#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২
সেদিনেই আরাব চৌধুরির বাসায় আসি আমি। উনার বাবা মা অনেক বছর আগেই গত হয়েছেন। এ বাড়িতে দু চারটে কাজের লোক ছাড়া কাউকে চোখে পড়ল না। বিশাল বড়ো রাজ প্রাসাদের মতো বাড়ি আমি এ প্রথম দেখেছি। আমার কাছে এটা বাড়ি নয় মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার রাজ্য। সাজানো গুছানো পরিচ্ছন্ন। শীতল একটা আমেজ চারপাশে। তীব্র গরমের কষ্ট নেই আবার তীব্র শীতেরও মলিনতা নেই। যা আছে তা কেবল বসন্তের ছোয়া। মনে হচ্ছে চারপাশে বসন্ত বইছে। উনি আমাকে ড্রইং রুমে বসতে বললেন। আমি সোফার এক কোণে বসলে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
“দেখো আয়েশা তুমি আমার থেকে ২৫ বছরের ছোটো। সময় মতো আমার সন্তান হলে তোমার মতোই বয়স হত। হঠাৎ ধেয়ে আসা দূর্ঘটনায় পড়ে তোমাকে বিয়ে করা। তবে এ বিয়েটা তোমার জীবনে শান্তি আনবে না। বয়সের এ ব্যবধান তোমার জীবনকে নরকে নিয়ে যাবে। তুমি ভীষণ ভালো মিষ্টি একটা মেয়ে।।আমার মতো বয়স্ক একটা ছেলের বউ হওয়ার দুর্ভাগ্য তোমার হলেও সেটা তুমি কাটিয়ে উঠবে আশা করি।”
আরাব চৌধুরির মোলায়েম কন্ঠের ধ্বনি শুনে আমি উনার দিকে এ প্রথম চোখ তুলে তাকালাম। বয়স ৪৩ হলেও উনাকে দেখতে তেমন বয়স্ক লাগে না। মনে হয় এখনও তিনি বেশ জোয়ান। হয়তো টাকার আলতো আপ্যায়নে বুড়াভাবটা উনার মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। গাল ভর্তি দাঁড়ি। চুল এবং দাঁড়িতে পাক ধরলেও সেটা মানানসই লাগছে। মাথায় তালু ফাঁকা না বরং তুলনামূলক চুল কম। উনাকে আমার কাছে তেমন খারাপ লাগছে না। হয়তো আল্লাহর রহমত নাযিল হয়েছে বলেই এত বড়ো বয়স্ক একটা মানুষকে মনে হচ্ছে আমার জন্যই গড়া। তার প্রতি আমার মহব্বত কাজ করছে। তাকে আমার ভালো লাগছে। বিয়ের বাঁধনে বরকত এবং রহমত আছে বলেই তার প্রতি আমার তীব্র ভালোবাসা গুঞ্জণ তুলছে। কিন্তু সে ভালোবাসা পরক্ষণেই দহনে পরিণত হলো একটি কথায়।
“আয়েশা আমি চাই তুমি এ বাড়িতে থাকো। পড়াশোনা করো। বড়ো হও। বাবার আদর্শ সন্তান হও।।তোমার ভরণ পোষণের দায়িত্ব আমার। সময় হলে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। এখনও দিতে পারি।।তবে সমাজ আবারও আমাদের সম্পর্ক নিয়ে বাজে কথা বলুক এটা আমি চাই না। পড়াশোনা শেষ করো। এরপর তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে আমি ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিব। সে পর্যন্ত তোমাকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমার। কথা দিচ্ছি কখনও তোমার কাছে স্বামীর অধিকার চেয়ে তোমাকে ছোটো করব না।”
আরাব চৌধুরির এ কথাগুলো শুনে আমি স্তব্ধ হতে লাগলাম। উনাকে স্বামী হিসেবে মানতে আমার একদম কষ্ট হচ্ছে না। বরং আমি চাচ্ছি উনার পরম আদরে উনার ছায়াতলে উনার সহধর্মিণী হয়ে থাকতে। কিন্তু উনার মনে চলছে ভিন্ন অভিমত। উনার কথার পৃষ্ঠে আমি আমার মত প্রকাশ করতেই যাব সে মুহূর্তে তিনি আবারও বলে উঠলেন
“আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা তোমাকে বলা হয়নি। আমার তোমার আগেও আরেকটা বিয়ে হয়েছে। এবং আমার সে স্ত্রী জীবিত। সে দেশের বাইরে আছে। কবে ফিরবে জানি না। তবে একটা অভিমানের রূপ আমাদের এ দূরত্ব। আমাদের বিয়ের ১৩ বছর চলে। আমার প্রথম স্ত্রীর নাম আনজুমান। অসম্ভব সুন্দরী এবং গুণের অধিকারি একটি মেয়ে। আমার সকল ভালোবাসা তার জন্য জমে আছে। জানি না আমাদের কখনও মিল হবে কি’না। তবে আমার পক্ষে তাকে ভুলা কোনোদিন সম্ভব না। তার জন্য আজীবন অপেক্ষা করতে পারি আমি। আয়েশা তোমার বিপদের উদ্ধাকারী হয়ে এ বিয়েটা কেবল করেছি তোমাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার জন্য। এর বাইরে কিছু না।”
আমি লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে তা ছাড়লাম। আমার বুকের দহন বাড়তে লাগল। আমি আর কোনো বিয়ে চাই না। মেয়েদের জীবনে একটা বিয়েই হয়। যে আমাকে সম্মান দিয়ে এতদূর এনেছে। এত নিরাপদ জীবন দিয়েছে। তাকে আমি কীভাবে মা ভালোবেসে পাড়ি। তবে আমার মনের কথা আমি মুখ ফুটে আর বলতে পারব না। বলতে গেলেই আত্মসম্মানটা বিকিয়ে যাবে। যেখানে তিনি বলেই দিয়েছেন উনার সকল ভালোবাসা আনজুমানের জন্য সেখানে আমার ভালোবাসা প্রকাশের বৃথা চেষ্টা না করায় শ্রেয়। আমি ঢুক গিললাম। বসন্তময় এ পরিবেশ ক্রমশেই ভারী হতে লাগল। চৈত্রের মতো খড়া পড়ে আমার মনটা চৌচির হতে লাগল। গগনবিদারী হাহাকার আমাকে যেন আলিঙ্গন করতে লাগল। বেলাহার করুণ সুর চারদিকে বাজতে লাগল। চাপা কান্না আমার বুকে এসে বাসা বাঁধতে লাগল। সবকিছুর উর্দ্ধে গিয়ে নিজেকে সামলে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম
“আপনার প্রথম স্ত্রীর খোঁজ কী এ ১৩ বছরে পাননি? যোগাযোগ হয়নি? তিনি আপনার মতোই একা আছেন নাকি তিনি বিয়ে করেছেন৷ নতুন সংসার করেছেন৷ ১৩ টা বছর তো কম না।”
কথাগুলো বলে উনার দিকে তাকালাম। মলিনতা উনাকে গ্রাস করছে। চোখে মুখে বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে। অস্থিরতা তার কপালের ভাঁজে স্পষ্ট। ভারী গলায় উত্তর দিল
“সবাই তো বলে মারা গিয়েছে। ছোটো একটা ঝগড়া হয়েছিল আমাদের। ঝগড়ার কারণটাও এত বড়ো ছিল না। তার জন্মদিনে একটা সাদা গোলাপ আনতে বলেছিল। সেটাই আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। বিয়ের পর প্রথম জন্মদিন ছিল। একটু জেদী স্বভাবের ছিল। ফুল আনেনি বিষয়টা সে মানতে পারে নি। রাত বারোটায় ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আমি আটকাবার অনেক চেষ্টা করি। মা, বাবাও চেষ্টা করে। তবে তার জেদের কাছে সবকিছু হার মানে। ভেবেছিলাম তার বাবার বাড়ি যাচ্ছে। সকালে গিয়ে নিয়ে আসব। তাই বেশিক্ষণ আর বাঁধা দিইনি। কারণ রাগের মধ্যে কী করে বসে সে ভয়ে।”
এরপর তিনি লম্বা নিঃশ্বাস নিলেন। বিষাদের আর্তনাদ তার চোখে লাল হয়ে দেখা দিয়েছে। কেবল সেটা অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়ছে না। কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বললেন
“ফোনে শতবার কল দিয়েছি। ফোন বন্ধ ছিল। সকাল পর্যন্ত আর অপেক্ষা করিনি। রাতেই ছুটে যাই আজুমানের বাসায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারি আনজুমান সেখানে যায়নি। এরপর অনেক খুঁজ করেছি৷ সম্ভাব্য সকল জায়গায় তাকে খুঁজেছি। পুলিশ ডায়রি করেছি। তবে তাকে খুঁজে পাইনি। তার পরিবার আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও করে। অবশ্য এটাও জেদ করে মেয়ে হারানোর শোকে করেছিল। আমি জেলে থেকেছি তিনদিন। তিনদিন পর আনজুমান তার বাবা, মা কে চিঠি দিয়ে জানায় সে দেশের বাইরে আছে। আমার সাথে আর সংসার করতে চায় না।
আজুমানের চিঠি পেয়ে মামলা তুলে নেওয়া হয়। আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে কোন দেশে গেছে। কোথায় আছে কেউ কিছু জানায় নি। তার পরিবারও বিষয়টি গোপন করেছে নাকি আদৌ জানে না জানি না। এ যুগে চিঠি দিয়ে সংবাদ দিয়েছে বিষয়টি বেশ এলোমেলো লেগেছিল। তার পরিবারকে দীর্ঘ ৪ বছর নজরে রেখেছি। কিন্তু আশানুরূপ কোনো ফল পাইনি। এরপর কেটে গেল ১৩ বছর। এর মধ্যে আর দেখা পাইনি, খোঁজ পাইনি। বিশ্বাস করি লাশ যেহেতু পাইনি তার মানে সে বেঁচে আছে৷ বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। আমি বিশ্বাসের জোরেই দীর্ঘ ১৩ টা বছর তার জন্য অপেক্ষা করেছি। আরও ১৩শ বছর অপেক্ষা করতে পারব।”
আরাব চৌধুরীর কথা শুনে এতটুকু উপলব্ধি হচ্ছে আনজুমান হয় মারা গেছে নাহয় অন্যত্র সংসার করে সুখে শান্তিতে ঘর করছে। তবে এ মানুষটার মনে গেঁথে যাওয়া ভালোবাসা এখনও তাজা হয়ে আছে। আমাকে এ আজুমানের জায়গাটা দখল করতে হবে। তার মনে নিজের ভালোবাসা এমন ভাবে গাঁথতে হবে যেন তিনি সব কিছু ভুলে আমাকে ভালোবাসে।।তবে আমার মনের এ কথা গোপনে থাকবে। অভিসারে তার মন জয়ের চেষ্টা চলবে। আমি আবারও তার দিকে তাকালাম। লাল চোখগুলো আরও লাল হলো। গলা খাঁকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল। এরপর আমাকে বলল
“তোমার যা লাগবে নির্দ্বিধায় আমার কাছে চায়বে। আমি সব দিব। ”
আমি কেবল বিড়বিড় করে বললাম
“আপনার মন লাগবে।”
তিনি আমার বিড়বিড় শুনে আবারও জিজ্ঞেস করলেন
“কী বললে?”
আমি কিছু বলতে যাব। ঠিক তখনই কারও উপস্থিতি টের পেলাম। সাথে সাথে পরিবেশটা বদলে গেল।
চলবে।