#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৫
সুর আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলল
“তুমি কী এভাবে যাবে?”
আমি কপালটা কুচকে উত্তর দিলাম
“কেন এভাবে গেলে কী সমস্যা? ভালো লাগছে না আমাকে? ড্রেস তো আপনিই কিনে দিয়েছেন। ফিটও হয়েছে। আর আমি তো একটু ঢিলাঢালা জামা পরতে পছন্দ করি৷ নিজের কেনা ড্রেস এখন নিজেই পছন্দ করছেন না?
তিনি কিছুটা রাগী গলায় জবাব দিলেন,
“এত বাজে বকো কেন তুমি? আমি তোমার ড্রেস ফিট নিয়ে কিছু বলছি না। তুমি কী এভাবে সালোয়ার উল্টো পরে বের হবে? তুমি সালোয়ার উল্টো পরে আছো। আর দুই পায়ে দুইরকম জুতা পরে আছো।”
উনার কথা শুনে আমি আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় নুইয়ে পড়লাম। অসম্ভব অস্বস্থি আমাকে ঘিরে ধরল। শরীর কাঁপতে লাগল। সে সাথে নিজের উপর রাগও উঠে গেল। যতই আমি নিজেকে স্বাভাবিক আর শান্ত রাখার চেষ্টা করছি ততই আমি আবেগে নুইয়ে একের পর এক ভুল করে নিজেকে হ্যাংলা বানাচ্ছি। চোখ টলমল করছে আমার। নিজেকে সামলে উত্তর দিলাম
“শরীর খারাপ লাগছিল তো তাই কীভাবে কাপড় পরেছি খেয়াল নেই। আমি এখনই কাপড় ঠিক করে বের হচ্ছি। আপনি ৫ মিনিট অপেক্ষা করেন।”
এরপর ঘরে এসে পুনরায় কাপড় পরিবর্তন করে উনার সাথে বের হলাম। বাসা থেকে বের হয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। ড্রাইভার এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। পেছনের দরজাও খুললো আবার সামনের দরজাও। আমি কোথায় বসব বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলাম৷ এমন সময় ভালোবাসার নির্মল হাওয়ার মতো কানে ভেসে আসলো কণ্ঠধ্বনি
“আয়েশা সামনের সিটে বসো।”
এরপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে সুর আবারও বলল
“তোমাকে ড্রাইভ করতে হবে না। আমি নিজেই ড্রাইভ করব।”
উনার এ কথা শুনে আমার বুকের ভেতরের স্পন্দন দ্রূতগতিতে বাড়তে লাগল। শরীরটা হালকা কাঁপুনি দিল। আমি লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়িতে উঠলাম। পাশেই উনি বসে গাড়ি চালাচ্ছে। আমি চুপ হয়ে বসে আছি। উনি কথা শুরু করলেন
“আয়েশা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তুমি জানো?”
আমি স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলাম
“কেন? ডাক্তারের কাছে।”
তিনি পাল্টা জবাব দিয়ে বললেন
“তোমাকে উকিলের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি। এভাবে একটা সম্পর্কের ফাঁদে তোমাকে আটকে রাখার অধিকার আমার নেই। উকিলের সাথে কথা বলে আমাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব। এরপর তোমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিব। তোমার চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমি তোমার সকল খরচ বহন করব। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে যা করতে হয় আমি করব। এমনিতে তোমার সাথে আমার বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি। তোমার আবেগ বেশি। আমি পুরুষ মানুষ, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আমার আশেপাশে থাকলে আমি নিজেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারি। এটা তো সিনেমা না যে এক ঘরে থাকলে আমাদের মাঝে কিছু হবে না। হয়তো কোনোদিন তাল হারিয়ে কিছু একটা করে বসলাম। তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আনজুমানের কাছেও আমি অপরাধী হয়ে যাব। তাই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া। আশাকরি তুমি এতে খুশি।”
কথাগুলো বলে উনি থামলেন। আমি চুপ করে রইলাম। আমার শরীরটা ভীষণ কাঁপছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ বুকে চাপ দিয়ে ধরে আছে। তিনি আবারও বলে উঠলেন
“চুপ কেন? উত্তর নেই কেন ?”
আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে উত্তর দিলাম
“সিদ্ধান্ত তো সব আপনি নিয়েই নিয়েছেন। এখানে তো আমার কিছু বলার নেই। আপনি চেয়েছেন বিয়ে হয়েছে। আপনি চাইবেন ডিভোর্স হবে। আমি আর কী বলব। বিয়েতে আমার মত ছিল না তারপরও বিয়ে হয়েছে। ডিভোর্সেও আবার মত নেই তারপরও ডিভোর্স হবে। এখানে আমার বলার কিছু নেই।”
তিনি আমার কথা শুনে গাড়িটা থামালেন। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
“ডিভোর্সে মত নেই কেন?”
আমার চোখ দিয়ে ততক্ষণে পানি পড়তে লাগল। আমি কিছুটা কান্না করেই উত্তর দিলাম
“বিষয়টা এমন না আপনাকে আমি ভালোবাসি, আপনাকে ছাড়া বাঁচব না। তবে আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি খারাপ সময়টায় আমাকে উদ্ধার করেছেন। নাহয় মহসীনের মতো লম্পট ছেলেকে আমার বিয়ে করতে হত। তবে বিয়ে হয়েছে নিয়তি বলে মেনে নিয়েছি। এখন বিয়ে হতে না হতেই ডিভোর্স। এত দ্রূত পরপর দুটো সিদ্ধান্ত আমার জন্য কতটা ভালো হবে সেটা আমি জানি না। আজকে আমার বাবা বেঁচে থাকলেও হয়তো চায়তো না আমাদের ডিভোর্স হোক। আমি নাহয় অসম একটা সম্পর্কেই আবদ্ধ থাকলাম। যখন মনে হবে আমি আর পারছি না তখন আলাদা হলাম। এখনও একটা সম্পর্কের মানে বুঝে উঠতে পারলাম না তাহলে সে সম্পর্ক কী করে আমি শেষ করে দিই বলুন?
আমাকে দুটো সম্পর্কের ফারাক বুঝতে দিন। আমি বিয়ে, বিয়ে খেলা চাই না। আজকে বিয়ে কালকে ডিভোর্স এটা আমার কাছে অপমানজনকেই লাগছে। সিদ্ধান্ত নিতে হলে উভয়পক্ষের পরামর্শে নিতে হয়। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় আমি হোস্টেলে গিয়ে কী করব? কতটা নিরাপদে থাকব বলুন?
আমি বলছি না আপনাকে আমি ভালোবাসি। তবে আমি এ সম্পর্কের জন্য একটু সময় চাই। আমরা একটা চেষ্টা করতে পারি। যদি দেখি আমাদের মাঝে সবকিছু সুন্দর করে এগুচ্ছে তাহলে আমরা সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিব। আর যদি দেখি সবকিছুতেই এ সম্পর্কটা বাঁধা দিচ্ছে তাহলে আমরা নাহয় সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে বের হলাম। আপাতত নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে চলি এটাই ভালো নয় কী?”
আমার কথা শুনে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
“আয়েশা তুমি আমার দুই, তিন দিনের আমাকে চেনো। পুরো আমিটাকে চেনো না। আমার জীবন অন্ধকার অধ্যায়ের সাথে জড়িত। তুমি যতটা ভালো মানুষ আমাকে মনে করছো। আমি ঠিক ততটাই কঠিন এবং খারাপ। যে সম্পর্ক আজকে তুমি জিইয়ে রাখতে চাচ্ছ। এ সম্পর্কটায় তুমি পরশু ভাঙতে চাইবে। তবে তখন আমি তোমায় মুক্তি দিব না। এখন তোমাকে দুটো অপশন আমি দিব। এক তুমি কী আমার সাথে নামে মাত্র এ সম্পর্কে থাকতে চাও নাকি চাও না। দুই যদি থাকতে চাও তাহলে পরবর্তীতে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে আমার মতের বিরুদ্ধে তুমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।”
আমি উনার কথার জবাবে বলে উঠলাম
“আমি আপনার সাথে দূরত্ব বজায় রেখে এ নামে মাত্র সম্পর্কে নিরাপত্তার জন্য থাকতে চাচ্ছি আপাতত। পরে যদি মনে হয় আপনার সাথে আমি থাকতে পারব না তাহলে আপনার সম্মতি নিয়েই আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিব। আর আমাদের কেবল সম্পর্কের নামেই থাকবে স্বামী স্ত্রী। কেউ কারও কাছে অধিকার চাইবো না। আপনি আপনার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে যা করা লাগে করুন। যদি কখনও সে ফিরে আসে তাকে নিয়ে বাকি জীবন পার করবেন। আমার এতে কোনো আপত্তি থাকবে না। আমি নিজ থেকেই সরে যাব।”
আমার কথা শুনে তিনি উত্তর দিলেন
“তুমি এখন তোমার ওয়াদায় বাঁধা। আমি তোমাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলাম। তুমি সেটা কাজে লাগাতে পারো নি। এ সম্পর্কের বেড়াজাল কতটা নির্মম ভয়ংকর সেটা তুমি বুঝতে পারবে। আর আনজুমান কখনও ফিরে আসবে না।”
আমি উনার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
“আনজুমান কেন ফিরে আসবে না?”
“কারণ মৃত মানুষ কখনও ফিরে আসে না।”
বিস্ময় নিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম
“কিন্তু আপনি তো বললেন সে জীবিত। দেশের বাইরে আছে।”
আমার কথার প্রেক্ষিতে তিনি উত্তর দিলেন
“যাকে আমি নিজের হাতে খু/ন করেছি সে কী করে জীবিত হয়? তাকে আমি সবার কাছে জীবিত প্রমাণ করে রেখেছি যাতে করে আমার উপর কারও সন্দেহ না আসে। দীর্ঘ তেরো বছর সে মৃত জেনেও আমি অপেক্ষা করছি তার জন্য। এটা কেবল একটা নাটক। আমি বললাম না তুমি আমার উপরটা দেখে গলে গিয়েছো। ভেতরটা চেনো নি ”
উনার কথা শুনে আমার বুক ধরফর করতে লাগল। আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমি কেবল দেখেছি উনি আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্রিভাবে হাসছে৷ এরপর…
চলবে।