চট করে কোলে তুলে নিল পারমিতাকে। পারমিতার বাঁধা শুনল না। পাশের ঘরে পারমিতাকে নিয়ে গেল।
রাতের তৃতীয় প্রহর। কয়েক দফা ভালোবাসাবাসির পর, প্রণয়ের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে পারমিতা। প্রণয় পারমিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পারমিতার চোখে জল। প্রণয় দেখার আগেই চোখের জলটুকু আড়ালে মুছে নিল পারমিতা। প্রণয় কেন পারমিতাকে এত ভালোবাসে, এত আদর করে, এত সম্মান করে, সব কথার গুরুত্ব দেয়। অনিরুদ্ধ তো এমন ছিল না।
মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয় পারমিতার। অনিরুদ্ধ নামক বিষাক্ত কালো অতীতের সাথে দেখা না হয়ে প্রণয়ের সাথে দেখা হলো না কেন! তাহলে শুরু থেকেই নিজের দেহ, মন উজার করে প্রণয়কে ভালোবাসতে পারত পারমিতা। এমনকি প্রণয়ের বাচ্চারও মা হতে পারত। এই মানুষটা এত কেন বুঝে পারমিতাকে। ঠাকুরের কাছে এখন একটাই প্রার্থনা। এই মানুষটার মৃত্যুর এক সেকেন্ড আগে যেন পারমিতার মৃত্যু হয়। জীবনে অনেককিছু হারিয়েছে পারমিতা। এই মানুষটাকে হারাতে পারবে না। কিছুতেই পারবে না।
“কী ভাবছ?”
পারমিতা মাথা তুলে প্রণয়ের মুখের দিকে তাকাল। মাথা নেড়ে বলল, “কিছু না।”
“পারমিতা…?”
“বলো?”
“তোমার দাদা এখানে থাকলে আমার কোনো সমস্যা নেই।”
পারমিতা চমকে উঠল। অস্ফুট স্বরে বলল,
“হঠাৎ একথা বলছ কেন?”
“তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি তোমার দাদাকে নিয়ে খুব টেনশন করছ।”
“না তেমন কিছু না।”
“আমি বুঝি পারমিতা।”
“দাদার জন্য যে টেনশন লাগছে তা মিথ্যা বলব না। তবে আমি চাই না দাদা এখানে থাকুক।”
“কেন?”
“যে মানুষটা নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে একবার ঠকাতে পারে, সেই মানুষটা সুযোগ পেলে যে আমাকে আবার ঠকাবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারো প্রতি একবার মন থেকে বিশ্বাস উঠে গেলে তার প্রতি আর নতুন করে বিশ্বাস জন্মায় না।”
“তাহলে কি করতে চাচ্ছ?”
পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি চাই তুমি ওর একটা কাজের ব্যবস্থা করে দাও। যেন ও খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। তবে দাদা এখানে থাকুক আমি চাই না।”
“কেন চাও না পারমিতা?”
পারমিতার চোখদুটো ছলছল করে উঠল। প্রণয়ের একহাত ধরে বলল,
“অনেককিছু হারানোর পর, আমি তোমাকে পেয়েছি, আমার মেয়েকে পেয়েছি। সুন্দর ভাবে বাঁচার মতো একটা জীবন পেয়েছি। আমার সুখের সংসারে আমি আর নতুন করে কোনো অশান্তি চাই না। দাদার জন্য হিয়ার ছোটো মনে কোনো বাজে প্রভাব পড়ুক আমি তা চাই না। দাদা এই বাড়িতে থাকলে একদিন না একদিন হিয়া ঠিকই জেনে যাবে ও আমার আপন দাদা। তখন হিয়া আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে গেলে আমি সহ্য করতে পারব না। জীবন আমাকে বার বার সুযোগ দেবে না। এবার ভুল করে তোমাদের হারাতে চাই না আমি। তোমাদের হারালে আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে যাবে।”
প্রণয় শক্ত করে পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,
“আমিও তোমাকে হারাতে পারব না। তুমি যা বলছ, তাই হবে। দূর থেকেও সাহায্য করা যায়। আমি তোমার হয়ে তোমার দাদাকে দূর থেকেই সাহায্য করব৷”
পারমিতা নিশ্চিন্তে প্রণয়ের বুকে মাথা রাখল। এই বুকে মাথা রাখলে খুব শান্তি লাগে।
(চলবে)