বেসামাল প্রেম পর্ব-৪২+৪৩

0
120

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪২
পড়ন্ত বিকেল৷ সমুদ্র পাড়ে পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়িয়ে সূচনা, মাহের৷ সূচনার পরনে ফিকে হলুদ রঙা ফিনফিনে শাড়ি। কটিদেশ মখমলের ব্লাউজে আবৃত। মাহেরের পরনে সাদা রঙের টি-শার্ট। গোড়ালি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে জিন্স গোটানো। খালি পায়ে বালুচরে দাঁড়ানো। বালুকাবেলায় নোনাজলের ফেনিল ছাপ স্পষ্ট। থেকে থেকে
সমুদ্রের গর্জন ধেয়ে আসে কিনারে। আছড়ে পড়ে ঢেউ। পড়ন্ত বেলা বিধায় সূর্যটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে৷ এইতো কিছু সময়। এরপরই সূর্যাস্ত। বেলা ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গে শীতের তীব্রতা বাড়ছে৷
আকাশে পাখি আকৃতির লেজহীন ঘুড়ি চোখের আড়াল হচ্ছে। দিনভর তেজোদ্দীপ্ত সূর্যটা ম্রিয়মান সমুদ্রের জলে। ওদের আশপাশে অনেক মানুষের ঢল। সকালবেলা একসঙ্গে সূর্যদয়, সারা বিকেল প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ। এরপর পাশাপাশি হাত রেখে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দর্শন। সময়টা দারুণ উপভোগ্য ছিল সূচনা, মাহেরের জন্য৷ সূচনার ইচ্ছে করছিল না সমুদ্র পাড় থেকে ফিরে যেতে। মাহের জোরপূর্বক রিসোর্টে ফিরল। এতে সূচনা ভীষণ মন খারাপ করেছিল৷ মন ভালো হলো প্রিয়তম অর্ধাঙ্গ যখন শীতের কাপড় পরার পর পুনরায় তাকে নিয়ে সমুদ্র পাড়ে এলো৷ রাতে ডিনারের সময়টা বাদে পুরো সময়জুড়েই ওরা সমুদ্র বিলাস করল। ঘড়ির কাঁটা যখন এগারোটা বেজে ঊনষাট মিনিট ঠিক সে সময় আচমকা মাহের কোলে তুলে নিল সূচনাকে। উপস্থিত সকলের সম্মুখে, কনকনে শীতের রাতে, সমুদ্র পাড়ে প্রিয়তমাকে নিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠল সে৷ এরপর সহসা বালুকায় নামিয়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল মাহের। সূচনার একটি হাত আলতো ছুঁয়ে বলল,

-” শুভ জন্মদিন ডিয়ার। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনাকে ঘিরে বাঁচতে চাই। আই লাভ ইউ সো মাচ৷”

প্রেমময় বুলি আওড়ে সহসা হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেল। ধীরেধীরে ওঠে দাঁড়িয়ে সূচনাকে নিজের সামনে পিছমুখী হয়ে দাঁড় করাল৷ ঝটপট পকেট থেকে বের করল লকেট সহ একটি গোল্ডের নেকলেস৷ সেটি পরিয়ে দেয়ার পূর্বে লকেট ওপেন করে দেখাল একপাশে তাদের দু’জনে বিয়ের ছবি। সূচনার চোখ দুটি আনন্দাশ্রুতে ছলছল। বুকে চলছে তীব্র উত্তেজনা। অতি সুখে পাগলপ্রায় সে। হাত, পা কাঁপছে তার। ভালোবাসার ভারে শরীর ঢলে পড়তে চাইছে তার৷ নিজেকে প্রাণপ্রণে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল সে৷ মাহের সন্তর্পণে হারটা তাকে পরিয়ে দিল। আশপাশে থাকা যারা এই প্রগাঢ় প্রেমের শাক্ষি হলো সকলেই হাত তালি দিল। তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে রইল। শেষে সকলে তাদের বেস্ট উইশেষ জানিয়ে একান্তে সময় কাটাতে স্পেস দিল৷ মাহের সকলের প্রশংসা, শুভকামনা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করল। পুরোটা সময়ই সূচনা নিশ্চুপ ছিল৷ তার এই নিশ্চুপতাকে প্রগাঢ় করতে সহসা পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরল সে৷ যত্নভরে গ্রীবাদেশে উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে বিগলিতচিত্তে অর্ধাঙ্গীর কম্পিত দেহটা পাঁজা কোল করে নিল। ধীরপায়ে এগুলো রিসোর্টের দিকে৷ সে সময়ই তার স্মরণ হলো, আজকের দিনে সূচনা তার কাছে কী চায় সেটাও জানা হয়নি। রুমে গিয়ে সর্বপ্রথম কাজ জন্মদিন উপলক্ষে বউ তার কাছে কী চায় তা গভীর মনোযোগ সহকারে জানা। যদিও তার বিশ্বাস এই মেয়েটা তেমন কিছুই চাইবে না৷ আর চাইলেও অতি সাধারণ কিছুই হয়তো চাইবে৷ কিন্তু সে খুব করে চায় এই মেয়েটা তার কাছে খুব অসাধারণ কিছু চাক। যা দিতে গিয়ে সে বারকয়েক হোঁচট খাবে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই দিতে পারবে। যা তার মনে এবং সূচনার মনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।
________
সারাদিন খুব একটা ভালো কাটেনি হৈমীর। মানসিক, শারীরিক উভয় ক্ষেত্রেই তীব্র দুর্বলতায় নেতিয়ে পড়েছে মেয়েটা। হৈমী যতই রাগ করুক, অভিমান করুক রুদ্র পাত্তা দেয়নি৷ সে তার মতো সেবা করেছে বউয়ের৷ দুপুরবেলা খেতে চায়নি বলে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। রাতের বেলায় যাতে কষ্ট করে রাঁধতে না হয় তাই রাতটাও বাইরের খাবার খেয়েছে দু’জন মিলে৷

ডিনার শেষে অফিসের খবরাখবর নিয়ে হৈমীর কাছে এলো রুদ্র। শতহোক পুরুষ মানুষ তো৷ গতরাতে যে সুখের ঠিকানা সে পেয়েছে সে সুখই তাকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করছিল। চৌম্বকের মতো টানছিল হৈমীর দিকে। আরো একবার তীব্র প্রণয়ের উত্তাল ঢেউয়ে যোগ দিতে মস্তিষ্কে আন্দোলন বেঁধে গেছে তার৷ শরীরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভূতিরা টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করেছে৷ একবার সেগুলো দমন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে৷ অভিমানে স্তব্ধ হৈমীকে ছোঁয়ার চেষ্টা করল গভীর করে৷ কী জানি হঠাৎ কী বুঝে হৈমীও সায় দিল। দ্বিতীয় বারের মতো ঘনিষ্ঠ হতে উদ্যত হলো তার সঙ্গে। রুদ্র যখন উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে উষ্ণ স্পর্শে তার দেহ কাঁপিয়ে তুলছিল৷ সেও সতর্কতার সঙ্গে তাকে সাড়া দিচ্ছিল৷ এক পর্যায়ে বলিষ্ঠ কাঁপা কাঁপা কাঁপা হাতটা তার পরিহিত বস্ত্র খুলতে উদ্যত হলো। পৃথিবীর আর কেউ রুদ্রকে এইরূপে হয়তো দেখেনি৷ হৈমী দেখেছে৷ রুদ্রর মতো কঠিন হৃদয়ের মানুষটারও হাত কাঁপে, গলা শুঁকিয়ে যায়। যা খুব গভীর হয়ে অনুভব করেছে শুধুই হৈমী। শুধু বুঝতে পারেনি মানুষটা ভেতরে ভেতরে তার কাছে কতটা দুর্বল। ঘন নিঃশ্বাস, বুকের ভিতর তীব্র উত্তেজনা একপাশে সরিয়ে পৈশাচিক ভাবে কিঞ্চিৎ হাসল হৈমী৷ সাহায্য করল স্বামীকে। পরনের লেডিস টি-শার্ট নিজে থেকেই খুলে দিল সে৷ রুদ্রর কী অতো কিছু খেয়াল করার বা হিসেব করার সময় তখন? সে প্রগাঢ় অনুভূতিতে ভেসে গিয়ে বউকে আদুরে স্পর্শে ভাসাতে চাইল কেবল৷ ছোট্ট নরম বক্ষ বিভাজনে উন্মত্ত ঠোঁটটা ডুবিয়ে দিল সন্তর্পণে। খুঁজে পেল ইহজন্মের সকল সুখ, সকল পূর্ণতা। গতরাতের সেই স্মরণীয় ক্ষণটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠল মুহুর্তেই৷ এক পলক তাকাল বদ্ধ চোখে, কম্পিত ঠোঁটে, বক্ষ তলে পড়ে থাকা হৈমীর পানে। রুমের ঝকঝকে বাতিটা নেভানো হয়নি। আজ আর ওঠে গিয়ে লাইট অফ করার তড় সইল না। ধীরেধীরে হাতটা নামিয়ে নিল উদর থেকে প্লাজুতে৷ অমনি খপ করে তার হাতটা চেপে ধরল হৈমী নিজের নমর হাত দ্বারা। চোখ খুলল বৈদ্যুতিক গতিতে। হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে তার বুকটা৷ সেদিকে তাকাতেই রুদ্রর পৌরুষ চিত্ত দৃঢ় উন্মাদ হয়ে গেল৷ পুনরায় আবারো চেষ্টা করল পরিধেয় শেষ বস্ত্রটুকু খোলার৷ কিন্তু হৈমী হিংস্র বাঘিনীর মতো ওঠে বসার চেষ্টা করল৷ শক্তিতে কুলোচ্ছিল না বলে সহসা রুদ্রর বুকের পাটায় শক্ত করে কামড় বসাল৷ রুদ্র ব্যথায় আহ সূচক শব্দ করে সরে গেল, ছেড়ে দিল তাকে। গায়ের ওপর কম্বল টেনে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে হৈমী মুখ খুলল,

-” একবার শর্ত ভেঙেছেন আপনি কিন্তু আমাকে ভাঙতে দেননি৷ তাই আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একবার যেই ভুল করেছি সেই ভুল দ্বিতীয় বার করব না। ”

রুদ্রর মন, মস্তিষ্ক জুড়ে ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়া অনুভূতি হলো৷ তার মুখের অবস্থা দেখে কম্বলের নিচে মুখ লুকিয়ে, ঠোঁট চেপে হাসল হৈমী। জোরে জোরে কতক্ষণ শ্বাস নিয়ে মাথা ঠান্ডা করল রুদ্র। আলগোছে কম্বল সরানোর চেষ্টা করল। ডাকল,

-” হৈমী, হৈমী। ”

কী নিরুপায় কণ্ঠস্বর। একমাত্র স্ত্রীর দ্বারাই বোধহয় সম্ভব স্বামীকে এভাবে চরম মাত্রার বেকায়দায় ফেলা। মনে মনে মায়াও হলো আবার আনন্দও পেল৷ মাথা তুলে দেখতে ইচ্ছে করল দা গ্রেট বেচারা রুদ্রকে৷ কিন্তু এখন মজা নেওয়ার সময় নয়। সময়টা খুবই সিরিয়াস। নিজেকে সংযত করল হৈমী। বলল,

-” আমি আপনার কোনো কথা শুনব না৷ এতে যদি আপনি জোর খাঁটিয়ে নিজের চাহিদা পূরণ করেন তাতে আমার সমস্যা নেই। শুধু সারাজীবন মনে রাখব আপনি শুধু খারাপ মানুষই না ভয়াবহ একজন ধ’র্ষ’কও! ”

-” হৈমী!!! ”

উচ্চরবে ধমকে ওঠল রুদ্র। কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে চুপসে গেল হৈমী৷ রুদ্রর কপালের রগ ফুলে ওঠল নিমিষেই। ক্রোধে হাত, পা কাঁপতে শুরু করল অবিরত। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে নিজের গালেই কষিয়ে এক থাপ্পড় বসাল৷ ফুঁসতে ফুঁসতে বিছানা থেকে নেমে চলে গেল রুমের বাইরে৷ দরজাটা তুমুল শব্দে লাগিয়ে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে সেখানেও এক লাত্থি বসাল। ড্রয়িং রুম থেকেও কয়েকটা জিনিস ভাঙচুর হওয়ার শব্দ পাওয়া গেল৷ ভয় হলেও নিজের জেদে অটুট থেকে এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল হৈমী৷

ড্রয়িংরুমের এক কোণে বসে সিগারেটের ধোঁয়ায় বুঁদ হয়ে পড়ে রইল রুদ্র। সারারাত নিদ্রাবিহীন কাটিয়ে দিল মানুষটা৷ দুটো চোখ রক্ত লাল। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। যে মেয়েটাকে সে ভালোবেসে আপন করে নিতে চাইল। বউয়ের স্বীকৃতি দিল। নিজের লাইফস্টাইলে অভাবনীয় পরিবর্তন আনল। আজ সেই কিনা তাকে ধ’র্ষ’ক উপাধি দিচ্ছে? তার অধিকারকে ধ’র্ষণের সমতুল্য বলছে? ক্রোধে আবারো নিয়ন্ত্রণ হারাল সে। সহসা জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরল বুকের মাঝখানে। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুঝে, জ্বলন্ত সিগারেট বুকে চেপে কাটিয়ে দিল পুরো রাত।

পৃথিবীতে এই মানুষ গুলো সবচেয়ে বেশি অসহায়। যারা নিজেকে, নিজের অনুভূতিকে বিশ্লেষণ করে বোঝাতে পারে না৷ ফলশ্রুতিতে তাদের বুকের ভিতর লালিত প্রগাঢ় অনুভূতি, সীমাহীন ভালোবাসা থেকে যায় আড়ালে আবডালে।
___________
রুমে এসে মাহের সূচনাকে জিজ্ঞেস করল,

-” জন্মদিন উপলক্ষে আপনার কী চাই সূচনা? ”

অকপটে জবাব সূচনার,

-” আমাদের সন্তানকে দ্রুত পৃথিবীতে আনতে চাই। খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে বাবা ডাক শোনাতে চাই মাহের। আর আমি হতে চাই মা। দেবেন তো এই উপহারটা? আমার জীবনের সেরা উপহারটা কিন্তু দিতেই হবে আপনাকে। দেরি কিন্তু সহ্য হবে না। ”

বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল মাহের৷ অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

-” এমন অসাধারণ উপহার কীভাবে চাইলেন আপনি? ”

মাহেরের চোখে চোখ রেখে লাজুক স্বরে সূচনা বলল,

-” অসাধারণ মানুষের কাছে সাধারণ কিছু চেয়ে আমি আর বোকামি করতে রাজি নই মাহের। ”

চলবে….

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৩
ভালোবাসা ছোট্ট একটি শব্দ। অথচ এর গভীরতা কী বিশাল! যারা ভালোবাসে তারা এই গভীরতা যতটা অনুভব করে, তার চেয়েও বেশি অনুভব করে যারা ভালোবেসে ব্যর্থ হয়। মাহের, সূচনা তেমনি এক দম্পতি। মাহের নিয়তির কাছে হেরে গিয়েছিল৷ হারিয়েছিল প্রথম প্রেমকে। সূচনা হেরেছিল সমাজের নিষ্ঠুরতার কাছে। বুকের ভিতর লালিত প্রথম প্রেমের বিসর্জন দিতে হয়েছে তাকেও। আজ পৃথিবীটা ভীষণ আলাদা। চিরচেনা সেই পৃথিবী, সেই মানুষ আজ আর নেই। আজ পৃথিবীটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। বুকের খুব গহীনে সুখ সুখ অনুভূতিটা তীব্র হচ্ছে। শরীর জুড়ে যে আরামটা বোধ হচ্ছে তা খুবই উষ্ণ, খুবই নরম৷ এই মন, এই দেহ যেন আজ শুধু একার নয়। যে মানুষটা বুক ভেদ করে হৃদয়ে নিখুঁতভাবে জায়গা করে নিল এই মন, এই দেহের ভাগিদার আজ সেও৷ শ্বাসরুদ্ধকর জীবন থেকে যেন চিরমুক্তি ঘটল৷ জায়নামাজে বসে সৃষ্টিকর্তাকে শুকরিয়া জানালো সূচনা৷ ঘাড় ফিরিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা মাহেরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। বিরবির করে বলল,

-” আমি বাঁচতে চাই। এই মানুষটার সঙ্গে কাটাতে চাই অনেকগুলো বসন্ত। ”

রাতের ফ্লাইটে ফিরতে হবে৷ তাই মাহেরকে ডেকে তুলল সূচনা৷ দু’জন মিলে একটু ঘুরতে বের হবে। হৈমীর জন্য কিছু জিনিস কিনতে হবে। মেয়েটা ম্যাসেজ করে বারবার করে বলে দিয়েছে তার জন্য যেন তেঁতুল নিয়ে যাওয়া হয়। আর কিচ্ছু চাই না তার৷ ম্যাসেজ লিখে আবার সতর্ক করেও দিয়েছে,

-” ভাবি রিপলাই দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি তোমার ভাইয়ের ফোন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ম্যাসেজ করেছি৷ এক্ষুনি ডিলেট করে দিব৷ তুমি রিপলাই না করলে উনি টেরও পাবে না। ”

এটুকু লিখে সাথে কয়েকটা হাসির ইমুজিও দিয়েছে। ভেবেই হাসল সূচনা। মাহেরের কাঁধে হাত রেখে ডাকল,

– ” মাহের, ওঠুন। ”

হালকা জেগে ওঠে মাহের বলল,

– ” নামাজ পড়েছেন ? ”

সূচনা কিঞ্চিৎ মন খারাপ করে বলল,

-” হ্যাঁ দু’জন একসাথে পড়লে খুশি হতাম। তা তো আর হলো না। ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। সে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কর্ণগোচর হতেই মুচকি হাসল মাহের। চোখ বুজে থাকা অবস্থাতেই। কিয়ৎকাল পেরিয়ে গেলে হাত বাড়িয়ে সূচনাকে কাছে টানল। সূচনা বুঝতে পেরে ধীরেধীরে তার কাছাকাছি এসে বসল। মাহের আলগোছে তার কোলে মাথা রেখে শীতল কণ্ঠে বলল,

– ” আজ দুপুর থেকে দু’জন একসঙ্গে নামাজ পড়ব। এবং এর পর থেকে প্রতি ওয়াক্তে তাই হবে। ”

সূচনা নিশ্চুপ। মাহের ধীরগতিতে চোখ খুলে তাকাল। দৃষ্টিপাত করল তার বউয়ের অভিমানী মুখশ্রীতে। বলল,

– ” এত অভিমান করলে চলে? একজন গুড হাজব্যন্ড হিসেবে আমি যা করেছি তা কি অন্যায়? ”

সূচনার হাসি পেলে তবুও সে মুখটা অভিমানী করেই রাখল। মাহের পুনরায় বলল,

– ” পুরো রাত এত টর্চার করেছি বউকে। শেষরাতে একটু ঘুমিয়েছে। আমার এত মায়া লাগল যে তখন আর ডাকতে পারলাম না৷ ভাবলাম আমি নামাজ পড়ে নিই তাকে একঘন্টা পর ডেকে দিই। খুব বেশি অন্যায় হয়ে গেছে নাকি? ”

লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেল সূচনার। মুখ লুকোনোর জায়গা না পেয়ে এদিক সেদিক চোখ ঘুরাতে লাগল৷ টের পেয়ে মাহের চোখ বুজল। মুচকি হেসে বলল,

– ” বউটা ভীষণ লাজুক। ”

সূচনা কথা ঘুরাতে বলল,

-” আপনি ওঠবেন না? চলুন না বের হই। আজ দিনটাই আছে। রাতে ফ্লাইট ভুলে গেছেন? ”

চট করে চোখ খুলল মাহের। জিজ্ঞেস করল,

-” সাহস তো খুব বেশি! ঘুরতে যেতে চাইছেন। ”

-” কেন? কী হয়েছে? ”

মৃদু কেশে ওঠে মাহের বলল,

-” অনেক কিছুই তো হলো। কোনটা বলব? বললেই তো লজ্জায় মুখ লুকাতে চাইবেন। ”

-” ইস! আপনি দেখছি খুব দুষ্টু। ”

কথাটা বলেই মাহেরের মাথা সরিয়ে ওঠে দাঁড়াল সূচনা। টুকটাক কাজের ছুঁতোয় বলল,

-” আপনি ওঠে তৈরি হন৷ আমি এগুলো গুছিয়ে নিই ততক্ষণ। ”

মাহের কতক্ষণ থম মেরে তাকিয়ে রইল৷ এরপর আকস্মিক প্রশ্ন করল,

-” পেইন কিলার টেবলেট খেয়েছেন? ”

চমকাল সূচনা। লজ্জায় নিঃশ্বাসগুলো বেসামাল হলো ভীষণ। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে শাড়ি ঠিকঠাক করার বাহানায় দাঁড়াল। আমতা আমতা করে বলল,

-” আমি ঠিক আছি সমস্যা নেই। ”

চট করে ওঠে বসল মাহের৷ একই ভঙ্গিতে ওঠে দাঁড়ালও। মৃদু পায়ে সূচনার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে কপাল, গলা চেক করল। অল্প উষ্ণতা অনুভব করে স্পর্শ করল শাড়ির আঁচলে। সূচনা আঁতকে ওঠে বলল,

-” কিছু হয়নি, আপনি অযথা ভাবছেন। ”

-” উহুম এত কথা বলছেন কেন? ”

চুপসে গেল সূচনা। তার শরীর জুড়ে দেওয়া লাভ বাইট গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল মাহের। লজ্জায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম সূচনার৷ মাহের চটপট শাড়ি ঠিকঠাক করে দিয়ে বলল,

– ” চলুন আগে কিছু খেয়ে নেবেন৷ তারপর ওষুধ দিচ্ছি। ”

থমথমে কণ্ঠে সূচনা কিঞ্চিৎ জবাব দিল,

-” হু। ”
__________
বসার ঘরে ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট চেপে বসে রুদ্র। দৃষ্টিজোড়া ল্যাপটপে স্থির। বেডরুমের দরজার আড়াল থেকে একটু পর পর উঁকি দিচ্ছে হৈমী। সারাবেলা পেরিয়ে গেল, রাতও বাড়ছে। তবুও রুদ্র একটি শব্দ বিনিময় করেনি তার সঙ্গে। একসঙ্গে বসে খায়ওনি। কাজের মেয়ে রিতু ছিল বলে সেও চুপচাপ ছিল৷ সন্ধ্যাবেলা সব কাজ সেরে মেয়েটা চলে গেছে। এবার বাসা পুরোই ফাঁকা। মনে মনে ভীষণ সাহস সঞ্চয় করে তাই হৈমী গিয়ে বসল রুদ্রর পাশে। থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-” আপনার বুকের কী অবস্থা দেখি? মলম লাগিয়েছিলেন? খুব জ্বালা করেছে তাই না। কীভাবে হলো বলুন তো? সিগারেট খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? আর তখনি ওটা ঠোঁট ফসকে বুকে পড়েছে তাই না। ইস আমার যে কী দুঃখ হচ্ছে। আমি একটু দেখি? একটু ছুঁয়ে দিই আরাম লাগবে। একটুও ব্যথা দিব না। শুধু একটু ফুঁ দিব। ”

কথাগুলো বলতে বলতে অনেকটা কাছাকাছি চলে এলো হৈমী। সহসা চোখ মুখ শক্ত করে রুদ্র এমন চোখে তাকাল। যে ওর গলা শুকিয়ে গেল৷ ঢোক গিলে সরে গেল সে৷ ক্ষীণ স্বরে বলল,

-” সরি। ”

রুদ্র হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে পুনরায় নিজের কাজে মন দিল। কয়েক পল পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ হৈমী ফুপিয়ে কেঁদে ওঠল। অভিযোগের সুরে বলল,

-” কাল তো চলেই যাব। ভাইয়া, ভাবি এই এলো বলে৷ আপনি আমার সাথে কথা না বললে আমার তো খুব কষ্ট হবে। যাওয়ার আগে একটু ভালোবাসবেন না? ”

দাঁতে দাঁত চেপে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল রুদ্র। চট করে ওঠে ল্যাপটপ নিয়ে চলে গেল বেডরুমে। হৈমী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ! কয়েক মিনিট পর গুটিগুটি পায়ে রুমে প্রবেশ করল সে। দেখল ডিভানে বসে আছে রুদ্র। তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে কপাল টিপছে মাথা নিচু করে। নিশ্চয়ই মাথা ধরেছে? ত্বরান্বিত হয়ে কাছে এলো সে। পাশে বসে বলল,

-” আমি মাথা টিপে দেই? ”

জবাব দিল না রুদ্র। পুনরায় সে বিরস বদনে বলল,

-” অমন করছেন কেন? কাল রাতের কথা ভুলে যান না। ওসব মনে রেখে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করার কি খুব দরকার। আপনি জানেন আমি শুনেছি, মনের ভেতর রাগ পুষে রেখে কারো সঙ্গে কথা না বললে পাপ হয়। শুনুন, আমি শুধু আপনাকে কাল বোঝালাম যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করালে কেমন লাগে। সেদিন আমাকে আপনি জোর করে কি সব খাওয়ালেন। তাই তো আমিও প্রতিশোধ নিলাম৷ দেখেছেন সব সময় নিজের ইচ্ছে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে নেই৷ সেদিন আপনি ভুল করেছেন৷ তাই আমিও কাল বোঝালাম আপনার ইচ্ছেকে গুরুত্ব না দিয়ে। ”

হৈমীর কথা শেষ হতেই চট করে রুদ্র ওঠে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো করে কয়েক দফা শ্বাস নিল সে। হৈমী ভয় পেয়ে গেল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,

-” অমন করছেন কেন? আপনার কি হাঁপানি রোগ আছে? এটা কি বংশগত নাকি শুধু আপনার একারই এমন হয়েছে। ”

রুদ্রর মাথাটা দপদপ করতে লাগল। দু’হাতে কান চেপে ধরতে নিয়েও থেমে গেল সে৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে চুপচাপ চলে গেল ডাইনিং রুমে। পিছু পিছু হৈমীও গেল। রুদ্র পানির গ্লাস ধরতে উদ্যত হতেই সে নিজ তাগিদে জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে দিল৷ এক পলক দৃঢ় চোখে তাকাল রুদ্র। হৈমী আমতা আমতা করে বলল,

-” নিন নিন ঠিক হয়ে যাবে। ”

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে পানিটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করল সে। হৈমী বলল,

-” খাবার বাড়ব নাকি ভাইয়ারা এলে খাবেন? ”

রুদ্র জাবাব দিল না। আলগোছে বেরিয়ে এলো ড্রয়িংরুমে। হৈমী মন খারাপ করে পিছন পিছন এলো। রুদ্র এগিয়ে যাচ্ছে রুমের দিকে সে পিছু নিয়ে গুটিগুটি পায় এগুচ্ছে। রুদ্রর গায়ে ঢিলেঢালা একটি টি-শার্ট৷ তার সঙ্গে মিলিয়ে ট্রাউজার পরেছে। মাথায় থাকা একঝাঁক চুল পেছনে ঝুঁটি করা। সেই ঝুঁটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই রুমে প্রবেশ করল সে। রুদ্র গিয়ে বসল বেলকনিতে। দু’টি বেতের চেয়ার পাশাপাশি রাখা ছিল সেখানে৷ হৈমী চট করে পাশেরটায় গিয়ে বসল। রুদ্রর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভর্তি কঠিন হয়ে থাকা চোয়ালে তাকিয়ে রইল সে। অনেকক্ষণ। পিটপিট করে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকার পর আকস্মাৎ চুমু খেল খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির চোয়ালে। রুদ্র স্থবির হয়ে একই ভঙ্গিতে বসে। তার সঙ্গে এই মাত্র কী ঘটে গেল সেদিকে বিন্দুমাত্র পাত্তাও দিল না৷ অথচ চুমু খেয়ে নিজের ঠোঁট বুলাচ্ছে হৈমী। মিনমিনে গলায় বলল,

-” কেমন কাঁটার মতো বিঁধে এগুলো। শুনুন, আপনি ক্লিন শেভ করবেন৷ ক্লিন শেভ করলে আমি চুমু খেয়ে শান্তি পাবো। আর আপনাকে দেখতে বাচ্চা বাচ্চাও লাগবে৷ তখন আপনার সঙ্গে আমাকে বেশি মানাবে।”

রুদ্র উত্তর করল না। সে হৈমীর কথা আদেও শুনেছে কিনা এটুকুও বোঝা গেল না। হৈমী নিজে থেকেই বলল,

-” আমিত কাল চলে যাচ্ছি… আপনি কিন্তু ফোন করবেন৷ আর ভিডিয়ো কলেও কথা বলব আমরা। ঠিক আছে? ”

রুদ্র একধ্যানে দূরের পথে তাকিয়ে। হৈমী প্রচণ্ড হতাশ হলো। বলল,

-” আমার না খুব কান্না পাচ্ছে। ”

কথাটা বলতে বলতেই ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে ফেলল সে৷ রুদ্র সহসা চোখ বুজে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ভরাট স্বরে বলল,

-” মাথা ধরেছে হৈমী। চুপ থাকো। ”

থামল হৈমী৷ অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আধো স্বরে জিজ্ঞেস করল,

-” মাথা টিপে দিব? ”

-” না। ”

রাশভারি স্বর রুদ্রর। হৈমী অনুনয় করে বলল,

-” চুল টেনে দিই আরাম লাগবে? ”

এ প্রশ্নে রুদ্র কিছু বলল না। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। রুদ্রর পেছনে দাঁড়িয়ে। ছোটো ছোটো নরম হাত দু’টো দিয়ে ধীরে ধীরে চুল টানতে শুরু করল। জিজ্ঞেস করল,

-” আরাম লাগছে? ”

রুদ্র ক্ষীণ উচ্চারণ করল,

-” হুম। ”

এইটুকুতেই মুখে হাসি ফুটল হৈমীর। অনেক ভালোবাসা আর আদর মেখে চুলগুলো টেনে দিতে লাগল সে।
______________
মাহের সূচনা ফিরে এলো। পরের দিন বিকেলবেলা তারা চলেও গেল। হৈমীকে নিয়ে। রুদ্র তার গম্ভীরতায় অটল ছিল। শুধু গাড়িতে ওঠার পর হৈমীর অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে বলেছে,

-” ডোন্ট ওয়্যারি, আমি ফোন করব। ”
.
.
এরপর কেটে গেল এক সপ্তাহ। রুদ্র ফোন করেনি হৈমীকে। অতিরিক্ত মন খারাপ আর চিন্তা করে হৈমীর মুখটা শুকিয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া একদমই হচ্ছে না। সারাক্ষণ ফোন নিয়ে পড়ে থাকে সে। এতদিন তার পার্সনাল ফোন ছিল না। মায়ের ফোনটাই ইউজ করত৷ বাড়ি আসার পরেরদিনই মাহের তাকে ফোন কিনে দিয়েছে। সেই ফোন নিয়েই সে পড়ে থাকে। তিনবেলা নিয়ম করে হোয়াটসঅ্যাপে বিশাল বিশাল ম্যাসেজ করে রুদ্রকে। সেই ম্যাসেজগুলো সিন হয়। কিন্তু রিপলাই আসে না৷ কেন আসে না? উত্তর হিসেবে বুঝে নেয় সে সেই রাতের ঘটনাকে। মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে কেন ফেরার সময় ‘ ফোন করব বলেছিল? ‘

ধীরেধীরে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলো। আর মাত্র এগারোদিন বাকি। হৈমীর চেহেরার অবনতি দেখে তার মা সূচনাকে বলল,

-” আমার মনে হয় রুদ্রর সঙ্গে ওর কথাবার্তা হয় না৷ তুমি একা ডেকে জিজ্ঞেস করো তো। আর তোমার ভাইকে বলে দিও ওর সামনে পরীক্ষা। বাচ্চা মেয়ে, অবুঝ একটু বোঝায় যেন। ”

সূচনা মাথা নাড়িয়ে বোঝায় সে ভাইকে জানিয়ে দেবে৷ রাত তখন ন’টা ছুঁই ছুঁই। আজ মাহেরের ফিরতে দেরি হবে। সে তার বন্ধুর এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাইরে গেছে। তাই হামিদা সূচনাকে বলল,

-” খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো। মাহেরের ফিরতে দেরি হবে৷ ”

সূচনাকে কথাটা বলে হৈমীকে ডাকল সে। হৈমী আসার পর নিজ হাতে মেয়েকে ভাত খাওয়িয়ে দিল৷ সূচনাকে অনেকবার বলল খেতে বসতে কিন্তু সে বসল না৷ হামিদার ইচ্ছে ছিল দু’জনকে একসাথে খাওয়িয়ে দেবে৷ কিন্তু সূচনা জানালো তার একদম খিদে নেই। মা মেয়ে খেয়ে চলে গেল। সূচনা সব গুছিয়ে সবেই রুমে গেছে অমনি কলিং বেল বাজল। সূচনা কিঞ্চিৎ তরান্বিত বেগে গিয়ে দজরা খুলল। মুচকি হেসে মাহের বলল,

-” খুব একটা দেরি হয়নি। ”

সূচনা মৃদু হেসে সরে দাঁড়াল। মাহের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

-” আপনারা খেয়েছেন? ”

সূচনা বলল,

-” মা আর হৈমী খেয়েছে। আপনি হাতমুখ ধুয়ে আসুন। আমি খাবার বাড়ছি। ”

মাথা চুলকে হাসল মাহের। বলল,

-” আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন? ”

লাজুক হেসে খাবার বাড়তে চলে গেল সূচনা। তৃপ্তিভরে শ্বাস নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো মাহের। প্লেটে খাবার দেখে বসতে বসতে বলল,

-” এত কষ্ট করে খাবার বাড়লেন কষ্ট করে আর নিজ হাতে খেতে হবে না। আমি খাওয়িয়ে দিচ্ছি। ”

চমকে তাকাল সূচনা। চাপা স্বরে বলল,

-” ইস না, মা বা হৈমী দেখলে খুব লজ্জায় পড়তে হবে। ”

-” আপনি বড্ড বেশি ভাবেন আর লজ্জা পান। ওসব কিছুই হবে না৷ আর যদি হয়ও মানে তারা দেখেও সমস্যা নেই। আমি কি পরনারীকে খাওয়াতে যাচ্ছি বা আপনি পরপুরুষের হাতে খাচ্ছেন? সব লজ্জা আমার পকেটে গুঁজে খেতে বসুন আর হা করুন। ”

মাহেরের জেদের কাছে হার মানল সূচনা। মাহের নিজ হাতে তাকে খাওয়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি নিজেও খাচ্ছে। এমন সময় খাবার রুমে এলো হামিদা। ছেলে, ছেলে বউকে এমন পরিস্থিতিতে দেখে কিছুটা লজ্জা পেল সে। ফিরে আসতে উদ্যত হয়েও থেমে গেল। হালকা কেশে ওঠল। মাহের কিঞ্চিৎ চমকাল। সূচনা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে মায়ের হাতে জগ দেখে মাহের বলল,

-” সূচনা মাকে পানি ভরে দিয়ে আসুন। ”

সঙ্গে সঙ্গে সূচনা ওঠে শাশুড়ির থেকে জগ চাইল। হামিদা থম মেরে ওরদিকে জগ এগিয়ে দিল। মাহের মাকে বলল,

-” প্রেশারের ওষুধ খেয়েছ? ”

হামিদা ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল,

-” হ্যাঁ। কখন ফিরেছিস? ”

-” এইতো কিছুক্ষণ আগে। শুয়ে পড়েছ ভেবে ডাকিনি। ”

সূচনা জগ ভরে এনে দিতেই হামিদা বলল,

-” তোমার তো একদমই খিদে ছিল না। এখন তো দিব্যি খাচ্ছ! বললেই পারতে আমার হাতে খেতে আপত্তি আছে। ”

বিস্মিত হয়ে বুকের ভিতরটা ধড়াস করে ওঠল সূচনার৷ হামিদা এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে চলে গেল৷ মাহের কিঞ্চিৎ অবাক হলেও পরোক্ষণে নিজেকে সামলে নিল। সূচনাকে বলল,

-” উমহ দ্রুত আসুন খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না। ”

থমথমে মুখে চেয়ারে গিয়ে বসল সূচনা৷ তার মাথায় চলছে শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন। মা কি তাকে খাওয়িয়ে দিতে চেয়েছিল? ইস সে তো বুঝতেই পারেনি। বুঝলে নিশ্চয়ই এই আদরটা লুফে নিত। সহসা চোখ দুটো টলমল হলো তার। মাহের তার মুখে খাবার দিতে উদ্যত হতেই সে পানি খেল। ক্ষীণ স্বরে বলল,

-” আর খাব না প্লিজ। ”

-” মা খাওয়িয়ে দিতে চেয়েছিল খাননি কেন সূচনা? এটা কিন্তু ভুল হয়েছে। তাই মা ওভাবে বলেছে। এই নিয়ে মন খারাপ করে এখন আমার হাতে না খেলে আমিও মন খারাপ করব। ”

উৎকণ্ঠিত গলায় সূচনা বলল,
-” বিশ্বাস করুন আমি বুঝতে পারিনি উনি খাওয়িয়ে দিতে চেয়েছে৷ উনাদের সঙ্গে খেতে বলেছে তাই বলেছি পরে খাব আপনি আসলে। আপনাকে ছাড়া খেতেও মন মানছিল না। আমি খুব সরি মাহের। মাকেও সরি বলব। ”

-” আচ্ছা বুঝেছি তাহলে ছোট্ট একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। ব্যাপার না। আমি আছিত মাকে সঠিকটা বোঝানোর দায়িত্ব আমার। ”

পরেরদিন সকালবেলা হামিদা বেশ চুপচাপ রইল। কারো সাথেই তেমন কথা বলল না। রান্না করে মাহেরকে খেতে দিতে দিতে এত ব্যস্ততা গেল সূচনার যে শাশুড়িকে সরি বলা হলো না। আজ প্রথম ক্লাসটাই মাহেরের৷ তাই দ্রুত বেরিয়ে যেতে হলো তাকে৷ পথিমধ্যে তার খেয়াল হলো গতরাতের কথা। সে যদি এক্ষুনি বিষয়টা না সামলায় অন্যসব বউ শাশুড়িদের মধ্যে হওয়া মান, অভিমান অতঃপর গৃহযুদ্ধ! হতে পারে৷ যদিও তার মা বা সূচনা দু’জন মানুষই ভীষণ শান্ত প্রকৃতির। তবুও মনে মনে একে অপরের প্রতি কিঞ্চিৎ তিক্ততা আসুক তা সে চায় না। তাই মাকে ফোন করল সে। লম্বা করে সালাম দিয়ে বলল,

-” ও মা তুমি কি তোমার ছেলের বউয়ের ওপর ভীষণ অভিমান করেছ? ”

হামিদা সন্দিহান হয়ে বলল,

-” সূচনা তোকে কী বলেছে? ”

-” কিছু বলেনি৷ কাল রাতে আপনিই তো বললেন৷ ওটা শুনেই জিজ্ঞেস করেছি। সময়ের অভাবে আজ দ্রুত বের হতে হলো। তাই ভাবলাম ফোনেই জরুরি কথা বলি। ”

-” কতবার বলেছি তোকে বাইক চালিয়ে ফোনে কথা বলবি না৷ ”

-” আমি বাইকে না। অটো করে যাচ্ছি ফাঁকা অটো ড্রাইভার ছাড়া কেউ নেই। ”

-” হুম। ”

-” মা, সূচনা বুঝতে পারেনি তুমি ওকে খাওয়িয়ে দিতে চেয়েছ। আর ও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বোঝোই তো নতুন বিয়ে… ঠিক যেমন তুমি বাবাকে ছেড়ে একবেলাও খেতে চাইতে না৷ পারতে না খেতে সূচনা বোধ হয় তোমার এই গুণটা পাবে মা৷ আমিত খুবই অবাক হয়েছি কাল যে ঠিক আমার মায়ের মতোন গুণ মেয়েটার খুবই স্বামী ভক্তি। ”

মাহের ইচ্ছে করেই মায়ের বউকালের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিল। যাতে সূচনার বর্তমান অনুভূতি সে বুঝতে পারে৷ আর সব অভিমান দূরে সরিয়ে ফেলে। মেয়েটার প্রতি কোনো নেগেটিভ চিন্তা না আসে! সত্যিই তাই হলো৷ হামিদার মনে পড়ে গেল তার বিয়ের পরবর্তী সময় গুলোর কথা। তার মৃত শাশুড়ির কথা। নিমিষেই সূচনার প্রতি সব অভিমান দূর হয়ে মনটা পুলকিত হলো৷ বউকালের সেসব স্মৃতি মনে করে মুচকি হাসল সে। ছেলেকে বলল,

-” বাবা তুই সাবধানে কলেজে যা। ওর ওপর আমি রাগ করিনি চিন্তা করিস না। ”

-” আচ্ছা তোমরা সাবধানে থেকো। হৈমীকে পড়তে বসতে বলিও। আর হ্যাঁ সূচনা কিন্তু খায়নি তোমার সঙ্গে খাবে বলে৷ খেয়ে নিও তোমরা। আমার ফিরতে পাঁচটা বাজবে। ”

পৃথিবীর প্রতিটি পুরুষের মাঝেই মা এবং বউয়ের মন রক্ষা করার ক্ষমতা থাকে। এই দু’জন নারীকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটি আল্লাহ প্রদত্তই। কিন্তু সব পুরুষ এই বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগায় না৷ সত্যি বলতে তারা কাজে লাগাতে চায় না৷ কেউ মাতৃভক্তিতে অন্ধ হয় কেউ বা বউভক্তিতে অন্ধ হয়। যারা দুই নারীর প্রতিই যথাযথ সম্মান, ভালোবাসা এবং দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয় দুনিয়া এবং আখিরাতে তারাই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। প্রতিটি পুরুষকে মনে রাখতে হবে, মা হলো সেই নারী যার মাধ্যমে তুমি পৃথিবীর আলো দেখেছ। আর বউ হলো সেই নারী যার মাধ্যমে তোমার ঔরসজাত পৃথিবীর আলো দেখবে।

চলবে…