#বৈরী_বসন্ত ১৭
লেখা – আয্যাহ সূচনা
মধ্যে কেটেছে দুটো দিন। আরিভ পুরোপুরি নয় তবে কিছুটা সুস্থ। পূর্ণ অসুস্থ মনের দিক থেকে। চাতক পাখির ন্যায় খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রিয়তমাকে। চোখজোড়া অশান্ত, দেহ পুরোটাই ভঙ্গুর। উঠতে পারছে না, ছুটে যেতে পারছে না। প্রেয়সী যেন শুনেও না শোনার ভান করে আছে। তাকে এক পলক দেখবার সুযোগ দিল না। কী যেন কী ভয় তার? এত ডেকেও কাছে আনা গেল না।
সদ্য প্রস্ফুটিত অনুরাগের রক্তজবা নেতিয়ে আছে। বারিধারার ছিটেফোঁটা না পেয়ে হয়তো ঝরে যাবে। তার পূর্বেই বর্ষণের প্রয়োজন, অতীব জরুরী। কিন্তু কীভাবে? আকাশে তেজী সূর্যের আলো, হৃদয়খান মরুভূমির মতো খাখা করছে।
-“খাচ্ছিস না কেন?”
মায়ের ডাকে হুশ ফিরল। আরিভ অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। ঘুরে চেয়ে ছিল জানালার দিকে। জানালা ভেদ করে পাশের বাড়ির রোশনী দেখবার চেষ্টা করছিল। ধরা দিল না সেই রোশনী।
শিরীন বেগম ভাত মাখিয়ে মুখের সামনে ধরে রেখেছেন। আরিভ খেয়ে নিল। যতই বকাঝকা করুক, একমাত্র ছেলে তার। যত্নে কোনো কমতি রাখছেন না।
শিরীন বেগম প্রশ্ন করলেন, – “কিছু নিয়ে চিন্তিত তুই?”
-“নাহ।”
-“তোকে অন্যমনস্ক দেখায়। অফিসে কোনো সমস্যা?”
মিছেমিছি হাসল আরিভ। বলল,
-“এমন কিছুই না আম্মা।”
শিরীন বেগম ছেলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। চোখের এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে আরিভ। নিঃশ্বাস ফেলছে ভারী, কিছুক্ষণ পরপর। আরও এক লোকমা খাবার মুখে পুড়ে দিয়ে বললেন,
-“মনে হচ্ছে কিছু লুকাচ্ছিস।”
আরিভ মায়ের দিকে তাকাল। তার চাহনী সুবিধাজনক না। ঠিক ছোটবেলায় চুরি ধরার পূর্বে এভাবেই তাকিয়ে থাকতেন। যে অব্দি সত্যিটা আরিভের মুখ থেকে বের না হতো সেই অব্দি চেয়েই থাকতেন। এরপর শুরু হতো কেলানি। ছাব্বিশ বছরে মায়ের স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি।
আরিভ পাশে থাকা পানির গ্লাস তুলে গটগট করে গিলল। শিরীন বেগম এখনও সন্দেহের চোখে চেয়ে আছেন। তিনি বলে উঠলেন,
-“কী লুকাচ্ছিস ভালোয় ভালোয় বলে দে।”
-“আম্মা… আসলে…”
-“আবার কোনো অকাজ বাজিয়েছিস?”
-“অকাজ না।”
-“তাহলে…”
আরিভ প্লেটের অবশিষ্ট খাবারগুলো দেখল। পেটে ক্ষিদে। এগুলো আর পরে কপালে নাও জুটতে পারে। খাবারের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ করা যাবেনা। আরিভ বোকা হেসে বলল,
-“আচ্ছা আম্মা খেয়ে নেই তারপর ধীরে সুস্থে বলছি।”
-“এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে তুই নিশ্চয়ই বিশাল কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছিস।”
আরিভ শিরীন বেগমের হাতের উপর হাত রেখে বললেন,
-“তোমাকে ছুঁয়ে বলছি আমি কিচ্ছুটি করিনি।”
শিরীন বেগম হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিল। বলল,
-“একদম আমাকে ছুঁয়ে বলবি না। আমাকে মারার ধান্দা সব।”
-“কীসব আজেবাজে কথা বলছো!”
শিরীন বেগম কথা বাড়ালেন না। খাবার খাইয়ে দিতে লাগলেন। ভাত খাওয়া শেষে আরিভ আরও দুই গ্লাস পানি খেয়েছে। এবার পেট ঠান্ডা, মাথাও ঠান্ডা। শান্তি শান্তি লাগছে। শিরীন বেগম হাত ধুয়ে এসে আরিভের সামনে বসেন। ঠিক তখনই আরিভ শিরীন বেগমের দুহাত চেপে ধরলো। বলল,
-“প্রমিজ করো মারবে না।”
শিরীন বেগম অকস্মাৎ রেগে যান। বলেন,
-“তোর হাড়গোড় গুড়ো করব আমি। কী করেছিস জলদি বল।”
মনে মনে দুয়া পড়তে শুরু করেছে আরিভ। বয়সের তুলনায় মন বেকুবের মত ভেবে বসল, যদি ত্যাজ্য করে দেয়? আরিভ সঙ্গেসঙ্গে নিজের ভাবনার উপর ধিক্কার জানাল। সামান্য প্রেমেইতো পড়েছে, তাই নিয়ে নিজের পেটের একমাত্র ছেলেকে ত্যাজ্য করবে?
-“আম্মা…”
শিরীন বেগম চোখ বড় বড় করে তাকান এবং ভারী কন্ঠে বললেন,
-“বল.. আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিস কিন্তু।”
-“আম্মা তোমার মনে হয়না তোমার একজন সঙ্গী দরকার।”
আশ্চর্য হয়ে তাকালেন শিরীন বেগম। সঙ্গী দরকার? কীসের সঙ্গী? এই প্রশ্ন তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। দাঁত কিড়মিড় করে বলেন,
-“কথা পেঁচাবি না।”
-“আম্মা.. এই বাড়িতে ছেলের সংখ্যা বেশি।”
অসুস্থ ছেলের পিঠেই কিল পড়ল। আরিভের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে সজোরে কিল লাগিয়েছেন শিরীন বেগম। সেটি পর্দার আড়াল থেকে মুঠোফোনে রেকর্ড হয়। প্রতিদিন একবার দুবার এসে দেখে যায় তাকে নাফিয়া। মুখে হাত দিয়ে হাসছে সে মার খাওয়ার দৃশ্যে। সামান্য মায়া হল বটে, এইভাবে অসুস্থ মানুষকে না মারলেও পারত।
শিরীন বেগম বললেন, -“আরেহ আমার গুণধর পুত্র! তোমার সঙ্গী লাগবে তুমি সেটা বল, টাল বাহানা করছ কেন?”
-“বুঝে গেছ?”
শিরীন বেগমের হাতটা নিশপিশ করছে আরও একটা চড় দেওয়ার জন্য। কিন্তু দিলেন না। তিনি বললেন,
-“তাইতো বলি আমার ছেলের মন আজকাল হুট করে উদাস, আবার হুট করেই উৎফুল্ল হয় কী করে? কার প্রেমে পড়েছিস? মেয়ে কোথাকার? কী করে? নাম কী?”
এতগুলো প্রশ্ন শুনে আরিভ আহাম্মকের মত চেয়ে রইল। এবার আরও বড় টাস্ক। নাম বলতে হবে। হুট করেই আরিভের মনে এল, যদি মা নাফিয়ার কথা শুনে সরাসরি না করে দেন? তার অপূর্ণতাকে বাঁধা হিসেবে এটে দেন তাদের দুজনের মধ্যে।
দুষ্টু মুখখানা গম্ভীরতায় ভরে উঠে। ঠোঁট ভেজায় আরিভ। মুহূর্তেই আকস্মিক পরিবর্তন শিরীন বেগমের চক্ষু এড়ায়নি। এবার তিনি শান্ত স্বরেই শুধান,
-“বল, কিছুই বলবো না।”
-“মা আমি নাফিয়াকে চাই।”
আরিভের স্পষ্ট বাক্য। এক বাক্যে তার চাওয়া মায়ের কাছে রেখেছে। শিরীন বেগম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিশ্চুপ ছেলের দিকে চেয়ে আছেন। ছেলে তার কাছে আবদার করেছে, সেটিও নাফিয়া? এটা কী করে সম্ভব? শিরীন বেগমের মতে আরিভ নাফিয়াকে এক দণ্ড সহ্য করতে পারেনা।
-“তুই নাফিকে পছন্দ করিস? কিন্তু তুই তো ওকে…”
-“পছন্দ করতাম না মা.. পছন্দ হয়ে গেছে। আমি জানি না কীভাবে, কখন। আমার জীবনে আগে কখনও কোনো নারী আসেনি। আমি আসতে দেইনি একমাত্র তোমার আর বাবার কথা ভেবে। আমি জানি তোমার ইচ্ছে তোমার ছেলের বউ তুমি নিজে পছন্দ করবে। কিন্তু আমি নাফিকে ভালোবাসি।”
নীরব রইলেন কিছুক্ষণ শিরীন বেগম। বুঝতে পারছেন না কী বলবেন। প্রথমেই মাথায় এল নাফিয়ার হাতের কথা। আরিভ শিরীন বেগমের দুহাত শক্ত করে চেপে ধরলো। বলল,
-“আমি জানি তুমি ওর হাতের কথা ভাবছো, ওর ত্রুটির কথা ভাবছো। আম্মা একটা হাত না থাকলে কীই বা আসে যায়? আমি ওকে নিয়ে ভালো থাকব।”
শিরীন বেগম কিছু সময় প্রতিক্রিয়াহীন রইলেন। বুঝতে পারছেন না কী বলা উচিত। দ্বিমুখী দ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন। ছেলের অসহায় মুখের দিকে চেয়ে বললেন,
-“নাফি তোর থেকে বয়সে অনেক ছোট, বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিসতো?”
-“আমি বুঝেশুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আম্মা। বয়স, নাফির ত্রুটি এতে আমার কিছুই আসে যায় না।”
-“নাফি তোকে পছন্দ করে?”
আরিভ হাসল। কল্পনায় তৎক্ষণাৎ নাফিয়ার কাজল রাঙ্গা চোখ ভেসে আসে পরপর তার অস্বস্তিমাখা মুখমন্ডল। আরিভ আশেপাশে থাকলে তার মধ্যে দেখা যায় অদ্ভুত বিচলন। সে আজকাল অপেক্ষা করে তার জন্য। এটি হয়তো পছন্দের চেয়ে বেশিকিছু ইঙ্গিত করে।
আরিভ সরাসরি জবাব দিল, -“করে।”
শিরীন বেগম আরও আশ্চর্য হয়ে তাকান। বলে উঠেন,
-“দুজনে মিলে এই ঘটনা কবে ঘটালি বল তো? আমি খবরও পেলাম না। এইতো কিছুদিন আগে একজন আরেকজনের দু চোখের বিষ ছিলি। হুট করে লাইলী মজনু সেজে ঘুরছিস? তোরা তো চোর ডাকাতকেও হার মানাবি।”
আরিভ ঠোঁট টিপে হাসে। মায়ের কথাগুলো শুনে হাসি পাচ্ছে তার। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
-“আম্মা…”
-“আবার কী?”
-“ইয়ে মানে… আমিতো এক ধাপ এগোলাম, তুমি যদি বিষয়টা ফাইনাল ধাপে নিয়ে যেতে তাহলে আমার উপরকার হতো আরকি।”
মিথ্যে লজ্জার নাটক করছে আরিভ। মাথা নুয়ে দুষ্টু হাসছে। এই অভিনয় দেখে পিত্তি জ্বলে গেল শিরীন বেগমের। কান মলা দিয়ে বললেন,
-“আমার সাথে নাটক করিস? প্রেম করবি তুই আর আয়োজন করব আমি?”
আরিভ মৃদু আর্তনাদ করে বলল, -“ব্যথা পাচ্ছি আম্মা।”
-“ব্যাথা পাওয়াই উচিত তোর, অসভ্য।”
কান ছেড়ে দিলেন শিরীন বেগম। সোজা হয়ে বসে আরিভ। এই ব্যথাকাতর দেহ অতি কষ্টে নড়িয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখল। বলল,
-“আম্মা তুমি চাও না নাফি আমার বউ হোক? তুমি কী রাজি নও? খুশি নও?”
শিরীন বেগমের মন নরম হল। বলল, -“তুই নাফিকে পেলে খুশি হবি?”
-“আম্মা আমার খুশির জন্য তুমি নিজের খুশি বিসর্জন দিবে না। বলো? তোমার মনে কী আছে?”
শিরীন বেগম বললেন, – “আমি আসলে নাফির হাতটার কথা ভাবছিলাম।”
-“হাতের কারণে ওর জীবন থেমে নেই মা। মা ওর দাদী ওকে প্রচুর পরিমাণে কষ্ট দেয়। অপয়া, অলক্ষ্মী বলে। ওর কী দোষ আম্মা? ও কী কখনও চেয়েছিল ওর একটি হাত অচল হয়ে যাক? আমি ওর সেই অনুভূতিশূন্য হাতটা না ধরলে ওর দাদী ওকে এমন কারো সাথে বিয়ে দিবে যে কীনা প্রতিনিয়ত ওকে ওর অপূর্ণতার খোটা দিয়ে যাবে।”
মা ছেলের সুন্দর দৃশ্যটুকু ক্যামেরা বন্দী হল। নাফিয়া হাসল ছবিটা দেখে। কী সুন্দর লাগছে দুজনকে? অনেকক্ষণ যাবত দুজন কথা বলছে একে অপরের সাথে। কিন্তু কী কথা?
_________
মুঠোফোনে জমা পড়ে আছে শত মেসেজ আর ফোনকল। তবে কোনো জবাব আসেনি। নাফিয়ার দিকে সামান্য ভিন্ন নজরেই তাকাচ্ছে বাড়ির সকলে। তার প্রতিটি পদচারণা লক্ষ্য করছে। নাফিয়ার মধ্যে বিচলন। দেখছে চাইছে আরিভকে, জানতে চাইছে কেমন আছে সে? কিন্তু পারছে না। মা-বাবা দুজনেই প্রশ্ন করে রেখে গেছে তার কাছে, কিন্তু জবাব নিয়ে যায়নি।
তাছাড়া লোকটাকে একটু শায়েস্তা করাও উচিত। কে বলেছিল ধেই ধেই করে ছাদে চলে আসতে ভাঙ্গা পা নিয়ে? হয়েছে তো বিপদ?
ঘন্টা খানেক পর নাফিয়ার মন মোমের মত গলে গেল। উঁকি মায়ের ঘর থেকে। মনমরা হয়ে বসে থাকা এক মানব। বারবার ফোন হাতে নিচ্ছে আবার রেখে দিচ্ছে।
নাফিয়ার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। ফোন হাতে তুলে লিখল,
-“ফোনের দিকে এত কী হ্যাঁ? কারো অপেক্ষা করছেন?”
আরিভ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। নিশ্চয়ই মেয়েটি তাকে ফলো করছে। দেখছে কোথাও আড়ালে দাঁড়িয়ে। নাফিয়া সঙ্গে সঙ্গে সরে গেল জানালার পাশ থেকে। আরিভ জবাব দিল,
-“কারো অপেক্ষায় নেই। ছিলাম একজনের অপেক্ষায়, সে আমার অপেক্ষা, আঘাত কোনোকিছুরই মূল্য দিচ্ছে না।”
-“তাই নাকি?”
-“হুম তাই..”
নাফিয়া বুঝে গেল আবার মুখ ফুলিয়ে বসেছে লোকটা। এমনই স্বভাব তার। সে বলল,
-“আপনার সাথে কতদিন ঝগড়া করি না? আপনিতো লুলা হয়ে ঘরে বসেছেন। আসুন ঝগড়া করি।”
-“মুড নেই।”
-“কেন মুড নেই? আমারতো আছে।”
-“তোমার কাছে বাধ্য নাকি আমি?”
নাফিয়ার মুখ চুপসে গেল। হুমকি স্বরূপ তার মার খাওয়ার কতগুলো ছবি পাঠাল। বলল,
-“ন্যাকামো বন্ধ করবেন নাকি এগুলো পোস্ট করব?”
-“করো।”
-“সত্যি করব কিন্তু?”
-“করো।”
-“তিন সত্যি করে দিব।”
-“তিনশত বার করো।”
নাফিয়ার ভীষণ রাগ হল। নিজের টাইমলাইনে ছবিগুলো পোস্ট করে ফেলে। আরিভ দেখবা মাত্রই তার চক্ষু চড়কগাছ। লাফিয়ে উঠে। দ্রুত ফোন করে নাফিয়ার নাম্বারে। কিন্তু লাভ হল না। নাফিয়া ফোন ধরছে না। নিজের ঘরে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে ঘরে বসেই।
মনে মনে বলে উঠল, -“অসভ্য লোক! আমার সাথে ত্যাড়ামো করেন।”
ফোনে না পেয়ে মেসেজ করল আরিভ। লিখল,
-“বেয়াদব মেয়ে এসব ডিলেট কর।”
-“করব না।”
-“করো বলছি! সাদিফ জোহান আমার ইজ্জতের দফারফা করছে।”
-“নয়ে আকার না।”
-“নাফির বাচ্চা!”
-“আমার কোনো বাচ্চা নেই।”
হাই প্রেশারের রোগীর মতো আচরণ শুরু করেছে আরিভ। পুরো এলাকার মানুষের কাছে মান সম্মান হানী হওয়ার আগে এগুলো ডিলেট করাতে হবে।
-“ডিলেট করবে?”
নাফিয়া নড়েচড়ে বসল। মুখের ভঙ্গি একেবারেই যেন বদলে গেছে। বলে উঠল,
-“আগে সরি বলুন।”
-“সরি? কীসের সরি? কেন সরি বলব?”
-“একটু আগে ভন্ডের মতো আচরণ করেছেন সেটার জন্য।”
আরিভ দাঁত কিড়মিড় করে চেয়ে আছে ফোনের দিকে। মুখপট কঠিন। লজ্জায় আরও কয়েকদিন হয়তো বাড়িতেই থাকতে হবে। এলাকায় মুখ দেখানো যাবে কীনা যে জানে?
-“আমি অপেক্ষা করছি কিন্তু।”
সাথেসাথে ফোন এল। গোমড়া মুখেই ফোন তুলল আরিভ। নাফিয়া নিজের হাসি আটকে রেখেছে। ভাব নিয়ে বলল,
-“হুম বলুন সরি।”
-“বলব না।”
-“আপনি কী চাইছেন আমি ছবিগুলো পাবলিক গ্রুপে পোস্ট করি?”
-“তুমি ভারী বেয়াদব একটা মেয়ে।”
-“সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
আরিভের কিছু না করা সত্ত্বেও নত হতে হচ্ছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাগী সুরে বলল,
-“সরি!”
-“উহু! হয়নি। সুন্দর করে বলুন। ‘ আমি হার মানলাম, আই এম রিয়েলী সরি ’ এভাবে বলুন।”
-“তোমার হাড়গোড় গুড়ো করব আমি।”
-“জেলের ভাত খাওয়াব আপনাকে।”
আরিভ ফোস ফোস করছে। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“তোমার একটা ব্যবস্থা করা লাগবে। এভাবে বাড় বেড়েছে অনেক। আমাকে ইগনোর করো, আমার সাথে হুটহাট যোগাযোগ বন্ধ করে দাও, আমাকে ব্ল্যাকমেইল করো আবার আমাকে দিয়েই সরি বলাচ্ছ। দিন আমারও আসবে।”
-“হোওওওওও! খুব ভয় পেলাম।”
-“ভয় পাবে, আমার দিন আসুক।”
-“আই’ল সি।”
আরিভ চুপ হয়ে গেল। মুখ ভার করে বসে আছে। নাফিয়া আবারও এল জানালার সামনে। উঁকি দিয়ে দেখল বোচা মুখটা। অদ্ভুত! হাসি আসছে কেন তার?
নাফিয়া বলল, – “জানেন আমার ফেসবুক একাউন্টে চারটে ফ্রেন্ড মাত্র।”
-“ভালো।”
-“সাদিফ ভাই, জোহান, নোহা আপু আর আপনি। টেনশন করবেন না আপনার ছবি ছড়ায়নি। ডিলেট করে দিয়েছি। ভয় দেখালাম একটু, নেক্সট টাইম আমার সাথে বুঝেশুনে কথা বলবেন।”
-“কথা বলার সুযোগ দাও তুমি?”
নাফিয়ার খারাপ লাগল। সত্যিই লোকটাকে কষ্ট দিয়েছে এতদিন। জানে না কী চলছিল তার মধ্যে। একটা ভয়, কিছু সংশয় তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। নাফি হুট করে বলে উঠল,
-“সেদিন আপনাদের বাসায় যে খিচুড়ি দিয়েছিলাম সেটা আপনার কেমন লেগেছিল?”
-“ভালোই।”
-“উম…”
-“কী?”
-“আমি খিচুড়ি, ইলিশ পোলাও রাঁধতে শিখেছি।”
-“তো আমি কী করব?”
-“আপনি খাবেন?”
আরিভের ভ্রুদ্বয় কপালে উঠে। রাগাতে জানে, জিততেও শিখে গেছে আবার রাগ বশে আনতেও পেরেছে। মুচকি হাসে আরিভ। তবে কণ্ঠের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,
-“দুটোদিন আমি একজনকে চাতক পাখির মত খুঁজেছি। কিন্তু সে নিষ্ঠুর, আমাকে ধরা দেয়নি, দেখা দেয়নি। বুকের ভিতরের ঝড় থামাতে আসেনি। তার রান্না করা খাবার খাওয়াতে চাইলে কসরত করতে হবে। বিগত দুদিনের মাশুল গুনতে হবে।”
চলবে…
#বৈরী_বসন্ত ১৮
লেখা – আয্যাহ সূচনা
পাশার দান উল্টে গেল। নাফিয়া হতবিহ্বল হয়ে দেখে গেল। দুদিনের শাস্তিস্বরূপ সাতদিন গায়েব আরিভ। এক মুহুর্ত যে তাকে দেখার জন্য হাহাকার করত সেই কোনো ফোন করছে না, কোনো মেসেজ করছে না। দেখা করতে চাওয়াতো দূরে থাকুক। নাফিয়ার খারাপ লাগার পরিবর্তে আশ্চর্যবোধ হচ্ছে। নিজে থেকে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল লাভ হয়নি।
তাদের মধ্যে অনুভূতির পরিবর্তন এসেছে। তবে বৈরী রয়ে গেছে। একজন আরেকজনকে যন্ত্রণায় পোড়ায় আবার কাছে এসে মলম লাগিয়ে দেয়। দ্বন্দ্ব, তর্ক, অনুভূতির আদান প্রদান, দুরত্ব সবকিছু মিলিয়েই যেন তারা দুজন।
নাফিয়া মুখ ভোঁতা করে বসে। যাবে না কিছুতেই বারান্দায়। সেও দেখে নিবে কত এড়িয়ে যেতে পারে। ঠিক তখনই সাদিফ জোহান এসে হাজির হল ঘরে। অনুমতি না নিয়েই বসে পড়ল নাফিয়ার সামনে।
জোহান বলল, -“নাফিপু।”
জোহানের কন্ঠে হুশ ফিরে নাফিয়ার। নুয়ে থাকা চোখজোড়া তুলতেই দেখল দুজন বসে আছে। নাফিয়া বলল,
-“তোরা এখানে?”
সাদিফ বিপরীতে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
-“কেন আসতে পারিনা বুঝি? এ বাড়িতে আসতে তোর অনুমতি লাগবে?”
জোহান ভাইয়ের সাথে তাল মেলালো। বলল,
-“সেটাই তো। আমরা এখানে যখন ইচ্ছে তখন আসব।”
নাফিয়া তর্ক করল না। মলিন মুখে জবাব দেয়,
-“আসিস।”
সাদিফ- জোহান একে অপরের দিকে তাকাল। চোখে চোখে কিছু ইশারা করল একে অপরকে। জোহান বলল,
-“নাফিপু তুমি কী ছ্যাঁকা খেয়েছ?”
-“ছ্যাঁকা? এগুলো কেমন কথা? আমি কোনো ছ্যাঁকা খাইনি।”
সাদিফ বলে উঠে,
-“তোকে দেখে মনে হচ্ছে আশপাশের কোনো ব্যাটালোক তোর মন ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে।”
থতমত খেয়ে খেল নাফিয়া। সাদিফ আর জোহানকে খুব ভালো করেই চেনে সে। তাদের কথার আকার ইঙ্গিত বুঝে। শুকনো ঢোক গিললো নাফিয়া। বলল,
-“এমন কিছুই না। আমি এসব বাজে কাজে নেই।”
জোহান সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করে,
– “আচ্ছা তাই?”
-“হুম তাই।”
দুই ভাই কিছুক্ষণ নীরব রয়। এরাও আরিভের মতই ভোজন রসিক। রেশমা বেগম নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসেন তাদের দুজনকেও। তাদের আওয়াজ শুনেই সাথে সাথে নুডুলস করে নিয়ে এসেছেন। আড়চোখে মেয়ের ফ্যাকাশে মুখটাও দেখে গেলেন।
জোহান মুখে খাবার পুড়ে বলল,
– “নুডুলসতো দারুন হয়েছে। তার মধ্যে চিংড়ি মাছ দেওয়া। আরিভ ভাইকে একটা ছবি পাঠাই। লোকটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাক।”
ফটাফট ছবি তুলতে উদ্যত হয় জোহান। নাফিয়া কিছু না ভেবেই প্রশ্ন করে বসে,
-“উনি কী এখন সুস্থ?”
সাদিফ ভ্রু উঁচু করে জানতে চাইল,
– “উনিটা কে?”
নাফিয়া চোখ রাঙিয়ে তাকাল। সাদিফ বলে উঠল,
-“কে আরিভ ভাই? উনি সুস্থ মানে? আজ অফিসেও চলে গেছে।”
হৃদয় ভারী হল আরও। সুস্থ হয়েছে, অফিসে গেছে অথচ একবার বললও না। ভালোই! ঠোঁট উল্টে গেল নাফিয়ার আপনাআপনি। সাদিফ বলল,
-“অফিসে যাবে না? ওখানে কত সুন্দর সুন্দর কলিগ আছে তার। শুনলাম একটা মেয়ে নাকি তাকে প্রেম করার অফার করেছিল।”
জোহান গালের একপাশে খাবার রেখেই বলল,
– “হ্যাঁ হ্যাঁ আরিভ ভাই হয়তো তার কারণেই পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে অফিসে চলে গেছে। কী প্রেম!”
নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল নাফিয়া। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি আকস্মিক বৃদ্ধি পেল। থমথমে হয়ে এল মুখটা। চোখের সামনের দুজন মানুষ যেন অদৃশ্য।
নিজেকে সামলে নিল কিছুক্ষণের জন্য। সাদিফ জোহানের সম্মুখে কিছুই আন্দাজ করতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু পেট গুলিয়ে আসছে, কেমন যেন আনচান শুরু হয়েছে।
সাদিফ আর জোহান এদিক–ওদিকের আলোচনা করে চলে গিয়েছে। নাফিয়া ওদের যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। হুট করে চোখ গেল ঘড়ির দিকে। দুপুর বারোটা বাজছে। নাফিয়া ভেবেছিল নিজ হাতে ইলিশ পোলাও রান্না করবে। ভেবেছিল কোনো না কোনো বাহানায় আরিভের বাসায় দিয়ে আসবে। সেটা আর হলো কই?
________
-“কোথায় আছেন?”
নরম নম্র সুরে প্রশ্ন এসেছে। ফোন কাঁধ ও কানের মধ্যিখানে গুঁজে ফাইলে সাইন করছে আরিভ। শরীরে অল্পস্বল্প ব্যাথা এখনও আছে তার। তবে অতটা নয়। অনেকদিন অফিস কামাই করেছিল। সামনেই নতুন প্রজেক্ট। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে এসেছে।
নাফিয়ার প্রশ্নের জবাবে ত্যাড়া উত্তর দিল আরিভ,
-“হানিমুনে এসেছি, সুইজারল্যান্ডে।”
মুখ কুঁচকে এল নাফিয়ার। ফালতু লোক বলে উঠল মনে মনে। তার উত্তরের মতো করেই নাফিয়া প্রশ্ন করে,
-“কার সাথে গিয়েছেন?”
-“একাই এসেছি।”
হানিমুন আবার একা কীভাবে হয়? এই প্রশ্নটা জিহ্বার ডগায় এসেছিল। কিন্তু সামনে ভয়ংকর লজ্জায় পড়তে হবে এই ইঙ্গিত পেয়ে আর এগোলো না নাফিয়া।
-“বলুন না কোথায় আছেন?”
-“তোমার জেনে কী লাভ?”
-“হুম…”
অতি সরল সুর। এ যেন মন খারাপের সুর। ছোট্ট একটি ‘হুম’ বুঝিয়ে দিল আরিভের কথায় ভীষণ ভারী আকারের অভিমান জমছে কিশোরী মনে। আরিভ মোমের মত গলে যেতে চাইল। কিন্তু গলল না। আরিভ নিজেকে সংযত করে ফেলল। নিজের অবস্থান থেকে কিছুতেই নড়চড় হওয়া যাবে না। তাকে যেভাবে পোড়ানো হচ্ছে, সেও একটু সেই দহনের সঙ্গী হোক।
আরিভ কথা না বাড়িয়ে নিশ্চুপ রইল। নাফিয়া আগ বাড়িয়ে কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে শুধায়,
-“বলুন না কোথায় আছেন?”
আত্মগলানিতে নুয়ে পড়া কন্ঠ তার। আরিভ অকপট গলায় বলে,
-“কোথায় থাকি এই সময়?”
-“অফিসে।”
-“অফিসেই আছি।”
-“উম.. খেয়েছেন?”
-“উহু, সময় পাইনি।”
নাফিয়া কিছুটা ভয় পাচ্ছে। এই দুঃসাহস জীবনে প্রথমবার করেছে। দশ তলা বিশিষ্ট একটি বিশাল ভবনের নীচে দাঁড়িয়ে সে। এক কাঁধে ব্যাগ। বিপরীতে নাফিয়ার কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আরিভ শুধায়,
-“কী হলো?”
-“আমি আপনার অফিসের নীচে দাঁড়িয়ে আছি।”
আরিভের বিস্ময়ে চক্ষু চড়কগাছ। ঠিকঠাক শুনেছে কিনা কে জানে? নিশ্চিত হতে আবার প্রশ্ন করে,
-“মজা করছো, তাই না?”
-“না না একদম মজা করছি না। সত্যি আমি দাঁড়িয়ে আছি, আপনি একবার আসবেন?”
আরিভ উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে,
– “তুমি কী পাগল? একা আমার অফিসের নীচে কেন এসেছ? ঠিকানা কিভাবে পেলে?”
আরিভের উৎকণ্ঠা আওয়াজে ভড়কে উঠে নাফিয়া। বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে কী? রেগে গেল নাকি? নাফিয়া ভীত স্বরে বলে উঠে,
-“একবার আসবেন?”
-“অসভ্য মেয়ে একটা! আসছি! দাঁড়াও।”
-“শুনুন আস্তে ধীরে নীচে নামবেন। আবার হাত পা ভেঙে বসলে আমি হাসপাতালে নিতে পারব না।”
-“তোমার আস্তে ধীরের গুল্লি মারি। তোমার হাত পা ভাঙব, যেখানে আছো দাঁড়াও ওখানেই।”
পায়ের হাড়ে চাপ পড়ছে। তারপরও দ্রুত হাঁটছে আরিভ। বুক কাপছে তার। নাফিয়া একা চলাফেরা করতে পারেনা। কালেভদ্রে বাধ্য হয়ে চলাচল করলেও সবসময় না। অফিস এরিয়া সম্পূর্ণ নতুন তার জন্য।
-“মাথা কী পুরোই গেছে?”
পেছন থেকে আরিভের চেঁচানোর আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে উঠল নাফিয়া। টালমাটাল হয়ে পড়ে যেতে নিলেই আরিফ বাহু এলিয়ে দেয়, ধরে ফেলে।
নাফিয়া আরিভের বুকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। বলল,
-“এভাবে কেউ চিৎকার করে?”
-“আমি করি! তোমার সাহস কী করে হল একা একা এখানে আসার?”
বলেই নাফিয়ার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিজের হাতে নিল। এক হাতে পেঁচিয়ে নিল বেল্ট। নাফিয়া কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। মস্তিষ্কে তাড়না দিল এক। স্কুল থেকে ফেরার সময় বাবাও ঠিক এইভাবে তার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিত।
-“বোবা হয়ে গেছ?”
চেতনা ফিরল আরিভের ধমকে। নাক মুখ কুঁচকে ফেলে নাফিয়া। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
-“ধমকাবেন না।”
-“ধমকাব না, তুলে আছাড় দিব একটা।”
-“সাহস থাকলে দিন।”
আরিভ এগিয়ে আসলেই নাফিয়া পেছনে সরে যায়। বলে,
-“একদম কাছে আসবেন না। আমি চেঁচিয়ে মানুষ জড়ো করব।”
আরিভ পকেটে হাত গুঁজে। তীর্যক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
-“আচ্ছা, কী বলবে মানুষ জড়ো করে?”
-“বলব এইযে ফিটফাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা একটা ইভটিজার।”
আরিভের মুখে আসন্ন হাসিটা দমিয়ে ফেলে। তাও ঠোঁট সামান্য প্রসারিত হল। নিষ্পলক চোখে তাকাল নাফিয়ার দিকে। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। সূর্য একেবারে মাথার উপর।
-“কতক্ষন যাবত দাঁড়িয়ে আছো?” শান্ত গলায় শুধায় আরিভ।
-“এইতো আধ ঘণ্টা।”
আরিভের মেজাজ আরও তুঙ্গে ওঠে। বলে,
-“আধ ঘন্টা আগে কল করা যেত না?”
-“আপনিইতো বলেছেন আপনার লাঞ্চ আওয়ার আড়াইটে বাজে। তাই আগে আগে বিরক্ত করিনি।”
-“আহারে আমার সতী সাবিত্রী নারী! ভালো মানুষের আত্মা ভর করেছে নাকি? নাকি ভং ধরছ? পাত্তা দিচ্ছি না তাই?”
-“ইশ! আমারতো বয়েই গেছে আপনার পাত্তা পাবার জন্য।”
-“তাহলে এসেছ কেন?”
ফেঁসে গেল। এবার উত্তর কী দিবে? মূলত এসেছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজে। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের তর্ক চলছে। হারা যাবে না কিছুতেই। নাফিয়া তার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখেই বলল,
-“আসতেই পারি… কেন এই রাস্তা কী আপনার? নাকি এই অফিসটা আপনার কেনা?”
ভ্রু উঁচু করে তাকায় আরিভ। বলে,
-“একা এসেছ, একাই থাক আবার একাই চলে যেও। টাটা।”
বলে আরিভ হাঁটতে করে উল্টো ঘুরে। নাফিয়ার ব্যাগটা তারই হাতে। হাঁটতে হাঁটতে কিছু পথ এগোয়। নাফিয়া দৌঁড়ে গেল। ইন করা শার্টের পেছন দিক আলতো করে টেনে ধরল,
-“আপনি আমার ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? চোর কোথাকার!”
-“আমি চোর? ব্যাগটা ফেলে দেই?”
এক হাতে ব্যাগ রাস্তার ড্রেনের দিকে এগিয়ে দিল। ফেলবে ফেলবে ভাব। ভয় দেখাচ্ছে নাফিয়াকে। নাফিয়া বিচলিত কন্ঠে বলে উঠে,
-“ফেলবেন না প্লীজ। এটায় খাবার আছে।”
-“খাবার কীসের খাবার?”
-“বলব না।”
আরিভ ধমকের সুরে বলে উঠল, -“নাফি!”
নাফিয়া তর্জনী আঙুল তুলে আরিভকে শাসিয়ে বলে,
-“একদম ধমকাবেন না। আপনাকে ড্রেনে ফেলে দিব। আমি সকাল সকাল উঠে রান্না করেছি। সাদিফ ভাইকে ঘুষ দিয়ে আপনার অফিসের এড্রেস নিয়েছি। খাবার চোরের মত লুকিয়ে প্যাক করেছি। মা’কে মিথ্যে বলে বেড়িয়েছি জীবনে প্রথমবার। এসব কেন করলাম? একটা জল্লাদ লোকের জন্য। আর সে আমার সঙ্গে ভাব দেখাচ্ছে।”
আরিভ বিষম খেয়ে নাফিয়ার রাগী মুখের দিকে চেয়ে আছে। সূর্যের দীপ্তির মত মুখখানা। তার চেয়ে বয়সে বড় লোকটিকে শাসাচ্ছে, রাগ দেখাচ্ছে। অধিকারবোধের সাথে কথা বলছে। মুগ্ধ করল বিষয়টি আরিভকে। এগিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে বলল,
-“রাগ করেনা।”
নাফিয়া হাত সরিয়ে দিল। মুখ ফিরিয়ে ফোস ফোস করছে। ভীষণ রেগে গেছে সে। অবশেষে হার মানতেই হল আরিভের। বলল,
-“ক্ষিদে পেয়েছে। সামনেই একটা ছোটখাটো পার্ক আছে সেখানে বসি?”
-“আপনি গিয়ে বসুন।”
-“তুমি বউদের মত আচরণ করছ জানো?”
নাফিয়া বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় আরিভের দিকে। তাকানোর সাথে সাথে পুনরায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার কাছে আরিভের বলা কথাটি ভয়াবহ। সত্যিই বউদের মত আচরণ করে ফেলেছে?
-“বউ হওয়ার প্র্যাকটিস করছো?”
-“মোটেও না।”
-“মোটেও হ্যাঁ।”
-“আপনার মাথা।”
-“আমার মাথা আমার ঘাড়ের উপর।”
আরিভ এগিয়ে এল। নাফিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। পার্কটা গাছপালায় ঘেরা। অফিসের পোশাকে অনেক মানুষ এখানে দুপুরের অবসরে বসে। কেউ খাবার খাচ্ছে, কেউ দলবেঁধে আড্ডায়, কেউ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।
বেঞ্চিতে বসল আরিভ। নাফিয়া তার থেকে দূরে বেঞ্চির অন্যপ্রান্তে গিয়ে বসল। মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। আরিভ অনুমতি ছাড়াই নাফিয়ার ব্যাগ থেকে খাবার বের করে প্রশ্ন করে,
-“কী রেঁধেছেন আমার জন্য?”
-“ঘোড়ার ডিম!”
-“যেহেতু আপনি রেঁধেছেন সেহেতু ঘোড়ার ডিম খেতেও রাজি।”
-“হুহ! ঢং!”
মধ্যিখানে থাকা ব্যাগটা সরিয়ে দিল আরিভ। কাছে এসে বসল। খাবারের বক্স খুলে দেখল ইলিশ পোলাও। পুরুষের মন যেন গলে প্রিয় খাবারে। সাথে যদি প্রিয় মানুষ থাকে, তাহলে তো কথাই নেই।
খাবারের বক্স নাফিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“খাইয়ে দাও।”
-“একদম অসভ্যের মত কথা বলবেন না। আশপাশে মানুষ।”
-“তো?”
-“পারব না আমি।”
-“ক্ষিদে পেয়েছে কিন্তু।”
-“চামচ আছে নিজে খেয়ে নিন।”
-“আমার হাতে ব্যথা।”
-“আর আমার হাত অচল।”
আরিভ রাগ হল। সাথেসাথে নাফিয়ার মাথায় ধীরে চাপড় মারলো। চোয়াল শক্ত করে বলল,
-“হোক অচল। বাম হাত দিয়েই খাইয়ে দিবে। কে কীভাবে তাকাবে, কী ভাববে আই ডোন্ট কেয়ার। চামচ হাতে তুলো। নয়তো এক সপ্তাহ কেন আগামী এক যুগ অব্দি আমাদের কথা আর দেখা বন্ধ থাকবে। নাও চয়েস ইজ ইউর্স।”
চলবে…