#বৈরী_বসন্ত ১৩
লেখা – আয্যাহ সূচনা
ভোর ছয়টায় রওনা হচ্ছে আরিভ। আজ বাইক নেয়নি। বাসে করেই যাবে। নাফিয়াকে আগেই জানিয়েছে তার রওনা হওয়ার সময়। নাফিয়ার চোখজোড়া ভোর পাঁচটা ত্রিশ মিনিটেই জেগে উঠে। ঘুম সম্পূর্ণ উবে গেছে। বারান্দার দিকে যাওয়ার এক প্রবল ইচ্ছে। কিন্তু লজ্জায় যেতে পারছে না। কী ভাববে আরিভ? তাকে বিদায় দেওয়ার জন্য সে জেগে? মান সম্মান কোনোটাই থাকবে না এমন হলে।
-“জেগে আছো জানি। একবার বারান্দায় আসবে, প্লীজ?”
মেসেজ পেয়ে নাফিয়ার চক্ষু চড়কগাছ। কী করে বুঝল? নাফিয়ার জড়তা দ্বিগুণ হল। যাবে? ভাবতে ভাবতে দু কদম এগিয়েছে বটে। ফের থেমে গেল।
-“আসবে নাফি? একবার দেখে যাই তোমায়।”
প্রশ্নটির জবাব না দিয়েই দ্রুত হাঁটল নাফিয়া। গায়ে ওড়না জড়িয়ে। পা গিয়ে থামে বারান্দায়। উঁকি দিল নীচে। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আরিভ আগে থেকেই উপরে চেয়ে আছে। নাফিয়াকে দেখে মলিন হাসল। আরিভের চেহারা ফোলা দেখাচ্ছে। ঘুম হয়নি হয়তো। চুলগুলো এলোমেলো। নাফিয়া ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি নত। আরিভও নির্বিকার দাঁড়িয়ে।
হুট করেই চোখাচোখি হয়। অসভ্যের মত ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। এবার বোধহয় নাফিয়ার হার্ট এ্যাটাক হয়েই যাবে। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। আরিভ বলল,
-“আসি, ভদ্র বাচ্চার মত ঘরেই থাকবে। যেকোনো দরকারে জোহান অথবা সাদিফকে ডাকবে। দুই ছাগলকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি।”
নাফিয়া ভদ্রভাবে মাথা দোলায়। মন খারাপেরা হুট করেই মনের মধ্যে ঝেঁকে বসছে। মুখশ্রীতে আঁধার ঘনায়। আরিভ যাচ্ছে, ঘুরে কয়েকবার পেছনে চেয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। খারাপ লাগা দুর্বলতা পরিণত হল নাফিয়ার। বসে পড়ল চেয়ারে। বিড়বিড় করল,
-“বাবাও দূরে, এখন আপনিও…”
নাফিয়া ঘরে এসে পেটে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ল। মুখ লুকালো হাতের আড়ালে। নিজেই বুঝতে পারছে না তার খারাপ লাগার কারণ। এক ঘন্টাওতো হল না। এখনই এই হাল? বাবাও জানিয়েছে কয়েকদিন দেরি করেই ফিরবেন। নাফিয়ার মস্তিষ্কটা সম্পূর্ণ জ্যাম হয়ে গেল। খুব করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুমটাও তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।
_____
“ তুই আর একটু আনমনে থাক
উড়ে যাক তোর কবিতা মাখা চুল।
এ শহরের হাজারো
বোকা প্রেমিকেরা তোর
ভাল চায়, বলে তাই
উপন্যাসের বন্যা দিয়ে মিছিল করে যায়।
আমি অলস তাই পিছে পড়ে রই।
দিশেহারা তুই
আর আমি মিলে দুই
আমার নীলাকাশ
ছিড়ে উড়ে গেলি তুই।
আমার বোকা অভিমান
তাসে হেরে যাওয়া দান
তোর পুরনো কাগজে
আমি মাথা গুজে শুই। ”
কী সুন্দর গান! কী সুন্দর কন্ঠ! গানটি আগেও শুনেছে নাফিয়া। তার প্লে লিস্ট বড়। কিন্তু এই গানটিকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পরপর তিনবার শুনল ভয়েস নোট। সর্বাঙ্গ শীতল হয়ে এল। গানের লাইনগুলো নিজের সাথেই মিলিয়ে নিল। লাজুক হাসল সাথেসাথে।
-“হাসছো নাকি লজ্জা পাচ্ছো?”
নাফিয়া সত্য স্বীকারোক্তি দেবার নয়। বলল,
-“ভীষণ বিরক্ত হচ্ছি। কী বাজে কন্ঠ!”
-“তোমার কন্ঠ কাকের মত জানো?”
ফুঁসে উঠল নাফিয়া। এই তার বদলে যাওয়া? এই তার পরিবর্তিত রূপ? বলল,
-“আসল রূপে ফিরে আসবেন জানতাম। এত দ্রুত আসবেন ভাবিনি।”
-“ওওও.. তাহলে এতদিন যে রূপে ছিলাম সেটা কী আপনার মনে ধরেছে?”
মনে ধরেছে মানে? জোর করে মনে সেট করার চিন্তাভাবনা, আচার আচরণ করে চলেছে। এই কথাটি বলতে চাইছে নাফিয়া। কিন্তু বলতে পারল না। বলল,
-“আপনার মত ইতর প্রজাতির প্রাণীকে মনে ধরবে? দিবা স্বপ্ন দেখেন নাকি?”
স্বপ্নের কথা বলতেই দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল আরিভের মাথায়। এবার তার স্বপ্নের কথা বলা যাক। দেখা যাক কী প্রতিক্রিয়া হয় নাফিয়ার।
-“খুব ভালো একটা কথা মনে করালে। সেদিন বলেছিলাম না তুমি আমাকে স্বপ্নে জ্বালাতন করো? বলব কী ধরনের জ্বালাতন?”
সন্দিহান মুখখানা নাফিয়ার। জানতে হবে অবশ্যই। বলে উঠল,
-“হুম বলুন শুনি।”
-“শাড়ি, চুড়ি পড়ে রাতে আমার স্বপ্নে আসো আমাকে সম্মোহিত করতে। রূপের আগুনে জ্বালানো পোড়ানো যাকে বলে। একটা সুন্দর ঘ্রাণ আসে তোমার কাছ থেকে। এসেই আমার পাশ ঘেঁষে বসে পড়ো। তারপর মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করো। কাবু করতে চাও আমাকে, এসব কী ঠিক নাফি? পর পুরুষকে এভাবে ছোঁয়া কী ভদ্র ঘরের মেয়েদের কাজ?”
কান গরম হয়ে গেল নাফিয়ার। মাথাটা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে। গালে লাল আভা ফুটে উঠেছে। আরিভ আবার বলল,
-“এভাবেই প্রতিদিন আমার কাছে এসে আমাকে বশ করেছ। আমি কত চাইলাম তোমার কাছ থেকে ছাড়া পাবার, কিন্তু সম্ভব হলো না। নিশ্চয়ই তুমি জাদুটোনার সাথে জড়িত। নয়ত তোমার মত একটা চন্ডাল আমার স্বপ্নে আসবে কেন?”
-“আপনার মুখটা আমি সেলাই করে দিব।”
রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে বলল নাফিয়া। আরিভ আরও বেগ পায়। বলে উঠে,
-“আমার কী দোষ? তুমি আমাকে নিজের জালে ফাঁসিয়ে দিলে। আমি কিন্তু ভালো ছেলে, ভীষণ রকমের লাজুক আমি। একটা মেয়ে এভাবে কাছে এসে হাসলে আমি কাচুমাচু হয়ে বসে থাকি।”
-“চুপ করুন!”
-“সত্যি বললেই দোষ তাই না? তুমি জাদুটোনা কার থেকে শিখেছ শুনি? নিশ্চয়ই ওই বুড়ির কাছ থেকে?”
-“আরিভ ভাই!”
ভাই শুনে আকাশ থেকে পড়ল। ধমকের সুরে শুধু আরিভ বলতে যাচ্ছিল। সুযোগ বুঝে ঝটপট ভাই যোগ করেছে। আরিভের মুখের নকশাই পাল্টে যায়। নড়েচড়ে বলে,
-“ভাই মানে? এই বেয়াদব মেয়ে? কীসের ভাই?”
এইতো সুযোগ। সব অসভ্যতামির শেষ এখানেই হবে। নাফিয়াও নড়েচড়ে বসল। বলল,
-“আপনি.. আপনিই তো ভাই। বড় ভাই, এলাকার ভাই।”
আরিভ এতক্ষণ যাবত নাফিয়াকে লজ্জা দিয়ে যাচ্ছিল, রাগাতে চাইছিল ইচ্ছে করে। এখন নিজেই রেগে যাচ্ছে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-“চড়িয়ে ভাইয়ের ভূত নামিয়ে দিব।”
-“বড় ভাই ভালোবেসে চড় দিলেও মাথা পেতে নিব ভাইয়া।”
-“নাফি! এটা সহ্য হচ্ছেনা।”
গুলি নিশানায় লেগেছে। একবিন্দু এদিক ওদিক হয়নি। পৈশাচিক আনন্দের শুরু সবে। পেয়েছে ব্যাটাকে হাতের মুঠোয়। এবার কোথায় যাবে?
-“কেনো ভাইয়া? কত আদুরে ডাক ‘ভাই’।”
-“আদুরে না ছাই! বন্ধ করো ভাই ডাকা।”
মিথ্যে অভিনয় শুরু করল নাফিয়া। কাঁদো গলায় বলল,
-“জানেন আমার একটা ভাইয়ের শখ ছিল, বড় ভাইয়ের। যে আমাকে চকলেট, আইসক্রিম কিনে খাওয়াবে। আবার ঘুরতেও নিয়ে যাবে, প্রতিদিন ক্যাম্পাসে নিয়ে যাবে। সব আপনি করেছেন। আপন রক্তের ভাই না হওয়া স্বত্বেও আমার জন্য এতটা করলেন। আপনার মাঝে আমি একজন বড় ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই আরিভ ভাইয়াআআআআ।”
শেষের ভাইয়াআআআআ ডাকটা পিত্তি জ্বালিয়ে দিল। মনে হল কেউ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছে, সাথে মরিচের গুড়োও যোগ করেছে। ছ্যাঁত করে উঠল আরিভ। বলল,
-“থামবে?”
-“কেনো ভাইয়া?”
-“ভাইয়া বানাচ্ছ এবার তোমার বাপকে বলো সম্পত্তির অর্ধেক লিখে দিতে।”
-“এত লোভী কেনো আপনি ভাইয়া?”
-“নাফি ভালো হচ্ছে না কিন্তু!”
-“কী করলে ভালো হবে ভাইয়া?”
-“চুমু খেলে ভালো হবে। আমি বাড়ি ফিরলে খেও কেমন? আমি একদম মাইন্ড করব না। বরং গাল পেতে দিব। ততক্ষণ ভাইয়ার মালা জপতে থাকো।”
যেন ফুটবল খেলছে। একবার বল আরিভের কাছে, আরেকবার নাফিয়ার কাছে। ‘চুমু’ শব্দটা শুনে নাফিয়া রুহ উড়ে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
-“অসভ্য, নির্লজ্জ লোক! আর একটা কথাও বলবেন না আপনি আমার সাথে।”
-“আরেহ খারাপ কী বললাম? ভাইয়াকে চুমু খাওয়া যায় না? আমিতো তোমার পাতানো ভাই।”
এখানে বেশিক্ষণ থাকলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে। এ্যাটাকও হয়ে যেতে পারে। নাফিয়া দ্রুত বেরিয়ে গেল ফেসবুক থেকে। ইন্টারনেট কানেকশন অফ করে দিল। পারলে লাইন কেটে দিত এই মুহূর্তে। কী ভয়ঙ্কর লোক! এসব কথা বলতে মুখে বাজল না? শিরশির করে উঠল নাফিয়ার শরীর। মাথায় পানি দিতে হবে এক্ষুনি। ধোঁয়া উড়ছে মাথা থেকে।
______
মায়ের সাথে বসে ‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রটি দেখছে নাফিয়া। তার আর কাজ কী? সারাটা দিন ঘরে থাকে। পড়ার জন্য তার আলাদা সময় আছে। সেটি সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। দিনের বেলা নাকি তার পড়া হয়না। সন্ধ্যায় এককাপ চা নিয়ে তবেই বসে। কখনও কখনও পরীক্ষা থাকলে বাধ্য হয়ে বসতে হয় দিনের বেলায়। আপাতত সেটি নেই। ভার্সিটি বন্ধ। দিন কাটে মায়ের আঁচল ধরেই। টুকটাক যাই পারে মাকে সাহায্য করে। অলস দিন পাড় হয় তার। ফোনের প্রতি আকর্ষণ আজ কিছুদিন যাবত। নয়ত সেটিও পড়ে থাকত অবলীলায়।
চুলে তেল দিয়ে দিতে দিতে রেশমা বেগম হুট করেই বলে উঠলেন,
-“চল গিয়ে আরিভের মায়ের সাথে দেখা করে আসি। শুনলাম আরিভ বাসায় নেই। উনি একা কী না কী করছেন? আমরা গেলে সঙ্গ পাবেন অন্তত।”
আরিভদের বাড়ির কথা শুনেই কেমন যেন লাগল। রেশমা বেগম শক্ত করে বেণী গেঁথে দিলেন চুলে। বললেন,
-“চল।”
মায়ের কথা অমান্য করেনি। খালি হাতে গেলেন না রেশমা বেগম। হাতে পায়েসের বাটি নিয়েছেন। আজ সকালেই রেঁধেছিলেন। মনের মাঝে কতশত ভাবনা নিয়েই আরিভদের বাড়ির চৌকাঠ বেয়ে ভেতরে গেল।
কলিং বেল চাপতেই দরজা খুললেন শিরীন বেগম। রেশমা বেগম ও নাফিয়াকে দেখেই হাসলেন। বললেন,
-“আরেহ আপনারা? আসুন আসুন।”
ভেতরে প্রবেশ করল তারা। আগে বাড়ির দরজা অব্দি আসা হলেও ভেতরে আসা হয়নি। পরিপাটি গোছানো ড্রয়িং রুম। ডান দিকে রান্নাঘর। সামনের দিকটায় পরপর তিনটে ঘর। নাফিয়ার মনে হুট করেই প্রশ্ন জাগলো, আরিভের ঘর কোনটা?
বাম দিকে খোলা বারান্দার। আর তাদের বাড়ির বারান্দা বরাবর পড়েছে সেই ঘরটা। অর্থাৎ এটাই মহাশয়ের ঘর।
শিরীন বেগম বলে উঠলেন,
– “এ বাড়িতে উঠার পর আপনারা একবারও আসেননি আমাদের বাড়িতে।”
রেশমা বেগম হেসে বললেন,
-“এভাবে কারো বাড়িতে যাওয়া কী উচিত আপা? এসব ভেবেই আসা হয়নি।”
-“আমরা তো প্রতিবেশী। নাফিয়া তুমি অন্তত আসতে পারতে জোহান আর সাদিফের সাথে।”
নাফিয়া ঠোঁট টিপে। কী জবাব দিবে? তার গুণধর পুত্রের সাথে তো তার দা কুমড়োর সম্পর্ক ছিল। কী উদ্দেশ্যে আসবে?
নাফিয়ার মস্তিষ্কে আরও একটি ভাবনা উদয় হল। আচ্ছা? আরিভ কী জানে সে এখন তাদের বাড়িতে উপস্থিত? কীসব অদ্ভুত চিন্তা! সে কী করে জানবে? কিন্তু জানালে কেমন হয়?
শিরীন বেগম ভাবনায় ছেদ ঘটান। বলেন, -“বাম পাশেরটা আমার ছেলের ঘর। আর ডান দিকেরটা আমার। মাঝের ঘরটা গেস্টদের জন্য রেখেছি।”
রেশমা বেগম বলেন, -“খুব সুন্দর হয়েছে বাড়িটা।”
চুপচাপ নাফিয়াকে বসে থাকতে দেখে শিরীন বেগম বললেন, -“নাফি তুমি বাড়ি ঘুরে দেখবে? একা আমাদের বুড়োদের আলাপে বিরক্ত হচ্ছ না তো?”
নাফিয়া বলল,- “না আন্টি আমি ঠিক আছি।”
-“তুমি বরং আশপাশ ঘুরে দেখো। আরিভ বাসায় নেই, তোমাকে জ্বালাবে না।”
জ্বালাবে না? জ্বালাচ্ছে সে। প্রতিনিয়ত জ্বালাচ্ছে। কাছে থাকলেও জ্বালায় দূরে থেকেও সেই একই কাজ করছে। শিরীন বেগমের অনুমতিতেই নাফিয়া উঠে এদিক ওদিক ঘুরে দেখল। সবার শেষে এসে দাঁড়াল আরিভের ঘরের দিকে। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। ঘরটা গোছানো। সাদা রঙের দেয়ালের সাথে ধূসর পর্দা বেশ মানিয়েছে। শান্ত শীতল একটা পরিবেশ এখানে। বিছানার পাশে গিটার রাখা, এর পাশেই একটি স্টাডি টেবিল। কিছু ফাইল আর অল্প সংখ্যক বই আছে। নাফিয়া ঘুরে ঘুরে দেখছে। ইচ্ছে হল ছুঁয়ে দেখতেও। প্রথমেই গিটার ছুঁয়ে দেয়। এরপর বইগুলো। সেখানে দেখা গেল একটি কলম এবং একটি নোটপ্যাড। দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল নাফিয়ার মাথায়। কলম নিয়ে নোটপ্যাডে লিখল,
“আপনি কী জানেন আপনি ভীষন রকমের একটা খারাপ লোক?”
পরের পৃষ্ঠায় লিখল,
“ইচ্ছে হচ্ছে পুরো ঘরটা এলোমেলো করে দেই। কিন্তু আন্টির কথা ভেবে করলাম না।”
তৃতীয় পাতায় লিখল,
“এত সুন্দর ঘরে এতো বাজে একটা মানুষ কীভাবে থাকতে পারে? আপনি আপনার রুমের সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিচ্ছেন।”
চতুর্থ পৃষ্ঠায় লিখল,
“শুনুন আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার ঘরের পর্দা, গিটার, বই, শো পিস ছুঁয়ে দিয়েছি। আপনি কী রাগ করবেন? সত্যিই রাগ করবেন? রাগ করবেন প্লীজ! আমি আপনাকে রাগানোর জন্যই এসব করলাম।”
পঞ্চম পৃষ্ঠায় যেতে যেতে নাফিয়া ভাবল অনেক হয়েছে। এবার ক্ষ্যান্ত দেওয়া উচিত। নয়ত এই লোক নোটপ্যাডের পৃষ্ঠারও হিসেব চেয়ে বসবে।
বারান্দার দিকে এগোতেই এক শীতল বাতাস ছুঁয়ে দেয় নাফিয়ার মুখমন্ডল। কী শান্তি! এরকম একটা খোলা ব্যালকনির ঘর যদি তারও হতো? ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠে। কলদাতা আর কেউ নয় আরিভ। নাফিয়া চট করে ফোন রিসিভ করে। অন্যপাশ থেকে আরিভ বলল,
-“আমার ঘরে যেহেতু আপনার কদম পড়েই গেছে, সেহেতু আরও একটু কষ্ট করুন ম্যাডাম। আমার আলমারির ড্রয়ারে একটা জিনিস রাখা আছে, সেটি আপনার। নিয়ে যাবেন, যদিও দেখা করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি নিজে থেকে নিলেই বেশি খুশি হব।”
-“আপনি কী করে জানলেন আমি আপনার ঘরে?”
-“এইতো কয়েক মিলি সেকেন্ড আগে আমার আম্মাজানের সাথে আলাপ হল। জানলাম আমার ঘরে এক চন্ডাল পরীর অবতরণ ঘটেছে।”
-“কীসব কথা!”
-“কী কীসব কথা? যাও আলমারির কাছে।”
-“এভাবে কারো আলমারিতে হাত দেই না আমি।”
-“সে কেউতো আমি।”
-“আপনি হোন আর যেই হোন।”
-“প্লীজ নাফি নিয়ে যাও। কেউ কিছু বলবে না। আমি অধিকার দিলাম তো আলমারি খোলার।”
ফোন কানে রেখেই আলমারির দিকে এগোলো নাফিয়া। খুব সাবধানতার সাথে খুলল আলমারি। আরিভের কথামত প্রথম ড্রয়ার খুলল। সেখানে আরিভের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সাথে ছোট একটি বক্স আছে। সেটি হাতে নিতে বলল আরিভ,
-“খুলে দেখ।”
একজোড়া পায়েল। দেখেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে নাফিয়ার। আরিভ জানতে চাইল,
-“পছন্দ হয়েছে?”
-“হুম।” ছোট্ট করে জবাব দিল নাফিয়া।
-“সেদিন আপনাকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দেয়ার পর কিনেছিলাম। সুযোগ হয়নি দেওয়ার।”
-“আমার এসব চাইনা।”
-“আমার চাই। আমি চাই তুমি পায়েলজোড়া পড়ে আমার আশপাশে ঘোরাফেরা করো। পায়েলের মৃদু ঝংকারে যেন তোমার আগমনী ধ্বনি শুনতে পাই।”
-“পিক আপ লাইন থ্রো করতেও জানেন দেখছি।”
-“শিখছি অনেককিছু ধীরেধীরে।”
নাফিয়া চুপ করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল পায়েল। মৃদু আওয়াজ যান্ত্রিক ফোন ভেদ করে অন্যপ্রান্তেও গিয়েছে। আরিভ গভীর গলায় বলে উঠে,
-“আমি এসে পরিয়ে দিব, সেই পর্যন্ত এই পায়েলজোড়া সামলে রেখো। খবরদার নিজে থেকে পড়তে যাবেনা।”
চলবে…
#বৈরী_বসন্ত ১৪
লেখা – আয্যাহ সূচনা
পায়েলের চেয়ে পায়েলের বক্সটি বেশি মনে ধরেছে নাফিয়ার। কাঠের বাক্সে বিভিন্ন রঙের স্টোন বসানো। পায়েলজোড়াও কম সুন্দর নয়। লজ্জা লাগছে নাফিয়ার, সাথে অপরাধবোধও। এইযে অনুভূতির পরিবর্তনের পর আরিভ তাকে বিশেষ অনুভব করাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিনিময়ে সে শুধু ঝগড়াই করে গেল।
চট করে নতুন ভাবনা এলো, সে কেন অনুশোচনায় ভুগছে? তার মধ্যে কী আরিভের জন্য কোনো বিশেষ কিছু আছে?
বিরক্ত হল নাফিয়া। এগুলো কেমন দ্বন্দ্ব? নিজের কাছেই নিজেকে এলোমেলো মনে হয়। সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না কেন? কিন্তু তার দূরত্ব যে দুয়েকদিনেই বেশ অশান্তির অনুভব করাচ্ছে। আরিভ নেই বিগত তিনদিন যাবত। এই তিনদিনে পায়েলজোড়া, তার পাঠানো ছবি, তার কণ্ঠের গান কতবার শোনা হয়েছে হিসাব নেই।
-“আমি এই লোকের ভন্ডামিতে পা পিছলে পড়ে গেলাম নাতো?”
সাথে সাথে মুখ ভেংচি কাটলো নাফিয়া। তার তো বয়েই গেছে এই লোকের উপর পিছলে পড়ার। তার মতো ইতর শ্রেণীর মানুষকে কারো পছন্দ হতে পারে? ইহা অসম্ভব।
হুট করেই কলিং বেলের আওয়াজে নাফিয়া ফিরে তাকাল। রেশমা বেগম চিৎকার করে বললেন দরজা খুলে দিতে। নাফিয়াও দৌঁড়ে যায়। দরজা খুলতেই ঠোঁটে লম্বা চওড়া হাসি ফুটল। বাবা দাঁড়িয়ে, খুশি হবার পূর্বেই পাশে দাঁড়ান দাদীকে দেখে সব খুশি জানালা দিয়ে পালায়।
সিদ্দিক সাহেব এসেই মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, -“কেমন আছে আমার আম্মা?”
-“বাবা? আমি ভালো আছি। তুমি না বলেছিলে আরও দেরিতে ফিরবে?”
-“আরও দেরি করে ফিরলে তুমি খুশি হতে?”
নাফিয়া দুদিকে মাথা দুলিয়ে বলে, -“না একদমই না। হুট করে দেখে চমকে গিয়েছি।”
-“খুশি হওনি?”
নাফিয়া সিদ্দিক সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বলল, – “খুব খুশি হয়েছি।”
মুখ ভার করে আছেন জমিলা বেগম। দরজায় দাঁড়িয়ে বাবা মেয়ের ভালোবাসার মুহূর্ত তার গায়ে জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করল। বলল,
-“এসব রং ঢং দেখতে হইব নাকি দরজায় দাঁড়ায়? ঘরে যামু না?”
নাফিয়া কষ্ট পেল। কিন্তু বুঝতে দিল না। মুখে হাসি টেনে বলল,
-“আসুন দাদী।”
-“তোর অনুমতি নেওয়া লাগব নাকি অপয়া?”
এতটাদিন ভালোই কাটছিল। আবার সেই ‘অপয়া’ শব্দটি শুনতে হচ্ছে। তীরের মত আঘাত করবে এই ডাক প্রতিনিয়ত। সিদ্দিক সাহেব বললেন,
-“আহহা আম্মা! আপনি ঘরে যান।”
নাফিয়া নতজানু হয়ে দাঁড়ান। সিদ্দিক সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“দাদীর আশপাশে বেশি থেকো না। দরকার ছাড়া তার কাছে যাবেনা। কি করব বলো? আমার মা তো, ফেলে দিতে পারি না। তোমাকে কষ্ট পেতেও দেখতে পারি না। আমার হাত বাঁধা।”
-“তুমি একদম চিন্তা করবে না বাবা।”
বাবা মায়ের ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল নাফিয়া। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কান পেতে দাঁড়াল। অবশ্য দাঁড়ানোর বিশেষ কারণ আছে। তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে, তার বিয়ে নিয়ে। নাফিয়া পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সিদ্দিক সাহেব বললেন,
-“আমি মায়ের কথার প্রশ্রয় দিচ্ছি না। তবে এক না একদিন নাফিকে বিয়ে দিতেই হবে।”
রেশমা বেগম জবাবে বললেন,
– “সেতো আমিও জানি। কিন্তু আমি চাইছিলাম ওর পড়ালেখাটা যদি শেষ হতো তারপর নাহয়….”
-“সেটাতো অবশ্যই কিন্তু….”
-“আপনি নাফির হাত নিয়ে ভাবছেন?”
-“হুম।”
-“আপনিতো ভাগ্যে বিশ্বাসী তাহলে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিন না?”
সিদ্দিক সাহেব শক্ত ধাঁচের মানুষ। কিন্তু মেয়ের ব্যাপারে বরাবরই দুর্বল। কিন্তু তার সামনে দেখান না। বুঝতে দেন না। স্ত্রীর সামনে কিছুটা দুর্বলতা প্রকাশ করলেন।
-“প্রতিটা মেয়েই তার বাবার কাছে আমানত। ওর জীবনে একজন ভালো জীবনসঙ্গীর সুখ আসবে না? আমি মরে গেলে ওর পেছনে ঢাল হয়ে কে দাঁড়াবে রেশমা? আমার বড্ড ভয় হয়। বয়স হচ্ছে আমার।”
রেশমা বেগম স্বামীর বাহুতে হাত বুলিয়ে দিলেন। এসব কথা বলতে বারণ করলেন। অন্যদিকে নাফিয়ার চোখজোড়া ছলছল করছে। বিয়ের কথা শুনে নয়, বাবার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে। সিদ্দিক সাহেব বললেন,
-“নাফিয়ার তো কোনো ভাইও নেই। বুঝতে পারছি না। বিয়ের দিকেও আমার সাহস কুলাচ্ছে না। কে সবটা মেনে আমার মেয়েকে আগলে রাখবে? এই যুগে কার এত সময় আছে?”
-“সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই আমাদের নাফির জন্য যোগ্য কাউকে রেখেছেন।”
-“সে যে শতভাগ ভালো রাখবে আমার মেয়েকে তার কী নিশ্চয়তা?”
মেয়েরা বুঝি এতই বোঝা হয় পৃথিবীতে? কেন একা চলতে পারেনা? পেছনে স্বামী, ভাই অথবা বাবার ছায়া প্রয়োজন হয়? ছায়া থাকা তো খারাপ কিছু নয়। কিন্তু এই ছায়া না থাকলে সমাজ কেন তাদের বোঝা হিসেবে ধরে নেয়?
-“নিজে থেকে কল করলে? আজ কী সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে পূর্ব দিকে অস্ত গেল? নাকি দিনে চাঁদ আর রাতে সূর্য উঠেছে? কই দেখিতো!”
বিছানায় গুটিয়ে শুয়ে আছে নাফিয়া। এক কাত হয়ে কানের নিচে ফোন চাপা দিয়ে। আরিভের দুষ্টুমিতে কিছুই আসলো গেল না তার। মন ভীষণ খারাপ।
নাফিয়ার নির্লিপ্ততা ভাবাল আরিভকে। ফোনের ওপাশ থেকে আদুরে গলায় জানতে চাইল,
-“কী হয়েছে বৈরীতা?”
নাফিয়া নাক টেনে বলল, -“ভালো লাগছে না।”
কণ্ঠস্বর ভারী তার। নাক টানছে। আরিভ প্রশ্ন করল,
-“কেঁদেছো তুমি?”
-“উহু।”
-“মিথ্যে বলছো কেন? তোমার কন্ঠ স্পষ্ট জানান দিচ্ছে তুমি কান্না করছো।”
নাফিয়া নিশ্চুপ, নিস্তব্ধে সময়ের স্রোত বইছে। জানে না কেন এই মন উদাসের মুহূর্তে তার আরিভের কথাই মনে হল। সময়, ক্ষণ কিছুই না ভেবে তাকে কল করেছে। কথা বলছে না কল করেও। কী চাইছে?
আরিভ বলল,
-“আমি কী আপনার মন ভালো করার ঔষধ?”
-“মানে?”
-“ভালো লাগছে না তাই আমাকে কল করলেন। নিশ্চয়ই চাইছেন আপনার মন আমি ভালো করে দেই।”
-“ভুল ধারণা।”
-“তাহলে রেখে দেই ফোনটা?”
নাফিয়ার মুখশ্রী আরও মলিন হয়ে এল। জানালা ভেদ করে চন্দ্রের আলো ফ্যাকাশে মুখমণ্ডলে পড়ছে। মৃদু বাতাসে চুলগুলো উড়ছে কিছুটা। চোখের পাপড়ি পিটপিট করছে।
আরিভের হৃদয়ে কোনো জায়গায় আঘাত হানলো এই নীরবতা। কান্নামাখা কন্ঠ ছটফটানি বৃদ্ধি করল আকস্মিক। চাইছে ছুটে আসতে। বুকে জড়িয়ে নেওয়ার এক অবাধ ইচ্ছেও জাগলো। কিন্তু সেটি এই মুহূর্তে অসম্ভব।
-“তোমার নীরবতা, তোমার কান্না আমাকে পোড়াচ্ছে।”
-“কেন?”
-“হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে।”
-“কিন্তু কেন?”
-“অসহায় অনুভব করছি।”
-“বলবেন কেন?”
-“তোমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।”
-“কারণ কী?”
-“কখনও আমার বুকে মাথা রাখলে কী তোমার খুব বেশি অস্বস্তি হবে?”
নাফিয়া আরও জড়োসড়ো হয়ে গেল। কেউ নেই তার আশপাশে তারপরও চাঁদের আলো থেকে নিজের মুখ লুকালো। আঁধারে চলে গেল। কল্পনায় আরিভের বলা মুহূর্ত ধরা দিচ্ছে। লজ্জা কাবু করে নিল সাথে সাথে।
-“ফিরবেন কবে?”
-“আমার অপেক্ষায় কেউ?”
-“কী জানি?”
-“তাহলে দেরি করে ফিরব।”
-“অপেক্ষায় থাকে যদি?”
-“তাহলে কালই ফিরব সব কিছু ফেলে।”
-“জরুরী কাজও?”
-“কাজটা কারো অপেক্ষার চেয়ে বেশি জরুরী না।”
-“তাহলে ফিরুন।”
-“কবে?”
-“আগামীকাল।”
-“কেউ তো অপেক্ষায় নেই।”
-“অপেক্ষায় নেই, তবে কিছু জরুরী প্রশ্ন আছে।”
-“উত্তর চাই?”
-“হুম?”
-“কীভাবে চাই? মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নাকি বুকে মুখ গুঁজে?”
নাফিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, -“দেখা হচ্ছে কাল। রাখি।”
_________
বাবার কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছে আরিভ। পায়ে বিশাল ব্যান্ডেজ। মাঠে বসে জোহান, সাদিফের ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে চোখ জোড়া রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেল। একি কাণ্ড! আতাউর সাহেব তার ছেলেকে ভালোভাবেই সামলে বাড়ির দরজা অব্দি আসলেন। নাফিয়া হা করে তাকিয়ে আছে। জোহান আর সাদিফের চোখ পড়তেই তারাও এগিয়ে গেল।
তার পিছু পিছু কদম এগোয় নাফিয়ারও। সাদিফ একপাশে গিয়ে আরিভকে ধরে বলল,
-“ভাই পায়ে কী হলো?”
আরিভের প্রশ্নের চেয়ে বেশি নাফিয়ার দিকে মনোযোগ। কতদিন পর দেখল! পাঁচদিন হয়েছে, কিন্তু মনে হল যুগের পর যুগ দেখেনি। মেয়েটি কীভাবে বিস্ফোরিত চোখে তার পায়ের দিকে চেয়ে আছে। কিছু বলছে না।
জোহান প্রশ্ন করে, -“লুলা হলেন কী করে?”
টনক নড়ে আরিভের। আতাউর সাহেব বললেন,
-“আমার ছেলেটা কাজের চেয়ে বেশি লাফালাফি করে। ফ্র্যকচার হয়েছে।”
ঠাট্টার সুরে বললেন তিনি। বড়ই রসিক মানুষ। সাদিফ প্রশ্ন করল,
-“বেশি লাগেনি তো?”
আতাউর সাহেব জবাব দিলেন, – “নাহ্। সব ঠিক আছে, রেস্ট করতে বলেছেন ডক্টর।”
আরিভ নাফিয়ার বিশাল চোখের ঘোরে। আশপাশের কোনো আলাপ – আলোচনা তার কানে যাচ্ছে না। অথচ নাফিয়ার সেখানে ধ্যান নেই। তার থমকে যাওয়া চোখ আরিভের পায়ের দিকে।
তিনজন ধরাধরি করেই ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল আরিভকে। আতাউর সাহেবের ধ্যান গেল নাফিয়ার দিকে। সুন্দর সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন,
-“নাফি, মা? এসো বাসায় এসো।”
-“হুম?”
হুশ ফিরল যেন নাফিয়ার। আরিভ মনে মনে বেজায় খুশি। বাবা মনের ইচ্ছাটা অজান্তেই পূরণ করে দিলেন। নাফিয়া বিরস মুখে বলল,
-“না থাক।”
আরিভের মুখ কুঁচকে যায়। চোখ রাঙায় নাফিয়াকে। ইশারায় বলল সাথে চলতে। আতাউর রহমান বললেন,
-“আসার পথে কুমিল্লার রসমালাই এনেছি। তোমরা সবাই খাবে, এসো।”
নাফিয়া আর বারণ করল না। তারও মনের কোণে কোথাও না কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ভদ্রতার খাতিরে না করেছে। রসমালাই এর কথা শুনে জোহান পারলে আরিভকে উড়িয়ে ঘরে নিয়ে যায়। আরিভ ধমকে উঠে,
-“ছোঁচা বিড়ালের মত আচরণ করছিস কেন? আস্তে হাঁট।”
দরজার সামনে দাঁড়ানো সকলে। শিরীন বেগম ছেলেকে মাথা থেকে পা অব্দি দেখলেন। পায়ে প্লাস্টার দেখে কপাল কুঁচকে গেল। আরিভ ভীত কন্ঠে বলে উঠে,
-“কই মারবে বলো? গালে নাকি পিঠে?”
নাফিয়াসহ সকলেই হেসে উঠে। শিরীন বেগমের মুখে হাসি নেই। বললেন,
-“পা ভেঙে এসেছিস কোথা থেকে?”
আতাউর সাহেব বললেন, -“কনস্ট্রাকশন এরিয়াতে গিয়েছিল। পা ফসকে পড়ে গেছে।”
শিরীন বেগম পেছনের তিনজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
-“ওকে দেখে মনে হয় তোমাদের ও একটা দামড়া ছেলে? ওর কাজ-কারবার দেখেছ?”
নাফিয়া বিড়বিড় করে বলল, -“দুটো লাগান ধরে।”
-“কিছু বললে নাফি?” শিরীন বেগম শুধায়।
-“নাহ আন্টি।”
-“আচ্ছা তোমরা ভেতরে এসো। আর এটাকে ঘরে নিয়ে যাও।”
এটা এটা হলে সম্বোধন করছেন শিরীন বেগম আরিভকে। মনে মনে চিন্তিত মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করবে না। চারজনকে একসাথে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে স্বামীকে প্রশ্ন উত্তর পর্বে বসিয়ে দিলেন। কীভাবে হলো? ব্যাথা বেশি নাকি কম? ইত্যাদি।
নাফিয়া দাঁড়িয়ে রইল। আরিভকে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায়। বাকি দুজনকে অদেখা করে নাফির দিকে তাকায়। অন্যমনস্ক মেয়েটির পানে চেয়ে বলল,
-“তুমি স্ট্যাচু অব লিবার্টি সেজে আছো কেন?”
-“ইচ্ছে!”
ঝাঁঝাল সুরে বলল নাফিয়া। রেগে থাকার কারণ আরিভের বোধগম্য হল না। আরিভ বাকি দুজনের দিকে তাকায়। কাবাবে হাড্ডির ভূমিকা পালন করছে। পারলে এখনই দুটোকে ব্যালকনি থেকে লাথি মেরে ফেলে দিত।
আরিভ বলল, – “বসো।”
হাত দিয়ে তার সামনের জায়গাটুকু দেখিয়ে দেয়। নাফিয়া এসে বসেছে বিনাবাক্যে। ঠিক প্লাস্টার করা পায়ের কাছে। জোহান লাফিয়ে উঠল বিছানায়। একটি মার্কার পেন আরিভের ডেস্ক থেকেই নিয়েছে।
বলে উঠল,
-“ভাই আপনার সাদা প্লাস্টার দেখতে ভালো লাগছে না। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এঁকে দেই?”
আরিভ আশ্চর্য ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে, -“নদী আঁকবি?”
-“হ্যাঁ ভাই।”
কোন জগতের বলদ এই ছেলে আরিভ, সাদিফ, নাফিয়া কারো মাথায় ঢুকে না। নদী কিভাবে আঁকবে? সবাই বিরক্তির সহিত চেয়ে আছে তার দিকে। সে আঁকতে শুরু করল। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার নামে পানির স্রোত এঁকে দিল। আরিভের মেজাজ গরম হয়ে যায়। একেতো এদের সহ্য হচ্ছে না তার আর নাফিয়ার মধ্যে। তার মাঝে এসব উদ্ভট কর্মকাণ্ড।
আরিভ দাঁত কিড়মিড় করে বলল, – “সাদিফ এটাকে আমার চোখের সামনে থেকে দূর কর।”
জোহান বলল, -“হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদেরতো বের করতেই চাইবেন।”
আরিভ চোখ রাঙিয়ে তাকায়। সাদিফ হাসল। সে বিষয়টা আগেই আন্দাজ করেছে। কিন্তু তার ছোট ভাই সচক্ষে দেখেছে। সমস্যাটা এই জায়গাই। মুখ পাতলা ছেলে।
শিরীন বেগম এসে সবাইকে রসমালাই দিয়ে গেলেন। আরিভের মাথায় হাতও বুলিয়ে গেছেন। আজ মার খেতে হয়নি এটাই অনেক।
খাওয়ায় মনোযোগী সাদিফ জোহান। নাফিয়া রসমালাই এর বাটি নিয়ে নড়াচড়া করছে। ঠোঁট কামড়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। নীচু গলায় আরিভ বলল,
-“এইভাবে মুখ ফুলিয়ে রাখলে ব্লাস্ট হয়ে যাবে।”
রাগান্বিত চোখে তাকায় নাফিয়া। কিছু বলল না, দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে রেগে আছে। তার মাঝেই জোহান বলে উঠল,
-“ভাই আরেকটু রসমালাই পেলে জীবনটা ধন্য হয়ে যেত আমার।”
আরিভ নাফিয়ার দিকে চেয়েই বলল, – “মায়ের কাছে গিয়ে চা।”
জোহান এক লাফে বেরিয়ে যায়। সাদিফও সুযোগ বুঝে বেরিয়ে গেল। হাফ ছেড়ে বাঁচল আরিভ। নাফিয়ার মত করেই মাথা নামিয়ে বলল,
-“রেগে আছো?”
নাফিয়া জবাব দিল না। আরিভ এই মুখখানার ঘোরে ডুবে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে কাছে টেনে নিক। এরপর পরই অসভ্যের ট্যাগ পেয়ে যাবে। নিজের ইচ্ছেকে দমালো বহু কষ্টে। বলল,
-“পায়ের থেকে ব্যাথা উঠতে উঠতে হাত পর্যন্ত এসেছে। এখন যদি কেউ খাইয়ে দিত, ভালোই হতো তাই না?”
নাফিয়ার প্রজ্জ্বলিত চোখ ফের তাকায় আরিভের দিকে। প্রশ্ন ছুঁড়ে,
-“কী করে হল এটা?”
-“কৈফিয়ত চাইছেন?”
নাফিয়া ভীষণ বিরক্ত হল। উঠে চলে যেতে চাইল। তার পূর্বেই আরিভ হাত টেনে ধরে। হ্যাঁচকা টানে পুনরায় বসে পড়ল। এবার দূরত্ব কিছুটা কম। আরিভ হাত এগিয়ে গাল টেনে দিয়ে বলল,
-“সরি।”
-“কবে পেলেন ব্যাথা?”
-“গতকাল সকালে।”
-“জানাননি তো।”
-“তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।”
নাফিয়া মুখ ফিরিয়ে নিল। গতকাল রাতে কথা হয়েছে। সে কী একটাবারের জন্য বলতে পারল না? বলেনি, উল্টো লুকিয়ে গিয়েছে। অভিমান করতে ইচ্ছে হচ্ছে নাফিয়ার। কিন্তু পারছে না। পেট গুলিয়ে আসছে তার। লোকটা কাছে থাকলে কিছুতেই শান্তি দেয়না।
-“কতদিন পর দেখলাম…”
জবাবহীন রইল নাফিয়া। আরিভ তার রেগে টইটুম্বুর কপোলে আলতো হাত ছোঁয়ায়। শক্ত হয়ে বসল নাফিয়া। এবার রাগ উড়ে গিয়ে অস্বস্তির শুরু হবে। হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাবে।
সূর্যের আলো সরাসরি নাফিয়ার স্নিগ্ধ মুখখানায় পড়ছে। আরিভের আরও বেহাল দশা হল। বুক কেঁপে উঠল। ছোটছোট চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে ব্যাকুল গলায় ডাকল আরিভ,
-“নাফি?”
ঝটপট এরূপ ডাকে ঘুরে তাকাল নাফিয়া। প্রশ্নের জবাবটুকু দেওয়ার সাধ্য হল না। এবার সূর্যের আলো তার চোখে এসে পড়েছে। কালো মণি ধূসর বর্ণের দেখাচ্ছে।
-“তুমি আমার হৃদযন্ত্রের সর্বনাশ করেই ছাড়লে।”
চলবে…