বেহালার সুর পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
223

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৬

আরাব আর আয়েশা গাড়ির দরজা খুলে পাশেই ছিটকে পড়ল। আয়েশার কপাল পাশে থাকা দোকানের সাটারে লেগে কেটে গড়গড়িয়ে রক্ত বের হতে লাগল। আরাব আয়েশার কপালে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখে আতঙ্কিত হয়ে গেল। পুরনো সে রোগটা তাকে আবার ঘিরে ধরল। সে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারাল। আয়েশার একার পক্ষে আরাবকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই রাস্তায় অনেকেরেই সাহায্য সে চাচ্ছে। তবে সবাই কেবল ভিডিও আর ছবি তুলায় ব্যস্ত। আয়েশা এতবার করে সবাইকে বলছে হেল্প করতে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। আয়েশার রাগটা বাড়তে লাগল মানুষের এ কান্ড দেখে। সে নিজের উড়নাটা দিয়ে কপালটা বেঁধে নিল যাতে করে রক্ত না পরে। এরপর যারা যারা তাদের ছবি, ভিডিও করছিল তাদের মধ্য থেকে একজনের ফোন নিয়ে রাস্তায় আছাড় মারল। সাথে সাথে ফোনটা ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেল। আয়েশা ফোনটা আছাড় মেরে বলে উঠল

“অমানুষের দল। একটা লোক জ্ঞান হারিয়েছে তোরা হাসপাতালে নিতে সাহায্য তো করছিসেই না উল্টা ছবি, ভিডিও করছিস। তোরা তো মানুষ না, কুত্তার দল। কুত্তার মতো এখানে এসে ঘেউ ঘেউ করছিস। মানুষটার অবস্থা খারাপ সেদিকে তোদের হুস নেই৷”

আয়েশার কথা শুনে তাদের মধ্যে থেকে একজন তেড়ে এসে আয়েশাকে আঘাত করতে নিলো। সে সাথে যার ফোন ভেঙ্গেছে সেও রাগে আয়েশাকে মারতে আসতে নিল। ঠিক তখনেই পেছন থেকে একজন সে ছেলেকে একটা লাথি দিল। সাথে সাথে ছেলেটি দূরে ছিটকে পড়ল। সে সাথে পাশে থাকা অপর ছেলেটিকেও লাথি দিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে বলল

“মিরাজ এদের সব কয়টাকে ধরে থানায় নিয়ে চল। ওদের এমন আদর করবি যাতে এরপর কোনো এক্সিডেন্ট হলে ভিডিও তো দূরে থাক প্রয়োজনীয় কলও যেন ফোন তুলে ধরতে না পারে। রাস্তায় এসে মাস্তানি শুরু করেছিস? লাফাঙ্গা পোলাপাইন একটা ফোন পাইছিস আর যেখানে সেখানে ভিডিও করে বেড়াচ্ছিস। মিরাজ ওদের যখন মারবি তখন ওদের ভিডিও করে সমস্ত মিডিয়ায় ছেড়ে দিবি। যাতে করে ওদের দেখে বাকিরা শিক্ষা পায়। এখানে কী সার্কাস চলছে যে তোরা ভিডিও করতে এসেছিস?”

কথাগুলো অফিসার তরুন কনস্টেবল মিরাজকে উদ্দেশ্য করে বলছিল। অফিসার তরুনের কথা শুনে কনস্টেবল মিরাজ আর সৌরভ মিলে সেখানে ভিডিও করা সব কয়েকটাকে ধরে থানায় নিয়ে গেল। অফিসার তরুন আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল

“আমি উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহায্য করছি। ট্রাকটাকে আমরা ফলো করছিলাম। মাদকের ট্রাক ছিল। ড্রাইভার আমাদের ফাঁকি দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ”

কথা গুলো বলতে বলতেই আরাবকে তুলে হাসপাতালে নেওয়া হলো। আয়েশার মাথায় ব্যান্ডেজ করা হলো। আরাবের জ্ঞান এখনও ফিরছে না। আয়েশার শরীর কাঁপছে। আরাবের চিন্তা তাকে ঝেঁকে ধরল। সে বসে আছে করিডোরে। হঠাৎ করে একজন নার্স এসে বলল

“আরাব সাহেবের সাথে কে আছেন? উনার জ্ঞান ফিরেছেন। আপাতত উনি সেইফজোনে আছেন। চাইলে দেখা করতে পারেন।”

আয়েশা আরাবের কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল। আরাবের কাছে যেতেই আরাব শুয়া থেকে বসলো। তারপর ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করল

“তুমি ঠিক আছো তো আয়েশা? তোমার কিছু হয়নি তো?”

আয়েশা আরাবকে ধরে বলল

“আমার তেমন কিছুই হয়নি। আমার মাথাটা কেবল ফেটেছে। আর সে রক্ত দেখেই আপনার এ হাল হলো। আপনি দয়াকরে এ রোগের জন্য ডাক্তার দেখান। এরকম হলে তো বিপদজনক। আমার কখনও কোনো বিপদ হলে বা রাস্তার কারও বিপদ হলে, কারও রক্ত ঝড়লে আপনি তো স্থির থাকতে পারবেন না। আর আপনি যদি অসুস্থ হয়ে যান তখন কে আপনাকে নিয়ে দৌঁড়াবে? এ অচেনা শহরে কেউ আসে না সাহায্য করতে। সবাই কেবল আসে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে। আপনি যখন জ্ঞান হারিয়েছিলেন তখন আমাকে একটা মানুষ ও সাহায্য করতে আসে নি। অফিসার তরুন যদি না থাকত তাহলে আমাদের যে কী হত? ”

কথাটা শেষ করতে না করতেই অফিসার তরুন কেবিনে এসে আরাবকে জিজ্ঞেস করল

“কী রে শরীর কেমন তোর? আর আয়েশা আমিও এগিয়ে আসতাম না। এ দেশে পুলিশও এত ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কেউ যদি অভিযোগ করে ডেকে না আনে তাহলে পুলিশও এসব ঝামেলা দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়। মানুষ কখনও মানুষের জন্য না। আরাব আমার বন্ধু বলেই তখন এগিয়ে এসেছিলাম। আরাবকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। নাহয় কখনই এতটা কো অপারেটিভ হতাম না। বিষয়টা স্বার্থপর লাগলেও এটাই সত্যি। একটা লাশও যদি দুই থানার মাঝখানে পড়ে আমরা সে লা/শ মেপে যে থানায় বেশি অংশ থাকে সে থানায় পাঠাই। নিজেদের উপর এত ঝামেলা নিই না৷ কারণ থনায় ঝামেলার শেষ থাকে না৷ যাইহোক এসব কথা বাদ দিই।”

এরপর আরাবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “আরাব শরীর কেমন লাগছে তোর?”

আরাব অফিসার তরুনের পিঠে একটা থাবড় দিয়ে বলল

“বেটার লাগছে। শরীরটা ভীষণ কাঁপছিল। এখন ঠিক আছে। ঐ যে ব্লাড নিতে পারি না। দেখলেই সে পুরনো এক্সিডেন্ট মনে পড়ে যায়। যার জন্য চায়লেও নিজেকে সামলাতে পারি না। মানসিক রোগ হয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা। যতই ভুলতে চাই সে স্মৃতি বারবার হানা দেয়। পিছু ছাড়ছে না সে কালো অধ্যায়। নিজেকে সামলিয়েও পেরে উঠিনি। আর এখন তো মনে হয় যত বয়স বাড়ছে সামলানোর ক্ষমতা তত কমছে।”

অফিসার তরুন আরাবের কথা শুনে সবগুলো কথাকে উড়িয়ে দিল। যাতে করে এ বিষয় নিয়ে আর বেশি কথা না বাড়ে। তাই তিনি বললেন

“আরে বাদ দে সেসব কথা। এখন আর সে নির্মম অতীত মনে করতে চাই না। এবার বল তুই বিয়ে করে ফেলেছিস আমরা কেন দাওয়াত পেলাম না? এক্সিডেন্ট না হলে তো জানতামেই না তুই বিয়ে করে ফেলেছিস। আমি তো ভেবেছিলাম তোর কোনো আত্মীয় হবে। পরে আয়েশার মুখে শুনলাম তোর স্ত্রী। আমি তো একদম অবাক হয়ে গেলাম এটা শুনে যে তুই বিয়ে করেছিস। অষ্টম আশ্চর্য লাগছিল। এ ঘটনার মাঝে বুঝতে পারলাম মানুষ একটা সময় সঙ্গ চায়। সব ভুলতে চায়। ”

আরাব হালকা হেসে বলল

“জানানোর সুযোগ পাইনি। আর একটু সময় নিতে চাচ্ছি নিজেদের মধ্যে বুঝার জন্য। বিয়ের ও একটা বড়ো কাহিনি আছে। বাসায় আয় একদিন বলবনে তোকে। জীবনে কখন কী ঘটে বুঝা যায় না৷ হুট করে সব হয়ে যায়। সবই আল্লাহর পরিকল্পনা। আমাদের পরিকল্পনা কেবল মানসিক স্বাত্ত্বণা। যাহয় সব আল্লাহর পরিকল্পনাতেই হয়৷ যাইহোক দিনকাল কেমন যাচ্ছে তোর? পরিবারের সবাই কেমন আছে?”

অফিসার তরুন দীর্ঘ নিঃস্বাস ফেলে বলল

“বাচ্চারা আর আমি ভালোই আছি। বাচ্চার মায়ের খবর জানি না। ৮ মাস হয়ে গেল আমরা আলাদা থাকছি। ডিভোর্স হলো ৪ মাস হয়েছে। বাচ্চাদের খুঁজও নিতে আসে না। কাহিনি বলে শেষ করতে পারব না বলতে গেলে। বাদ দিই বিষয়টা। সে ভালো থাকুক। আমিও ভালো আছি বাচ্চাদের নিয়ে। তবে তোর বিয়েতে আমি খুশি হয়েছি৷ জীবনটাকে সাজানোর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস এটা ভালো। একা জীবন পার করা কষ্ট। দিনশেষে একজন লাগে যাকে সব বলা যায় সব শুনানো যায়। যার সে মানুষটা নেই তার জীবনে কষ্টের শেষ নাই। ধুর কী শুরু করলাম! বাদ দেই এসব করুণ কাহিনি।

তুই বাসায় গিয়ে রেস্ট কর। আমি এদিকের সব ম্যানেজ করে নিচ্ছি। গাড়িটা থানায় আছে। সময় করে পাঠিয়ে দিব৷”

অফিসার তরুন বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। আয়েশা আর আরাব অফিসার তরুনকে বিদায় দিল। আরাব হাসপাতালের সকল বিল পরিশোধ করে বাসায় আসলো। শরীরটা একটু ভালো লাগছে তার। তবে আয়েশার মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। চোখ ঝাঁপসা লাগছে তার। ঘরে প্রবেশ করেই দাঁড়ানো থেকে বসে পড়ল সে। আয়েশাকে হুট করে বসে পড়তে দেখে আরাব দ্রূত ধরল । তাকে ধরে সোফায় বসিয়ে বলল

“এনিথিং রং?”

আয়েশা ঢুক গিলে বলল

“মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে আর শরীরটা অনেক ভার লাগছে। চোখও ঝাঁপসা লাগছে।”

আরাব লতাকে দিয়ে প্রেসার মাপার মেশিনটা আনাল। মেশিনটা দিয়ে প্রেসার মেপে দেখল প্রেসার অনেক লো। সে তাৎক্ষণিক লতাকে বলল গ্লাসে করে চিনির পানি নিয়ে আসতে। লতাও আরাবের কথায় দ্রূত চিনির পানি আনল। আরাব সেটা আয়েশাকে খাইয়ে দিয়ে বলল। আয়েশার একটু বেটার লাগছে। আয়েশার শারীরিক উন্নতি দেখে আরাব আয়েশাকে বলল

“চোখ বন্ধ করে রেস্ট নাও। মাথায় আঘাত পেয়েছো তাই আরও খারাপ লাগছে। ডক্টর যা ঔষধ দিয়েছে সেগুলো খেয়ে নাও। এরপর একটা লম্বা ঘুম দাও। ”

আরাব আয়েশার দিকে ঔষধগুলো এগিয়ে দিল। আয়েশা ঔষধগুলো খেয়ে চোখটা বন্ধ করল।।তার শক্তি নেই হেঁটে তার রুমে যাওয়ার। তাই আরাবেই আয়েশাকে কোলে নিয়ে রুমে গেল।।তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। আয়েশার পাশে বসে আয়েশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আয়েশা চোখ বন্ধ করল। একটা পর্যায়ে সে ঘুমিয়ে গেল।

রাত তখন আড়াইটে। আয়েশার ঘরের মৃদু লাইটটা জ্বলছে। চোখগুলো টেনে তাকালো সে। মনে হচ্ছে আবছা একটা ছায়া দেখছে সে। সে ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করেও পারছিল না। নিজের সাথে বেশ যুদ্ধ করে চোখ গুলো বড়ো করে তাকাল। তারপর ছায়াটা লক্ষ্য করে পেছনে ফিরেই আঁৎকে উঠে বুকে থুথু দিল।

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৭

আয়েশা লতাকে দেখে অনেকটা ভয় পেয়ে গেছে। লতা হাতে একটা ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। আয়েশার ভয়টা বাড়তে লাগল। সে জোরে বলে উঠল

“লতা এখানে ছুরি নিয়ে কি করছো? এভাবে আমার দরজার সামনে ছুরি নিয়ে কী চাই? কী হচ্ছে? কথা বলছো না কেন? তোমার মোটিভ কী? তুমি কী সত্যিই কাজ করতে এসেছো নাকি অন্য কিছু? কী হলো কথা বলছো না কেন?”

লতা আয়েশার দিকে ছুরি নিয়ে তেড়ে আসলো।।আয়েশাকে আঘাত করতে গিয়েও সে থেমে গিয়ে বসে পড়ল। এরপর হুহু করে কেঁদে উঠল। আয়েশার হাত ধরে বলল

“আমাকে আপনারে খু/ন করতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আমি পারুম না আপনারে খু/ন করতে। আপনার মতো ভালো মানুষরে খুন করলে আমার ভালো হইব না। বিশ্বাস করেন আমার বাবারে আটকে রাখছে। বলছে এ বাসায় কাজের লোক হয়ে ঢুকে আমি যেন আপনারে সময় মতো খুন করি। আমি কোনোভাবেই পারতেছি না। বলছে কথামতো যদি কাজ না করি তাহলে আমার বাপরে মাইরা ফেলব। আপু আমার সন্তানও মারা যায় নাই। ঐদিন সব সত্য বললেও এটা মিথ্যা কইছিলাম। আমার সন্তান বেঁচে আছে। আমার বাচ্চা শিশুটারেও আটকে রাখছে। কিন্তু আমি আপনারে খু/ন করতে পারুম না। সোনিয়ারেও খু/ন করছে তারা। আমার সন্তান যদি মারা যায় আল্লাহর কাছে ভালো থাকুক এ দোয়ায় করি৷ কিন্তু এত বড়ো পাপ আমি করতে পারুম না।”

লতা কাঁদতে লাগল। আয়েশা এর মানে কিছুই বুঝছে না। সে লতার দিকে তাকিয়ে বলল

“কে তোমাকে এ কাজের জন্য পাঠিয়েছে? আমার স্বামী আরাব?”

আয়েশার কথা শুনে লতা আয়েশার মুখে তার হাত দিয়ে চেপে বলল

“আপু স্যার অনেক ভালো মানুষ। স্যার কেন আপনারে খু/ন করবে। স্যার তো আপনারে ভালোবাসে। আমারে পাঠায়ছে পুলিশ অফিসার তরুন। তিনিই আমারে এ পর্যন্ত আসতে বলেছে। সুজনরে ফাঁসাইয়া এ বাসায় ঢুকতে কয়ছে। আপু আমি পারব না আপনাকে খু/ন করতে। আপনাদের মতো ভালো মানুষদের আমি কীভাবে খু/ন করব বলুন।”

লতা কাঁদতে লাগল। আয়েশা মেলাতে পারছে না কেন অফিসার তরুন তাকে মারতে চাচ্ছে। সবকিছুই কেমন যেন গোলমেলে লাগছে তার। ক্রমে ক্রমের সন্দেহের ভাঁজ তার মনে ঢুকতে লাগল। তাহলে হয়তো অফিসার তরুনেই ট্রাক দিয়ে তাদের চাপা দিয়ে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। আর এরপর এসব নাটক করে। কিন্তু সে তো অফিসার তরুনকে চিনত না। তার সাথে অফিসার তরুনের কী এমন রাগ থাকতে পারে যার দরুণ দুই দুইবার মারার চেষ্টা করেছে। আর সোনিয়াকে যদি অফিসার তরুনের লোক মারে তাহলে আরাব কেন মহসীনকে ধরে রেখেছে? সব প্রশ্ন তার গোলমাল লাগতে শুরু করল। নিজেকে কিছুটা সামলে নিল সে। তারপর লতাকে বলল

“আমি যে কাকে বিশ্বাস করব বুঝতে পারছি না। আমার নিজেকেই নিজে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হয় এসব ভেবে। লতা তুমি যদি সত্যি বলো তাহলে তোমার সন্তানকে উদ্ধার করার দায়িত্ব আমার। আমি আরাবকে কেন জানি বিশ্বাস করতে পারি না। খুব কষ্ট হয় বিশ্বাস করতে। যতই আমি বিশ্বাস করব বলে প্রতিজ্ঞা করি ততই আমি দ্বিধায় পড়ে যাই। আরাবের সাথে যতটা মিশেছি আরাব বেশ ভালো মানুষ। এমন একটা ভালো মানুষকে আমি কী করে অবিশ্বাস করি৷ আবার চারপাশে যা ঘটছে তাতে মনে হয় আরাব দোষী। এ সংশয় থেকে আমি মুক্তি চাই।”

লতাও কাঁদছে আয়েশাও কাঁদছে। তাদের কান্না শুনে আরাব আয়েশার রুমে আসলো। বিস্ময় নিয়ে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল

“কী হয়েছে এভাবে কাঁদছো কেন?”

আয়েশা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল

“না এমনি কিছু না।”

আরাব বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল

“দুজন মানুষ কী করে এভাবে কারণ ছাড়া কাঁদে? হয়েছে কী বলো।”

আয়েশা আমতা আমতা করে লতার ঘটনা খুলে বলল। আরাবের মথায় যেন বাজ পড়তে লাগল। সে এটা মেনে নিতেই পারছে না তরুন এ কাজ করেছে। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তরুন৷ একমাত্র তরুনেই তার এমন সিকরেট জানে যেটা আর কেউ জানে না। সময়ের সাথে সাথে যোগাযোগ কমে গেলেও সম্পর্কটা তো নষ্ট হয়নি৷ অফিসার তরুনের এ কাজ আরাবকে ভীষণ যন্ত্রণা দিতে লাগল। এদিকে আয়েশাও বারবার বলছিল

“একটা বন্ধু কী করে এমন হয়। কী করে এ মানুষটা এভাবে একটা বন্ধুর ক্ষতি করতে পারে?”

আয়েশার কথা শুনে আরাবের আরও বেশি যন্ত্রণা হতে লাগল। আরাব কখনও চায়তো সে তার কালো অতীতে ফিরে যাক। একটা সময় আরাব বেশ ভয়ংকর মাফিয়া ছিল। কালোবাজারি করত। টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছিল সে কালো বাজারি করে। কিন্তু একটা সময় পর সে বুঝতে পারে সে যা করছে এটা অন্যায়। তাই সে নিজেকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে নেয়৷ তার দ্বারা হয়নি এমন কোনো অন্যায় কাজ নেই। কিন্তু আনজুমানকে বিয়ের পর সে সব কিছু ত্যাগ করে। তার এ কালো অতীতটা কেবল অফিসার তরুন জানে। সে এতকিছু জেনেও আরাবকে সবকিছু থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কোনো আইনি ঝামেলায় পড়তে দেয়নি। এতদিন পর্যন্ত তার এ অতীত সে আড়াল করে রেখেছে আজ যেন তা সবার সামনে প্রকাশিত হওয়ার সংকেত দিচ্ছে। নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছে সে প্রতিনিয়ত। কালো টাকা সাদা করার উদ্দেশ্যেই সে এত মানবিক কাজগুলো করছে। এখন সে সৎ পথেই ইনকাম করছে। সে বুঝতে পেরেছে সৎ পথেও ইনকাম করে কোটি টাকার মালিক এবং ক্ষমতার অধিকারি হওয়া যায়। তাই সে পূর্বের অতীতটাকে ভুলতে চায়। সে কালো অতীতকে নিজের জীবন থেকে মুছতে চায়। এ অতীতটা তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দেয়। আর এ যন্ত্রণার আগুনে সে আর পুড়তে চায় না। অবশ্য সে আয়েশাকে ধাপে ধাপে জীবনের সব কথা বলে নতুন জীবন শুরু করত। তাই তো আয়েশার সাথে সব ঠিক হওয়ার পরও সে আয়েশার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে।

আরাব আর কোনো কথা বলল না। সরাসরি আরাবের রুমে চলে গেল। এরপর অফিসার তরুনকে ধরে আটকে রাখার নির্দেশ দিল তীব্রকে। তীব্র আরাবের কথা মতো হ্যাঁ হ্যাঁ করছিল। এদিকে মহসীন খাচ্ছিল। খাওয়ার মাঝখানে তীব্রকে বলল

“আপনি আমার কথা শুনেন৷ কত করে বললাম আমার কথা শুনেন।”

তীব্র রেগে মহসীনকে একটা লাথি দিয়ে বলল

“কতবার নিষেধ করেছি যে কোনো কথা হবে না৷ বারবার কী ছাতার মাথা বলতে চাচ্ছিস? জিভটা কেটে ফেলব কথা বলতে চায়লে। এজন্যই ট্যাপ দিয়ে মুখ আটকে রাখি।”

মহসীন আর কিছু বলতে পারল না। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল তার। এদিকে তীব্র বেশি না এক ঘন্টার মধ্যেই অফিসার তরুনকে ধরে এনে আটকে দিল। অফিসার তরুনকে ইচ্ছামতো প্রহার করে লতার সন্তান আর বাবার সন্ধান নিল। তিন ঘন্টার মধ্যেই তাদের উদ্ধার করে আরাবের বাসার হাজির করা হলো।

আরাব লতাকে তার সন্তান ফিরিয়ে দিয়ে বলল

“এটা তোমার সততার পুরুষ্কার। তুমি আমাদের জন্য নিজের সন্তান পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে চেয়েছো এর থেকে বড়ো আর কিছু হতে পারে না। তোমার সন্তানকে আমি ফিরিয়ে দিলাম। ওর জীবনে চলার পথে যত খরচ লাগে সব আমি দিব।”

আয়েশা এসব দেখে অবাক হচ্ছিল। আরাব কী করে লতার সন্তানকে এত দ্রূত উদ্ধার করল সে বুঝতে পারছে না। আরাবের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কিছু বলতে চেয়েও পারছিল না। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলল,

“কিন্তু মহসীন তো নির্দোষ। তাকে কেন ধরে রাখা হলো?”

আয়েশা জানতে চায়লে আরাব জানায়

” মহসীন নির্দোষ না। সেই এই সোনিয়াকে খু/ন করেছে এটা আমি নিশ্চিত। আর সেটা সে তরুনের কথায় করুক বা অন্য কারও। মহসীনের শাস্তি মহসীন পাবে। ”

সময়ের বহমান নদীর স্রোতে সময় চলছে। আয়েশা কলেজে যাচ্ছে। পড়াশোনা শুরু করেছে। সময় ভালোয় যাচ্ছে তার। আরাবের সাথে সম্পর্কটা ধীরে ধীরে তার ঘনিষ্ঠ হতে লাগল। সবমিলিয়ে তাদের জীবন সুন্দর করেই এগুচ্ছিল। দেখতে দেখতে ৩ টা মাস কেটে গেল। সেদিন মহসীনকে থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেদিন রাতেই বিষ প্রয়োগে মহসীনের খুন হয়। এখানের মূল টুইস্ট ছিল এটা যে তীব্র খাবারে বিষ মেশায় নি। এ বাসায় সে একা থাকে। একা বাসায় তাহলে কে বিষ মেশালো?

মহসীনের মৃত্যুর কথা শুনে আরাব চমকে উঠল। সে মহসীনকে মারতে চায়নি। সে কেবল চেয়েছিল মহসীনকে শাস্তি দিতে। কিন্তু এখানে একটা বিশাল প্রশ্ন দাঁড়ায়। মহসীনকে কে খু/ন করেছে? তৃতীয় ব্যাক্তিটা কে যে তাদের মাঝে আছে। অফিসার তরুন তো আটক তাহলে কে সে ব্যাক্তি যে মহসীনকে খুন করেছে? আর এত বড়ো একটা গেইম খেলছে। এখানে তারা কেবল সে ব্যক্তির গুটি হয়েই খেলছে।

সে খু/নের রহস্য তলিয়ে দেখতে গিয়েই সামনে আসলো একটি বড়ো সত্য। যার ধাক্কা সইতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। জীবনের ফেলে আসা অতীত যে তাকে এভাবে হানা দিবে কে জানত। তেরো বছর আগের কাহিনি যেন আবারও ফিরে আসলো।

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৮

আরাব বসে পড়েছে মেঝেতে। তীব্রর একটা কল আরাবের অশান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা কী করে সম্ভব সে ভাবছে। যে মানুষটা চলে গিয়েছে পৃথিবী ছেড়ে সে কী করে ফিরে আসলো। মৃত মানুষ বেঁচে উঠলো কী করে? তার বুক ধুকধুক করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখনেই হৃদ ক্রিয়া বন্ধ হয়ে দম যাবে তার। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে।

আয়েশা ঘর থেকে বের হয়ে লক্ষ্য করল আরাব ড্রইং রুমের মেঝেতে বসে আছে। বিষন্ন চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তার কপালে। আয়েশার অস্বস্তি হতে লাগল। সে দ্রূত আরাবের কাছে গেল। আরাবের পাশেই মেঝেতে বসলো সে। তার কাঁধে ধরে আয়েশা জিজ্ঞেস করল

“আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আপনার শরীর কী খারাপ লাগছে? ভীষণ চিন্তিত লাগছে। কিছু কী হয়েছে?”

আরাব আয়েশার কোনো কথার উত্তর না দিয়ে বলল

“আমাকে এক গ্লাস পানি দাও আগে।”

আয়েশা মেঝে থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে পানি আনতে গেল। দ্রূত জগ থেকে পানি এনে আরাবের পাশে বসে তার হাতে পানির গ্লাসটা দিল। আরাব এ ঢোকে পানিটা খেয়ে বসা থেকে উঠল। এরপর আয়েশার হাতটা মুষ্টি করে ধরে টেনে টেনে রুমের দিকে নিয়ে গেল। রুমে গিয়ে আরাব বিছানায় বসে পড়ল। কোনো কথায় সে বলছে না। কীভাবে কথা শুরু করবে সে বুঝতে পারছে না। আয়েশা আরাবের কোনো কিছুই বুঝতে পারছে না৷ হঠাৎ করে তার হাত ধরে কেন টেনে আনলো এটাও তার কাছে অদ্ভুত লাগছে। সে আবারও আরাবকে জিজ্ঞেস করল

“আপনি কি কিছু বলবেন? শরীর ঠিক আছে তো আপনার? কী হয়েছে? এভাবে টেনে আনলেন কেন?”

আরাব আয়েশার দিকে তাকাল। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল। আয়েশাকে হালকা গলায় বলল

“আমি যা বলব তা শুনে তোমার দিক থেকে যা করতে মন চায় করো। তবে এ বিষয়গুলো আমি আর আড়ালে রাখতে পারছি না৷ আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আয়েশা এ ছয়মাসে তোমার প্রতি আমি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছি। তবে তোমাকে কখনও বুঝতে দিতাম না কারণ এতে তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারত। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় আমি বেশ দোটানায় থাকতাম। কারণ আমার কালো অতীত জানলে তুমি আমাকে মানতে পারবে কি’না। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তোমার মুড চেন্জ হয়ে যায় কি’না। আর দুর্বলতা দেখালে তুমি আমার দুর্বলতা নিয়ে খেলো কি’না৷ এসব ভেবে মনের কথাটা কখনও বলা হয়নি। এক মাস আগে থেকেই আমি তোমাকে অনেক বেশি অনুভব করতে পারছি। যেটা কখনও কোনো মেয়ের প্রতি হয়নি। আনজুমানের চলে যাওয়ার পর নিজেকে এতই অপরাধী লাগত যে সে জায়গায় কাউকে বসাতে গেলেও আমার কষ্ট হত।”

আরাবের কথা শুনে আয়েশার মনটা খুশি হয়ে গেল। তার ভীষণ আনন্দ লাগছে। সে আরাবকে ধরে বলল

“এ দিনের জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম। আপনার প্রতি আমি কতটা দুর্বল আপনিও জানেন। তবে নিজের সম্মান পুরোপুরি বিকিয়ে দিয়ে আমি আমার অধিকার চাইতে যাইনি৷ কারণ আমি চেয়েছিলাম আমার প্রাপ্য অধিকার আপনি দিবেন। আর সেজন্যই এত অপেক্ষা করে গিয়েছি। আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

আয়েশার কথা শুনে আরাব আয়েশার হাত ধরে বলল

“এখন আমি যা বলব তা শুনে যদি তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারো তাহলে তোমার জন্য পুরো দুনিয়া আমি কুরবান করে দিব। আর যদি আমার প্রতি তোমার ঘৃনা আসে তাহলে তুমি যে জায়গায় যেতে চাও আমি নিজ দায়িত্বে সেখানে নিয়ে যাব। আমি জানি না এ কথাগুলো তুমি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবে কি’না। ”

আরাবের কথা শুনে আয়েশা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বলল

“কী কথা?”

আরাব আয়েশার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল

“আমিই আনজুমানের খু/নী।”

আরাবের এ কথা শুনার পর আয়েশার ধুক করে উঠল। তার শরীর কাঁপছে। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তার সন্দেহ এভাবে সত্যি হয়ে যাবে কে জানত। আয়েশার বুক ভার হতে লাগল। দুঃসময় এসে যেন সুসময়কে গ্রাস করে নিচ্ছে। সে খুব কষ্টে নিজেকে সামলে চুপ করে বসলো। আরাব বলতে শুরু করল

“আমার বর্তমান নাম আরাব চৌধুরি। তবে একটা সময় সবাই আমাকে চিনত রাজবীর বলে। রাজবীর নামটা আমার নিজের তৈরী। বীরদের রাজা মনে করতাম নিজেকে তাই রাজবীর নাম দিই নিজেকে। এ রাজবীর নামের পেছনে লুকিয়ে আছে আমার অন্ধকার জীবন৷ আর সে জীবনের পর্দায় এখন তোমাকে ফাঁস করতে যাচ্ছি।

আমার বয়স তখন অল্প। অল্প বয়সে টাকার নেশা ঝেঁকে ধরেছিল৷ বাবা মায়ের কাছে সবসময় বাধ্য ছেলের মতো থাকতাম। কিন্তু বাবা মায়ের বাইরে আমি আরেকটা জগত তৈরী করে নিয়েছিলাম যা বাবা, মাও জানত না৷ কলেজ ফাঁকি দিয়ে কখনও কখনও জুয়ায় বাজি ধরতাম। এভাবেই আমার জীবনের ছন্দ পাল্টাতে শুরু করল। একদিন জুয়ার বাজি ধরতে গিয়ে একজনের সাথে হাতাহাতি হয়ে যায়। ভুলবশত অনিচ্ছাকৃত আমার একটা থাপ্পরে সে স্পট ডেথ হয়ে যায়।

আমার শরীর কাঁপছিল যখন বুঝতে পারি সে মারা গেছে৷ সে ছিল বসন্তের ভাই। বসন্তের তখন অনেক নাম ডাক ছিল। তার ভয়ে সে এলাকা কাঁপত। আমি যখন বসন্তের ভাইকে অনিচ্ছাকৃত খুন করে ফেললাম তখন বুঝতে পারলাম আমার জীবনে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে।

এ খুনটা আমার ইচ্ছাকৃত ছিল না আয়েশা। ভুলবশত খু/ন হয়ে গিয়েছিল। বসন্তের ভাইয়ের নাম ছিল আমির। আমিরের মৃত্যুতে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সাথে সাথে বসন্তের লোকজন আমাকে ধরে নিয়ে যায়। অল্প বয়সে কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি একজন জুয়ারি থেকে খু/নী হয়ে উঠলাম। এরপর নিজের প্রাণ বাঁচাতে আরও কয়েকটা খু/ন করতে হয়। আর সেটার মধ্যে বসন্তের খু/নটাও আমার হাতে হয়। বসন্তের খু/নের পর পরই বিষয়টি চারদিকে ছড়িয়ে পরে। রাতারাতি আমার নাম, ডাক হতে লাগল। আমি মাফিয়া হয়ে গেলাম। বয়স কম ছিল তাই টাকার নেশাও ধরে নিয়েছিল। সব মিলিয়ে সাধারণ বাচ্চা একটা ছেলে কালো বাজারি, খু/ন খারাবিতে জড়িয়ে পড়ে। আয়েশা তখন আমি রক্ত দেখে ভয় পেতাম না। বরং প্রতিদিন রক্ত না দেখলে আমার শান্তি লাগত না।

ক্রমে ক্রমে আমি বসন্তের জায়গাটা নিয়ে নিই। ক্ষমতার দাপট সবকিছু ছিল আমার। সে সময়টায় তরুনও আমার সহযোগী ছিল। সে অন্যায় কিছু করত না তবে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সে অনেন খু/নের মামলা থেকে বাঁচিয়েছে আমাকে। তাই আমার একমাত্র সিকরেট তরুন জানত।

আমার বাবা, মা এ বিষয়ে কিছু জানত না। আমি বুঝতেও দিতাম না তাদের। বেশ অনেক বছর আমার কেটে যায় এ জগতে। সে সময় আনজুমানের সাথে আমার দেখা হয়৷ প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পড়ে যাই আমি৷ এত ভালোবাসি যে মনে হত পুরো দুনিয়া এক করে দিতে পারব তার জন্য। আনজুমান বেশ সুন্দরী, বুদ্ধিমতি ছিল। আমি তাকে মনের কথা বলতে গিয়ে কতবার যে থেমে গিয়েছি বলতে পারব না৷ প্রথম ভালোবাসা বলে কথা। এ ভালোবাসায় আমার কালো দুনিয়া রঙিন করতে লাগল। একটা কঠোর মনে ভালোবাসার সূচণা আনজুমানেই ঘটিয়েছিল।

আনজুমান পড়াশোনা করত ভার্সিটিতে। রোজ তাকে ভার্সিটি যাওয়ার সময় দেখতাম। কিন্তু মনের কথা আর বলতে পারতাম না। একদিন সাহস করে আনজুমানকে আমার মনের কথা বলি। আমি সব কিছু হাইড করেছিলাম। আমার জীবনের অতীত আমি লুকিয়েছিলাম। কিন্তু আমি যে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের পর আর পড়িনি সে বিষয়টি লুকাইনি। আমাকে সে জিজ্ঞেস করেছিল কী করি। বলেছিলাম বিজনেস। কিসের বিজনেস ডিটেইলস সেও জানতে চায়নি আমিও জানাইনি। তবে আনজুমান তুখোড় মেধাবী ছিল। সে পড়াশোনা খুব ভালোবাসত। তাই সে জানায় সে আমাকে বিয়ে করবে যদি আমি পড়াশোনা শেষ করি। মানে অনার্সটা শেষ করে গ্রেজুয়েট করি। আমি আনজুমানের এ কথায় রাজি হয়ে গেলাম। এ ভালোবাসার জন্য সিদ্ধান্ত নিলাম সব ছেড়ে দিব৷ এ কালো অধ্যায় জীবনে রাখব না।

আর সে সিদ্ধান্ত থেকেই সব কিছু গুটিয়ে নিলাম। সে সময় তরুন আমাকে ভীষণ সাপোর্ট দিয়েছে। একটা কালো জায়গা থেকে সরে আসতে চায়লেও সেখান থেকে সহজে আসা যায় না। কত ঝামেলায় আমি পড়েছি গুণে শেষ করা যাবে না। দীর্ঘ এক বছর প্রচেষ্টার পর আমি সেখান থেকে ফিরে আসি। আনজুমানের সাথে কথা বলে বিদেশে পড়াশোনার জন্য যাই। পড়াশোনা বেশ অল্প সময়ে শেষ করে দেশে এসে আনজুমানকে বিয়ে করি৷

যেদিন আনজুমানকে আমার করে পাই সেদিন মনে হয়েছিল পুরো পৃথিবী আমি পেয়ে গিয়েছি। আমি আস্তে আস্তে হালাল ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসাতেও বেশ সাফল্য আসা শুরু করে। যেহেতু সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল তাই ব্যবসাতে ভীষণ মন দিতে হত আমার। আর এ বিষয়টার জন্য আনজুমানের প্রতি একটু খেয়াল, কেয়ার আমার কমে গিয়েছিল। আমি কেয়ার করতাম না বিষয়টা এমন না। আমি বরং তার মতো করে তাকে ট্রিট করতে পারছিলাম না।

একটা সময় পর আমি লক্ষ্য করলাম আনজুমান আর সুনীলের একটা কেমিস্ট্রি। আমি বুঝতে পারতাম আনজুমানের সাথে সুনীলের কিছু একটা চলছে। আনজুমান ধীরে ধীরে সুনীলের প্রতি দুর্বল হতে লাগল। এ বিষয়টা আমার আত্মসম্মানে আঘাত হানতে লাগল। যে মেয়েটার জন্য আমি আমার জীবন পুরোপুরি পাল্টে নিয়েছিলাম সে মেয়েটির আমার প্রতি এত অশ্রদ্ধা আমি মানতে পারছিলাম না। বেশ কয়েকবার আনজুমানকে আমি ওয়ার্ন করি৷ কিন্তু সে তার গতিতেই ঠিক ছিল। লজ্জায় আমি সুনীলকে কিছু বলতে পারতাম না, জিজ্ঞেসও করতে পারতাম না। আমার ইগোতে লাগত বিষয়টা।

অনেক ভেবে সুনীলকে আমি কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেই। সেদিন আনজুমানের জন্মদিন ছিল। আনজুমানের জন্য আমি ফুল কিনে আনলাম। তার পছন্দের গোলাপ। আমি সেদিনের পর থেকে আনজুমানকে তার মতো করে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। তবে আনজুমান সেটা চায়নি। সে ততদিনে সুনীলের প্রতি বেশি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।

বিশ্বাস করো আয়েশা আনজুমানকে আমি সময়, ভালোবাসা, কেয়ার কম করিনি। তবুও তার মনে হত আমি তাকে অবহেলা করি। সত্যি বলতে কী জানো সে আমাকে ভালোবাসতেই পারে নি ৷ আমার প্রতি তার মোহ কেটে গিয়েছিল। কেন কেটে গিয়েছিল সেটাও আমার জানা নেই।

সেদিন আনজুমানকে জন্মদিনের গিফট দিতে গিয়ে আসল সত্যটা বের হয়ে আসে। আনজুমান আর সুনীল আগে থেকেই পরিচিত ছিল। তারা আগে থেকেই একটা সম্পর্কে ছিল। আনজুমান চেয়েছিল আমার সাথে বিয়ে করে একটা মোটা অঙ্কের কাবিন দাবি করে বা টাকা পয়সা নিয়ে সুনীলের সাথে সংসার বাঁধবে। এত বড়ো ছলনা, এত বড়ো মিথ্যা আমি মানতে পারি নি। সে তার দোষ ঢাকতে সবার কাছে বলে বেড়াত আমি তাকে সময় কম দিই, প্রায়োরিটি কম দেই, সেজন্য তার মানসিক অশান্তি হয়৷ সে কৌশলে ডায়রি লিখেছিল। যাতে করে সে ডায়রি দেখে সে চলে যাওয়ার পর নিজেকেই দোষী মনে করি আমি। ঐ যে বললাম না বুদ্ধিমতি ছিল ভীষণ।
কিন্তু সেদিন সুনীলকে তাড়িয়ে দেওয়ায় রাগে, তার মুখ থেকে আসল কথা গুলো বের হয়ে যায়। সে রাগে বলে উঠে

“আমি তেমাকে কখনও ভালোবাসতাম না। তোমার প্রতি আমার কোনো মোহ কাজ করে না। আমার পরিবার সুনীলকে মেনে নিত না। কারণ সুনীলের পরিবার ছিল অসহায়, গরীব। তাই তোমাকে বিয়ে করেছি। এরপর ভেবেছি তোমাকে কালপ্রিট বানিয়ে তোমার থেকে কাবিন নিয়ে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব। আর এরপর সুনীলকে বিয়ে করব৷ এতে করে পরিবারের ও পরবর্তী বিয়েতে কোনো বাঁধা থাকবে না। আর আমার কাছেও সারাজীবন চলার মতো একটা এমান্ট চলে আসবে। এজন্যই তো এক কোটি টাকা কাবিন দিয়েছি। আরাব যা হওয়ার হয়েছে। এতদিন অনেক নাটক করেছি। আর পারছি না। আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারছি না। হয় তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও নাহয় আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব।”

আনজুমানের কথাটা আমি নিতে পারি নি। রাগে কষ্টে আমি আনজুমানের গায়ে হাত তুলি। আনজুমানকে জোরে ধাক্কা দিই। দেয়ালের সাথে মাথার পেছন পাশটা আনজুমানের আঘাত লাগে। সাথে সাথে রক্ত গড়গড়িয়ে পড়ে সে স্পট ডেথ হয়। আনজুমানকে আমি মারতে চাইনি। ভালো হওয়ার পর এটা ছিল আমার একমাত্র মার্ডার। আনজুমান মারা যাওয়ার পর আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। অনেক ভেবে তরুনকে কল দিই। তরুন এসে আমাকে বলে বডিটা লুকিয়ে নাটক সাজাতে হবে। তা না হলে পুলিশ কেইস হবে। আর এতে করে আমার বাবা, মায়ের কষ্ট বাড়বে আর আগের সব কুকর্ম ফাঁস হয়ে যাবে৷ আমি বাধ্য হয়ে তরুনকে সবটা দায়িত্ব দেই। সেই আনজুমানের বডিটাকে সরিয়ে সবটা ম্যানেজ করে। আর এরপর এত বড়ো একটা নাটক সাজায়। আমার নামে আনজুমানের পরিবার মামলাও করে। তবে আনজুমানের লেখা ডায়রি আর একটা মিথ্যা চিঠির মাধ্যমে তাদের ভুল বুঝিয়ে মামলা তুলা হয়। টানা চার বছর আমি ঐ পরিবারে নজর দিয়েছি এজন্য তারা আমার নামে আবার মামলা বা কিছুর সিদ্ধান্ত নেয় কি’না দেখার জন্য। আর তারা সত্যিই ভেবে নেয় আনজুমান চলে গেছে কারও সাথে। সেজন্য তারা আনজুমানকে মন থেকে ঘৃনা করে। তার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনও তারা মনে করে না৷

সেদিনের পর থেকে আমি রক্ত দেখতে পারতাম না। আনজুমানকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। সেজন্য আমার পক্ষে আবার বিয়ের মতো বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস আমার আর হয়ে উঠেনি। এ ট্রমা থেকে আমি বের হতে পারিনি আজ পর্যন্ত। এরপর অনেক বছর পর নিজের জীবন পরিবর্তন করতে তৃনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু তৃনাও চলে গিয়েছিল৷ সব মিলিয়ে আমি আমার জীবনে একা থাকার সিদ্ধান্ত নেই।

এরপর একাও ছিলাম। ঘটনাক্রমে আমার জীবনে তুমি আসলে। তারপরও সব ঠিক ছিল। কিন্তু সেনিয়ার মৃত্যু, মহসীনের বিষ প্রয়োগে মৃত্যু আর তরুনের কিছু স্টেটম্যান ঘটনাকে ভিন্ন দিকে মোড় দিচ্ছে। আর একটা নতুন রহস্যের উন্মোচন করছে।”

আয়েশা আরাবের কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল

“মহসীন মারা গেছে?”

আরাব শান্ত গলায় উত্তর দিল

“মহসীনের বিষ প্রয়োগে মৃত্যু হয়। কে বিষ মিশিয়েছিল সেটা ঘাটতে গিয়েই একটা রহস্যের উন্মোচন হলো।”

আয়েশা জিজ্ঞেস করল

“আনজুমান বেঁচে আছে তাই তো? আর সেই এই এ কাজ করেছে তাই তো?”

আরাব হালকা গলায় বলল

“না আয়েশা এমন কিছু না।”

আয়েশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল

“তাহলে?”

….
চলবে।