#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭
আরাব চৌধুরিকে দেখে মনে হচ্ছে ধ্যানে বসেছে। পুরো ঘরটায় অনেকগুলো ইংলিশ বই। আমি কিছু বইয়ে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলাম এগুলো হিপনোটাইস করার বই। আমি বুঝতে পারছিলাম না তিনি কেন এ বইগুলো সংগ্রহ করেছেন। আর কেনই বা তিনি এভাবে ধ্যান করে বসে আছেন। বিস্ময় আমার কাটছেই না। আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। এতসব প্রশ্নের বেড়াজাল আমাকে উন্মাদ করে ফেলল। বেশ জোর গলায় বললাম
“আপনি নিজেকে খুব চালাক মনে করেন। আসলে আপনি ভীষণ বোকা। আপনিই আনজুমানকে খু/ন করেছেন। এখন নাটক সাজাচ্ছেন। আমি জানি একটু আগে যা হয়েছে সেটা সত্য। আপনি সোনিয়া এবং আমাকে হিপনোটাইস করেছেন। একটু আগে যে আমরা বের হয়েছিলাম সেটা ভুলিয়ে দিয়েছেন। এজন্যই আপনার ঘরে এত হিপনোটাইস বিদ্যা শেখার বই। আপনি যত যাই করুন। আমি প্রমাণ করেই ছাড়ব আপনি খুনী।”
আমার কথা শুনে আরাব চৌধুরি আমার দিকে তাকালেন। মৃদু গলায় বললেন
“গলা উঁচিয়ে কথা না বলে শান্ত হয়ে মনে যা আছে বলো। ছোটো মানুষ ছোটো মানুষের মতো আচরণ করো। ভুলে যেও না আমি তোমার বয়সে বড়ো। সুতরাং বড়োদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা নিশ্চয় তোমার বাবা শিখিয়েছে।”
আমি উনার কথা শুনে আরও বেশি রেগে গেলাম। রেগে উত্তর দিলাম
“আমার বাবা অনেক কিছুই শিখিয়েছে। বড়োড়া সম্মান নষ্ট করলে তার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও শিখিয়েছে। নিজেকে অনেক বেশি ধূর্ত মনে করেন আপনি। নিজের স্ত্রীকে খু/ন করতে বুক কাঁপলো না? আবার তেরো বছর তার জন্য অপেক্ষা করার নাটক করছেন। কেউ আপনাকে না চিনলে আমি ঠিকেই আপনাকে চিনে ফেলেছি।”
আমার কথা শুনে তিনি এবারও শান্ত গলায় বললেন
“আয়েশা সীমা অতিক্রম করো না। সীমা অতিক্রম করলে আমি নিজেকে ঠান্ডা রাখতে পারব না।”
আমি উনার কথায় আরও রেগে গেলাম। রেগে গিয়ে কোমরের কাছ থেকে লুকানো ছুরিটা বের করে বললাম
“কী করবেন? মেরে ফেলবেন তো? নিন আমাকেও মেরে ফেলুন। একটা খু/ন করতে পারছেন আরও একটি পারবেন। নিন ছুরি, আমাকে খুন করে দিন। এত আতঙ্ক নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন আপনি। আপনাকে আমি অনেক ভালো মানুষ মনে করেছিলাম। তবে আপনি একটা জঘন্য মানুষ। আমি আপনাকে ঘৃনা করি।”
আমার কথা শুনে আরাব চৌধুরির চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি হাত উঁচিয়ে আমার গালে জোরে চড় কষিয়ে দিয়ে বললেন
“সীমা অতিক্রম করতে বাধ্য করো না। মেয়ে মানুষের গায়ে হাত তুলাকে আমি কাপুরুষত্ব মনে করি। তুমি দয়াকরে আমাকে দিয়ে এ কাজটা করিও না। এ চড়টা কেবল তোমার ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দিয়েছি।”
গালের চড়টা বেশ জোরেই লেগেছে। নিজের আত্মসম্মানে বেশ আঘাত লাগতে শুরু করল। আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। হাতে থাকা ছুরিটা নিয়ে নিজের হাতে নিজে আঘাত করে বলতে লাগলাম
“আমিই আমাকে শেষ করে দিব।”
আমার হাত থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। আমার হাতের রক্ত দেখে আরাব চৌধুরির দম ঘন হতে লাগল। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আর কোনো কথা বলতে পারছেন না। মাটিতে ধপাশ করে পড়ে গেলেন। আমি বুঝতে পারলাম না কী হয়েছে। সোনিয়াকে ডাকতে লাগলাম। নিজের হাতের কাটার কথা আমি ভুলেই গেলাম। আরাব চৌধুরির কাছে গিয়ে লক্ষ্য করলাম উনার কোনো জ্ঞান নেই। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। শরীর কাঁপতে লাগল আমার।
সোনিয়া এসেই আমাকে বলতে লাগল
“ম্যাডাম হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে স্যারকে। স্যারের কোনো সাড়া শব্দ নেই। আর আপনার হাত থেকেও অনবরত রক্ত পড়ছে। দয়াকরে আপনার শরীরের উড়না দিয়ে হাতটা পেঁচিয়ে নিন। নাহয় আপনিও অতিরক্তি রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারাবেন।”
সোনিয়ার কথা শেষ করতে না করতেই কলিং বেল বেজে উঠল। সোনিয়া দৌড়ে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে সোনিয়া শান্তির একটা নিঃশ্বাস নিল। আরাব আমার জন্য যে ডক্টরকে আসতে বলেছিল তিনি এসেছেন। ডক্টর তৈয়ব উনার নাম। উনি আরাবের ফ্যামিলি ডক্টরও বলা যায়। চেম্বার শেষ করে এ বাসায় চলে এসেছেন। তৈয়ব সাহেবকে দেখেই সোনিয়া দ্রূত ঘরে এসে আরাবকে দেখতে বলল। তৈয়ব সাহেব ঘরে ঢুকে আমার হাতের রক্ত আর আরাবকে পড়ে থাকতে দেখে বলতে লাগলেন
“আরাব রক্ত দেখেই হুঁশ হারিয়েছে। তিনি রক্ত সহ্য করতে পারেন না। এটা উনার একটা মানসিক রোগ। কোনোরুপ রক্ত দেখলে উনি সেটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেন না। অসুস্থ হয়ে যান। তিনি আরাবকে ধরে বিছানায় উঠালেন কষ্ট করে। এরপর দারোয়ানকে দিয়ে প্রয়োজনীয় ইনজেকশন আর মেডিসিন আরাবের দেহে পুশ করলেন। এদিকে তিনি একই সাথে আমার হাতেও সেলাই করে দিলেন। সেলাই করতে করতে তিনি বললেন
” এটা কী তুমি নিজের হাতে করেছো তাই না? এটাতে কিন্তু পুলিশ কেইস হয়ে যেত। কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে তোমার এ হাতের চিকিৎসা করত না, স্টিচ করত না। সরকারি হাসপাতালে গেলেও পুলিশ কেইস করে স্টিচ করতে বলত। আমি আরাবের পরিচিত বলেই এত সব ঝামেলার মধ্যে ফেললাম না। তোমার শরীর থেকেও অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিছুদিন ভালোমন্দ খেয়ে নিবে। আর আরাবের কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।”
আমি আর কোনো কথা বললাম না। চুপ করে বসে রইলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে মানুষটা সামান্য রক্ত সহ্য করতে পারে না সে মানুষটা কী করে একটা মানুষকে খুন করবে! আমি সত্যিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। যেটা একদম উচিত হয়নি। আমি নিজের মধ্যে অনুসূচণায় পুড়তে লাগলাম। আরাবের পাশে বসে রইলাম। তার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলাম। তৈয়ব সাহেব চলে গেছেন। সোনিয়া আমার জন্য খাবার বানাতে গিয়েছে। আমি তিতির পাখির মতো আরাবের দিকে তাকিয়ে আছি। আরাবের চোখ কাঁপতে লাগল। সে মিটমিট করে তাকাল। তার জ্ঞান ফেরাতে আমার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগল। আমি কিছু বলার আগেই তিনি বলে উঠলেন
“তুমি কী ঠিক আছো? তোমার হাত?”
আমি অপরাধী সুরে উত্তর দিলাম
“ডাক্তার আমার হাত ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গিয়েছে। হালকা কেটেছে। তবে আমি যা করেছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত। আমি এত প্রেসার নিতে পারছি না। সবকিছু আমার এলোমেলো লাগছে। আমাকে মাফ করবেন।”
আরাব আমার হাতটা ধরে উঠে বসলো। এরপর নম্র গলায় বলল
“আয়েশা তুমি এসেছো সবে। কয়েকটা দিনও পার হয়নি। এর মধ্যেই তুমি কতগুলো অকাজ করলে। এগুলো ঠিক হয়েছে বলো? তোমাকে আমি তোমার ভালোর জন্য বিয়ে করেছি। তোমার গায়ে হাত তুলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার ছিল না। আমি তারপরও তোমার গায়ে হাত তুলেছি তোমার অবাধ্যতার জন্য। বয়স কম উত্তেজিত বেশি হয়ে যাচ্ছ। তোমার কিছু জানার থাকলে সেটা নম্র গলায় আমাকে বলতে পারো। আমি সত্যিটায় বলব। তবে তোমার জিজ্ঞেস করার ধরণ ছিল রুড। এভাবে বড়োদের সাথে কথা বলতে হয় না।
আর বাকি রইল হিপনোটাইসের ব্যাপারটা। আমি আনজুমানের জায়গা কাউকে দিতে পারব না। আমাকে বাবা, মা অনেক চেষ্টা করেছে বিয়ে দেওয়ার জন্য। যাদের জন্য চেষ্টা করেছে তারা দুজন আমার কাছের আত্মীয় ছিল। তারা এসে আমার বাসায় থেকে আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল। তবে আমি তাদের না করা সত্যেও জোর করত। এরপর আমি নিজে এমন একজন মানুষের সাথে পরিচিত হই যিনি হিপনোটাইস করতে পারে। এরপর এটা আমি নিজেও রপ্ত করি। যে দুজন আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল তাদের আমি নিজেই হিপনোটাইস করে এমন স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম যাতে করে তারা আমাকে ভয় পেয়ে বিয়েতে অমত করে। এবং সেটাই হয়েছিল। তোমাকে যখন দেখেছি আমার ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তা করছো তখন আমিও তোমাকে রুমে ঢুকার সময় হিপনোটাইস করে একই স্বপ্ন দেখাই। যার জন্য বিষয়টা তোমার কাছে সত্যি মনে হয়। আমার প্রতি তোমার সন্দেহ আসে। আর আস্তে করে আমার প্রতি নেতিবাচক ভাবো। কখনও আমার প্রতি দুর্বল হও সেটা আমি চাই না। আমি তোমার মাঝে আমার প্রতি দুর্বলতা খুঁজে পাই। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আমার নেই। যা আছে সেটা কেবল দায়িত্ব। আমি তোমাকে বিয়ে করেছি তোমার জীবনটা বাঁচানোর জন্য এর বাইরে কিছু না৷
নিজের জীবনকে সাজাও। যা লাগে তাই দিব। তবে আনজুৃানের জায়গাটা নেওয়ার চেষ্টা করো না। আমি না মানলেও তুমি আমার স্ত্রী। আমি তোমাকে এ বিষয়টা খুলে বলতাম না। তবে তুমি আজকে নিজের ক্ষতি যেভাবে করেছো সেটা আমি একদম মেনে নিতে পারছি না। তাই তোমাকে সত্যিটা বলে দিতে বাধ্য হলাম।”
আমি লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হালকা কান্না করে বললাম
“আমি না চাইতেও আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছি। হয়তো এটা আল্লাহর তরফ থেকে। আপনি আমার স্বামী। আমি একজন স্ত্রী হয়ে আপনার মুখে যদি সবসময় আনজুমানের নাম শুনি এটা আমার জন্য কষ্টদায়ক এবং অপমানজনকও। দিনশেষে আনজুমান আমার সতীনেই। আর সতীনকে কোনো স্ত্রী মানতে পারে না। যাইহোক আমি হ্যাংলা না যে জোর করে আপনার কাছে ভালোবাসা চাইব। আমি আপনার প্রতি দু্র্বল কারণ আপনি আমার স্বামী।
যেদিন নিজে থেকে আমার কাছে ভালোবাসা চাইবেন আমি ঠিক সেদিনেই নিজেকে আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করব এর আগে না। এর মধ্যে আমাদের মধ্যে যা থাকবে সব কিছু স্বাভাবিক। আমি উঠলাম আপনি বিশ্রাম করুন।”
কথাগুলো বলে চলে আসলাম রুমে। বুকের ভেতরটায় আমার ভীষণ পুড়তে লাগল। আমি জীবনের প্রথম কাউকে ভালোবাসলাম তবুও সেটা নিজের স্বামীকে। যে স্বামী আমার মতো অল্প বয়সী বউ পেয়ে মাথায় তুলে রাখার কথা সে স্বামী আমাকে কেবল অবহেলা করছে। নিজের বাবা হারানোর যন্ত্রণা আর এদিকে সব পেয়েও অধিকার না পাওয়ার যন্ত্রণা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বেশ জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম।
কাঁদতে কাঁদতেই আমার চোখে একটি বিশেষ কিছু অবলোকিত হলো। যেটা আমাকে আরও বেশি দ্বিধায় ফেলে দিল। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা সবকিছুর বেড়াজালে আমি পড়ে গেলাম।
…..