#বেহালার সুর
#পর্ব-১২
#শারমিন আঁচল নিপা
আর কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। তৃণা এসেছে তার রুমে। তার উপর কোনো অনুমতি নিয়ে আসেনি। তৃণা মেয়েটাকে এক সময় আরাব খুব পছন্দ করেছিল। বিয়েও করতে চেয়েছিল। এরপর বিয়ের দিন মেয়েটি তার বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে বেশ কয়েক বছর পর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে আরাবের কাছে সাহায্য চায়তে আসে। তখন আরাব তাকে তার কোম্পানিতে একটা চকুরি দেয়। তৃণার এমন কান্ড দেখে আরাব কিছুটা রাগী গলায় বলল
“তৃণা আমার রুমে অনুমতি ছাড়া অফিসের কোনো স্টাফের প্রবেশ নিষেধ। অফিসের নিয়ম ভঙ্গ করো না। আর এভাবে আমার রুমে ঢুকে আমার গায়ে হাত দেওয়াও অভদ্রতায় মনে করি আমি৷ এরকম আর যেন না দেখি।”
তৃণা মাথা নুইয়ে ফেলল। জীবনের একটা ভুল আরাবের থেকে তাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। মাথা নুইয়ে নীচু গলায় উত্তর দিল
“একটা ইমপরট্যান্ট কাজের জন্য এসেছিলাম। এসে অনেকক্ষণ দরজা নক করি। একদম সাড়া শব্দ ছিল না। কিছুটা ভয় পেয়ে রুমে প্রবেশ করি। ভেবেছিলাম জ্ঞান হারিয়েছেন। আর সেজন্যই কপালে হাত দেওয়া। আপনি প্লিজ নেগেটিভ নিবেন না স্যার।”
আরাব নিজেকে স্বাভাবিক করে উত্তর দিল
“এরপর যদি আমি মারাও যাই তারপরও তুমি অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করবে না। আশা করি আমার এ কথা তুমি বুঝতে পেরেছো।”
তৃণার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। তবে এ চাকুরি ছাড়াও তার পক্ষে সম্ভব না। আরাবের দয়া নিয়েই তাকে বাঁচতে হবে এখন। তার একটি মেয়ে আছে। সেই মেয়ের এবং তার মা বাবার ভরণ পোষণের দায়িত্ব তার। আর সেজন্য এ চাকুরিটা তার ভীষণ প্রয়োজন। আর চায়লেও এ শহরে নতুন চাকুরি পাওয়া যায় না। যোগ্যতা থাকলেও মানুষ চাকুরির পেছন ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে যায় কিন্তু চাকুরি মেলে না। তৃণা নিজের কান্না আটকিয়ে জবাব দিল
“জি স্যার বুঝেছি।”
এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলল
“শুনেছি আপনি বিয়ে করেছেন? ঘটনা কী সত্য? কানে শুনা তাই জিজ্ঞেস করা। প্রশ্নটাকে নেগেটিভভাবে নিবেন না। ব্যক্তিগত প্রশ্ন যদিও তারপরও জিজ্ঞেস করে ফেললাম। তবে যে মেয়েটিকে বিয়ে করলেন সত্যিই সে মেয়েটি ভাগ্যবতী বলেই আপনাকে পেয়েছে। আপনার মতো হীরে পেয়েও আমি একটা সময় মূল্যায়ন করতে পারিনি এটা আমার ব্যর্থতা। বিষয়টা ইদানীং খুব পীড়া দেয়৷ কৌতুহল থেকেই মূলত প্রশ্ন করা। যদি ভুল হয় ক্ষমা করবেন।”
আরাব বেশ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল
“হুম করেছি। একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছি বলা যায়। বয়স বেশি না সতেরো হবে। ভালোবাসতে শুরু করেছি সবে। মেয়েটা ভীষণ ভালো। একটু কথা বেশি বলে। একটু বেশি অভার থিংকিং করে। তবে গুণ আছে মাশআল্লাহ। অবশ্য এ বয়সের মেয়েরা এমনই হবে এটাই স্বাভাবিক। আর সে সাথে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে সেটা বুঝা যায়। আমার স্ত্রীর নাম আয়েশা। দেখো যা হয় ভালোর জন্য। সেদিন তুমি আমাকে বিয়ে করলেও আমার যথাযথ মর্ম তুমি বুঝতে না। কিন্তু আজ যে মেয়েকে আমি বিয়ে করেছি সে আমার মর্মটা বুঝে। সে বুঝে তার জীবনে আমার গুরুত্বটা কতটুকু। যাইহোক একদিন তোমার বাচ্চাকে নিয়ে আয়েশার সাথে দেখা করে যেও। ওর রান্নার হাত অনেক ভালো। আর কিছু যদি বলার থাকে বলতে পারো নাহয় আসতে পারো।”
তৃণার চাপা একটা কষ্ট হচ্ছে। নিজের ভুলের মাসুল দিতে দিতে সে ক্লান্ত। চাপা গলায় বলল
” না স্যার আর কিছু বলার নেই। পরে কথা হবে। আমি মমিনকে দিয়ে কাজের সব ডিটেইলস পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিনিই সব বুঝিয়ে দিবেন। আসলাম।”
বলেই তৃণা রুম থেকে বের হলো। এদিকে আয়েশা ঘরে বসে বার বার ঘড়ি দেখছে কখন যে সন্ধ্যা হবে আর সে বের হবে সে চিন্তায় তার মাথায় ঘুরছে। লতা তার পাশে আয়েশার অস্থিরতা দেখে বলল
“আপু এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আপনি একটু বিশ্রাম করুন।”
আয়েশা উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে উঠল
“আজকে আমার অস্থিরতা যাবে না। আচ্ছা লতা কী পরে যাব? কোন কালার জামাটা পরলে আমাকে ভালো মানাবে আরাবের পাশে?”
লতা হেসে জবাব দিল
“আপনি সুন্দর মাশআল্লাহ। আপনাকে সব কালার জামাতেই সুন্দর লাগবে। একটা পরে গেলেই হয়৷ তবে আজকে যেহেতু প্রথম বের হচ্ছেন লালা কালার পরুন। নতুন বউদের লাল যেকোনো জিনিসে খুব মানায়। আপনাকেও ভীষণ মানাবে৷ পারলে শাড়ি পরুন।”
আয়েশা লতার কথা শুনে মুখটা কালো করে বলল
“আমার কোনো লাল জামা নেই আর শাড়িও নেই। যে কয়টা জামা আছে সেগুলো অন্য কালার। এর মধ্যেই যেকোনে একটা কালার চুজ করে দাও।”
লতা আলমারি ঘেটে পারপল একটা জামা বের করে বলল
“এটাতে মানাবে। এটা পরতে পারেন। আর আপু আপনি সত্যিই খুব সুন্দরী একটা মেয়ে । যা পরবেন তাতেই আপনাকে ভীষণ মানাবে। ”
আয়েশা লতার হাত থেকে জামাটা নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখতে লাগল। আয়নার সামনের যেতেই তার দুঃখগুলো আয়নায় ভেসে উঠল। নিজের বাবা আর সোনিয়ার কথা তার ভীষণ মনে পড়তে লাগল। সোনিয়ার সাথে কেবল দুই তিনদিনের পরিচয় ছিল তবুও সে এ অল্প পরিচয়ে আয়েশার পুরো মনটা দখল করে রেখেছে। আয়েশার চোখ টল টল করছে৷ সে নিজেকে সামলে নিয়ে কাপড়টা ওয়াশরুমে গিয়ে পরিবর্তন করে নিল৷ তারপর হালকা সেজে আরাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
আরাব আসলো সন্ধ্যায়। আয়েশাকে দেখে আরাব চোখ ফেরাতে পারছে না। আয়েশার প্রতি সে দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে সাথে একটা অজানা আশঙ্কা তাকে ঝেঁকে ধরেছে। আয়েশা এখন অল্প বয়সী তাই আবেগটা তার ভীষণ কাজ করছে। তার উপর বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তার জ্ঞান কম৷ সেজন্য আরাবকে তার কাছে সবকিছু মনে হচ্ছে। কিন্তু যখন বুঝতে শিখবে, বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে জানবে, পড়ালেখা করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবে। তখন আরাবকে তার ভালো না ও লাগতে পারে। আনজুমান তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এরপর তৃণা বিয়ের দিন পালিয়েছে। মানুষ এ নিয়ে আড়ালে অনেক কথায় বলে এটা সে বুঝতে পারে। কিন্তু এখন যদি আয়েশাও তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। একটা সময় মানুষ তার সামনে কথা বলতেও পিছ পা হবে না। নিজেকে এভাবে অপমানিত হতে সে কখনও দেখতে পারবে না৷
আরাব এসবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে। আয়েশার মোলায়েম গলার সুরে আরাবের ভাবনায় ছেদ পড়ে। আয়েশা বলে উঠে
“কী ভাবছেন?”
আরাব নিজেকে স্বাভাবিক করে আয়েশাকে উত্তর দিল
“তেমন কিছু না। চলো আমার সাথে।”
আয়েশা বের হলো। গাড়ির সামনের সিটে সে বসলো। আর আরাব গাড়ি চালাচ্ছে। আয়েশা বলে উঠল
“এটা কী হিপনোটাইস এর প্রভাব? না মানে এর আগে তো এভাবেই আমরা গাড়ি করে যাচ্ছিলাম। পরে জানতে পারি এটা হিপনোটাইস। এখন কী সেরকম কিছু নাকি?”
আয়েশার কথা শুনে আরাব জোরে হেসে দিল। আরাবের এ প্রাণ উচ্ছ্বাস হাসিটা আয়েশার মন কেড়ে নিল। আরাবকে সে এভাবে কখনও হাসতে দেখেনি। আরাব বেশ কিছুক্ষণ হেসে উত্তর দিল
“আমি ঐসব ছেড়ে দিয়েছি। যে কারণে ঐসব করেছিলাম সেটা ঘটেই গিয়েছে। বিয়ে তো করেই ফেলেছি। তাহলে আর ঐসব হিপনোটাইস শিখে কী লাভ? আচ্ছা আয়েশা কখনও যদি এমন হয় এক পাশে আমি আরেক পাশে তোমার ক্যারিয়ার। কাকে বেছে নিবে?”
আয়েশা উত্তর দিল
“আমি আপনাকে বেছে নিব। এরপর আপনাকে বুঝিয়ে ক্যারিয়ারটা আপনাকে সাথে নিয়েই গড়ব। আমার জীবনে দুজনেই গুরুত্বপূর্ণ আপনি এবং ক্যারিয়ার। কারও জন্য কাউকে বাঁধা বানাব না।”
আরাব আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল
“তোমার মাথায় উপস্থিত বুদ্ধি ভালো।”
আবারও গাড়ি চলতে লাগল। রাতের শহর ঝলমলে হয়ে আছে। চারদিকে চাকচিক্যের বেড়াজাল। আয়েশার কাছে এসব কিছুই নতুন। চারপাশে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে কেবল দেখছে সে। এত বড়ো অট্টালিকা সামনে থেকে সে দেখেনি কখনও। আজকে সব স্বপ্নের মতো লাগছে তার। মনে হচ্ছে এটা একটা সুখের স্বপ্ন যেকোনো সময় ভেঙে গিয়ে দুঃসময় চলে আসবে। কিন্তু আয়েশা যদি পারত এ সময়টাকে থামিয়ে দিত। আরাবের সাথে সে এভাবেই সারাজীবন সুখে থাকতে চায়।
গাড়িটা ব্রেক কষলো। আয়েশা আরাবের দিকে তাকিয়ে বলল
“থেমে গলেন কেন?”
আরাবের উত্তর আসলো
“গন্তব্যে চলে এসেছি তাই।”
এরপর আরাব প্রথমে গাড়ি থেকে নামলো এরপর আয়েশাকে নামালো। তারা একটি বাসায় এসেছে। কার বাসা আয়েশা জানে না। কৌতুল হয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল
“আমরা কার বাসায় এসেছি?”
আরাব কেবল বলল
“সময় হলে বুঝতে পারবা।”
বাসাটি পনেরো তলা। তারা লিফট দিয়ে পনেরো তলাতেই উঠল। ছাদের কার্ণিশে একটা ছোটো ফ্ল্যাট। আরাব আয়েশাকে সেখানে নিয়ে গেল। কলিং বেলটা চাপ দিল। ওপাশ থেকে কেউ দরজার খুলল। দরজা খুলতেই আয়েশার বুক ধুক ধুক করতে লাগল। কারণ…