#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১
আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী আমি। একটা দূর্ঘটনার কবলে পরে আমার স্বামী আমাকে বিয়ে করে। আমার স্বামী একজন বড়ো ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ের কাজেই গিয়েছিল আমাদের গ্রামে। আমার ছোটোখাটো পরিবার। আমার বাবা একজন ইমানদার মানুষ। মসজিদের ইমাম। মা মারা যায় ছোটোবেলায়। এরপর আর বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বিয়ে করেনি৷ আমি পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। নিজের পুরো সময়টা পড়ায় মন দেওয়ার চেষ্টা করতাম। আমার জীবনটাও বেশ রঙিন কাটছিল। টাকা ছিল না তবে সুখের কমতি ছিল না। শান্তির কমতি ছিল। বড়ো কোনো আশা ছিল না। তবে বাবার জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা সবসময় ছিল৷
আমার স্বামীর নাম আরাব চৌধুরি বয়স ৪৩ বছর। তিনি যখন আমাদের গ্রামে আসেন তখন আমার বয়স ছিল সতেরো বছর। আমাদের গ্রামে বিশাল বড়ো বাঙলো উনার। উনি যতবারেই গ্রামে আসতেন আমার বাবা খাবার দিয়ে আসতেন। এতে অবশ্য তিনি আমার বাবাকে টাকা দিতেন। যে কয়বার উনি গ্রামে এসেছেন সে কয়বার আমি উনাকে কখনও মুখোমুখি দেখিনি।যেদিন আমার সাথে তার মুখোমুখি দেখা হয় সেদিনেই উনার সাথে আমার বিয়ে হয়।
ঘটনা আরও তিনমাস আগের। উনি গ্রামে এসেছিলেন ব্যবসায়ের কাজে। বরাবরেই গ্রামে আসলে রান্নার ভারটা আমার উপরেই পড়ে। যেদিন দেখি বাড়িতে অনেক ভালোমন্দ রান্না হচ্ছে সেদিন বুঝতে পারি উনি এসেছেন। শেষবার যখন উনি এসেছিলেন সেদিন রান্না করে বাবাকে ডাকতে গিয়ে দেখি তিনি শুয়ে আছেন। অবেলায় শুয়ে থাকতে দেখে বাবার কাছে গিয়ে লক্ষ্য করলাম বাবা ভীষণ জ্বরে কাঁতরাচ্ছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বাবা আমাকে বললেন
“আয়েশা মা, তুমি খাবারটা চৌধুরি সাহেবের জন্য নিয়ে যাও। আজকে আমার শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। বাইরেও বৃষ্টি। গতরে একদম শক্তি নেই যে উঠে খাবার নিয়ে যাব।”
বাবার শারিরীক কষ্ট বুঝতে পেরে আমিই এ বাদল বৃষ্টি ভেদ করে কচু পাতা মাথায় দিয়ে উনার বাড়িতে যাই। বেলা তখন দুপুর দুটো। আমি যেতেই আরাব চৌধুরি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
“কী চাই? এখানে কেন এসেছো?”
আমি কিছুটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিলাম
“আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। বাবা ভীষণ অসুস্থ । তাই আসতে পারে নি।”
সেদিন এতটাই ভয়ার্ত ছিলাম যে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। শরীরটাও থরোথরো করে কাঁপছিল। আমাকে কাঁপতে দেখে তিনি হালকায় গলায় জিজ্ঞেস করলেন
“কাঁপছো কেন? সামনে তো বাঘ ভাল্লুক বসে নেই। খাবার কী সবসময় তুমি রান্না করো?”
আমার ভয়ার্ত গলায় উত্তর আসলো
“জ্বি স্যার আমিই রান্না করি।”
তিনি বেশ স্বাভাবিক গলায় আমাকে বললেন
“খাবারটা টেবিলের উপর রেখে চলে যাও। আর রাতে রান্নার প্যারা নিতে হবে না। রাতে আমি খাব না।”
“জ্বি স্যার”
আমি খাবারটা রেখে বাড়ি থেকে বের হলাম। কথোপকথনের সময় একটাবারও আমার উনার চোখের দিকে তাকনোর সাহস হলো না। এমনকি দেখতে কেমন সেটাও আমি বলতে পারব না। আমি বাড়ির গেইটের সামনে আসতেই চারপাশ অন্ধকারে মেঘের গর্জন দিয়ে ছেয়ে যাচ্ছিল। ভয়ে আমি জড়োসড়ো হয়ে গেইটের কোণে দাঁড়িয়ে আছি। আকাশের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম চারপাশে মেঘেরা খেলা করছে। যখনই বাড়ি যাবার জন্য পা বাড়ালাম তখনই বৃষ্টির ঢল আকাশ থেকে নামতে শুরু করলো।
আমি তাড়াহুড়ো করে গেইট থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসলাম। পুরো শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। আমি বের হতেই পাড়ার মহসীনের সাথে আমার দেখা। মহসীন এ পাড়ার সবচেয়ে ইতর লোক। বাবার কাছ থেকে কয়েকটা টাকা ধার পায় সে।।সে ধারের টাকা বাবার পরিশোধ করতে বিলম্ব হচ্ছে বলে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় বাবাকে। বাবা অবশ্য এতে একদম নারাজ। কারণ একজন বাবা তো জেনে শুনে একটা লম্পটের সাথে নিজের মেয়েকে তুলে দিতে পারে না। তাই সবসময় সুযোগ খুঁজে আমার ক্ষতি করার।
আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখে তার লালসার চোখ আমার উপর পড়ল। আমার হাতটা ধরে নোংরা ভাষায় বলতে লাগল
“কী রে মা**গি আমারে বিয়ে করতে পারিস না। অথচ ভেজা শরীর নিয়ে বুইড়া বেডার সাথে শুইতে আসছিস। চরিত্রহীন মেয়ে। খালি বাড়ি থেকে এমনে বের হইছস। বুঝি না কী করে আইছস। তোরে আজকে হয় আমার সাথে বিয়ে দিবে নাহয় তোর নামে কলঙ্ক রটাব।”
মহসীন এ কথাগুলো বলেই আমাকে টানতে টানতে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আর লোক জড়ো করছিল।।সব লোক সমাগম আমার বাড়ির সামনে। সবার হৈ হুল্লোরে বাবা জ্বর শরীর নিয়ে বের হলো। মহসীন বাবাকে দেখেই বলে উঠল
“মাইয়া বিয়ে দিতে সমস্যা। ভাড়া খাটাইতে সমস্যা নাই? তাই না? বুইড়া বেডার কাছে মাইয়া পাঠায়ছেন খুশি করে টাকা আনার জন্য। ”
এরপর গ্রামের কিছু মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলল
“এই আয়েশার বাপ একটা ভন্ড হুজুর। নিজে ইমামতি করে মাইয়ারে ভাড়া খাটায়। এ বাদলা দিনে এ মাইয়া বাঙলো থেকে বের হয়ছে। বাঙলোতে একা শুধু আরাব চৌধুরি থাকে এটা সবার জানা। ভেজা শরীর নিয়ে লুকিয়ে বের হতে গিয়েই আমার হাতে ধরা পড়ছে।।এটা তো সমাজের জন্য ক্ষতি। এই নষ্টা মেয়ের জন্য আর ভন্ড হুজুরের জন্য তো সমাজ নষ্ট হইব। যদিও মাইয়া খারাপ। তবুও এতদিন আয়েশার বাপ আমাদের নামাজ পড়ায়ছে সে সুবাদে একটা সুযোগ দেওয়া যায়। আমি চাই আয়েশারে বিয়ে করতে। এত দূর্নাম জেনেও বিয়ে করতে চাই কারণ মাইয়ার মা নাই। অসহায় মাইয়া বিয়ে করলে সওয়াব আছে। আর বিয়ের পর ঠিকমতো টাইট দিলে চরিত্রও ঠিক হয়ে যাইব। এহন আপনারা যা সিদ্ধান্ত নেন।”
গ্রামবাসী সবাই মহসীনের কথায় তাল মিলিয়ে বাবাকে ছিঃ ছিঃ করতে লাগল। বাবার চোখ বেয়ে কান্না জড়ছে। ছোটো একটা বিষয় এত বড়ো হয়ে যাবে কে জানত। কান্না গলায় বাবা বলল
“দরকার হয় সমাজ ছাইড়া চইলা যামু। তবুও আমার মেয়েরে এ লম্পটের হাতে তুলে দিমু না। চৌধুরি সাহেব অনেক ভালো মানুষ। আমি উনাকে কাছ থেকে চিনি। সে ভরসায় নিজের শরীর খারাপ ছিল তাই আয়েশাকে দিয়ে খাবার পাঠায়ছি।।আমার মেয়ে নষ্টা না। একটা লম্পট ছেলের কথায় আমার মেয়েকে দয়াকরে এ অপবাদ দিবেন না। ”
মহসীনকে লম্পট বলায় মহসীন রেগে আমার বাবার কাছে তেড়ে গিয়ে বাবার গালে থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে বলল
“নষ্টা মেয়ে জন্ম দিয়ে নষ্টামি করে আমাকে লম্পট বলা।”
গ্রামবাসীও বাবাকে মারার জন্য তেড়ে আসতে লাগল।।সত্যি বলতে সেখানে যারা উপস্থিত ছিল সবাই মহসীনের কথায় উঠছিল বসছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম তাদের মহসীন আগেই টাকা দিয়ে কিনে এ নাটক সাজিয়ে ফেলেছে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকা মহসীন হুট করে সুযোগ পেয়ে আজকে ঝোপ বুঝে কোপ মারল। গ্রামবাসীকে এভাবে তেড়ে আসতে দেখে বাবা ভীষণ ভেঙে পড়ে। দাঁড়ানো থেকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।
আমি গ্রামবাসীকে চিৎকার করে বুঝানোর চেষ্টা করেও পারছিলাম না। পাশের বাড়ির মালতি চাচী আমার চুল ধরে বলতে লাগল
“নষ্টা একটা। তোর জন্য তো আমাদের মেয়েরা নষ্ট হবে। মহসীন যে তোকে বিয়ে করতে চায়ছে শুকরিয়া করে বিয়ে কর। নাহয় বাপ বেটিকে চুল ন্যাড়া করে গ্রাম ছাড়া করব।”
পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিল। বাবা বসে আর কোনো কথা বলতে পারছিল না। আমি নিজেও মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম।
হুট করেই একটা কণ্ঠ সব কিছু নিস্তব করে দিল। পেছন থেকে আরাব চৌধুরি বজ্র কণ্ঠে বলে উঠলেন
“সমস্যা আমাকে নিয়ে। মেয়েটা আমার বিছানায় গিয়েছে তাহলে মহসীন কেন বিয়ে করবে? এত উদার মানুষ হলে তো সমস্যা। সমস্যা যেহেতু আমাকে নিয়ে এ মেয়েকে বিয়ে আমিই করব। মেয়ের বাবা একজন সম্মানিত লোক। তার পেছনে আপনারা নামাজ পড়েন। সে মানুষটাকেই আপনারা অসম্মান করছেন। বিবেক কী বিকিয়ে দিয়েছেন? আয়েশার বাবাকে সবাই চিনেন কতটা সৎ তিনি। তারপরও আপনারা যা নয় তা বলছেন। আর মেয়ের দোষের শাস্তি বাবাকে কেন দিচ্ছেন? দোষ যেহেতু মেয়ে করেছে আর আমি এতে জড়িত৷ আয়েশাকে বিয়ে আমিই করব। ”
আরাব চৌধুরির কথা শুনে সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেলেও মহসীন বলে উঠল
“এসব মুখে বলায় সম্ভব। বিয়ে করলে এখন এ মুহুর্তে করেন। আমি কাজী ডাকি। বড়োলোকের মুখের কথার দাম নাই।”
আরাব চৌধুরী মহসীনের কলার ধরে বলে উঠল
“যাকে ডাকার ডাক। আমি এ মুহুর্তে আয়েশাকে বিয়ে করব৷ আমি এক কথার মানুষ। আমার জবান শক্ত।”
এরপর গ্রামবাসীর তোপে পড়ে আমার বিয়েটা হলো। কীভাবে সবটা পাল্টে গেল নিজেও বুঝলাম না। বাবা সেই যে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসেছিল আর কথা বলেনি। বিয়ের পরদিন বাবা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে হার্ট এটাক করে মারা যায়। সবার অপমান এতসব কথা, নিজের মেয়ের এমন করে বিয়ে এসব বাবা সইতে পারেনি। বাবার মৃত্যুটা আমাকে একদম হতাশ করে দেয়। এ গ্রাম গ্রামের মানুষ আমার কাছে বিষের মতো লাগতে শুরু করে। আমি বাবার কবরের মাটি হাতে নিয়ে শুধু বলেছিলাম তোমার এ অপমানের প্রতিদান যেন প্রতিটা মানুষকে আল্লাহ দেয়। বাবা আমি চেষ্টা করব মাথা উঁচু হয়ে বাঁচতে। যত কষ্ট হোক যত সমস্যা হোক, আমার মাথা নোয়াব না। সবসময় নিজের আত্মসম্মান বাজায় রেখে উঁচু হয়ে বাঁচব।
বাবাকে করব দেওয়ার পরদিন আমি ঢাকায় আসি। এর মধ্যে আমার স্বামীর সাথে আমার কোনো কথায় হয়নি। ঢাকায় আসার পর জানতে পারি আমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী আর সেখান থেকে আমার জীবনের গল্পের নতুন মোড় নিল।
চলবে।