#বৈরী_বসন্ত ৮
লেখা – আয্যাহ সূচনা
বিচিত্র অনুভবের সাগরে ভাসছে। ভাসতে ভাসতে কোন কূলে গিয়ে ঠেকবে জানা নেই। নাকি ভাসমান রয়ে যাবে? অকস্মাৎ দৃষ্টিভঙ্গির এরূপ পরির্বতন কেন? সহানুভূতি? মায়া? নাকি অন্য কিছু এর নাম? আরিভ দোটানায় ভুগতে শুরু করেছে। আগে কখনও এমন স্তব্ধতা কোনো রাতেই তার মধ্যে বিরাজ করেনি। সেতো গভীর নিদ্রায় মত্ত থাকতো। নিশ্চিন্তে; নির্বিঘ্নে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। বিগত দুটো রাত্রীর প্রহরে নিদ্রা উবে যায়। কি যেন ভাবে, সবটা এলোমেলো। অপ্রিয় মানুষের ছবি দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কখনও বিরক্ত লাগে আবার কখনও ভালো। রাত পাড় হয় ঘন ঘন ফেলা দীর্ঘশ্বাসে।
কাল আবার দেখা হবে। আবার নতুনভাবে তর্ক হবে। নতুন পোশাক, নতুন রূপে। আরিভ পুনরায় সেই দিনের স্মৃতিচারণ ঘটাবে রাতে। স্থির থাকতে পারবে না। এসবের সঠিক কোনো জবাবও পাবে না।
ছবিটি চার পাঁচবার দেখে ফোন পাশে রেখে চোখ বুঁজলো। নিজের উদ্দেশ্যেই বলে উঠল,
-“ভালো লাগেনা।”
চোখ লেগে আসতেই স্বপ্নে এল নাফিয়া। আরিভ সেখানে অর্ধ ঘুমে। পাশে বসল, আচমকাই চুলের গভীরে হাত ডুবিয়ে বিলি কেটে দিতে শুরু করল। কিন্তু কিছু বলল না। আরিভ এই নীরবতা মেনে না নিতে পেরে মৃদু গলায় ডেকে বলে,
-“কথা বলো।”
নাফিয়া শান্ত সুরে শুধায়,
-“কী বলব?”
-“তোমার যা ইচ্ছে…”
-“কোনো ইচ্ছে নেই।”
-“তুমি আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছ যে?”
-“আপাতত এটাই ইচ্ছে।”
-“এইতো বললে কোনো ইচ্ছে নেই।”
-“হুট করেই উদয় হলো।”
আবেশে চোখ বুঁজে আরিভ। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। নিভু নিভু স্বরে বলে,
-“তবে এই ইচ্ছেটা আমার ভীষন ভালো লাগছে।”
হুট করেই নাফিয়ার কোলে মাথা রাখল আরিভ। এটা তার অবচেতন মনের ইচ্ছে। মন হুট করেই চাইল, আর সেটার পূর্ণতা দিল সঙ্গে-সঙ্গে। নাফিয়া কিছুই বলেনি। বরং হালকা কোকড়ানো চুলগুলো টেনে দিচ্ছে। আরিভ জানে এটা স্বপ্ন, এখানে যা হচ্ছে সবটাই কল্পনা।
নাফিয়ার অনুভূতিহীন হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। প্রশ্ন করে গভীর কন্ঠে,
-“তুমি কী এই হাতে আমার স্পর্শ অনুভব করতে পারছ?”
নাফিয়া সরাসরি জবাব দেয়, -“নাহ।”
আরিভ নাফিয়ার হাতটা টেনে নিজের গালে রাখল। প্রশ্ন করল,
-“এবার?”
-“নাহ।”
আরিভ হতাশ হয়ে যায়। ইচ্ছে দ্বিগুণ হল। এবার হাত টেনে রাখল বুকের বা পার্শ্বে। শীতল কন্ঠে শুধায়,
-“এখন?”
নাফিয়া দুদিকে মাথা দোলায়। ছোট্ট করে বলে,
-“উহু।”
হৃদপিণ্ডের বেগতিক গতিটুকু অব্দি শুনল না, বুঝল না, উপলব্ধি করল না। অসহায় লাগল আরিভের। কাছে বসে তার অগোছালো অনুভূতিগুলো বুঝাতে পারছে না। ইচ্ছেগুলো দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ হয়। হাতের তালুতে রুক্ষ ঠোঁটের ছোঁয়া দিল। ফের বলল,
-“এবারও পারছ না নিশ্চয়ই।”
নাফিয়া অনুভব করতে পারেনি। তবে দেখেছে। দৃষ্টি হয়ে হৃদয় অব্দি গেল ছোঁয়াটুকু। কেমন যেন লাগল তার। হুট করেই উঠে গেল মেয়েটি। আরিভের মাথা বিছানায় পড়ে গেল। উঠে বসে আরিভ। নাফিয়া বলল,
-“আজ আসি।”
আরিভ ব্যাকুল গলায় শুধায়,
-“কাল আসবে?”
-“আপনি এমন অদ্ভুত ব্যবহার না করলে আসব।”
-“আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে কী করব?”
-“দমিয়ে নিবেন নিজেকে।”
কখন সকাল হয়েছে তার হদিস নেই। কিন্তু যান্ত্রিক এলার্মটা তার সময়মতো বাজতে ভুল করল না। ঠিক নয়টায় বেজে উঠেছে। আরিভ লালাভ চোখজোড়া খুলে তাকায়। সুন্দর স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে এতেই।
আরিভ উঠে বসে চুল খামচে ধরলো। এসব স্বপ্ন না দেখলেই নয়! বেশি বেশি এগিয়ে গেছে কল্পনার মাঝেই।
গোসল, নাস্তা সেরে বেরিয়েছে বাইক নিয়ে। গলির মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নাফিয়া কি আসবে? এই প্রশ্ন মনে আসতে না আসতেই দূর হতে দেখল সবুজ রঙের কুর্তি পড়ে এগিয়ে আসছে নাফিয়া। স্বপ্নে ঠিক এই রংটাই দেখেছিল সে।
নাফিয়া এড়িয়ে যেতে লাগল আরিভকে। আরিভ বাইক সামনে টেনে বলল,
-“ঢং করবে না। বাইকে উঠো।”
নাফিয়া শুনল না। যেন কেউ কিছু বলেই নি। হেঁটে যেতে লাগল। আরিভের কপালে ভাঁজ পড়ে বিরক্তিতে। বাইক এনে দাঁড় করালো নাফিয়ার সামনে। পথ আটকে বলল,
-“এতক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছি ভালো লাগেনা?”
-“আপনাকে কী আমি বলেছি অপেক্ষা করতে?”
আরিভ ধমকের সুরে বলল, -“বাইকে উঠো।”
-“আপনি এমন করছেন কেন বলুনতো! ভালো লাগেনা আমার এত জোরজবরদস্তি।”
আরিভ নাফিয়ার দিকে তাকাল। হুট করেই মনে পড়ল স্বপ্নটার কথা। নির্লজ্জের মত চুমু খেয়ে তার হাতে। এটা যদি নাফি জেনে যায়? দেহে অদ্ভুত শিরশির অনুভূত হল। তেজি চোখে চেয়ে আছে নাফিয়া। আজ সম্পূর্ণ বিরক্তি প্রকাশ করেছে। আরিভ ঝড়ো নিঃশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইল।
-“এটা রাস্তা, আর কিছুই বলবো না। বাকিটা বুঝে নাও।”
-“জোর খাটাচ্ছেন? কিন্তু কেন বলুনতো?”
আরিভ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল, -“ইচ্ছা আমার।”
নাফিয়া হার মেনেছে। উঠে বসল বাইকে। আরিভ আলগোছে মুচকি হাসে। নাফিয়া পেছন থেকে বলল,
-“আজই শেষ।”
-“শুরু।”
-“আপনি একটা খারাপ মানুষ।”
-“ভালো।”
-“উফ!”
নাফিয়ার কথার গুরুত্ব না দিয়েই বাইক চলতে শুরু করল। মাঝ রাস্তায় গিয়ে প্রশ্ন করল আরিভ,
-“বাইকের ভয় কেটেছে তোমার?”
-“একটু একটু।”
-“পুরো কেটে যাবে আমার সাথে প্রতিদিন যাতায়াত করলে।”
নাফিয়া কিয়ৎক্ষণ চুপ রইল। আরিভ এর চোখ কখনও সামনে কখনও লুকিং গ্লাসে। এই দৃষ্টি আবার নাফিয়ার দৃষ্টিগোচর হয়েছে খুব ভালোভাবেই। মেয়েদের মধ্যে ভিন্ন রকম শক্তি থাকে। তার দৃষ্টি পরীক্ষা করতে জানে। কোন দৃষ্টি কেমন? আরিভের দৃষ্টি তার আচরণের চেয়ে বিপরীত দেখাল। নাফিয়া প্রশ্ন করে বসল,
-“আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন বারবার?”
আরিভ বিব্রতবোধ করে। কিন্তু বুঝতে দিল না নাফিয়াকে। বলল,
-“আমারতো বয়ে গেছে তোমাকে দেখব! আমি লুকিং গ্লাসে পেছনের গাড়িগুলো দেখছিলাম।”
-“ওহ আচ্ছা। আমি ভাবলাম ত্যাড়া চোখে আমার দিকেই দেখছেন।”
-“তুমি কী আসমান ভেদ করে নেমে আসা পরী?”
-“পরী হবার শখ নেই আমার।”
-“হতেও পারবে না।”
নাফিয়া ভেংচি কাটল লুকিং গ্লাসের দিকে চেয়ে। আরিভ লক্ষ্য করেছে বিষয়টা। কিছু বলেনি। সেতো সত্যিই নাফিয়াকে দেখছিল। খোলা আকাশের নীচে মিথ্যে কথা বলে নিজের ইমেজ পরিষ্কার করতে।
ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছে গেল ঠিক সময়েই। আরিভ কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই নাফিয়া হাত তুলে থামিয়ে দিল তাকে। বলল,
-“জানি কি বলবেন। আমি যেন ক্যাম্পাস ছুটির পর আপনার সাথেই যাই, তাইতো?”
আরিভ হেসে ফেলে। বলে, – “হ্যাঁ।”
-“আপনার অফিসতো সন্ধ্যায় শেষ হয় আর আমার ক্লাস বিকেলে। সেই হিসাব করে এসেছেন বাসা থেকে?”
-“জি করে এসেছি। লাঞ্চ ব্রেকে বেরোব।”
-“ওমা! আপনি আমাকে নিয়ে আবার বাড়ি যাবেন, সেখান থেকে আবার অফিস, আবার সন্ধ্যায় বাড়ি আসবেন। এটা কেমন হলো?”
-“তোমাকে মাথামোটা আমি কেন ডাকি জানো?”
-“কেন?” মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করে নাফিয়া।
-“আজ কি বার?”
-“কী জানি, জানিনা তো।”
-“আজ বৃহস্পতিবার বলদ মেয়ে। হাফ ডে আমার।”
নাফিয়া ঠোঁট গোল করে বলল, -“ওওওও”
-“যাও এবার।”
নাফিয়া চলে গেল। ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। প্রতিদিন পিক এন্ড ড্রপ সার্ভিস নিজ ইচ্ছায় দিচ্ছে। এতে আবার ধন্যবাদ দেওয়ার কি হল?
আরিভ তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। দরজা ভেদ করে একেবারে বিলীন না হওয়া অব্দি চেয়ে ছিল। স্বপ্নটা আবারও মস্তিষ্কে হানা দিল। ঠোঁট চেপে নিল আরিভ। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট করে।
_______
দাদী ব্যাগপত্র গুছিয়েছেন। বাবার সাথে তুমুল ঝগড়া বেঁধেছে আজ। সে কেঁদে কেটে নাজেহাল অবস্থা। থাকবেন না কিছুতেই। সিদ্দিক সাহেব খুব সাবলীলভাবেই বলেছিলেন মাকে কিছুদিন গ্রামে গিয়ে থেকে আসার জন্য। তিনিও সাথে যাবেন বলেছিলেন। সেই কথার ভুলভাল অর্থ দাঁড় করেছেন জমিলা বেগম। এই রাতে ব্যাগ গুছিয়ে হাজির। কান্না করে চলেছেন। বলছেন,
-“আমার পোলা আর আমার নাই। বউয়ের গোলাম হইয়া গেছে। আমার মত বুড়িরে ঘর থিকা বাইর কইরা দিতাছে। এই পোলা জন্ম দিলাম আমি! ছিঃ ছিঃ। ধিক্কার!”
রেশমা বেগম এগিয়ে এসে বললেন, – “আম্মা, নাফির বাবা আপনাকে একেবারের জন্য যেতে বলেননি। জসিম চাচা অসুস্থ, আপনাকে দেখতে চাইছেন। তাই আরকি।”
-“হ হ আমি সবই বুঝি। আমি কী তোমার মাইয়ার খারাপ চাই? বিয়া দিতে চাইছি বইলা মিথ্যা কইয়া আমারে আমার পোলার কাছে খারাপ বানাইলা। আমি থাকমু না এদিকে। সামনে কোনো বৃদ্ধাশ্রম থাকলে ওদিকে চইলা যামু।”
-“আপনার কোথাও যাওয়া লাগবে না আম্মা। আমাদের সাথেই থাকুন।”
আঁচল দিয়ে মুখ মুছে জমিলা বেগম বলেন, – “তুই হইলি সব নষ্টের গোড়া। আমার পোলারে জাদুটোনা কইরা নিজের বশে রাখসোস। এখন আমার পোলা আমারে দেখতে পারেনা।”
সিদ্দিক সাহেব পেছনে হাত বেঁধে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। মায়ের কান্নাকাটি দেখছেন অথচ একটা কথা বলছেন না। রেশমা বেগম তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি রেশমা বেগমকে থামিয়ে দেন। বলেন,
-“আম্মা আপনি গ্রামে যাবেন। আমিও যাব আপনার সাথে। জসিম চাচাকে দেখে এক সপ্তাহে ফিরে আসব। এটা আপনার বাড়ি। কেউ আপনাকে বের করে দিচ্ছে না।”
-“চুপ থাক তুই সিদ্দিক। তোর আসল রূপ আমি দেইখা ফেলছি। আমারে যাইতে দে।”
সিদ্দিক সাহেবের ভাবমূর্তিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং তিনি একইভাবে আছেন। শান্ত গলায় বললেন,
-“ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন।”
চেঁচামেচি থামল না জমিলা বেগমের। সে বসে রইলেন ব্যাগ নিয়ে দরজার দ্বারে। তখনই কলিং বেল বাজে। সিদ্দিক সাহেব এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলে দেখলেন আরিভ, সাদিফ আর জোহান দাঁড়িয়ে।
জোহান বলল, – “আসসালামু আলাইকুম আংকেল।”
-“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
-“আংকেল ছাদের চাবি দেওয়া যাবে? আসলে আজ নাফির জন্মদিন। আমরা ছাদে বার্বিকিউ করব।”
জোহান বলল, – “দেখুন আরিভ ভাই কেকও এনেছে তার জন্য।”
বলেই জ্বিভ কাটল জোহান। আরিভ বারণ করেছিল এটি বলতে। নিজের ভুল উপলব্ধি করতে না করতেই শব্দহীন ঘুষি পড়েছে জোহানের পিঠে। আরিভ বোকা হেসে দাঁড়িয়ে আছে। সিদ্দিক সাহেব হাসলেন। ঘর থেকে চাবি এনে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“এই নাও। বেশি রাত করো না।”
-“জি আংকেল।”
সাদিফ বলল, -“আংকেল আপনারাও আসুন।”
-“না না। বাচ্চাদের মধ্যে আমরা কি করব? আমি নাফিকে পাঠাচ্ছি। আর খেয়াল রেখ আজকের দিনে যেন আমার মেয়ের মন খারাপ না হয়।”
জোহান বলল, -“এটা আরিভ ভাইকে বোঝান। উনি শুধু ঝগড়া করে নাফি আপুর সাথে।”
পরপর আরও একটা কিল পড়ল পিঠে। হাড্ডি বোধহয় দুয়েকটা ভেঙে গেছে। চ্যাপ্টা মুখ নিয়ে ছাদে চলে গেল তারা তিনজনই।
নাফিয়া জানে না ছাদে কী হচ্ছে। টুকটাক হাঁটাহাঁটির আওয়াজ পাচ্ছে। বাবা মাত্র বলেছে জোহান সাদিফ তাকে ডেকেছে ছাদে। সিদ্দিক সাহেবদের পরিবারের সাথে সাদিফ জোহান এর পরিবারের সম্পর্ক খুব ভালো। এরা তিনজন একই সাথে বেড়ে উঠেছে। তাই মেয়ের ব্যাপারে এই দুজনকেই বিশ্বাস করেন একমাত্র। আরিভের মধ্যে খারাপ কিছু দেখেনি তারা। প্রয়োজন হলে দেখে আসবেন এই চিন্তায় মেয়েকে পাঠালেন উপরে।
নাফি ছাদে পা রাখতেই দেখল আগুন জ্বালানোর জন্য তোড়জোড় চলছে। মধ্যে আরিভ জোহানের মাথায় চাপড় দিয়ে নিজে দায়িত্ব নিল। বলল,
-“তোদের দ্বারা কিচ্ছু সম্ভব না।”
নাফিয়া এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল,
-“কী হচ্ছে এখানে?”
আরিভ ঘুরে তাকায়। মুখে আসন্ন হাসিটা গিলে ফেলল। বলল,
-“চোখ নেই নাকি? দেখছ না আগুন জ্বালাচ্ছি।”
-“সেটা তো দেখছি, কিন্তু কী উপলক্ষে?”
-“তোমার বিয়ে। সেই উপলক্ষে।”
নাফি ঠোঁট কামড়ে হাসল। দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। বলল,
-“তা আমার বর কোথায়? তাকে ডাকুন।”
সাদিফ জোহান হাসছে। আরিভ বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে তাকাল। ফের নিজের কাজে মনোযোগী হল। বলল,
-“তোমাদের ছাদে জ্বিন আছে শুনেছি। তার সাথেই তোমার বিয়ের আয়োজন হচ্ছে।”
-“জ্বিন হলেও চলবে আমার।”
জোহান বলল, -“তুমি বিয়ের জন্য উতলা হলে কেন নাফি আপু?”
-“আঠারো পেরোলাম। এখনই বয়স বিয়ের।”
অতঃপর আগুন জ্বালাতে সক্ষম হল। এই আগুনের সাথে সাথে নাফিয়ার কথায় গায়েও আগুন ধরছে। আরিভ হাত ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে গেল নাফিয়ার দিকে। বলল,
-“খুব শখ না বিয়ে করার?”
-“হ্যাঁ।”
কাটকাট জবাব দিল নাফিয়া। চোখে মুখে কোনো ভয় নেই, বিয়ে নিয়ে কোনো সংকোচও নেই। হ্যাঁ বোধক উত্তর শুনে মুখ শক্ত করেই সরে গেল আরিভ। বিরক্ত হচ্ছে। কার জন্য এসব আয়োজন করল? সে তো অন্য কাউকে এক লাফে বিয়ে করতে রাজি।
আরিভ চেয়ারে গিয়ে বসতে চাইলেই নাফিয়া দৌঁড় লাগায়। আরিভের আগে গিয়ে নিজে বসে পড়ে। বলে,
-“আপনি মাটিতে বসুন।”
-“সর এখান থেকে। বসবো আমি।”
-“ না হবেনা। আজ আমার জন্মদিন। আমি স্পেশাল ট্রিটমেন্ট পাব।”
-“এমন মার মারব একেবারে হাসপাতালে গিয়ে ট্রিটমেন্ট নিতে হবে।”
-“এই আপনার সাহস তো কম না। আমাদের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকেই হুমকি দিচ্ছেন। ছাদ থেকে ফেলে দিব, নিজের বাড়ির ব্যালকনিতে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকবেন।”
-“নাফির বাচ্চা!”
-“ছিঃ ছিঃ কী বলেন এসব? আমার বিয়েই হলো না বাচ্চা আসবে কী করে?”
নাফিয়ার এই রূপটি আগে চোখে পড়েনি। সুযোগ হয়নি দেখার। খিল খিল করে হেসে উল্টোপাল্টা বকে যাচ্ছে। সামান্য লজ্জাটুকু পাচ্ছে না। আরিভ কোমরে দুহাত রেখে কটমট করে চেয়ে রইল তার দিকে। বিনিময়ে দাঁত দেখানো পৈশাচিক হাসি পেয়েছে নাফিয়ার তরফ থেকে।
-“আমি তোমার দাদীকে বিষয়টা জানিয়ে আসি। নাতনি বড় হয়েছে, বিয়ে করতে চায়, আবার বাচ্চাও চায়। কোনো অঘটন ঘটানোর আগে তোমার বিয়ে দেওয়া দরকার।”
আরিভ মিছেমিছি এগিয়ে গেল সিঁড়িঘরের দিকে। নাফিয়ার চক্ষুযুগল বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়। দৌঁড়ে গিয়ে কোনো উপায় না পেয়ে পেছন আরিভের টিশার্ট টেনে ধরল। আকুতি জানিয়ে বলল,
-“দাদীকে বলবেন না, প্লীজ। আমি দুষ্টুমি করছিলাম।”
আরিভ ঠোঁট টিপে হাসে। নাফিয়াকে আরও ভড়কে দিতে একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল। নাফিয়া পেছনে হটে গেল। চোখ নামায় সঙ্গে সঙ্গে। আরিভের অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছে আর চঞ্চল হাত নাফিয়ার গাল টিপে দেয়। বলে,
-“এখন বিয়ে আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভাববার বয়স না, তবে হ্যাঁ নতুন প্রেমে মজবার বয়স হয়েছে ঠিকই।”
নাফিয়া মুখ তুলে জবাব দেয়, – “প্রেম ভালো না।”
-“কে বলেছে তোমাকে?”
-“সবাই বলে। নয়ত বাবা, মায়েরা কেন ছেলে মেয়েদের প্রেম ভালোবাসা থেকে দূরে রাখতে চায়? কেন বাজে চোখে দেখে?”
-“পয়েন্ট!”
-“দেখেছেন। তাই বললাম প্রেম ভালো না।”
-“যদি ভুলেভালে প্রেমে পড়ে যাও?”
-“তাহলে বিয়ে করে ফেলব।”
-“কাকে?”
-“যার প্রেমে পড়ব তাকেই।”
নাফিয়ার কন্ঠ স্পষ্ট। সোজাসাপ্টা উত্তর দিচ্ছে। সাহসী নারীর মতই। আরিভ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
-“তাহলে প্রেম আগে নাকি বিয়ে?”
-“সেটা আমি কী করে বলব?”
-“আইডিয়া করতেই পারো।”
-“আপনি কেন জানতে চাইছেন?”
আরিভ ঝড়ের বেগে নিঃশ্বাস ফেলে। ঝাপটা এসে পড়ল নাফিয়ার মুখে। হুট করেই কেঁপে উঠল সে। এভাবে কেউ নিঃশ্বাস ফেলে? মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল নাফিয়া। আরিভ তার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
-“প্রেম আগে, তারপর বিয়ে, তারপর বাকিটা বুঝে নাও।”
চলবে…