বৈরী বসন্ত পর্ব-০৯

0
2

#বৈরী_বসন্ত ৯
লেখা – আয্যাহ সূচনা

ধোঁয়া উঁড়ছে ছাদ জুড়ে। নাফিয়া গালে হাত রেখে দেখছে আরিভকে। তাকে নয় তার কাজ করার নিপুণ হাতজোড়াকে। মুরগির মাংস ভালোভাবে ধুয়ে, কেটে ম্যারিনেট করল। এরপর সেগুলো কয়লার উপর দিল স্টিকের সাহায্যে। ধোঁয়ায় কাশতে কাশতে নাজেহাল অবস্থা। চোখ লাল হয়ে গেছে আরিভের। মশলা মাখা হাত ভালোভাবে ধুয়ে সরে গেল সেখান থেকে। হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। হাঁচি দিতে দিতেই নাফিয়ার পাশে রেলিংয়ের সাথে ঘেঁষে দাঁড়ায়। নাফিয়ার মায়া হল।

বলল, – “ এই আপনাকে রুমাল এনে দিব?”

নাফিয়ার এমন কথায় কিছুটা চমকে গেল আরিভ। নাক টানতে টানতে বলল,

-“হুট করে দরদ দেখাচ্ছ? মতলব কী?”

-“মতলব টতলব নেই কোনো। আমার জন্যই তো এসব আয়োজন। এত কষ্ট করছেন, বিনিময়ে আমি একটু দয়া দেখাতেই পারি।”

-“জীবন ধন্য আমার। এবার যান, গিয়ে রুমাল ভিজিয়ে আনেন।”

নাফিয়া কথা শুনল। দৌঁড়ে গেল নিচে। নিজের রুমালটা আজই ধুয়ে রেখেছিল। দিবে কী দিবেনা? ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্তে এলো দিয়েই দিক। সে অন্য আরেকটা নিবে। রুমাল ভিজিয়ে ছাদে ফিরে আসে। ততক্ষণে সাদিফ জোহানের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। প্রথম পিসটা কার পেটে যাবে সেটা নিয়ে।

নাফিয়া আরিভের দিকে খেয়াল না দিয়েই রুমাল এগিয়ে দেয়। দুই ভাইয়ের ঝগড়ার দিকে তার বেশি মনোযোগ। জোহান বলছে,

-“টেস্ট কেমন হয়েছে সেটা দেখি। যদি কাঁচা রয়ে যায়?”

সাদিফ বলল, – “সেটা তোর দেখা লাগবে কেন? আমি দেখছি আমাকে দে।”

দুজনের মধ্যে তুমুল বিতর্ক। মধ্যে আরিভ গেল। হাত দিয়েই একটি চিকেন স্লাইস তুলে নিল দুজনের চক্ষু আড়াল করে। নাফিয়ার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

-“হা করো।”

-“হ্যাঁ?”

-“হ্যাঁ না হা।”

আরিভ নাফিয়ার মুখের সামনে তুলে ধরল। আপনাআপনি ঠোঁট ফাঁকা হয়ে যায় নাফিয়ার। টুপ করে চিকেন মুখে পুরে দিয়ে আরিভ সরে যায়। বলে,

-“যার টেস্ট করার সে করেছে। এবার তোরা থাম দয়া করে।”

সাদিফ, জোহান দুজনেই অবাক হয়ে চেয়ে আছে। কে টেস্ট করেছে? কখন? কীভাবে? প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। দুজনেই কাড়াকাড়ি করে নিতে এল। আরিভ দুজনকেই ধমকের সুরে বলে উঠে,

-“খবরদার যদি টাচ করেছিস! লোভ সামলানো যায় না, তাই না?”

জোহান বলল, -“আসলেই যায় না ভাই।”

-“এমন চড় দিব, লোভ ছাদ থেকে লাফিয়ে আ ত্মহ ত্যা করবে।”

নাফিয়া এখনও চিকেন চিবিয়ে যাচ্ছে। স্বাদ দারুন। বলল,

-“বাহ আপনি শুধু খাদকই নন ভালো শেফও বটে।”

আরিভ বুক ফুলিয়ে বলল, – “আমি রাঁধতেও জানি, খেতেও জানি। নট এ বিগ ডিল।”

সাদিফ বলল,- “তাহলে আপনি আমাদের ভাগের চিকেন নাফিকে দিয়েছেন? এটা অন্যায় ভাই!”

-“তোর অন্যায়ের গুষ্টির কিলাই। গিয়ে কোল্ড ড্রিংক নিয়ে আয়।”

হতাশ সাদিফ। আরিভের কাছে তার কোনো মান সম্মান নেই। সে আসার আগে তো খুব বড় ভাই সেজে ঘুরতো। এখন সেটাও পারেনা। বড় ভাইকে সঙ্গ দিতে জোহানও ছুটল।

দুজন চলে যেতেই আরিভ আরও কিছু চিকেন স্লাইস তুলে নিয়ে আসে। প্লেট নাফিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

-“বিচ্ছু দুটো আসার আগে খেয়ে নাও। পরে ভাগে পাবে না।”

নাফিয়া অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, -“বাব্বাহ! শত্রুর প্রতি এত মায়া দেখানো হচ্ছে যে? জ্বর টর আসেনি তো আবার?”

আরিভ প্লেট সরিয়ে ফেলল। বলল, -“ভালো কাজের দাম নেই দুনিয়াতে।”

-“আরেহ আরেহ! আমি তো মজা করছিলাম। দিন ক্ষিদে পেয়েছে আমার। আপনাদের এসব নাটক দেখতে দেখতে আজ রাতে খেলামও না।”

আরিভ প্লেটটি এগিয়ে দিল। ভালো করেই জানা আছে তার এসব ঢং। হুট করেই পাশে এসে বসল। নাফিয়া চমকে উঠে। দূরত্ব বেশি নয়। খোলা আকাশের নীচে দুজন স্বল্প দূরত্বে বসে আছে। আরিভের চোখ সরাসরি আকাশের দিকে। সেখানে মিটমিট করা তারাদের মধ্যমণি চাঁদ। সে প্রেমিক নয়, তাই চাঁদ নিয়ে কখনও কাব্য রচনা করা হয়নি। প্রেম এই দেহ, মন কখনোই ছুঁয়ে দেয়নি এই অব্দি।

আকাশের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নাফিয়ার দিকে তাকাল আরিভ। হুট করেই বলে উঠল,

-“মুরগির বাচ্চাদের মত খাচ্ছ কেন? এভাবে খেলে সারারাতও খাওয়া শেষ হবে না।”

-“আমি ধীরে ধীরে খাই। আপনার মত গপাগপ গিলতে জানি না।”

আরিভ জবাব দিল না। তাকিয়ে রইল। অল্পক্ষণ থেকে বেশকিছুক্ষণ অব্দি। এতটা সময় এক ধ্যানে চেয়ে থেকেও বিরক্ত লাগল না। যাকে দেখছে সে মনোযোগী তার খাবারে। চুলে বেণী করা সত্ত্বেও সামনের চুলগুলো বিরক্ত করছে তাকে। আরিভের মনে দারুন ইচ্ছে জাগলো। সরিয়ে দিক? কিন্তু এটা কি উচিৎ হবে? ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিল। বাম হাতে খেতে দেখে ক্ষণিকের জন্য অবাক হলেও পরপর মনে পড়ল নাফিয়ার ডান হাতের কথা।

ভারী সুরে বলল, – “বাম হাতে খেতে নেই।”

নাফিয়ার মুখ চুপসে গেল। হাতটাও থেমে গেল। সে কি জানে না তার ডান হাত অচল? আরিভ শুধায়,

-“বাড়িতে কে খাইয়ে দেয়?”

নাফিয়া মন খারাপের ভঙ্গিতে বলল, – “মা। আবার কখনও বাবাও দেয়।”

আরিভ খাবারের প্লেট নিজের হাতে নিল। নাফিয়ার দিকে ঘুরে বসল। নিজের হাতে তুলে এগিয়ে দিল। নাফিয়া কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই আরিভ কঠোর গলায় বলে,

-“চুপ! একদম চুপ! ওরা আসার আগে শেষ কর। খাইয়ে দিচ্ছি বিষয়টা ওরা ভালো চোখে দেখবে না।”

নাফিয়া মুখ খোলেনি। আরিভ চোখ রাঙিয়ে রাগী গলায় বলে উঠে,

-“হা করো নাফি!”

-“আপনি শুধু আমাকে ধমকান।”

নাফিয়ার কন্ঠে খানিক অভিমান। আরিভের কঠোর মুখমন্ডল শীতল হয়ে আসে। বাক্যটিতে বিশেষ কিছুই ছিল না। কিন্তু কথার ধাঁচ বুকে গিয়ে আঘাত করল সরাসরি।

আরিভ ধীর ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠে, -“সরি।”

-“আমি কী কানে বেশি শুনছি নাকি কম? আপনি আর সরি?”

আরিভ খাইয়ে দিতে দিতে বলল, – “বেশি কথা বলো।”

-“আচ্ছা বলুনতো আপনার কী হয়েছে? হুট করে আমার উপর মেহেরবান হচ্ছেন কেন? কিছু হয়েছে?”

-“একটা ছেলে, একটা মেয়ে হয়েছে। এবার খাও।”

-“ওহ আচ্ছা আপনার বাচ্চাকাচ্চাও আছে।”

-“জ্বালাচ্ছ কিন্তু।”

-“কই আমিতো আপনার গায়ে কোনো আগুন দেখছি না।”

আরিভ কিছুটা চেঁচিয়ে বলল, – “মনে আগুন লেগেছে, মনে।”

-“হায় হায় বলেন কী? এখন কি ফায়ার ব্রিগেড ডাকব?”

-“বাচাল মেয়ে চুপ করো!”

নাফিয়া ঠোঁট টিপে হাসে। এসব বাঁদরামি করতে করতেই খাওয়ার পর্ব শেষ। ঠোঁটের এক কোণে লেগে থাকা খাবার বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে দিল আরিভ। এযাত্রায় নাফিয়া কিছুটা বিব্রতবোধ করল। চোখ নামিয়ে নিল। কিছু সময় নীরবতা পালন করে নিজে থেকেই বলল,

-“আপনার মন গলছে কেন?”

আরিভ এক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, -“জানি না।”

-“আমার কিন্তু সহানুভূতির প্রয়োজন নেই। আমি মেনে নিয়েছি।”

-“সহানুভূতি নয়।”

নাফিয়া থমকায়। অবুঝ নয় সে। তবে চাইছে তার চিন্তা ভুল প্রমাণিত হোক। হুট করেই নিজের উপর বিরক্তি এলো। কীসব ভুলভাল ভাবছে!

আরিভ নিজে থেকেই শুধায়, -“জানতে চাইবে না?”

-“উহু।”

-“জানতে চেয়েও লাভ নেই। সেসব আমার বোধগম্যতারও বাহিরে।”

নাফিয়া চোখ তুলে তাকাল। বলল,- “কীসব?”

আরিভ চোখ বুঁজল। কিছুক্ষণ রইল সেভাবে, কিছু মিলি সেকেন্ড। এরপর চোখ খুলে বলল,

-“তোমার দুর্বলতা নিয়ে আমার সহানুভূতি কখনোই আসেনি নাফি।”

-“তাহলে?”

-“তুমি আজকাল আমার স্বপ্নে এসে আমাকে জ্বালাতন কর।”

-“সেটা আপনার ভাষ্যমতে বাস্তবেও করি। সেসবই হয়ত স্বপ্নেও দেখেন।”

-“উহু! কিছুটা ভিন্ন ধরনের জ্বালাতন।”

নাফিয়া উৎসুক গলায় জানতে চায়, – “কেমন?”

-“বাদ দাও।”

নাফিয়ার সামনে থেকে সরে গেল আরিভ। দূরে গিয়ে দাঁড়াল। এদিক ওদিক চেয়ে বলল,

– “বলদগুলো কোথায় গেল কে জানে? কোল্ড ড্রিংকস আনতে গিয়েছে নাকি ফ্যাক্টরিতে বানাতে গিয়েছে কে জানে।”

______

সেদিনের পর দুটো দিন আরিভের সাথে কোনো দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। নাফিয়া সচরাচর ক্যাম্পাসে যায় না অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কোনো ক্লাস, পরীক্ষা অথবা কাজ না থাকলে। তার জন্য একা চলাফেরা কষ্টসাধ্য।

আনমনে বারান্দায় বসে সামনের ব্যালকনির দিকে তাকাল। সেখানে থমথমে নীরবতা বিরাজ করছে। দরজা জানালা সবটাই বন্ধ। প্রতিদিন যার সাথে কথা না হলেও তর্কটুকু হতো সে লোক বিগত দুদিন যাবত উধাও। কোনো মেসেজও করেনি। বাইকের বিশ্রী আওয়াজও শোনা যায়নি।

নিজের ভাবনার উপর আশ্চর্যবোধ করল নাফিয়া। তাকে জানানোর কথা ছিল বোধহয়? তার কী একটা মেসেজ করে জিজ্ঞাসা করা উচিত? হ্যাঁ – না, উচিত- অনুচিত যত্তসব আজগুবি চিন্তা ভাবনার মাঝে ফোন হাতে নিল। নিজের মত করেই লিখল,

-“এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন?”

কয়েক মিনিট পেরোয়, এরপর কয়েক ঘন্টা। কোনো জবাব আসেনি। এবার আশ্চর্যের সীমা বাড়ল নাফিয়ার। অস্থির এদিক ওদিক হেলেদুলে বেড়ান লোকটি কিনা গায়েব?

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। সন্ধ্যা শেষে রাত। ক্লাসে যায় না কিন্তু মায়ের জন্য পড়া কামাই দিতে পারেনা নাফিয়া। ওই আগেকার মতই ধরে বেঁধে পড়তে বসান সন্ধ্যার পরপরই। আজ একাডেমিক বই শেষে গল্পের বই হাতে নিল নাফিয়া। ঘড়ি টিকটিক করে রাত বারোটায় এসে থেমেছে।

বিকট আওয়াজে ফোন বেজে উঠে। নাফিয়া আকস্মিক শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠল। বুকে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করে ফোন হাতে নেয়। আরিভ কল করেছে। ভ্রু জোড়া কপালে উঠে। রিসিভ করে,

-“পালাই নি। পালাবোও না।”

-“দুর্ভাগ্য আমার।”

-“তা মেসেজ করেছ কী আকার ইঙ্গিতে আমি কোথায় আছি সেটা জানতে? নাকি অন্য কোনো বিশেষ কারণ আছে?”

-“দুটোর মধ্যে একটাও কারণ না। শত্রু ময়দান ছেড়ে পালিয়েছে কিনা সেটা শিউর হতে মেসেজ করেছি।”

-“বেয়াদবের পাশাপাশি তুমি মিথ্যুক বটে।”

ধরা পড়ে গেল? নাকি এখনও আরিভের সামনে সম্মান বাঁচানোর কোনো উপায় আছে? সে যাই হোক। কিছুতেই স্বীকার করবে না নাফিয়া।

-“এই তুমি কী এনি হাও আমাকে মিস করছো?”

-“মোটেও না।” জোরালো গলায় বলল নাফিয়া।

-“এর মানে করছো। কিভাবে তড়াক করে জবাব দিলে। মানুষ মিথ্যে বলতে তাড়াহুড়ো করে।”

নাফিয়া জবাব দিল না। মিথ্যে ঢাকতে আবার মিথ্যে বলা লাগবে। তার চেয়ে চুপ থেকে নীরবে হার মেনে নেওয়া শ্রেয়। আরিভ ঝগড়ার মুড থেকে বেরিয়ে এল। শান্ত গলায় বলল,

-“গ্রামে এসেছি আর্জেন্ট কাজে। এখানে নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে। এখন আমি কোথায় জানো?”

-“কোথায়?”

-“হাইওয়ে রোডে। পুরো নির্জন রোড। টাওয়ার দেখে থামলাম একটু।”

-“আপনার ভয় করেনা?”

-“জি না।”

-“এক্ষুনি সেখান থেকে চলে যান। এসব জায়গা কত রিস্কি জানেন না?”

আরিভ ব্যাঙ্গ করে বলল, -“নাহ! আপনি না বললে জানতামই না।”

-“এখন জেনেছেন, আপনার ভটভটি নিয়ে ভাগেন জলদি।”

-“অর্ডার দিচ্ছেন নাকি রিকোয়েস্ট করছেন?”

আরিভের মুখে আপনি ডাক অদ্ভুত শোনায়। এত সম্মান তাকে মানাচ্ছে না। মানায়নি তবে শুনতে মন্দ লাগছে না। নাফিয়া বলল,

-“দুটোই।”

আরিভ হাসল। আসলেই বেরিয়ে যাওয়া উচিত এখান থেকে। জায়গাটা সেফ না। আরিভ বলল,

-“রওনা হচ্ছি। ফিরছি সকালেই আপনার জান ভাজা ভাজা করতে। অপেক্ষা করুন।”

-“ওকে সাবধানে ফিরবেন।”

কথাটি মুখ ফসকেই বেরিয়ে এলো। আরিভ ফোন আরও একবার কানে নিয়ে বলল,

-“কি বললে? আরেকবার বলো দেখি?”

-“বলেছি যেইভাবে ইচ্ছে ফিরেন।”

-“ফিরতেই হবে?”

প্রশ্নটি শুনে নাফিয়া কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। কীসব অলুক্ষণে কথাবার্তা। তার সাথে নাফিয়ার সম্পর্ক খারাপ হতে পারে কিন্তু ক্ষতি চাইবে না কখনোই।

-“কী হল?”

নাফিয়া খানিক রাগ দেখিয়ে বলল, – “যাত্রা পথে অশুভ কথা বলতে নেই। রাখছি।”

এক অজানা কারণে রাতে ঘুম হল না। নাফিয়া জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে বারান্দায়। বাইক জিনিসটা বড্ড ভয়ংকর। তার অতীত আর বর্তমানে আরিভের সাথে কথোপকথন তার মধ্যে লুকানো ভয়টাকে ফের জাগ্রত করে তুলেছে। রাত জাগার স্বভাব নেই নাফিয়ার। আজ প্রথমবার। চোখ ফুলে গেছে, সাথে মুখটাও। অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় আসছে বারবার। চেয়েও সরাতে পারছে না।

সেখানে বসে বসেই চোখ লেগে আসে নাফিয়ার। ঘুম কাঁচা। কানে বাইকের হর্ন শুনতে পেয়েছে কিন্তু মস্তিষ্ক সেটিকে প্রোসেস করতে পারছে না। হর্নের আওয়াজ বৃদ্ধি পেল। সাথে শিরীন বেগমের ‘ আসছি ’ আওয়াজে সম্পূর্ণ ঘুম ভেঙে যায়। নাফিয়া উঠে দাঁড়াল। বারান্দার গ্রীলে হাত রেখে নীচে তাকাল। আরিভ এসেছে। বাইক ভেতরে নিতে নিতে এক পলক তাকিয়েছে উপরে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরিভের অবাক মুখখানা দৃষ্টির আড়াল হয়নি।

আরিভ লাফিয়ে উপরে এল। কাপড় না বদলে সরাসরি ব্যালকনির দরজা খুলে এসে হাজির হয়। হয়রান গলায় প্রশ্ন করে,

-“তুমি এত সকালে এখানে কি করছ?”

নাফিয়ার ঘুম ঘুম ভাব কাটেনি। চোখের এক কোণে পানি জমে আছে জোর করে ঘুম থেকে জেগে উঠার ফলে। নাফিয়া কোনো জবাব দিতে পারল না নিদ্রার ভারে। মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

-“এই মেয়ে! এখানে কি করছ এত সকালে? ঘুমাওনি।”

নাফিয়া কোনো রকম মাথা দুদিকে দোলায়। অর্থাৎ সে ঘুমায়নি। আরিভ বিস্মিত হয়ে তাকায়। বলে,

-“সারারাত করেছো কী?”

বিরক্ত হল নাফিয়া। এমনিতে ঘুমে দুলছে, তার মাঝে এত প্রশ্ন। ভালো লাগছে না এসব। ত্যাড়া জবাব দিল,

-“মশা মেরেছি।”

-“তুমি সারারাত বারান্দায় ছিলে?”

-“হুম।”

-“আরেহ ভাই কিন্তু কেন?”

নাফিয়া দ্বিগুণ বিরক্ত হয়ে বলে,

-“আপনি জানেন না বাইকে ফোবিয়া আছে আমার। কেন বললেন তখন এই কথাটা? ওইসব অলুক্ষণে কথাবার্তা। আমার এসব শুনলেই ভয় হয়।”

এবার আরিভ মাথা ঘুরেই পরে যাবে। মেয়েটার মাথা পুরো গেছে। কিন্তু তার খুশি লাগছে, ভীষণ ভালো লাগছে শুনে। আরিভ বলল,

-“আচ্ছা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে তাহলে?”

-“ঘোড়ার ডিম! আমার ভয় করছিল। আপনার সাথে আমার শত্রুতার হিসেব আলাদা, তাই বলে আপনি বাইক নিয়ে টপকে যান সেটা আমি চাই না। আর বলবেন না এসব ফালতু কথা। আমার ঘুমটা নষ্ট করল অসভ্য লোক কোথাকার।”

আবোল তাবোল বকতে বকতে ঘরে চলে গেল নাফিয়া। আরিভের হাসি আসছে সাথে বিষম খেয়ে আছে। কোনটাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত? হাসি নাকি বিস্ময়কে? দুটো একসাথেই অনুভব হল। চুলে হাত ফিরিয়ে আরিভ একাকী বলে উঠল,

-“আমার জন্য অপেক্ষা… বাহ্!”

চলবে….