#বেহালার সুর
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২৭/শেষ পর্ব
কিন্তু কোনোরূপ আপডেটেই আয়েশার দিচ্ছিল না। আরাব ডাক্তারের কাছে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল
“আয়েশার অবস্থা কেমন? এখন কী সে ঠিক আছে? সব ভালোভাবে হয়েছে?”
ডাক্তার রাইসা আরাবের দিকে হাত উঁচিয়ে শান্ত হতে হয়ে বলল
“দেখুন এখনও আমরা কিছু বলতে পারছি না। কিছু জটিলতা আছে। আয়েশার বয়স অল্প। এ অল্প বয়সে প্র্যাগনেন্সি। সে সাথে বড়ো বড়ো দুটো সার্জারি হয়েছে। সব মিলিয়ে বিষয়টা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে মেডিকেল বোর্ড বসাতে হবে। সুতরাং সময় নষ্ট করবেন না। আল্লাহকে ডাকতে থাকুন৷ আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করছি।”
ডাক্তার রাইসার কথা শুনে আরাব ভেঙে পড়ল। শরীর তার ভীষণ কাঁপছে। সে আবারও আল্লাহকে ডেকে বলল
“হে আল্লাহ আমার মতো একজন মানুষকে তুমি কী জন্য বাঁচিয়ে রাখবে? যার বেঁচে থাকার অবলম্বনেই তুমি নিয়ে যাচ্ছে তাকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ? তুমি আমাকে নিয়ে যাও৷ তবুও আয়েশাকে সুস্থ করে দাও। এ অল্প বয়সে তাকে নিয়ে যেও না। তার জীবনের কিছু অংশ আমার সাথে কাটাতে দাও। আমি দুনিয়ায় একমাত্র তুমি ছাড়া কারও কাছে কিছু চাইনি। সেই তুমি আমার জীবনের এত বড়ো আশা কেড়ে নিয়ে নিরাশ করো না। হাত জোড় করে বলছি আমার আয়েশাকে ফিরিয়ে দাও৷”
মেডিকেল বোর্ড বসিয়ে আবারও আয়েশার অস্ত্রোপচার দ্বিতীয় ধাপে শুরু হলো। টানা ৬ ঘন্টা চলল অপারেশন। এরপর ক্লান্ত হয়ে ডাক্তাররা ওটি রুম থেকে বের হলো। ডাক্তারকে দেখেই আরাব ছুটে গেল। আরাবকে অস্থির হতে দেখেই ডাক্তার বলল
“আপনার স্ত্রী সুস্থ আছে।”
আরাব একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। একটু হালকা লাগছে তার। সে একটু দম নিয়ে জিজ্ঞেস করল
“বাচ্চাকে কী বাঁচানো সম্ভব হয়েছে?”
ডাক্তার মাথা নীচু করে উত্তর দিলেন
“আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। তবে এত জটিলতার মধ্যে বাচ্চাটার জন্য আমরা কিছু করতে পারিনি। তাই আপনার বাচ্চাটার জন্য আমরা কিছু করতে পারিনি। আমরা সরি।”
আরাবের একটু কষ্ট লাগলেও সে নিজেকে সামলে নিল। কারণ আয়েশা বেঁচে আছে এটাই তার কাছে অনেক। সে ডাক্তারকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল
“আমি কখন আয়েশার সাথে দেখা করতে পারব?”
ডাক্তার হালকা গলায় উত্তর দিলেন
“এ মুহুর্তে সম্ভব না। অবজারভেশনে রেখে আমরা হয়তো কাল রোগীকে বেডে দিব। তখন দেখা করবেন। আর এখনও আয়েশার জ্ঞান ফেরে নি৷ আশা করি কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।”
কথাগুলো বলে ডাক্তার চলে গেলেন। পরদিন আয়েশাকে কেবিনে দেওয়া হলো। আরাব আয়েশার কাছে যেতেই আয়েশা কেঁদে দিল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল
“আমার বাচ্চাটা জান্নাতের পাখি হয়ে চলে গেছে।”
আরাব আয়েশাকে স্বাত্ত্বণা দিয়ে বলল
“তুমিই তো বলো আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। এটাও মনে করো ভালোর জন্য হয়েছে। তুমি নিজেকে সামলাও আয়েশা। ইনশাআল্লাহ তুমি আবার মা হবে। এদিকে তুমি একটু সুস্থ হলে তোমার মুখের সার্জারিও আমি করাব। আমি দেশের বাইরের একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। আর আমাদের বাচ্চার সাথে ইনশাআল্লাহ আমরা জান্নাতে দেখা করব।”
আয়েশার আরাবের হাতটা গালের নীচে নিয়ে একটু কাঁত হয়ে শুয়ে নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল। চোখের জল গড়িয়ে আরাবের হাতে পড়তে লাগল। আরাবের চোখ বেয়েও কেবল সন্তান হারানোর অশ্রু ঝড়ে পড়ছে।
পেরিয়ে গেল বেশ কয়েকদিন। আয়েশা আবার মেডিকেল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবার তাকে যে করেই হোক সকল প্রতিকূলতা অভারকাম করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আয়েশার পড়াশোনার গতি ততই বাড়তেছে দিন যত যাচ্ছে। আয়েশা মেডিকেল এডমিশন টেস্ট দিল শুধু। কারণ তার লক্ষ্য ডাক্তার হওয়া। সরকারিতে না হলে বেসরকারিতে পরবে। তবুও সে ডাক্তারেই হবে। আরাবও আয়েশার এ ফোকাসকে অনেক পছন্দ করে। কারণ আয়েশা সব সময় নির্দিষ্ট একটা জায়গায় ফোকাস করে। আর সে জায়গাকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে যায়। আরাব এটা বুঝতে পারছে আয়েশা অবশ্যই মেডিকেল এডমিশনে ভালো করবে। তার ফোকাস, পড়ার গতি তাই বলে দেয়।
মেডিকেল এক্সাম শেষ হলো। আজকে তার রেজাল্ট। আয়েশা ভীষণ চিন্তায় আছে। আরাব আর লতা তাকে বুঝাচ্ছে। তারা বলছে যা হবে ভালোর জন্য। তবে আয়েশার অস্থিরতা তা মানতে চায় না। তার ভেতর অস্থিরতায় বাড়তে লাগল। নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা কেবল করতে লাগল।
রেজাল্ট পাবলিশড হলো। আবার মোবাইলে আয়েশার রেজাল্ট দেখল। আরাব খুশিতে আয়েশাকে বলে উঠল
“আয়েশা তোমার অবশ্যই ঢাকা মেডিকেলে হয়ে যাবে। তোমার মেরটি স্কোর ৩। কনগ্রাচুলেশন আয়েশা।”
আয়েশা খুশিতে কথা বলতে পারছে না। শরীর তার কাঁপছে। সে আরাবকে জড়িয়ে ধরল। পরক্ষণেই তার মনে হলো আরাব তো চোখে দেখতে পারে না। তাহলে রেজাল্ট কীভাবে দেখল! সে আরাবকে ছেড়ে আরাবের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
“আপনি তো চোখে দেখতে পারেন না। তাহলে এখন কীভাবে দেখছেন? আপনি কী ঠিক হয়ে গেছেন?”
আরাব আমতা আমতা করতে লাগল। আয়েশাকে ধরে উত্তর দিল
“আমি এতদিন অন্ধের অভিনয় করেছি। যেদিন তোমার গালটা পুড়ে গিয়েছিল সেদিনেই আমি তোমাকে দেখতে পেয়েছিলাম। তবে তোমার মনোবল ভেঙে পড়বে বলে মিথ্যা বলেছিলাম। কারণ তোমার ধারণা ছিল তোমাকে দেখে আমি মুখ ফিরিয়ে নিব। কিন্তু আয়েশা আমি তোমার মনটাকে ভালোবেসেছি, আত্মাকে ভালোবেসেছি, তোমার রুপ, যৌবনকে না। আর সেজন্যই এত বড়ো নাটক করা যাতে তোমার ভেতরে অনিশ্চয়তা না থাকে।”
আয়েশা কেঁদে দিল আরাবের কথায়। এত সুখ তার জীবনে ঢলে পড়বে কে জানত। সে শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল সে যেন এভাবে আজীবন সুখে থাকতে পারে।
স্রোতসীনি নদীর মতো সময় পার হচ্ছে। আয়েশার চেহারা একটা সার্জারির পর ঠিক হয়ে গিয়েছে। আয়েশা ঢাকা মেডিকেলের ইন্টার্ণ ডাক্তার এখন। সে সাথে আরাবের সন্তানের মা হতে চলেছে। তার গর্ভে সাত মাসের সন্তান। কিছুদিন পড়েই তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। সুখের সাগর পাড়ি দিয়েই সে এ পর্যন্ত এসেছে। তার জবীনের সকল সুখ সৃষ্টি কর্তা তার অপার মায়ায় ঢেলে দিয়েছিল।
আয়েশা বাসায় এসে আরাবের রুমে ঢুকলো।।আরাবের মাথায় কাঁচা পাকা চুল। লোকটা ভীষণ বুড়া হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সময় তাকে অনেক দুর্বল করে দিয়েছে। বয়সের একটা ছাপও পড়ে গেছে। আরাব আয়েশাকে দেখে জিজ্ঞেস করল
“কী দেখছো?”
আয়েশা হেসে বলল
“তোমাকে।”
আরাব মুচকি হেসে উত্তর দিল
“বুড়ো মানুষকে দেখতে ভালো লাগে?”
আয়েশা অট্ট হাসলো। হাসির রেশ টেনেই বলল
“তুমি বুড়ো হলে তো আমিও বুড়ি। বুড়োর স্ত্রী তো বুড়িই হয় তাই না। কয়েকদিন পর বাবা হবে এরপর নাতি নাতনি হবে। জোয়ান আর রইলাম কই।”
আরাব হাসতে হাসতে বলল
“তুমি তো জোয়ানেই আছো। আমিই বুড়িয়ে গেলাম। আমার বাচ্চা আমাকে বাবা না বলে দাদা না ডেকে বসে। পাকা চুল দেখে তো তার এমনই মনে হতে পারে।”
আয়েশা হাসলো। জোরে জোরে হাসলো। আরাবকে ধরে সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
“সৃষ্টিকর্তা তোমায় অনেকদিন হায়াত দিয়ে আমাদের পাশে ছায়া হওয়ার সুযোগ দিক সে দোয়ায় করি।”
সময় পেরিয়ে আয়েশার একটা ফুটফুটে ছেলে হলো। ছেলের নাম আরাবের সাথে মিল রেখে রাখা হলো আবরার। ছেলেটা বড়ো হতে লাগল। আয়েশাও এগিয়ে যেতে লাগল নিজের লক্ষ্যে। আজকে আয়েশা একজন বড়ো গাইনোকলোজিস্ট। আর আয়েশার ছেলেও ক্লাস টুতে পড়ে।
প্রতিদিনকার মতোই আয়েশা আসলো। ছেলেকে ঘুম পারিয়ে আরাবের কাছে আসলো। আরাব অনেকটা অসুস্থ হয়ে আছে। ঠিক মতো চলাফেরা করতে পারে না। আয়েশাকে দেখে আরাব পাশে বসিয়ে তাকে বলল
“মনে হচ্ছে আমি বেশিদিন বাঁচব না। আমি মরে গেলে তুমি আরেকটা বিয়ে করে নিও। তোমার বয়স এখনও তেমন হয়নি।”
আয়েশা আরাবের পাশে শুয়ে তার বুকে মাথা রেখে বলল
“তোমাকে হারিয়ে হয়তো আমি করুণ যন্ত্রণায় ভুগব। আমার আগে তুমি গেলে সে বিষাদময়তায় তোমাকে কেবল আমার জীবনের বিষাদের বেহালার সুর করেই স্মৃতিতে রাখব। সে স্মৃতিতে আর কেউ থাকবে না। কেউ আসবে না। আমার জীবনের সুর তুমি। তুমি চলে গেল সে সুর কেবল করুণ হয়ে বেহলার সুরে রুপান্তরিত হবে।”
কথা গুলো বলে আয়েশা আরাবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আরাবও আয়েশাকে শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল।
আয়েশা মনে মনে বললো প্রতিটা ক্ষণ বিষাদময় বেহালার সুর আমার কানে বাজে শুধুমাত্র তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু এটাই প্রার্থনা তোমাকে যেন আমার জীবনের সুর করে রাখে। সে সুর যেন রুপান্তরিত না হয় বিষাদময় #বেহলার সুরে।
সমাপ্ত।