বেহালার সুর পর্ব-০৩

0
1

#বেহালার সুর
#পর্ব-৩
#শারমিন আঁচল নিপা

চুলোগুলো খাটো। ঘাড় অবধি কাটা। গায়ের গড়ন মাঝারি। গায়ের রঙ ফর্সা। পরনে একটা জিন্স আর টপস পরা৷ বেশ পরিপাটি হয়ে সাজা একজন মহিলা। তার সাথে দুজন বাচ্চা মেয়ে এসেছে৷ আমার তো প্রথমে বুকটা ধুক করে উঠেছিল। ভেবেছিলাম বাংলা সিনেমার মতো আমার আগমনের বার্তায় আনজুমানের আগমন ঘটল। আরাব চৌধুরির মুখের এক্সপ্রেশন হুট করে বদলে যাওয়ায় এমন ভাবতে বাধ্য হয়েছি। কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছি না। মনের ভেতর দহনের দাবদাহ বাড়তে লাগল। বুঝে উঠার আগেই মহিলাটা বলে উঠলেন

“আরাব কেমন আছো তুমি? অনেক বছর আমাদের যোগাযোগ নেই। তোমাকে খুব মিস করেছি। দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পর ব্যস্ততায় আর কারও সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ হয়নি৷ এরপর দেখো আমার ভাগ্য, আমার মোবাইলটাও হারিয়ে যায়। যার ফলে দেশের সব কাছের মানুষগুলোর নম্বরও চলে যায়। খুব চেষ্টা করেছি তোমার সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু বাচ্চা হওয়ায় তাদের লালন পালন নিয়ে এতটা বছর পার করে ফেললাম। যোগাযোগ আর হলো না।”,

মহিলার কথা শুনে আমার বুকটা আরও বেশি কাঁপতে লাগল। সবকিছুই আনজুমানের সাথে মিলে যাচ্ছে। বুকের কাঁপুনিতে শরীরের লোমও কাটা দিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি দমটা বন্ধ হয়ে যাবে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম অভিসারে বসে আছে। বিষাদের সাগরে ডুবে যেতেই নিব এমন সময় আরাব চৌধুরি বলে উঠলেন

“আরে সুইটি না? তোর খোঁজ খবরও নেওয়ার ভীষণ চেষ্টা করেছিলাম। একটা মাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলি তুই। তোর ইমেইলে কত মেইল করেছি। বাহ্ দুই বাচ্চার মাও হয়ে গেলি৷ তা দেশে আসলি কবে?”

আরাব চৌধুরির কথা শুনে আমার ভেতরটায় স্বস্তি নেমে আসলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস টেনে ছাড়লাম। বুঝতে পারলাম মহিলাটার নাম সুইটি আর উনি আরাব চৌধুরির এক সময়কার বান্ধবী। আমার ভেতরটা শীতল লাগছে। শরীরও এখন হালকা লাগছে। আরাব চৌধুরির কথার পৃষ্ঠে সুইটি বলে উঠলো

“আর বইলো না সব ভুলে গিয়ে বসে ছিলাম। তাই নতুন ফোন নিয়ে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। তোমার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেও তোমার নম্বর জোগাড় করতে পারিনি। এসেছি গতকাল। এসেই তোমার খোঁজ নিতে চলে আসলাম। গতকাল এসেছিলাম জানতে পারি তুমি গ্রামে গিয়েছো। আজকে খবর পেলাম তুমি ফিরেছো। তাই দেরি না করেই চলে আসলাম। তা তোমার সবকিছু কেমন যাচ্ছে?”

আরাব চৌধুরি স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল

“চলছে কোনোরকম। তুই কী মেয়েদের নিয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলবি নাকি এক জায়গায় স্থির হয়ে বসবি। আর কী খাবি বল? বাচ্চারা কী খাবে? আমি বাইরে থেকে অর্ডার করছি।”

সুইটি হেসে একপাশে সোফায় বসলো। বাচ্চদের ও বসালো। দুটো ফুটফুটে জমজ বাচ্চা। বয়স আনুমানিক ১৫ বছর হবে। মেয়েগুলো বেশ চুপচাপ। একদম মায়ের বিপরীত। মা আর মেয়ের উপস্থিতিতে মনে হচ্ছে সাগরের শান্ত ঢেউ আর জ্বলোচ্ছাস একসাথে বসে আছে৷ সুইটি আরও একটু হেসে বলল

“ধুর ব্যাটা বাইরে থেকে অর্ডার করে খাব কেন? ভাবীর হাতের রান্না খাব। ভাবী যা রান্না করবে তাই খাব।”

ভাবী শব্দটা শুনে আমার বুকে আবারও ব্যথা হতে লাগল। যতবারেই আমি আরাব চৌধুরির সাথে কাউকে মিলাচ্ছি ততবারেই আমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। আবারও আগুনের লাভা যেন বুকে এসে জ্বলুনি দিচ্ছে। পরক্ষণেই সেটা বরফের স্পর্শ পেয়ে যেন শীতল হয়ে গেল। কারণ সুইটি গড়গড় করে বলতে লাগল

“আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি আবার বিয়ে করেছো। আমি তো দেশে এসে তোমার এ কাহিনি শুনে একদম হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আনজুমানের বিষয়টা আমাকে ভীষণ অবাক করেছিল। কিন্তু কাল রাতেই জানতে পারলাম তুমি গ্রামে আবার বিয়ে করেছো। যাকেই বিয়ে করেছো মন থেকে তার জন্য দোয়া। আমি চাই তুমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসো। যাইহোক ভাবী কোথায়?”

সুইটির কথা শুনে আমার বুকে ভালোবাসার কম্পন উঠতে লাগল। এত অল্প সময়ে কারও প্রতি এত দুর্বলতা আসতে পারে সেটা নিজেকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। সুইটির কথার পাল্টা জবাবে আরাব চৌধুরি বলে উঠল

“সুইটি যা শুনেছিস ভুল শুনেছিস। এমন কিছুই না। একটা মেয়ে বিপদে পড়েছিল আমি তার ভাত, কাপড়, যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নিয়েছি। এটাই বিয়ে বলে রটেছে।”

এরপর আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল

“ঐ যে মেয়েটা বসে আছে। মেয়েটার নাম আয়েশা৷ ওর বাবা মারা গিয়েছে৷ তাই ওর সমস্ত খরচের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। বিয়ে টিয়ে কিছু না। এত বাচ্চা মেয়ে কী আবার বউ হবে নাকি। আর তা বাদে আনজুমানের জন্য আমি এখনও অপেক্ষা করছি। আনজুমান হয়তো হুট করেই তোর মতো ফিরে আসবে। তুই এত বছর পর ফিরে এসেছিস৷ সেও আসবে। আশার আলোটা আরও বেড়ে গেল। আর আয়েশা আজকেই এ বাসায় আসলো। আয়েশার হাতের রান্নাও ভালো। তবে এ মুহুর্তে সে রান্না করার মতো অবস্থায় নাই। তুই কী খাবি বল আমি অর্ডার দিয়ে নিচ্ছি।”

সুইটি আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালো। বেশ কিছুক্ষণ আমাকে পরখ করল। বিড়বিড় করে কিছু একটা মনে মনে বলল। তারপর আরাব চৌধুরির দিকে তাকিয়ে বলল

“খাব না আপাতত কিছু। আজকে আমি উঠলাম। আবার পরে দেখা হবে। মেয়েদের নিয়ে বসায় যাই আপাতত। এরপর একা এসে আড্ডা দিয়ে সবকিছু শুনব। তোমার বিয়ের সংবাদ শুনে মেয়েদের কোথাও রেখে আসার সুযোগ না পেয়ে নিয়েই চলে এসেছি। বেশিক্ষণ আড্ডা দিলে ওরা বোর হবে। ”

আরাব চৌধুরি হালকা হেসে পকেট থেকে দুই বান্ডেল টাকা দুটো মেয়ের হাতে দিয়ে বলল

“মামনিরা এটা মামার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য গিফট। তোমাদের নাম কী?”

শান্ত সুরেই দুটি মেয়ে উত্তর দিল

“আয়রা, টায়রা।”

টাকাগুলো মেয়েরা নিতে ইতস্তত করলেও সুইটির ইশারায় তারা শেষ অবধি স্বাভাবিকভাবেই নিল। এরপর সুইটি মেয়ে দুটো নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। তাদের কথোপকথনে এটা আমি বুঝতে পারলাম আরাব চৌধুরির মনে আমার জন্য বিন্দু মাত্র ভালোবাসা নেই যা আছে তা কেবল দয়া। সুইটি যাওয়ার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম

“আমি তো আপনার স্ত্রী হই। তাহলে আপনার ফ্রেন্ডকে কেন সেটা খোলাসা করে বললেন না? কাগজে পত্রে আল্লাহর দরবারে আমি তো আপনার স্ত্রী।”

আরাব চৌধুরি আমার দিকে তাকিয়ে নমনীয় গলায় উত্তর দিল

“আমি তোমাকে আমার স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে তোমাকে অসম্মান করতে চাই না। সবাই ভাববে আমি তোমাকে টাকা দিয়ে কিনে এনে বিয়ে করেছি। টাকার গরমে কচি একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি। আর তোমাকে সবাই জাজ করবে লোভী হিসেবে। ভাববে টাকার লোভে আমাকে বিয়ে করেছো। কী দরকার সমাজের বাইরে গিয়ে একটা অসম সম্পর্ককে স্থাপন করার। আর আমাদের তো প্রেমের বিয়ে না। দূর্ঘটনার কবলে পড়ে বিয়ে। এ বিয়েতে তোমারও মত ছিল না। শুধু গ্রামের টক্সিক মানুষের তোপে পড়ে বিয়ে হয়েছে। তাই এ বিয়েটাকে প্রতিষ্ঠিত না করায় উত্তম।

যাইহোক অনেকটা সময় পার হয়েছে। আমি সোনিয়াকে বলছি তোমার ঘরটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। সে ঘরের আলমারিতে তোমার জন্য কাপড় রাখা আছে পড়ে নিও। আসার সময় রাস্তায় বসেই সবকিছুর জোগাড় করেছি তোমার জন্য। আন্দাজে সাইজ বলে কাপড়গুলো আনা। ফিট হয় কি’না দেখে নিও। আর খাবার কী খাবে বলো। সোনিয়া সেটা বানিয়ে দিবে।”

আরাব চৌধুরির নমনীয় গলায় আমি আবারও গলে গেলাম। আমার প্রতি তার এ দায়িত্ব আমাকে আবারও তার প্রতি দুর্বল করতে লাগল। আসার আগেই আমার জন্য সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা আমাকে আরও মুগ্ধ করলো। আবার বসন্ত বইতে লাগল চারপাশে।

আমি সোনিয়ার সাথে আমার রুমে গেলাম। সেখানে আলমিরা থেকে একটা কাপড় বের করলাম। সোনিয়া আমাকে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিল। তবে গ্রামের মেয়ে আধুনিক ওয়াশরুম ব্যবহারে তেমন পটু না। কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছিলাম কীভাবে এর সমাধান করব। সোনিয়াকে বলতে ভীষণ লজ্জা লাগছিল। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম স্বামীকে তো সব বলা যায়। আমি সোনিয়াকে বললাম

“আপু একটু গিয়ে উনাকে ডাক দিবেন?”

সোনিয়া হালকা গলায় উত্তর দিল

“জি ম্যাডাম বলছি।”

সোনিয়া চলে গেল আরাবকে ডাকতে। আমি আরাবকে আর এ নামে ডাকতে চাই না। এত বড়ো একটা মানুষকে নাম ধরে ডাকা যায় না। আবার ওগো, তাগো বলে ডাকাও যাবে না। তাই উনার একটা সুন্দর নাম দিয়েছি সেটা হলো সুর। উনি আমার বেহালার সুর।

আমি ওয়াশরুমে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। এর মধ্যেই সুর এসে আমার দরজায় কড়া নেড়ে ভেতরে প্রবেশ করল। আমি ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে উনাকে বললাম

“আধুনিক এ ওয়াশরুমগুলো আমি কখনও ব্যবহার করিনি। গ্রামে কলে অথবা পুকুরে গোসল করেছি। আমি এ ওয়াশরুমের কিছুই বুঝতে পারছি না। যদি একটু শিখিয়ে দিতেন? সোনিয়াকেও নিজের অজ্ঞতার কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। আর শুনেন আপনাকে তো নাম ধরে ডাকতে পারব না তাই আপনার একটা নাম দিয়েছি। আপনাকে আমি সুর বলে ডাকব। বেহালার সুর আপনি। আমার করুণ সময়ে সুরের ছন্দ হয়ে আমার জীবনে এসেছেন। তাই এ নাম দেওয়া”

আমার চঞ্চলতা দেখে সুর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর ওয়াশরুমে এসে আমাকে সবকিছু সুন্দর করে বুঝাচ্ছিল। আমি তার কথা মতো একটি কল ওপেন করতেই উপর থেকে পানি ঝড়নার মতো পড়ে আমাকে আর সুরকে ভিজিয়ে দিল। এক মাদকতা যেন আমাকে মাতাল করে তুলল। সে মাদকতায় মাতাল হয়ে একটা ভুল আমি করে বসলাম।

….