#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৪
আমি সুরকে জোরে জড়িয়ে ধরলাম। দুহাতের মুষ্টি দিয়ে তার পিঠে এতই জোরে ধরলাম যে নখ দুটো বসিয়ে দিয়েছি। জানি না আমার কী হলো। ছোটোবেলার বদঅভ্যাসটা আমাকে ঝেঁকে ধরল। আমি যখন খুব বেশি এক্সসাইটেড হয়ে যাই বা রেগে যাই তখন আমার দাঁত কিড়মিড় করে। আমি তখন কামড় দিয়ে বসি। এবারও কী মনে করে যেন সুরের বাহুডোরে আমি জোরে কামড় দিয়ে বসলাম। আমি কামড় দিয়ে কিড়মিড় করতে লাগলাম। সুরের কন্ঠধ্বনিতে আমার হুঁশ ফিরল। সে অস্বস্তি নিয়ে বলতে লাগল
“আয়েশা কী করছো কী?”
সুরের কথা শুনে নিজের ভুলটা আমি বুঝতে পারলাম। নিজের আত্মসম্মানকে এভাবে বিকিয়ে দিয়ে ভালোবাসা নামক শব্দটাকে অপমান করা উচিত হবে না৷ এ মুহুর্তে নিজেকে এভাবে লেলিয়ে দেওয়াটা হবে সবচেয়ে বোকামি। তাই সুরকে কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না এটা আমার আবেগের বিস্তরণ। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে হাত, পা কাঁপিয়ে সুরের দিকে তাকিয়ে দাঁত জোড়া কিড়মিড় করে ঘনঘন দম নিয়ে লাগলাম। বুঝাতে লাগলাম আমার দম নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমার সারা শরীর ইচ্ছা করেই মৃগি রোগীদের মতো কাঁপাতে লাগলাম। সুরও আমার এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল। সে আমাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুয়ালো। এরপর সোনিয়াকে ডাকতে লাগল। সোনিয়া এসে আমাকে এ অবস্থায় কাঁপতে দেখে সুরকে বলল
“স্যার মেডামের মনে হয় মৃগি বেরাম আছে। মৃগি রোগীরা এভাবে কাঁপে। আমগো গ্রামে জুতার ঘ্রাণ শুকাইতো এসব রোগীদের। আমি কী জুতা আনব? তাহলে ম্যাডামের নাকে ধরলে ম্যাডাম ঠিক হয়ে যাবে।”
সোনিয়ার কথা শুনে আমি নিজেকে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক করতে লাগলাম। এ অবস্থায় জুতার ঘ্রাণ শুকার মতো ধৈর্য আমার হচ্ছে না৷ এ ছোটো ভুলের এত বড়ো শাস্তি নিজেকে দিতে পারব না। এদিকে সোনিয়ার কথা শুনে সুর ধমক দিয়ে বলল
“বাজে কথা বলা বন্ধ করো। এত বেশি কথা কেন বলো? চুপচাপ এসে আয়েশার পাশে বসে আয়েশাকে দেখো। আমি ডাক্তার আনতে গেলাম।”
সুরের মুখে ডাক্তার আনার কথা শুনে আমার ভেতর এবার সত্যি সত্যি কাঁপতে লাগল। ধরা পড়ে গেলে লজ্জায় এ মুখ কীভাবে দেখাব সেটাই ভাবছি। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে এরপর বড়ো কোনো রোগ হলেও তিনি বিশ্বাস করবেন না। একটা মিথ্যা ঢাকতে কতগুলো মিথ্যার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। ডাক্তারের থেকে তো জুতার ঘ্রাণ শুকায় শ্রেয় মনে হচ্ছে। সুর সোনিয়াকে আমার পাশে বসিয়ে রুম থেকে বের হলো।
রুম থেকে বের হতেই আমি নিজেকে স্বাভাবিক করলাম। হঠাৎ করে আমাকে এভাবে সুস্থ হতে দেখে সোনিয়া বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল। বিস্ময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল
“ম্যাডাম আপনি ঠিক হয়ে গেছেন? এখন কী ভালো লাগছে? একটু আগেই তো খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন।”
আমি সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে মুখটাকে হালকা বাঁকিয়ে বললাম
“ঠিক না হয়ে উপায় আছে? তুমি আমাকে জুতার ঘ্রাণ শুকাতে চাচ্ছ। তোমার সাহেব আমাকে ডাক্তার এনে ইনজেকশন দিতে চাচ্ছে। এত সব ট্রেজেডির কথা শুনে রোগ নিজেই ভয় পেয়ে অক্কা বুল বুল বলে পালিয়েছে।”
সোনিয়া আমার কথা শুনে জোরে হেসে দিল। হাসির রেশটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে থাকল তারপর আবারও মুখটাকে মলিন করে ফেলল। তার এ অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ বড়ো ভুল করে ফেলেছে। নিজের অপরাধী চোখ দুটোকে আমার দিকে তাক করে বলল
“ম্যাডাম আপনার কথা শুনে ভুল করে হেসে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না। এ বাড়িতে আসার পর হাসতেই ভুলে গিয়েছিলাম। একটা মানুষ আমি সারাদিন কাজ করি। একা থাকি। কারও সাথে কথা বলার সুযোগ পাই না৷ আর স্যার তো সবসময় গম্ভীর মুখ করে থাকেন৷ প্রয়োজনের বাইরে একটা কথা বলেন না। আজকে মনে হলো কারও সাথে একটু মন খুলে হাসলাম। প্লিজ ম্যাডাম রাগ করবেন না।”
আমি সোনিয়ার কথা শুনে তাকে অভয় দিয়ে বললাম
“রাগ করিনি। তবে তুমি যদি আমার কথামতো চলো তাহলে তোমাকে আমি স্নেহ করব, মায়া করব, শ্রদ্ধাও করব যেহেতু বয়সে আমার বড়ো তুমি। আর যদি আমার কথার বরখেলাপ করো তাহলে আমি শক্ত হব। এখন তুমি চিন্তা করো তুমি কী করবে?”
সোনিয়া আমার হাতটা ধরে বলল
“ম্যাডাম আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনব।”
আমি হালকা হেসে তার কানে কানে ফিস ফিস করে শিখিয়ে দিলাম সুর আসলে কী জবাব দিবে।
এর মধ্যেই সুর ঘরে প্রবেশ করলো। তার চোখেমুখে, কপালে চিন্তার ভাঁজ। মুখটা শুকিয়ে আছে। ঘরে ঢুকেই আমাকে সুস্থ অবস্থায় দেখে তিনি বেশ চমকালেন। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
“তোমার শরীর ঠিক হয়ে গিয়েছে? এত দ্রূত সুস্থ হয়ে গিয়েছো? আমি তো ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
পাশ থেকে সোনিয়া আমার কথা মতো বলে উঠল
“স্যার বলেছিলাম না ম্যাডামের মৃগি বেরাম হয়েছিল। দেখুন সত্যিই মেডামের মৃগি বেরাম হয়েছিল। আমি জুতা শুকাতেই ম্যাডাম ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
সুর সনিয়াকে ধমক দিয়ে বলল
“আজেবাজে কথা বন্ধ করো তো। ঝড়ে বক মরলো আর সাধুবাবার কারসাজি হয়ে গেল তাই না? এসব অদ্ভুত কথা বলবে না আর।”
আমি সুরের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম
“আরে আপনি শুধু শুধু তাকে বকতেছেন। সত্যিই জুতা শুকানোর পর আমি সুস্থ হয়ে যাই। এগুলো অনেক পুরনো টুটকা। গ্রামের মানুষ এগুলো ভীষণ মানে। আর কাজেও দেয় ”
সুর আমার দিকে তাকাল। কপালটা রাগে ভাঁজ হয়ে আছে৷ তবে কণ্ঠে নমনীয়তা। আমাকে মোলায়েম গলায় বলল
“তুমি তো শিক্ষিত মেয়ে। তুমি কীভাবে এরকম অবৈজ্ঞানিক কথা বলছো? পড়াশোনা করে এসব শিখতেছো? গ্রামে অনেক কুসংস্কার বিশ্বাস করে। আর এগুলো মানেও তারা। কারণ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত । তারা বুঝে না কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। সোনিয়া নাহয় তেমন শিক্ষিত না তাই বুঝে নি৷ তুমি কীভাবে শিক্ষিত হয়ে এমন কথা বলছো? অসুস্থ হয়েছো হুট করে ঠিক হয়ে গিয়েছো। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তবে তোমার মধ্যে অসুস্থতা আছে। সুতরাং সন্ধ্যার পর ডক্টর দেখাতে নিয়ে যাব। আমার সাথে যাবে। তোমার সবকিছুর দায়িত্ব আমার। আর আমি দায়িত্ব পালনে একদম অবহেলা করি না। যাও শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও। আমি তোমাকে নতুন করে আবার কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিব কিছুদিনের মধ্যে। ”
এরপর সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
“আর তুমি কখনও আয়েশার সামনে এসব উদ্ভট কথা বলবে না। এখন গিয়ে রান্নাঘরে খাবার রান্না করো।”
কথাগুলো বলে তিনি বের হয়ে গেলেন। সোনিয়া মন খারাপ করে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সোনিয়ার মাথায় হাত দিয়ে বললাম
“হেই সোনিয়া মন খারাপ করে তুমিও অক্কা বুল বুল হয়ে যাচ্ছো নাকি?”
সোনিয়া আমার কথা শুনে জোরে হেসে দিয়ে বলল
“না ম্যাডাম মন খারাপ করিনি। আপনি থাকলে মন খারাপ করে থাকা যাবে নাকি৷ উঠি… রান্না করতে যাই। আপনি ফ্রেশ হোন। নাহয় স্যার রাগ করবে।”
সোনিয়া চলে গেল৷ আমি বিছানা থেকে উঠে শাওয়ারে গেলাম। চোখে শুধু সুরকে ভাসছে। তার চোখ, নমনীয় কন্ঠ, মোলায়েম ঠোঁট আমার চোখ দুটো বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে। আমি নিজেকে বেশ সংযত করে গোসল শেষ করে বের হলাম।
এরপর খেয়ে নিলাম কিছু। রান্না ঘর থেকে একটা ছুরি এনে বিছানার বালিশের নীচে রাখলাম। সবসময় নিজেকে শক্ত দেখাতে হবে। পুরুষ মানুষ যত সাধুই হোক ঠিকই স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবে। আর সেটা কোনোভাবেই সহজে দেওয়া যাবে না। আমাকে যেভাবে পুড়াচ্ছে আমিও সেভাবে পুড়িয়ে খাটি করে নিজেকে বিলিয়ে দিব, উজার করে দিব৷ এর আগে না। এসব ভাবতে ভাবতেই আমার চোখে ঘুম এসে ঝেঁকে ধরল। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টের পাইনি।
একটি মোলায়েম হাতের স্পর্শে আমার ঘুম ভাঙ্গতে লাগল। কপালে শীতলতা অনুভব করলাম। চোখ দুটো টেনে টেনে তাকিয়ে দেখলাম সুর আমার পাশে বসা। তাকে বসে থাকতে দেখেই মনে হচ্ছে সে এখন আমার কাছে স্ত্রীর অধিকার চাইবে। কিন্তু আমি তো তা হতে দিব না। তাই ঝট করে উঠে বালিশের নীচ থেকে ছুরিটা বের করে তার দিকে তাক করে বললাম
“একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করলেই খুন করে দিব।”
আমি বেশ সিরিয়াস মুড নিলাম চোখেমুখে। আমার এ অবস্থা দেখে সুর আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাতে ধরা ছুরিটা আমার হাতের কব্জি ধরে হাত বাঁকিয়ে বলল
“আমি যদি তোমাকে ছুতে চাই তাহলে ছুরি কেন রাম/দা নিয়ে বসলেও ছুতে পারব। বাংলা নাটক বেশি দেখা হয়? তাই বাংলা নাটকের মতো কাহিনি করতেছো। আমাকে এসব ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এটা বাস্তবতা। আমি যেহেতু বলেছি তোমাকে অসম্মান করব না, সেহেতু কখনও যদি তোমার প্রতি আমার পুরুষত্ব জেগেও উঠে আমি সেটা দমন করেই রাখব। সুতরাং নিশ্চিন্তে থাকো। বালিশের নীচে ছুরি রাখার দরকার নেই। আমি এসেছিলাম তোমাকে দেখতে। অনেকক্ষণ ডাকার পরও উঠছিলে না তাই কপাল ধরে কেবল দেখছিলাম ঠিক আছো কি’না। যাইহোক তৈরী হয়ে নাও। ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব।”
আমি ঢুক গিললাম। এরপর হালকা ভাবে কেবল মাথা ঝাঁকালাম। সুর বের হয়ে গেল। আমি মাথা আঁচড়িয়ে একটু পরিপাটি হয়ে নিলাম। এমন সময় আয়নায় দাঁড়িয়ে বাবার কথা ভীষণ মনে পড়তে লাগল। আমার দহন বাড়তে লাগল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে কাপড় পড়ে সুরের সামনে গেলাম৷ কিন্তু এখানে এসেও যে এত বড়ো অঘটনের সম্মুখীন হব কে জানত?
….