#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৬১
ঢাকার সেই ফ্ল্যাটে দ্বিতীয়বারের মতো পা রাখল হৈমী। বিয়ের পর যেখানটায় রুদ্রর সঙ্গে গুটিকয়েক মাস কাটিয়েছিল সে। তৈরি করেছিল দুষ্টু, মিষ্টি অনুভূতিপ্রবণ একরাশ স্মৃতি। ভেবেছিল, এসেই তাকে সংসার গুছানোর কাজে লেগে পড়তে হবে৷ কিন্তু রুদ্র তার জন্য কোনো কাজই বাকি রাখেনি। বন্ধু এবং কাজের লোক দিয়ে সব কাজই সেরে ফেলেছে। বেডরুম সাজিয়েছে তাজা তাজা ফুল দিয়ে। বিশাল বেডরুমের একপাশে তাদের বিছানা। যেমনটা পূর্বেও ছিল। পার্থক্য শুধু এটাই আগে যেখানটায় ডিভান রাখা ছিল সেটা এখন আর নেই। এর পরিবর্তে সেখানে আনা হয়েছে বাচ্চাদের জন্য দু’টো নরম তুলতুলে দোলনা জাতীয় বিছানা। সবকিছুতে দৃষ্টিপাত করে লাজুক হাসল হৈমী৷ মনে মনে ভাবল, পরিবর্তন তো হবেই। তার আর রুদ্রর জীবনেও তো পরিবর্তন এসেছে। দুজনার সংসারে আরো দু’জনের আগমন ঘটেছে। তাদের সন্তান রুদ্রিক, রুদবা। এই দুটো প্রাণ তাদের সবকিছু জুড়েই থাকবে এখন৷ সকাল শুরু হবে এদের দুজনকে নিয়ে, রাত শেষও হবে এদের দু’জনকে নিয়ে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাচ্চাদের খাবার গরম করল হৈমী। রুদ্র বসার ঘরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে রুদ্রিক, রুদবাও তাদের কাছেই। এই সুযোগে কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরে চলে এলো হৈমী। আসার পথে রুদ্র জিজ্ঞেস করেছিল,
-” কী করবে? আমরা আজ বাইরে থেকে খাবার এনে খাব। ”
হৈমী কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলল,
-” আমাদের খাবারের চিন্তা আমি করি না৷ বাচ্চারা খাবে কী? ওদের তো আর বাইরের খাবার দিব না৷ এমনিতেই খেতে চায় না। দশমাস হয়ে গেছে এখনো মেয়েটাকে ভাত খাওয়াতে পারলাম না৷ ছেলেটা যাও মুখে তুলে মেয়েটা একেবারেই তুলে না। এই চিন্তা কি আপনার আছে? থাকবে না তো সব চিন্তা শুধু আমার। আমার একার বাচ্চা যে! ”
-” অ্যাঁই মেয়ে অ্যাঁই, তথাকথিত বউদের মতো এভাবে ঝগড়া করছ কেন? সহজভাবে প্রশ্ন করেছি না আমি? ”
সহসা রুদ্র চটে যাওয়ায় হকচকিয়ে গেল হৈমী। আশপাশে তাকিয়ে সুড়সুড় করে চলে গেল রান্নাঘরে৷ রুদ্রর বন্ধু আবির ঠোঁট টিপে হাসল। বলল,
-” আহারে বেচারিকে ধমক দিলি কেন? ভালোই তো লাগছিল। ”
-” তোর ভালো দিয়ে আমার কী কাজ? ”
আবির আর কথা বাড়ায়নি। সময় অনুযায়ী খাবার চলে এলে সকলে এক সঙ্গে খেয়ে চলে গেল। রুদ্র ওদের এগিয়ে দিতে গেলে হৈমী বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দিল বিছানায়। এরপর ঝটপট সাদা কাগজ, কলম নিয়ে লিখতে বসল,
অ্যাঁই যে মিস্টার রুদ্রিক, রুদবার বাবা,
কথানুযায়ী বাচ্চাদের রেখে আমি চললাম। এবার নিজের বাচ্চা নিজেই সামলান। খুব তো বড়াই করে বলেছিলেন৷ ওরা জন্মানোর পর আমাকে ডিভোর্স দেবেন। আমি বেশ বুঝে গেছি আমাকে ডিভোর্স দেয়া আপনার সাহসে কুলোবে না। দ্যা গ্রেট রুদ্রর আজকাল বড্ড সাহসের অভাব। তাই ডিভোর্স বিহীন আপনাকে ত্যাগ করে আমি চলে গেলাম৷ এবার দেখুন, কেমন লাগে। রাগের মাথায় মুখ দিয়ে যা খুশি তাই বলার ফল এবার ভোগ করুন৷
ইতি,
রুদ্রিক, রুদবার আম্মু।
চিঠি লিখে স্বস্তি ভরে শ্বাস ফেলল হৈমী। কয়েক পল নিশ্চুপ বসে থেকে মুচকি হাসল৷ সেদিন তার মন খুবই বিক্ষিপ্ত ছিল। অ্যাবর্শন করার মতো ভুল পথ বেছে নিয়েছিল সে৷ রুদ্রর ভয়ে। সেই ভয়কে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিয়েছিল রুদ্র৷ পাশাপাশি তাকে ভুল পথ থেকেও ফিরিয়ে এনেছিল। বাঁচিয়েছিল তাদের সন্তানদের।
এ পর্যন্ত ভেবেই দোলনায় ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাদের দিকে তাকাল হৈমী৷ ওঠে গিয়ে ওদের কপালে চুমু খেল স্নেহভরে৷ শ্বাস নিল বুকভরে। এরপর স্মরণ করল সেই দিনটাকে। যেইদিন রুদ্রর থেকে তীব্র আঘাত পেয়ে খালাত বোন টিশাকে ফোন করেছিল সে৷ হাউমাউ করে কেঁদেছিল নিজের বীভৎস জীবন বিবৃতি দিয়ে। টিশা তাকে বুঝিয়েছিল। রুদ্রর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল৷ কিন্তু ধীরেধীরে যখন রুদ্রর পরিবর্তন হৈমীর নজরে এলো তখন সে আবারো টিশার সাহায্য চাইল। রুদ্রকে হৈমী ভালোবাসে। সবকিছুর পর তারা স্বামী- স্ত্রী। তাদের দু’টি মাসুম বাচ্চা রয়েছে। এছাড়া সম্পর্ক ভাঙ্গন, পরিবার ভাঙ্গন কখনো সমাধান হতে পারে। দু’টো মানুষদের যদি ভেঙে সমাধান আনতে চায় তাহলে হয়তো তারা দু’জন সুখী হবে। কিন্তু তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর জীবন হয়ে ওঠবে দুর্বিষহ। সবচেয়ে বড়ো কথা রুদ্রিক, রুদবার জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাছাড়া রুদ্র যদি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে। হৈমী যদি একটু সময় নিয়ে অনুভব করতে পারে এই মানুষটার সঙ্গে বাকি পথ চলা সম্ভব। তাহলে নিক না সময়। টিশার বুদ্ধিতে সেই সময় নিয়েছে হৈমী। বুঝেছে মানব জীবনের গতিধারা। আমরা পুঁথিগত শিক্ষায় যতটা অর্জন করি। জীবনের পথে চলতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থানের মুখে পড়ে তার চেয়েও দ্বিগুণ অর্জন করে ফেলি। হৈমীও অর্জন করে নিল। আপাদমস্তক রুদ্রটাকেই জেনে ফেলল সে। নিজের সন্তানদের বাবাকে পড়ে ফেলল অনায়াসে। সবশেষে বুঝে নিল, যায় এই মানুষটার সঙ্গে বাকি পথ অনায়াসেই চলা যায়।
এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই পারফেক্ট হয় না। সব মানুষের মাঝেই রয়েছে দোষ, গুণ, ত্রুটি। আমরা যদি মানুষকে তাদের দোষগুণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই। ত্রুটি গুলো চিহ্নিত করে দিই। তাহলে হয়তো মানুষটা নিজের ভুলগুলো বুঝে এক সময় ঠিক শুধরে যাবে।
হৈমী পুনরায় ফিরে এলো বিছানায়। ফুলে সজ্জিত বিছানায় হাত বুলিয়ে আরো একটি চিঠি লিখতে বসল,
শুনুন,
আপনার এই ফুলশয্যাও আমি ত্যাগ করলাম৷ কেন জানেন? ইতিপূর্বে যে ভুলগুলো করেছেন তার জন্য আপনি আমার কাছে একটা সরিও বলেননি। বলবেন কেন? আপনি তো একজন ইগোয়েস্টিক পার্সন। আচ্ছা আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন আমার পাশে আপনাকে মানায় না৷ কীভাবে মানাবে? বলুন কীভাবে মানাবে? আপনি তো একটা বটগাছ! বটগাছের সাথে কি আর ডালিম গাছ যাবে? না কক্ষনো যাবে না। আমি হচ্ছি সহজসরল ভোলা ভালা একটা মেয়ে। আমার মধ্যে অহংকারের ‘অ’ও কেউ খুঁজে পাবে না৷ আর আপনি অহংকারের অ, হ, ং, ক, র সবই লালন, পালন করে বড়ো হয়েছেন। নাহ এভাবে হয় না। ওহ হ্যাঁ মোস্ট ইম্পর্টেন্ট বিষয় তো লিখলামই না৷ লিখছি…
অ্যাঁই আপনার সমস্যা কী। আমাকে বিয়ে করে দুটো বাচ্চার মা বানিয়ে ফেলেছেন। অথচ… আজ পর্যন্ত একটা বার আই লাভ ইউ বলেননি। আমার তো খুব দুঃখ হচ্ছে এই ভেবে, যে লোকটার দু’টো সন্তানের মা আমি৷ সেই লোকটা এখন পর্যন্ত আমাকে আই লাভ ইউই বলেনি। ছিঃ ছিঃ ছিঃ নিজের ওপর ছিঃ আসছে। কীভাবে সম্ভব এটা কীভাবে? নাহ আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকব না। আপনার মতো ইগোয়েস্টিক, রসকষহীন জামাই আমার দরকার নেই।
ইতি,
আপনার নিরহংকারী বউ।
চলবে…
#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৬১ ( বর্ধিত অংশ )
দু’টো চিঠির প্রতিটি শব্দ পড়ে রুদ্রর চিবুকের হাড় শক্ত হলো। পুরো বাসায় তন্নতন্ন করে খোঁজার পরই এই দু’টো চিঠি পেয়েছে সে। যা এখন হাতের মুঠোতে মুচড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। দু-হাত কোমরে রেখে বুক টানটান করে শ্বাস নিল ঘনঘন। এরপর ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল রুদ্রিক, রুদবাকে। রুদ্রিক একটু একটু নড়াচড়া করছে। এই বুঝি ওঠে যায়। মা’কে না পেয়ে এই বুঝি কান্না করে তার অন্তর জ্বালিয়ে দেয়। বাচ্চা দু’টোর কান্না একদমই সহ্য হয় না তার একদমই না। মন বলে ওদের সুখের জন্য সবকিছু করতে সে প্রস্তুত থাকবে। ওদের মুখের হাসির জন্য সব করতে পারবে রুদ্র সব। ঐ আকাশের রূপালি চাঁদটাও বুঝি ছিনিয়ে আনবে অনায়াসে। শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসল দোলনার সামনে। রুদ্রিকের বুকে মৃদু চাপড় দিল। দুপাশের কোলবালিশ দিয়ে জড়িয়ে রাখল। যাতে সে বুঝতে পারে পাশে বাবা, মা আছে। কিন্তু কতটুকু সফল হবে? মা, মা গন্ধ তো আর এই কোলবালিশদুটিতে নেই। উফফ সূচকে শব্দ করে মাথা চেপে ধরল রুদ্র।
রুদ্রিকের নড়াচড়া কমে এলে ত্বরিত ওঠে দাঁড়াল সে। হৈমী চলে গেছে? সত্যিই কি তাকে ছেড়ে যেতে পারে মেয়েটা? মুখে বলেনি বলে সে কি তার ভালোবাসার গভীরতা একটুও টের পায়নি। কোথায় যেন শুনেছিল, ছেলেদের কানের কাছে মাইক দিয়ে ভালোবাসার কথা বললেও তারা বুঝতে পারে না কোনো মেয়ে তাকে ভালোবাসে। আর মেয়েরা জাস্ট চোখের ইশারায়তেই সব বুঝে নেয়। ওদের অবচেতন মনের শক্তি হয় প্রখর। তাহলে হৈমী কেন বুঝল না? কেন? নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না রুদ্র। হাত মুঠ করে সমস্ত শক্তি খাঁটিয়ে দেয়ালে এক ঘুষি মারল। ঠিক সে মুহুর্তেই তার মস্তিষ্কে খেলে গেল একটিই কথা। হৈমী চলে গেছে? কই যাওয়ার পথে তার সঙ্গে তো দেখা হয়নি৷ দেখা হওয়ার কথা ছিল তো। সে তো বাসার সামনেই ছিল! পরোক্ষণেই খেয়াল হলো হৈমী যেমন বাসার বাইরে যায়নি তেমনি এই ফ্ল্যাটের মেইন দরজাও খোলা ছিল। অর্থাৎ!!! অধর কামড়ে বিচলিত ভঙ্গিতে রুমের দরজা লক করে বেরিয়ে গেল রুদ্র।
____________________
ধরিত্রী জুড়ে রাজ করছে কৌমুদীপতি। নিজের আলোয় আলোকিত করে রেখেছে আঁধারকে। সেই আলো গায়ে মাখছে এক যুবতী। পরনে তার শুভ্র রঙা শাড়ি৷ পিঠ জুড়ে ছড়ানো চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়ছে। উড়ছে ঐ আঁচলখানাও। ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়ানো রমণীকে দেখে মেজাজ সপ্ত আকাশে ওঠে গেল রুদ্রর। অধর কামড়ে মেজাজটুকু সামলে নিল মুহুর্তেই। লোকের মুখে শুনেছে তীব্র রাগে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলে রাগ কমে যায়। কিন্তু রুদ্র মাটির দিকে তাকাল না। সে তাকাল বিশাল ঐ আকায় পানে৷ মাটিতে তাকালে রাগ কমে কিনা জানে না৷ কিন্তু ঐ যে বিশাল আকাশ। জোছনা রাত্রি। আকাশে রূপোলী চাঁদ। যার চারিধারে তাঁরা’রা জ্বলজ্বল করছে। সেই আকাশ পানে তাকাল সে। কয়েক পল পর তার বুকের সব বিষাদ, ক্রোধ দূর হয়ে গেল। বুকভরে শ্বাস টেনে মনটাকে প্রশান্তি দিল। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে অভিমানী রমণীটির পাশে দাঁড়াল। গুম ধরা সুরে বলল,
-” ইট’স ওভার। ”
রুদ্র বাক্যটুকু উচ্চারণ করা মাত্র হৈমী তার গোল গোল লাল চোখ দুইটি দিয়ে এমন করে তাকাল যে রুদ্র শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। ক্ষীণ স্বরে সে কেবল উচ্চারণ করল,
-” হৈমী, ঠিক আছো? ”
মুখ ফিরিয়ে, দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল হৈমী। কিয়ৎকাল পর নাক টানার শব্দ শুনতে পেল রুদ্র। বুঝল, পরিস্থিতি খুবই সিরিয়াস হয়ে গেছ আজ। রুদ্র আমতা আমতা শুরু করল। কী বলবে খুঁজে না পেয়ে শেষে বলল,
-” বাবুরা ওঠে পড়বে হৈমী। তোমায় না পেলে কান্না করবে৷ রুদ্রিকের গলা ভেঙে যাবে৷ ঘরে চলো। ”
হাত বাড়িয়ে হৈমীর ডানহাত স্পর্শ করল রুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিল হৈমী। রুদ্র হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। আমতা আমতা করল, মাথা চুলকালো। পরিহিত শার্টের হাতা গুটালো। কলার ঠিক করল। বুকের পাশের কয়েকটা বোতাম খুলে দিল। কত কিছু করল। অথচ হৈমীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। হৈমীর এই বাচ্চামো, এই জেদে রাগ হলো না রুদ্রর। শুধু মাথায় চলল রুদ্রিক, রুদবা ওঠে পড়বে। তাদের দুজনের একজনকেও না পেলে বাচ্চা দু’টো ভয় পাবে কাঁদবে। সবদিক বিবেচনা করে ত্বরিত সে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল। প্রচণ্ড দ্বিধায় ভুগে প্রথমে দু-হাত দিয়ে কান ধরল। চোখ বুজে মৃদুস্বরে বলল,
-” অহংকারী রুদ্র শেখ তার নিরহংকারী বউয়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। নিরহংকারী বউটা কি তার অহংকারী স্বামীকে ক্ষমা করেছে? ”
বিস্ফোরিত চোখে তাকাল হৈমী। আশ্চর্য হয়ে গেল এত সহজেই রুদ্রকে ঘায়েল করতে পেরে। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। রুদ্রর হাত দু’টো তখনো কান ছুঁয়ে। তাই ইশারায় আবারো জিজ্ঞেস করল। ক্ষমা করেছে কিনা৷ হৈমী মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল ক্ষমা করেছে। রুদ্র ঝটপট ওঠে দাঁড়াল। হৈমীর হাত ধরে বলল,
-” ঘরে চলো। ”
হৈমী শক্ত মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। অর্থাৎ সে যাবে না। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
-” ঘরে চলো তারপর যতখুশি রাগ করো অভিমান করো। ”
হৈমী মানলো না। সে হাত ছাড়িয়ে নিল আলগোছে। রুদ্রর কোঁচকানো ভ্রুদ্বয় আরো কুঁচকে গেল। ঠিক তখনি মনে পড়ল চিঠির কথাগুলো। তার মানে হৈমী তার কাছে ভালোবাসার কথা শুনতে চাচ্ছে। কিন্তু শুনিয়ে শুনিয়ে ভালোবাসায় তো সে বিশ্বাসী নয়। পৃথিবীর সব মানুষ তো এক ধাচের হয় না। সব মানুষের ভালোবাসার ধরনও এক হবে না। তার ভালোবাসা তো এমনই৷ কিন্তু এখন উপায়? অনেক ভেবেচিন্তে রুদ্র হৈমীর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। দু’হাতে ওর নরম গাল দু’টোতে হাত রেখে বলল,
-” ভালোবাসা তো বলার জিনিস নয় বোঝানোর জিনিস। আর আমার বিশ্বাস তুমি সেটা এতদিনে বুঝে গেছ। শুধু শুধু এই মধ্যরাতে ঢং করো না। রুমে চলো। ”
-” আমি ঢং করছি? ”
চটে গেল হৈমী। রুদ্র বাঁকা হেসে মাথা নিচু করে হৈমীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” হয় ঢং করছ নয়তো আমাকে চটানোর চেষ্টা করছ। আমি অলরেডি চটে গেছি ডার্লিং। সো নিশ্চিন্তে ঘরে চলো। এরপর আমাকে তোমার সঙ্গে মানায় কি মানায় না এই উত্তর গুলো প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেবো। এই বটগাছের প্রেম ডালিম গাছকে কতটা রাঙাতে পারে হাড়ে হাড়ে বোঝাবো। ”
কথাগুলো বলার ফাঁকে হৈমীর আঁচল টেনে ঠোঁটে থাকা লিপস্টিক মুছতে শুরু করল রুদ্র। হৈমী বাঁধা দিতে এলে সে জোর করেই মুছে দিল। এরপর দুর্বোধ্য হাসি হেসে নরম ঠোঁটজোড়ায় তর্জনী ছুঁয়ালো। ফিসফিসিয়ে বলল,
-” ডালিম আমার কতটা প্রিয় তুমি জানো না জান। ”
হৈমীর হৃৎস্পন্দন থমকে গেল। নিজের জালে নিজে ফেঁসে যাওয়ার অনুভূতিতে লুটোপুটি খেল মন মস্তিষ্ক। দ্রিমদ্রিম করে বাজতে থাকা বুকের ভেতরের যন্ত্রটির অনুভূতি শক্তি বাড়িয়ে দিতে আচমকা তাকে পাঁজা কোল করে নিল রুদ্র। ঘরে যেতে যতক্ষন সময় লাগল ঠিক ততক্ষণ সময়ই রুদ্র যাতা বলে লজ্জা দিল ওকে। কান গরম হয়ে যেন এবার ধোঁয়া ওঠার উপক্রম। ওর সেসব, বেসামাল, অমার্জিত কথা শুনে মনে মনে হৈমী সহসা বুকের কাছে শার্ট খামচে ধরল। চোখ, মুখ শক্ত করে কোনো ক্রমে উচ্চারণ করল,
-” দোহাই আপনার এবার থামুন। ”
.
.
সকাল কয়টা বাজে জানা নেই৷ চুল আঁচড়ে, মুখে ক্রিম লাগিয়ে ত্বরিত গতিতে বিছানায় চলে এলো হৈমী৷ রুদবা ওঠে গেছে ওকে খাইয়ে আবার ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করল৷ মেয়েটা ঘুমালোই না বরং ছেলেটাও ওঠে পড়ল। কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে দু’জনই। টের পেয়ে হৈমী সামলানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পেরে ওঠল না৷ সারারাত ঘুম না হওয়াতে হাই ওঠছে বারেবার। তখনি দু’জন একসঙ্গে কান্না শুরু করল৷ কারো থামবার নাম নেই৷ মাথায় ভনভন শুরু হলো এবার৷ উপায় না পেয়ে রুদ্রকে ডাকতে শুরু করল,
-” অ্যাঁই শুনছেন? ওঠুন প্লিজ। ”
রুদ্র নড়েচড়ে ওঠে বসল। রুদ্রিক বেশি বিরক্ত করছে বলে ওকে নিল সে। স্বস্তি পেয়ে হৈমী রুদবাকে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। আধাঘন্টা হাঁটাহাঁটি করে ঘুম পাড়ালো ওকে। রুদ্র রুদ্রিককে নিয়ে রুমেই হাঁটাহাঁটি করছিল। হৈমী এসে বলল,
-” রুদবা ঘুমিয়েছে। আপনি ওকে দেখুন আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই। ”
রুদ্র তাকিয়ে রইল হৈমীর দিকে। চোখে চোখে ইশারা করল কিছু। মৃদুস্বরে বলল,
-” সরি। ”
হৈমীর গাল দুটো লাল হয়ে গেল। সামনে থেকে সরে যেতে যেতে কৃত্রিম মেজাজ দেখিয়ে বলল,
-” আপনি কিন্তু খুব খারাপ করছেন এবার৷ বার বার সরি বলে আমাকে ক্ষেপাচ্ছেন এবার। এবার কিন্তু সরি বলার কিছু হয়নি। যা হয়েছে ওটা তো স্বাভাবিকই হয়তো ঘোরের মাথা… ”
নিজের লাগামহীন কথায় আচমকা শক্ত হয়ে গেল হৈমী। লজ্জায় মাথা ঘোরাতে শুরু করল তার। ত্বরিত মেয়েকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে কম্বল মুড়িয়ে নিল সর্বাঙ্গে। রুদ্রর ঠোঁটে তখন দুষ্টু হাসি খেলা করছে। চোখ দু’টিতে রয়েছে তৃপ্ততা। নিশ্বাসে আছে স্বস্তি।
___________
সকাল আটটা নাগাদ সূচনার কল পেল রুদ্র। সহসা বজ্রপাতের ন্যায় খবর জানালো, দাদিন আর নেই! ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করে মৃত্যু ঘটেছে তার। এ খবর শুনে রুদ্রর সমস্ত কিছু যেন থমকে গেল। নিজের কানে সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। এক মুহুর্তের জন্য হলেও সে ভুলে গিয়েছিল মানুষ মরণশীল। তার বৃদ্ধা দাদিন মারা গেছে এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। একটি স্বাভাবিক ঘটনা কীভাবে অস্বাভাবিক হয়ে গেল! শুধুমাত্র রাগ, জেদ তীব্র অভিমানের কাছে হেরে গেল চিরন্তন সত্য স্বাভাবিক ঘটনাটা৷
রুদ্র ড্রাইভ করতে পারবে না বলে বন্ধু ঝিনুক ড্রাইভ করল। রুদ্র, হৈমী আর বাচ্চারা বসে আছে পিছনের সিটে৷ দাদিনের মৃত্যুর খবর পেয়ে হৈমী তাকে দেওয়া চিঠিটা রুদ্রকে দিয়েছে। কথা ছিল চিঠিটা রিদওয়ান শেখকে দেবে। কিন্তু দেওয়ার আগেই দাদিন ইহকালের মায়া ত্যাগ করলেন৷ বেঁচে থাকতে তার শেষ ইচ্ছে গুলো কাউকে জানাতে পারলেন না৷ হায়রে নিয়তি!
দাদিনের চিঠিটা পড়ার পর রুদ্র আরো বেশি মিইয়ে গেছে। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে সে। যেন আজ সে নির্বাক। শৈশবের বহু স্মৃতি তার হৃদয়ে আঘাত হানছে। যে দাদিন তার দ্বিতীয় মা ছিল সেই দাদিনের থেকে কীভাবে এতটা দূরে সরে গেল সে? ভুল হয়ে গেছে তার মারাত্মক ভুল। সবকিছু ছাপিয়ে ঐ বৃদ্ধাই তাদের শক্তি ছিল। একটি ঘরের ছাদের ন্যায় ছিল মানুষটা। বুকটা হাহাকার করে ওঠল রুদ্রর। সে বাড়ি যাচ্ছে। তার দাদিন আর বেঁচে নেই। দিলওয়ার শেখও নিশ্চয়ই মৃত মা’কে দেখতে আসবে? দেখতে আসবে তার জন্মদাত্রীও। সাথে তাদের ছোটো ছেলে রিমন। সবাই আসবে আজ। আজ হয়তো কেউ তাদের করা অন্যায়গুলোর জন্য প্রশ্ন তুলবে না। আজ কেউ ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে তাদের দিকে তাকাবে না। দুনিয়াটা কত অদ্ভুত। কত সহজে রং বদলায় এই দুনিয়া আর দুনিয়ার মানুষগুলো।
নিজের মনকে খুব কষ্টে রুদ্র বোঝালো দিলওয়ার বা সুরভি কারো সঙ্গেই ঝামেলা করবে না সে। চোখের সামনে পড়ে গেলেও না দেখার ভান করবে। সবশেষে দাদিনের ইচ্ছে গুলো পূরণ করবে সে। এ জীবনে কখনো ওদের ক্ষমা করতে পারবে না। তবে ভিক্ষা দেবে। দাদিনের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে সারাজীবনের জন্য ও বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করবে। শেকড় ছিঁড়ে গেছে তো। আজ আর কোনো পিছুটান নেই। শুধু আফসোস থেকে যাবে একটাই। শেষবার দাদিনের স্নেহের স্পর্শ পাওয়া হলো না। সূচনাতে যার সঙ্গে এত মধুর স্মৃতি ছিল, তার সঙ্গে শেষ স্মৃতি রইল অত্যন্ত তিক্ততার। এই আফসোস আজীবন পুড়াবে তাকে আজীবন। বুকের গভীর থেকে দাদিন শব্দটা বার বার হাহাকার করতে লাগল। এক পর্যায়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল রুদ্র। বাচ্চা দু’টোকে আগলে রুদ্রর কাঁধে মাথা রাখল হৈমী। ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-” ভেঙে পড়বেন না রুদ্র। আমি আছি, আমরা আছি আপনার সঙ্গে। ”
সহসা চুপসে গেল রুদ্র। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল হৈমীর অসহায় মুখশ্রী। অদ্ভুত এক ভরসা পেল এই মুখে সে। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক শক্তিও পেল। তিনজনকে বুকের ভেতর আগলে নিয়ে গভীর শ্বাস ছেড়ে বলল,
-” ভাগ্যদোষে অনেক হারালাম। আর কিছু হারাতে চাই না আমি হৈমী আর কিছু হারাতে চাই না। ”
-” আর কিছু হারাতে দিব না তো আমি। ”
.
.
শেখ বাড়িতে আজ বহু মানুষের ভীড়। এই ভীড় ঠেলে রুদ্র যখন দাদিনের মৃতদেহটা দেখল। অজান্তেই শরীর ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল সে। কিঞ্চিৎ দূরে বসা সূচনা ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে। ভাইকে জড়িয়ে ধরে উন্মাদের মতো কাঁদল সে। বাচ্চাদের মা, চাচি শাশুড়ির কোলে দিয়ে রুদ্রর পাশে এসে বসল হৈমী। সূচনার পাশে এসে বসল মাহের। রুদ্র হৈমীকে আঁকড়ে ধরল। সূচনা আঁকড়ে ধরল মাহেরকে। মানুষ তো এমনই। আমরা যখন আমাদের একজন আপন মানুষ হারিয়ে ফেলি তখন অপর আপনজনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টাও করি।
সব দুঃখ, কষ্ট ভুলে, সব হারানোর ব্যথাকে দূরে সরিয়ে রুদ্র, সূচনা বাঁচুক তাদের ভালোবাসাকে আঁকড়ে।
_____ সমাপ্ত ______
দু’টো জমজ বাচ্চার মা হৈমী। জমজ দুটোর বয়স মাত্র চার বছর৷ অথচ তাদের সামলাতে গিয়ে হৈমীর কখনো সখনো মনে হয় এরা চারশ বছর যাবৎ তার হাড় জ্বালাচ্ছে। দিন, রাতের ধকল গুলো আর সামলে ওঠতে পারছে না সে। দুপুরে দু’জনকে খাইয়ে দিয়েছিল৷ এবার ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে৷ রুদ্রিক ঘুমালেও রুদবা ঘুমাচ্ছে না। সে কুচুরমুচুর করছে। হৈমী চেয়েছিল দুটিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে গোসলে যাবে। তারপর এসে খাবার খাবে। বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে কোনোকিছুরই সময় পায় না৷ যখন একেবারে পুঁচকে ছিল। তখন ভাবত, কয়েক বছর গেলে এদের লালন-পালন করা কিছুটা সহজ হবে৷ কিন্তু যত বড়ো হতে লাগল, ততই পরিস্থিতি কঠিন হতে শুরু করেছে৷ নিজের করুণ দশার কথা ভেবে কান্না পাচ্ছিল হৈমী। হঠাৎ রুদবা শোয়া থেকে ওঠে বসল। মাকে বলল,
-” মাম, বাবাইকে ভিদিয়ো কল দাও। ”
মেজাজ চটে গেল হৈমীর৷ ঠাস করে গালে চড় মেরে বলল,
-” চুপচাপ শুয়ে ঘুমাবি। বাবাই অফিসে বিজি। তোর মতো আজাইরা সময় তার নেই।”
কথাগুলো বলেই ঠেশে শুইয়ে দিল মেয়েকে। রুদবা গালে হাত দিয়ে গলা চড়াও করে কাঁদতে লাগল। চারদেয়ালের ভিতরে সেই কান্না যেন হৈমীর মস্তিষ্ক চিবাতে শুরু করল। রুদ্রিকও ওঠে পড়ল সহসা। আচমকা ঘুম ভাঙায় সেও কাঁদছে। হৈমী উপায়ন্তর না পেয়ে কান্নারত ছেলেমেয়ে রুমে রেখে মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে গেল। কল করল রুদ্রকে। রুদ্র অফিসে। মিটিংয়ের মাঝেও বউয়ের কল রিসিভ করল সে। করুণ দশা শুনে স্বান্তনা দিয়ে বলল,
-” এক কাজ করো। ল্যাপটপ থেকে আমাদের রিসিপশনের ভিডিয়ো দেখাও ওদের। তাহলেই কান্না থেমে যাবে। ”
হৈমী চট করে ফোন কেটে দিল। আইডিয়াটা তার কাছে মন্দ লাগল না। আরেকটু ছোটোবেলায় এই ভিডিয়ো দেখেই ওদের খাওয়াতো সে। খোশমেজাজে বাচ্চাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে ভিডিয়ো অন করে দিল। আদর করে বলল,
-” সোনামোনারা ভিডিয়ো দেখো। মাম এই যাবে আর এই আসবে। ”
হৈমী একছুটে গোসলে চলে গেল। রুদবা রুদ্রিক বাবা, মায়ের ভিডিয়ো দেখছিল। মামা, মামিকে দেখতেই বোনকে বলল,
-” দেখ মামাই। ”
রুদবা চিৎকার করে বলল,
-” দেখ দাদান, দাদান। ”
এরপর হঠাৎই রুদবার কপালে ভাঁজ পড়ল। এখানে সবাই আছে কিন্তু তারা নেই। কেন? বাবাই, মাম তাদের কেন নিয়ে গেল না? ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে সে বলল,
-” ভাই, সবাই আচে শুধু তুমি আর আমি নেই। ”
রুদ্রিক চোখ গোল গোল করে সবাইকে দেখতে লাগল। ভাবুক স্বরে বলল,
-” আমি আর তুই কোতায়? ”
রুদবা ভীষণ মন খারাপ করল। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই চোখ উপচে পানি পড়তে শুরু করল তার। রুদ্রিক এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে বাথরুমের সামনে গেল। দরজায় সমানে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল,
-” মাম, মাম। ”
হৈমী বলল,
-” কী হলো বাবা। ভিডিয়ো দেখো আমি আসছি। ”
কিছুক্ষণ পর রুদবার কান্নার শব্দ পেল। হৈমী গর্জন দিয়ে বলল,
– ” তুই ওকে মেরেছিস আবার? ”
রুদ্রিক বলল,
-” মাম রিচিপসনের ভিডিয়োতে আমি আর বোন নেই কেন? তুমি কখন গেচ আমাদের নিয়ে গেলে না কেন? ”
রুদবারও আধোস্বরে অভিযোগ শুনতে পেল হৈমী,
-” ভাই আমরা যখন ঘুমাই তখন গেচিল! ”
এরপর আবার উচ্চরবে কান্না। হৈমীর সব তালগোল পাকিয়ে গেল৷ এই দুটো নাদান বাচ্চা কি সত্যি তার পেট থেকে বেরিয়েছে? এদিকে রুদ্রিক মায়ের থেকে পাত্তা না পেয়ে দৌড়ে বাবাইকে কল করল। দু’জনে কাঁদছে। রুদ্র ফোন রিসিভ করে অস্থির কণ্ঠে বলল,
-” কী হয়েছে কাঁদছ কেন তোমরা? ”
দু’জনে একস্বরে অভিযোগ করল,
-” আমাদের রিচিপসনে নিয়ে যাওনি কেন বাবাই? ”
রুদ্র হকচকাল, ভড়কাল। বিস্ময়ে চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হলো। সামনে বসে থাকা বিজনেস পার্টনাররা দেখল, এসি চলার পরও রুদ্র শেখ ঘামতে শুরু করেছে। সকলের সামনেই কণ্ঠ নিচু করে মুখের সামনে হাত দিয়ে আগলে রুদ্র ছেলেমেয়েদের বলল,
-” তোমরা তখন ছিলে না বাবারা। ”
ওরা বিশ্বাস করল না বরং কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিল। রুদ্র কী করবে বুঝে ওঠতে না পেরে স্বভাবসুলভ ঝোঁকের বসে বলল,
-” আমি নিতে চেয়েছিলাম তো সোনা। তোমাদের মাম আমাকে বকা, ঝকা করে নিতে দেয়নি।”
এ পর্যন্ত বলেই ফোন কেটে দিল রুদ্র। মনে মনে পৈশাচিক হেসে নিজের কাজে ব্যস্ত হলো সে। এদিকে হৈমীর অবস্থা দফারফা করে দিল জমজ দুটো। এইটুকুন বাচ্চারা আঙুল তুলে অভিযোগ করছে,
-” তুমি পঁচা। তুমি আমাদের ভালোবাসো না। বাবাইকেও ভালোবাসতে দাও না। একা একাই বাবাইকে নিয়ে রিচিপসনে যাও। ”
কখনো ঠোঁট উল্টে, কখনো বিছানায় মুখ লুকিয়ে কাঁদল ছেলেমেয়ে দু’টো। যেন জগতে এদের মতো অসহায় আর কেউ নেই। হৈমী শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তাজ্জব মুখে হঠাৎ বলে ওঠল,
-” এরা কারা? এরা কোত্থেকে এলো? ”
®জান্নাতুল নাঈমা