বেহালার সুর পর্ব-০৬

0
2

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৬

এরপর আমার হুঁশ ফিরল কারও হাতের স্পর্শে। আর পানির ঝাঁপটায়। আমি চোখ দুটো টেনে তাকানোর চেষ্টা করলাম। চোখ খুলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তবুও সেটা উপেক্ষা করে চোখ খুললাম৷ লক্ষ্য করলাম আমি মেঝেতে পড়ে আছি। উনি আর সোনিয়া আমার পাশে বসা। আমি ভয়ে ভয়ে উনার দিকে তাকাতেই উনি বলতে লাগলেন

“কাপড় পাল্টাতে এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে কীভাবে? কোনো কিছুতে কী আঘাত পেয়েছো?”

আমি অবাক চোখে আরাবের দিকে তাকালাম। সুর নামটায় অনেক আবেগ মিশ্রিত। এ নামটা এখন আর আসছে না আমার মুখে। আমার শরীর কাঁপতে লাগল। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম

“আমি এখানে কী করে আসলাম? আমি আর আপনি তো বাইরে ছিলাম। আমরা তো উকিলের কাছে যাচ্ছিলাম।”

আমার কথা শুনে আরাব আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি যা বলছি সেটা সম্পর্কে সে অবগত না। পাশ থেকে সোনিয়া বলে উঠল

“ম্যাডাম আপনি তো বাসা থেকে বেরেই হন নি। এখানে এসেছিলেন কাপড় আর জুতা পরিবর্তন করতে। অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ায় আমাকে স্যার ডাকতে পাঠায়। এসে দেখি আপনি মেঝেতে পড়ে আছেন। এরপর আমি স্যারকে ডাক দিলে তিনি এসে আপনাকে চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়। আপনি ঠিক আছেন তো?”

সোনিয়ার কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম আমি কাপড় পরিবর্তন করতে এসেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর বাকি যা হয়েছে তা আমার অবচেতন মনের ভাবনা। কিন্তু অবচেতন ভাবনাও এতটা সত্যির মতো কী করে হয়? ট্রেজেডিক লাগছে বিষয়টা অনেক। সোনিয়াকে আরাব বলল

“ম্যাডামের জন্য গ্লুকোজ বানিয়ে নিয়ে এসো। ওর প্রেসার অনেক লো।”

সোনিয়া চলে গেল গ্লুকোজ বানাতে। আরাব মেঝেতেই আমার পাশে বসে আছে। আমাকে কোলে তুলে বিছানায় শুয়ালো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল

“জ্ঞান ফেরার সময় তুমি খুব অস্থির ছিলে। আনজুমানের নামটা বারবার মুখে নিচ্ছিলে। কী হয়েছিল তোমার? এখন ঠিক আছো?”

আমি নিজের ভেতর এত চাপ রাখতে পারলাম না। গা গুলাচ্ছিল প্রচুর। আমি একদমে কিছুক্ষণ আগে আমার কল্পনায় ঘটে যাওয়া বিষয়টা বলে উঠলাম। আমার কথা শুনে আরাবের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। সে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে ধরে আবারও বলল

“সত্যিই কী তুমি এমন কিছু দেখেছো? এটা কী করে সম্ভব? হুবুহু একই রকম বর্ণণা।”

আমি আরাবের কথা শুনে আরও বিচলিত হলাম। বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম

“একই রকম বর্ণণা মানে?”

এরপর আবার গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল

“সোনিয়া এ বাসায় অনেকদিন যাবত আছে। সে কখনও এমন কিছু দেখেনি বা এমন কিছুর সম্মুখীন হয়নি। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক করা বিষয় হচ্ছে আমার বাসায় আমার যত অল্প বয়সী মেয়ে আত্মীয়স্বজন, যার সাথে আমার বিবাহ জায়েজ এবং সুন্দরী। তারা যদি কোনো দরকারে আমার বাসায় এসে থেকেছে সেদিন রাতেই তারা এমন স্বপ্ন দেখে ধরফর করে উঠেছে। সবার কাছে স্বপ্নের মটিভ সেম ছিল। আমাকে খুনী বানানো। এ স্বপ্নে তুমি একটা বিষয় স্কিপ করে গিয়েছো সেটা হলো আমার আর তোমার বিবাহের সিন। যেটা বাস্তবে অলরেডি ঘটে গিয়েছে৷ কিন্তু বাকি মেয়েদের স্বপ্ন শুরু হত আমার সাথে বিয়ের সিন দিয়ে। এরপর আমি তাদেরকে উকিলের কাছে নিয়ে ডিভোর্স দিতে চাইতাম তারা চাইত না৷ এরপর আমি তাদের দুটো শর্ত দিতাম। তারা সেটা মেনে নিত। এরপর আমি বলতাম আমি আনজুমানকে খু/ন করেছি।
এটা কী করে সম্ভব একই রকম স্বপ্ন সবাই দেখেছে। আমার আত্মীয়স্বজন কম। আসার মধ্যে আমার ফুফাতো বোন আর খালাত বোন এসেছিল বাসায়। তারা এসে একদিন করে থেকে এসব বলেই চলে যায়। আমার ধারণা ছিল আনজুমানের হঠাৎ চলে যাওয়া তাদের ভীষণ ভাবিয়েছে তাই তারা এমন স্বপ্ন দেখেছে৷ আর হয়তো প্রথমজন স্বপ্নটা দেখার পর অন্যজনকে বলেছে তাই অন্যজনও সেটা দেখেছে৷ কিন্তু তুমি তো একদম আলাদা মানুষ। তাদের সাথে কানেকশনও নেই৷ বিষয়টি এতদিন আমি মাথায় নিই নি। এখন মনে হচ্ছে এখানে অবশ্যই কোনো কিন্তু রয়েছে। এ বাসায় আসলে কী সবার মানসিক ডিসঅর্ডার হয় কি’না জানি না।

যাইহোক যা দেখেছো এটা তোমার একটা কল্পনা, মতিভ্রম। বিষয়টিকে গভীরভাবে চিন্তা করে নিজের উপর প্রেসার নিও না। তুমি শিক্ষিত + ধার্মিক মেয়ে। দোয়া দুরুদ পড়তে থেকো সবসময়। আর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কষ্ট করতে হবে না। ডাক্তার নিজেই এসে তোমাকে দেখে যাবে। ”

এর মধ্যেই সোনিয়া আমার জন্য গ্লুকোজ বানিয়ে নিয়ে আসলো। সোনিয়া আসতেই আরাব আমার পাশ থেকে উঠে সোনিয়াকে বলল

“ম্যাডামকে গ্লুকোজটা খাইয়ে ওর জন্য দুটো ডিম সিদ্ধ দিয়ে খাইয়ে দিও। ম্যাডামের সকল দায়িত্ব আজ থেকে তোমার। রান্নার জন্য নতুন বাবুর্চি আমি নিয়োগ দিব। সবসময় ম্যাডামের পাশে থাকবে।”

সোনিয়া মাথা ঝাঁকালো। আরাব রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

“একটা সত্যি কথা বলবে?”

সোনিয়া চোখে চোখ দিয়ে সম্মতি দিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম

“তুমি এ বাসায় এসেছো কত বছর যাবত?”

সোনিয়া নম্র গলায় উত্তর দিল

“নয় বছর হবে৷ আমার বয়স যখন ১৩ বছর তখন এসেছিলাম।”

“তখন কী আমার শ্বশুড় শ্বাশুড়ি ছিলেন?”

“হ্যাঁ ছিলেন। তারাই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর উনারা দুজনেই কোভিডে মারা যায়।”

“আরাব চৌধুরি কেমন? খুব কড়া? সোনিয়া তেরো বছর আনজুমান নিখোঁজ। এমনও তো হতে পারে তোমার সাহেব সে মেয়েকে খুন করেছে।”

সোনিয়া আমার কথা শুনে হাসতে লাগল। সোনিয়ার হাসি দেখে আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম

“সোনিয়া হাসির কী আছে এখানে? তুমি এভাবে বোকার মতো হাসছো কেন? আমি তোমাকে সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করেছি।”

সোনিয়া হাসির রেশ কেটে বলল

“ম্যাডাম স্যার তেলাপোকা দেখে ভয় পায়। স্যারের সামনে কারও হাত কাটলে স্যার ভয় পায়৷ রক্ত সহ্য করতে পারে না৷ কুরবানী ইদে স্যার গরুর কুরবানী দেখতে বের হয় না। কারণ এটা তিনি নিতে পারেন না। স্যার বেশ কোমল মনের অধিকারি। আর এ কোমল মনের জন্যই এত বছর এখানে টিকতে পেরেছি। স্যারের মন মানসিকতা অনেক ভালো। আমার পুরো পরিবারের সকল দায়িত্ব স্যার নিয়েছে৷ শুধু আমার না প্রতিটা কর্মচারীকে স্যার অনেক বেশি স্নেহ করেন। এমনিতে অনেক গম্ভীর এবং কথা কম বলে। তবে মনের দিক দিয়ে স্যার অনেক নরম সেটা আমরা বুঝি। যে ব্যক্তি মুরগির রক্ত দেখেই অস্বস্থি অনুভব করে সে কী করে একটা মানুষ খু/ন করবে৷ ম্যাডাম এমন মনে হওয়ার কোনো কারণ আছে?”

সোনিয়ার কথা শুনে আমি একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বুঝতে পারলাম এটা আমার স্বপ্ন ছিল। তবে এটা স্বপ্ন হোক বা বাস্তব। এ স্বপ্ন হয়তো আল্লাহর তরফ থেকে একটা বার্তাও ছিল। কারণ কাউকে না জেনে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না। কারও প্রতি দুর্বলতা বাড়ানো ঠিক না। বয়সে ছোটো হলেও নিজের বুদ্ধি তো আছে। বুদ্ধি দিয়েই আমাকে এগুতে হবে। পরিস্থিতি মানুষকে বাধ্য করে বয়সের তুলনায় বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে। যদি আনজুমানকে খুনের বিষয়টা সত্যিই হয় তাহলে একদিন তা প্রকাশ পাবেই। আর যদি অলৌকিক কিছু হয় সেটাও একটা সময় প্রকাশ পাবে। আমার কেবল এখন নিজের গোল সেট করে সামনে এগুতে হবে। প্রেম ভালোবাসা আবেগ দিয়ে আমার জীবনটাকে নষ্ট না করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আর সে সাথে আনজুমানের রহস্যও উদঘাটন করতে হবে।

আরাবের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে। আমি তার প্রতি দুর্বল। এ দুর্বলতাকে হাতিয়ার বানাতে হবে। আমি সারাদিন আজেবাজে চিন্তা করি বলেই এমন একটা স্বপ্ন আমি দেখেছি৷ কিন্তু আমার আগে আরও দুজন একই স্বপ্ন কী করে দেখল সেটাও ভাববার বিষয়। বিষয়টা কী সত্যিই ভৌতিক নাকি কাল্পনিক নাকি থ্রিলিং। প্রশ্ন থেকেই যায় মনে।

ভাবনায় ছেদ পড়ল সোনিয়ার ডাকে। সে আমাকে ডেকে বলল

“ম্যাডাম খেয়ে নিন। নাহয় স্যার রাগ করবে৷”

আমি লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে গ্লোকোজটা খেলাম। সোনিয়া আমার পাশে বসলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

“স্যার যে কাউকে বিয়ে করবে ভাবতেই পারিনি৷ বড়ো স্যার, বড়ো ম্যাডাম কত চেষ্টা করেছে স্যারকে বিয়ে করাতে। কিন্তু পারে নি। স্যারের ফুফাত বোন মাইশা। স্যারকে অসম্ভব ভালোবাসত। এখন পর্যন্ত তিনি বিয়ে করেননি স্যারের জন্য। প্রায়ই বাসায় আসে স্যারের সাথে দেখা করে যায়। বড়ো স্যার, ম্যাডাম অনেক চেয়েছিল মাইশা ম্যাডামের সাথে স্যারের বিয়ে দিতে কিন্তু পারেনি৷ স্যার তার জীবনের তেরো বছর আগেই আটকে গিয়েছে। এরপর ব্যর্থ হয়ে স্যারের খালাত বোন টিয়ার জন্য স্যারকে বলেছিল। সেক্ষেত্রেও স্যার বিয়ে করেনি। কিন্তু হুট করে এত বছর পর আপনাকে বিয়ে করল। স্যার আপনাকে অনেক ভালোবাসে তাই না?”

আমি দমটা ছেড়ে বললাম

“স্যার আমাকেও ভালোবাসে না। আচ্ছা আনজুমানের পরে তোমার স্যারের জীবনে কোনো ভালোবাসা আসেনি? মানে কাউকে ভালো লাগে নি?”

সোনিয়া অকোপটে জবাব দিল

“আনজুমানের পরে স্যার অবশ্য একটা মেয়েকে বিয়ের কথা বলেছিল। ৭ বছর আগের ঘটনা। যখন বড়ো ম্যাডাম আর বড়ো স্যার খুব অসুস্থ। তখন স্যার তৃণা নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। সবকিছু ভুলে নতুন করে সব শুরুও করতে চেয়েছিল। কিন্তু তৃনা মেয়েটি বিয়ের দিনই পালিয়ে যায়। কেন পালিয়ে যায় কোথায় পালিয়ে যায় জানা যায় নি। এরপর তিন বছর আগে মেয়েটি স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছিল। সে তার আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। তার হাসবেন্ড তাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই সাহায্যের জন্য এসেছিল। মেয়েটিকে স্যার তার কোম্পানিতে একটা জব দেয়। এখনও মেয়েটি সেখানে কাজ করছে যতদূর জানি।”

আমি সোনিয়ার কথা শুনে অনেক কিছুই রিলেট করতে পারলাম। কিছু রহস্য উন্মোচন করতে পারলাম। মতিভ্রম ভেবে ঘটে যাওয়া কিছুক্ষণ আগের রহস্যও ভেদ করতে পারলাম৷ আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম৷ সোনিয়া আমাকে উঠতে দেখে বলল

“কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম?”

আমি বেশ বলিষ্ঠ গলায় বললাম

“তোমার স্যারের রুমে।”

সোনিয়া বেশ নমনীয় গলায় আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল

“স্যার এ সময়টায় রুমে প্রবেশ করতে সবাইকে মানা করে।”

কিন্তু নাছোরবান্দা আমি সেটা মানলাম না। বালিশের নীচে থেকে ছুরিটা হাতে নিয়ে তা কোমড়ে লুকিয়ে নিলাম। এরপর দরজা নক না করেই রুমে ঢুকে চমকে গেলাম।

….