বেহালার সুর পর্ব-২৬

0
2

#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২৬

আরাব দ্রূত আয়েশাকে ধরে শুয়ালো। ডাক্তারকে কল দিয়ে আনালো ইমারজেন্সি। ডাক্তার এসে আয়েশাকে দেখল। আয়েশাকে দেখে আরাবকে পরামর্শ দিল সরাসরি যেন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। লক্ষণ ভালো লাগছে না। আরাব ভয় পেয়ে গেল। শরীর কাঁপছে তার। নিজেকে সামলে নিল। তারপর দ্রূত আয়েশাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল।

হাসপাতালে যাওয়ার সাথে সাথে আয়েশার কিছু টেস্ট করা হলো এবং আয়েশাকে অবজারভেশনে রাখা হলো। টেস্ট রিপোর্ট আসতে একটু দেরি হবে। এ দেরিটায় যেন আরাব সহ্য করতে পারছে না। প্রতিটা সেকেন্ড তার কাছে সহস্র বছরের মতো লাগছে। সে নিজেকে সামলাতে চেয়েও পারছে না। আয়েশার জ্ঞান এখনও ফিরে নি। চিন্তায় তার ভেতর কাঁপছে।

এক রাশ চিন্তা আর অশান্তিতে সারাটা দিন কাটল। ডাক্তার আরাবকে ডাকলো। আরাব ডাক্তারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল

“আয়েশা ঠিক আছে তো?”

ডাক্তার মিহির সাহেব আরাবকে বলল

“দেখুন বিষয়টা অস্থির হবার মতোই। তবে আপনাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আয়েশার হার্টে ছোটো একটা ফুটা আছে। এটা হয়তো তার জন্ম থেকেই। হার্টের এ ফুটা সম্পর্কে আপনি নিশ্চয় জানেন?”

আরাব মাথা নেড়ে বলল

“আয়েশার দুটো সার্জারি হয়েছে। গুলি লাগার জন্য সার্জারিগুলো দ্রূত করতে হয়েছিল। আর সে সময় ডাক্তার এ বিষয়ে অবগত করেছিল। তবে তারা বলেছিল এটা স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে তেমন কিছু প্রয়োজন নেই।”

ডাক্তার মিহির আরাবকে বলল

“আরাব সাহেব এ জায়গাটাতেই ভুল হয়েছে। নিয়মিত চেক আপ নিশ্চয় করেননি?”

আরাব সাহেব মাথা নীচু করে বলল

“ঐ সময়টায় এত স্ট্রেস আর এত সমস্যা গিয়েছে বিষয়টা আমার মথা থেকেই চলে গিয়েছিল। ঘটনার প্রায় দু বছর পার করে ফেললাম। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে একবারও আমার মাথায় আসে নি। আমার গুলি লাগার পর আমি দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। সে সাথে আমার হালকা মেমোরি লসও হত। এসব রোগ, শোকের জন্য এ বিষয়টা আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখন কী কোনো সমাধান আছে? আয়েশার কান্ডিশন কী এখন ভালো? এজন্য যদি আয়েশার বড়ো কিছু হয়ে থাকে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আপনি প্লিজ বলুন কী করব, কী করলে আয়েশা সুস্থ হবে?”

ডাক্তার মিহির আরাবের দিকে তাকালো। আরাব বেশ অস্থির হয়ে আছে। আরাবের অস্থিরতা দেখে তিনি আরাবকে আস্বস্ত করে বললেন

“আরাব সাহেব শান্ত হোন। রোগ আছে রোগের ট্রিটমেন্ট ও আছে। আয়েশার অবস্থা এখন ভালো। ছোটো একটা রিং পরিয়ে নিলেই হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আয়েশা একই সাথে গর্ভবতী। এ সময় রিং পরানোটা জটিল। আবার রিং পরাতে গেলে বাচ্চারও ক্ষতি হতে পারে। আর রিং না পরালে আয়েশার ক্ষতি হতে পারে। আপনাকে একটা সিদ্ধান্ত আমাদের দিতে হবে। আমরা আয়েশার রিং পরাতে গিয়ে যদি আয়েশার গর্ভপাত হয় এটা নিয়ে কোনোরকম আপত্তি জানানো যাবে না। আবার যদি বলেন রিং দেরি করে পরাবেন বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর। তাহলে বলব এটা রিস্ক হয়ে যাবে আয়েশার জন্য। তার যে অবস্থা রিং না পরালে যেকোনো সময় তার মৃত্যু হতে পারে। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।”

আরাব কোনো চিন্তায় করলো না। সে ডাক্তারের হাত দুটো ধরে কনফিডেন্ট হয়ে বলল

“আমি শুধু চাই আয়েশা বেঁচে থাকুক। সন্তান যদি আল্লাহ দেয় আবার হবে। আমরা তো আর ইচ্ছা করে নিজের সন্তান খু/ন করছি না। পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করছে। আমার বাচ্চা লাগবে না আয়েশাকে লাগবে। আর আয়েশার যদি ভবিষ্যতে বাচ্চা না ও হয় আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। আমার এতিমখানার শত শত বাচ্চা বাবা, মা অভিভাবকহীন। তাদের নিয়ে বাকি জীবন পার করে দিব। এত চিন্তা করার কিছু নেই। আয়েশাকে বাঁচাতে আপনার যা করা লাগে করুন। টাকা পয়সা, যা লাগে সবকিছু আমি দিতে রাজি। শুধু আয়েশাকে বাঁচান।”

ডাক্তার মিহির আরাবের কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। এ প্রথম তার সামনে এমন একজন স্বামী যে কি’না কোনো চিন্তা ভাবনা দ্বিধা ছাড়া কেবল মাত্র তার স্ত্রীকে বাঁচাতে চাচ্ছে। তার কাছে তার স্ত্রীর জীবন সবকিছুর উর্ধ্বে। তিনি আরাবকে হালকা গলায় বললেন

“বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। ফিজিক্যাল কান্ডিশান স্টেবল হলেই আমরা অপারেশন করব। একজন গাইনোকলোজিস্টের সাথেও পরামর্শ প্রয়োজন। আপনি দোয়া করুন। আমরা কেবল চেষ্টা করতে পারি। রিজিকের মালিক আল্লাহ সে সাথে হায়াতের মালিকও আল্লাহ। কেবল মাত্র দোয়ায় পারে এ দুটো বাড়াতে।”

আরাবের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে করিডোরে বসে এক মনে আল্লাহকে বলছে

“হে আল্লাহ জীবনে অনেক পাপ করেছি, অন্যায় করেছি। তবে আমি যখন তওবা করে সে পাপ ছেড়েছি নতুন করে সে পাপে আর জড়াইনি। আমি জানি আমার পাপের ভান্ডার থেকে আপনার রহমতের ভান্ডার আরও বিশাল। আমি আমার জন্য তওবা ছাড়া দুনিয়াবী কিছু চাইনি। আজকে দুনিয়াতে শুধু আমি আয়েশার হায়াত ভিক্ষা চাই। আয়েশার রিজিক ভিক্ষা চাই। হে আল্লাহ দয়াকরে তার হায়াত এবং রিজিক ভিক্ষা দিন। আমার সকল হায়াত তাকে দিয়ে দিন। তার জীবনের পরিধি এত স্বল্প রাখিয়েন না। সে নিষ্পাপ। কখনও পাপ করতে দেখিনি। সবসময় আপনাকে স্মরণ করতে দেখেছি। শালীন ভাবে চলতে দেখেছি। সকালে সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখেছি। এরকম সুন্দর সকাল আমার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েন না৷ হে আল্লাহ আমার বুক ভার হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসার ভারত্ব যে এত ভারী আমি আজকে বুঝতে পারছি। এ কষ্টের ভার আমি সইতে পারছি না।”

আরাব করিডোরে বসেই কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ কেঁদে মনটাকে শক্ত করে নিল। তারপর সরাসরি চলে গেল প্রসেসিং এ। সকল প্রকার কাগজ পত্রে সিগনেচার করে নিল সে। তার মধ্যে আয়েশার জ্ঞান ফিরেছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে সে আয়েশার কাছে গেল। আয়েশার কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল

“এখন কেমন লাগছে?”

আয়েশা হালকা দম নিয়ে বলল

“আগের থেকে ভালো। আচ্ছা আমার কী হয়েছে?”

আরাব নিজেকে স্বাভাবিক করল। আয়েশাকে এটা বলা যাবে না সে গর্ভবতী। কারণ এতে সে আরও বেশি হার্ট হবে৷ তাই আয়েশার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল

“তেমন কিছু না। তোমার হার্টের সমস্যাটা ছিল সেটা বেড়েছে। এখানে আমারও গাফলতি ছিল। কারণ আমি তোমার এ বিষয়টি খেয়াল রাখতে পারিনি। আজকের মধ্যেই তোমাকে রিং পরাতে হবে। এরপর তুমি একদম সুস্থ। কিছুক্ষণের ব্যাপার শুধু। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

আয়েশা আরাবের কথা শুনে কিছুটা ভয় চোখে বলল

“তাহলে আমার বাচ্চার কী হবে?”

আয়েশার মুখে বাচ্চার কথা শুনে আরাব চমকে উঠল।।ভাবতে লাগল সে কীভাবে জানল তার বাচ্চা পেটে। সে তো তাকে কিছু বলেনি। এমনকি সকল ডাক্তারও বিষয়টি তার থেকে হাইড করেছে। আরাব আমতা আমতা করে বলল

“বাচ্চা মানে?”

আয়েশার আরাবের দিকে তাকিয়ে বলল

“আমি প্র্যাগন্যান্ট। সকালেই জানতে পারি। কিট দিয়ে টেস্ট করেছিলাম। পরীক্ষার রেজাল্টের চিন্তায় বিষয়টা বলিনি। ইচ্ছা ছিল দুটো সংবাদ একসাথে দিব। তবে হুট করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমি বলতে পারিনি। দেখুন আমার যা হওয়ার হোক আমার বাচ্চার যেন কোনো ক্ষতি না হয়৷ আমার বাচ্চাকে আপনি প্লিজ বাঁচাবেন।”

আরাব আয়েশাকে ধরে বলল

“তুমি বাঁচলে বাচ্চা আরও নেওয়া যাবে। পরিস্থিতি যা সিদ্ধান্ত নিতে বলবে তাই নিতে হবে। নিজেকে সামলাও। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।”

কথাগুলো বলেই আরাব বাইরে চলে আসলো। আয়েশা কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে বলল

“হে! আমার রব। আমার জীবনে স্বজ্ঞানে আপনার নফরমানী করিনি৷ সবসময় নিজেকে পাপ মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। তবুও আমরা মানুষ অজানা কত পাপেই করে ফলি। সে পাপ আপনি ক্ষমা করে দিন। ক্ষমা করে দিয়ে আমার সন্তানের হায়াত বাড়িয়ে এ দুনিয়ায় আনার ব্যবস্থা করে দিন। আমার সকল পাপ আপনি ক্ষমা করে দিন দয়াকরে।”

আয়েশাকে একটু পরে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। অপারেশন শুরু হলো। আরাব কেবল অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে আছে। কখন ডাক্তার এসে বলবে
আয়েশার সকল সমস্যা কেটে গেছে এ আশায় বসে আছে সে।

এর মধ্যেই একজন ডাক্তার থিয়েটার থেকে বের হলো। কিন্তু..
চলবে।