#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৯
আরাব ঢোক গিলল। নিজেকে একটু সামলে নিল সে। তারপর হালকা গলায় বলল
“আনজুমান বেঁচে নেই। তবে আনজুমানের প্রেমিক সুনীল হিংস্র হয়ে উঠেছে। ওর সবকিছুতেই হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। রীতিমতো সবকিছুতে সে আমাকে ব্লেকমেইল করছে। আনজুমানের মৃত্যু রহস্য ফাঁস হয়ে গিয়েছে। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে আনজুমানের শরীরের অংশ বিশেষ মানে হাড়গোড় সুনীলের কাছে আছে এখন। আর এটা সে তরুনের সাথে হাতে হাত মিলিয়েই নিয়েছে।
তরুন সেদিন আনজুমানের লা/শটাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল একটা জঙ্গলে। সেখানে আনজুমানের লা/শ পুড়িয়ে প্রমাণ লোপাটের জন্য হাড়টা সে তার বাসায় নিয়ে এসেছিল। তার স্ত্রী একজন ডক্টর ছিল। মূলত তার স্ত্রীকে আনজুমানের হাড়টায় দিয়েছিল। এত বছর আনজুমানের হাড়টা বাড়িতেই পড়ে ছিল তার। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন তরুনের স্ত্রী তাকে তালাক দিতে চায়। তরুনের স্ত্রী তরুনকে তালাক দিতে চায়তো আনজুমানের খু/নের রহস্য জানতে পেরেই। তরুন একবার মদ্যপ অবস্থায় তার স্ত্রী রাবেয়াকে আনজুমানকে কীভাবে খুন করে পুড়িয়ে দিয়েছিল বলে দিয়েছিল। এরপর থেকে রাবেয়ার তরুনের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা কাজ করত। সে সবসময় মনে আতঙ্ক নিয়ে থাকত কখন না তার স্বামী আনজুমানের মতো তাকে খুন করে দেয়। যদিও আনজুমানের খুন আমার মাধ্যমে হয় তবে তরুন মধ্যপ অবস্থায় আমার নাম না নিজেই খুন করেছে বলেছিল। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্ধ লেগেই থাকত। আর সে দ্বন্ধের অবসান হয় রাবেয়ার খু/নে। তরুন রাবেয়াকে খু/ন করে দেয়। চার মাস হলো রাবেয়ার খু/ন হয়েছে। আর একইভাবে খু/ন করে পুড়িয়ে দেয় যেভাবে আনজুমানকে পুড়িয়েছিল সে।
তবে রাবেয়াকে খু/ন রাগের বশে করলেও সে রাবেয়াকে ভালোবাসত। তার সন্তানের মা ছিল রাবেয়া। সন্তানরা যখন মায়ের অভাব প্রকাশ করত তখন তার ভেতরে অপরাধবোধ কাজ করত। আর সে মনে মনে আমাকে দায়ী করত। সে এটা মনে করতে লাগল আমার জন্যই তার আজ এ হাল। তাই সে আমার প্রতি রাগান্বিত এবং বিরক্ত হতে লাগল। এর মধ্যে আমার বিয়ের বিষয়টা তাকে বেশি আঘাত করল। সে এটা মানতেই পারছে না আমি কাউকে বিয়ে করে সুখে থাকছি। তার ভেতরে থাকা রাগ প্রকাশ পেতে লাগল। সে আমাকে প্রথমে ট্রাক চাপা দিয়ে খু/ন করার চেষ্টা করল। এরপর ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলে সে আমাকে বাঁচাতে সাহায্য করে আমার বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করল। সেই লতাকে পাঠাল যাতে করে তোমাকে খুন করতে পারে আর আমি একাকীত্বে ভুগি। সেই প্রথমবার তোমাকে খু/ন করতে মহসীনকে পাঠিয়েছিল। আর তোমাকে খুন করতে গিয়ে ভুলক্রমে সোনিয়ার খু/নটা মহসীনেই করে আর সেটা তরুনের কথায়। মহসীনের এত সাহস ছিল না এ বাসায় এসে তোমাকে খুন করার। তরুনের মতো শক্ত ভিত্তি পেয়েছিল বলেই সে তোমাকে খু/ন করতে আসার সাহস পেয়েছিল। আর মহসীনের একটা রাগ ছিল তোমার প্রতি। মূলত তরুন আমাকে একা করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা সে আর পারেনি।
এরপর সে পরের ধাপে যায়। সুনীলকে সে জানিয়ে দেয় তার ভালোবাসার মানুষকে আমি খু/ন করেছি। প্রমাণ স্বরূপ সে আনজুমানের হাড়গুলো দিয়ে দেয়। আর সুনীল ও বুঝতে পারে আনজুমান তার কাছে আসতে চেয়েছিল বলেই আমি রাগে তাকে খু/ন করে ফেলি। সে জেদ ধরেই সে ও আমার পিছু নিয়েছিল। সুনীলের মূল টার্গেট ছিল আমার সমস্ত কিছু দখল করা আর আমাদের দুজনকে ফাঁসিয়ে জেলে দেওয়া।
আর সেটার সুযোগেই সে তার পরিকল্পনা সাজালো। আনজুমান আমার শাস্তিঘর সম্পর্কে জানত। আমার শাস্তিঘরে সহজে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। সে ঘরে প্রবেশের একটা কোড আছে যেটা আনজুমানকে আমি বলেছিলাম। তাকে বলেছিলাম আমার সাথে যারা অন্যায় করে তাদের শাস্তি আমি দিই। তাকে আমার কালো জগতের কথা না বললেও এ ঘর সম্পর্কে বলেছিলাম। সে আমার ঘরটা দেখার বায়না করেছিল। একদিন তাকে নিয়েও গিয়েছিলাম। সে ঘরে প্রবেশের নিয়মও তাকে বলেছিলাম৷ ভালোবাসতাম তো ভীষণ তাই আবেগে বলে ফেলেছিলাম। সেই একটা সময় সুনীলকে এটাও বলে দিয়েছিল।
সময় পাল্টেছে। তেরো বছর পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার শাস্তিঘরের সকল নিয়মকানুন একই রয়েছে। তীব্র আমার হয়ে অনেক বছর যাবত কাজ করছে৷ তাকে অবিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই। সে আমার জন্য জীবনও দিয়ে দিতে পারবে।
কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় গতকাল। তরুনের হঠাৎ মিসিং এ সুনীল বুঝতে পারে আমিই তরুনকে গায়েব করেছি। তাই সে আনজুমানের সে কথাটা মনে রেখে আমার শাস্তিঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সে সেই ঘরে তখন যায় যখন তীব্র ঘর থেকে বের হয়। আর সে সেখানে গিয়ে তরুনকে ছাড়িয়ে দেয় আর মহসীনের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়৷
তীব্র বাইরে থেকে এসে তরুনের ঘরের লক আর খুলেনি। শুধু মহসীনের ঘরের লক খুলে তাকে খাবার দিয়েছিল। আর সে খাবার খেয়েই মহসীনের মৃত্যু হয়। আমি আর তীব্র মহসীনের মৃত্যু নিয়েই চিন্তিত ছিলাম। এর রহস্য উদঘাটন করতেই সিসি ফুটেজ চেক করে দেখি কোনো ফুটেজ নেই। মানে সুনীল সিসি টিভির তার আগেই কেটে দিয়েছিল।
এরপর আমরা পুরো ঘর তল্লাশি করতে গিয়ে লক্ষ্য করি তরুন সেখানে নেই। প্রথমে ভেবেছিলাম তরুন হয়তো মহসীনের খাবারে বিষ মিশিয়ে পালিয়েছে। তবে পরবর্তী প্রশ্ন জাগে তরুন বিষ মেশাবে কী করে? সে নিশ্চয় বাইরে গিয়ে আবার নরকে প্রবেশ করবে না বিষ মেশাতে। তার যদি মহসীনকে মারার হতো গলা টিপেই মারতে পারত।
এরপর তরুনকে নিয়ে রহস্য তলিয়ে দেখতেই সুনীলের বিষয়টা সামনে আসে। তরুনের কললিস্টে সুনীলের নম্বর দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। আর সে সন্দেহের পেছনে ছুটতে গিয়েই সকল ঘটনার রহস্য ফাঁস হয়।
আয়েশা আমি চিন্তিত এখন তোমার জীবন নিয়ে। আমি মরে গেলে আফসোস নেই। কিন্তু তোমার কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। সুনীল আর তরুন এখন বাইরে। যে করেই হোক তারা আমাকে আর তোমাকে মারতে চায়বে। আমি চাইনি এ হানাহানিতে ফিরতে। তবে বিধাতা আমাকে আবারও সেই তেরো বছর আগের আমিকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করল। আমি কী করব জানি না।”
আরাবের কথা শুনে আয়েশার বুক কাঁপছে। সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না আরাব খু/নী। এত শান্ত একটা মানুষ খুনও করতে পারে তার বিশ্বাস হচ্ছে। চোখ গড়িয়ে তার পানি পড়ছে। একজন খু/নীকে স্বামী বলে মেনে নিতে তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তবুও সে নিজেকে সামলালো। আরাবকে সে ভালোবাসে। আর সে ভালোবাসার দায়িত্ব থেকে আরাবের পাশে থাকা তার উচিত বলেই সে মনে করে৷ সে আরাবকে স্বাত্ত্বণা দিয়ে বলল
“আমি আপনার পাশে আছি। তরুন আর সুনীলকে কীভাবে আটকাতে হয় আপনার নিশ্চয় জানা। এখন তো আমাদের বাঁচতে হলে তাদের মারতে হবে। এটা তো আমদের ইচ্ছাকৃত না৷ আর অনিচ্ছাকৃত কোনো কিছুই অপরাধ না।”
আয়েশার কথা শুনে আরাব আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। এ প্রথম আয়েশাকে আরাব জোরে জড়িয়ে ধরেছে। আয়েশা আরাবের এ স্পর্শে নিজেকে বিলিয়ে দিল। ভীষণ শান্তি লাগছে তার।
হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। আয়েশার পিঠে এসে একটা গুলি লাগল। আয়েশা বুঝে উঠার আগেই ঢলে পড়ল। আরাব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল সামনে তরুন আর সুনীল। আয়েশার পিঠ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আরাবের রক্ত দেখে হাত পা কাঁপতে লাগল। আরাবের অবস্থা দেখে আয়েশা বলল
“আমার রক্ত দেখে আপনি নিজেকে গুড়িয়ে ফেলবেন না। বুকে সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়ান। নাহয় ওরা আপনাকে খু/ন করে দিবে।”
আয়েশার কথা শুনে আরাব নিজেকে সামলাতে লাগল। কিন্তু বরাবরেই তার হাঁত পা কাঁপছে। মস্তিষ্ক শিথীল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে একটা গুলি তার হাতে লাগল। আর সাথে সাথে সে লুটিয়ে পড়ল।
….
#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২০
আয়েশা বারবার আরাবকে বলছে
“আপনি যদি এক বিন্দু ভালোবাসেন আমাকে তাহলে দয়াকরে নিজেকে এভাবে গুড়িয়ে দিবেন না। বাঁচার জন্য হলেও একটু চেষ্টা করেন। আমি বাঁচতে চাই।”
আয়েশার এ কথা শুনে তরুন আয়েশাকে আরেকটা গুলি করল। গুলিটা আয়েশার বুকে এসে লেগেছে। আয়েশার দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। চোখ ঝাঁপসা হয়ে যেতে লাগল। শেষবার শুধু এটা বলল
“আমি বাঁচতে চাই। আপনার বেহালার সুর হয়ে। আমি বেদনাকে গ্রাস করে সুখের সময়টাকে উপভোগ করতে চাই। আপনি আমাকে বাঁচান।”
আয়েশার কথাগুলো আরাবের কানে বাজছে। আরাব চোখ তুলে তরুনের দিকে তাকাল। তরুন আরাবকে আরও একটা গুলি করল। গুলিটা আরাবের পেটে এসে লেগেছে। দু দুটো গুলি খেয়ে আরাবের দমও বন্ধ হয়ে আসছিল। তবুও সে নিজেকে সামলে নিল। উঠে দাঁড়াল। তরুন আরাবকে আরেকটা গুলি করতেই যাবে সে মুহুর্তে তরুনের পিঠে এসে গুলি লাগে। সাথে সাথে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেই সাথে সুনীলও লুটিয়ে পড়ে। কে গুলি করেছে আরাব ভাবতে লাগল।সে চোখ তুলে পেছনে তাকিয়ে দেখল তীব্র দাঁড়ানো। তরুন আর সুনীল লুটিয়ে পড়লে তীব্র তাদেরকে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠাল। সে সাথে আয়েশা এবং আরাবকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। লতা ঘরের ভেতর ভয়ে ঝাপটি মেরে বসেছিল। তীব্র আসাতে সে বের হলো। আয়েশা আর আরাবের অবস্থা দেখে সে কাঁপতে লাগল। তীব্র লতাকে বলল
“তুমি দ্রূত আয়েশার সাথে বসো। আমি আরাবের সাথে বসছি। ”
লতা আয়েশার সাথে বসলো। বড়ো বড়ো দম নিচ্ছে আয়েশা। হালকা জ্ঞান ফিরেছে তার। ঝাঁপসা চোখে লতাকে বলল
“আরাব কোথায়? কোথায় আছে?”
লতার কেবল চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে। কিছুই বলার নেই তার। কী বলবে বুঝতেও পারছে না সে। চুপ হয়ে কেবল আয়েশার দিকে তাকিয়ে আছে। লতা চায় না আরাব বা আয়েশার কিছু হোক। দুটো মানুষ তার জীবনের আলো ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন যদি দুজন চলে যায় তাহলে তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে। লতা মন থেকে দুজনের সুস্থতার জন্য দোয়া করছে৷
চারজনকেই ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরকম রোগী গুলোর বেসরকারি হাসপাতালে কোনো ট্রিটমেন্ট করা হয় না। ঢাকা মেডিকেলে যেতেই তরুনের মৃত্যু হয়। সুনীল মারা যায় রাস্তাতেই।
তীব্র হাসপাতালে যাওয়ার পথেই আইনী সকল জটিলতা সেরে ফেলে। তাই আরাব আর আয়েশাকে হাসপাতালে নিতেই দ্রূত অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো। অফিসার পলাশ এসেছে বিষয়টি তদন্তের জন্য। অফিসার পলাশ তীব্রর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল
“আপনি সম্পর্কে কী হোন উনাদের?”
তীব্র উত্তর দিল
“আমি স্যারের পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট হই।”
“কী হয়েছিল? কেন গুলি করা হলো? আর অফিসার তরুনেই বা মারা গেল কীভাবে?”
তীব্র একটু কৌশলে উত্তর দিল
“মহসীনের রাগ ছিল স্যারের উপর। আয়েশাকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু একটা দূর্ঘটনায় আয়েশার বিয়ে হয় স্যারের সাথে। স্যারের এটা দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম স্ত্রী স্যারকে ডিভোর্স দিয়ে তেরো বছর আগেই বিদেশ স্যটল হয়ে যায়। আর তেরো বছর পর স্যার আয়েশাকে বিয়ে করে। তাদের জীবন বেশ ভালোভাবেই চলছিল৷
এরমধ্যেই মহসীন পুরনো জেদের বশে আয়েশাকে খুন করতে গিয়ে সোনিয়াকে খুন করে ফেলে। পুলিশ মহসীনের এ বিষয়টি তদন্ত করে তিনমাস পরে বুঝতে পারে। মহসীনকে ধরতে যাবে এর মধ্যে জানা যায় মহসীনের বিষ প্রয়োগে মৃত্যু হয়। মূলত মহসীন নিজের উপর বিরক্ত হয়েই বিষ খেয়ে আত্মহনন করে এটাই জানা যায়।
এদিকে তেরো বছর পর উত্থান হয় স্যারের স্ত্রী আনজুমানকে অফিসার তরুন খুন করেছে। এরপর সেই খুনের ধামাচাপা দিতে বড়ো নাটক সাজায় সে সময় তরুন সাহেব। স্যার বেশ বিশ্বাস করত তরুন সাহেবকে তাই সেসব নাটক যাচাই করারও প্রয়োজন মনে করেনি
এদিকে একদিন মদ্যপ অবস্থায় অফিসার তরুন তার স্ত্রী রাবেয়াকে খুনের বিষয়ে সব বলে দেয়। এটা নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা চলছিল। আর ঝামেলার এক পর্যায়ে অফিসার তরুন তার স্ত্রী রাবেয়াকে খুন করে ফেলে। আর রাবেয়ার মাধ্যমেই আনজুমানের সে খুনের কথা জানতে পেরে যায় স্যারের বাসার আগের ড্রাইভার সুনীল। গুঞ্জণ শুনা যেত আনজুমান আর সুনীলের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। যদিও স্যার এটা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু সুনীল আনজুমানকে গভীর ভালোবাসত। তেরো বছর পর সে আনজুমানের খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারে অফিসার তরুন আনজুমানকে খু/ন করেছে। আর খু/নের জেদ ধরে সে গিয়েছিল অফিসার তরুনকে খু/ন করতে স্যারের বাসায়।
কারণ অফিসার তরুন কিছুদিন অবকাশ যাপন করতে ছুটি নিয়েছিল। এরপর সরাসরি চলে আসে স্যারের সাথে দেখা করতে। স্যার তো এসব কিছুই জানত না। তাই অফিসার তরুন যখন আসে তখন তিনি আর আয়েশা অফিসার তরুনের সাথে কথা বলার জন্য বের হয়েছিল। সে মুহুর্তে সুনীল আসে। অফিসার তরুন আর তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটিতে এতসব সত্য বের হয়ে আসে। এরপর তাদের মধ্যেই গুলাগুলি হয়।
সে গুলাগুলির বলি হয় স্যার আর ম্যাডাম।”
তীব্র কথাগুলো শেষ করে দম নিল। অফিসার পলাশ তীব্রর দিকে তাকিয়ে বলল
“তুমি কী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলে?”
তীব্র উত্তরে জানায়
“আমি উপস্থিত ছিলাম না। আমি বাইরে ছিলাম। যখন আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই তখন গিয়ে দেখি ৪ টা বডি মাটিতে লুটিয়ে আছে। আমি দ্রূত সে জায়গা থেকে ৪ জনকেই হাসপাতালে নিয়ে আসি। সুনীল রাস্তাতেই মারা যায়। কারণ তরুন সুনীলের পিঠে একটা গুলি করে এরপর কপালে। আর অফিসার তরুনকে হাসপাতালে আনার পর মারা যায়।
ভাগ্যক্রমে স্যার আর ম্যাডাম বেঁচে যায়। তাদের অপারেশন করা হচ্ছে। জানি না তারা বাঁচবে কি’না।”
অফিসার পলাশ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল
“তুমি তো ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলে না। তাহলে পুরো ঘটনার বর্ণণা দিলে কী করে? এটা যে বানানো কাহিনি না তার কী প্রমাণ?”
তীব্র হতভম্ব হয়ে গেল। কিছুটা নার্ভাস অনুভব করলেও সে নিজেকে সামলে নিল। এরপর বেশ স্বাভাবিক টোনে উত্তর দিল
“স্যারকে এম্বুলেন্সে আনার পথে আমি ছিলাম পাশে। তখন স্যার সবটা খুলে বলেছে।।যতটা জানিয়েছে আমি তাই জানালাম।”
অফিসার পলাশ তীব্রকে আবারও জিজ্ঞেস করল
” আনজুমানকে কেন খু/ন করেছে অফিসার তরুন?”
তীব্র হালকা গলায় বলল
“সঠিক কারণ তো বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা তরুন সাহেব স্যারকে ভীষণ হিংসা করত। তাই স্যারকে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্যই এ কাজ করেছিল। আর আমি বেশ অনেকবার স্যার আর তরুন সাহেবের মধ্যে একটা কমপিটিশন দেখতাম। মানে কমপিটিশন টা স্যার করত না তবে তরুন সাহেব করতেন। স্যার কেনো দামী ঘড়ি কিনলে তিনিও কিনতেন। স্যার যদি আগের দিন দামী কোনো শার্ট কিনেছেন। পরের দিন তিনি তার জন্য এরচেয়ে দামী শার্ট কিনতেন।
বিষয়গুলো চোখে লাগার মতো ছিল। তবে স্যার তরুন সাহেবকে অনেক অনেক বিশ্বাস করতেন। এরপর বশে কয়েকবছর স্যার অনেক ব্যস্ত হয়ে যায় আর তরুন সাহেবের সাথে যোগাযোগও কমে যায়।
হুট করে যোগাযোগ হয় স্যারের বিয়ের পর।।হয়তো বিয়েটা মানতে পারেননি তিনি। তাই তিনি এমনটা করেছেন। আমি এর চেয়ে বেশি বলতে পারব না। ”
অফিসার পলাশ তীব্রর কথাগুলে শুনে সেখান থেকে প্রস্থান নিল। যদিও তীব্র এত সুন্দর করে কাহিনি সাজিয়েছে সেটা অবিশ্বাস করার মতো না তবুও পুলিশের কাজ বলা যায় না। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে দুজন সাক্ষী সুনীল আর তরুন নিহত। সেখানে প্রমাণ করার মতো আর কেউ থাকে না। যা বলা হবে তাই মানতে বাধ্য। তবে আয়েশা আর আরাবের জন্য চিন্তা হচ্ছে তার। অপারেশন এখনও হচ্ছে। কী হবে বুঝতে পারছে না সে।
লতা করিডোরে বসে কাঁদছে। লতার কাছে পুলিশ অফিসার পলাশ আসলো। যদিও তীব্র আগেই লতাকে বলে দিয়েছিল কী বলবে। তাই লতাকে যখন অফিসার পলাশ জিজ্ঞেস করল
“ঘটনাস্থলে কী হয়েছিল?”
লতা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল
“স্যার আমি কিছুই জানি না। হঠাৎ তর্কাতর্কির শব্দ শুনি ড্রইং রুমে। আমি তর্কাতর্কি কী নিয়ে হচ্ছিল সেটাও খেয়াল করিনি। কিন্তু হঠাৎ গুলির শব্দে আমি ভয় পেয়ে ঘরে ঝাপটি মেরে ছিলাম। তীব্র স্যার এসে আমাকে ডাক দেয়াতে আমি বের হই। ততক্ষণে দেখি স্যার, আপু আর বাকি দুজনও অজ্ঞান হয়ে আছে। এরপর তীব্র স্যার তাদের নিয়ে হাসপাতালে আসলেন। এখানে এসে জানতে পারি স্যার আর আপু ছাড়া বাকি দুজন মারা গেছে।”
অফিসার পলাশ লতার দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল
“সত্যিই কিছু জানো না নাকি জেনেও বলছো না? আর তোমার স্যার, ম্যাডাম কেমন ছিল?”
লতা কাঁদতে কাঁদতে বলল
“আমি সত্যিই জানি না স্যার। উনাদের মতো এত ভালো মানুষকে কেন মারলো আমি তো সেটাই মেলাতে পারছি না। স্যার আর ম্যাডাম অনেক ভালো ছিল। আমার বাচ্চার সকল খরচ তারা বহন করে। আমাকে কখনও কাজের লোকের মতো ট্রিট করে না। আমাকে সবসময় তাদের বাসার সদস্য হিসেবে ট্রিট করে।”
অফিসার পলাশ আবারও জিজ্ঞেস করল
“আচ্ছা এমনও তো হতে পারে তোমার স্যার তাদের গুলি করে খু/ন করেছে।”
লতা হালকা গলায় উত্তর দিল
“স্যারের যেন কী একটা রোগ আছে রক্ত দেখলে জ্ঞান হরায়। তিনি রক্ত সহ্য করতে পারেন না। উনার সামনে মাছ মাংসও কাটা নিষেধ। উনি কী করে মানুষ খু/ন করবে?”
“তাহলে তোমার ম্যাডাম?”
লতার সাবলীল উত্তর
“আপু ভীষণ ভালো মেয়ে। উনি কখনও কাউকে আঘাত করেই কথা বলতে পারে না৷ সেখানে খু/ন করাটা একদম অস্বাভাবিক বিষয়।”
অফিসার পলাশ যতটুকু তথ্য পেয়েছে সেটা নিয়ে চলে গেল।
ঘন্টা দেড়েক কেটে গেল। অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বের হলো। তীব্র আর লতা দৌঁড়ে ডাক্তারের কাছে গেল। তীব্র ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করল
“রোগীদের কী অবস্থা?”
ডাক্তার উত্তর দিল
“আয়েশার অবস্থা ভালো। সে এখন আশঙ্কামুক্ত আলহামদুলিল্লাহ। তবে আরাব….।”
তীব্র ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল
“স্যারের কী হয়েছে? স্যার ঠিক আছে তো?”
ডাক্তার কবির উত্তর দিলেন…
#বেহালার সুর
#পর্ব- ২১
#শারমিন আঁচল নিপা
“আরাব সাহেব কখনও চোখে দেখতে পারবেন না। তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। এটা ভালো হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আর এমনিতেও উনি সবসময় ডেনজার জোনে থাকবেন। কারণ তার গুলি বের করা গেলেও অনেক সমস্যায় রয়ে গেছে যা পুরোপুরি রিকোভার সম্ভব হয়নি। বয়সের একটা ভারে উনার অবস্থার অবনতি বেশি হয়েছে। এখন আপাতত মোটামুটি সুস্থ। কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে বাসায় নিয়ে যাবেন। তবে একটা কথা রোগীর মেজাজের উঠানামা হতে পারে। খিটমিট করতে পারে। বিষয়গুলো মাথায় রেখে রোগীর সাথে আচরণ করবেন। রোগীকে হাইপার করা যাবে না।”
তীব্র মাথা নাড়ল শুধু। আরাবের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেছে তীব্রর মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে কোনোরকম সামলে নিল সে। এখন আরাবের সাথে দেখা করা যাবে না ঘন্টাখনেক পর দেখা করা যাবে। তবে আয়েশার সাথে দেখা করা যাবে এখন। তাই সে সরাসরি চলে গেল আয়েশার সাথে দেখা করতে। আয়েশা বেডে শুয়ে আছে। তীব্রকে দেখে শুয়া থেকে বসতে নিয়েও পারছিল না। আয়েশার বসতে চাওয়ার প্রবণতা দেখে তীব্র বলে উঠল
“আরে কী করছেন? এখন বসা যাবে না। আপনি শুয়ে থাকুন। আমি কেবল আপনার সাথে দেখা করতে আসলাম। শরীর এখন কেমন লাগছে?”
আয়েশা হালকা গলায় উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল
“আরাব কেমন আছে?”
তীব্র নম্র গলায় উত্তর দিল
“স্যার ভালো আছে। আপনার শরীর কেমন আছে? এখন ভালো লাগছে?”
আয়েশার সাবলীল উত্তর
“একটু হালকা লাগছে। তবে ব্যথা হচ্ছে। ইনজেকশন দিয়ে গেলে ব্যথাটা কমে আবার কিছুক্ষণ পর ব্যথা শুরু হয়। আর হাত, পা একদম নাড়াতে পারছি না। আচ্ছা সুনীল আর তরুন সাহেবের কী অবস্থা? তাদের কী পুলিশ ধরেছে?”
তীব্র আয়েশার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল
“দুজনেই মারা গেছেন। এসেছিল আপনাদের মারতে কিন্তু আল্লাহর কী লীলা তারাই ওপারে চলে গেল। আর ম্যাডাম দুঃসংবাদ দিতে চাচ্ছিলাম না। তবুও যা সত্যি সেটা জানিয়ে দেওয়ায় ভালো। এ সময় জানাচ্ছি সেজন্য দুঃখিত। তবে মানিয়ে নিতে যেন পারেন সেজন্য জানানো।”
আয়েশার চোখ মিটমিট করে বলল
“ভণিতা করার কী দরকার ভাইয়া? যা বলার বলে ফেলেন। দুঃসংবাদকে আর ভয় পাই না। যাদের সময়টায় খারাপ যাচ্ছে তাদের আবার দুঃসংবাদ কিসের বলুন?”
তীব্র মাথা নীচু করে উত্তর দিল
“স্যার তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। কখনও দেখতে পারে কি’না নিশ্চিত না। আর এমনিতেও স্যারের অবস্থা বেশি ভালো না। মানসিক অবস্থার অনেক অবনতি হয়েছে। তাই সবসময় খিটমিট করতে পারে। আশা করি আপনি মানিয়ে গুছিয়ে নিবেন। স্যার এমনিতে অনেক ভালো মানুষ৷ তবে পরিস্থিতি যদি স্যারকে খারাপ করে তুলে এখানে আমাদের বলার কিছু থাকে না।”
আয়েশার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। আয়েশাকে কখনও আরাব দেখতে পারবে না এটা শুনে তার বুকটা চৌচিড় হয়ে যাচ্ছে। সে চেয়েছিল আরাবের সামনে লাল টুকটুকে বউ সেজে যাবে সেটা আর পূরণ হবে না তার। নিজেকে সামলে নিয়ে তীব্রকে উত্তর দিল
” যা হওয়ার হয়ে গেছে। আল্লাহ যদি চান আরাব কখনও আমাকে দেখবেন না তাহলে দেখবেন না। আবার আল্লাহ যদি চান আরাব আমাকে দেখবেন তাহলে হয়তো একটা সময় পর তিনি ঠিক হয়ে যাবেন। এটা আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষা। আমি সেটা খুশি মনে মেনে নিলাম। দৃষ্টি আমারও যেতে পারত। যাইহোক ভাইয়া আমাদের জন্য আপনি অনেক কিছুই করেছেন। আর লতা কোথায় আছে? ও কেমন আছে? ”
তীব্র লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল
“লতা ভালো আছে। আমি বের হলে সে দেখতে আসবে আপনাকে। আমি এখন স্যারের সাথে দেখা করতে যাব। আপনি নিশ্চিন্তায় থাকুন। স্যারের সকল দায়িত্ব আমি নিব। স্যারকে সুস্থ করে বাসায় তুলা পর্যন্ত আমি হাসপাতালে স্যারের পাশেই আছি। আপনি নিজে সুস্থ হওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিন।”
তীব্র বের হয়ে গেল কথা গুলো বলে। তীব্র বের হয়ে লতাকে পাঠিয়েছে আয়েশার কাছে। আর তীব্র চলে গেল আরাবের কাছে। আরাবের জ্ঞান ফিরেছে। তবে সে চোখে দেখতে পারছে না। আরাব কারও উপস্থিতি টের পেয়ে আতঙ্কিত গলায় বলে উঠল
“কে?”
তীব্র আরাবের পাশে গিয়ে তার হাত টা ধরল। হাতটা ধরতেই আরাব বলে উঠল
“তীব্র?”
তীব্রর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। এ মানুষটা তার স্পর্শ এত ভালো করে চিনে ভেবেই এ ব্যাকুল কান্না তার চোখে এসে বসেছে। গলা ভার হয়ে যাচ্ছে তার। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিল
“হুম স্যার আমি। চিনলেন কী করে?”
আরাব হেসে উত্তর দিল
“চোখের দৃষ্টি চলে গেলেও অনুভূতি তো চলে যায়নি তীব্র। হাতের স্পর্শে অনেক কিছুই চেনা যায় যা চোখের দৃষ্টিতেও যায় না। আয়েশা কেমন আছে?”
তীব্র আরাবের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল
“আয়েশা ভালো আছে। সব ধরণের ডেনজার জোন থেকে সে মুক্ত। একটু সুস্থ হলেই আপনাদের দুজনকে বাসায় নিয়ে যাব।”
আরাব ভার গলায় জিজ্ঞেস করল
“আয়েশা জানে আমার দৃষ্টি হারিয়ে যাওয়ার কথাটা? ”
তীব্র হালকা গলায় উত্তর দিল
“হুম জানে।”
” সে কী আমাকে মেনে নিতে পারছে?”
“স্যার ম্যাডাম আপনাকে অনেক ভালোবাসে। মেনে না নেওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনার প্রতি তার ভালোবাসা কমেনি। এতদিন আপনি আপনার দৃষ্টিতে দুনিয়া দেখেছেন। এখন থেকে ম্যাডামের দৃষ্টিতে দুনিয়া দেখবেন। একজন তো দেখতে পারছেন। আর আপনিই তো বললেন মাঝে মাঝে চোখের দৃষ্টি থেকে অন্তরের দৃষ্টি প্রখর হয়। এই যে আমাকে চোখে না দেখেও আপনি চিনতে পেরেছেন।”
আরাব হালকা নিঃশ্বাস ফেলল। তীব্রকে মোলায়েম গলায় বলল
” তরুনের বাচ্চাদের খবর নিও। তাদের এ দুনিয়ায় কেউ নেই। বাবা, মা কেউ নেই। আর তাদের সকল খরচ আমি বহন করব। রাবেয়ার প্রাণ হারানোর পেছনেও আমার কাহিনি জড়িয়ে ছিল আর তরুনের ক্ষেত্রেও তাই। তাই ওর বাচ্চারা যেহেতু ছোটো, তাই বড়ো হওয়া পর্যন্ত ওদের দায়িত্ব আমি নিব।”
তীব্র পরপর কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল। একটা মানুষ কতটা উদার হলে শত্রুপক্ষের বাচ্চার দায়িত্ব নেয় সেটাই ভাবছে সে। মানুষটার মন কতটা নরম। আর এ মানুষটার জীবনে কত ঝড় বয়ে গেল। সে আরাবের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করল। কখনও যদি আরাবের সাথে কেউ অন্যায় করে তাহলে তাকে সে জানে মেরে ফেলবে। এ মানুষটার আশেপাশে আর কোনো আঁচ লাগতে সে দিবে না।
পরিস্থিতি যেমনেই হোক। সময় কখনও থেমে থাকে না। পরিস্থিতির কড়াল গ্রাস পার করেই সবাই সময়ের সাথে ছুটে। জীবনে যত ঝড়েই আসুক সে ঝড়কে মোকাবেলা করেই সবাই বাঁচে, বাঁচতে চায়, বেঁচে থাকার লড়াই করে৷ দেখতে দেখতে ছয়টা মাস কেটে গেল। পরিস্থিতি এখন ভীষণ ঠান্ডা। আরাব দেখতে না পারলেও আয়েশা আরাবের দৃষ্টি হয়ে সবকিছুর বর্ণণা করে যাচ্ছে। আয়েশা নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে। দুজনেই আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। বৈবাহিক সম্পর্কের দূরত্বটা রয়ে গেলেও মানসিক দিক দিয়ে তারা ভীষণ কাছে। আয়েশা কলেজ শুরু করেছে। পড়াশোনায় মন দিয়েছে। নিজের লক্ষ্যে সে পৌঁছাতে চায়।
আর এ পড়াশোনার সূত্র ধরেই আয়েশার সাথে পরিচয় হয় তারই ক্লাসমেট আয়ানের। আয়ানও বেশ মেধাবী,চৌকস, হ্যান্ডসাম। তার জীবনের প্রথম প্রেম আয়েশা। উঠতি বয়সের আবেগ আর প্রেমের কোনো বাঁধা থাকে না। তখন সবাই তাল হারিয়ে আবেগে ডুবে যেতে চায়। আর আয়ানের সে আবেগে ডুবে যাওয়ার আফিম হলো আয়েশা। সে আয়েশার প্রতি নিজের দুর্বলতা এখনও প্রকাশ করেনি। তবে সময় মতো সে প্রকাশ করবে৷ সে এটা জানে না আয়েশা বিবাহিত। কারণ আরাব কখনও আয়েশার কলেজে আর আসেনি৷ নিজের অসুস্থতার জন্য সে কখনও আসতে পারে নি।
আজকে ১৭ জুলাই। আয়েশার আঠারো বছর পূর্ণ হবে। আজকে সারপ্রাইজ প্রস্তুত করেছে আয়ান। সেদিকে আরাবও আয়েশাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য তীব্রকে দিয়ে বড়ো প্ল্যান করেছে।
তীব্রকে দিয়ে আয়েশার সকল ফ্রেন্ডদের সে বাসায় ইনভাইট করেছে। সে সাথে বড়ো একটা স্টেজ সাজিয়েছে সে। যদিও আরাব চোখে দেখে না তবে কল্পনায় আঁকা সকল অনুভূতি প্রকাশ করেই সে স্টেজটা সাজানোর ব্যবস্থা করেছে। তীব্র আরাবের প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখে স্টেজটা তৈরী করেছে।
আয়েশা যদিও ভুলেই গিয়েছে তার জন্মদিনের কথা। ছুটির দিন হওয়ায় সে আরাবকে সময় দিচ্ছিল। তার সাথে গল্প করছিল। আরাব গল্পের এক পর্যায়ে বলে উঠল
“আচ্ছা আমার জন্য আমার মনের মতো করে সাজতে পারবে? একটা পুতুলের মতো সাজতে পারবে? তোমার জন্য পারপল কালার একটা গাউন তীব্রকে দিয়ে আনিয়েছি। তুমি সেটা পরবে। চুলগুলো খোলা রাখবে। হালকা লিপস্টিক ঠোঁটে দিবে। চোখে হালকা কাজল। আর রাণীর মতো মুকুট পরে আমার সামনে আসবে। আমি তোমাকে কল্পনার দৃষ্টিতে দেখব। মন ভরে দেখব।”
আয়েশা আরাবকে জড়িয়ে ধরল কথাগুলো শুনে। তার চোখ টলমল করছে। সে জড়িয়ে ধরে আরাবকে উত্তর দিল
“আপনার জন্য পুরো পৃথিবী এক করে দিতে পারব। আমি আপনাকে বড্ড ভালোবাসি৷”
এদিকে আয়েশার ক্লাসের কেউ জানে না সে বিবাহিত। আয়ানের ক্ষেত্রেও তাই। আয়ান ভেবেছিল আয়েশাকে জন্মদিনের গিফটের সাথে একটা চিরকুট দিয়ে নিজের মনের কথা বলবে। তাই সে হাজারো বর্ণমালা একত্র করে একটা চিঠি লিখেছে। আয়েশার সাথে তার সম্পর্ক ভালো।।তার ধারণা আয়েশা তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
সন্ধ্যা ৭ টায় অনুষ্ঠান শুরু হবে। আয়েশা একটা পুতুলের মতোই সেজেছে। আরাবের সামনে আসতেই আরাব আয়েশার উপস্থিতি টের পেয়ে বলল
“হ্যাপি বার্থ ডে আয়েশা। তোমার জন্য একটা বড়ো সারপ্রাইজ আছে।”
আয়েশা আরাবের মুখে নিজের বার্থ ডে উইশ শুনে কেঁদে দিল। সে তার জন্মদিনের কথা ভুলে গেলেও আরাব মনে রেখেছে ভেবে তার ভেতরটায় প্রশান্তি অনুভূত হলো। কী সারপ্রাইজ তার জন্য অপেক্ষা করছে সেটাই ভাবছে সে। আর আরাব সে সারপ্রাইজ দিতে গিয়েই আয়েশার বিপদ ডেকে আনবে কে জানত। আয়েশার জীবনের কঠিন পরিস্থিতি সূচণা এখান থেকেই শুরু হয়৷
আর এখান থেকেই…
চলবে।