#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৮
কারো ঘনঘন উষ্ণ নিশ্বাস বক্ষপটে ধারালো হয়ে বিঁধছে। আচমকা দৃষ্টিজোড়া মেলে তাকাল মাহের। দেখতে পেল রোজকার মতোই অত্যাশ্চর্যকর দৃশ্যটা। তন্দ্রাচ্ছন্ন সূচনার সুশ্রী মুখটা দেখে নিত্যদিনের মতোই বিরবির করে আওড়াল,
-” আমার একেকটা দিনের সূচনা ঘটে আপনার এই নিষ্পাপ মুখটা দেখে। আমার আকাশ ভরা মেঘের ঘনঘটায় আপনি আমার এক টুকরো রোদের আলো।”
অধর কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে তার৷ প্রতি রাতে দু’জন যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমালেও সকালটা আজকের মতোনই অমায়িক সুন্দর হয়। অপলকে তাকিয়ে সূচনার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখায় মগ্ন মাহের। তার এই মগ্নতায় বাঁধ সাধল সেলফোনের রিংটোন। নাম্বার দেখে কেটে দিল সে। মৃদুস্বরে ডাকল সূচনাকে। কারণ হৈমীর বইপত্র নিয়ে সকাল সকালই সূচনাকে শেখ বাড়ি যেতে হবে। সেখানে ঝিনুক আর পনির অপেক্ষায় থাকবে তার জন্য। হামিদা বাড়িতে নেই, সে আছে টিশার দেখভাল করার জন্য হসপিটালে। এরপর হয়তো টিশার বাচ্চাটার জন্য টিশার বাসায়ও থাকবে দীর্ঘদিন। একদিকে ভালোই হলো, এই সময়টায় টিশাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। হৈমীর শোকটাও কাটিয়ে ওঠতে পারবে। মাহেরের এত চিন্তার মাঝে আরো একটি চিন্তা যোগ হয়েছে। তা হলো তার মা এবং সূচনার বাচ্চার প্রতি গভীর ভালোবাসা। গতরাতে বাড়ি ফেরা নিয়ে সূচনা কী মন খারাপটাই না করল! এক প্রকার জোর করেই আনা হয়েছে তাকে। নেহাতই মেয়েটা শান্ত মনের, বুঝদার। তাই রাগ করেনি, মন খারাপ করলেও তা দীর্ঘ করেনি। একবার তার ইচ্ছে করেছিল বলতে,
-” মন খারাপ করবেন না সূচনা। একদিন আমাদেরও এমন বাচ্চা হবে। তাকে সব সময় আপনার কাছে রাখবেন। আমি বাঁধা দেব না, কেউ বাঁধা দেবে না৷ কারণ তার ওপর আপনার অধিকার সর্বোচ্চ। ”
কিন্তু বলেনি। হাজার হোক মেয়ে মানুষের মন। এদের রক্তে, মাংসে মা, মা অনুভূতি লুকিয়ে আছে। দেখা গেল এ কথা শুনে এখনি বাচ্চা কনসিভ করতে চাইবে। প্রেমের বীজ অলরেডি হৃদয়ে বপণ করে দিয়েছে৷ এবার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করার পালা। এসবে মাহেরের বাঁধা নেই, নেই জড়তা। সে নিজেও সূচনাকে পূর্ণরূপে নিজের করে চায়। তবে এই চাওয়া পূর্ণ করার আগে সূচনার স্বপ্ন পূরণ করতে চায়৷ তার যে স্বপ্ন নিজের পায়ে দাঁড়ানো। নিজের আলাদা একটি পরিচয় গড়ে তোলার। তাই সে স্বামী হিসেবে পাশে থেকে, সাপোর্ট করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে চায় নিজের স্ত্রীকে। যেন আজ থেকে বিশ বছর, বা ত্রিশ বছর পর মেয়েটা নিজের সফলতা নিয়ে গল্প করার সময় অর্ধাঙ্গের দিকে একটিবার ফিরে তাকায়। বুকে মাথা গুঁজে তৃপ্তি সহকারে বলে,
-” আপনি আমার সাহস, আপনি আমার শক্তি। ”
জীবদ্দশায় যদি পৃথিবী থেকে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। তবুও যেন প্রিয়তমা তাকে একটি বার স্মরণ করে, যে স্মরণ থাকবে শ্রদ্ধা, এক সমুদ্র ভালোবাসা।
_______
সকাল আটটা। ঘুম ভেঙে চোখ কচলে ওঠে বসল রুদ্র। এদিক ওদিক তাকিয়ে ডানপাশে তাকাতেই ঘুম ছেড়ে গেল তার। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গুনগুন করে গান গাইছে হৈমী। পাশাপাশি মেকআপ বক্স বের করে সাজগোজও করছে। সাতসকালে মানুষ বই খাতা নিয়ে বসে, টুকটাক কাজ থাকলে করে, ব্রেকফাস্টে কী খাবে তাই নিয়ে চিন্তা করে, সে অনুযায়ী রান্নাবান্নাও করে। আর এই মেয়ে মেক-আপ বক্স নিয়ে বসেছে! চোখ, মুখ শক্ত করে নিল সে। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল,
-” এত সাজগোজের মানে কী? ”
হৈমীর মন কাল রাত থেকেই বেশ ফুরফুরে। রুদ্র সরাসরি তাকে সুন্দরী না বললেও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে। এতেই সে ফিদা হয়ে গেছে। বুঝে গেছে রুদ্রর চোখে সে আগুন সুন্দরী। শাবনূরের চেয়ে সুন্দরী মানে তো আগুন সুন্দরীই। সাথে এও বুঝেছে রুদ্র তাকে পছন্দ করে, ভালোও বাসে। সব মিলিয়ে সে খুব খুশি। সেই খুশিকে কেন্দ্র করেই সকাল সকাল একটু সাজতে বসেছে। যাতে ঘুম ভাঙতেই রুদ্র তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে মুগ্ধতায় মুখ ফস্কে প্রপোজও করে দেয়,
-” হৈমী আই লাভ ইউ। ”
রুদ্রর প্রশ্ন শুনে উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকাল সে। চঞ্চলিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” আমাকে কেমন লাগছে? ”
-” খুব বাজে! ”
কাঠ কাঠ জবাব রুদ্রর। জবাব শুনে চোখ বড়ো করে মুখটা গুমড়া করে ফেলল সে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-” এত কষ্ট করল সাজলাম। আর আপনি বাজে বললেন? সাজগোজের কী বুঝেন আপনি? আমাকে সুন্দরই লাগছে। দাঁড়ান আমি আদ্রিতা আপু আর আবির ভাইয়াকে দেখিয়ে আসি। ”
চট করে ওঠে পাশের ঘরে যেতে উদ্যত হলো হৈমী। রুদ্র তড়াক করে ওর হাত টেনে ধরল। ব্যস্ত গলায় বলল,
-” অ্যাই ওঘরে যাবে না। ”
-” আমি যাবই। ”
ত্যাড়ামি করল হৈমী। রুদ্রও দ্বিগুণ ত্যাড়ামি দেখিয়ে শক্ত করে হাত চেপে ধরল। টেনে বসাল বিছানায়। মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-” দেখো এই সব নাটক বন্ধ করো। একটু সিরিয়াস হও, আমি কিন্তু ধৈর্য্যশীল পুরুষ নই। মেরে একদম হাড়গোড় ভেঙে দেব। ”
আঁতকে ওঠল হৈমী। ঢং করে কেঁদে দিয়ে বলল,
-” আপনি আমাকে আবার মারবেন? আমি এখানে থাকব না, এক্ষুনি দিয়ে আসুন আমাকে। আপনার জন্য আমি আমার মা, ভাইকে কষ্ট দিয়েছি আর আপনিই কিনা আমার হাড় ভাঙার পরিকল্পনা করছেন! আমি এখানে থাকব না, আমি আম্মুর কাছে যাব। ”
-” চুপপ! একদম চুপপ। মাথাটা ধরিয়ে ফেলছ আর একটা কথা বললে হাত, পা, মুখ বেঁধে ফেলে রাখব। বেয়াদব মেয়ে! বাড়ি যাওয়ার কথা ভুলে যাও। ঝিনুক আজ তোমার বইপত্র নিয়ে আসবে। সংসার করবে আর পড়াশোনা করবে ব্যস। ”
কাচুমাচু হয়ে বসে রইল হৈমী। রুদ্র ধমকি-ধামকি দিয়ে ওঠে ফ্রেশ হয়ে এলো। দেখল হৈমী বসে আছে, চোখ দু’টো টলমল করছে তার। সত্যি বলতে সিরিয়াস ধমক খেয়ে এবার তার মা, ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। তারা তাকে কখনো এমন করে ধমক দেয়নি। তার মুখোভঙ্গি দেখে রুদ্র বলল,
-” মেয়ে হয়ে জন্মেছ অথচ কিছুই পারো না। বিছানা গোছাতে জানো না, রুম ঝাড় দিতে পারো না, রান্না করতে পারো না, খেতে পর্যন্ত পারো না! শুধু পারো বকবক করতে। শুনেছি পড়াশোনায়ও কাঁচা। শুধু কথায় পাকা, অ্যাই শোনো তোমাকে যদি মানুষ না বানাতে পারি আমিও রুদ্র না। ”
তীব্র অপমানে গাল ফুলে ওঠল হৈমীর৷ থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন! ”
-” নো, যা সত্যি তাই বলছি। ”
কাভার্ড থেকে টিশার্ট বের করতে করতে বলল রুদ্র। হৈমী নাক ফুলিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। টিশার্ট পরতে পরতে রুদ্র আবার জিজ্ঞেস করল,
-” কয়েক মাস পরই তো পরীক্ষা, সেদিকে মন আছে? মন আছে সাজগোজ, আর হাঁসের মতো পকপক করাতে ”
মেজাজ খারাপ হলো হৈমীর। বিছানা থেকে নেমে এসে রুদ্রর সামনে দাঁড়াল। তর্জনী উঁচিয়ে বলল,
-” মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। আমার পড়াশোনা আমি ইচ্ছে হলে করব, আমার মুখ আমি হাজারটা কথা বলব। ”
চোয়াল শক্ত করে হাত বাড়িয়ে রুদ্র তার তর্জনি চেপে ধরল। কিছুটা ব্যথা সহকারেই ধরল। হৈমী ” আহ ” করে ওঠতেই বলল,
-” বেয়াদবি নট এলাউ। যা বলেছি তাই শুনবে। বোঝাপড়া করব পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর! ”
ঢোক গিলল হৈমী। রুদ্র এবার হাতটা নরম করল। সে বলল,
-” আপনাকে কে বলেছে আমি পড়াশোনায় খারাপ? শুনুন, বিসিএসে আসা প্রশ্নের উত্তরও আমি জানি। ”
ভ্রু বাঁকিয়ে রুদ্র বলল,
-” তাই? ”
মনে মনে হৈমী বলল,
-” এই রে বেশি বলে ফেললাম নাকি! ”
-” বিশ্বে কয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল? ”
-” দুইটি, দুইটি। ”
-” প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কবে হয়েছে জানো?”
-” দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগে। ”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রুদ্র। চোখ, মুখের আকৃতি কিছুটা বিকৃতি করে পুনরায় প্রশ্ন করল,
-” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে হয়েছে?
উল্লসিত কণ্ঠে হৈমী উত্তর দিল,
-” প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। ”
উত্তরটা দিয়ে মনে মনে বলল,
-” সাল ভুলে গেছি তাই বলে আমি খারাপ স্টুডেন্ট নই। লজিক দেখিয়ে ঠিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। ”
দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্র বলল,
-” বাহ তোমাকে তো স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ারে এওয়ার্ড দেয়া উচিৎ। আর এ মুহূর্তে তোমাকে আমার মিউজিয়ামে রেখে আসা উচিৎ। ”
কথাটা বলেই হেঁচকা টানে ছোট্ট শরীরটা নিজের বক্ষে এনে ফেলল। তার বুকপটে কপাল ঠেকল হৈমীর। গম্ভীর মুখটায় মাথা তুলে তাকাল সে। রুদ্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ় চোখে তাকিয়ে রইল। কয়েক পল চুপ থাকার পর বলল,
-” সত্যিই নির্বোধ একটা! ব্যাপার না সোজা বানিয়ে ফেলব। ”
________
কফি বানানোয় পারদর্শী থাকায়, হৈমীকে দিয়ে তিন কাপ কফি বানালো রুদ্র। এরপর কল করল আবিরের ফোনে। আবির ফোন রিসিভ করতেই সে বলল,
-” কী রে আজ ওঠবি না? ”
-” এই তো বন্ধু ওঠতেছি। ”
ফোন কেটেই বেরিয়ে এলো আবির। সোফায় বসা ছিল রুদ্র। তাকে দেখে তৃপ্তিময় হেসে এগিয়ে এসে পাশেই বসল। রুদ্র কফি খেতে ইশারা করলে আবির কফির মগ হাতে নিয়ে বলল,
-” ভাই আমি অনেক ভাগ্যবান পুরুষ। প্রেম থাকাকালীন কত ঝগরা করেছি, কত কষ্ট দিয়েছি। অথচ মেয়েটা আমাকে কাল সেরা উপহারটাই দিল। আমি ওকে আর বিন্দুমাত্র কষ্টও দিব না। ও যা বলবে তাই শুনব। জানিস কেমন ফিল হচ্ছে? এই মেয়েটা যদি এখন আমাকে বিষপান করতেও বলে আমি তাই করে ফেলব! ”
বাঁকা হাসল রুদ্র। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আবির আবারো বলল,
-” আমি সত্যি ভাগ্যবানরে ওর মতো বউ পেয়ে। ”
রান্নাঘর থেকে হৈমী বেরোতেই আবিরের এই কথা শুনে চোখ পিটপিট করে এগিয়ে এলো। আবিরকে বলল,
-” শুধু আপনি একা একাই ভাগ্যবান না ভাইয়া উনিও ভাগ্যবান তাই আমার মতো বউ পেয়েছে। আপনি ভালো মানুষ তাই স্বীকার করলেন, কিন্তু উনি মোটেই ভালো মানুষ নন এজন্য স্বীকার করবে না। ”
রুদ্র চোখ গরম করে তাকাল। কথার আগা মাথা না বুঝে এই মেয়েটা ফোঁড়ন কাটতে এলো। মান, সম্মান আর রাখবে না দেখছি! হৈমীর কথা শুনে আবির মিটিমিটি হাসতে লাগল। তার খুব বলতে ইচ্ছে করল,
-” ওর মুখে ভাগ্যবান শুনতে চাইলে তোমাকে যে অনেক সেক্রিফাইস করতে হবে বোন। ”
কিন্তু বলল না। রুদ্র বিষয়টা পছন্দ করবে না। তাছাড়া হৈমী তার ছোটো বোনের চেয়েও ছোটো। তাই ওর সঙ্গে এসব মজা করতেও বিবেকে বাঁধে।
রুদ্রর গরম চাহনি দেখে হৈমী বলল,
-” দেখেছেন কীভাবে তাকাচ্ছে? আপনি কখনো আপুর দিকে এভাবে তাকান? ”
আপুর কথা স্মরণ হতেই খেয়াল করল সে উপস্থিত নেই। তাই বলল,
-” এমা আপু কোথায়? কফি তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমি দিয়ে আসি কেমন? ”
কফির মগ নিয়ে আদ্রিতার কাছে গেল হৈমী। আবির খিলখিল করে হাসতে লাগল। বলল,
-” বন্ধু তুমি সব সময় এত হট থাইকো না। তোমার বাচ্চা বউ সইতে পারবে না। ”
রুদ্র চোখ কটমট করে তাকাল। আবির বলল,
-” দোস্ত, তোর মুখে ভাগ্যবান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে রইলাম। শুধু আমি না আমাদের ছোট্ট মিষ্টি ভাবিটাও বসে আছে। ”
চলবে…
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৯
আজ সারাদিন আদ্রিতার কাছে চার, পাঁচ রকমের রান্না শিখেছে হৈমী। দুপুরে আদ্রিতার হাতের রান্না দিয়ে লাঞ্চ করেছে সকলে। আর বিকালের সময়টা আদ্রিতার সঙ্গেই গল্প করে কাটাচ্ছে হৈমী। রুদ্র, আর আবির বাইরে গেছে। রুদ্র গেছে তার বিজনেসের উদ্ভোদন নিয়ে ছোটো কাকা, আর বড়ো ভাই রাদিফের সঙ্গে জরুরি মিটিং করতে। আবির গেছে এমনিই ঘুরাঘুরি করতে। আবির সম্পর্কে হৈমী, রুদ্র তাই জানে। অথচ আবির বেরিয়েছে আদ্রিতার সঙ্গে নির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা করে। এবার শুধু পরিকল্পনাটি সফল হওয়ার পালা। আদ্রিতা যদি সুবুদ্ধি দিয়ে হৈমীর ফাঁকা মাথা ভরাট করতে পারে। তাহলে তার বন্ধুর জমকালো সংসার কেউ আটকাতে পারবে না!
হৈমীর সঙ্গে গল্প করতে ভীষণ উপভোগ করছে আদ্রিতা। কিন্তু এসব গল্পে ভুললে তো চলবে না। তাদের যে আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে। হৈমী একাধারে তার ছোটোবেলার গল্প করেই যাচ্ছে। আদ্রিতা উৎসুক মুখে সেসব শুনতে শুনতে হঠাৎ বলল,
-” ছোটোবেলার গল্প তো অনেক শোনা হলো। এবার এসো বড়োবেলার গল্প করি। ”
-” বড়োবেলার গল্প! কোন ক্লাস থেকে শুনবে আপু? ”
খুশিতে আটখানা হয়ে বলল হৈমী। আদ্রিতা বলল,
-” বিয়ে, সংসার এসব বিষয় নিয়ে শুনব। তার আগে আমাদের গল্প শোনাই? ”
হৈমী মাথা নাড়ল। আদ্রিতা তার আর আবিরের প্রণয়, শুভ পরিণয় নিয়ে রোমাঞ্চকর অনেক কথাই শেয়ার করল। গতরাতে যে তারা দু’জন দু’জনার হয়ে গেছে, কিছুটা লাজুক ভঙ্গিতে সেটাও বলল। সব শুনে পিটপিট করে তাকিয়ে রইল হৈমী। আদ্রিতা মাথা নাড়িয়ে, ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” কী ভাবছ? আমাদের তো একদিন আগে পড়ে বিয়ে হয়েছে। তোমরাও নিশ্চয়ই দু’জন দু’জনার হয়ে গেছ? ”
লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল হৈমী। আদ্রিতা বলল,
-” ও বাবা হৈমী বুড়ি আবার লজ্জাও পায়? ”
চট করে ওঠে দাঁড়াল হৈমী৷ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে পিছমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বলল,
-” ইস আমার খুব শরম করছে। আমাদের ওসব কিছুই হয়নি গো। তুমি আমাকে আর লজ্জা দিও না। লজ্জা পেতেও আমার ভারী লজ্জা লাগে! ”
উচ্চশব্দে হেসে ওঠল আদ্রিতা। ওঠে এসে হৈমীর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। বলল,
-” তুমি যে কী মিষ্টি আর কী দুষ্টু। তোমার দুষ্টু মিষ্টি কথাগুলো শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। এখানে আসার পর থেকে মনে হচ্ছে দারুণ একটা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। তোমার সঙ্গে পরিচয় না হলে অনেক কিছুই মিস করে যেতাম। তোমার কথাগুলো ম্যাজিকের মতো বুঝেছ। তোমার আশপাশে যারা থাকে তাদের মন যতই খারাপ থাকুক তোমার কথা শুনে তারা হাসতে বাধ্য হবে। ”
প্রচণ্ড খুশিতে আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরল হৈমী। বলল,
-” নিজের প্রশংসা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। তুমি কী সুন্দর করে আমার প্রশংসা করলে! তুমি খুব ভালো আদ্রিতা আপু। ”
আদ্রিতা হৈমীর কাঁধ জড়িয়েই ধীরপায়ে ওকে নিয়ে বেলকনিতে গেল। চলে গেল অন্য প্রসঙ্গে। যা তার পরিকল্পনায় ছিল। বলল,
-” জানো, স্বামী – স্ত্রীর সম্পর্ক অনেক পবিত্র। শুধু তাই না এই সম্পর্কটা পৃথিবীর সব সম্পর্কের চেয়ে গভীর। কতটা গভীর জানতে চাও? ”
পিটপিট করে আদ্রিতার মুখের দিকে তাকাল সে। মাথা নাড়িয়ে বোঝাল সে জানতে চায়। আদ্রিতা তাকে ছেড়ে দু’হাতে বেলকনির গ্রিল ধরে বলতে লাগল,
-” একজন স্ত্রী হলো তার স্বামীর পোশাকের মতো। আর স্বামীও তার স্ত্রীর পোশাকের মতো। আমাদের জীবনে পোশাকের গুরুত্ব কতটা জানোতো? একটা বয়সের পর আমরা মানুষরা ন’গ্ন হয়ে যেমন কাটাতে পারি না, উচিৎও নয়। তেমনি বিয়ের পর স্বামী, স্ত্রীরও একে অপরকে ছেড়ে থাকাটা উচিৎ নয়। এরা একে অপরের পরিপূরক। বিয়ে আমাদের জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। এর গুরুত্ব এতটাই যে সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মানবের জন্য বিয়ে ফরজ করে দিয়েছেন। ”
আদ্রিতা কিয়ৎকালের জন্য থামল। হৈমী বিস্মিত হয়ে বলল,
-” তাহলে তো আমরাও ফরজ কাজ সেরে ফেলেছি। আর দু’জন একসাথেই আছি। জানো আমার কত কষ্ট হচ্ছে। আম্মু, ভাইয়াকে কত মিস করছি। উনার সামনে কাঁদলে কত বকে তাই কাঁদতেও পারি না। এত কষ্ট পেয়েও আমি কত গুড গার্ল হয়ে উনার সঙ্গে আছি৷ ”
শেষ কথাগুলো ভীষণ মন খারাপ করে বলল হৈমী। আদ্রিতা তার অনুভূতি বুঝতে পেরে বলল,
-” আমাদের সবাইকে এভাবে থাকতে হয় হৈমী। প্রতিটা মেয়েকেই বাবা, মা, ভাই, বোন ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে তার পরিবারে থাকতে হয়। এটা প্রকৃতিগত নিয়ম। এই কষ্টটা প্রত্যেক মেয়েকেই সহ্য করতে হয়৷ কেউ আগে করে কেউ বা পরে। দেখবে ধীরেধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
হৈমী নিশ্চুপ হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আদ্রিতা জিজ্ঞেস করল,
-” তোমাদের কিছু হয়নি বললে? এক সঙ্গে এক ঘরে রয়েছ অথচ কিছু হয়নি? রুদ্র ভাইয়া তো বেশ ধৈর্য্যশীল। নারী, পুরুষ এক ঘরে এক বিছানায় রয়েছে। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী অথচ কিছুই হয়নি! ”
-” কিছু হবেও না আমাদের। ”
-” সেকি! কেন? এসব বলতে হয় না। বললাম না স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা খুবই গভীর। এই গভীর সম্পর্কটা অগভীর করলে পাপ লাগবে। যদিও শুধু ফিজিক্যাল সম্পর্কটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবুও প্রতিটা মানুষের জীবনে এ সম্পর্কেরও প্রয়োজন আছে, গুরুত্ব আছে৷ তোমরা যদি এক সঙ্গে মিলেমিশে কাটিয়ে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিতে চাও ভালো। কিন্তু হৈমী রুদ্র ভাইয়া ছেলে মানুষ এবং প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ সে। যদিও তোমার বয়স কম আমার বলা ঠিক হচ্ছে কিনা জানি না, তবুও তার দিকটা তোমায় ভাবতে হবে। মনে রেখ পুরুষ মানুষের মন কখন পিছলা খায় বোঝা মুশকিল। ”
-” পিছলা! কীসের পিছলা? ”
বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে প্রশ্ন হৈমীর। আদ্রিতা এবার বেশ সিরিয়াস হয়ে, সাংঘাতিক মুখোভঙ্গি করে বলল,
-” ওমা তুমি জানো না? দেশে, বিদেশে যে দিন দিন ডিভোর্সের হার বাড়ছে, পরকীয়া বাড়ছে। এসব কেন বাড়ছে? এসব তো স্বামী – স্ত্রীর মধ্যেকার সম্পর্কে দূরত্ব থাকার কারণেই বাড়ছে। আর এই দূরুত্বটা শুধু মন কেন্দ্রীক নয় শরীর কেন্দ্রীকও। আজকাল এসব লোকে লজ্জা পেয়ে বলতে চায় না। আমরা স্মার্ট ছেলে, মেয়ে সত্যি বলতে দ্বিধা করি না। ”
ঢোক গিলল হৈমী। বলল,
-” আমাদের তো তেমন দূরত্ব নেই। শুধু ঝগরাটাই বেশি হয়। আমি টের পাই উনিও আমাকে ভালোবাসেন আর আমিও। ”
-” তাহলে বললে কেন কিছু হবে না? ”
-” এমনি। ”
মুখ ফিরিয়ে নিল হৈমী৷ আদ্রিতা নরম সুরে বলল,
-” ভাইয়াকে তে ভালোবাসোই ? ”
আস্তে করে মাথা নাড়াল সে। আদ্রিতা খুশি হয়ে বলল,
-” তাহলে চিন্তা নেই ভালোবাসা থাকলে সব হবে সব।”
-” কিছুই হবে না, আমাদের মধ্যে শর্ত হয়েছে। ”
-” কীসের শর্ত? ”
-” কিছু না হওয়ার শর্ত। ”
-” ওমা কেন? ”
-” কারণ উনি শর্ত দিয়েছিলেন উনার বউ হতে হলে মাতৃত্ব ত্যাগ করতে হবে। এটা শুনে আমার খুব রাগ হয়েছে। তাই আমিও শর্ত দিয়েছিলাম আমাকে বিয়ে করলে উনার পৌরুষ চাহিদা ত্যাগ করতে হবে। ”
বিস্মিত হয়ে গেল আদ্রিতা। মা গো মা কী সাংঘাতিক কথাবার্তা দু’জনের। এরা তো পৃথিবীর অসম্ভব দু’টি ঘটনা নিয়ে শর্ত দিয়ে জেদ ধরে বসে আছে। ঢোক গিলল আদ্রিতা কিঞ্চিৎ শঙ্কা নিয়ে বলল,
-” এটা কী করে সম্ভব! ”
-” জানি না। ”
-” ইম্পসিবল, সুস্থ, সবল কোনো পুরুষই ঘরে বউ থাকতে এত বড়ো ত্যাগ করতে পারবে না। সে যত শুদ্ধ পুরুষই হোক না কেন। আর তোমার তো মাতৃত্ব ত্যাগের প্রশ্নই আসে না৷ তোমরা দু’জনই দেখছি মহা পাগল। শোনো রুদ্র ভাইয়া তোমার কাছাকাছি না এসে থাকতেই পারবে না। অর্থাৎ সে তার শর্ত ভাঙবেই। আর সে শর্ত ভাঙলে তুমিও অনায়াসে শর্ত ভাঙতে পারবে। এটা বড়ো কোনো সমস্যাই না। তাই মন খারাপ করো না। ”
হৈমী কিছুই বলল না। আদ্রিতা এবার তাকে বেশ গম্ভীর হয়ে বলল,
-” শোনো বিয়ে হয়ে গেছে তোমার। তুমি যার বউ তার ওপর একটু অধিকার ফলিও। এতে তোমারই ভালো হবে। রুদ্র ভাইয়া একটু গম্ভীর মানুষ, রাগটাগ নাকি খুব বেশি। কিন্তু তোমাকে মন থেকে খুব পছন্দ করে ভালোওবাসে। এই ভালোবাসাকে আরো গভীর, গাঢ় করতে তোমাকেই আগাতে হবে। তুমি যদি তাকে ভালোবেসে, আগলে রেখে আজীবন কাটাতে চাও তাহলে নিজেকে তার মতো করে একটু গুছিয়ে নিও। শুনেছি ভাইয়া, ভীষণ আঘাত পাওয়া মানুষ। নিজের জন্মদাত্রীর দ্বারা খুব অল্প বয়সে কঠিন আঘাত পেয়েছিল। যেই আঘাত তার মনটাকে পাথরের মতো শক্ত করে দিয়েছে। সেই শক্ত পাথরটাকে তুমি ভালোবাসায় সিক্ত করে দিও, নরম মাটিতে পরিণত করো। আমার আর আবিরের বিশ্বাস তুমি পারবে। তোমার মধ্যে স্পেশাল একটা ব্যাপার আছে। ”
খুব মনোযোগ সহকারে কথা গুলো শুনল হৈমী। আদ্রিতা শেষে মনে মনে দুষ্টু বুদ্ধি এঁটে বলল,
-” আর শোনো পুরুষ মানুষ দিনশেষে যেমন একজন নারীর কাছে দুর্বল, তেমন একটা নারী শরীরের তৃষ্ণায় কাতরও। জামাই তোমার সেই হ্যান্ডসাম শক্ত হাতে ধরে রেখ। ফস্কে গেলে কিন্তু আফসোস করবে। ভাইয়া তো নতুন বিজনেস স্ট্রার্ট করছে, তাও আবার শাড়ির বিজনেস। ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরের আধুনিক
রমণীরাও এখানে কাজ করবে। দু’জন সুন্দরী মেয়ে আছে একজনের নাম নিশিতা। বেশ জনপ্রিয় ব্লগার। তার মাধ্যমে ভাইয়া তার কম্পানির শাড়িগুলো অনলাইনে শো অফ, পাশাপাশি অনলাইন বিজনেসও শুরু করবে। শুনেছি এসব মেয়েরা নাকি কাজের ফাঁকে হ্যান্ডসাম মালিকদের সঙ্গে ঢলাঢলিও করে। সুযোগ পেয়ে ফাঁসিয়ে বিয়ে টিয়েও করে নেয়। ঘরে, বউ, বাচ্চা কিছুই মানে না। টাকাওয়ালা ছেলেদের দুই, তিন বউ হতেও এদের সমস্যা নেই। ”
আদ্রিতার একেকটা বাক্য শেষ হচ্ছে আর হৈমীর হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করে ওঠছে। তার একমাত্র স্বামীটা ফস্কে গেলে তার কী হবে?
____________
সারারাত ঘুম হলো না হৈমীর। কাউচে বসে কোলের ওপর ল্যাপটপ রেখে স্ক্রিনে মুখ গুঁজে বসে আছে রুদ্র। দুপা বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে ছোটো টি টেবিলের ওপর রাখা। রাত বাড়ছে তবুও বিছানায় যাচ্ছে না সে। এই নিয়ে হৈমীর আরো বেশি ছটফট লাগছে, কান্না পাচ্ছে। মনে প্রশ্ন জাগছে, তাদের কী অনেক বেশিই দূরত্ব? বিকেলে আদ্রিতার কথাগুলো শোনার পর থেকে তার নাওয়া, খাওয়া, ঘুম সব বরবাদ হয়ে গেছে৷ নিশিতার সঙ্গে সেদিন রুদ্রকে রেষ্টুরেন্টে দেখা। আজ আবার তার সঙ্গে বিজনেস সংক্রান্ত বিষয় শোনা। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ভুগতে লাগল সে।
রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। রুদ্র তখনো ল্যাপটপে বিভোর। আর সহ্য করতে পারল না হৈমী। নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে রুদ্রর সামনে এলো। ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি তুলে হৈমীর দিকে তাকাল রুদ্র। সহসা হৈমী তার কোল থেকে ল্যাপটপ নিয়ে পাশে রেখে কোলে ওঠে বসল। মুহুর্তেই গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে ডুকরে ওঠল সে। রুদ্র হতভম্ব, বাকরুদ্ধ হয়ে আলগোছে এক হাত হৈমীর পিঠে অন্য হাত মাথায় রাখল। হতবুদ্ধি শূন্য হয়ে এক ঢোক গিলল, শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-” কী হয়েছে! ”
চলবে…