#বৈরী_বসন্ত ২১
লেখা – আয্যাহ সূচনা
-“আমি আপনাকে বিয়ে করব না। করব না, করব না!”
দারুন হাতের লেখা। মোড়ানো কাগজটা দুমড়ে-মুচড়ে আছে। এই মাত্র পাশের বারান্দা থেকে এসে কেউ একজন উড়িয়ে ছুঁড়ে দিয়ে গেল তার দিকে। কাজ সেরে দৌঁড়ে পালিয়েছে। তিনবার বিয়ে করব না লিখেছে। অর্থাৎ সে সিরিয়াস। কিন্তু তার সিরিয়াসনেসে হাসি পেলো আরিভের।
মনে মনে বলে উঠল, -“তুমি করবে, তোমার ঘাড়ও করবে।”
আরিভ আড়মোড়া দিতে দিতে ঘরের দিকে গেল। নাফিয়ার দেওয়া প্রত্যাখানের কাগজটি তার হাতেই। এসে ডায়রীর মধ্যিখানে রেখে দিল। পরিকল্পনা করল ভবিষ্যতে তার বাচ্চাদের দেখাবে। বলবে, তার মা তাকে প্রত্যাখান করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি, তার বাবা ঠিকই তাকে বিয়ে করেছে। আজগুবি ভাবনায় নিজেই হেসে নিল একদফা। দাঁড়াল আয়নার সামনে। নিজেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল ভালোভাবে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল,
“শুধু আরিভ থেকে নাফিয়ার বর আরিভ হিসেবে তাকে কেমন দেখাবে?”
উত্তরটাও নিজেই দিল নিজেকে, “অল পারফেক্ট, শুধু ভুঁড়ি কমাতে হবে।”
শিরীন বেগম এলেন ঘরে। এক গ্লাস দুধ তার হাতে। ছেলেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলেন,
-“কী করছিস?”
-“আম্মা দেখো তো তোমার ছেলেকে জামাই হিসেবে কেমন লাগবে?”
শিরীন বেগম আরিভের দিকে চেয়ে জবাব দিলেন,
– “জঘন্য! নাফি আরও ভালো ডিজার্ভ করে।”
-“এতো ভালো আবার নাফির স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না আমি। আমি একটু খারাপ নাফির জন্য ভালো।”
শিরীন বেগম কিছু বললেন না। দুধের গ্লাস এগিয়ে দিলেন। এখনও দুর্বলতা আছে আরিভের। সেটিই দূর করতে হবে। আরিভ দুই ঢোকে গ্লাস শেষ করে বলে উঠে,
-“আম্মা চলো বিয়ের শপিংয়ে যাই।”
-“এতো তাড়া! বাব্বাহ!”
-“যত তাড়াতাড়ি বিয়ে করব তত ভালো। ওই মেয়ের মাথায় দুয়েকটা তার ছিঁড়ে গেছে, জোড়া দিতে হবে।”
-“নাফি কী রাজি?”
-“না।”
শিরীন বেগম অবাক হয়ে বলে উঠেন, -“রাজি না হলে কীভাবে?”
-“কীভাবে কী? এভাবেই। বিয়ে হচ্ছে, ওর মতামত দিয়ে কী আসে যায়?”
-“জোর করে বিয়ে করবি বুঝি?”
আরিভ দাঁত বের করে হেসে বলল,- “হ্যাঁ।”
-“মেয়েটাকে সিদ্ধান্ত নিতে দে। বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়।”
আরিভ শিরীন বেগমের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
-“ছেলেখেলা নয়। অনেক দায়িত্বের, অনেক স্যক্রিফাইসের। আমি সবই জানি মা। আমি তোমাকে আর বাবাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। দেখেছি দুজন কীভাবে তাল মিলিয়ে সংসারটাকে টিকিয়ে রেখেছো।”
-“শুধু দেখলে হবে? শিখেছিস কিছু?”
-“শিখছি।”
আতাউর সাহেব ঘরেই আছেন। স্ত্রী আর ছেলের কথা শুনে ঘরে এলেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-“এতো উতলা হতে হয় না বাবা। বিয়ের আগে আমিও উতলা হয়েছিলাম তোর মায়ের জন্য। এখন আমার অবস্থা দেখ? নিজের ঘরেই ভয়ে কুঁকড়ে থাকি।”
আরিভ ঠোঁট টিপে হাসল। শব্দ করে হাসা যাবেনা। মায়ের হাতের উপর ভরসা নেই। উরাধুরা চলতে শুরু করলে থামবে না। আতাউর সাহেব দারুন মানুষ। হাসি ঠোঁট থেকে সরে না, মোটেও গম্ভীর নন। তার কিছু স্বভাব আরিভের মধ্যে এসেছে। আতাউর সাহেবের এরূপ কথায় শিরীন বেগম জবাব দিলেন,
-“ভয় পাওয়ার মত কাজকর্ম করলে ভয় দেখাবো না?”
আতাউর সাহেব আরিভের দিকে চেয়ে বললেন,
– “ঘরের বাহিরে পুরুষ বাঘ, আর ঘরে বিড়াল। তোরও দিন আসছে, নিজেকে শক্ত কর বাবা। সামনের পথ ভীষণ ভয়াবহ আর কঠিন।”
শিরীন বেগম বলে উঠেন,
-“একদম উল্টোপাল্টা শেখাবেন না আমার ছেলেকে।”
আতাউর সাহেব জবাবে বললেন,
-“সত্য বলেছি।”
-“বাপ ছেলেকে নিয়ে আর পারলাম না!” বলে স্থান ত্যাগ করেন শিরীন বেগম।
__________
-“কতবড় সাহস দেখেছিস? অন্য মেয়েদের সাথে হেসে হেসে কথা বলে আর আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।”
ছাদে গোল হয়ে বসেছে সাদিফ, নাফিয়া আর জোহান। সাদিফ মুখে কুলুপ এঁটেছে। সেদিন মার খেতে খেতে বেঁচেছে। আজ মুখ খুললে তারই বিপদ।
কিন্তু জোহান পূর্ণ সায় দিল নাফিয়ার কথায়। বলল,
-“ঠিক বলেছো নাফিপু। আরিভ ভাই লোকটা মোটেও সুবিধার না।”
-“সেটাই তো! ডাইরেক্ট বিয়ে? আমার কী বিয়ের বয়স? তাও আবার ওনার মত বুড়ো একটা লোককে? আমাদের মধ্যে ৮ বছরের গ্যাপ।”
জোহান আঙুলে গুনতে শুরু করল। গুণে বলল,
-“নাহ নাফিপু এখন তোমাদের মধ্যে ৭ বছরের গ্যাপ। তোমার ১৯ বছর হয়ে গেছে।”
পেছন থেকে হুট করে সাদিফ তারই ছোট ভাইকে বলে উঠল,- “মাথামোটা!”
কিন্তু তারা দুজন চুগলি করতে ব্যস্ত। নাফিয়া বলে যাচ্ছে আর জোহান তাল মেলাচ্ছে। নাফিয়া বলল,
-“তোরা তো আমার ভাই। বলতো এই লোকটাকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়?”
-“আমার কাছে দারুন আইডিয়া আছে নাফিপু।”
নাফিয়া ভীষণ রেগে। রাগান্বিত মুখটা মিয়ে এল। আগ্রহের সাথে প্রশ্ন করল,
-“কী আইডিয়া?”
-“ওনাকে আমরা রাতে ডাকব। বলব নাফিপু কথা বলতে চায়, এরপর ওনার মুখে কালো কাপড় বেঁধে ওনাকে তোমাদের বাড়ির গ্যারেজে নিয়ে বেধড়ক পিটুনি দিব।”
নাফিয়ার মুখটা কুঁচকে এল। সাদিফ আরেকদফা ভাইকে মাথামোটা বলে সম্বোধন করে। জোহান ছেলেটা কলেজে পড়ে। অথচ তার বুদ্ধি যেন হাঁটুর নিচেই পরে আছে। নাফিয়া সন্তোষ প্রকাশ করল না এই বুদ্ধিতে। মুখ ফুলিয়ে বসে রইল।
অন্যদিকে একের পর এক মেসেজ এসে যাচ্ছে সাদিফের ফোনে। সবগুলোই হুমকি। শেষমেষ একটি মেসেজে আরিভ লিখেছে,
-“নাফি কোথায়?”
এটার জবাব দেওয়াই যায়, -“ছাদে আছে আমাদের সাথে।”
-“আমি আসছি। আর খবরদার যদি নাফিকে কিচ্ছু জানাবি না।”
ঢোক গিললো সাদিফ। আরিভের কথামত মুখে তালা এটে বসে। মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে আরিভ এসে হাজির। হুট করেই আরিভকে দেখতে পেয়ে চক্ষু কপালে উঠল নাফিয়ার। ততক্ষণে আরিভ পাশ ঘেঁষে বসেছে। নাফিয়া তৎক্ষণাৎ সরে গেল। ফুঁসতে শুরু করল রাগে।
আরিভ সাদিফ আর জোহানের দিকে চেয়ে বলল,
-“কী সমস্যা? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
দুজনের আগে নাফিয়া বলে উঠে,
-“এখানে কেন এসেছেন? আমাদের বাসায় কার পারমিশন নিয়ে এসেছেন?”
-“হবু শ্বশুরবাড়িতে আসতে পারমিশন লাগবে?”
নাফিয়ার রাগ আরও তীব্র হল। ইচ্ছে করছে চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। সেটা পারবে না, অগত্যা উঠে চলে যেতে চাইল। তখনই আরিভ সাদিফের দিকে চেয়ে বলে,
-“নাফি এক কদম ছাদের দরজার বাহিরে দিলে তুই মার খাবি সাথে তোর ভাইয়ের হাড়গোড়ও বোনাস হিসেবে ভাঙব।”
নাফিয়া ঘুরে তাকায়। ফিরে এসে বলল,
– “আমার ভাইদের হুমকি দেন, সাহস তো কম নয় আপনার।”
আরিভ শয়তানি হাসি হেসে বলল,
– “হবু শ্যালকদের হুমকি দিয়েছি।”
-“চুপ থাকুন আপনি। এটা আপনার শ্বশুরবাড়ি না, আর ওরা আপনার শ্যালকও না।”
আরিভ নাফিয়ার কথায় কোনো গুরুত্ব দেয়নি। যেন শুনেই নি তার কথা। সামনে থাকা দুজনের দিকে চেয়ে বলল,
-“ভাগ এদিক থেকে।”
সাদিফ ভদ্রভাবে উঠে গেল। সাথে টেনে জোহানকেও নিয়ে যাচ্ছে। নাফিয়াও তাদের পিছু নিল। আরিভ এক লাফে উঠে দাঁড়ায়। দৌঁড়ে গিয়ে হাত টেনে ধরে বলল,
-“আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি?”
নাফিয়া ভয় পেল না। বরং দ্বিগুণ ঝাঁঝাল কন্ঠে বলে উঠল,
-“আপনি কে আমাকে অনুমতি দেওয়ার?”
রাগী চেহারাটাও ভীষণ মায়াবী। অদ্ভুতভাবে টানছে আরিভকে। দুহাত একত্র করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছুটা দূরত্ব কমায় আরিভ। নাফিয়া এবার পেছালো না, ভয় পেল না, বিব্রতবোধও করল না। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
-“আমি কেউ না?”
-“না কেউ না!” জবাবটা যেন ঠোঁটের ডগায় এসে ছিল।
-“সমস্যা নেই, এই শুক্রবারে হয়ে যাব।”
আরিভের কন্ঠ শান্ত- শীতল। চোখজোড়া ক্ষুদ্র তবে গভীর অর্থবহ। নাফিয়া নিস্তেজ হয়ে যেতে চেয়েও নিজেকে শক্ত করে রেখেছে।
-“কী হবেন?”
-“হবো খুব কাছের একজন।”
আরিভ অন্যহাতে নাফিয়ার কপালের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল। লোকটা তাকে শক্ত থাকতে দিবে না। দূর্বল হয়ে আসছে। ঠিক তখনই সেদিনের কথা মনে এসে গেল। নাফিয়া দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
-“কেউই হবেন না। আপনাকে আমি বিয়ে করব না। একদম করব না।”
-“কেন করবেন না?”
-“কারণ আপনি ভালো লোক না।”
-“খারাপ কী করলাম?”
-“অন্য মেয়েদের সাথে এভাবে হেসে কথা বলেন? নিশ্চয়ই আরও মেয়েদের সাথে এভাবেই খাতির জমিয়েছেন? ওই মেয়ের জন্যই পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে অফিস চলে গিয়েছিলেন তাই না?”
আরিভ হেসে ফেলে। বলে,
-“তোমার কী হিংসে হচ্ছে?”
-“জি না।”
-“তাহলে রাগ দেখাচ্ছো কেন?”
-“বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন কেন?”
আরিভের হুট করেই মনে হল সেই এলোমেলো হয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলোই ভালো ছিল। এই পরিপাটি রূপ ভালো লাগছে না। আবারো কানের পেছন থেকে চুলগুলো নিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
-“বিয়ে করতে চাই, তাই দিয়েছি।”
নাফিয়া মুখ ঘুরিয়ে বলল,- “আমি করব না বিয়ে।”
-“বিয়ে আমাকেই করতে হবে। আজ হোক, কাল হোক। যেদিনই হোক আমাকেই করতে হবে। তাছাড়া তোমার কাছে অন্য কোনো অপশন নেই নাফি।”
-“অপশন খুঁজে নিব।”
হাতে চাপ পড়ল। সামান্য ব্যাথা অনুভব করল নাফিয়া। ব্যথিত চোখে চাইতেই দেখল আরিভের মুখখানা আর শীতল নেই। রাগ ফুটে উঠেছে কপালে। সেটি কন্ঠেও প্রকাশ করে বলল,
-“খবরদার এসব কথা যদি আবার মুখে এনেছো! সামনের শুক্রবার ভালোয় ভালোয় কবুল বলবে, নয়তো বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাব।”
-“আপনি কী গুন্ডা?”
-“হলাম নাহয় একদিনের জন্য।”
নাজুক মেয়েটি। ছোটবেলা থেকে আহ্লাদেই বড় হয়েছে। সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের মত মুখমন্ডল তার। অভিমান চোখে জমা। নাফিয়া হুট করেই দমে গেল, দৃষ্টি নত করল। শিশির জমেছে নেতিয়ে থাকা চোখে। বুঝতে পারছে তার বাড়াবাড়ি, কিন্তু মন কিছুতেই মানতে পারছে না সেদিনের বিষয়টি। আরিভকে অন্য মেয়ের সাথে হেসেখেলে কথা বলতে দেখে ভার হয়ে আসছে বারবার মন।
আরিভ থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে মুখ তুললো। ঠিক তখনই দুই চোখের কোণ বেয়ে ঝরে গেল শিশির কণা। আরিভ হাতের বাঁধন আলগা করে দুহাতে আগলে নিল প্রিয়তমার মুখখানা। বলল,
-“জানি তোমার মনের অবস্থা। মেয়েরা অভিমানী হয়, অল্পতে কষ্ট পেয়ে বসে থাকে, অযথাই উল্টোপাল্টা ভাবে।”
নাফিয়া বলে উঠল,
– “সাদিফ ভাইয়ের বলা কথা আর সেদিন ওই আপুর সাথে আপনার হেসে হেসে কথা বলা, এসব কী ভুল?”
-“অবশ্যই ভুল। দিবা আমার কলিগ। কাকে বিশ্বাস করতে হবে, সেটা বুঝতে শিখো। সাদিফকে ভালোভাবেই চেনো তুমি, সে এক বাক্য বললে সেখানে বেশিরভাগ শব্দই মিথ্যে। দুষ্টুমির ছলে বলেছে, আর তুমি বিশ্বাস করে বসে আছো বোকা মেয়ে।” বলে সামান্য হাসল আরিভ।
তার হাসি দেখতে চেয়েও দেখল না নাফিয়া। কেন এত ভাবছে জানা নেই, বারবার মনে ভয় আরিভও যদি তার অপূর্ণতার দোহাই দিয়ে চলে যায়? তাকে ভুলে যায়? তাকে কষ্ট দেয়?
-“কাকে বিশ্বাস করব, জানি না।”
আরিভ গোল উঁচু করে জবাব দেয়,
– “আমাকে, শুধুই আমাকে বিশ্বাস করবে।”
-“আপনি ভালো না।”
-“খারাপ হলেও তোমার।”
তৎক্ষণাৎ চোখ তুলে তাকায় নাফিয়া। খারাপ হলেও তোমার কথাটি কর্ণপাত হওয়ার সাথেসাথেই সর্বাঙ্গ জুড়ে এক শীতলতা বয়ে গেল। আরিভ বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে সিক্ত ললাট মুছে দিয়ে বলে,
-“আমার চোখ তোমাকে দেখে ফুরসত পায় না, আশপাশের চাকচিক্য আমার কাছে ভীষণ তুচ্ছ। তুমি আসবে বলে অন্য কোনো নারী আমার জীবনে কখনোই পদার্পন করেনি, আর কখনও করবেও না। সেই সুযোগ নেই, সুযোগ শেষ করে দিয়েছি।”
-“হুম।”
-“হুম? শুধু হুম? এতবড় স্পিচ দিলাম এর বদলে শুধু হুম? তুমি ভীষন আনরোমান্টিক নাফিয়া।”
নাফিয়ার ভ্রুদ্বয়ের মধ্যিখানে গাঢ় তিনটে ভাঁজ পড়ল। মনে মনে ভাবল, রোমান্টিক হওয়ার কথা ছিল বুঝি? আরিভ বলে উঠে,
-“ব্যাপার না। বিয়ের পর রোমান্স শিখিয়ে দিব।”
-“আপনি এতটা অশ্লীল কেন?”
হো হো করে হেসে ফেলে আরিভ। বুক ফুলিয়ে বলল,
-“আমি রোমান্টিক প্রকৃতির লোক, অশ্লীল না।”
-“নির্লজ্জের মত কথাবার্তা বলেন, আবার সেটি বুক ফুলিয়ে জাহির করছেন। লজ্জা হওয়া উচিত।”
-“আমার লজ্জা ছোটবেলা থেকেই একটু কম।”
-“সেটা বোঝাই যায়।”
-“আচ্ছা লজ্জা শরমের হিসেব পরে করব। আগে বলো বিয়েতে কী রঙের শাড়ি পড়বে? যদিও তোমাকে সব রঙে মানাবে।”
এবারে লজ্জা গ্রাস করল নাফিয়াকে। চোখ নামিয়ে ফেলল। আরিভের বোঝানোতে বুঝে গেছে, কিন্তু এখন যে বিয়েটাও করতে হবে সেটা ভুলতে বসেছিল।
-“কী হলো বলো? নাকি বিয়ে করার ইচ্ছে নেই?”
নাফিয়া ঠোঁট কামড়ে বলে উঠে, -“নেই।”
-“সামান্য অভিমান করেছো বলে বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছি, বিয়েতে টালবাহানা করলে বাংলা সিনেমার মত তুলে নিয়ে কপালে বন্দুক রেখে বিয়ে করতে দু’বার ভাববো না।”
-“আপনার কাছে বন্দুক আছে বুঝি?”
ডায়লগবাজি করতে গিয়ে নাফিয়ার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। আরিভের মুখ বন্ধ করে দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে নাফিয়া। আরিভ হুট করে বলে উঠল,
-“আমার লাগামছাড়া ইচ্ছেরা বলছে, এক্ষুনি তোমার হাসিমাখা গালে অধর ছুঁয়ে দিতে। তবে নিজেকে দমিয়ে নিলাম, তোলা থাকল।”
নাফিয়ার ফোলা গাল টেনে দিয়ে বলল,
– “এখন আসি, হবু বউ। টাটা।”
চলবে….
#বৈরী_বসন্ত ২২
লেখা – আয্যাহ সূচনা
নাফিয়ার পেট গুলিয়ে আসছে। হুট করেই ঠাওর করতে পারে, বিয়ের মত একটা বড় সিদ্ধান্ত তার জন্য নেওয়া হচ্ছে। বাহিরেই শিরীন বেগম, আতাউর সাহেব বসে আছেন। সাথে আরিভও। কথা বলছেন সিদ্দিক সাহেব ও রেশমা বেগমের সঙ্গে। টুকটাক কথাবার্তা আর হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে ঘরে। অল্পস্বল্প আওয়াজ বুক কাঁপিয়ে তুলছে নাফিয়ার। কালচে সবুজ রঙের সেলওয়ার কামিজ পরনে, মাথায় সামান্য কাপড় টানা। বিছানায় মূর্তির মত বসে অনুভব করছে হৃদপিণ্ডের বেগতিক স্পন্দন। শ্বাস কষ্ট উঠে যাবে হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যেই।
ঠিক তখনই রেশমা বেগমের সঙ্গে শিরীন বেগম ঘরে এলেন। এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়ল নাফিয়া। অনেকটা ঘাবড়ে উঠেছে। নাফিয়াকে এরূপ আতঙ্কিত হতে দেখে শিরীন বেগম বলেন,
-“ভয় পেয়েছো?”
-“হ্যাঁ… না, আসলে..”
আবোলতাবোল বলছে নাফিয়া। হুট করেই গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেল। শিরীন বেগম হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-“ভয়ের কিছু নেই, মা। আমি তোমাকে তোমার বিয়ের শাড়ি দিতে এসেছি।”
বিয়ের শাড়ি? এর অর্থ কী কথা পাকা হয়ে গেছে? অবস্থা আরও নাজুক হতে শুরু করে নাফিয়ার। খিচে চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
শিরীন বেগম হাত টেনে নাফিয়াকে পাশে বসালেন। শাড়ির বক্স এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“আমার ছেলেটা পাগল। যেদিন থেকে তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি, এর এক দিন পরই আমাকে নিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করে ফেলেছে। তোমাদের তরফ থেকে কী উত্তর আসবে সেই অপেক্ষাও করেনি।”
বলেই হেসে ফেলেন শিরীন বেগম ও রেশমা বেগম। শাড়ির বক্স খুলে গাঢ় মেরুন রঙের শাড়িটি গায়ে জড়িয়ে দেখলেন। রেশমা বেগমের চোখ আকস্মিক ঝাপসা হয়ে আসে। তার মেয়েকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে। শিরীন বেগম বলে উঠলেন,
-“ভীষণ মানাচ্ছে তোমাকে রংটা। তোমার ভালো লেগেছে নাফি?”
নাফিয়া গায়ে জড়ানো শাড়িটা দেখল। নরম তুলতুলে, রংটি মনে ধরার মত। নিশ্চয়ই আরিভের পছন্দ। তাইতো সেদিন জানতে চেয়েছিল। নাফিয়া লাজুক গলায় বলে উঠল,
-“জি পছন্দ হয়েছে।”
-“তুমি আরিভকে বিয়ে করতে রাজি তো? ও একটু অন্যরকম, কখনও রসিক আবার কখনও রাগী, কিন্তু দায়িত্বহীন না।”
প্রশ্নের জবাব তার হৃদয় আগেই দিয়েছে। কিন্তু সেটি মুখে ফুটবে কী করে? ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল। আতাউর সাহেব আর সিদ্দিক সাহেব দাঁড়িয়ে। অনুমতি চাইলেন,
-“আসবো?”
রেশমা বেগম চোখ মুছে জবাব দিলেন,
– “জি আসুন, ভাইসাহেব।”
আতাউর সাহেব ঘরে ঢুকে নাফিয়াকে দেখেই বললেন,
-“বাহ! দারুন লাগছে তো আমার হবু বৌমাকে।”
নাফিয়া লজ্জায় আরও নতজানু হয়ে এল। সেদিন আরিভের মুখে হবু বউ শব্দজোড়া শুনে হতভম্ব হয়ে ছিল। আজ আরেকটা নতুন ডাক, ‘ বৌমা ’। এই নিত্য নতুন ডাকে পাগলপ্রায় অবস্থা নাফিয়ার।
সিদ্দিক সাহেব আতাউর সাহেবের দুহাত ধরে বলে উঠলেন,
-“ভাই প্রতিটা বাবা চায় মেয়েকে একজন যোগ্য ভালো কারও হাতে তুলে দিতে। প্রতিটা বাবা মেয়ের ক্ষেত্রে ভীষণ লোভী। আপা যখন আরিভের জন্য প্রস্তাব দিলেন আমি সাথে সাথেই রাজি হয়েছি। শুধুমাত্র মেয়ের ভালো থাকার লোভে। হ্যাঁ, এটাকে আমি লোভই বলব, আমি ভেবেছি আরিভের চেয়ে আর ভালো ছেলে পাবো না আমি মেয়ের জন্য। আর আমার মেয়েটাও আমার চোখের কাছে থাকবে, এই সুযোগ কী করে হাতছাড়া করি বলুন?কিন্তু আমার মেয়ের যে কিছু অপূর্ণতা আছে। এতে আমার মেয়ের কোনো দোষ নেই। দোষ আমার, আমার খামখেয়ালীতে আমার মেয়েটার এতবড় বিপদ হয়েছে। সব ঠিক থাকা সত্ত্বেও তাকে মানুষের মুখে কিছু নোংরা শব্দ শুনতে হয়। আমি কথা দিচ্ছি আমার মেয়ে আপনার ঘরের বউ হিসেবে কখনও দায়িত্ব ভালোবাসায় গাফলতি করবে না। শুধু একটাই অনুরোধ, ওর অপূর্ণতাকে ওর দুর্বলতা হিসেবে দেখবেন না।”
সোফায় বসে ছটফট করছে আরিভ। দুহাত একত্রিত করে নিচু হয়ে বসে আছে অনেকক্ষণ যাবত। সামনেই জমিলা বেগম। বেশকিছু সময় ধরেই আরিভকে পর্যবেক্ষণ করছে। আরিভও আড়চোখে কয়েকবার দেখেছে তাকে।
হুট করেই বলে উঠল, – “ভালো আছেন?”
জমিলা বেগম এমনেতেই খুশি নন বিয়েতে। তার মধ্যে আরিভের খোঁচা মারা প্রশ্ন,ব্যাঙ্গাত্মক হাসি। গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। জবাবে বললেন,
-“তোমরা ভালো থাকতে দিতাছো?”
-“কেন দাদী? আপনার নাতনীর বিয়ে, তাও আবার নায়কের মত একটা ছেলের সাথে। আপনার তো খুশিতে নাচার কথা।”
জমিলা বেগমের মুখ আরো কুঁচকে এল। বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
-“মশকরা করতাছো?”
-“আপনার সাথে তো আমার দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক হতে চলেছে, দাদী। একটু মশকরা করলাম নাহয়।”
জমিলা বেগম ফুঁসে উঠেন। তড়াক করে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন। বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছেন আরিভকে। অন্যদিকে হেসে যাচ্ছে আরিভ। মনে মনে বলে উঠল,
-“ সবে মাত্র শুরু আপনার সাথে আরও মশকরা বাকি।”
সাদিফ আর জোহান ঠিক তখনই বিনা আমন্ত্রণের মেহমানের মত ঢুকে পড়ল। আরিভকে এভাবে মার্জিত ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে দুজনের চোখ কপালে উঠেছে। দুজন এসেই আরিভের দুপাশে বসল। এমভাবে তাকিয়ে রইল যেন মিউজিয়ামে রাখা কোনো ঐতিহাসিক বস্তু আরিভ। আরিভ চোখ ঘুরিয়ে দুজনকে দেখে বলল,
-“কী সমস্যা কী?”
জোহান বলল,- “বিয়ে করছেন তাহলে?”
-“হ্যাঁ, তো?”
-“এভাবে তো বিয়ে হবে না। আমরা আমাদের বোনকে যারতার হাতে তুলে দিব না। আপনার দুলাভাই হওয়ার পরীক্ষা দিতে হবে।”
আরিভ সঙ্গেসঙ্গে দুজনের ঘাড় চেপে ধরে দুহাতে। বলে,
-“অতি পাকনামি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিয়েতে বাঁকানো ঘাড় নিয়ে উপস্থিত হতে না চাইলে এই কেঁচির মত মুখ একদম বন্ধ রাখবি।”
সাদিফ বলল, -“শরীরে বল আছে বলে অপপ্রয়োগ করেন। দূর্বল মানুষের সাথেই পারবেন।”
-“তোর অবস্থা আমি দ্বিগুণ খারাপ করব, মনে রাখিস।”
সাদিফ দমে গেল। কিছু বলা যাবে না, নয়তো ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করবে।
কিছুক্ষন পর সকলেই নাফিয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হাসিমুখে। বিয়ে হচ্ছে এটা ফাইনাল, কিন্তু নাফিয়া কোথায়? একবারও দেখা হল না। বাহিরেও এলো না। তাকে দেখবার জন্য মনটা আনচান করছে আরিভের।
সিদ্দিক সাহেব আতাউর সাহেবের দুহাত ধরে বললেন,
-“ভাই আমি চাই নাফিয়ার পড়ালেখা শেষ হলে ওকে তুলে দিতে। এখন আকদ হয়ে থাকুক।”
আরিভের মুখটা বেলুনের মত চুপসে যায়। এটা তো সে চায় না। নিজেকে আটকালো। নয়তো লাফিয়ে বলে ফেলত, তার বউ তার কাছেই থাকবে।
আতাউর সাহেব বললেন, -“আমরা বিয়ের পর বউ নিয়েই যাব ভাই। আমাদের দূরত্ব আর কতটুকু বলুন? আমাদের মেয়ে কখনও এবাড়ি কখনও ওবাড়িতে থাকবে। ওর পড়ালেখার দায়িত্ব এখন থেকে আরিভের।”
-“কিন্তু?”
-“কিন্তু না ভাই, আমার বৌমাকে আমরা নিয়ে যাব। আপনার যখন ইচ্ছে, যত সময় ইচ্ছে মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে পারবেন। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
আরিভের নেতানো মুখে খুশির ঝলকানি। বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনের ইচ্ছে পূরণ করে দিল সে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আরিভ।
____________
দেখতে দেখতে শুক্রবার। নাফিয়া কল্পনাও করতে পারেনি সময়টা এত দ্রুত আসবে। সকাল থেকে কখনও আড়ালে, কখনও প্রকাশ্যে কেঁদে চলেছে। আজকের দিনে একবারও আরিভের কথা মনে হয়নি তার। কথা বলার তৃষ্ণা জাগেনি। অদ্ভুত ভয় পুরো মনটাকে গ্রাস করে ফেলেছে। রেশমা বেগম কেঁদেছেন, কিন্তু মেয়েকে বুঝতে দেননি। হাসিমুখেই নাফিয়ার কাপড় লাগেজে রেখেছেন।
নাফিয়ার কান্নার আওয়াজ হুট করেই তীব্র হল। জমিলা বেগমের কান অব্দি পৌঁছে গেছে। আজও তার মনে কোনো রহম হল না। বিরক্তি প্রকাশ করে নাফিয়ার সামনে এসে বললেন,
-“যত্তসব ঢং! এতই দরদ বাপ মার লেইগা তো পিরিত করতে গেছিলি কেন?”
নাফিয়া হুট করেই চুপসে যায়। সিদ্দিক সাহেব মায়ের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে মেয়ের কাছে এলেন। মেরুন রঙের শাড়িতে তাকে আর বাচ্চা মেয়ে লাগছে না। মেয়েকে দেখে হাসিমুখে বলে উঠলেন,
-“এতো কান্নার কী আছে মা? দেখো আমাকে? আমি ভীষন খুশি।”
নাফিয়া চোখ তুলে তাকাল। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। মাত্রই সিদ্দিক সাহেব নামাজ পড়ে এসেছেন। আরিভরাও চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। নাফিয়া কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠে,
-“তোমাদের ছাড়া কীভাবে থাকব আমি?”
-“আমাদের ছাড়া? কে বলল আমাদের ছাড়া? তুমি যখন তখন ডাকবে বাবাকে, দেখবে এক মিনিটে আমি হাজির। আমি তোমার জন্য সারাক্ষণ বারান্দায় বসে থাকব নাহয়। আমাদের প্রতিদিন দেখা হবে, মা।”
-“কিন্তু ওটা তো আমার বাড়ি, আমার ঘর হবেনা।”
-“এটা কোনো কথা বললে তুমি? ঐটাই তোমার আসল বাড়ি, আসল ঘর। আর আর আজ থেকে তোমার জন্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে তোমার স্বামী, অর্থাৎ আরিভ। আমার দায়িত্ব শেষ হলো, কিন্ত ভালোবাসা নয়।”
বাবার বুকে মুখ গুঁজে দিল নাফিয়া। রেশমা বেগম এসে হাত বুলিয়ে দিলেন মেয়ের মাথায়।
নীচ থেকে কিছু আওয়াজ ভেসে এল। নাফিয়া বুঝতে পারল না কীসের আওয়াজ। উঠে নীচে তাকাতেই আতকে উঠে নাফিয়া। সাদা রঙের পাঞ্জাবি গায়ে সাদিফ আর জোহানকে শাসিয়ে যাচ্ছে আরিভ। ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছেনা তাকে টাকা ছাড়া। সেসবের দিকে নজর নেই নাফিয়ার। সে নিষ্পলক দৃষ্টিতে শুধু দেখল আরিভকে। লোকটাকে একদম গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এই কয়টা দিন। আজ একবারের জন্য তার কাছেই চলে যাবে। সত্যিই তাদের বিয়ে হচ্ছে? যাকে দু চোখে সহ্য হতো না আজ তার জন্যই বউ সেজে বসে? পুরো শরীর কেঁপে উঠে নাফিয়ার। এই অনুভূতি বলে বোঝানোর মত নয়।
ভাবনায় ডুবে থাকা নাফিয়া। ঠিক তখনই কাজী সাহেব এসে হাজির হলেন। সাথে গুরুজনেরা। রেশমা বেগম মেয়েকে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলেন। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলে নাফিয়ার মন বলে উঠে,
-“সবকিছু এত দ্রুত হচ্ছে কেন? সময় এত তাড়াহুড়ো করে চলে যাচ্ছে কেন?”
হৃদয়ের ধুকপুকানি বাড়ল। মায়ের হাত খামচে ধরলো নাফিয়া। এটা ভয়? নাকি সংকোচ? বুঝতে পারছে না কিছুই। কেমন যেন সব ঘুরছে তার চোখের সামনে। গুলিয়ে আসছে। কোনো নাম দিতে পারছে না নাফিয়া এই অবস্থার। কাজী সাহেব বিনয়ের সঙ্গে কবুল বলতে বললেন নাফিয়াকে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। সিদ্দিক সাহেব এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
-“কবুল বলো, মা।”
নাফিয়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ল। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, -“কবুল।”
নিজের সঙ্গে এক প্রকার যুদ্ধ করেই তিন কবুলে গ্রহণ করেছে আরিভকে। কাজী সাহেব উঠে চলে গেলেন আরিভের কাছে। নাফিয়া মায়ের বুকে শরীরটা ছেড়ে দিলো। বলল,
-“মা আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে! আমর ভীষণ খারাপ লাগছে মা।”
রেশমা বেগম নিজের অশ্রু লুকিয়ে বললেন,
– “এমন হয় বিয়ের সময়। একটু পর দেখবে ঠিক হয়ে গেছে।”
-“আমি তোমাদের পর হয়ে গেলাম, তাই না?”
-“ধুর বোকা মেয়ে! সন্তান কখনও পর হয় বাবা মায়ের কাছে?”
আরিভ বিয়ে করতে অতি আগ্রহী আগে থেকেই। কাজী সাহেব সামনে এসে বসলে সোজা হয়ে বসল। মনের উচ্ছ্বাসটা মনের মাঝেই চেপে নিল কিছুক্ষণের জন্য। মাত্র তিনটে শব্দ আর নাফিয়া সারাজীবনের জন্য তার। এক পলক জমিলা বেগমের দিকে তাকাল আরিভ। এক বুড়িটা কোনো বাগড়া দিতে পারেনি। একেবারে চুপচাপ আছে। হয়তো চাইছে অনেককিছু বলতে কিন্তু পারছে না। আরিভ তার দিকে চেয়ে শয়তানি হাসি হাসলো। তাকে রাগিয়ে কাজী সাহেবের কথা মত এক নিঃশ্বাসে বলে উঠে,
-“কবুল, কবুল, কবুল।”
পেছন থেকে সাদিফ বলে উঠে, -“শ্বাস নিন এবার।”
কথাটি ব্যাঙ্গ করেই বলা হয়েছে। আরিভ চোখ পাকিয়ে তাকাল তার দিকে। বিয়ে হয়ে গেছে, ঘরোয়া ছিমছামভাবেই, এর চেয়ে স্বস্তির এই মুহূর্তে কিছু নেই। কিন্তু তার বউয়ের দেখা যে পেলো না? তার কী হবে? আরিভের মধ্যে শুরু হলো আরেক অস্থিরতা, নাফিয়াকে বউরূপে দেখবার ইচ্ছা।
হাঁসফাঁস করেও লাভ হয়নি। তার স্ত্রীকে লম্বা ঘোমটা টেনে বিদায়বেলায় নিয়ে আসা হল তার কাছে। ওড়নার আড়ালে থাকা মুখটা দেখা গেল না। হতাশ আরিভ। নাফিয়া রীতিমতো ভয়ে কুঁকড়ে আছে। তার ঠান্ডা হাতটা এগিয়ে আরিভের হাতে রেখে সিদ্দিক সাহেব বললেন,
-“আমি এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বাবা। মেয়েকে হাসতে হাসতে বিদায় করছি, একটুও কান্না আসছে না আমার। কারণ মেয়ে আমার চোখের কাছেই থাকবে, যখন ইচ্ছে তখন দেখতে পারব আর আমার বিশ্বাস আরিভ একজন চমৎকার জীবনসঙ্গী হবে।”
চলবে….