#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫০
______________________
সূচনার সঙ্গে হামিদাও এলো। চোখের সামনে যা সব ঘটনা দেখল, এরপর আর নিশ্চিন্তে মেয়েকে শেখ বাড়িতে পাঠাতে পারলো না। কান্নাকাটি করে মাহের, সূচনা বুঝিয়ে চলে এলো মেয়ের শশুর বাড়ি। এতে অবশ্য রুদ্রর মাথা ব্যথা হলো না। একশজন এলেও তার মাথা ব্যথা থাকবে না৷ সে শাশুড়ি, বউ, বোন নিয়ে নিজ বাড়িতে নিশ্চিন্তেই ফিরল। ভেতর ঘর থেকে রিনা ঘাবড়ে গেল ওদের উপস্থিতি দেখে। ত্বরিত দরজা আঁটকে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। উদ্বিগ্নচিত্তে। সূচনা বার দুয়েক ডাকল ছোটো কাকিকে। সাড়া না পেয়ে ঘুমিয়ে গেছে ভেবে দাদিনের রুমে দু’বার টোকা দিল। হামিদা তখন হৈমীকে জড়িয়ে ধরে সোফায় বসে। রুদ্র গম্ভীর মুখখানা নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আঁটকে দিয়েছে। অনুমান করা যায় আজ আর এই দরজা খোলা হবে না। হঠাৎ রাতদুপুরে সূচনাকে দেখে দাদিন বেশ ভড়কালো। হৈমী আর হৈমীর মা’কে দেখে বিচলিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো। সূচনা সংক্ষিপ্ত করে দাদিনকে খুলে বলল সব। মুহুর্তেই ভয়ে বৃদ্ধার শরীর কেঁপে ওঠল। ইদানীং হাঁটা চলায় বেশ সমস্যা হচ্ছিল তার৷ তাই লাঠি ভর করেই হাঁটে। সূচনার কথা শুনে ঠকঠক শব্দে লাঠির সাহায্যে পা এগিয়ে নিল হৈমীর সামনে। ঝুঁকে এসে ভীত চোখে তাকিয়ে বলল,
-” সব বুঝলাম। কিন্তু তোর মাথায় এই কুবুদ্ধি আসলো কীভাবে? নিজ বুদ্ধিতে তুই এতদূর আগাইছস? ”
হৈমীর চোখ, মুখ বিবর্ণা হলেও ভয়ের লেশমাত্র নেই। ঘন্টাখানেক আগে ভয়হীন এই মুখটা তীব্র ভয়ে বিধ্বস্ত ছিল। অথচ এখন কী ভীষণ শান্ত। ভয়হীন এই শান্তভাবে কিঞ্চিৎ দুঃশ্চিন্তায় পড়ল সূচনা। রান্নাঘরে গিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে আনল দুই গ্লাস। দাদিন একের পর এক প্রশ্ন করলেও হৈমী কোনো উত্তর দিল না৷ সে চুপ করে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বসে রইল। শ্বাস ফেলল ঘনঘন। হামিদা আচমকা ডুকরে ওঠে রুদ্রর আচরণের কথা দাদিনকে জানালো। সব শুনে দাদিন কী বলবে বুঝে ওঠতে পারলো না। শেষে স্বান্তনার বাণী দিয়ে বলল,
-” রুদ্র যা করেছে খুব অন্যায় করেছে। কিন্তু হৈমীও সঠিক কিছু করেনি। রুদ্র যে ধরনের ছেলে এমন ঘটনা শুনে এই তাণ্ডব অস্বাভাবিক কিছু না। ”
হামিদা এই অনাচার মানতে পারলো না। অভিযোগের সুরে বলল,
-” আপনার নাতি তো জেনে-বুঝে ওকে বিয়ে করেছে। ওর মাথায় যে বুদ্ধিশুদ্ধি কম এই কথা সে ভালো করেই জানে। ”
-” আহা রাগ করো কেন? পুরুষ মানুষ রাগের মাথায় ওসব কি হুঁশ থাকে। ”
-” তাই বলে আমার মেয়েটাকে এভাবে মারবে? এখন কি সেই যুগ আছে? ওর একটু ভুল আছে বলে এখনো চুপ করে আছি৷ নয়তো আপনার নাতিকে আমি ছেড়ে কথা বলতাম না৷ তাকে বলে দেবেন যেচে আমরা তার কাছে মেয়ে দেইনি। আমার সহজসরল মেয়েটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করেছে আপনার নাতি৷ না জানি কোন উদ্দেশ্যে। যা সব দেখছি বুঝছি এতে তো আমার মাথায় ধরছে না কিছুই। ”
দাদিন কিঞ্চিৎ বিরোধিতা করে বলল,
-” এমন ভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে বলছো যে শিশু বাচ্চাকে বিয়ে করেছে। যে বয়সে হৈমীর বিয়ে হলো এই বয়সে আমি এক বাচ্চার মা ছিলাম…”
বাকি কথা বলতে পারলো না দাদিন। আরো একবার কলহ বাজবার ভয়ে সূচনা থামিয়ে দিয়ে বলল,
-” দাদিন তুমি ভাইয়ার দিকে টেনে কথা বলো না। তুমি হয়তো জানো না, ভাইয়া হৈমীকে বিয়ের সময় শর্ত দিয়েছিল কোনোদিন বাচ্চা না নেবার। হৈমী ভাইয়াকে ভালোবেসে এই শর্ত মেনে নিয়েছে। কিন্তু এক্সিডেন্টলি বাচ্চা এসে গেছে! ভাইয়াকে ও কতটা ভয় পায় ভাবো? শুধু ভয় কেন কতটা ভালোবাসে একবার চিন্তা করো৷ ভয় আর ভালোবাসা থেকে ওর ছোটো মাথায় এই চিন্তা এসেছে। কিন্তু আমি ভাবছি ও এতবড়ো পদক্ষেপ একা একা নিল কীভাবে? কারো সাহায্য নিয়েছে নিশ্চিত। ”
এ পর্যন্ত বলে হৈমীর দিকে তাকাল সূচনা। শাশুড়িকে শরবত দিলে সে সেটা খেল না। টি টেবিলে রেখে দিল। হৈমীকে শরবত দিয়ে বলল,
-” এটা খেয়ে নাও। তারপর সত্যি করে বলো তো কার সহায়তা নিয়েছ তুমি? ”
শরবতটি হাতে নিল না হৈমী। সূচনার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। দোতলার একপাশে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে সমস্ত কথাই শুনল রুদ্র। সূচনার প্রতিটি কথাই তার কর্ণকুহরে তীক্ষ্ণতার সঙ্গে প্রবেশ করল। সুক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে রইল হৈমীর দিকে। হৈমী সূচনার প্রশ্নটিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল। মাথা ধরে বলল,
-” আমি ঘুমাব আম্মু। ”
দাদিন বুঝল শরীর খারাপ লাগছে তার। সূচনাও ধাতস্থ হলো। আরো একটি চিন্তায় পড়ল সে। রুদ্র তো ঘরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। হৈমী শুবে কোথায়? এ চিন্তা মাথায় আসার পর দোতলায় তাকাতেই চমকে ওঠল৷ রুদ্র থম মেরে তার দিকেই তাকিয়ে। সূচনা ঢোক গিলে হৈমীকে বলল,
-” আমার ঘরে গিয়ে ঘুমাও আজ। ভাইয়া তো রেগে আছে। রাগ কমলে ও ঘরে যেও। ”
সূচনাকে সমর্থন করে হৈমীকে নিয়ে সূচনার ঘরে গেল হামিদা। মা মেয়ে একসঙ্গে শুয়ে পড়ল। হৈমী মায়ের সঙ্গে একটি কথাও বলল না। নিঃশব্দে চোখ বুজল। মস্তিষ্কে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠল তখনকার ঘটনাগুলো। রুদ্রর বলা প্রতিটি বিষাক্ত কথাগুলো। দিশেহারা বুকটায় চিনচিন করে ওঠল কেবল একটি প্রশ্ন, ভালোবাসা কোথায়?
রাত পেরিয়ে সকাল হলো। ঘুম ভাঙতেই পাশে মা’কে বসা পেল হৈমী। শুষ্ক মুখটায় মলিন হাসলো সে। আচমকা বলল,
-” খেয়েদেয়ে বাড়ি চলে যাও আম্মু। ভাবি এখানে, ভাইয়ার একা একা কষ্ট হয়ে যাবে। ”
-” কিহ চলে যাব মানে? তোকে একা রেখে চলে যাব আমি অসম্ভব। ঐ গুণ্ডাকে এক বিন্দু ভরসাও আমি করি না৷ এখন বুঝছিস তো কেন আমি চাইনি ওর সঙ্গে তোর বিয়ে হোক। তুই নিজের পায়ে নিজে কেন কুড়াল মারলি মা? তোর ভবিষ্যৎটা অনিশ্চিত হয়ে গেল! স্বামী সুখ নেই, উন্মাদ স্বামী, এরওপর অল্প বয়সে গর্ভবতী হলি। চিন্তায় আমার প্রেশার বাড়ছে। ”
-” চিন্তা করো না আম্মু। আমার কিছু হবে না। ”
-” রুদ্র কী বলছে শুনিসনি? ”
-” শুনেছি। ”
চটপটে উত্তর হৈমীর৷ হামিদা সন্দিহান চোখে মেয়ের দিকে তাকাল। বলল,
-” এতকিছু হয়ে গেল তবুও মেয়ে সিরিয়াস হলি না। কতবড়ো ধকলটা গেল কাল। এখনো গলায় লাল দাগ স্পষ্ট। মেরে ফেলতো তোকে। ”
তাচ্ছিল্য করে হাসলো হৈমী৷ এই হাসিটা কোনো সহজসরল, বাচ্চা মেয়েদের বোধহয় দেওয়া সম্ভব না। হামিদা ঘাবড়ে গেল। তার মেয়েটা অতি দুঃখে পাগল হয়ে গেল কি? সহসা ফুপিয়ে কেঁদে ওঠল সে। হৈমী বিচলিত হয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরল। ভরসা দিয়ে বলল,
-” আমার কিছু হবে না আম্মু। তুমি প্লিজ বাড়ি ফিরে যাও। ”
-” তোকে এ বাড়িতে একা ফেলে যাব না আমি। তুই কেন চলে যেতে বলছিস? ”
জেদি স্বর হামিদার। হৈমীর সহজ বাক্য,
-” একা কোথায় ভাবি আছে তো। ”
হামিদার মন সায় দিল না। এক প্রকার জোর করেই দুপুরের পর হামিদাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল হৈমী। মা চলে যাওয়াতে যেন স্বস্তি মিলল তার। সে বুঝে গেছে তার জীবনটা জটিলতায় ঘিরে গেছে। তার অসহায় মা এই জটিলতার মধ্যে পড়ুক তা সে কোনোভাবেই চায় না। ভুল যখন সে করেছে শুধরাবে সে নিজেই। ভুল? হ্যাঁ ভুল। রুদ্রকে অন্ধের মতো ভালোবেসে নিজের মাতৃত্ব ত্যাগের সিদ্ধান্তটি মারাত্মক ভুল ছিল।
_________________
পুরো বেলা কেটে গেল। রুদ্রর মুখোমুখি হতে হয়নি। রাতে ডিনারের সময় মুখোমুখি হলো। সে রুদ্রর দিকে তাকাল বারকয়েক। রুদ্র তাকাল না একবারো। সকলের মধ্যে নীরবে খেয়েদেয়ে চলে গেল রুমে। খাওয়ার সময় হঠাৎ দাদিন বলল,
-” তোর মাথা কুবুদ্ধি খানা কে ঢুকাইছিল বললি না তো? ”
সহসা হৈমীর চোখ চলে গেল রিনার দিকে। সে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখে ইশারা করল যেন কোনোমতেই তার নাম না নেয়। হৈমী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার চোখে দোষী ছোটো কাকি নয়। দোষী সে নিজেই। আর এই দোষের উৎসাহ দাতা একমাত্র রুদ্র। গতকালের সেই মুহুর্ত সে এখনো ভুলতে পারেনি। রুদ্রর ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখতে দেখতে এবার সে বড্ড ক্লান্ত। যার জন্য সে সব ত্যাগ করল কাল সেই চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে কতবড়ো ভুল করেছে। এরপর আর কিছু বলার বা করার থাকে? হাসি পায় না নিজের প্রতি? পায় তো। এই তো তার পাচ্ছে। খুব হাসি পাচ্ছে। প্রানখুলে কখন হাসতে পারবে একটু?
খেয়েদেয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসেছে মাত্র। অমনি গা গুলিয়ে ওঠল। মুখ চেপে ধরে রান্নাঘরের দিকে ছুটতে গিয়ে মাঝপথেই গলগল করে বমি করে দিল। রুদ্র তখন সিঁড়ির মাঝ অবধি গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় বাঁকিয়ে হৈমীর দিকে তাকাতেই দেখল সূচনা ছুটে এসে ধরেছে ওকে। বুকচিরে হাঁপ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। বাকি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে গেল। ঝড়ের গতিতে। বেডরুমে গিয়ে ফোন করল বান্ধবী সুবর্ণাকে। জেনে নিল প্রেগ্নেসিতে কোথায়, কোন ডক্টর দেখালে ভালো হবে? বমি বন্ধ হওয়ার জন্য কোন ওষুধ খাওয়াবে ইত্যাদি ইত্যাদি৷ সুবর্ণা গতকাল রাতেই জেনেছে রুদ্রর বউ প্রেগনেন্ট। মাঝরাতে রুদ্রই জানিয়েছে। শুনে এক প্রকার ধাক্কাই খেয়েছে সে। আচমকা জিজ্ঞেসও করে ফেলেছে,
-” এত দ্রুত বাচ্চা নিলি যে? তোর বউ তো মাত্র অনার্সে এডমিশন নিল! ”
গম্ভীর কণ্ঠে রুদ্র উত্তর দিয়েছে,
-” প্ল্যান ছিল না, এক্সিডেন্টলি হয়ে গেছে। ”
বান্ধবীর থেকে সব খোঁজ, খবর নিয়ে সূচনাকে ম্যাসেজ করল সে। আগামীকাল হৈমীকে ডক্টর দেখাতে নিয়ে যেতে আদেশ করল। সূচনা সম্মতি দিয়ে বলল, যাবে। পরের দিন সকালবেলা যখন সূচনা হৈমীকে রেডি হতে বলল, প্রায় দেড়ঘন্টা সময় নিয়ে রেডি হলো সে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো , হৈমী আজ শাড়ি পরেছে। মোটামুটি সুন্দর রূপে সাজিয়েছেও নিজেকে। সূচনা হকচকিয়ে গেল। হৈমীর ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না তার কাছে৷ তবে বুঝতে পারলো, ওর মাথায় ভয়ানক কিছু চলছে। কিন্তু সেই কিছুটা কী ধরতে পারছে না। নিজেকে সম্পূর্ণ তৈরি করে নেয়ার পর রুম থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ সূচনা বলল,
-” হৈমী? ”
থমকে দাঁড়াল সে। প্রশ্ন সূচকে তাকাল সূচনার দিকে। সূচনা বলল,
-” ভাইয়া সেদিন যাই বলুক মন থেকে বলেনি। রাগের মাথায় বলেছে। তুমি তো ভাইয়াকে চেনো৷ নতুন করে কী বলব আর। আমি আসলে বুঝতে পারছি না কিছু। শুধু এটুকু বলতে পারি যা করেছে মন থেকে নয় নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে বরাবরই ব্যর্থ ভাইয়া। ”
হৈমী আচমকা থামিয়ে দিল সূচনাকে। বলল,
-” দেরি হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি চলো ভাবি। ”
সূচনা চুপসে গেল। ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল হৈমীর পিছুপিছু। বাড়ির মেইন দরজার সামনে এসে সহসা হৈমী বলল,
-” কে কে যাচ্ছি? ”
সূচনা বলল,
-” তুমি আর আমি। ”
অবাক হলো হৈমী। সহসা বাচ্চাদের মতো করে বলল,
-” তোমার ভাই কোথায়? ”
সূচনা ঢোক গিলে বলল,
-” নিজের ঘরে। ”
চোখমুখ কুঁচকে ফেলল হৈমী। এক প্রকার চিৎকার করে বলল,
-” আমাকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়া কি তোমার দায়? যার বাচ্চা সে কোথায়? অন্যের বাচ্চাকে নিজের পেটে বহন করব আমি আর সে ঘরে বসে আরাম আয়েশ করবে। অন্যের বউকে কামলা খাটাবে তা তো হবে না। ”
হৈমীর চিৎকার শুনে সবাই যার যার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো৷ রুদ্র বের হলো দ্বিতীয় চিৎকার শুনে।
-” আমার পেটে যার বাচ্চা আছে তাকে ছাড়া হাসপাতালে যাব না আমি! ”
হকচকিয়ে গেল উপস্থিত প্রতিটি সদস্য। সূচনা কিঞ্চিৎ লজ্জা সীমাহীন ভয়ে জর্জরিত হলো। রুদ্রর গম্ভীর চোয়ালদ্বয় পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠল। তার পরনে ছিল কালো কাবলি রুমে ঢুকে শুধু উষ্কখুষ্ক চুলগুলো পেছনে ঝুঁটি করে নিল। মোবাইল, ওয়ালেট নিয়ে দ্রুত পায়ে নেমে এলো নিচে। সকলের দিকে কঠিন দৃষ্টি ছুঁড়ে দৃঢ় পায়ে হৈমী আর সূচনাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। ভরাট স্বরে সূচনাকে বলল,
-” আয়। ”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হৈমী৷ সকলের দিকে তাকিয়ে সকলকে অবাক করে দিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। এরপর সূচনার পিছু পিছু বেরিয়ে গেল। সকলেই হতভম্ব। রুদ্র নয় হৈমীর আচরণে। এই মেয়ের মাথায় চলছে টা কী?
গাড়ির পিছন সিটে সূচনা, হৈমী বসল। রুদ্র গাড়ি স্টার্ট করতেই সূচনা হৈমীর দিকে চেপে বসে বলল,
-” হৈমী তুমি হঠাৎ এমন করছ কেন? ”
-” কেমন করছি? ”
উচ্চস্বরে করা হৈমীর প্রশ্নটিতে গলা শুঁকিয়ে গেল সূচনার। চাপাস্বরে বলল,
-” আরে আস্তে ভাইয়া আছে তো। ”
-” তো কী হয়েছে আবার মারবে? ”
প্রশ্নটা করেই রুদ্রর দিকে তাকাল হৈমী। রুদ্রর দৃষ্টিও লুকিং গ্লাসে স্পষ্ট হয়ে থাকা হৈমীর মুখটায়। হৈমী তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেও রুদ্রর ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল। স্টিয়ারিং থাকা হাতদুটো চঞ্চল হলো। গাড়ির স্পিড বাড়ল দ্বিগুণ। রুদ্রর মস্তিষ্কে আচমকা প্রশ্ন ঘুরপাক খেল,
-” হৈমী শাড়ি পরেছে কেন? আর এত সেজেছেই বা কেন? কাল যা ঘটেছে এরপর মনে এত রঙ লাগার কারণ কী। আর এত চ্যাটাং চ্যাটাং কথাই বা শোনাচ্ছে কেন? ”
রুদ্রর মনের কথাগুলো কীভাবে যেন বুঝে গেল হৈমী। সবার মুখে চলতে থাকা বুদ্ধিহীন মেয়েটার বুদ্ধি বোধহয় খুলল। সে আচমকা সূচনাকে বলল। বেশ উচ্চস্বরে,
-” ভাবি জিজ্ঞেস করলে না তো আমি এত সেজেছি কেন? ”
সূচনা হৈমীর বাহু চেপে ধরল। শাসানি সুরে বলল,
-” হৈমী কেন এমন করছ? ”
হৈমী শব্দ করে হেসে ওঠল। অট্টহাসি! রুদ্রর হাতজোড়া কেঁপে ওঠল সে হাসির শব্দ শুনে। সূচনার বুকে কাঁপন ধরল। হৈমী রয়ে সয়ে বলল,
-” পরের উপকার তো অনেক করলাম। ভবিষ্যতেও করব। ভাবছি পাশাপাশি নিজেরও একটা উপকার করি। কী উপকার করব নিজের শুনবে? ”
সূচনা কাঁদো কাঁদো হয়ে ভাইয়ের কঠিন মুখটা দেখে নিল। হৈমীর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো। অর্থাৎ সে শুনবে না। হৈমী খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা লাগল তার। আহ সূচক শব্দ করে রুদ্রর দিকে তাকাল। ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ চ্যুত হয়েও হলো না রুদ্রর। ত্বরিত সামলে নিল নিজেকে।
চলবে…
#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫১
ডক্টর দেখিয়ে একরাশ দুঃশ্চিতা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরল রুদ্র, সূচনা৷ অথচ দুঃশ্চিতার মূলে থাকা মানুষটি নিশ্চিন্তে গিয়ে সোফায় বসল। গুনগুন করে গাইল গান। আঁচল নাচাতে শুরু করল অবিরত। ঠোঁট টিপে হাসছেও সে। তার হাসির কারণটি হচ্ছে, সে যে গাইনিকে দেখিয়েছে তিনি তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করেছে,
-” প্রেগন্যান্ট? ”
হৈমী লাজুক হেসে মাথা নেড়েছে। ডক্টর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলেছে,
-” টাঙ্গাইল জেলায় অল্প বয়সী বিবাহিত মেয়ে, বাচ্চার অভাব নেই। এই ছোটো ছোটো শিশুরা নাকি আরেক শিশুর জন্ম দেবে! ”
রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল ডক্টর মহিলা। পিটপিট করে তাকিয়ে হৈমী জিজ্ঞেস করে বসল,
-” কেন অন্য জেলায় বুঝি আমার বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয় না? ”
হৈমীর প্রশ্নটি পছন্দ হলো না তার। বারতি কথা বলতে আগ্রহও পেল না বোধহয়। ক্ষীণ স্বরে শুধু জবাব দিল,
-” এ বছর গড়ে এ জেলাতেই এই সংখ্যা বেশি। ”
ডক্টরের মুখ, কথা বলার ভঙ্গি মনে করেই পেট চেপে হাসি পাচ্ছে হৈমীর। সে তার সমস্যা গুলো নিয়ে মোটেই বিচলিত নয়। বাচ্চা হওয়ার সময় যদি সে মরে যায় মরবে। শুধু বাচ্চাটা বাঁচলেই হলো। এরপর মরে ভূত হয়ে রুদ্র কেমন সুখী জীবন কাটায় দেখবে! হাসি যেন ধরল না তার মুখে। লম্বা শ্বাস টেনে বিরবির করল,
-” মরে গেলে তো এমনিতেই সব চুকে যাবে। যদি না মরি কীভাবে সব চুকাব? ঐ নিষ্ঠুরটাকে কীভাবে শাস্তি দেব? ওকে যে আমি খুব ভালোবাসি। ”
রক্তে হিমোগ্লোবিন কম হৈমীর। বর্তমানে গর্ভবতী নারীদের এই সমস্যাটি প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মেডিসিন লিখে, কোন কোন খাবার এমতাবস্থায় প্রয়োজন সেসব বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে। রুদ্রকে বারবার করে বলে দেয়া হয়েছে। এখন থেকেই যেন হৈমীর প্রতি যত্ন নেয়া হয়। নয়তো ডেলিভারির সময় বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হবে। সূচনা হৈমীর প্রেসক্রিপশন, রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট চেক করতে করতে হৈমীর পাশে এসে বসল। রুদ্র গম্ভীর মুখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা হৈমীর দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। ঐ হাসিখুশি মুখটা বড্ড অশান্তি দিচ্ছে তাকে। চিন্তায় চিন্তায় রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল আচমকা। আশপাশে তাকিয়ে কাউকে না পেয়ে নিজেই চলে গেল ডাইনিংয়ে। এক গ্লাস পানি পান করে সূচনাকে ডাকল হাঁক ছেড়ে। হাতে থাকা কাগজপত্র পাশে রেখে সূচনা ছুটে গেল ভাইয়ের কাছে। রুদ্র তাকে জিজ্ঞেস করল,
-” পানি খাবি? ”
-” না ঠিক আছি। ”
-” তাহলে এটা ওকে গিয়ে দিবি৷ পিপাসা না লাগলেও খেতে বলবি। কথা না শুনলে ধমক দিবি। এরপরও কাজ না হলে আমাকে ডাকবি। ”
ঢোক গিলল সূচনা। ভাইয়ের দিকে তাকাল গভীর ভাবে। হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিল সন্তর্পণে। কয়েকটি ভারিক্কি কথা শুনিয়ে দিল একনাগাড়ে,
-” এটা ঠিক নয় ভাইয়া। তুমি যা করছ একদম ঠিক নয়। তোমার এই আচরণটা সত্যি ওর জন্য প্রাপ্য নয়৷ তুমি ভুল করছ। ”
রুদ্রর দৃষ্টি কঠিন হতে শুরু করল। চোয়ালদ্বয় ভারিক্কি। সূচনা নিজের অবস্থায় অবিচল থেকে বলল,
-” তোমার আসল ভুল কী জানো? তুমি হৈমীকে ভালোবাসলেও সেটা প্রকাশ করতে পারো না৷ অথচ ওর প্রতি কতটা চটে গেছ সেটা ঠিক প্রকাশ করে দাও। একটা শিশু বাচ্চাকে যদি সব সময় মা, বাবা শাসনে রাখে ঐ বাচ্চাটা কি বাবা, মায়ের ভালোবাসা টের পাবে? পাবে না৷ ভালোবাসা কখন টের পাবে জানো? যখন একবার শাসন করে দ্বিতীয় বার ভালোবেসে কাছে টেনে নেবে। কোনটা ভুল, কোনটা সঠিক বুঝিয়ে দেবে৷ তাছাড়া হৈমী যা করেছে এখানে আমি কোনো ভুল দেখছি না। কারণ ও যা করেছে স্বামীকে ভালোবেসে হারানোর ভয়ে করেছে। একটা মেয়ে তার স্বামীকে কতটা ভালোবাসে তুমি জানো না ভাইয়া৷ সেই ভালোবাসার গভীরতা জানতে হলে তোমাকে আগে বুঝতে হবে তাদের করা ত্যাগ গুলোর কথা। আমাকেই দেখো না মাহেরের জন্য আমি তোমাদের ছেড়ে ওর কাছে থাকি। কেন থাকি? দায়িত্ব আর ভালোবাসা থেকেই তো থাকি তাই না৷ আমার ত্যাগটা দেখে তোমার হৈমীর ত্যাগটা বোঝা উচিৎ। ওর বেলায় আরো বেশি বোঝা উচিৎ। কারণ আমার বিয়েটা পারিবারিক হলেও তোমাদের পারিবারিক বিয়ে ছিল না। ”
নিজের কথাগুলোর শেষ টেনে চলে যাচ্ছিল সূচনা। সহসা ঘাড় ফিরিয়ে ভাইয়ের স্থবির মুখটায় তাকাল। দম ছেড়ে পুনরায় বলল,
-” একটা প্রশ্ন করি ভাইয়া। উত্তরটা পরে দিলেও চলবে। ধরো আজ থেকে সাত, আট মাস পর, হৈমীর ডেলিভারির সময় আল্লাহ না করুক তোমাকে একজনকে বেছে নিতে বলা হলো। যে কোনো একজনের প্রাণ সংশয় থাকল। কী করবে তুমি? কাকে বেছে নেবে? এই উত্তরটা মিলিয়ে তারপর হৈমীর অপরাধ বিবেচনা করবে। আর হ্যাঁ যদি ওর অপরাধের ভারটা এতে কমে প্লিজ তুমি অন্তত ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও। কারণ একটা মেয়ে হিসেবে ওর জায়গায় নিজেকে রাখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মেনে নিতে পারছি না। হৈমী সত্যি খুব বোকা ভাইয়া। আমারো মনে হচ্ছে ওর সহজসরলতার জন্যই কপালে আজ এই দুঃখটা হলো! ”
আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না সূচনা। বোনের প্রতিটি কথাই বুকে গিয়ে বিঁধল রুদ্রর। দম আঁটকে গেল নিমিষেই। কর্ণে বারবার প্রতিধ্বনিত হলো সূচনার বক্তব্য। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কে চাপ পড়ল এটা ভেবে যদি সত্যি কখনো অমন সিচুয়েশন আসে সে কী করবে? দু’হাতে আচমকা কান দু’টো চেপে ধরল সে। ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বলল,
-” নাহ এমন দিন কক্ষণো আসবে না। কিন্তু যদি আসে? ”
এ প্রশ্নে ভয়ে মুষড়ে পড়ল যেন। থমথমে মুখ নিয়ে বেরিয়ে এসে হৈমীর দিকে তাকাল এক পলক৷ এরপর ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি মুখী হয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। রুদ্ধদ্বারে পড়ে রইল ঘন্টার পর ঘন্টা। হঠাৎ করে রুদ্রর এমন অবস্থা দেখে ভয় পেল সকলেই। মনে মনে হৈমীও কম চিন্তায় পড়ল না। শেষে সূচনাকে অনুরোধ করে বলল,
-” ভাবি তুমি গিয়ে উনাকে দরজা খুলতে বলো। উনার সমস্যার কথা তো তুমি জানো? যদি বিপদ ঘটে যায়! ”
হৈমীর মুখে এ কথা শুনে সূচনাও চিন্তায় পড়ল। হৈমীর মাথায় হাত রেখে বলল,
-” তোমার মতো মেয়েকে বউ হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হৈমী। ভাইয়া এই সৌভাগ্যকে পায়ে ঠেলে ঠিক করছে না। ”
হৈমী মাথা নত করে ফেলল। তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। সূচনা আর দেরি না করে চলে গেল রুদ্রকে ডাকতে৷ কিন্তু আর বেশিক্ষণ সবাইকে দুঃশ্চিতায় থাকতে হলো না। রুদ্র দরজা খুলে দিয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। সূচনা ভাইকে খাওয়ার জন্য জোর করল। কিন্তু সে সাফ জানিয়ে দিল, খাবে না৷ সূচনা বিচলিত হলো৷ রুদ্র তাকে শান্ত করতে বলল,
-” খিদে নেই। বেরোবো একটু। টেনশন নিস না আমি ঠিক আছি। ”
________________________
রাত প্রায় দু’টা ছুঁই ছুঁই। আজ রাতেও হৈমী সূচনার সঙ্গে ঘুমিয়েছে। রুদ্র একা। দুপুর পর থেকেই সূচনার কথা গুলো মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছিল রুদ্রর। দুঃশ্চিতা কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছিল না। রাতে খেয়েদেয়ে শুয়েছে। অমনি তলিয়ে গেছে গভীর ঘুমে! ঘুম ভেঙেছে প্রকট এক দুঃস্বপ্ন দেখে। যে বিষয়টা নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় ব্লাড প্রেশার বাড়ছিল। ঠিক সে বিষয়টাই স্বপ্নে এসে ধরা দিল আচমকা। ভীষণ ঝকঝকে চকচকে ভাবে।
আসলে, আমরা মানুষরা খুবই অদ্ভুত প্রকৃতির। কেউ সঠিক পথে চলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ভুল পথ বেছে নিই। কেউ ভুল পথে চলতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে সঠিক পথের সন্ধানে মনে কোনো প্রবৃত্তিও জাগে না। আমাদের মনে রাখা উচিৎ, ভুলের তরে জীবন সঁপে দেয়া মানবজীবনের কর্তব্য নয়। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিকটা গ্রহণ করাই মানবজীবনের প্রকৃত কর্তব্য।
.
হসপিটালের করিডোরে একটি চুক্তিপত্র হাতে বসে আছে রুদ্র। তার সামনে দাঁড়িয়ে হামিদা বেগম, মাহের, সূচনা। তিনজনের দৃষ্টিই অশ্রুসিক্ত। সূচনা ধপ করে তার সামনে বসে পড়ল। হাতজোড় করে মিনতি করল,
-” প্লিজ ভাইয়া তুমি সই করো না। হৈমী বেঁচে থাকলে তোমরা আবার সন্তান নিতে পারবে। ও চলে গেলে ওকে কিন্তু আর ফিরে পাবে না। ”
মাহের সূচনার দিকে কটমট চোখে তাকাল। কর্কশ গলায় বলল,
-” রুদ্র যদি বন্ড সই করে আমি এক্ষুনি এই মুহুর্তে তোমাকে তালাক দিব। যার কাছে আমার বোনের মূল্য নেই। আমার কাছেও তার বোনের মূল্য নেই! ”
মাহেরের উক্ত কথা শুনে সূচনা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। রুদ্রর পা খামচে ধরল। তবুও রুদ্রর মন গলল না। সকলকে কাঁদিয়ে সে বন্ড সই করল। তার বাচ্চা চাই। হৈমী যদি মারা যায় এর দায়ভার কারো নয়। মা বা বাচ্চার মধ্যে সে তার বাচ্চাকেই বেছে নিল। এর আধঘন্টা পর ফুটফুটে নবজাতক কোলে নার্স এগিয়ে গেল। হামিদা, মাহের, সূচনা কেউ এগুলো না। রুদ্র সকলের দিকে তাকিয়ে বিচলিত ভঙ্গিতে গিয়ে নবজাতককে আগলে ধরলে। বুকে চেপে ধরে নিঃশব্দে নিশ্বাস ফেলে বিরবির করল,
-” আমার সন্তান, আমার অংশ। ”
পর মুহুর্তেই সূচনার গগনবিদারী চিৎকার শুনতে পেল। সেই চিৎকারে নবজাতকেরও গলা ফাটানো কান্না তিব্রতর হলো। সহসা কেঁপে ওঠল রুদ্র। সূচনার বিধ্বস্ত মুখ ভেসে ওঠল চোখের সামনে। রুদ্র নিজের মুখে তৃপ্তিভরে হেসে নবজাতককে এগিয়ে ধরল সূচনার দিকে। সূচনা দু পা পিছিয়ে গেল আচমকা। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” মাহের আমাকে তালাক দিয়েছে ভাইয়া। অফিশিয়ালি নটিশও পাঠাবে। ”
থমকানো স্বরে রুদ্র প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-” কিন্তু কেন! ”
সূচনা কাঁপা হাতের তর্জনী উঁচিয়ে দেখাল সম্মুখের দিকে। একটি সিঙ্গেল বেডে সাদা কাপড়ে মোড়ানো হৈমী। শুধু মুখের ওপরের কাপড়টাই উন্মুক্ত। সহসা এহেন দৃশ্য দেখে রূহ কেঁপে ওঠল রুদ্রর। হাত, পা হয়ে গেল অবশ। ভুলে গেল কোলে থাকা নবজাতকের কথা। আচমকা ছেড়ে দিল নবজাতককে ধরে রাখা দু-হাত। সূচনা কানের কাছে এসে বীভৎস এক চিৎকার করে বলল,
-” এ কী করলে ভাইয়া। শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তানকেও মে’রে ফেললে! ”
আচম্বিতে রুদ্রর দৃষ্টি নামল। সাদা টাইলসে তাজা র’ক্তের বন্যা বইছে। কারণ সদ্য জন্মানো নিষ্পাপ শিশুটির মৃত্যু ঘটেছে। তারই ভুলে!
.
দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল আচমকা। সর্বাঙ্গ মৃদু মৃদু কাঁপছে রুদ্রর। বুক শুঁকিয়ে চৈত্রের খরাতে রূপান্তরিত। শরীর ঘেমে জবজব। বড্ড অস্থির লাগছে। হাতড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালালো সে। জগে এক ফোঁটা পানিও নেই। থাকবে কী করে হৈমী তো এ ঘরে নেই। সে থাকলে নিশ্চয়ই সবটা গুছিয়ে মনে করে জগ ভর্তি পানি রাখত। দুঃস্বপ্ন, সাদা কাপড়ে হৈমীর পবিত্র মুখশ্রী বুকের ভিতরটা শূন্য করে দিল তার। টনটনে অনুভূতি হলো প্রগাঢ়ভাবে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কোনো রকম ভারি শরীরটা দাঁড় করালো। হাঁটতে গিয়ে ভারসাম্য হারাতে চাইল কয়েকবার। তবুও সাবধানে নিচে গেল। পিপাসা মিটিয়ে মনের ব্যথা কমাতে চলে গেল সূচনার ঘরের সামনে। ভেড়ানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ল সে। বিনা অনুমতিতে। ড্রিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেল হৈমীর ঘুমন্ত সুশ্রী মুখাবয়ব। অস্থির বুকটা ধীরেধীরে শান্ত হতে শুরু করল। দৃঢ় পায়ে গিয়ে বসল হৈমীর পাশে। হাত বাড়িয়ে নাকের কাছে আঙুল ঠেকাল। শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকঠাক আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হৈমী ঘুমে তাই নির্বিঘ্নে চুমু খেল কপালে, দুই গালে। ফিরে আসার মুহুর্তে থমকে বসল পুনরায়। উষ্ণ হাতটা স্পর্শ করল, হৈমীর গলায়। চোখ বুঁজে হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। সূচনার দিকে তাকিয়ে সহজ গলায় উচ্চারণ করল,
-” তোর প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি সূচনা। কিন্তু উত্তরটা তোকে আমি দিব না। কাউকেই দিব না। কারণ এতে আমি অপরাধী হয়ে যাব। ভয়ংকর অপরাধী। তুই নিশ্চয়ই জানিস, অপরাধীদের সঙ্গে কেউ সংসার করতে চায় না। অপরাধীদের কেউ ভালোবাসে না। ”
চলবে…