বেহালার সুর পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
36

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৩

কারণ ঘরের ভেতর মহসীন বাঁধা অবস্থায় ছিল। মহসীনের হাত, মুখ, পা বাঁধা। মহসীনকে দেখে আয়েশা কাঁপতে লাগল। কাঁপতে কাঁপতে আরাবকে জিজ্ঞেস করল

“মহসীনকে এভাবে বেঁধে রেখেছেন কেন? মহসীন কী করেছে? আর তাকে গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে এসেছেন কেন?”

আরাব শান্ত গলায় বলল
” একটু ভেতরের দিকে চলো চা খেতে খেতে বলি৷”

তারপর তীব্রর দিকে তাকাল। তীব্র এ বাসা দেখাশোনা করে। সে একজন প্রাইভেট গোয়েন্দাও। মাঝে মধ্যে সে বডি বিল্ডিং ও করে। ৬ ফুট উচ্চতা তার, বডিও বেশ বলিষ্ঠ। সে তীব্রকে বলল

“তীব্র মহসীনকে ঘরে আটকে রাখো। দিনে এক বেলা খাবার দিবে। তিনটা মাস ওকে আটকে রেখে পুলিশের কাছে দিবে। আর এ তিনমাস ওকে নরকের মতো যন্ত্রণা দিবে। যাতে করে এ যন্ত্রণা সইতে না পেরে সে নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করে।”

তীব্র জোরালো কণ্ঠে উত্তর দিল

“আপনাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। এ ধরণের কেইস কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় আমার জানা আছে। আপনার সাথে তো আমি নতুন কাজ করছি না।”

তাদের কথোপকথন শুনে আয়েশা চুপসে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে তার। আয়েশার সামনেই মহসীনকে টানতে টানতে অন্য রুমে নিয়ে আটকে দিল তীব্র। আয়েশা আরাবের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিকে তাকাল। আরাব আয়েশাকে কিছু না বলেই হাতটা ধরে ভেতরের দিকে নিয়ে গেল। সেখানে একটি টেবিলে অলরেডি চা, কফি রাখা আছে। আয়েশাকে আরাব বসতে বলল চেয়ারে। তারপর নিজে বসলো। এরপর আয়েশার দিকে কোল্ড কফি এগিয়ে দিয়ে বলল

“কফিটা খাও। আমি সব বলছি।”

আয়েশা চুপ হয়ে বসে আছে। এ কফিতে কিছু মেশানো আছে কি’না ভাবতে লাগল। আবারও সন্দেহ তাকে ঝেঁকে ধরেছে। বারবার ভাবছে আরাবকে বিশ্বাস করা কী তার ঠিক হয়েছে? আয়েশার দ্বিধাদ্বন্ধের ছাপ তার মুখেও ফুটে উঠেছে। আরাব আয়েশার দিকে তাকিয়ে তার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে এক চুমুক খেয়ে বলল

“নিশ্চান্তায় কফি খেতে পারো। এখানে কিছু মেশানো নেই। আমাকে ভালোবাসো আর আমাকে বিশ্বাস করতে পারো না? আমার প্রতি ভরসা রাখতে পারো না? এই তোমার ভালোবাসা? ভালোবাসার মানুষকে আগে বিশ্বাস করতে হয়, ভরসা করতে হয়। তার উপর আস্থা রাখতে হয়৷ তাহলে সে ভালোবাসা কখনও দমে যায় না। নাহয় যে কোনো সময় তা ভেঙে যায়।”

আরাবের কথা আয়েশা কিছুই বুঝতে পারছে না৷ কফিটা হাতে নিয়ে কৌতুহল দৃষ্টিতে কেবল সে তাকিয়েই আছে। আয়েশা এখনও কফিতে চুমুক দেয়নি। যদিও তার গলা শুকিয়ে আছে। তবুও তার বিস্ময় কাটছে না। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না৷ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝমেছে তার। মনে হচ্ছে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের গুমগুম শব্দ তার বুকের ভেতর হচ্ছে। আয়েশার এ অবস্থা দেখে আরাব আয়েশার হাত দুটো ধরল। এরপর বলল

“মহসীন তোমাকে খু/ন করতে এসেছিল। সে ভুল করে তোমাকে খু/ন না করে সোনিয়া খু/ন করে ফেলে। সে এবং তার সাথে আরও দুজন সহযোগী ছিল। দুজন সহযোগীকে এখনও ধরা যায়নি। তবে মহসীনকে ধরতে পেরেছি। তীব্র আমার পুরনো একজন বিশ্বস্ত লোক। সে গোয়ান্দাগিরি করে। আমার জীবনের জন্য যারা হুমকি তাদের আমি এভাবেই শাস্তি দেই। তীব্রকে কেইসটা এতদিন সলভ করতে বলেছি। মহসীন খু/ন করেছে এটা আমি জানতে পেরেছি একমাস পরেই। তবে তাকে হাতেনাতে ধরতে পারছিলাম না। হাতেনাতে ধরি সোনিয়ার মৃত্যুদিনে। সেদিন সে হাসপাতালের পেছন দিক দিয়ে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে। এরপর সোনিয়ার কেবিনের জানালা দিয়ে কৌশলে ঘরে প্রবেশ করে এবং গলা চেপে খুন করে। কারণ সে ভয়ে ছিল৷ সোনিয়া যদি জ্ঞান ফিরে তার বর্ণণা দেয় তাহলে সে ফেঁসে যাবে। তাই সে সোনিয়াকে হাসপাতালে এসে গলা চেপে খু/ন করে। আমি মহসীনকে পুলিশের হাতে তুলে দেইনি কারণ পুলিশ তদন্ত করে ওর শাস্তি হতে হতে অনেক দূর। আমি আবার এত অপেক্ষা সহ্য করতে পারছি না৷ তাই ওকে তুলে এনেছি। সোনিয়া যেভাবে তিনমাস ধুকে ধুকে মরেছে তাকে তিনমাস ঐরকম শাস্তি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিব।

আর আয়েশা মহসীন কেন তোমাকে মারতে এসেছিল এটা নিশ্চয় বুঝেছো? সে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তোমাকে সে নিজের মতো চালাতে চেয়েছিল। তবে আমার জন্য সেটা সে পারে নি। তোমাকে না পেয়ে সে অপমানিত হয়৷ গ্রামবাসীর কাছে সে ছোটো হয়। আর সেটার জন্যই তোমার উপর একটা রাগ ছিল তার। সোনিয়া তোমার বয়সী ছিল৷ আর লম্বায় এবং স্বাস্থ্যে তোমার মতোই ছিল। মহসীন ভেবেছিল তুমি কাজ করতেছো। তাই সে তার সহযোগীকে আঘাত করতে বলে। কিন্তু যখন সোনিয়া চিৎকার দিয়ে পেছনে ফিরে তখন সে বুঝতে পারে ভুল করে তারা তোমার পরিবর্তে আরেকজনকে ছুরি মেরেছে। তাই তারা দ্রূত প্রস্থান নেয়। তারা বিয়ের পর পরই চেষ্টা করছিল তোমাকে খু/ন করার জন্য। সেদিন দরজা খুলা পেয়ে চেষ্টা সফল করেও ব্যর্থ হয়৷

এবার নিশ্চয় তোমার এ দুঃশ্চিন্তা কেটেছে। এতক্ষণ নিশ্চয় আমাকে মাফিয়া ভাবতে শুরু করেছিলে? ”

আরাবের কথা শুনে আয়েশা লজ্জা পাচ্ছিল এবার। সত্যিই সে আরাবকে ভালোবাসলেও আরাবকে সহজে বিশ্বাস করতে পারে না৷ একেক সময় আরাবকে তার একেক রকম মনে হয়৷ আরাবকে তার রহস্যময় কিছু মনে হয়৷ আয়েশার এবার একটু শান্তি লাগতে শুরু করল। সোনিয়ার অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে দেখে তার ভেতরটায় প্রশান্তি লাগছে। কারণ আয়েশার ভাগ্য সোনিয়াকে বহন করতে হয়েছে। সোনিয়াকে হরানোর ব্যথা তাকে ভীষণ করে পীড়া দিয়ে তাকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাত। আজকের পর সেটা আর হবে না৷ অন্তত পরকালে সোনিয়ার সাথে দেখা হলে সে বলতে পারবে তার খু/নীকে সে শাস্তি দিতে পেরেছে। আয়েশা আরাবের দিকে তাকাল। তারপর হালকা গলায় বলল

“আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে আর অবিশ্বাস করব না আমি। সবসময় আপনার উপর আস্থা রাখব। আপনার প্রতি সম্মান আমি বজায় রাখব। আপনাকে কখনও ঠকাব না। আপনাকে কখনও জেনে বুঝে কষ্ট দিব না। সবসময় ভালো রাখার চেষ্টা করব। এ মহসীন শুধু সোনিয়ার খুনী না। পরোক্ষভাবে আমার বাবার খুনী। আজকে আমার খুশি আপনাকে বুঝাতে পারব না। বাবাকে হারিয়ে আমার অবস্থা আজকে কী হত ভাবলেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমাকে নিরাশ করে নি৷ তিনি ঠিকেই ফেরেশতা করে একজনকে আমার জীবনে পাঠিয়েছেন। যার ছোঁয়ায় আমার সকল কষ্ট ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।”

আরাব আয়েশার দিকে কেবল চোখ দিয়ে আশ্বাসের একটা ইশারা করল। আয়েশা আরাবকে আবারও প্রশ্ন করল

“তিনমাস পর যখন মহসীনকে ধরিয়ে দিবেন তখন যদি পুলিশকে সে এসব বলে দেয় তাহলে তো আপনার নামে মামলা হয়ে যাবে।”

আয়েশার কথা শুনে আরাব হেসে বলল

“মাঝে মাঝে টাকার খেলায় অনেক কিছুই করা যায় আয়েশা। তোমার এসব চিন্তা করতে হবে। চলো এবার।”

এরপর আয়েশা আর আরাব সেখান থেকে বের হয়ে পুনরায় গাড়িতে উঠল। আয়েশার বেশ স্বস্তি লাগছে। শরীরটাও বেশ হালকা লাগছে। সে শুধু আড়চোখে আরাবকে দেখছে। আরাব বেশ মনোযোগ সহকারে গাড়ি চালাচ্ছে।

কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর গাড়িটা একটা শপিংমলে থামলো। আরাব সেখানে আয়েশা নিয়ে নামল। আয়েশাকে একটা শো রুমে নিয়ে গিয়ে বলল

“তোমার পছন্দ মতো জামা চুজ করো।”

আয়েশা জামা দেখছিল। কিন্তু যে কয়টা জামা সে দেখছে সেগুলোর দাম দেখে তার চোখ কপালে উঠতে লাগল। প্রতিটি জামার দাম ১০ হাজারের উপর। অনেক খুঁজেও সে কম দামে জামা পাচ্ছিল না। এত দাম দিয়ে জামা কেনার সাহসও তার হচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ সে জামা দেখল। কিন্তু কম দামে জামা আর পাচ্ছিল না। আরাব আয়েশার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল

“তোমার কী এখানে জামা পছন্দ হচ্ছে না? অন্য শো রুমে যাব?”

আয়েশা মাথা নুইয়ে উত্তর দিল

“জামা পছন্দ হয়েছে ঠিক তবে জামার দাম অত্যাধিক বেশি। ১০ হাজারের উপর একেকটা জামার দাম।”

আরাব আয়েশার হাত ধরে হালকা চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে বলল

“এখানে জামার দাম এমনেই। যে কয়টা পছন্দ হয় নাও। আমি বিল করে দিব।”

আয়েশা মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে একটা লাল জামা কেবল পছন্দ করল। যার দাম ১৪ হাজার টাকা। সে জামাটা হাতে নিয়ে আরাবকে দিয়ে বলল

“আমি এটাই নিব।”

আরাব বুঝতে পারছে আয়েশা দামের জন্য আর জামা নিচ্ছে না। তাই আরাব নিজ থেকে আরও ৭,৮ টা জামা নিল। এরপর ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে বিল দিল। টোটাল ৯ টা জামা নেয়া হয়েছে। বিল এসেছে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। আয়েশা বিল দেখে হা হয়ে গেল। আরাব আয়েশাকে নিয়ে বের হয়ে আবারও গাড়িতে উঠল। গাড়িটা চলতে লাগল। আয়েশা আরাবকে বলল

“আপনি যে টাকা দিয়ে একটা জামা কিনেছেন সে টাকা দিয়ে আমাদের দুমাস সংসার চলত। আর যে টাকা দিয়ে এক মুঠে আমাকে এতগুলো জামা কিনে দিলেন সে টাকার অর্ধেক ঋণের জন্য আমার বাবাকে মহসীনের কাছে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে। অথচ দেখুন আপনাদের কাছে এ টাকাটা কিছুই না। কতই অদ্ভুত এ দুনিয়া তাই না?”

আরাব আয়েশাকে বলল

“এটা নির্ভর করে আয়ের উপর। যার যত আয় তার খরচও তেমন। এখন আমার আয় যদি কম থাকত তাহলে আমি নিশ্চয় আরও কম খরচ করতাম৷ আয় আছে বলেই আমরা খরচ করি। আর সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করাও বড়ো মনের পরিচয়। এখন ধরো আমার বাসায় যারা কাজ করে তাদেরকেও আমি যে কাপড় দেই সেগুলো ভীষণ দামি। সেগুলো দিয়ে তারা ৪,৫ টা কাপড় কিনতে পারবে। আমি যদি তাদের ১৫০০ টাকা দিয়েও কিছু কিনে দিতাম তাতেও তারা খুশি হত। কিন্তু আমি তাদের দিই আমার আয় বুঝে। আমার আয়ের একটা অংশ আমার সমার্থ্য অনুযায়ী আমি খরচ করি। আমি আয় বুঝে ব্যয় করি। আর আমি কাউকে সাহায্য করতেও কার্পণ্য করি না। আর আয়েশা এগুলো কেবল তোমার বাসায় পরার জামা কাপড়। তাই সুতি জামা যেখানে বেস্ট পাওয়া যায় সেখানে নিয়ে গিয়েছি। তোমার পার্টি জামা গুলো আরো গর্জিয়াস এবং আরও দামি হবে। আস্তে আস্তে তোমার অভ্যস্ততায় এগুলো আনতে হবে। কারণ এখন তুমি গ্রামের সাধারণ মেয়ে না। আমার স্ত্রী। আর আমার স্ত্রীকে আমার সামর্থ্য অনুযায়ী বেস্টটা দিয়েই সাজিয়ে রাখব।”

বলতে বলতেই গাড়িটা ব্রেক কষলো। কথার পরতে আয়েশা এতক্ষণ বুঝতেই পারেনি কোথায় যাচ্ছে তারা। হঠাৎ করে একটা ফাঁকা জায়গায় গাড়িটা থামতে দেখে আয়েশা জিজ্ঞেস করল

“কোথায় আসলাম আমরা?”

আয়েশার উত্তরে আরাব যা বলল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে।

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৪

এক ঝাঁক বাচ্চা পাখির মতো উড়ে এসে আয়েশাকে ধরল। আয়েশা চমকে উঠল। কিছুই যেন তার বোধগম্য হচ্ছে না। পাশ থেকে একজন বুড়ো মহিলা আরাবকে বলতে লাগল

“বাছা বউ লইয়া আইছো? বউ তো অনেক সুন্দরী। তোমার লগে মানায়ছে বাছা।”

আয়েশা কিছুটা বিস্মিত। কী থেকে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে কী করবে সেটাও তার বুঝে আসছে না। বৃদ্ধ মহিলার কথার উত্তরে আরাব বলল

“তোমরা কও বউ দেখবা। তোমাগো শখ পূরণ করলাম। খুশি তো সবাই? দোয়া কইরো।”

আরাবের ভাষার টোন শুনে আয়েশা আরও বিস্মিত হয়ে গেল। আরাবের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাল সে। আয়েশার বিভ্রান্তি বুঝতে পেরে সে বাচ্চাদের ইশারা করল আয়েশাকে ছাড়তে। বাচ্চারা তাকে ছেড়ে দিল। আরাব আয়েশাকে নিয়ে এক পাশের একটা ছাউনিতে বসলো। সামনে অনেক বাচ্চা খেলছে। বৃদ্ধরা আড্ডা দিচ্ছে। আয়েশা কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল

“উনারা কারা? আমরা কোথায় এসেছি?”

আরাব উত্তর দিল

“এটা একটা এতিমখানা এবং বৃদ্ধাশ্রম। এখানে এক পাশে এতিম বাচ্চাদের সকল ধরণের বরণ পোষণ আর পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে৷ অন্য পাশে অসহায় বৃদ্ধদের। আর এ মাঠটায় রাতের বেলাতেও বেশ আলোকিত এজন্য রাখা হয় যাতে করে বাচ্চারা এবং বৃদ্ধরা একসাথে সময় কাটাতে পারে। বাচ্চাদের যেন এটা মনে না হয় তাদের গার্ডিয়ান নাই। আর বৃদ্ধদেরও যেন এটা অনুভব না হয় তারা একা। বাচ্চাদের বৃদ্ধরা নিজের নাতি/নাতনির মতোই আদর করে।

এটা আমার করা একটা ভালো উদ্যোগ বলতে পারো। আমি তো একটা সময় চিন্তা করে নিয়েছিলাম জীবনে বিয়ে করব না। কাউকে এ জীবনে জায়গা দিব না৷ সন্তানের অভাব আমি এ বাচ্চাদের দিয়েই পূরণ করেছি বলতে পারো। যতদিন আল্লাহ সামর্থ্য দিবেন এদের জন্য করে যাব। আমি মনে করি ওদের দোয়ার বরকতে আমার বিজনেসে এত সাকসেস। ১০জন বিজনেস ম্যানের মধ্যে আমার নাম আছে। আল্লাহ এত রিজিক কী এমনি এমনি দিয়েছেন? নাহ্ এমনি এমনি দেননি। এদের সেই রিজিকে হক আছে বলেই আমার রিজিক বৃদ্ধি করে দিয়েছেন৷ ঐ যে বললাম না আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সবার জন্য করে যাব। আমার কাছে জীবন মানে কাঠগড়া না। বরং জীবন উপভোগের অনেক ভালো উপায় আছে সেগুলো বেছে জীবন উপভোগ করা। আমার ভালো দিক আছে আবার খারাপ দিকও আছে। আমি ভীষণ রাগী। কখনও রেগে গেলে আমি হিংস্র হয়ে যাই। এ রাগটা বর্জনের অনেক চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ। আমার রাগ সহজে উঠে না। অনেকটা সীমা অতিক্রম হলে রাগ উঠে। অন্যথায় রাগ সবসময় নিবারণ থাকে। আমার জীবনের আরও কিছু অধ্যায় আছে সবকিছুর সাথে তোমাকে আমি পরিচয় করিয়ে দিব। ধীরে ধীরে আমাকে চেনার ব্যবস্থা আমি করে দিব তোমাকে।”

আয়েশা আরাবের দিকে তাকালো। সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা তার চলে গেল। আরাবকে সে নতুন করে আবিষ্কার করল আজকে। তার কাছে আরাবকে হিরো নয় বরং সুপার হিরো লাগছে। সে কোনো কথায় বলতে পারছে না। কেবল আরাবের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। আরাব আয়েশাকে ডাকলেও সে কথা বলতে পারছে না। সে যে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে তার চোখ সরছেই না। হঠাৎ হাতে আরাবের চিমটিতে আয়েশা চেঁচিয়ে উঠে বলল

“আহ্ ব্যথা পাচ্ছি তো। কী করছেন?”

আরাব হেসে জবাব দিল

“ব্যথা পাওয়ার জন্যই দিয়েছি। যেভাবে তাকিয়ে আছো মনে হচ্ছে আমার নাককে হিমালয় ভেবে কল্পনায় নাকের ডগায় উঠতেছো।”

আরাবের কথা শুনে আয়েশা জোরে হেসে দিল। আয়েশার হাসি ভীষণ সুন্দর। আয়েশার হাসিতে আরাবের চোখ আটকে গেল। আয়েশা বেশ কিছুক্ষণ হেসে লক্ষ্য করল আরাব এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই সে ও আরাবকে বলে উঠল

“এখন কী আপনি আমার নাকের ডগায় উঠে যাচ্ছেন?”

আরাব উত্তর দিল

“হাসির উচ্ছাসে তলিয়ে যাচ্ছি। আয়েশা তোমার হাসি ভীষণ সুন্দর। আমার তোমার প্রতি দুর্বল হতে ভয় লাগে। এ অসম সম্পর্ক টিকবে তো? বদলে যাবে কি’না বেশ দ্বিধায় আছি আমি।”

আয়েশা আরাবের হাত ধরে বলল

“আমার কাছে সবটা স্বপ্ন লাগছে। আমার তো মনে হয় আমি স্বপ্ন দেখছি। আর হঠাৎ সে স্বপ্ন ভেঙে গেলে শুনব আপনি আমাকে হিপনোটাইস করছেন নাহয় আনজুমান ফিরে এসেছে। উনাকে কখনও দেখিনি। তবে উনার প্রতি তীব্র হিংসা আমার কাজ করে। কবে আপনার সমস্ত মন জুড়ে নিজেকে বিস্তার করে আনজুমানের নাম মুছতে পারব জানি না। আমার ভয় লাগে আমাদের এ ভালো মুহুর্তে আনজুমান ফিরে আসলে কী করবেন?”

আনজুমানের কথা শুনে আরাবের মুখটা শুকিয়ে গেল। সে উত্তরে বলল

“আনজুমান ফিরে আসলে এতদিনে চলে আসত। আর আনজুমানের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে। সে ফিরে আসলে কী করব সেটা ভাবা হয়নি৷ আর এটা এখন ভেবে ভালো মুহুর্তটাকে বিষাদে পরিণত করতে চাই না। আমি মুভ অন করতে চাই আয়েশা৷ আমাকে মুভ অন করতে দাও। আনজুমানের কথা বলে আমার কালো অতীতটাকে মনে করে দিও না।
যাইহোক উঠো। বাসায় যেতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে।”

আয়েশা মাথা নাড়লো। এরপর আরাব আর আয়েশা সবার কাছে বিদায় নিয়ে পুনরায় গাড়িতে উঠল। রাতের শহর কত চাকচিক্য। আয়েশা এ শহরে নতুন। এর আগে কখনও ঢাকায় আসেনি সে৷ আয়েশা চারপাশ কেবল দেখছে। রিজিক কত বড়ো জিনিস ভাবছে সে। আল্লাহ কার রিজিক কীভাবে লিখে রাখে বলা যায় না৷ আয়েশার রিজিক যে এ শহরে ছিল সে কখনও ভাবতেই পারেনি। কোথায় ছিল সে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সে। একটা সময় টাকার জন্য কত কষ্টই না করত সে৷ আজ সে টাকা তার পিছু ছুটছে। এ যেন কল্পনাকেও হার মানায়।

গাড়িটা আবারও বাসায় এসে পৌঁছালো। আরাব গাড়ি থেকে নামল তারপর আয়েশাকে নামতে বলল। দুজনেই বাসায় প্রবেশ করল। আরাব চলে গেল আরাবের রুমে। আর আয়েশা চলে এসেছে আয়েশার রুমে। আয়েশার মনটা আজকে ভীষণ ফুরফুরা। তার খুশি তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। আয়েশা ঘরে ঢুকতেই লতা পেছন থেকে ডেকে বলল

“আপু ভেতরে আসব?”

আয়েশা উত্তরে বলল

“হ্যাঁ আসো তো।”

লতা ভেতরে প্রবেশ করল৷ আয়েশা ব্যাগ থেকে লতাকে এক জোড়া কানের দুল দিয়ে বলল

“এটা তোমার জন্য।”

লতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল

“এটা তো অনেক দামি আপু।”

আয়েশা হেসে উত্তর দিল

“এটা তোমার জন্যই নিয়েছি আমি। ১৭০০ টাকা নিয়েছে। আমার জন্য যে শো রুমে জামা কিনতে গিয়েছিলাম সেখানে এ ছোটো কানের দুলগুলো চোখে পড়েছিল। এরপর দামটা দেখে মনে হলো মোটামুটি সস্তা। তাই নিয়ে আসলাম। আমি যখন অনেক ইনকাম করব তখন তোমায় আরও দামি গিফট দিব লতা৷ আগে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াই।”

লতা বিস্ময় সুরে বলল

“১৭০০ টাকা অনেক টাকা আপু। এত টাকা দিয়ে এনেও বলতেছেন সস্তা! এত দামী জিনিস আমার হজম হবে কি’না বুঝতেছি না। ১৭০০ টাকা দিয়ে এক জোড়া কানের দুল পরব আমি! ভাবতেই পারছি না।”

আয়েশা লতার কাছে গিয়ে বলল

“লতা আমার পরিবারও নিম্নবিত্ত। দিনে এনে দিনে খেত। এ ১৭০০ টাকা আমার কাছেও অনেক বেশি। তবে আমাকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল সেখানে এর থেকে সস্তা আর কিছু নেই। যা আছে সব অনেক দামী। আমার কাছে তো এগুলো স্বপ্ন লাগছে। যে আমি কখনও ১৭০০ টাকার জামায় পরিনি সে কি’না তোমাকে ১৭০০ টাকা দিয়ে ছোট্ট এক জোরা কানের দুল গিফট করছি এটা সত্যিই আমার কাছে বিস্ময়ের থেকেও বেশি কিছু। আচ্ছা লতা আমার হাতে একটা চিমটি কাটো তো। দেখি তো আমি স্বপ্ন দেখছি কি’না। ”

লতা আয়েশার কথা শুনে আয়েশার হাতে চিমটি কাটল। আয়েশা ওহ্ করে শব্দ করে উঠল। আয়েশার শব্দ শুনে লতা বলে উঠল

“আপু আপনি স্বপ্ন দেখছেন না। দেখলেন না ব্যথা পাচ্ছেন। আপনার মন অনেক ভালো। আপনার জীবনে আরও সাফল্য আসবে। আপনি তো ছাত্রী ভালো। আমি তো পড়ালেখায় একদম ভালো না। পড়তেও ভালো লাগে না। ক্লাস সেভেনে যখন উঠলাম তখন একটা প্রেম করে বাবার কাছে ধরা খেলাম। এরপর বাবা পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দিয়ে দিল। ১৪ বছরে বিয়ে হয়েছে আমার। ৩ বছর সংসার করলাম৷ একটা বাচ্চা হয়েও মারা গেল। স্বামীর অত্যাচার, শ্বশুড় শ্বাশুড়ির অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম।”

কথাটা বলেই লতা তার হাত দেখিয়ে বলল

“এই যে দেখুন কাটা দাগ। হাত কেটে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ ঠিকই বাঁচিয়ে রাখলেন৷ এরপর বাবার বাড়ি ফিরে আসি। একটা বাসায় প্রথম কাজ নেই। সে বাসাতেও কারণে অকারণে ভুল হলেই মারত। টানা এক বছর অত্যাচার সহ্য করে একদিন সেখান থেকে পালিয়ে আসলাম। এরপর সুজনের সাথে পরিচয়। সুজন আমাকে পছন্দ করে ভীষণ। তবে এত সব যন্ত্রণার মাঝে তাকে পাত্তা দেওয়া আমার হয়ে উঠেনি। বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম ১৬০০ টাকায়। সেই ১৬০০ টাকা জোগাড় করতে পারছিলাম না বলে আমাকে ঘর থেকে রাস্তায় বের করে দিল। রাস্তায় বসে কাঁদছিলাম।
সুজন জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। তখন তাকে সব খুলে বললাম। সে তখন জানাল এ বাসায় একজন কাজের লোক দরকার। আমি রাজি হয়ে গেলাম। মনে সংশয় ছিল আমাকে এবারও না যন্ত্রণার আগুনে পুড়তে হয়। সোনিয়া হাসপাতালে ভর্তি এটা শুনে আরও বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম৷ ভেবেছিলাম আপনারা তাকে মেরে এ হাল করেছেন৷ তবে একটা সময় বুঝতে পারলাম আপনাদের মতো ভালো মানুষ নেই। যেই আমি ১৬০০ টাকার জন্য ঘর ছাড়া হলাম সে আমি আজকে ১৭০০ টাকার কানের দুল পরব। সত্যিই জীবন অনেক অদ্ভুত। আল্লাহ আমাকে কষ্টের পর এক চিলতে সুখ দেখিয়েছেন।”

আয়েশা লতার দিকে তাকাল। লতার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। লতার মতো বাচ্চা একটা মেয়ে এত কষ্ট সহ্য করেছে ভেবে তার বুকটা খা খা করছে। আয়েশা লতাকে ধরে বলল

“মন খারাপ করো না। এত কষ্ট পেয়েছো বলেই আল্লাহ তোমাকে সুখের মুখ দেখিয়েছে। কষ্টগুলো কেবল পরীক্ষা ছিল আর কিছু না৷”

লতা চোখের জল মুছে বলল

“খাবেন না? রাতে কী খাবেন?”
“হুম খাবো তো। তুমি যাও। আমি ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে আসছি।”

লতা চলে গেল। আয়েশা নিজেকে ফ্রেশ করে নিল। বেশ রাত হয়েছে। এত রাতে আরাব কী খাবে আয়েশা জানে না। তবে ভারী খাবার খাবে না এটা সে বুঝতে পারছে। তাই হালকা খাবার কী দেওয়া যায় তাই ভাবছে। ভাবতে ভাবতেই সে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

হঠাৎ তার চোখে কিছু একটা অবলোকিত হল। সে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল।..

#বেহালার সুর
#পর্ব- ১৫
#শারমিন আঁচল নিপা

আরাব আয়েশার আগেই কিচেনে গিয়ে কী যেন বানাচ্ছে। আয়েশার চোখ কপালে উঠে গেল। সে দ্রূত সেখানে গেল। আরাবের দিকে তাকিয়ে বলল

“কী করছেন?”

আরাব স্লাইস করা চিকেনটা এবং তার সাথে সবজিগুলো হালকা তেলে ছেড়ে ভাজতে ভাজতে বলল

“একটা মজার রান্না করছি। চিকেনের সাথে হালকা সবজি, ক্যাপসিকাম, এরপর পরিমাণ মতো মসলা দিয়ে হালকা তেলে ভেজে রুটি দিয়ে খেলে ভীষণ টেস্ট হয়। এত রাতে এটা খাওয়ার জন্য বেস্ট হবে। অতিরিক্ত তেলমশলা দিয়ে খাবার এত রাতে হজম হবে না। বয়স হয়েছে তো বুঝতে হবে।”

আয়েশা আরাবের কথা শুনে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল

“আপনি রান্না পারেন?”

আরাব হেসে বলল

“আমি বিদেশে মানুষ। বিদেশে এত কাজের লোক থাকে না। সেখানে নিজের কাজ নিজে করে খেতে হয়। নিজের রান্না নিজেই করে খেয়েছি। সব রান্নাই পারি৷ সময়ের অভাবে করা হয় না শুধু। তুমি বসো আমি চিকেনটা ভেজে রুটি গুলো ভেজে নিয়ে আসতেছি।”

আয়েশা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে বলল

“আপনি রুটিও বানাতে পারেন?”

আরাব অট্ট হেসে বলল

“নাহ! আমি এ কঠিন কাজটি করতে পারি না। রুটি বানাতে গিয়ে আমার বাংলাদেশের মানচিত্র হয়ে যায়। ফ্রোজেন রুটি কিনতে পাওয়া যায়। ঐটায় জাস্ট প্যাকেট খুলে ভেজে নিব।”

আয়েশা আরাবের হাতে থাকা খুন্তিটা ধরে বলল

“আমাকে দিন আমি করে দিচ্ছি সব। আপনার এত কষ্ট করতে হবে না। আমি রুটি ভেজে নিয়ে আসছি।”

আরাব আয়েশার হাত থেকে খুন্তিটাকে ছাড়িয়ে বলল

“ভালো মেয়ের মতো যা বলছি করো। বলেছি তোমাকে গিয়ে বসতে, বসো। আমিই রান্না করে নিয়ে আসতেছি। আজকে আমার রান্নায় তুমি খাবে। কাল তো আছেই। রান্না করো তখন।”

আয়েশা ডাইনিং টেবিলে এসে বসল। কিচেনটা ওপেন। তাই সে ডাইনিং টেবিলে বসেই আরাবকে দেখছে। সে খুব মনোযোগ সহকারে রান্না করছে। আরাবের প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি আয়েশা লক্ষ্য করছে। আরাবের রান্না প্রায় শেষ। চিকেনটা তুলে রুটি গুলো হালকা ঘি তে ভেজে নিচ্ছে সে। এরপর প্লেটে সুন্দর করে সব পরিবেশন করে নিল। দু হাতে দুটো প্লেট নিয়ে সে আয়েশার কাছে আসলো। আয়েশার দিকে একটা প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল

“খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।”

আয়েশা আরাবের হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে রুটি দিয়ে চিকেনটা খেল। আরাবের রান্না সত্যিই অনেক মজা হয়েছে। সে খেয়ে ভাবতে লাগল ছেলে মানুষও এত ভালো রান্না করে তা জানা ছিল না তার। কারণ গ্রামে মেয়েরাই এসব কাজ করে। আর বউকে রান্না করে খাওয়ানো তো দূরে থাক একদিন বউ যদি রান্না না করে তাহলে অত্যাচারের শেষ নেই৷ সে আরাবকে খেতে খেতে বলল

“আপনি অনেক ভালো রান্না করেন। সত্যিই অনেক মজা হয়েছে। ছেলে মানুষ এত ভালো রান্না জানে আমার জানা ছিল না।”

আরাব হেসে উত্তর দিল

“শহরের সব দামী রেস্টুরেন্ট গুলোতে শেফ ছেলেরায় হয়। আর আমার হোটেল ম্যানেজম্যান্টেও কোর্স করা আছে। সব ধরণের রান্নায় পারি। তোমাকে মাঝে মধ্যে রান্না করে খাওয়াব নে।”

আয়েশা মাথা নাড়ল শুধু। তাদের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। আরাব শুধু খাওয়া শেষ করে বলল

“আয়েশা সকালে তৈরী থেকো। কালকে তোমাকে নিয়ে কলেজে যাব। তোমাকে এডমিট করাব। কাগজপত্র সব রেডি করা শেষ।”

আয়েশা কেবল মাথা নাড়ল। আরাব তার রুমে চেলে গেল। আয়েশাও খাবার শেষ করে লতাকে খেতে বলল। এরপর সে তার রুমে চলে আসলো। বিছানায় গা এলিয়ে সে কেবল সারাদিনের কথায় ভাবছে। সবকিছু এত দ্রূত হচ্ছে যে তার ভীষণ ভয় লাগছে তাতে। বারবার মনে হচ্ছে সবটা স্বপ্ন। এভাবে তার জীবনের এত সুন্দর একটা মোড় নিবে সে বুঝতেই পারে নি। সে কেবল আরাবকে চিন্তা করছে। চোখ বন্ধ করলেই আরাবের মুখটায় চোখে ভেসে উঠছে। ছটফট করছে সে। সারাক্ষণ আরাবের সাথে থেকে এখন একা একা বেশ বিষন্ন লাগছে তার। একাকীত্ব যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। সকালের অপেক্ষা করছে সে। সময়টা যেন এখন কাটছেই না।

ছটফট করতে করতেই সে ঘুমিয়ে গেল। বাইরে আজান হচ্ছে। আয়েশা চটপট উঠে নিল। এরপর সরাসরি অজু করে নামাজ পড়ে নিল। নামাজ শেষে গোসল করে চুল শুকিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে নিল। সকাল ৭ টার মধ্যেই সে রেডি হয়ে বসে আছে। লতা এসে আয়েশাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল খাবে কিনা। কিন্তু আয়েশার গলা দিয়ে এখন কিছুই নামবে না। আয়েশা কেবল আরাবের অপেক্ষা করছে। কখন আরাব উঠবে তাকে দেখবে সে চিন্তায় তার মাথায় ঘুরছে। ভীষণ অস্থির হয়ে লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিচ্ছে সে।

এর মধ্যেই ৮ টা বাজলো। আরাব উঠেই ড্রইং রুমে এসে আয়েশাকে দেখে কিছুটা চমকে উঠল। আয়েশা এত সকালে সেজেগুজে বসে আছে দেখে সে কিছুটা অবাক হলো। সে আয়েশার কাছে গিয়ে বলল

“রাতে কী তুমি ঘুমাওনি? আমরা তো বের হব দশটায়। তুমি এত সকাল সকাল তৈরী হয়ে আছো কেন?”

আয়েশা কিছুটা কাঁপা গলায় আমতা আমতা করে বলল

“আমি ভাবলাম যদি দেরি হয়ে যায় আর আপনি রেগে যান। তাই দেরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে আমি আগেই তৈরী হয়ে গিয়েছি। ভীষণ ভয় লাগছে। এতদিন পড়ালেখার বাইরে ছিলাম। আবার পড়ালেখা শুরু হবে আজকে থেকে। এ শহরের সবার সাথে তাল মেলাতে পারব কি’না এসব ভেবে নার্ভাস ফিল হচ্ছে।”

আরাব আয়েশার পাশে বসলো। আয়েশার হাত ধরে বলল

” আমার বিশ্বাস তুমি সবটা সামলে নিতে পারবে। এখানে চলাফেরার ধরণ, হাবভাব আমি সব শিখিয়ে দিব তোমাকে। সময় লাগবে রপ্ত করতে। তবে আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। তোমার মধ্যে সে গুণ আমি লক্ষ্য করেছি। আয়েশা অনেক পড়াশোনা করে অনেক বড়ো হও। আমি চাই তোমার বাবার স্বপ্ন তুমি পূরণ করো। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। তোমাকে যেন সবাই তোমার পরিচয়ে চিনে সে বিষয়টাই মাথায় রাখবে। নিজের পরিচয় তৈরী করা অনেক বড়ো বিষয় আয়েশা। নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার এটাই সুযোগ। এ সুযোগকে হেলাফলা করবে না। বয়সটা আবেগের। আর আবেগকে কন্ট্রোল করতে পারলেই তুমি সাকসেস।”

আয়েশার মনোবল ফিরে আসতে লাগল আরাবের কথায়। তার বাবার স্বপ্ন ছিল সে বড়ো ডাক্তার হবে। আয়েশা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল। যত কষ্টই হোক সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। বড়ো ডাক্তার হবে। একদিন সবার সামনে বুক ফুলিয়ে বলবে আমি ডাক্তার আয়েশা। তার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পেতে লাগল। সে আরাবকে ধরে বলল

“আপনি পাশে থাকলে আমি সব পারব। আমি আপনার কথার মাঝে শক্তি খুঁজে পাই। আমার শক্তির জেগানদাতা আপনি। আমি আপনার চাওয়াকে কখনও অসম্মানিত হতে দিব না। ইনশাআল্লাহ আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করব। আপনার চাওয়া পূরণ করব। নিজের একটা পরিচয় আমি তৈরী করব।”

আয়েশার কথা শুনে আরাবও বেশ সাহস পেল। আয়েশাকে নিয়ে নামা যুদ্ধে সে জয়ী হবে এটাই তার মনে হচ্ছে। আরাব আয়েশাকে বসতে বলে নিজে পরিপাটি হয়ে নিল। ঘড়ির কাটায় ৯ টা বাজে। আরাব ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে আয়েশাকে আসতে বসলো। আয়েশা আরাবের ডাকে সাড়া দিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো। এরপর দুজন মিলে সকালের নাস্তা করল। নাস্তা করতে করতে ৩০ মিনিট পার হয়ে গেল।

নাস্তা শেষে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে গন্তব্যের দিকে রওনা দিল৷ তারা ঠিক এগারোটায় কলেজে পৌঁছালো। আরাব আয়েশাকে নিয়ে কলেজের অফিসে প্রবেশ করলো। এরপর আয়েশাকে ভর্তি করিয়ে দিল।

ভর্তির আগে অবশ্য আয়েশার ছোটোখাটো ইন্টারভিউ তারা নিয়েছে। আয়েশার বিচক্ষণতা দেখে তারা বেশ মুগ্ধ। কলেজ শিক্ষিকা তানিয়া আরাবকে ডেকে বললেন

“আয়েশাকে ভর্তি করানোর জন্য আপনার কোনো এক্সট্রা চার্জ লাগবে না। আয়েশার মতো একটা স্টুডেন্ট পেয়ে আমরা খুশি। বেশ বিচক্ষণ, পটু। এ মেয়েকে দিয়ে কিছু একটা হবেই। আমরা বেশ আশাবাদী আয়েশাকে নিয়ে। আমরা আয়েশাকে ভর্তি নিয়ে নিয়েছি। আয়েশা কাল থেকে ক্লাস শুরু করলেই হবে। ক্লাস টাইম সকাল ৯ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত। আর আমাদের কলেজের একটা ড্রেস কোড আছে। সেটা কলেজের সামনের টেইলার্সকে বললেই বানিয়ে দিবে।”

আরাব শিক্ষিকা তানিয়ার কথা শুনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কলেজ বিদায় নিয়ে তারা বের হলো৷ এরপর আয়েশাকে নিয়ে টেইলার্সে এসে কলেজ ড্রেস অর্ডার দিল। কলেজ ড্রেস অর্ডার দেওয়ার পর তারা আবার গাড়িতে উঠল। আরাব আয়েশাকে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল

“কলেজের শিক্ষক শিক্ষিকারা আজকে যেভাবে প্রসংশা করেছে আমি এ প্রশংসাটা সবসময় শুনতে চাই। নিজের এ মানটা ধরে রেখো।”

আয়েশা নম্র গলায় উত্তর দিল

“আমি সবসময় চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। ”

আয়েশা আরও কিছু বলতে যাবে। এমন সময় লক্ষ্য করল একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। আরাব দ্রূত তাদের গাড়িটা সাইট করতে নিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। সাথে সাথেই ট্রাকের ধাক্কা খেল গাড়িটা। আরাব আর আয়েশা…

চলবে।