বেসামাল প্রেম পর্ব-৫৪+৫৫

0
122

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৪

দুপুরবেলা। লাঞ্চ শেষে রুমে এলো রুদ্র। হৈমী দাদিনের ঘরে। আমের আচার খাচ্ছে। এই সুযোগে সে সিগারেট ধরাল। রুমে নয় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। বেলকনির দরজা আঁটকে দিয়েছে। জানালার গ্লাসও লাগানো। ধোঁয়া রুমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আগে এসব মানতে হতো না। এখন মানতে হচ্ছে। শুধু হৈমীর জন্য বললে বিষয়টা মিথ্যে হবে। বরং তাদের দুজনের জন্যই মানছে। দু’জনের জন্য কীভাবে? হৈমীর গর্ভে যে ছোট্ট প্রাণটা আছে। গতমাসে যার হার্টবিট এসেছে বলে ডক্টর নিশ্চিত করলেন। সেই ছোট্ট প্রাণটার সঙ্গে তারা দু’জনই জড়িত৷ একজন তাকে পৃথিবীতে আনার জন্য যুদ্ধ করছে। আরেকজন এ পৃথিবীতে তাকে টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে। স্বপ্ন বুনে চলেছে রাতের পর রাত। দিনের পর দিন। বলা চলে সময়টা বেশ ভালো। এ সময়ে সুখী সুখী একটা ব্যাপার আছে। মাঝেমধ্যে তীব্র ভয়ে অবশ্য বুকে কাঁপুনি ধরে। প্রিয়জন হারানোর ভয়ে টনটন করে ওঠে বুকের বা’পাশটায়। সে টনটনে ব্যথা নিয়ে সে যখন নির্লিপ্ত হয়ে যায়। দুর্বল চোখে তাকিয়ে মলিন হাসি উপহার দেয় হৈমী। কিছুটা খোঁচা দিয়েই বলে,

-” খুব ভয় পাচ্ছেন? আপনাকে তো ভয় পেলে মানায় না। আপনার এই অসহায় মুখটা দেখতে ভালো লাগে না। একটু গম্ভীর হয়ে ভয়কে ধমকে দিন। ”

এ কথা শুনে রুদ্র মুখ ফিরিয়ে নিলে সে কানের কাছে এসে ফিসফিসে বলে,

-” যত হম্বিতম্বি সব আমার সাথেই। কোথায় গেল সেই গম্ভীরতা, তিরিক্ষি মেজাজ? ”

মানুষের সময় সব সময় সমান যায় না। রুদ্ররও যাচ্ছে না। বিগড়ানো মেজাজটাও ইদানীং শান্ত হয়েছে। বেঁচে থাকার একটিমাত্র অবলম্বনকেও হারানোর ভয় বুকে বাসা বাঁধলে দিশেহারা লাগবে না বুঝি? জন্মলগ্ন থেকেই বোধহয় লেখা ছিল জীবনের পরতে পরতে সে মানসিক অশান্তিতে থাকবে। সুখ থাকবে চিরকাল ধোঁয়াশাতেই। এরই মধ্যে দাদিন তাকে অসাধারণ এক অশান্তি উপহার দিয়েছে। দু’দিন আগে তিনি পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলাকে দিয়ে দু’ভরি সোনার গয়না বিক্রি করেছেন। যার বর্তমান বাজারমূল্য এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা। এই টাকা দাদিন তার বড়ো ছেলের ঠিকানায় পাঠিয়েছে গতকাল। টাটকা খবরটি যার মাধ্যমে পাঠিয়েছে সেই জানিয়েছে রুদ্রকে। যে মানুষ দু’টো স্বার্থপরের মতো নিজেদের সুখের আশায় পুরো পরিবারকে অন্ধকারে ঠেলে গিয়েছিল। তাদের সুখ কি এতটাই ঠুনকো হয়ে গেছে আজ? চোরের মতো করে মায়ের কাছে হাত পাতছে। বৃদ্ধা মহিলাটির শেষ অবলম্বন টুকু কেড়ে নিতেও কুণ্ঠা বোধ করছে না। ঘৃণার মুখ বিকৃত হলো রুদ্রর। স্মরণ হলো ছোটো ভাইয়ের বউকে নিয়ে যে ভেগে যেতে পারে তার আবার কুণ্ঠা কিসের? ঐ দু’জন তো মানুষই নয় অমানুষ। কিন্তু দাদিন? সে কী করে এতটা বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়ে গেল? মাতৃস্নেহে? স্নেহ করা ভুল নয় কিন্তু স্নেহে অন্ধত্ব অপরাধ। ক্রোধে কপালের রগগুলো দপদপিয়ে ওঠল। নিঃশ্বাস ভারি হলো খুব। উত্তেজনা কমাতে সিগারেটে টান দিল একাধারে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল,

-” দরজা খুলুন, দরজা খুলন। ”

দরজায় টোকা দিয়ে জানালার কাছে গেল হৈমী। কাঁচ ভেদ করে রুদ্রর কাণ্ডগুলো স্পষ্টই দেখল সে। মজা পেল খুব। হৈমীর উপস্থিতি টের পেতেই রুদ্র ত্বরিত সিগারেট ফেলে দিল। চারপাশের ধোঁয়া হাত দিয়ে রেলিঙের বাইরে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল৷ হা করে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছাড়ল। যেন সিগারেটের গন্ধ বেরিয়ে যায়৷ হৈমী যেন এই গন্ধ একটুও না পায় তাই বারেবারে হা করে নিশ্বাস ছাড়ল। হৈমী অধৈর্য্য হয়ে দরজায় টোকা দিল। রুদ্র শান্ত হতে বলে আরো কয়েক পল পর দরজা খুলল। হৈমী উৎসুক হয়ে বেলকনিতে যেতে নিলে রুদ্র ওর হাত চেপে ধরল৷ দরজা বন্ধ করে রুমে টেনে এনে বলল,

-” আচার খাওয়া শেষ। ”

হৈমী মাথা নাড়িয়ে তার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। রুদ্র মৃদু হেসে বিছানায় বসল। হৈমীর ফুলে ওঠা পেটের দিকে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। তা লক্ষ করে এক পা এগোলো হৈমী। বলল,

-” চুমু খান। ”

হকচকিয়ে গেল রুদ্র। মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। পরোক্ষণেই মনে পড়ল পেটে চুমু খেলে সমস্যা নেই। মুখের গন্ধ বেবি পর্যন্ত পৌঁছাবে না। তাই স্বাচ্ছন্দ্যে পেটে চুমু খেল। খুশিতে গদগদ হলো হৈমী। মোটামুটি শরীরটা তার ভারি৷ স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়াতে চেহেরায় নাদুসনুদুস ভাব এসেছে। পাঁচ মাস পড়েছে। আরো কটা মাস গেলে পেট ভারি হলে ওজন ষাট প্লাস হবেই। সেই ফিনফিনে শরীর আর আজকের এই নাদুসনুদুস শরীর ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। এই শরীর নিয়েই রুদ্রর কোলে চড়ে বসল সে৷ আচমকা বসাতে সামলাতে বেগ পেল রুদ্র। হঠাৎ এভাবে কাছে আসায় ঘাবড়ালোও। টের পেল কুমতলব আছে নিশ্চিত। তার ধারণাই সঠিক হলো। হৈমী মুখ এগিয়ে আবদার করে বসল,

-” কিস মি প্লিজ। ”

চমকে ওঠল রুদ্র। হৈমী এ অবস্থায় না থাকলে বিষয়টা এখন অন্যরকম হতো। কুমতলব সুমতলব করে মেয়েটাকে নাজেহাল করে ছাড়ত। কিন্তু সময়টা এমন যে নাজেহাল শুধু তাকেই হতে হবে। অসহায় মুখ করল রুদ্র। অপরাধীর ন্যায় বলল,

-” সরে বসো। ব্রাশ করে আসি। ”

-” না না এক্ষুনি আমার চুমু চাই। ”

-” বোঝার চেষ্টা করো হৈমী। আমি সিগারেট খেয়েছি সমস্যা হবে। ”

মৃদু ধমকে টনক নড়েনি হৈমীর। সে বাচ্চাদের মতো জেদ করল,

-” আমারো সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। ”

চোখ রাঙাল রুদ্র। হৈমী পাত্তা না দিয়ে টোপ করে ওর ঠোঁটে চুমু খেল। রুদ্র ঝটকায় মুখ সরিয়ে কৌশলে হৈমীকে বিছানায় শুইয়ে দিল। হৈমী বাহু চেপে ধরল ওর। রুদ্র হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,

-” জ্বালাচ্ছ কেন? ”

-” আমি না সিগারেট জ্বালাচ্ছে আপনার ফুসফুস। ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র বলল,

-” রেগুলার খাই না এখন৷ হঠাৎ… ”

-” জানি। ”

-” তাহলে পাগলামি করছ কেন? ”

-” এটুকু বাদ দিন। ”

-” দেব শর্ত আছে মানবে? ”

সহসা ক্ষেপে ওঠল হৈমী। বলল,

-” সবকিছু তে শর্ত শর্ত আর শর্ত। আর কত শর্ত দেবেন। ভালো লাগে না এসব। ”

পাশফিরে শুয়ে রইল হৈমী। শ্বাস ফেলল ঘনঘন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠে গেল রুদ্র। ব্রাশ করে এসে রুমের দরজা রুদ্ধ করে বিছানায় এলো৷ হৈমীর পাশে শুয়ে হাত বাড়িয়ে পেটে স্পর্শ করল৷ কয়েক পল যেতেই হাতটা কেঁপে ওঠল। সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রর শরীরও কাঁপল। উত্তেজনায় শ্বাস আঁটকে এলো৷। এরপর সে আতঙ্কিত গলায় বলল,

-” অ্যাঁই অ্যাঁই ও নড়ছে! এইতো এইতো! ”

চিৎকার করে ওঠল রুদ্র। হৈমী ভয় পেয়ে গেল রুদ্রর উত্তেজনা দেখে। রুদ্র প্রায় লাফিয়ে ওপাশে চলে গেল। হৈমীর মুখের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে পেটে তাকাল। গতকাল ঠিক একই উত্তেজনা নিয়ে হৈমী কল করেছিল তাকে৷ রাতে খাওয়ার পর রুদ্র একঘন্টার জন্য বাইরে বেরিয়েছিল। হৈমী আরাম করছিল রুমে বসে। এমন সময় পেটের ভিতর অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা চলছিল। ভয়, উত্তেজনা নিয়ে রুদ্রকে ফোন করে আনার পর সব শান্ত। রুদ্র কিছুতেই তার কথা বিশ্বাস করল না। শেষে মন খারাপ করে সেও বিশ্বাস করাতে যায়নি। ভাগ্যিস মাঝেমধ্যে পেটে হাত রাখার অভ্যেস রুদ্রর। তাই তো ম্যাজিকটা ঘটে গেল। পেটের ভিতর বাচ্চার নড়াচড়া চলল অনেকক্ষণ। রুদ্রর হাতের স্পর্শ পেয়ে যেন ওখানে থাকা প্রাণটা প্রচণ্ড খুশি হয়েছে। বেশি নড়াচড়া করে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। হৈমীর চোখ দিয়ে জল গড়াল। খেয়াল করল রুদ্র কেমন বাচ্চাদের মতো তার পেটের সঙ্গে খেলা করছে। হাত বুলাচ্ছে সস্নেহে। কয়েক পল রুদ্রর ঝাপসা দৃষ্টি, ঠোঁটে মৃদু হাসিরও দেখা মিলল। তৃপ্তির শ্বাস ফেলল হৈমী। চোখ বুজল আরামে। মিনিট দুয়েক পর অজান্তেই ঘুমিয়েও পড়ল। রুদ্র শান্ত, অপলকে তাকিয়ে আছে ফুলে থাকা নগ্ন চামড়াটার দিকে। যে চামড়া আজ থেকে পাঁচ মাস আগেও তাকে কামুক করে তুলত। সে চামড়ায় এ মুহুর্তে কোনো কামুকতা নেই। আছে শুধু প্রতীক্ষা, স্নেহ, আদর, ভালোবাসা।
_____________________
মাঝরাতে ওঠে একবার খায় হৈমী। আজো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। রুদ্র ওকে খাইয়ে নিচে এসেছিল সবকিছু রাখতে। তখনি দাদিনের ঘর থেকে কান্নার শব্দ পেল। আজ যেন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল তার। বড়ো বড়ো পা ফেলে বিনা অনুমতিতে আধখোলা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল সে। তার উপস্থিতি দেখে আঁতকে ওঠল দাদিন। ত্বরিত ফোন কেটে দিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,

-” তুই! ”

-” কেন খুব অসুবিধায় ফেললাম? কী চায় তোমার বড়ো ছেলে আর তার বউ। গত সপ্তাহে গয়না বিক্রির দেড় লক্ষ টাকা পাঠালে। সব শেষ, আরো চাই? এবার কী দেবে এ বাড়িটা বিক্রি করবে? দাদানের নামে বাড়ি তুমি চাইলে বিক্রি করতেই পারো। ”

-” রুদ্র! ”

-” একদম ধমকাবে না দাদিন। তোমার প্রতিও ধীরেধীরে আমার মনে ঘৃণা জন্মাচ্ছে। ছিঃ তুমি কেমন মা? রিদওয়ান শেখ কি তোমার নিজের সন্তান? আমার তো মনে হয় না। তাই যদি হতো তার জীবন ধ্বংসের জন্য যে দায়ী তাকে নিজের সর্বস্ব দিতে না। ”

মুখে আঁচল চেপে ডুকরে উঠলো দাদিন। রুদ্র মুখ ঘুরিয়ে নিল। দাদিন বলল,

-” আমাকে ভুল বুঝিস না রুদ্র। ওরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছে। ওর চাকরিটা নেই আজ দু’বছর। বউ বাচ্চা নিয়ে পথে থাকতে হতো আমি টাকা না পাঠালে। ”

-” এবার কী করবে? ঐ টাকা শেষ হলে কী দেবে আর কী আছে তোমার? ”

-” রুদ্র, আমি তো মা। আমি জানি দিলু অন্যায় করেছে। কিন্তু মা হয়ে সন্তানের মৃত্যু তো চাইতে পারি না। ”

খুব কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছিল রুদ্র। দাদিন হঠাৎ বলে ফেলল,

-” অনেক বছর তো হলো। পুরোনো কথা ধরে রেখে কী লাভ। যা ভুল তা তো করেই ফেলেছে। তাই বলে সারাজীবন কি বাপের ভিটে ছাড়া থাকবে? ”

দু-হাত শক্ত মুঠ করে ফেলল রুদ্র। বলল,

-” বাহ চমৎকার। তোমার বড়ো ছেলে মেজো ছেলের বউ নিয়ে ভেগে সংসার পাতলো। সে ঘরে বাচ্চা সহ এবার এ বাড়িতে ফিরে আসবে। আর মেজো ছেলে দেখবে তার প্রাক্তন স্ত্রী তার বড়ো ভাইয়ের ঘর করছে। আর বড়ো চাচি যে এখনো তোমার বড়ো ছেলের বউ হিসেবে এ বাড়িতে আছে। তার কথাটাও তুমি ভাবলে না। এতটা স্বার্থপর তুমি হয়ে গেলে? কীভাবে সম্ভব দাদিন। কীভাবে সম্ভব এই বাড়িতে ওদের আসা? তুমি এতটা নিচু মনের কী করে হয়ে গেলে। ”

দাদিন বসে পড়ল। হাউমাউ করে কেঁদে বলল,

-” ওরা তাহলে থাকবে কোথায়? রিদুকে বলবি, ঢাকার একটা বাড়ি ওদের দিতে? ”

তাচ্ছিল্য হেসে রুদ্র বলল,

-” অসম্ভব। আমার মতো নির্দয় মানুষকে এমন আবদার করা মোটেই উচিৎ হয়নি তোমার। ”

রুদ্র ফিরে যেতে নিয়েও থামল। দাদিনের দিকে তাকিয়ে রুঢ় স্বরে বলল,

-” তোমার বড়ো ছেলে সম্পর্কে আমার চাচা আর তার বউ আমার জন্মদাত্রী! তোমার মেজ ছেলে আমার বাবা অথচ আমার মা তার বড়ো ভাইয়ের বউ! গা ঘিনঘিন করে না দাদিন এসব শুনতে? জানো আমার ভাবতেই মরে যেতে ইচ্ছে করে! এরপরও যদি তুমি এই ঘৃণ্য, জটিল সম্পর্কের মানুষদের এক বাড়িতে আনার দুঃসাহস দেখাও মনে রেখো, বাবা, আমি, বড়ো চাচি, রাদিফ ভাই সকলের সঙ্গে সম্পর্কের সুতো কাটতে হবে তোমাকে। ”

শেষ বাক্যগুলো বড্ড অসহায়ের মতো আওড়াল রুদ্র। এরপর প্রস্থান করল দাদিনের ঘর। বলা চলে আজীবনের জন্য। ছোটোবেলা থেকে যে মানুষটা তাকে আগলে বড়ো করল সেই মানুষটার ভুল আবদার এক নিমিষে সব তছনছ করে দিল। নিশ্চিত করে দিল শেষ ভবিতব্য।

চলবে….

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৫

প্রায়শ্চিত্ত মানে চিত্তের বিশুদ্ধতাসাধন। এই বোধ জাগ্রত হওয়ার পর আর কখনো কষ্ট পাননি সুরভি বেগম। তবে বুকের গহীনে আফসোস রয়েছে। গর্হিত সেই পাপটির জন্য। যেই আফসোস আমৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সেলাই মেশিনে ছিঁড়ে যাওয়া মেকসির হাতা সেলাই করে চুপচাপ বসে সুরভি বেগম। আজকাল অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে সে। একটু সেলাই করেই হাঁপিয়ে গেছে। ইদানীং বেশ বুঝতে পারে, বয়স বাড়ছে। চমকে ওঠল সুরভি। বয়স? কত বয়স তার? এক মুহুর্ত শ্বাস আঁটকে গেল যেন। যৌবনের শুরুতেই বিয়ে হয়েছিল তার। রুদ্রর বাবার সঙ্গে। সদ্য আঠারোতে পা পড়েছে। তরতাজা ফুলটাকে নিজের ঘরে তুলেছিল সুস্বাস্থ্যের প্রাপ্তবয়স্ক যুবকটি। কত প্রেম, কত স্নেহ, কত সুখ। আহা,সেই রঙিন দিনগুলো স্মরণে আসা মাত্রই বুক ভার হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিসেব কষল তার বর্তমান বয়স কত? ঊনিশের মাঝামাঝিতে রুদ্রর জন্ম। চব্বিশে সূচনার। দুই সন্তানের পরিপূর্ণ সংসার ছিল তার। আহা! একেই বোধহয় বলে, মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না। পাপে ধরেছিল তাকে। একেবারে নিঃস্ব করেই ছাড়ল। ছাব্বিশ বছর বয়সে যৌবনের উত্তাপে বুকের ভেতর যে খরা নেমেছিল। সেই খরায় আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দিলওয়ার শেখ। শুরুতে সে সায় দেয়নি। ভয় পেতো। কিন্তু ধীরেধীরে মনের ভিতর শয়তান বাসা বাঁধল। সেই একটি রাত সবকিছু ওলটপালট করে দিল। সেদিন কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল না? কেন আচমকা সেই স্পর্শের বিনিময়ে কষিয়ে এক থাপ্পড় লাগালো না ভাসুরের গালে? তাহলেই তো আজ সব অন্যরকম হতো। দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠল সুরভি। বয়স আজ ছেচল্লিশে এসে ঠেকেছে। কিন্তু কাঁধে থাকা পাপটা এত ভারি যে তার ভারে বয়স পঞ্চাশের অধিক মনে হয়। পাপ করা সহজ কিন্তু
পাপের বোঝা বহন করা বড়ো কঠিন।

সেদিন, ফাঁকা বাড়িতে দুই সন্তান নিয়ে একা ছিল সে। ঝড়বৃষ্টির রাত। রুদ্র, আর সূচনাকে ঘুম পাড়িয়েছে মাত্র। এমন সময় বাড়ির সদর দরজায় টোকা পড়ে। সে গিয়ে দরজা খুললে দিলওয়ারের ভিজে চুপেচুপে বলিষ্ঠ শরীরটা নজরে আসে। মাথায় কাপড় তুলে সরে দাঁড়ায় সে। পূর্বে তার থেকে অনৈতিক আহ্বান পেয়েছিল। বিধায় সে মুহুর্তে তীব্র অস্বস্তিতে পড়ল। দিলওয়ার স্বাভাবিক চিত্তে ভেতরে ঢুকে। বলে,

-” খাবার গরম করতে পারবে? খুব খিদে পেয়েছে। ”

বাঙালি ভীতু নারী সে। অধিক লজ্জাবতীও। তাই সে মুহুর্তে মাথা নুইয়ে খাবার গরম করে দিল। দিলওয়ার তৃপ্তি ভরে খেল। সুরভি সব গুছিয়ে বেসিনে হাত ধুতে গেলে আচমকা তার পেছনে এসে দাঁড়ায় দিলওয়ার। আঁচল সরে যাওয়া ন’গ্ন কোমরটা স্পর্শ করে আবেগঘন হয়ে। সুরভির মস্তিষ্ক তখন দিশেহারা। ফাঁকা বাড়ি। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ। প্রকৃতি শীতল। হৃদয়ে উত্তাপ। সবমিলিয়ে শয়তানের প্ররোচনায় ক্রমশ তারা লিপ্ত হতে থাকে অবৈধ স্পর্শে। সেই স্পর্শ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় শেখ বাড়ির দোতলার তৃতীয় ঘরটায়। যতক্ষণে জগতে হুঁশ ফেরে ততক্ষণে তার শরীরটাকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে ফেলেছে দিলওয়ার। আর পিছু হটার সুযোগ নেই। একবার পিছুপা হয়েছিলও। সন্তানদের কথা ভেবে। কিন্তু সেই সময় দিলওয়ারের প্রেম তাকে বাঁধ্য করেছিল সব ছেড়ে এক তাকেই আঁকড়ে ধরতে।
যে স্পর্শ শুরুতে তাকে ভয়, লজ্জা দিয়েছিল। সেই স্পর্শই সেদিনের পর থেকে তাকে আনন্দ দিতে লাগল। মন, শরীর এতটাই পাপে জর্জরিত হলো যে। দু’জন মিলে দু’টো সংসার ধ্বংস করে চলে এলো। শুধু কি দু’টো সংসার? সে কি নিজেকে ধ্বংস করেনি? আজ তার জীবন তার ছেলের জীবন অনিশ্চিত। এর দায় কার? তারই তো। সে মা হারা করেছিল রুদ্র, সূচনাকে। বাবা হারা করেছিল রাদিফ, সাদমানকে। পুরষ্কার সরূপ কী পেয়েছে? এই তো জীবন। একাকী, নিঃসঙ্গতা।

দরজায় করাঘাত হতেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল সুরভি। দরজা খুলতেই রিমনের ক্লান্ত মুখের দেখা মিলল। সুরভি ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে দিল তাকে। রিমন সেটা খেয়ে মায়ের হাতে চারহাজার টাকা গুঁজে দিল। বলল,

-” টিউশনির টাকা। কালকে আরো দুহাজার পাবো। ঘর ভাড়াটা আজ দিয়ে দাও মা। ”

-” গোসল করে আয় ভাত বাড়ছি। ”

শার্ট খুলতে খুলতে রিমন বলল,

-” কী রেঁধেছ? ”

-” ছোটো মাছ চর্চরী। ”

-” কাল মাংস আনব। ”

মৃদু হেসে সুরভি বলল,

-” আনিস। ”

রিমন গোসলে চলে গেল। সুরভি নিজেকে শক্ত করে নিয়ে ভাত বাড়তে লাগল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ছেলেটা একসময় মাংস ছাড়া ভাত খেতো না। বাবা ছাড়া এক মুহুর্ত ভাবতে পারতো না। অথচ আজ? সবকিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। মাসান্তর একবার মাংস খেতে পারে। বাবা ছাড়া কাটিয়ে দিল দু’টো বছর। মানুষটা কি নিষ্ঠুর! মুহুর্তেই চমকাল। যে প্রথম দু’টো সন্তান ছেড়ে তার হাত ধরতে পারে সে অবশ্যই তৃতীয় সন্তান ছেড়েও অন্য কারো হাত ধরার ক্ষমতা রাখে? একেই বোধহয় বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। সে রিদওয়ানকে নিঃসঙ্গ করে এসেছিল। আজ নিজেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে। রিদওয়ানের পরিস্থিতি তার মতো শোচনীয় নয়। বরং সে পরিবার নিয়ে সুখেই আছে। শুনেছে রুদ্রর বউ গর্ভবতী। ক’দিন পর নিশ্চয়ই পরিবারে সুখের ঢেউ খেলবে? বড়ো ছেলের কথা মনে হতেই মেয়েটাকে মনে পড়ে গেল। বুক ভার হলো আবারো। সে কী জঘন্য। সময়ের বেড়াজালে না আটকালে কখনোই টের পেত না। রিদওয়ান তাকে ছাড় দিলেও সৃষ্টিকর্তা এক চুলও ছাড় দেননি।
__________________________
মাঝরাত। হৈমীর পেটের দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্র। ঘুমন্ত হৈমী যেন জেগে না যায় তাই খুব সাবধানে মেকসি উপরে তুলল। আলগা করল পেট। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে জায়গাটা। রুদ্র ভয় ভয়ে তাকিয়ে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। এই অল্প জায়গাতে দু’দুটো বাচ্চা আছে। তার এমন ছোটো বউ। ছোট্ট একটা পেট। সেখানে কিনা দু’টো বাচ্চা! নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। সেই দুপুর থেকে বড্ড পাগলামি করছে রুদ্র। হৈমীর ভেতরের পাগলাটে সত্তা আজ যেন নিজের মাঝে ধারণ করেছে সে। হাত বাড়িয়ে পেটে স্পর্শ করল রুদ্র। সারাদিন ঠিকভাবে দেখতে পারেনি। আদর করতে পারেনি। সূচনা, মাহের, হামিদা সকলেই এসেছিল। আলট্রা করার পর সবাই হসপিটাল থেকে বাড়ি এলো। কত হৈচৈ করল। তাকে কেউ সুযোগ দেয়নি। আর যখন সুযোগ পেয়েছে নিজের ভারিক্কি খোলসটা খুলতে পারেনি। হৈমী ঘুমানোর পর সেই খোলস উন্মুক্ত হয়েছে। মন ভরে আদর করল রুদ্র। ভাবল কত কী। এরপর ঠোঁট এগিয়ে চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে দিল উঁচু হওয়া পেটটা। হৈমী নড়েচড়ে ওঠল। সে কিঞ্চিৎ দমে আবারো চুমু খেল। এক, দুই, তিন কত হলো? একশো হয়েছে কি? হতেও পারে। একশো চুমুতে সিক্ত করে তুলল। সহসা হৈমীর পেটের ভিতর নড়াচড়া শুরু হলো। রুদ্র চমকে ওঠল। বেবি রেসপন্স করছে তাকে! ঘুম ছুটে গেল হৈমীর৷ হাত চলে গেল পেটে। বাবুরা বেশি নড়াচড়া করছে। আশপাশে তাকিতুকি করতেই দেখল রুদ্র তার পেটের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। কয়েক পল পর যেখানটায় বাবু নড়ল ওখানটায় হাত রাখল রুদ্র। হৈমী বলল,

-” উহ এত নড়ছে ওরা। ”

হৈমীর কণ্ঠ শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ল রুদ্র। বিস্মিত স্বরে বলল,

-” অ্যাঁই হৈমী, আমি ওদের ছুঁতে পাচ্ছি। ওরা আমাকে ছুঁতে সাহায্য করছে। ওয়েট তোমাকে ছবি তুলে দেখাচ্ছি। ”

রুদ্র ঝটপট কয়েকটা ছবি ওঠিয়ে ফোনটা হৈমীকে দিল। হৈমী যা দেখল তাতে ওর শরীর শিউরে ওঠল। নাভির কিঞ্চিৎ নিচে পেটের দু’পাশে উঁচু হয়ে আছে। বাবুরা কি হাত বা পা দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করছে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মুখে বলে ফেলল। রুদ্র উন্মাদের মতো মাথা নাড়াল। বাচ্চাদের মতো বলল,

-” ওরা এখানে আর থাকতে চাইছে না। আমার কাছে আসতে চাচ্ছে। আমার বুকে ঘুমাতে চাইছে। ”

মিটিমিটি হাসল হৈমী। আরাম করে শুয়ে বলল,

-” হ্যাঁ আপনার বুকেই তো ঘুমাতে হবে। ওরা এলেই তো আমার ছুটি। ”

সহসা চমকে ওঠল রুদ্র। বলল,

-” ছুটি মানে? ”

খিলখিল করে হাসল হৈমী। বলল,

-” বারে, নিজের কথা নিজেই ভুলে গেছেন? ”

মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেল রুদ্র। ধীরেধীরে পাশে শুইয়ে পড়ল। শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এক মুহুর্ত কী যেন ভাবল। এরপর হৈমীকে টেনে নিজের মুখোমুখি করল। বলল,

-” তুমি ছাড়া ওদের ভাবতে পারি না আমি। ”

ভেঙচি কাটল হৈমী। বলল,

-” সব জানা আছে আমার। সময় বুঝে গিরগিটি হওয়ার ওস্তাদ আপনি। ”

আচমকা হৈমীকে জড়িয়ে ধরল রুদ্র। পুরুষরা তো হাউমাউ করে কাঁদে না। পুরুষ কাঁদে নিঃশব্দে। রুদ্র কি কাঁদল? আলগোছে রুদ্রর মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল হৈমী। ফিসফিস করে বলল,

-” যারা নিজের ভুল বুঝে মাথা নত করে, ভুল স্বীকার করে তাদের ক্ষমা করা মহৎ গুণ৷ কিন্তু যারা ভুল বুঝে ইগো দেখিয়ে গুমরে মরে ওদের কী করা উচিৎ জানেন? ”

রুদ্র মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে জানে না। হৈমী চোখ কটমটিয়ে বলল,

-” আচ্ছা জানাচ্ছি। ”

বলেই রুদ্রর ঝুঁটিতে শক্ত করে চেপে ধরল। মাথাটা বুকের ওপর থেকে সরালো ওভাবেই। কিঞ্চিৎ ব্যথায় রুদ্র বলল,

-” আহ, কী হচ্ছে টা কী? ”

-” কিছু হয়নি এবার হবে। ”

কথা বলেই সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রর বুকের বা’পাশে শক্ত এক কামড় বসালো। দাঁত ডাবিয়ে! ব্যথায় উহু, আহ করল রুদ্র। ইচ্ছে করলেই পারত এক ঝটকায় সরিয়ে দিতে। কিন্তু সরালো না। হৈমী নিজের মতো ওকে শাস্তি দিল। রক্ত বেরোতেই আচমকা সরে গেল। সে। রুদ্রর চোখের কার্ণিশে এক ফোঁটা অশ্রু। হৈমী নিঃশব্দে সরে গেল। পাশফিরে ভারি নিঃশ্বাস ফেলল চোখ বন্ধ করে। রুদ্র রক্তে লাল বুকের বা’পাশটায় তাকিয়ে এক হাত চেপে ধরল। নিঃশব্দে হৈমীর গা ঘেঁষে চিবুক ছোঁয়াল কাঁধে। বলল,

-” কাঁদছ কেন? আমিত বকিনি। কামড়েছ বেশ করেছ। ইট’স গুড। ”

হৈমী কথা বলল না। বুকে ভার হয়ে ওঠেছে তার। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। সে তো সত্যিই ছাড়তে পারবে না এই মানুষটাকে। এই মানুষটাও কি পারবে? সেই প্রমাণ তো এখনো পায়নি। তবে পাবে নিশ্চিত।
________________________
ভরদুপুরে দাদিন খবর পেল তার বড়ো ছেলে দু’বছর আগে তৃতীয় বিয়ে করেছে। খবরটি টেলিফোনে ফোন করে দিল তার বড়ো বোন। বড়ো বোনের ছেলের বউ যে হাসপাতালের নার্স হিসেবে যুক্ত। সেই হাসপাতালে দিলওয়ারের তৃতীয় বউ কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। তরতাজা এ খবরটি পেয়ে দাদিন আঁচ করল, এতদিন দিলওয়ার তাকে মিথ্যা কথা বলে টাকা নিয়েছে। সে আসলে সুরভি বা ছেলে রিমনের জন্য নয়। তৃতীয় বউ, তৃতীয় সংসার খরচের টাকা নিয়েছে মায়ের থেকে। তাহলে সুরভি, রিমন ওরা কোথায়? ওদের পথে বসিয়ে দিলওয়ার নতুন সংসার পেতেছে! আর কত অমানুষী রূপ দেখাবে ছেলেটা? রক্তে চাপ পড়ল দাদিনের। প্রেশার বেড়ে জ্ঞান হারালো আচমকা। হৈমী খাচ্ছিল, জেরিন বাসনপত্র ধুতে ব্যস্ত। এমন সময় দাদিন জ্ঞান হারানোয় সবার প্রথম নজরে পড়ল হৈমীরই৷ সে ছুটে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল! চিৎকার করে কেবল উচ্চারণ করল,

-” দাদিন! ”

চলবে…