বেসামাল প্রেম পর্ব-৩২+৩৩

0
119

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩২
_______
রুদ্র ফিরে এলো পরেরদিন দুপুরে। বাসায় ফিরে সে গোসলে ঢুকল। কাজের মেয়ে রিতু দুপুর এবং রাতের রান্না শেষ করে হৈমীর থেকে বিদায় নিল। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্তই সে কাজ করবে। এ সময়ের মধ্যে রান্নাবান্না, ঘর মোছা, কাপড়চোপড় ধৌত করা, নিত্যদিনের যাবতীয় কাজই সে করে দিয়ে যাবে। গতদিন রাত্রি যাপন করেছিল শুধু রুদ্র বাসায় থাকবে না বলে। আজ রুদ্র ফিরেছে তাই সেও নিজের কাজ সম্পন্ন করে বিদায় নিল। হৈমী খাবার বেড়ে সব গুছিয়ে রাখতে রাখতেই, তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রুদ্র এলো ডায়নিং রুমে। উদাম শরীরে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে ধপ করে বসল চেয়ারে। পিটপিট করে তাকিয়ে হৈমী নিজেও বসল। জিজ্ঞেস করল সূচনার কথা, তার ভাইয়ের কথা। রুদ্র খাবার খেতে মনোযোগ দিয়ে তার কথায় হু, হা জবাব দিল। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে হৈমী আর কথা বাড়ালো না। খাবার শেষ করে রুদ্র রুমে চলে গেলে সে সব গুছিয়ে রাখল। এরপর রুমে যেতে উদ্যত হয়েছে ঠিক তখনি বেজে ওঠল কলিং বেল। চঞ্চলিত পায়ে দরজা খুলতেই কয়েক রকমের ফুলগাছ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল জোভানকে। অমায়িক এই মানুষটার সঙ্গে গতকালই পরিচয় হয়েছে তার। তারপর অনেকটা সময় গল্পও করেছে। গল্পের বেশিরভাগ জুড়েই ছিল ফুল নিয়ে। সেই গল্পের ফাঁকেই হৈমী দু’টো গোলাপ গাছ নিয়ে এসেছে। যা এখন তাদের বেলকনিতে রয়েছে। পাশাপাশি আবদার করেছিল আরো কিছু ফুলের চারা এনে দিতে। যত দাম লাগুক সে দিয়ে দেবে। বিয়ের পর জামাইয়ে কাছে চেয়ে চেয়ে কিচ্ছু নেয়নি। এবার না হয় ফুলগাছ কেনার টাকা নেবে। তার কথাগুলো শুনেই জোভান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল টাকা লাগবে না, এমন ফুলপ্রেমী মানুষকে এমনিই গিফট করবে সে৷ এতেই তৃপ্তি পাবে। তাছাড়া এই বাসার মালিকের স্ত্রী সে। বয়স অনুযায়ী ছোটো বোন বলাও চলে। তাই সাদা মনে একগাদা ফুলগাছ নিয়ে হাজির হলো সে। হৈমীও খুশিতে দিশেহারা হয়ে ধন্যবাদের বন্যা বইয়ে দিল। জোভান সবেই ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। তাই হৈমী অসংখ্যবার বলার পরও ভিতরে ঢুকল না। গাছগুলো হৈমীর হাতে দিয়ে সে চলে গেল। সেই মুহুর্তেই ঝড়ের গতিতে রুদ্র এলো। দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে চোখ, মুখ কঠিন করে জিজ্ঞেস করল,
-” কে, কে ছিল? ”

হৈমী চারাগুলো উঁচিয়ে ধরে বলল,
-” দেখুন কতগুলো চারা… এখানে কালো গোলাপ, সাদা গোলাপ, নয়নতারা…”

থামিয়ে দিল রুদ্র। ধীরেধীরে তার চোখ রক্তিম হয়ে ওঠল। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল,
-” ছেলেটা কে ছিল? ”

রুদ্রর শরীর মৃদু কাঁপছে, শরীরে ঘাম ছুটে গেছে। রুম থেকে সে এক পলক দেখতে পেয়েছে হৈমী, তৃতীয়তলায় ছেলেটার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। ছেলেটা সম্পর্কে সে ভালোই অবগত, তবুও নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল৷ মুহুর্তেই তার মাথাটা জাস্ট নষ্ট হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল বহু বছর পূর্বের এক জঘন্য স্মৃতি। বিশ্বাসঘাতকার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
তার মা আর বড়ো কাকার হাস্যজ্জ্বল মুখ, একে, অপরের সেই অবৈধ মেলামেশার দৃশ্যটুকু। হৈমীকে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে দেখে সেই দৃশ্য কেন মনে পড়ল? পুরো পৃথিবীটাই বা কেন এলোমেলো লাগতে শুরু করল? চোখ, মুখে অস্বাভাবিকতা ফুটিয়ে তুলে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
-” কে ছিল ও? ”

জানা উত্তরটাই হৈমীর মুখ থেকে জানতে মরিয়া হয়ে ওঠল সে৷ হৈমী তার অস্বাভাবিকতা বুঝতে পেরে ঢোক গিলল। আমতা আমতা করে বলল,
-” তৃতীয়তলার জোভান ভাই। ”

উত্তর দিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়ালো। রুদ্র তৎক্ষনাৎ ওর সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। চোয়াল শক্ত করে চোখ, মুখ খিঁচে বলল,
-” এর আগে কথা হয়েছে? হঠাৎ এসব কেন দিয়ে গেল? ”

হৈমী সহজ মনে গতকালকে পরিচয় হওয়ার কথা, তাকে দু’টো ফুল গাছ দেওয়া, আজ আবার এগুলো এমনিই গিফট করার কথা জানালো। সবটা শুনে রুদ্র আর এক মুহুর্ত সময় নিল না হৈমীর হাত থেকে ফুলগাছের চারাগুলো কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলতে! এহেন কাণ্ডে ভয় পেয়ে মৃদু চিৎকার দিল হৈমী। বলল,
-” এটা আপনি কী করলেন! ”

বাক্যটা শেষ করতেই নরম গালটায় সজোরে আঘাত পড়ল তার। রুদ্রর শক্ত হাতের কঠিন থাপ্পড় খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। ঠোঁটের কোণা বেয়ে নামল রক্তের চিকন ধারা। ধীরে ধীরে তা চিবুক স্পর্শ করে গলায় পৌঁছাল। ব্যথায়, ভয়ে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল সে৷ ভেজা অনুভব করায় হাতটা চোখের সামনে ধরতেই রক্ত দেখে ভয়ে চোখ, মুখ খিঁচে চিৎকার দিল। রুদ্রর ক্রোধ তবুও কমল না। বরং বেড়ে গেল। অত্যাধিক ঘৃণায় মাথায় যেন খু/ন চেপে গেল। বারবার চিৎকার করে বলতে লাগল,
-” মাত্র চব্বিশ ঘন্টা, চব্বিশ ঘন্টা দূরে ছিলাম। এতেই তোর রূপটা দেখিয়ে দিলি! আমি ভুল, আমি ভুল। এত বড়ো ভুল! তোকে আমি…”

খ্যাপা বাঘের মতো গর্জন ছেড়ে, চারপাশে অসুস্থ দৃষ্টি ঘুরিয়ে কাঠের চেয়ার নজরে পড়ল। তড়াক করে সে চেয়ার তুলে এনে হৈমীকে আঘাত করতে উদ্যত হতেই তীব্র ভয়ে দু’হাতে মুখ চেপে বীভৎস এক চিৎকার দিল হৈমী। শরীর মুচড়িয়ে সরেও পড়ল। তার বসার জায়গাটায় বিকট শব্দে ভারী চেয়ারটা পড়ল! রুদ্রের চোখের আড়াল হতে সোফার এক কোণে গুটিশুটি হয়ে বসে কাঁপতে লাগল সে। ক্রন্দনরত কণ্ঠে ডাকতে লাগল, আম্মু আর ভাইয়াকে। তার কান্নার শব্দ রুদ্রের কানে পৌঁছাল, দৃষ্টিতে ধরা পড়ল লুকিয়ে পড়ার। ক্রোধের মাত্রা কমল কিনা বুঝা গেল না। ক্ষিপ্ত হয়ে বলিষ্ঠ শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে ধপাধপ পা ফেলে চলে গেল বেডরুমে।
_______
রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। অতিরিক্ত ভয় পাওয়াতে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো হৈমীর। ড্রয়িংরুমে সোফার এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে সে। রুদ্র রুম থেকে বেরিয়ে হৈমীকে একই জায়গায় পড়ে থাকতে দেখে ধীরেসুস্থে এগিয়ে এলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করে আচমকা পাঁজা কোল করে রুমে চলে এলো। কোলে নেয়ার পর পরই বুঝতে পারল ভয়াবহ জ্বর এসেছে মেয়েটার। চোখ বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সে। তখন যদি ওভাবে সরে না যেত অনেক বড়ো দূর্ঘটনা ঘটে যেত! নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেক বড়ো একটি আঘাত করতে বসেছিল সে। বুঝতে পারল তবুও হৈমীর প্রতি রাগ কমল না। উত্তপ্ত শরীরটা শুইয়ে দিয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিল। এরপর কল করল ডাক্তার বান্ধবী সুবর্ণাকে। তার বলা ওষুধের নাম লিখে ঝিনুককে ডেকে ওষুধ কিনতে পাঠিয়ে দিল। একঘন্টা বসে বসে জলপট্টি দিল কপালে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বরটাও বাড়তে লাগল। জ্বরের ঘোরে বারবার হৈমী বলল,
-” আমি আম্মুর কাছে যাব, আমি ভাইয়াকে সব বলে দিব। আপনি আমাকে আবার মেরেছেন। আপনি একটা খারাপ লোক! ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। রাতে দু’জনের কারোই খাওয়া হলো না। ফলশ্রুতিতে ওষুধও খাওয়াতে পারল না হৈমীকে। বিষণ্ন মনে চুপচাপ হৈমীর পাশে শুয়ে পড়ল সে। রাত গভীর হতেই হৈমীকে বুকে টেনে নিল। জ্বরের ঘোরে রুদ্রর বুকের উষ্ণতা পেয়ে হৈমী কিছুটা হুঁশে এলো। ভয় জড়ানো স্বরে বলল,
-” আমি থাকব না। ”

আচমকা ফুপিয়ে কেঁদেও দিল। রুদ্রর হাতের বেষ্টন দৃঢ় হলো। মাথা ঝুঁকিয়ে হৈমীর গালে গাল ছুঁইয়ে ভরাট স্বরে বলল,
-” তোমাকে থাকতেই হবে। ”

নড়েচড়ে হৈমী বলল,
-” আপনি আমাকে খু/ন করতে চেয়েছিলেন। আমি অনেক ভয় পেয়েছি, ছেড়ে দিন, ভাইয়াকে ফোন করুন, আমি চলে যাব। ”

এক হাত ওঠিয়ে হৈমীর ঠোঁট চেপে ধরল রুদ্র। মানানোর স্বরে বলল,
-” আমার মাথা ঠিক ছিল না, কেমন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি সহ্য করতে পারি না বিশ্বাস করো, সহ্য করতে পারি না। ”

হৈমী প্রশ্ন করল,
-” কী করেছি আমি? শুধু তো কয়টা ফুলগাছই নিয়েছি। ”

বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল। রুদ্র ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-” আমি আমার অতীতটা সহ্য করতে পারি না হৈমী। চোখের সামনে আমি যা কিছু দেখেছি সেসব আমাকে তীলে তীলে আজো কষ্ট দেয়। তখন আমি অবুঝ শিশু ছিলাম, কিন্তু তখনকার সেই ঘটনাগুলো আজ আমার কাছে স্পষ্ট। আমার মা আমার বাবাকে ঠকিয়েছে হৈমী। উনি আমার আর বোনের জীবনে যে দাগ ফেলে গেছে তা কোনোদিন ওঠে আসবে না। এই হৈমী, তুমি ঐ ছেলেটার সঙ্গে আর কথা বলো না, তুমি কারো সাথেই কথা বলবে না, কারো সাথে মিশবে না। আমি তোমাকে সব এনে দিব সব, তোমার কী চাই মুখ ফুটে বলবে আমি সব দেব। তুমি শুধু আমার থাকো, তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো। আর মারব না তোমাকে, একটুও কষ্ট দিব না। শুধু তুমি আমি ছাড়া সব পুরুষ থেকে দূরে থাকো, কথা দাও। কথা দাও আমাকে। ”

হৈমীকে ঝাঁকাতে লাগল সে। রুদ্রর এই আচরণে তার ভয় গাঢ় হলো, অদ্ভুত এক মায়াও কাজ করল। তাই ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” কথা দিলাম। ”

শান্ত হয়ে হৈমীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রুদ্র। উন্মাদের মতো ওর সারা মুখে চুমু দিয়ে আদর করতে লাগল। আশ্চর্য হয়ে হৈমী ভাবতে লাগল, আজ রুদ্রর আরো দুটো রূপ সে দেখে নিল। কোনটা সত্যি? গভীর রাতের এই অনুনয় করা, আদরে ভরিয়ে দেওয়া রুদ্র নাকি তখনকার ভয়ানক রুদ্র? আর এতদিন যাকে দেখেছে তার সত্যিটাও কতটুকু?
______
কেটে গেল এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে রুদ্রকে নতুন করে আবিষ্কার করল হৈমী। পাশাপাশি বুকের ভিতরে ভয়ের পাহাড় গড়ে তুলল। লোকটা তাকে অসম্ভব ভালোবাসে এটা যেমন সত্যি। লোকটা তাকে এক বিন্দুও বিশ্বাস করে না সেটাও ধ্রুব সত্যি। এই বিশ্বাস করেনা বলেই ভয়টা মনে তীব্র হচ্ছে। মনে জেদও চেপেছে ভালোবাসায় যে বিশ্বাস জরুরি এটা রুদ্রকে বুঝতেই হবে৷ রুদ্রর সঙ্গে তার জীবনটা অনেক বেশি কঠিন মনে হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যেভাবেই হোক চলে যাবে সে৷ কিন্তু সেই রাতের অনুনয় যেতে দিল না। কারণ সেও যে রুদ্রকে ভালোবেসে ফেলেছে। অবুঝ মনের, পাগলাটে অনুভূতির এক কঠিন ভালোবাসা। রুদ্র রুদ্রর মতোই সময় কাটাচ্ছে। আগের চেয়ে হৈমীর ওপর নজরদারি তার বেশিই হয়েছে। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াতে দেয় না। জানালার পাশে বসতে দেয় না। তার ফোনটাও হাতে দেয় না। কোন ভয়ে, কোন সন্দেহে এসব করে টের পায় হৈমী। করুণ এই পরিস্থিতির চাপে পড়ে কদিনে তার চঞ্চলতারাও মিইয়ে গেছে। মাথায় চেপেছে অসংখ্য টেনশন, মনে চেপেছে ভয়। না জানি কখন খ্যাপে যায় রুদ্র। এমনই চিন্তার ভীড়ে একদিন লুকিয়ে রুদ্রর ফোন থেকে আবিরের নাম্বারে লম্বা ম্যাসেজ পাঠালো সে। সঙ্গে সঙ্গে ডিলেট করেও দিল। সেই ম্যাসেজ আবির, আদ্রিতা পড়ে কল করল রুদ্রকে। রুদ্রর সঙ্গে আবির মিনিট কয়েক কথা বলে জানালো আদ্রিতা হৈমীর সাথে কথা বলবে। রুদ্রর সামনে কথা বলায় হৈমী সেভাবে কিছু বলতে না পারলেও ম্যাসেজ পড়ে আদ্রিতা পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে হৈমীকে কিছু বুদ্ধি দিল, ভালোবাসার বুদ্ধি, যত্নের বুদ্ধি, উপযুক্ত স্ত্রী হয়ে ওঠার বুদ্ধি। সেই বুদ্ধি নেয়ার পর থেকেই রোজ রাতে ভয়ে, সংকোচ নিয়েই রুদ্রর কাছে স্ত্রীর অধিকার চায় হৈমী। প্রতিবারই রুদ্র তাকে ফিরিয়ে দেয়। এভাবে কেটে যায় আরো সাতদিন। সেদিন ডিনার করার পর কাজের সূত্রে রাত এগারোটার দিকে বাইরে যায় রুদ্র। একা বাসায় হৈমী কী করবে একঘন্টা কীভাবে পার করবে? ভাবতে ভাবতেই মাথায় আসে শাড়ি পড়বে। যদিও সে শাড়ি পড়তে পারে না তবুও অগোছালো করেই শাড়ি পরল। তার সঙ্গে ম্যাচিং করে একটি পিঠখোলা আকর্ষণীয় ব্লাউজও পরে নিল। আজ রুদ্র তার আবদার কীভাবে ফেলে সেটাই দেখার পালা। স্বামী স্ত্রী তারা। একে, অপরকে ভালোওবাসে। অথচ সম্পর্কে কেমন ঠুনকো ভাব। এবার তাকে বড়ো হতে হবে, স্বামীকে ভালোবেসে বিশ্বাস অর্জন করে নিতে হবে। মানুষটাকে অসীম ভালোবাসা, বিশ্বাস উপহার দিতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে সব সম্ভব। যেমন- সে বিশ্বাসহীন ভালোবাসা দিয়ে তাকে আঁটকে রেখেছে।

চলবে…

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩৩
প্রায় একঘন্টার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে জয়ী হলো হৈমী। ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে খ্যাত করলেও মন্দ হবে না৷ প্রথমবার নিজ দায়িত্বে শাড়ি পরতে সক্ষম হয়েছে সে। আজ নিজেকে একটু বেশিই প্রতিভাশালী লাগছে তার। আম্মুকে, ভাবিকে ফোন করে জানাতে ইচ্ছে করছে তার এই দারুণ প্রতিভার পরিচয় এবং যুদ্ধ জয়ের সংবাদটি। গাঢ় তাম্রবর্ণের ( ডার্ক রেড ) ঢাকাই জামদানি শাড়িটা তার ফর্সা গায়ে কী সুন্দর মানিয়েছে, চকচক করছে যাকে বলে , এ কথাও ফোন করে জানাতে ইচ্ছে করছে। তার জামাইয়ের পছন্দ কতটা অমায়িক ভাবতেই গা শিউরে ওঠছে। সত্যিই রুদ্রর পছন্দের তারিফ করতে হয়। তা নয় কি আর তাকে জীবনসঙ্গী করে! মানুষটা যেমনি হোক পছন্দটা মারাত্মক। আপনমনেই মুচকি হাসল হৈমী। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখল। সময় গড়িয়েছে অনেক, অথচ রুদ্র ফিরেনি। কিঞ্চিৎ চিন্তা হলো, ভয় চাপলো মনে। একা বাসায় রয়েছে আর কেউ নেই এটাই তার ভয়ের একমাত্র কারণ। রুদ্রকে নিয়ে তার ভয় নেই। কারণ রুদ্র শেখ মানুষকে ভয় দেখানোতে ওস্তাদ। মিনিট দুয়েক পর খেয়াল হলো, সে শাড়ি পরলেও একটুও সাজগোজ করেনি। তাই পা টিপে টিপে বেতের মোড়া নিয়ে এলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে। শাড়ি পরতে পটু নয় বলেই গায়ে জড়ানো শাড়ি খুলে যাওয়ার আশঙ্কা হচ্ছে। কুঁচিগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি খুলে যাবে সব। শঙ্কিত মনে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মোড়ায় বসল সে। আঁচলটাও ঠিকঠাক থাকছে না। কিয়ৎক্ষণ দর্পণে দৃষ্টি বুলিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। বিরবির করে বলল,
-” বিয়ের পর নাকি মেয়েরা একটু মোটা হয়, কই আমিত হলাম না। মনে হচ্ছে শাড়ি আমি পরিনি শাড়িই আমাকে পরেছে, যেন আমি হ্যাঙ্গার! ”

নিজের করুণ অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। পরিপূর্ণ সাজুগুজু করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিমিষেই। রাত করে মেক-আপ ইউজ করতে অনাগ্রহী, তাই সব সময় ব্যবহারকৃত ফেস পাওডার লাগালো দু’গাল ভরে। এরপর শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক লাগালো। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চোখে গাঢ় করে কাজল, কপালে ম্যাচিং করে গাঢ় লাল টিপ। নিজেকে দেখে নিজের মনটাই ফুরফুরে হয়ে গেল। না জানি আজ তার রুদ্র বেয়াই ওরফে জামাইটার হার্ট এট্যাক হয়ে যায়। ভাবতেই শরীর জুড়ে বয়ে গেল শিহরণ। বুকের ভিতর শব্দ হলো, ধিকধিক ধিকধিক। লম্বা করে শ্বাস ফেলে আকস্মাৎ দাঁড়িয়ে গেল। চঞ্চলিত মনে, তরিৎ হাতে, হেয়ারব্যান্ড খুলে পিঠ সমান সিল্কি চুলগুলো পুরোপুরি বাঁধনছাড়া করে দিল। মন পাখিটার ছটফটানিতে অসহ্য হয়ে, খুশিতে, আবেগে টগবগ করতে করতে দুহাতে শাড়ি ধরে রুমজুড়ে পায়চারি করল কতক্ষণ।
পাশাপাশি একটু পর পর আয়না আর ঘড়ি দেখে পার করল আরো একঘন্টা। তবুও রুদ্রর খবর নেই।

রাত দু’টো ছুঁই ছুঁই! হাই তুলতে তুলতে গিয়ে বসল বিছানায়। অমনি কেঁপে ওঠল ফোনের রিংটোনে। বালিশের পাশে রুদ্রর ফোন বাজছে! সে ফোন রেখেই বাইরে চলে গেছে! চটজলদি ফোন নিয়ে দেখল স্ক্রিনে ইংরেজিতে ‘আর’/R লেখা। কোনোকিছুই না ভেবে ফোনটা রিসিভ করল সে। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে কর্কশ কণ্ঠটা ভেসে এলো,
-” বাহ, ফোন রিসিভ করে ফেললে! কয়েক ঘন্টার জন্য ফোন রেখে এসেছি অমনি হাতাহাতি শুরু করেছ। তুমি একটা অবিশ্বাসী নারী হৈমী। তুমি শুরু থেকেই আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলছ। সেদিন আমাদের বিয়ে অস্বীকার করলে, এরপর জোভানের সঙ্গে… আর আজ সুযোগ পেয়ে আমার ফোন ধরেছ, ছিঃ। ”

একদমে কথাগুলো বলে থামল রুদ্র। ঘুম জড়ানো মস্তিষ্কটা ফুড়ুত করে জাগ্রত হলো হৈমীর। অতিরিক্ত বিস্ময়ে মাথা কেমন ঘুরতে শুরু করল তার। কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে রইল ক্ষণকাল। ওপাশ থেকে পুনরায় চিবানো চিবানো সুর এলো,
-” স্টুপিডের মতো চুপ করে আছ কেন? আমার ফিরতে আরো আধঘন্টা দেরি হবে। তোমাকে আমার কসম যার সঙ্গেই কথা বলে থাকো না কেন একটা নাম্বারও ডিলেট করবে না। মনে রেখো ডিলেট করলেই বিধবা হবে এবং আজীবন নিঃসঙ্গতায় ভুগবে৷ কারণ আমি মরে গেলেও কোনো পুরুষের সাহস হবে না তোমাকে সঙ্গ দেয়ার! ”

ফোন কেটে দিল রুদ্র। হৈমী স্তম্ভিত। সবটাই মাথার ওপর দিয়ে গেল তার। রুদ্র যে তার দুটো ফোনের একটি ফোন রেখে বাইরে গেছে এটা সে খেয়ালই করেনি। ফোন না করলে জানতেই পারত না রুদ্র ফোন রেখে গেছে। সে ব্যস্ত সাজগোজ নিয়ে তাও রুদ্রর জন্যই। অথচ আশ্চর্য মানুষটা ফোন করে বিনা কারণে সন্দেহ করে বসল তাকে। কিছুটা মন খারাপ হলেও পরোক্ষণে ফোন পেয়ে সেটাকে পাত্তা দিল না। কল করল মা’য়ের নাম্বারে। হামিদা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে হ্যালো বলতেই হৈমী কাঁদো কাঁদো স্বরে ডাকল,
-” আম্মু… ”

সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরল হামিদার। মাঝরাতে মেয়ের ফোন, কাঁদো স্বর শুনে আঁতকে ওঠে বসল সে। উত্তেজিত হয়ে বলল,
-” কী হয়েছে মা, কী হয়েছে? তুই ঠিক আছিস, বাবা বল আমাকে। ”

নিঃশ্বাস আঁটকে, কণ্ঠও রোধ হয়ে এলো হৈমীর৷ কাঁপা স্বরে বলল,
-” তুমি কেমন আছ? ”

সহসা দু-চোখে অশ্রু ভরে ওঠল হামিদার। হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” আল্লাহ যেমন রাখছে তেমনি। আমার খবর নেয়ার কি আর মানুষ আছে? ”

তার অভিমানী স্বর শুনে হৈমী কেঁদে দিল। হামিদা বলল,
-” তুই কেমন আছিস? কিছু হয়েছে? সূচনার কাছে শুনলাম কাল কথা হয়েছে তোদের। ”

-” আমি ভালো আছি আম্মু, তুমি চিন্তা করো না। জানো আমি আজ একা একা শাড়ি পরেছি। ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হামিদা বলল,
-” হু অবাক হইনি, তুই একা একা এখন সব পারিস তো। তা আরেকজন কোথায়? শুনলাম তার বোন ছাড়া কারো সাথেই কথা বলতে দেয় না। আর পড়াশোনা সেসবের কী খবর পড়াশোনা হচ্ছে তো? ”

-” উনি বাসায় নেই। জানো ফোন রেখে গেছে আমি জানিই না। জানলে অনেক আগেই ফোন করতে পারতাম৷ ও আম্মু, আমার ওপর তোমার রাগ কমেছে তাই না? আম্মু, আমি তোমাকে খুব মিস করি। ও আম্মু, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো প্লিজ। জানো ঐদিন কীভাবে কী হয়ে গেল আমি বুঝতেই পারিনি, সব কেমন করে হয়ে গেল। আমি সরি আম্মু, খুব সরি। এই হৈমী পিচ্চিটাকে তুমি মাফ করে দাও। এই আম্মু, টিশার ছেলেটা খুব কিউট হয়েছে, আমার না খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, কোলে নিতে মন চাচ্ছে। আচ্ছা আম্মু তুমি আমাকে মিস করো তো? আমিও খুব মিস করি আবার কবে তোমার কোলে মাথা রাখব, তোমার হাতের পায়েস খাবো? ভাইয়াকে কতদিন দেখি না। ”

একটানে বলা পূর্ণ কথা হামিদা কম মনোযোগে শুনলেও ছ’বার আম্মু ডাক ঠিক মন দিয়ে শুনেছে৷ শান্ত হয়েছে তার মাতৃহৃদয়। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে কান্না আঁটকাল সে৷ কিন্তু তার বাচ্চাটা যে কাঁদছে! তাই অভিমানে, দুঃখে, কষ্টে ধমক দিল। বলল,
-” সবার জন্য খুব দরদ উতলাচ্ছে এখন৷ এসব আগে মনে ছিল না। আর রুদ্র! সে কোন আক্কেলে মাঝরাত অবধি তোকে একা রেখে বাইরে আছে। আমি চুপ আছি বলে এই না আমার মেয়েকে আমি একদম বাদ দিয়ে দিয়েছি। সেদিন রাগ করে যাই বলি না কেন ও যেন ভেবে না নেয় আমি মরে গেছি। এ কথাটা বলে দিস। আমি এক্ষুনি সূচনাকে ডাকব। বলব, ওর ভাই কোন আক্কেলে তোকে এভাবে রেখেছে। আমার ছেলে কি কোনোদিন ওর প্রতি বিন্দু অবহেলা করেছে? তাহলে ওর ভাই কেন তোকে এভাবে একা রেখে যাবে। ভয় পাচ্ছিস তাই না, কিছু হবে না। যতক্ষণ না আসে আমার সাথে কথা বল। ”

মায়ের কথা শুনে হৈমীর কান্না বেড়ে গেল। মাকে শান্ত করতে মিথ্যেমিথ্যি বলল,
-” ও আম্মু উনি এসে পড়েছে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো চিন্তা করো না। আমি তোমাকে পরে ফোন করব আবার। ”

রুদ্র আসার কথা শুনে হামিদা শান্ত হলো। বলল,
-” মন দিয়ে পড়িস সামনে কিন্তু পরীক্ষা। ”

হৈমী এক হাত মুখে চেপে অন্যহাতে ফোন কেটে দিল৷ ভেঙে পড়ল বাঁধভাঙা কান্নায়৷ ওদিকে হামিদা বেগমের কলিজাটা মোচড়াচ্ছে খুব৷ মায়ের মন তো, তাই আফসোস হচ্ছে সেদিন যদি রাগ না করে সবটা মেনে নিত, আজ মেয়েটার জন্য এত পুড়তে হতো না৷ ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে সিদ্ধান্ত নিল মাহের আর সূচনাকে ঢাকা পাঠাবে। সূচনাকে দিয়ে রুদ্রকে বোঝাবে সামনে হৈমীর পরীক্ষা। তাই যেন তাদের সাথে হৈমীকে টাঙ্গাইল পাঠিয়ে দেয়৷ পরীক্ষার পর দুই পরিবারের মধ্যে একটি আয়োজন করে না হয় আবার হৈমীকে তার কাছে দেয়া হবে। শত হোক মা সে, মেয়ের ওপর রাগ পড়ে যখন গেছে, যেভাবে মেয়ের সুখ হয় শান্তি হয় হোক। তবে হ্যাঁ রুদ্রর সেই শর্ত অবশ্যই ভাঙতে হবে৷ মা হয়ে মেয়ের এই সর্বনাশ সে মেনে নিতে পারবে না। আজ হৈমীর বয়স কম কাল বয়স হবে তখন নিশ্চয়ই এই শর্ত টা ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াবে? তার আগেই রুদ্রর মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে৷ এক্ষেত্রে একমাত্র সহায়তা করতে পারবে সূচনা। যতই হোক বোনটা রুদ্রর কলিজার চেয়ে বেশি।
_______
রুদ্র ফিরল প্রায় শেষ রাতে। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে মেইন ডোর খুলে ভিতরে প্রবেশ করল সে। নিজ রুমে গিয়ে চমকে ওঠল মেঝেতে এলোমেলো শাড়ি পরিহিত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হৈমীকে দেখে। হাতের কাছে মোবাইল ফোন এবং খাতা, কলম পড়ে আছে৷ ভ্রু কুঁচকে, বিচলিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো সে। হৈমী শাড়ি পরেছে কেন? এত সাজগোজই বা কেন? তীব্র সন্দেহে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। নিঃশ্বাস বিক্ষিপ্ত, দৃষ্টি এলোমেলো। তরিৎ বেগে ফোন হাতে নিয়ে চেক করল। কল লিস্টে নাম্বারটা অপরিচিত! সঙ্গে সঙ্গে কল করল নাম্বারটায়। দু’বারের সময় হ্যালো বলল হামিদা। সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিল রুদ্র। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে বিরবিরালো,
-” তুমি বড়ো নির্লজ্জ মেয়ে! সেদিনের সেই থাপ্পড় তুমি ভুললেও আমি ভুলিনি। ”

ফোনে রেকর্ড অপশন চালু করা ছিল বলে হামিদার সঙ্গে কী কথা হয়েছে সেসব পরে শুনবে স্থির করল। এবং ফোনটা বন্ধ করে রাখল। এরপর আবারো হৈমীর দিকে চিন্তান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। এই সাজগোজ তার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে। এত সেজেছে কেন? আর শাড়ি! এভাবে কেউ শাড়ি পরে? মেজাজ খিঁচে ওঠল। কড়া স্বরে ডাকতে লাগল হৈমী বলে৷ হৈমী ঘুমের ঘোরে নড়াচড়া করে পাশ ফিরে ভারী নিশ্বাস ছাড়তে লাগল৷ ওর ঘুমের গভীরতা সম্পর্কে বেশ ভালোই জানে রুদ্র তাই আর ডেকে সময় নষ্ট করল না। আধখোলা শাড়ির ফাঁকফোঁকরে হৈমীর শুভ্র, মসৃণ কোমর, পিঠ নজরে আসতেই নিঃশ্বাস আঁটকে রইল। মাথা ঝিম ধরে হাত বাড়িয়ে শাড়ি টেনে হাতের মুঠোয় এনে, সমস্ত রাগ খাঁটিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। হৈমী গভীর তন্দ্রায়! কোমরে দুহাত রেখে ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। বড়ো বড়ো করে শ্বাস টেনে পা বাড়াল বাথরুমে। হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পরিবর্তন করে রুমে আসতেই নজরে পড়ল হৈমীর পাশে থাকা খাতা কলমে। পড়া চোর মেয়েটার পাশে তার অনুপস্থিতিতে খাতা কলম? এটাত রহস্যজনক! বেশ গম্ভীর হয়ে এগিয়ে এসে এক হাঁটু গেড়ে বসল। সাদা পাতায় গোটা গোটা বেশ কয়েকটা লাইন,
-” শুনুন, জীবনে প্রথমবার একা একা শাড়ি পরেছি। শুধু আপনার জন্য। সাজুগুজুও করেছি আপনার জন্য। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি আপনি আসছেন না। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, পৃথিবীর সবাইকে আমি বিশ্বাস করতে পারি শুধু আমার ঘুমকে ছাড়া। তাই এই চিঠি, যদি ঘুমিয়ে পড়ি কাজে লাগবে। আম্মুকে ফোন করে কান্নাকাটি করেছি। চোখের কাজল কিছুটা লেপ্টে গেছে, ব্যাপার না। ভালোবাসার মানুষের কাজল লেপটানো চোখও সুন্দর হয়। একটু সুন্দর মন নিয়ে দেখবেন তাই হবে। আর হ্যাঁ শুনুন, আমার যখন ঘুম ভাঙবে সিনেমার নায়কদের মতো হেঁচকা টান দেবেন ওকে? তারপর একটু ঝুঁকবেন। কারণ আপনি অতিরিক্ত লম্বা রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে আমার চোখে চোখ রাখতে হিমশিম খাবেন। তাই ঝুঁকে এসে আমার চোখে চোখ রেখে বলবেন,
” শোনো কাজল চোখের মেয়ে,
আমার দিবস কাটে,
বিবশ হয়ে তোমার চোখে চেয়ে ”

এই লাইনগুলো আমার প্রিয় লেখক সাদাত হোসাইন এর কবিতার বইয়ে পেয়েছিলাম। তখন থেকেই স্বপ্ন, আমার জামাই আমার চোখে মুগ্ধ চোখে চেয়ে এভাবে বলবে। আপনি কিন্তু বলবেন নয়তো আমার খুব মন খারাপ হবে। আর হ্যাঁ এভাবে বলার জন্য অগ্রীম আই লাভ ইউ উম্মাহ! ”

চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল রুদ্রর। মনে মনে প্রাণখোলা হাসিটুকু ক্রমশ ঠোঁট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। শ্বাস নিল প্রাণ ভরে। ধীরেসুস্থে ওঠে খাতা-কলম টেবিলে রেখে পুনরায় হৈমীর কাছে এলো। বিরবির করে কী সব যেন বলে সহসা পাঁজা কোলে নিল, তার আধপাগলি বউটাকে। দোনোমোনো করে বিছানায় গিয়ে ওকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল। অবাধ্য অনুভূতিরা আশকারা পেতে চাইলেও আশকারা দিল না। সে আরো সময় নিতে চায়, পাশের মানুষটাকে বুঝতে চায় পুরোপুরি। মনের সংশয় গুলো যে বড্ড যন্ত্রণা দেয় তাকে। গায়ে কম্বল টেনে হৈমীকে সন্তর্পণে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেল। অনুভব করল হৈমীর
শরীরটা বেশ ঠাণ্ডা, পা দু’টোও বরফ হয়ে আছে। শীতের পোশাক না পরে ইনি শাড়ি পরে মেঝেতে শুয়ে ছিলেন হুহ! মনে মনে ভেঙচিয়ে ধীরে ধীরে নিজের শরীরের উষ্ণতা দিয়ে ওর শরীর উষ্ণ করে দিল। আরাম পেয়ে হৈমীর ঘুম আরে বেশি গভীর হলো। রুদ্রর বাহুডোরে আবদ্ধ থেকে খুব বেশি নড়াচড়া হয়নি আজ৷ কিন্তু ভোর সকালেই তলপেটের অসহ্য ব্যথায় ঘুম ছেড়ে গেল ওর৷ রুদ্র বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ দেখে আকস্মাৎ ডুকরে ওঠল। পেটে হাত দিয়ে কান্নার শব্দ ক্রমশ বাড়িয়ে তুলল। ভীতিগ্রস্ত হয়ে ঘুমন্ত রুদ্র সহসা চোখ খুলল। চট করে হৈমীকে ছেড়ে দিয়ে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। বলল,
-” সমস্যা কী তোমার? সকাল সকাল কী শুরু করলে? ”

হৈমী নিজের দিকে ভুত দেখার মতো তাকিয়ে রুদ্রর দিকে ক্রোধের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কান্নারত কণ্ঠে বলল,
-” আপনি এতটা খারাপ লোক আমি জানতাম না। আমি বার বার আপনার কাছে গেছি তখন ছুঁয়েও দেখেননি। আর আজ ঘুমন্ত ভাবে আমায়ে পেয়ে…”

রুদ্র তাজ্জব বনে গেল। ধমকে ওঠে বলল,
-” চুপপ, একদম চুপপ। ”

হৈমী পেট চেপে ধরে ও মা গো বলে শুয়ে পড়ল। এতে রুদ্র আরো বেশি বিস্মিত হলো। হৈমী বলল,
-” আপনার কি একটুও তর সইল না। আর একদিন অপেক্ষা করতে পারলেন না? ঘুমন্ত অবস্থায় আমার সাথে ওসব! ”

আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল রুদ্র। বলল,
-” কোন সব? ”

-” ন্যাকামি করছেন বুঝেন না? টিশার জামাই ওর সাথে যা করত আপনিও আমার সাথে! ”

হতাশ হয়ে রুদ্র শুয়ে পড়ল। কর্কশ স্বরে বলল,
-” ইউ থিংক আ’ম ইন্টিমেট উইথ ইউ? ”

হৈমী চ্যাঁচিয়ে বলল,
-” তা নয়তো কি এমনি এমনিই আমার শাড়ি খুলেছেন? ”

অভিযোগী কণ্ঠ শুনে সহসা হৈমীকে হেঁচকা টান দিয়ে বুকের ওপর ফেলল রুদ্র। একহাতে ওকে জড়িয়ে অপরহাতে মুখের সামনের চুলগুলো সরিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,
-” লিসেন মিসেস. ডার্লিং হৈমী, এটা হলে তোমার চারঘন্টার এই আরামদায়ক ঘুমটা ঘুমাতে পারতে না। আরামের ঘুম টোটালি হারাম হয়ে যেত। নির্বোধের মতো এই কাহিনীটাও এখন করতে না। টের প্রভাতে নয় গোটা রজনিতেই পেতে। ”

হৈমীর চোখের পানি দেখে একটু চুপ করে পুনরায় বলল,
-” পেটে পেইন হচ্ছে? ”

হৈমী মাথা নাড়ালো। রুদ্র ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল,
-” ওয়াশরুম ঘুরে এসো যাও। ”
________
সূচনা ফোন করে জানালো সামনে সপ্তাহে সে আর মাহের ঢাকা আসবে। এ খবর পেয়ে রুদ্র ভীষণ খুশি হলো। আবার চিন্তিতও হলো হৈমী যদি তাদের সঙ্গে যেতে চায়? আগামীকাল নতুন বিজনেসের উদ্ভোদন কাজ সম্পন্ন করা হবে। তাই নিয়ে সে ভীষণ ব্যস্ত। পাশাপাশি আগামীকাল তার জন্মদিনও! সে জানে আগামীকাল কেউ একজন তাকে ফোন করবে। জন্মদিনের উইশ করে হাসাবে, যন্ত্রণা দেবে সর্বোপরি অশ্রাব্য গালি সমেত ঘৃণ্য অপমানিত হয়ে ফোন কেটে দেবে। প্রতি বছর ই হয় এটা। রুদ্র ইচ্ছে করেই নাম্বার পরিবর্তন করে না, আর না রাখে সেই মানুষটার নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টে। কিছু সম্পর্ক থাকে জটিল, কিছু মানুষ থাকে ঘৃণ্য, কিছু অনুভূতিতে থাকে তিক্ততা, তবুও দিনশেষে আমরা সেগুলোতে আঁটকে রই।
_______

আজ রুদ্রের জন্মদিন জানত না হৈমী। রুদ্র সকাল সকাল গোসলে ঢুকেছে। আজ সে আটটার মধ্যেই বেরিয়ে যাবে। হৈমী খাবার বেড়ে রুমে এসেছে রুদ্র বেরিয়েছে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু না সে বেরোয়নি। এদিকে তার ফোন বেজে চলেছে। হৈমী ভ্রু কুঁচকে ফোন রিসিভ করল। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল,
-” শুভ সাতাশতম জন্মদিন বাবা। অনেক অনেক বড়ো হও, আমার দোয়া সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে। ”

-” আজকে উনার জন্মদিন! আর আমি জানি না। অ্যাই আপনি কে হ্যাঁ? ”

প্রতিবছরের ন্যায় এবারের প্রতিত্তোর হয়নি বলে
থতমত স্বরে ওপাশ থেকে বলল,
-” তুমি কে? ”

-” আমি কে জানেন না? যাকে ফোন করেছেন আমি তার বউ৷ আপনি কে শুনি? ”

ওপাশ থেকে বিস্মিত স্বর,
-” রুদ্র বিয়ে করেছে! আমি তোমার শাশুড়ি, রুদ্রের মা! ”

-” আমার শাশুড়ি! ”

আকস্মাৎ হৈমীর কানে চেপে রাখা ফোনটা কেড়ে নিল রুদ্র। মুহুর্তেই ঘটে গেল ভয়াবহ, কল্পনাতীত কিছু ঘটনা৷ ভয়ে শিউরে ওঠল হৈমী। রুদ্রের মুখ থেকে বের হওয়া একেকটা গা’লি যেন তার মস্তিষ্কে বু’লেটের ন্যায় বিঁধল। পাশাপাশি রুদ্রের চেহারার বিকৃত রূপ, জন্মদাত্রীকে করা জঘন্যতম অপমান শুনে মাথা ঘুরতে লাগল। ফোন কেটে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারল রুদ্র। হৈমীর দিকে খেয়াল করল না সে, আশপাশের কোনোকিছুতেই আর হুঁশ রাখল না। ধপাস করে মেঝেতে বসে দু’হাতে নিজের মাথার চুলগুলো খামচে ধরে উন্মাদের মতো গলা ফাটানো চিৎকার করতে লাগল। রাগে থরথর করে কাঁপছে সে। এই যন্ত্রণা, এই হাহাকার বোঝার মতো ক্ষমতা বোধহয় পৃথিবীর আর একটি প্রাণীরও নেই! তার সে হাহাকার দেখে হৈমীর ছোট্ট হৃদয়ে কঠিন আঘাত পড়ল। না চাইতেও তার চোখ বেয়ে অঝোরে নোনাপানির স্রোত নেমে এলো। সে স্ত্রী বলেই কি রুদ্রর এই যন্ত্রণার শাক্ষি হতে পারল? কীভাবে কমবে এ যন্ত্রণা? সে যে সহ্য করতে পারছে না। যে যন্ত্রণা চোখে দেখে তার সহ্য হচ্ছে না সে যন্ত্রণা রুদ্র ভোগ করছে কীভাবে?

চলবে..