বেহালার সুর পর্ব-২২+২৩

0
15

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২২

আর এখান থেকেই সংগ্রামকে শক্তি হিসেবে নিয়ে সামনে যাওয়ার পথচলা তার শুরু।

আয়েশাকে আরাব স্টেজে নিয়ে উঠতে লাগল। ক্লাসের সব ফ্রেন্ডরা আয়েশাকে স্টেজে উঠতে দেখে জোরে জোরে বলতে লাগল

“হ্যাপি বার্থ ডে আয়েশা। অনেক অনেক শুভ কামনা।”

ক্লাসের সবাইকে দেখে আয়েশার মনটা খুশিতে ভরে গেল। আরাব এত বড়ো সারপ্রাইজ তার জন্য রেডি করেছে সে ভাবতেই পারছে না। খুশিতে যেন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। আরাব যদিও চোখে দেখতে পারছে না৷ তবে এতটুকু বুঝতে পারছে আয়েশা ভীষণ খুশি হয়েছে। কারণ আয়েশার খুশিটা সে অনুভব করতে পারছে৷ আরাব একটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল

“সবাইকে স্বাগতম। আজকে এখানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনের মূল কারণ আয়েশার জন্মদিন। সে সাথে আরেকটি কারণও আছে। আর আমি সেটাই বলতে যাব।

আয়েশার সাথে দেখতে দেখতে আমার ১ টা বছর পার হয়ে গিয়েছে। একটা বাচ্চা মেয়েকে গ্রামে গিয়ে আমি বিয়ে করেছিলাম। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ দ্যুতিময় চোখ আমাকে পাগল করেছিল। কখনও তাকে বলার সুযোগ পাইনি সে কতটা সুন্দর। এত ঝড় ঝাপটা আমাদের উপর বয়ে গেছে ভালোভাবে ভালোবাসি বলার সুযোগটায় কখনও হয়ে উঠেনি৷ ঝড়ের বেগবান হাওয়ায় কখন যে বিয়ের ডেটটা পার হয়ে গেল খেয়াল করতে পারিনি৷ যদিও ভীষণ অসুস্থ থাকায় এমনটা হয়েছে।

আমিই মনে হয় একমাত্র পুরুষ যে তার স্ত্রীকে পাগলের মতো ভালোবেসেও আজও বলতে পারিনি। আমি একটা সময় আমার চোখ দিয়ে তার সৌন্দর্য অবলোকন করতাম। আজকে তার কণ্ঠ শুনে তার সৌন্দর্য অবলোকন করি। তার চোখ দিয়ে পুরো বিশ্ব দেখি। এই একটা বছর যে মানুষটা আমাকে এত সাপোর্ট দিয়েছে সে মানুষটার আজকে জন্মদিন।

সে আর কেউ নয়। আমার সহধর্মিণী আমার অর্ধাঙ্গী আয়েশা। আজকে সবার সামনে বলছি আমি আয়েশাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। যে কথাটা গত একবছরে আমি বলতে পারিনি। আজকে বলে দিলাম।”

আরাবের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে আয়েশা গলে গেল। সে সবার সামনে আরাবকে জড়িয়ে ধরল। জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া আজকের এ দিনটা। আজকের এ দিনের জন্য সে এতদিন ধৈর্য ধরেছে, অপেক্ষা করেছে৷ আল্লাহর কাছে চেয়ে এসেছে। আজকে যেন আল্লাহ তাকে সবকিছু ঢেলে দিয়েছে।

এদিকে আয়েশার ক্লাসের সবাই আরাবের মুখে এমন কথা শুনে থমকে গেল। আয়েশার মতো সুন্দরী একটা মেয়ের স্বামী আরাব তারা মানতেই পারছে না। অসুস্থতায় আরাবের স্বাস্থ্য চেহারা আরও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে সাথে শরীরও অনেকটা ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যে আরাব চোখে দেখে না,বয়স বেশি। তারা প্রথমে আরাবকে স্টেজে দেখে মনে করেছিল এটা আয়েশার বাবা। তবে এখন এ কথা শুনে সবাই চুপসে গেল।

আয়ানের বুক ধুকধুক করছে। একটু আগেই আরাবের সাথে তার দেখা হয়েছিল। সে আরাবকে আংকেল বলে সম্বোধন করেছিল। আর সে আংকেল কি’না তারেই প্রিয় মানুষটার স্বামী। সে এটা কোনোভাবেই মানতে পারছে না। শরীরটা রাগে ক্ষোভে জ্বলে উঠছে তার।

আয়েশার ক্লাসের সবাই কীভাবে যেন আয়েশাকে দেখছে। আয়েশা বিষয়টি লক্ষ্য করেও এড়িয়ে গেল। বেশ ভালোভাবেই অনুষ্ঠানটি শেষ হলো।

অনুষ্ঠান শেষে আয়েশা আর আরাব রুমে আসলো। আরাব সোফায় বসলো। এরপর আয়েশাকে বলল

“তুমি কী আমার প্রতি খুশি নাকি আমাকে মানতে তোমার কষ্ট হচ্ছে।”

আয়েশা আরাবের পাশে বসলো। আরাবের দুটো হাত শক্ত করে ধরে বলল

“আমি আপনার মুখে এ কথাগুলো শুনার জন্য অধীর আগ্রহে দিন গুণছিলাম। আপনার মনের সৌন্দর্যের কাছে বাহ্যিক সকল সৌন্দর্য ফিকে। আপনার এ ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কতটুকু সংগ্রাম করেছি আমি জানি। আপনার জন্য আমি আমার জীবনটাও দিয়ে দিতে পারব। আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি আমি।”

আয়েশার কথা শুনে আরাবের চোখে জল টলমল করছে। সে যদি আয়েশার মুখের এক্সপ্রেশনটা দেখতে পারত কতই না ভালো লাগত তার। অনুভূতি বুঝতে পারলেও সে আয়েশার মুখ অবয়বটা দেখতে পারছে না। কল্পনায় যদিও একটা এক্সপ্রেশন সে ভেবে কল্পনা করে ফেলেছে। তবে সেটা তো বাস্তবের সাথে নাও মিলতে পারে। আজকে তার ভীষণ মন চাচ্ছে চোখের দৃষ্টি জোড়া ফিরে পেতে।

আয়েশা আর আরাব নিজেদের রুমে গেল ফ্রেশ হতে। আয়েশা কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নিল। আরাবও নিজেকে ফ্রেশ করে আয়েশার রুমে আসলো। আয়েশা তখন বিছানায় বসে চুল আঁচরাচ্ছিল। আরাবকে দেখে চমকে উঠে বলল

“এত রাতে আপনি? কীভাবে আসলেন? রাত, বিরাতে এভাবে একা হাঁটতে আপনাকে নিষেধ করেছি না? তারপরও কেন একা একা হাঁটতে গেলেন? যদি পরে যেতেন। চারপাশে লাইট অফ হয়ে অন্ধকার হয়ে আছে। আপনার কী আক্কেল হবে না?”

আরাব হালকা হেসে উত্তর দিল

“আমার জন্য রাত আর দিন কী? আমার জন্য সবই তো এক। আমার চোখ অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখে না আয়েশা। তোমার ঘ্রাণে চলে এসেছি। বিপদ আর কী হবে? যে নিজেই সবার বিপদ সে আর কী বিপদে পরবে। এসেছিলাম একটা কথা বলতে।”

আরাবের মুখে এমন কথা শুনে আয়েশার মুখটা শুকিয়ে গেল। আরাবের কষ্ট তাকে ভীষণ পীড়া দেয়। মন থেকে আল্লাহর কাছে সে আরাবের দৃষ্টি ভিক্ষা চায়। সে নরম গলায় উত্তর দিল

“কী বলবেন? বলুন না।”

আরাব হালকা হেসে বলল

“এখনও কী আলাদা ঘরে থাকবে নাকি একসাথে থাকবে? আমরা বিয়ের এক বছর পার করে ফেলেছি। আর এতদিন আলাদা ঘরে ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আলাদা ঘরে না থেকে আমরা চাইলে একসাথে থাকতেই পারি। এতে যদি তোমার সমস্যা না থাকে।”

আরাবের কথা শুনে আয়েশা লজ্জা পাচ্ছিল। লজ্জা কণ্ঠে উত্তর দিল

“আপনি যা বলবেন তাই।”

আরাব আয়েশার বিছানায় শুইয়ে পড়ল। তারপর বলে উঠল

“আজকে আর ঐ ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি বরং এখানেই ঘুমাই। তুমিও ঘুমিয়ে পরো।”

আরাবের কথা শুনে আয়েশা চুলগুলো খোপা করে আরাবেই পাশেই শুয়ে পড়লো। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ভেসে আসছে দুজনের। এ নিঃশ্বাস যেন দুজনকেই তাড়না দিচ্ছে একটা নতুন অধ্যায়ের শুরু করতে। আর সে অধ্যায়ের সূচণা ঘটাতেই দুজন একে অপরের সাথে মিশে গেল।

পূর্ব আকাশে রক্তিম সূর্যের আভাস। সকালের শুরু। মিষ্টি একটা বাতাস চারদিকে বইছে। আয়েশার সারা শরীরে আরাবের স্পর্শ মেখে আছে। সে চুলগুলো খোপা করে বিছানা ছেড়ে উঠল। ফ্রেশ হয়ে কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিল। আরাব তখনও ঘুমাচ্ছিল। আয়েশার কলেজ মর্নিং শিফট হওয়ায় তাকে সকাল সকাল উঠেই কলেজে যেতে হয়। এদিকে আরাব একটু বেলা করে ঘুমায়। অপারেশনের পর থেকে তার সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস টা চলে গেছে। চায়লেও সে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না।

আয়েশা তাই আরাবকে আর ডাকলো না। তৈরী হয়ে সরাসরি কলেজ চলে গেল। কলেজে যেতেই আয়েশার দিকে সবাই আড়চোখে তাকাতে লাগল। মনে হচ্ছে আয়েশা বড়ো কোনো অপরাধ করেছে। আয়েশা সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল

“এনিথিং রং? সবাই এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমি কী কোনো ভুল করেছি?”

আয়ান আয়েশার সামনে এসে তিরস্কার করে বলতে লাগল

“ভীষণ ভালো মেয়ে মনে করতাম। কিন্তু তলে তলে যে এত দূর কে জানত। একেক দিন একেক গাড়ি দিয়ে কলেজে আসার কারণ তো এখন বুঝলাম। সুগার ড্যাডি বিয়ে করেছো। তোমার মতো মেয়েরা এভাবেই সুগ্যার ডেডি বিয়ে করে টাকা পয়সার পাহাড়ে শুতে চায়। ইশ কী বিচ্ছিরি দেখতে লোকটা। আচ্ছা আয়েশা ঐ লোকটার সাথে এক বিছানায় শুতে ঘিন্না লাগে না? আমরা তো ভেবেছিলাম তোমার বাবা। ওমা এরপর শুনি তোমার স্বামী। তোমাদের মতো লোভী মেয়েদের জন্যই ভালো ময়েদের দূর্নাম হয়। তা কয় টাকার বিনিময়ে তোমার বাবা মা এমন বুড়ো দামড়ার কাছে তোমাকে বেঁচলো?”

আয়ানের কথা শুনে ক্লাসের সবাই হেসে দিল। সে সাথে সবাই আয়ানের সাথে জোরে জোরে বলতে লাগল

“সুগার ড্যাডি, সুগার ড্যাডি, কার? কার? আয়েশার আয়কশার। ”

আয়েশা এসব শুনে লম্বা নিঃশ্বাস নিল। বুক ভারী হয়ে যাচ্ছে তার। এত বড়ো অপমান সে নিতে পারছে না। সুন্দর একটা সম্কর্ককে তারা কত নোংরা ভাবে উপস্থাপন করছে এটা ভেবেই তার গায়ের লোম কাটা দিয়ে উঠল। এদিকে সবাই আয়েশাকে জোর গলায় তিরস্কার করতে লাগল। আয়েশা নিজেকে সংযত করতে পারল না। বেশ রাগে আয়ানের গালে জোরে চড় কষিয়ে দিল।

আর সাথে সাথে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠল..

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২৩

আয়ান সবার সামনে চড় খাওয়ায় ভীষণ রেগে গেল। অল্প বয়সের তরুন টগবগে রক্ত। একটু গরম তো হবেই। আয়ানের পাশে থাকা সবাই চুপ হয়ে গেল। আয়ানকে চড় খেতে দেখে এখন সবাই হাসছে। এরা হচ্ছে গিরগিটির মতো। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। আয়ানের অপমানবোধ বাড়তে লাগল। সে আয়েশাকে কষিয়ে চড় দিতে নিলো। আয়েশা হাতটা ধরে মুচড়ে দিয়ে আয়ানকে বলল

“এ হাতে গ্রামের অনেক শক্ত ডাল ভেঙেছি। আর তোমার হাত তো সে তুলনায় অনেক নরম। আমাকে যতটা সহজ তুমি মনে করেছো আমি তার থেকে কঠিন এবং শক্ত। আমার স্বামীকে নিয়ে একটা বাজে কথা বললে আমি জিহ্বা ছিড়ে ফেলব। আমার স্বামীর সাথে আমার শুতে ঘিনঘিন না লাগলেই হবে। তোমরা কেউ তো আর আমার স্বামীর সাথে শুতে যাবে না। তাহলে চিন্তা কিসের? আর আমার স্বামীর ব্যাক্তিত্ব পর্যন্ত পৌঁছাতে তোমাদের অনেক দিন সময় লেগে যাবে। মানুষটার বয়স দেখলে বাহ্যিক চেহারা দেখলে তবে মানসিকতাটা দেখতে পারো নি। কারণ জানোয়াররা সবসময় বাহির দেখেই বিচার করে। মন পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষমতা তাদের নেই। আর একটা বার যদি আমার স্বামীকে নিয়ে কোনো কথা কেউ বলবে সাথে সাথে আমি তাকে পুঁতে ফেলব।

আর আরেকটা কথা আমার বাবা, মা মৃত। আর বাবা, মা কখনও সন্তান বেঁচতে পারে না। তবে সব বাবা মা তার সন্তানকে সবসময় সঠিক শিক্ষাটা দিতে পারে না৷ তোমার শিক্ষার এতই অভাব যে কারও মা, বাবা তুলে বাজে কথা বলতেও দ্বিধা করছো না। নিজেকে যতটা স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম মনে করো , তুমি ততটাই লুজার। আর লুজাররা সবসময় অন্যকে উপহাস করে মজা পায়।”

আয়েশা আয়ানের হাতটা মুচড়ে এবার ছেড়ে স্থান পরিত্যাগ করল। সবাই আয়েশার কথায় চুপ ছিল এতক্ষণ। আয়েশার বলিষ্ঠ জবাব সবাইকে চুপ হতে বাধ্য করল। আয়েশা চলে যেতেই আয়ানের বন্ধু হোসাইন বলে উঠল

“তোরে একদম সবার সামনে ন্যাংটা করে দিল আয়েশা। আয়েশার পেছন লাগতে গিয়ে, আয়েশাকে ছোটো করতে গিয়ে নিজেই উল্টো ছোটো হলি। আর সবয়েচে বড়ো কথা তুই মেয়েটাকে পছন্দ করতি৷ এখন জানতে পারলি মেয়েটা বিবাহিত। মুভ অন কর। তা’না করে আয়েশার জামাই হ্যান্ডসাম, নাকি বয়স্ক, নাকি সুগার ড্যাডি এসব নিয়ে কে ভাবতে বলেছে তোকে? তোর সাথে তো আয়েশা ডাবল টাইমিং ও করে নি। বয়স্ক হোক বা সুগার ড্যাডি আয়েশা তার হাসবেন্ডকে সম্মান করে তার কথাতেই বুঝা যাচ্ছে। আর শুন আয়েশার হাসবেন্ড বয়স্ক হলেও অঢেল টাকার মালিক। এত টাকা তুই কখনও চোখেও দেখিস নি। ১০ জন টপ বিজনেস ম্যানের মধ্যে আয়েশার হাসবেন্ড আরাব চৌধুরি নাম আছে। দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলার পরও তিনি জমজমাট ব্যবস্যা করে যাচ্ছেন। আরাব চৌধুরির মতো লোকেই আয়েশাকে সামলাতে পারবে। তোর আমার মতো ফকির পারবে না। এসব বাদ দিয়ে মুভ অন করে পড়তে বস। আর ক্লাসের সবাই যেদিকে নৌকা যায় সেদিকে গলা মেলায়। এসব গিরগিটি নিয়ে আসছিস আয়েশাকে অপদস্ত করতে। বন্ধু হয়ে বলছি যা হয়েছে ভুলে যা। সামনে পরীক্ষা মন দিয়ে পড়।”

আয়ান গম্ভীর দুটো নিঃশ্বাস ছাড়ল। আর কোনো কথায় বলল না। তবে অপমান তার সইছে না৷ আয়েশাকে নিয়ে যতই ভাবছে ততই তার শরীরে জ্বালা ধরছে।

এদিকে ক্লাসে আয়েশা অনেকটা এক ঘরে হয়ে আছে। আয়েশা বুঝতে পারছে এতদিন তার সাথে যারা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেছে তারা কেবল স্বার্থে করেছে। আয়েশা তাদের যখন যেভাবে পেরেছে হেল্প করেছে। আজ কোনো অপরাধ ছাড়ায় সবাই তার দিকে আঙুল তুলছে, নাক শিটকাচ্ছে। তার দোষ হলো সে এমন একজনকে বিয়ে করেছে যে তার থেকে বয়সে একটু বড়ো। কিন্তু বয়সে বড়ো কাউকে বিয়ে করা তো অন্যায় না। ইসলামে নিষিদ্ধও না। তাহলে সবাই কেন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এটা তো বড়ো কোনো ক্রাইম ও না৷ আজকে আয়েশা এটা বুঝতে পারলো দুনিয়াটায় স্বার্থের খেলা। স্বার্থপর হলেই কেবল শান্তিতে থাকা যায়। অন্যথায় শান্তিতে থাকা বড়ো দায়। পুরো ক্লাসটায় তার অস্বস্থি হয়েছে।

সময় যেতে লাগল। আয়েশার সবার সাথে সম্পর্কটা একটু ঠিক হতে লাগল। আস্তে আস্তে আবার সবাই আয়েশাকে পছন্দ করতে শুরু করল। আয়ানের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তারা আয়েশার সাথে যে অন্যায় করেছে তার জন্য সবাই অনুতপ্ত।

দেখতে দেখতে পরীক্ষার সময় চলে এসেছে। আর একটা মাস পরেই পরীক্ষা। আয়েশা পড়াশোনায় প্রচুর সময় দিচ্ছে। তাকে যে করে হোক নিজের জীবনের চাকাটা ঘুরাতে হবে। একজন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়তে হবে। জীবনে সকল কালো অতীত ভুলে সে সামনে যেতে চায়। আর সেজন্যই পড়াশোনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখছে বেশি। লতাও আয়েশার প্রতি বিশেষ নজর রাখছে। কখন কী লাগছে বলার আগেই নিয়ে আসছে। এই যে আয়েশা রাত জেগে পড়ে এক কাপ চা তার রাত জাগতে সহয়তা করে। তাই লতা আয়েশার জন্য প্রতিদিন সন্ধার পর চা করে নিয়ে আসে। বলা যায় বিশেষ যত্ন নিচ্ছে সে। আয়েশার জন্যই সে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিল। তাই সে আয়েশার সাফল্য দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

আরাব যদিও আয়েশার ব্যস্ততা চোখে অবলোকন করতে পারছে না। তবুও বুঝতে পারছে আয়েশা পড়াশোনা এবং পরীক্ষা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আছে৷ চিন্তায় আছে। আয়েশা যখন টেবিলে বসে পড়ে। তখন আরাব তার পাশে বসে থাকে। আয়েশাকে সঙ্গ দেয়। আয়েশার স্বপ্ন পূরণের সাথী হয়ে থাকতে চায় সে।

আয়েশা পড়ছিল। প্রতিদিনকার মতো আরাব বসে আছে আয়েশার পাশে। আয়েশা আরাবকে নম্র গলায় বলল

“আমার তো পরীক্ষা তাই রাত জাগি৷ আপনি কেন প্রতিদিন আমার সাথে নিয়ম করে রাত জাগেন? একটু বিশ্রাম তো করতে পারেন। আপনার শরীর এখনও ফিট না এটা ভুলে যাবেন না। এভাবে রাত জাগলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তখন তো আমার নিজেকে অপরাধী লাগবে। আপনাকে আর রাত জাগতে হবে না। আপনি গিয়ে বিশ্রাম করুন।”

আরাব মুচকি হেসে আয়েশাকে জবাব দিল

“আমার ভালো লাগে তোমার পাশে বসে থাকতে। ভালো লাগার কাজ করলে মানুষ সুস্থ থাকে অসুস্থ হয় না। তোমার পাশে বসে নিদ্রাহীন অজস্র রাত আমি পার করতে পারব। তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি বুঝাতে পারব না আয়েশা। মাঝে মাঝে মন চায় যদি পারতাম তাহলে তোমাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতাম। আমি তো তা পারি না। দৃষ্টি চলে যাওয়ায় বাইরেও তেমন বের হতে পারি না। তাই যতটুকু পারি সাধ্যের মধ্যেই আগলে রাখার চেষ্টা করি। এটাতে বাঁধা দিও না।”

আরাবের কথা শুনে আয়েশা আরাবের কাঁধে মাথাটা হেলিয়ে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিল। এ নিঃশ্বাসে পরম শান্তি লুকিয়ে আছে।

সকালের শুরু। সেদিন কেমিস্ট্রির ল্যাব চলছিল। প্রতিটা ছাত্রছাত্রী সেইফটি পোশাক পরে সালফিউরিক এসিড দিয়ে এক্সপিরিমেন্ট করছে। সবার সাথে আয়েশার সম্পর্ক ভালো হলেও আয়ানের সাথে আয়েশার সম্পর্কের উন্নতি হয়নি৷ আয়েশার চড়টা আয়ানকে দিনকে দিন হতাশ করে দিচ্ছিল। সারাক্ষণ এ চড়ের প্রতিশোধ নেওয়ার ভাঁজে ভাঁজে ঘুরছিল সে। কীভাবে প্রতিশোধ নিলে আয়েশা সবচেয়ে বেশি কষ্ট এটাই সে ভেবে যাচ্ছিল।

আজকে হঠাৎ যখন সালফিউরিক এসিড দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিল। তখন সে ভাবতে লাগল আয়েশার সৌন্দর্য যদি নষ্ট করে দেয় তাহলে আয়েশা সারাজীবন নিজেকে যতবার আয়নায় দেখবে ততবার কষ্ট পাবে৷ আর আয়েশার সুগার ড্যাডি আরাবও এত কুৎসিত মেয়ে রাখবে না। এতে করে আয়েশার সকল দম্ভ ধুলোয় মিশে যাবে।

আয়ান সালফিউরিক এসিড দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে হোসাইনকে বলছিল

“আমি যদি আয়েশার মুখে এটা ছুড়ে মারি। আয়েশার কী মুখ ঝলসে যাবে?”

হোসাইন কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল আয়ানের দিকে। তারপর আয়ানকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল

“পাগল হয়ে গেছিস নাকি? এত বড়ো ফানেলে সালফিউরিক এসিড নিয়েছিস কেন? আর এটা শরীরে লাগলে চামড়া ঝলসে যায়। কী আবোল তাবোল বলছিস? আয়েশার পিছে লাগা বন্ধ কর।”

আয়ান হেসে জবাব দিল

“আজকের পর থেকে আর আয়েশার পেছন লাগব না। তবে আমার অপমানের শাস্তি তো আমি দিবই।”

কথাটা বলেই সে আয়েশার কাছে গিয়ে আয়েশাকে ডাকল। আয়েশা আয়ানের দিকে ফিরতেই পুরো এসিড টা তার মুখে মারল। ভাগ্যক্রমে আয়েশা একটু দূরে যাওয়ায় এসিডটা কেবল তার গালের এক পাশে লেগেছে। সাথে সাথে জ্বালা পোড়া শুরু হয়ে গেল আয়েশার। আয়েশা জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল।

চলবে।