#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৯
আমি দৌঁড়ে সোনিয়ার কাছে গেলাম। সোনিয়া চিৎ হয়ে তখন শুয়া ছিল। ফ্লোরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। সোনিয়ার কাছে যেতেই সে আমার হাতটা ধরে বলতে লাগল
“ম্যাডাম আমাকে পেছন থেকে আঘাত করা হয়েছে। আমার পিঠে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। স্যার মাত্রই বের হয়েছে অফিসের উদ্দেশ্যে। মূল দরজাটা খোলা ছিল। স্যার বের হয়েছে ১৫ মিনিট হবে। আমি সবজিগুলো গুছিয়ে দরজাটা লাগাতে চেয়েছিলাম। এর মধ্যেই আমার পিঠে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। আমি তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে পেছনে ফিরলে তাদের মধ্যে একজন বলে উঠে
” এ কাকে ছুরি মারলি? এত আয়েশা না। আয়েশাকে মারতে বলেছিলাম অন্য মেয়েকে না। চল চল তাড়াতাড়ি চল। নাহয় বিপদ বেড়ে যাবে। ”
এরপর তারা তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। আর আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। পিঠে যে ছুরিটা দিয়ে আঘাত করেছিল সেটাও তারা সাথে নিয়ে যায়।”
সোনিয়ার কথা শুনে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার জন্যই আজকে ওর এ অবস্থা। আমি যে আরাবকে বিষয়টা জানাব সেটাও পারছিলাম না। কারণ আরাবের নম্বর আমার বা সোনিয়ার কাছে নেই। তাই বাসার অন্য কাজের লোকের সহয়তা নিয়ে দ্রূত সোনিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাই৷ সেখানে প্রথমেই ডিটেইলস শুনে জানিয়ে দেয় পুলিশ কেইস করতে। আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি কেবল ডাক্তারদের অনুরোধ করে বলছিলাম আপনারা চিকিৎসা শুরু করুন। কারণ চিকিৎসা শুরু না করলে সোনিয়া রক্তক্ষরণে মারাও যেতে পারে।
বেশ অনেকক্ষণ অনুরোধের পর তারা চিকিৎসা শুরু করে। একের পর এক মেডিসিন আনতে বলা হয়। এদিকে আমার কাছে তেমন টাকা নেই। যে দুজন আমার সাথে এসেছে তাদের কাছেও ক্যাশ টাকা নেই তেমন। তারা আরাবকে কল দিলেও আরাব কল তুলে নি এর মধ্যে। অপরদিকে টাকার জন্য মেডিসিন আনতেও বেশ হিমশিম খাচ্ছিলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে আমার গলায় হাত গেল। আমার গলায় একটা সোনার চেইন ছিল৷ সেটা আমার মায়ের শেষ স্মৃতি ছিল। সে চেইনটা আমার সাথে আসা সুজনকে দিয়ে বললাম
“সুজন এটা বিক্রি করে আপাতত টাকার জোগাড় করো। একের পর এক মেডিসিন বাকিতে দিবে না। হাসপাতালের বিল নাহয় পরে দেওয়া যাবে কিন্তু মেডিসিনের বিল পরে দেওয়ার সুযোগ নেই। সোনিয়ার কিছু হলে নিজেকে অপরাধী লাগবে। আমি চাই না সোনিয়ার চিকিৎসায় কোনো কমতি থাকুক। তোমার স্যার আসলে টাকার ম্যানেজ এমনিই হয়ে যাবে। পাশ থেকে সাথে আসা সবুজ বলে উঠল
” ম্যাডাম তাই বলে চেইন বিক্রি করে দিবেন। আমরা স্যারের জন্য অপেক্ষা করি।”
আমি তাদের বেশ রেগে উত্তর দিলাম
“স্যারের জন্য অপেক্ষা করে বিপদ ডেকে আনবে? যা হওয়ার হয়ে গেছে। বাকিটা পরে দেখা যাবে। এখন চেইন বিক্রি ছাড়া উপায় নেই। কথা না বাড়িয়ে যাও গিয়ে টাকা জোগাড় করো।”
পিনপনা নীরবতা। আয়েশা থেমে গেল। পুলিশ স্টেশনে বসে অফিসার নাহিদকে সে ঘটে আসা সকল ঘটনার বর্ণণা করছিল। আয়েশার নীরবতা দেখে অফিসার নাহিদ এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল
“থেমে গেলেন কেন? তারপর কী হয়েছে?”
আয়েশা হালকা ঢুক গিলল। গলাটা শুকিয়ে এসেছে তার। পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক ঢুকে পানি খেয়ে নিল সে। তারপর উত্তর দিল
“এরপর সবুজ আর সুজন চেইন বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসে৷ সে টাকা দিয়ে আমি সে মুহুর্তে যতটা পেরেছি সোনিয়ার জন্য চেষ্টা করেছি। আমি সোনিয়ার জন্য নিজেকে বিসর্জন দিতেও রাজি ছিলাম৷ কারণ সোনিয়ার এ হাল আমার জন্যই হয়েছিল।
এদিকে বিকেল তিনটাতে আরাব সুজনের কল ব্যাক করে। সুজন তখন পুরো ঘটনা তাকে জানায়। অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় আরাব তখন কলটা রিসিভ করতে পারেনি৷
সুজনের মুখে আরাব সব জেনে তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে চলে আসে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে। সোনিয়ার সকল ধরণের চিকিৎসার ব্যবস্থা সে করে। আর এটাও বলে দেয় সোনিয়াকে বাঁচাতে যত টাকা লাগে সে খরচ করবে। সোনিয়ার বাবা, মাকে খবর দেওয়া হয়। তারাও আসে। আর চিকিৎসা ভালোভাবেই করা হচ্ছিল। ডক্টরও প্রাণপণ চেষ্টা করছিল সোনিয়ার জন্য।
কিন্তু সোনিয়া পুরোপুরি কোমায় চলে যায়। আরাব চেয়েছিল থানায় বিষয়টা জানাতে। তবে সোনিয়ার পরিবারেই তখন আরাবের হাতে পায়ে ধরে বিষয়টা থামিয়ে দেয়। তারা জানায় যদি সোনিয়ার এ দূর্ঘটনার কথা জানাজানি হয় তাহলে সুস্থ হলে সোনিয়াকে বিয়ে দিতে পারবে না। তারা গরীব মানুষ সে সাথে গ্রামের মানুষ। মেয়ের এ খুত জানলে বিয়ে করবে না কেউ। আরাব অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে তাদেরকে। কিন্তু তারা বিষয়টি মানতে নারাজ হয়। তাই তাদের মেয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে এ বিষয়টি মথায় রেখে ডাক্তারকে অনুরোধ করে সোনিয়ার বিষয়টি থানা পর্যন্ত আনে নি।
টানা তিনটা মাস আমি হাসপাতালে পড়ে থেকেছি সোনিয়ার জন্য। আমি চেয়েছি সোনিয়ার জ্ঞান ফিরলে তাকে আমি লোকগুলোর বর্ণণা জিজ্ঞেস করব। বিশ্বাস করুন আরাব মন থেকে চেয়েছিল প্রটেক্ট করার, থানায় জানানোর। তবে সোনিয়ার পরিবারের কী ভীমরতি হয়েছিল জানি না তারাই বিষয়টি জানাতে দেয় নি তখন। এখানে আরাবের কোনো দোষ নেই।
এরপর টানা তিনমাস চোখের পলকে কীভাবে কেটে গেল জানি না। সোনিয়ার অসুস্থতা আমাদের স্বাভাবিক জীবনটাকেই অস্বাভাবিক করে তুলেছিল। দিনরাত আমরা কেবল সোনিয়ার সুস্থতার জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুনিয়ায় সোনিয়ার রিজিক ছিল স্বল্প। তাই তিনমাস কোমায় থাকার পর গত পরশু সে মারা যায়।
সে মারা যাওয়ার পর কেন তার পরিবার নিজে থেকে এসে থানায় কমপ্লেইন করল আমাদের কারও জানা নেই। আপনারা ইনভেস্টিগেশন করেন, দেখেন। এতটুকু নিশ্চিত থাকুন সোনিয়ার এ অবস্থার জন্য আমি বা আরাব কেউ দায়ী না। ঐ বাসায় সোনিয়া আমার ভালো বন্ধু ছিল। সোনিয়াকে সবচেয়ে আপন মনে হত। তাকে আমার পাশে দরকার ছিল। কিন্তু আমি তাকেই হারিয়ে ফেললাম। আমি যা বলছি সবটা সত্যি। এক বিন্দু মিথ্যা বলছি না। এবং সবকিছু ডিটেইলস এজন্য বলেছি যাতে আপনাদের তদন্ত করতে সুবিধা হয়।
সোনিয়ার বাবা, মা এতদিন মেয়ের জন্য কিছু করেনি। যখন মারা গেল তখন মেয়ের জন্য তাদের মায়া বেড়ে গেল? ক্ষতিপূরণ চাইলো? সোনিয়ার পেছনে এ তিনমাসে আরাব ৫৭ লাখ টাকা খরচ করেছে। সোনিয়াকে যদি আমাদের মারার পরিকল্পনা থাকত তাহলে কী একটা মানুষ এত টাকা খরচ করত? নিশ্চয় করত না। ৫৭ লাখ টাকা কী মুখের কথা বলুন? আমি আমার জীবনে ৫৭ লাখ কখনও চোখেই দেখিনি৷ আর আরাবের মতো মানবিক মানুষ বলেই একজন কাজের লোকের চিকিৎসার জন্য ৫৭ লাখ টাকা খরচ করেছে।
আর সোনিয়ার বাবা, মা অকৃতজ্ঞ বলেই মেয়ের শোক ভুলে ক্ষতিপূরণ চায়ছে। আরাব ক্ষতিপূরণ দিতে এজন্যই রাজি হয়নি কারণ তারা তাদের মেয়ের মৃত্যু নিয়ে ব্যবস্যা করছে।
আর আমি আরাবকে যতটুকু চিনি, জানি আরাব জেল খাটলেও ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হবে না৷ আরাবের টাকা পয়সার অভাব নেই। তবে মৃত মানুষকে নিয়ে যারা ব্যবস্যা করে তাদের আরাব টাকা দিবে না। আর উনারা বলছে আমরা উনার মেয়েকে মেরে দিয়েছি। আমরা যদি মারতামেই তাহলে তারা এতদিন কেন আসেনি থানায়? লোকগুলো আমাকে মারতে চেয়েছিল। সোনিয়াকে না। আর সোনিয়ার সাথে আমাদের কী শত্রুতা থাকবে বলুন। তাকে খুন করে আমাদের লাভ কী বলুন।”
কথাগুলো শেষ করে আয়েশা একটা দম নিল। অফিসার নাহিদ আয়েশাকে বলল
“আচ্ছা আপনাদের কাকে সন্দেহ হয়?”
আয়েশা হতাশা গলায় উত্তর দিল
“আমরা কাউকে সন্দেহ করতে পারছি না। এ শহরে আমি নতুন। এখানে কার সাথে আমার শত্রুতা থাকবে যে আমাকে খু/ন করতে আসবে।”
অফিসার নাহিদ আয়েশাকে বেশ নম্রভাবে বলল
“আমরা যতদিন ইনভেস্টিগেশন করব ততদিন ঢাকা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আপাতত আসতে পারেন।”
আয়েশা বসা থেকে উঠল। তারপর সেখান থেকে প্রস্থান নিল। বাইরে সোনিয়ার বাবা, মা দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দেখে আয়েশার রাগে গা জ্বলছে। তবুও নিজের রাগ সামলে নিল সে।
নিজেকে সামলে তাৎক্ষনাত গাড়ি দিয়ে বাড়ি চলে আসলো। সুজন আর সবুজ তখন বাসার আরাবের সাথে কথা বলছিল।।আয়েশাকে দেখেই সুজন বলে উঠল
“ম্যাডাম ঠিক আছেন তো?”
আয়েশা হালকা গলায় জবাব দিল
“হুম ঠিক আছি। যা সত্য তাই বলে এসেছি। এবার যদি আল্লাহ সহায় হোন।”
আরাব কেবল আয়েশার দিকে তাকাল। আয়েশার এ বলিষ্ঠ জবাব আরাবের মনে একটা সুক্ষ্ম তীর বুনে দিচ্ছে।।আয়েশার প্রতি একটা দুর্বলতা কাজ করছে। এ মুহূর্তে আরাবের কোনদিকে ফোকাস দেওয়া উচিত বুঝতে পারছে না। সে কী সোনিয়ার পরিবারের পাগলামি থামাবে নাকি আয়েশাকে কারা খু/ন করতে এসেছিল সেটা নিয়ে ভাববে বুঝতে পারছে না।
আয়েশা নিজের ঘরে এসে কাপড় পাল্টে নিল। এরপর বিছানা গুছিয়ে শুতে যাচ্ছিল। বালিশটা সরিয়ে ওপাশে নিতেই আয়েশা চমকে উঠে। মনে মনে ভাবতে লাগল এটা কী করে সম্ভব?
…..