বৈরী বসন্ত পর্ব-২৭+২৮

0
10

#বৈরী_বসন্ত ২৭
লেখা – আয্যাহ সূচনা

নাফিয়া ডাক্তারের কাছে যেতে নারাজ। তার মতে ছোটখাটো একটা আঘাতে আবার কীসের ডাক্তার? ছোট্ট একটি বিষয় নিয়েই সকাল সকাল আরিভ আর নাফিয়ার মধ্যে তর্ক চলছে। অফিস যাওয়ার পথে রেগে গেল আরিভ। বলল,

-“তোমার হেঁয়ালিপনা আমার পছন্দ হচ্ছেনা নাফিয়া।”

-“আপনার বাড়াবাড়িও আমার পছন্দ হচ্ছেনা।”

আরিভের কথার কাটকাট জবাব দিয়ে বসল নাফিয়া। আরিভ আরও খানিকটা রেগে গেল। নাফিয়ার হাত টেনে ক্ষত স্থানটা দেখিয়ে ধমকের সুরে বলল,

-“হাতের অবস্থা দেখেছো? কেমন কালচে হয়ে আছে? তাও বলছো এটি ছোট একটি চোট?”

-“এমন ব্যাথা আমি আগেও পেয়েছি।”

-“আগের হিসাব আমার সাথে চলবে না নাফি।”

-“দেখুন…”

আরিভ হাত তুলে থামিয়ে দিল নাফিয়াকে। বলল,

-“আমি কিছুই শুনতে চাই না।”

হাত ছাড়িয়ে নিল নাফিয়া। জেদ ধরেই বলল,

-“আমি যাব না।”

-“কেন? কি সমস্যা? ডাক্তারের কাছে যেতে কি সমস্যা?”

নাফিয়ার মুখটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে এসেছে। এক অজানা ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে মুখে। আরিভ নিজেকে খানিকটা শান্ত করল। এগিয়ে এসে নরম গলায় শুধাল,

-“কি সমস্যা বলো আমায়?”

-“আমি ভয় পাই ডাক্তারের কাছে যেতে।”

-“এটা কোনো কারণ হতে পারেনা নাফিয়া।”

-“এটাই কারণ। আমি কাটাছেঁড়া সহ্য করতে পারিনা, আমার অস্থির লাগে। বাবার যখন এক্সিডেন্ট হয় তার কপালে সেলাই পড়েছিল। আমার হাতটাও সেই এক্সিডেন্টে….”

আরিভ নাফিয়ার গালে হাত রেখে বলল,

-“তুমি অতীতের একটা ফোবিয়া নিয়ে বেঁচে আছো নাফি। যেমন বাইকের ফোবিয়া কেটে গিয়েছে, এটাও ঠিক কেটে যাবে।”

-“কাটবে না। প্লীজ জোর করবেন না।”

-“আমি কোনো কথা শুনব না। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব এটাই আমার শেষ কথা।”

নাফিয়া কিছু বলতে চাইল। তার আগেই আরিভ তাকে থামিয়ে দেয়। অফিস ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল,

-“নো মোর ওয়ার্ডস। আসি, তৈরি হয়ে থাকবে।”

ডাক্তারের নামে এক অজানা ভয় কাজ করে নাফিয়ার। এক্সিডেন্ট এর পর থেকেই নিজেকে জগতের অনেককিছু থেকেই গুটিয়ে নিয়েছে। আজও বাবার কপালের ক্ষতটা দেখলে গা শিউরে উঠে। সেদিন রক্ত দেখেছিল আরিভেরও। অনেক বছর পূর্বে তার বাবাকেও দেখেছিল ঠিক একইভাবে। সাথে নিজের অকেজো হাতটাও দেখে নিল। এই হাতটাও অনেককিছু সহ্য করেছে। সেই আগেকার ফোবিয়া এখনও রয়ে গেছে। আজ নিজের হাতের সেই ছোট্ট ক্ষতটাকে বোঝা মনে হতে শুরু করল। নিজেকে দোষী করতে শুরু করল। কেন আঘাত পেতে গেল? কেনোই বা নিজের খেয়াল রাখল না?

মনের মধ্যে ভয় পুষে সারাটা দিন কাটে নাফিয়ার। মনে মনে কয়েকবার প্রার্থনাও করেছে। আরিভ যেন ভুলে যায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি অসম্ভব। জোর চলবে না তার, সেটা নাফিয়া খুব ভালোভাবেই জানে।

_________

নাফিয়ার হাতটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন ডাক্তার। ক্ষত স্থানের আশপাশে নীল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। আরিভের শার্ট অন্যহাতে খামচে ধরে বসে আছে নাফিয়া। বেশ কিছুদিন চেক করে ডাক্তার চোখ তুলে তাকালেন। নাফিয়ার ভয়ার্ত মুখ দেখে হাসলেন। বললেন,

-“আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন?”

নাফিয়া মৃদু ছটফট করে উঠল। মাথা দুদিকে দুলিয়ে না বোধক উত্তর দেয়। আরিভ তার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। আরিভ ডাক্তারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,

-“সব ঠিক আছে ডক্টর?”

ডাক্তার সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন,

-“জি ঠিক আছে। আমি ব্লাড টেস্ট দিচ্ছি। আজই করিয়ে ফেলুন। আগামীকাল রিপোর্ট নিয়ে দেখা করবেন আমার সাথে।”

আরিভ এক পলক ডাক্তারের মুখের দিকে তাকাল। মনে হল তিনি সম্পূর্ণ সত্যিটা বলছেন না। কেমন যেন অদ্ভুত ভয়ের অনুভূতি হচ্ছে আরিভের মধ্যে। চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে ডাক্তার সাহেব বলে উঠেন,

-“আগামীকাল আপনি একা আসলেই চলবে। সাথে ওনার পুরোনো ট্রিটমেন্টের ফাইলটাও নিয়ে আসবেন।”

আরিভের ভয়টা দ্বিগুণ হল। নাফিয়া আরিভের মুখের দিকে চেয়ে আছে। দু চোখে প্রশ্ন, হয়তো জানতে চাইছে কেন তাকে একা আসতে বলা হল। আরিভ নিজের মুখখানা স্বাভাবিক করে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল,

-“চলো টেস্ট করিয়ে আসি।”

চেম্বার থেকে বেরিয়ে নাফিয়া আরিভের শার্ট টেনে ধরল। সরাসরি প্রশ্ন করে বসল,

-“ডাক্তার আপনাকে একা আসতে বলল কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

-“কি সমস্যা হবে বউ? সমস্যা হলে তোমাকে সাথে নিয়ে আসতে বলতো। তোমার প্রয়োজন নেই তাই বারণ করেছে আসতে।”

নাফিয়া মলিন মুখে প্রশ্ন করে,

-“সত্যি তো? আমার ভয় করছে।”

-“সত্যি। এবার চলো। টেস্ট করিয়ে আমরা এক জায়গায় যাব।”

-“কোথায়?”

আরিভ চোখ টিপে বলল,

-“সারপ্রাইজ!”

ছোটখাটো কোনো অসুখ হলে সবসময় বাবা তার পাশে থাকতো। ওসব টেস্ট ফেস্ট করানো নাফিয়ার পছন্দ নয়। সৌভাগ্যবশত এ মুখো হতে হয়নি বেশি একটা। কালেভদ্রে ডাক্তারের কাছে আসা হয়েছে। আজ বাবার বদলে পাশে ভিন্ন একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রিয় মানুষ, তার স্বামী। তার মুখের দিকে চেয়ে বাবার একটি কথা মনে পড়ল। সেটি বাবা সবসময় বলতেন,

-“যে পুরুষকে দেখে মনে হবে সে তোমার বাবার মত করে দায়িত্ব পালন করছে, সেই পুরুষটি সঠিক জীবনসঙ্গী হিসেবে।”

আরিভের চাহনী, নাফিয়াকে রক্ত দেওয়ার সময় ভুলিয়ে ফুসলিয়ে রাখা নীরবে পর্যবেক্ষণ করল নাফিয়া। তাকে দেখতে দেখতে কখন ব্লাড নেওয়া হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি সে।

আরিভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-“দেখলে? কিছুই হয়নি। অযথা ভয় পাচ্ছিলে তুমি।”

-“আপনি সাথে ছিলেন তাই ভয়, ব্যাথা কোনোটাই অনুভব করিনি।”

আরিভ নাফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে হাসল। সময় বেশি হয়নি। আজ আরিভ অফিস থেকে দ্রুত ছুটি নিয়েই ফিরেছিল। সেই সুবাদে বিকেলের মধ্যেই ডাক্তার দেখানো আর টেস্ট করা শেষ। সন্ধ্যা নামতে অল্প কিছু সময় বাকি। আরিভ তার প্রিয় বাইক আর প্রিয় মানুষের সাথে এসে হাজির হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। বাইক থেকে নেমে কোমরে হাত রেখে নাফিয়া বলল,

-“আবারও খেতে এসেছেন না?”

আরিভের মুখে দুষ্টু হাসি। বলল, -“শুধু খেতে এসেছি?”

-“তাইতো মনে হচ্ছে।”

-“জি না। মনে আছে তোমার আমার ফার্স্ট ডেট এখানে।”

-“ডেট?”

-“হ্যাঁ ডেট। বিয়ের পূর্বে একসাথে ঘুরে বেড়ানোকে ডেট বলে।”

নাফিয়া জবাব দিল,

– “ডেট প্রেমিক প্রেমিকাদের হয়। আমরা তো প্রেমিক প্রেমিকা ছিলাম না।”

আরিভ তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

– “ছিলাম না বুঝি?”

-“জি না, ছিলাম না।”

-“ছিলাম.. আমরা প্রেমিক প্রেমিকাই ছিলাম। সেদিন থেকে যেদিন তোমার নবীন বরণ অনুষ্ঠান ছিল। তুমি শাড়ি পড়েছিলে। আমি তোমাকে দেখে ছটফট করতে শুরু করি। মিথ্যে কথা বলে আর জোর করে তোমাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসি। কেন জানো? যে সময়টুকু তুমি তোমার নবীন বরণের অনুষ্ঠানে নষ্ট করতে সে সময়টুকু আমার প্রয়োজন ছিল। খাওয়ার বাহানায় তোমাকে চুড়ি কিনে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে ছিল। ভাগ্য সায়ও দিয়েছে। শুধু চুড়ি কিনেই দেইনি, পড়িয়েও দিয়েছি।”

হা হয়ে শুনল নাফিয়া। বিস্ময়ে চোখ সামান্য কপালে উঠে গেছে। তাহলে এসব কিছুই তার বাহানা ছিল। নাফিয়া বলল,

-“কতবড় বাটপার আপনি! নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আমাকে সেদিন নবীন বরণে যেতে দেননি।”

আরিভ নাফিয়ার গাল টেনে দেয়। বাইকের চাবি এক আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,

-“স্বার্থ না বউ, ভালোবাসা উদ্ধারের জন্য।”

-“আপনি একটা চোর, বাটপার, সুযোগ সন্ধানী।”

-“সুযোগতো নিলামই না।”

আরিভের কথার অর্থ বুঝতে সময় লাগল নাফিয়ার। বুঝবার সাথে সাথে ধমকের সুরে বলল,

-“চুপ থাকুন অসভ্য লোক।”

বলে একাই উদ্যানের গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করে নাফিয়া। আরিভ দ্রুত কদমে পিছু নিল। বলল,

-“কবে বড় হবে? সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতাম তাহলে।”

নাফিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ রাঙ্গালো। বলল,

-“মুখ ভেঙে ফেলব আপনার।”

-“কেস খেয়ে যাবে।”

-“মানুষ জড়ো করব।”

-“করে কি বলবে?”

-“ঐযে, বলব আপনি ইভটিজার। আমাকে বিরক্ত করছেন।”

আরিভ সশব্দে হেসে উঠে। বলে,

-“বিয়ের ছবি আর বিয়ের কাগজের ছবি দুটোই আছে সাথে।”

এইতো কয়েক মুহূর্ত আগে রেগে ছিল, হুমকি ধামকি দিচ্ছিল, তেজ দেখাচ্ছিল। হুট করেই বিশাল গাছতলায় এসে যেন হাবভাব পরিবর্তন হয়ে গেল নাফিয়ার। নিজে থেকেই আরিভের কাছ ঘেঁষে বসেছে। বলিষ্ঠ বাহু জড়িয়ে ধরে মাথা রেখেছে সেথায় আলতো করে।

-“একটি গান আছে। সেখানে বলা আছে মেয়েদের মন বোঝা, নয়রে নয় সোজা। সরেজমিনে প্রমাণ পেলাম।”

নাফিয়া সামান্য মুখ তুলে প্রশ্ন করল, -“মানে?”

-“এইতো কিছুক্ষণ পূর্বে কেউ একজন আমাকে ইভটিজার বানাতে চাইছিল। সে এখন নিজে থেকেই সেই ইভটিজারের কাঁধে মাথা রেখে আছে।”

-“অধিকার আছে আমার তাই রেখেছি।”

-“এর মানে তুমি ইভটিজারের বউ।”

নাফিয়ার নাক মুখ কুঁচকে এল। কি বিশ্রী শোনাচ্ছে! ইভটিজারের বউ। নাফিয়া মাথা দোলালো। না বলতে চাইলো। আরিভ জবাবহীন হাসল। নাফিয়া হুট করেই মাথা তোলে। আবদারের সুরে বলল,

-“আপনার কথা শুনে ডাক্তারের কাছে এসেছি। এবার আমার কথা শুনুন।”

আরিভ দুষ্টুমি করেই কান এগিয়ে দিল। বলল,

-“বলো শুনছি।”

-“কাছে এসে শুনতে হবে কেন?”

-“কাছ থেকে ভালো শোনা যায়।”

নাফিয়া আরিভের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

-“আমাকে চুড়ি কিনে দিন।”

কখনও আবদার করেনি নাফিয়া। বিয়ের পূর্বে আরিভ কোনো উপহার নিলেই নাকচ করেছে বারবার। বিয়ের পর মেয়েটির মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখল। আরিভের সান্নিধ্য চায়, আবদার করতেও শিখেছে, আগ্রহ দেখায় বিভিন্ন কাজে।

-“আমার একঘেয়েমি কেটে গেছে। আগে সারাদিন একা পড়ে থাকতাম। কেউ ছিল না কথা বলার। মাঝেমধ্যে মা আর বাবার সাথে কথা বলতাম। তবে কোনো বন্ধু ছিল না। আমার দিন রাত এক রকম ছিল, কোনো নতুনত্ব ছিল না। বিয়ে নিয়ে ভয় ছিল। ভাবছিলাম সবকিছু বদলে যাবে, কিভাবে কি করব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিয়ে হয়ে ভালোই হয়েছে। আপনি না আসলে হয়তো আমার জীবনটা সাদা কালোর মধ্যেই রয়ে যেত। নিজের অপূর্ণতা ও একাকীত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো।”

আরিভের মধ্যে চলতে থাকা ভাবনার জবাব অজান্তেই দিল নাফিয়া। আরিভ নিজেও চিন্তিত ছিল। নাফিয়ার বয়স কম। আরিভ বেশ তাড়াহুড়ো করেই বিয়েটা করেছে। সিদ্ধান্ত সঠিক নাকি বেঠিক চিন্তা করার সময় পায়নি। তবে নাফিয়ার কথাগুলো শুনে নিশ্চিত হল। জবাবে বলে উঠল,

-“ভালোবাসি।”

নাফিয়া মুচকি হাসল। জবাব দিল না। তবে মন চাইছে বলতে। সেও ভীষণ রকমের ভালোবাসে এই অসভ্য লোকটাকে, যাকে এককালে অসহ্যকর লাগত।

-“জবাব দিতে হতো…”

-“সময় হলে দিব।”

-“সময়টা কবে হবে?”

-“সময়ের সময় হবে যখন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরিভ। উঠে গেল চুড়ির দোকানে। হাঁটু মুড়ে বসল। দোকানী মহিলার বয়স ভালোই। আরিভকে আসতে দেখে মুখে হাসি ফুটেছে তার। তড়িঘড়ি করে চুড়ি দেখাতে দেখাতে বলল,

-“কি রঙের চুড়ি লাগব কন? অল্প দামে ছাইড়া দিমু।”

আরিভ প্রশ্ন করল, -“অল্প দামে কেন ছাড়বেন?”

মহিলার মুখে আঁধার নেমে এল। বলল,

-“দুইদিন যাবত একটা চুড়িও বিক্রি করতে পারি নাই।”

আরিভ পেছনে ঘুরে তাকায়। মহিলার কাছে চুড়ি তেমন নেই। খুব অল্প একটি টুকরিতে করে নিয়ে বসেছেন। আরিভ নাফিয়াকে দেখিয়ে বলল,

-“ওই মেয়েটাকে দেখেছেন? ওটা আমার বউ। চুড়ি ভীষণ পছন্দ করে।”

মহিলাটি আগ্রহ নিয়ে তাকাল। বলল,

-“ম্যালা সুন্দর বউ আপনার।”

-“আমি এই সবগুলো চুড়ি যদি বউকে উপহার দিই সে নিশ্চয়ই খুশি হবে?”

দোকানী অবাক হলেন যেন। সবগুলো চুড়ি? কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। আরিভ হেসে বলল,

-“আমি সবগুলো নিব। বউকে খুশি করতেই হবে।”

লম্বা চওড়া হাসি ফুটল মহিলার মুখে। সবগুলো একবারে বিক্রি হয়ে গেলে তারও স্বস্তি। আরিভ এক এক করে সবগুলো চুড়ি প্যাক করিয়ে নিল। ন্যায্য দামের চেয়ে একটু বেশীই দিল। মহিলাটি নিতে না চাইলেও জোর করেই দিয়েছে।

এতগুলো চুড়ি নিয়ে নাফিয়ার দিকে তাকাতেই নাফিয়া পুনরায় ধমকে উঠে,

-“আপনাকে এতগুলো চুড়ি নিতে বলেছে কে?”

-“আমার মন।”

-“উফ! আপনাকে কিছু বলাই ভুল।”

-“তোমার একার জন্য নিয়েছি নাকি?”

নাফিয়া সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

– “আর কার জন্য নিয়েছেন? অন্য আরেকটা বউ আছে বুঝি?”

-“বউ না মা আছে। বউকে কিনে দিচ্ছি, মা’কে দিব না? না দিলে টিপিকাল বউ-শ্বাশুড়ির ইমোশনাল ড্রামা দেখতে হবে।”

-“মা আর আমি মোটেও এমন নই।”

আরিভ মাথা দুলিয়ে বলল,

-“কোনো শিউরিটি নেই বাপু। তোমাদের মেয়েদের পেট ভর্তি হিংসে।”

-“আপনার চুড়ি আপনি রাখুন। আমি নিব না।”

-“হয়েছে, ঢং করতে হবেনা। তুমি এক মিনিট দাঁড়াও আমি আসছি।”

কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে প্রশ্ন করার সুযোগটাও দিল না। আসছি বলে ঝড়ের গতিতে চলে গেল। কথাটি হজম করার সময়টুকু দেয়নি। যে গতিতে গিয়েছে ঠিক সেই গতিতে ফিরে এসেছে। এক গুচ্ছ দোলনচাঁপা হাতে। ময়লা পড়া মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল সবার সামনেই। বলল,

-“আমার দোলনচাঁপার জন্য একগুচ্ছ দোলনচাঁপা।”

চলবে….

#বৈরী_বসন্ত ২৮
লেখা – আয্যাহ সূচনা

-“আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। বলতে গিয়েও ভয়ে ভয়ে বলা হয়নি। যখন আমার এক্সিডেন্ট হয়, সব ট্রিটমেন্ট শেষে ডাক্তার বলেছিলেন যেন এই হাতের উপর কোনো প্রকার প্রেশার অথবা আঘাত না পরে। হিতের বিপরীত হতে পারে। ঠিক এই কারণে আমি চাইছিলাম না ডাক্তারের কাছে যেতে। এই বিষয়টা আমাকে অস্থির করে তুলছে বারবার।”

ডাক্তারের সামনে এসে বসেছে আরিভ। তিনি রিপোর্ট চেক করছেন। ঠিক তখনই যান্ত্রিক ফোনে এই মেসেজটি এল। পাঠিয়েছে নাফিয়া। আরিভ গম্ভীর মুখে ফোনের স্ক্রিন অফ করল। নির্বোধ দৃষ্টি তার।

হাতে থাকা রিপোর্টটি বন্ধ করে ডাক্তার আরিভের দিকে তাকালেন। নরম সুরে বলতে লাগলেন,

-“দেখুন মিস্টার আরিভ, আপনার স্ত্রীর হাত আগে থেকেই ফুললি প্যারালাইজড। সেখানে রক্ত চলাচলের গতি দূর্বল ছিল। তার মধ্যে সে ধারালো ব্লেড অথবা টিন জাতীয় কিছুর সাথে আঘাত পেয়েছে।”

ডাক্তারের কথাগুলো ধীরে ধীরে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করতে লাগল আরিভের। তারপরও শক্ত হয়ে বসে আছে। অস্থিরতার ছাপ মুখে ফুটতে দিল না। ঢোক গিলে প্রশ্ন করল,

-“মূলত কি সমস্যা হয়েছে? সহজ ভাষায় বলুন ডক্টর।”

-“জি বলছি। আপনার স্ত্রীর হাতে আঘাতের ফলে গ্যাস গ্যাংগ্রিন, অর্থাৎ এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়েছে। যা সাধারণ কোনো সংক্রমণের চেয়ে মারাত্মক। এটি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে কারণ শুরুতেই কোনো এন্টিসেপটিক ইউজ করা হয়নি। ঘন্টাখানেক সময়ে আঘাত কালচে হয়ে ইনফেকশন আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।”

এবার আর অস্থিরতা লুকাতে পারল না আরিভ। হাঁসফাঁস করতে শুরু করল। ভয়াবহতা বুঝতে পারছে না, সে আসলে বুঝতে চাইছে না। মন দারুণভাবে আনচান শুরু করল। আরিভ বিচলিত কন্ঠে জানতে চাইল,

-“ট্রিটমেন্ট কি? কি করতে হবে বলুন? আমি সব ট্রিটমেন্ট করাতে রাজি।”

-“ওয়েল, প্রাথমিক কিছু ট্রিটমেন্ট আছে। তবে সেটি কতটা কার্যকরী হবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।”

-“গ্যারান্টি নেই মানে? আমি উপায় জানতে চাচ্ছি ডক্টর।”

-“তাকে সেফ রাখার একটাই উপায়, হাতের অর্ধ ভাগ অপারেশন করে কেটে ফেলে দেওয়া। নাহয় এটি পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

কথাটি যেন বজ্রের মত পড়ল আরিভের মাথায়। অস্থির সটাং দেহটা নেতিয়ে পড়ল পেছনের দিকে। দূর্বল লাগতে শুরু করল তার। কথাটি কি ঠিক শুনেছে? নিশ্চিত হতে আবার প্রশ্ন করল,

-“নাফির হাত কেটে ফেলতে হবে? আপনি কি মাত্র এটাই বললেন?”

-“জি। সংক্রমণ বাড়লে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে। আপনি সিদ্ধান্ত নিন, কি করবেন?”

ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে আরিভ। বুক জ্বালাপোড়া শুরু করেছে। হাতটা নিয়েই মেয়েটির জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে দুর্দশায়। হতাশা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিল। বসন্ত এসেছিল এক যুগ পর তার জীবনে? তবে আবহাওয়ার পরিবর্তন হলো কেন? কেন আবার জীবন বৈরী আচরণ শুরু করেছে তার সাথে।

-“আপনি শক্ত থাকুন দয়া করে। আপনার স্ত্রী এমনেতেই দুর্বল চিত্তের মানুষ। তাকে আপনারই সামলাতে হবে।”

-“আমি… আমি বুঝতে পারছি না ডক্টর। আমার মাত্র বিয়ে হয়েছে… আমার স্ত্রী নতুন জীবন, নতুন সংসার পেয়ে ভীষণ খুশি। অন্ধকার, একাকীত্ব কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিল…”

ডাক্তার সাহেব পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। বললেন,

-“রিল্যাক্স মিস্টার আরিভ। আপনি নিজেকে সামলান আগে। আর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন। আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি। সেগুলো সময় মত তাকে দিবেন। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করিয়ে নিবেন।”

ক’দিন হল? কতদিনই বা হলো দুজনের প্রণয়ের? নতুন সম্পর্কের সবে মাত্র পাঁচদিন। জীবনের দশটি বছর আঁধারে নিম্মজিত ছিল নাফিয়া। নির্দোষ একাকীত্বকে সঙ্গী করে নিয়েছিল। তার চুপচাপ ব্যক্তিত্বের পেছনে যে চঞ্চল এক সত্তা আছে সেটির ঝলক দেখা যায় প্রায়শই। তবে পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়না। কোথাও না কোথাও নিজের অপূর্ণতার নিচে দাবিয়ে রেখেছে নিজেকে। কীভাবে জানাবে তাকে আরিভ? কীভাবে বলবে সে ঠিক বলেছিল, তার সুখ বেশিদিন সয় না।

এক বিধ্বস্ত মানব দেহ এসে হাজির হল নাফিয়াদের বাড়ির দরজায়। আজ নিজের বাড়িতে যাওয়ার পূর্বে নাফিয়াদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে আরিভ। আরিভকে দেখেই ব্যস্ত হলেন রেশমা বেগম। মেয়ে জামাইর খাতিরদারি করতে হবেতো নাকি?

-“কি খাবে বলো? চা করি? নাকি কফি খাবে?” রেশমা বেগম প্রশ্ন করলেন।

আরিভ মলিন সুরে বলল,

-“মা এসবের কোনো দরকার নেই।”

রেশমা বেগম জবাবে বললেন,

-“তা কি করে হয়? বিয়ের পর প্রথমবার এসেছো। ভুলে যেও না এখন আমরা প্রতিবেশী নই। তুমি এখন আমার মেয়ের জামাই। জামাই আদর করব না বুঝি?”

রেশমা বেগমকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। আরিভের শরীরটা আরও ছেড়ে দিল। কীভাবে বলবে? কীভাবে জানাবে?

-“মা আজ নাহয় থাকুক? আমি আপনাদের সাথে কিছু জরুরী কথা বলতে এসেছি। বাবাকে ডেকে দিবেন প্লিজ?”

রেশমা বেগম বললেন,

-“তোমার বাবা নামাজ পড়ছেন। আমি ততক্ষণে তোমার জন্য চা করি, বসো।”

আরিভ না করতে চেয়েও পারল না। ঠিক তখনই হাজির হলেন জমিলা বেগম। সোফায় আরিভের ঠিক সামনে এসে বসলেন। মুখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন, কিছু বলছেন না। আরিভের তার দিকে তাকানোর ফুরসৎ হলো না। একজোড়া নেতিয়ে থাকা চোখ ফর্সের দিকে।

সিদ্দিক সাহেব এলেন। এসেই জড়িয়ে ধরলেন আরিভকে। তার মুখটাও হাস্যোজ্জ্বল। আরিভের ভীতি দ্বিগুণ হল। সিদ্দিক সাহেব আরিভের মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন,

-“তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? খুব ক্লান্ত বুঝি?”

ধীর গতিতে মাথা দুলিয়ে আরিভ জবাব দিল,

-“না, ক্লান্ত নই।”

আরিভের হাতে থাকা রিপোর্টগুলোর দিকে চেয়ে সিদ্দিক সাহেব পুনরায় প্রশ্ন করলেন,

-“এটা? কোনো রিপোর্ট কি?”

আরিভ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। চোখ তুলে তাকায় শ্বশুড় মশাইয়ের দিকে। নিজেকে কঠোর করল যেন। বলতে লাগল,

-“বাবা আপনার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিল।”

সিদ্দিক সাহেব সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। আরিভের কথার গাম্ভীর্যে সোজা হয়ে বসলেন। কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,

-“কি কথা? কি ব্যাপারে?”

-“নাফির ব্যাপারে।”

রেশমা বেগম চা নাস্তা নিয়ে হাজির হয়েছেন। এসব দেখেও দেখল না আরিভ। খাওয়ার কোনো রুচি আপাতত তার নেই। ঠিক তখনই ফোড়ন কাটলেন জমিলা বেগম। বললেন,

-“বিয়ার মাত্র কয়দিন, এহনই জামাই অভিযোগ নিয়া আইছে তোর মাইয়ার। দেখলি?”

আরিভের মেজাজ তরতর করে তুঙ্গে উঠে গেল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দমালো নিজেকে দ্রুত। নাহয় মুখ ফসকে কি থেকে কি বলে ফেলবে, তার ঠিক নেই। কঠিন দৃষ্টিতে জমিলা বেগমের দিকে একপলক চেয়ে, সিদ্দিক সাহেবের দিকে তাকাল আরিভ। বলল,

-“কথা ঘুরাব না বাবা। নাফিয়ার হাতে ইনফেকশন, ঠিক সেই হাতে যে হাতটা প্যারালাইজড। ইনফেকশন ইতিমধ্যে হাতের কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। অতি দ্রুত সেটি অপারেশন করে…”

বলতে বলতে থেমে গেল আরিভ। গলা জড়িয়ে আসছে। নিজেকে পুনরায় শক্ত করল। বলল,

-“বাবা আমি অকেজো হাতের মেয়েকে বিয়ে করতে পেরেছি। ওর ঐ হাতটা না থাকলে আমার কিছু আসে যায়না। আমি আমার স্ত্রীকে ঠিক সেইভাবেই ভালোবাসবো, যেইভাবে এখন বাসি। অনুমতি দিন। আমি দুয়েকদিনের মধ্যে অপারেশনের ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি।”

থমথমে নীরবতা বয়ে গেল সম্পূর্ণ ঘরজুড়ে। এইমাত্র যে খবরটা পেল সেটা শুনে বিমূঢ় সিদ্দিক সাহেব এবং রেশমা বেগম উভয়েই। নারীদের চোখে জল আসে, অল্প আঘাতেই আসে। রেশমা বেগমের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল স্বাভাবিক মনে হল আরিভের কাছে, তবে সিদ্দিক সাহেবের দিকে তাকাতেই আরিভের দৃষ্টি বিষন্নতায় আটকে গেল। মধ্যবয়স্ক লোকটি, আধপাকা দাড়ি মুখ ভর্তি। সেই দাড়ি ভেদ করেই অশ্রুদানা গড়িয়ে পড়ছে। লুকোনোর চেষ্টা করল না একবারের জন্যও।

-“বাপের কপাল পুড়াইয়া এবার জামাইর কপাল পুড়াইতাছে।”

এমন পরিস্থিতিতে বাক্যটি তীরের মত আঘাত করল উপস্থিত তিনজনের কানে। কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেবার পূর্বেই বজ্র কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন সিদ্দিক সাহেব। বললেন,

-“ঘরে যান আপনি! আপনার মত মা আর দাদী কারও না হোক। এক্ষুনি ঘরে যাবেন।”

অবাক হয়ে তাকালেন জমিলা বেগম। মিথ্যে কান্না শুরু করার পূর্বেই সিদ্দিক সাহেব থামিয়ে দিলেন তাকে। বললেন,

-“খবরদার যদি কুমিরের কান্না কেঁদেছেন। আমার আমর মেয়ের আর মেয়ের জামাইর কোনো বিষয়ে একটা কথাও আপনি বলবেন না। আপনার কাছ থেকে এই অধিকার আজ আমি কেড়ে নিলাম।”

আরিভের মনের ক্ষোভ সিদ্দিক সাহেব মিটিয়ে দিয়েছেন। ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলে দাদী নামক অসভ্য মহিলার দিকে রাগী দৃষ্টি ছুঁড়লো সেও। অন্যদিকে মুখ গুঁজে মৃদু শব্দে কাঁদছেন রেশমা বেগম। সিদ্দিক সাহেব আরিভের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আরিভও উঠে দাঁড়িয়েছে। সিদ্দিক সাহেব নিজেকে শক্ত করে বললেন,

-“নাফি এখন তোমার স্ত্রী। তুমি ওর জন্য যেই সিদ্ধান্ত নিবে আমরা তাতেই রাজি। শুধু আমার মেয়েটা সুস্থভাবে বেঁচে থাকুক।”

-“থাকবে।” ছোট্ট শব্দে জবাব দিল আরিভ।

-“আর যদি সমস্যা হয় তাহলে আমার মেয়েকে আমায় ফিরিয়ে…”

-“বাবা এসব কথা বলবেন না। আমি নাফিয়াকে আমার অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে নিয়ে গিয়েছি, ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। সে আমার কাছে থাকবে, যেকোনো হালতে। আপনি ফিরিয়ে নিতে চাইলেও আমি দিব না। আমার আটকে রাখার অধিকার আছে।”

পেছন থেকে রেশমা বেগম বলে উঠলেন,

-“ওকে কিভাবে জানাবে বাবা? আমার মেয়েটা ভেঙে পড়বে।”

এই দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বড়। কিভাবে জানাবে তাকে? নাফিয়া সহ্য করতে পারবে তো? হয়তো পারবে না। সিদ্দিক সাহেব ভঙ্গুর গলায় বলে উঠলেন,

-“সহ্য করতে পারবে না আমার মেয়েটা।”

-“শিখতে হবে, শেখাব সহ্য করতে। আপনারা অনুমতি দিন।”

সিদ্দিক সাহেব কাঁধে হাত রাখলেন আরিভের। এটিকেই সম্মতি হিসেবে ধরে নিল আরিভ। বিদায় নেওয়ার পূর্বে বলল,

-“নিজের উপর জেদ করে হলেও আপনাদের শক্ত থাকতে হবে বাবা। আপনার মেয়ের জন্য নিজেদের এখনই সামলে নিন। আসি, আসসালামু আলাইকুম।”

_________

কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো হাতের সাহায্যেই মুছে নিল আরিভ। বাড়ির দরজায় পৌঁছেছে। মুখে জোরপূর্বক হাসি টানলো। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে গেল। কে দাঁড়িয়ে থাকবে সেটিও অজানা নয়।

ব্যাগটা টেনে নিজের হাতে নিয়েই মাথা এগিয়ে দিল নাফিয়া। বিয়ের পর থেকে এ যেন তাদের রীতি। আরিভ এসেই তার মাথায় হাত রাখবে। তার হাতের উষ্ণতা অনুভব করবে। স্মান হাসল আরিভ। মাথায় হাত রেখে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

-“খেয়েছো?”

-“উহু, আপনার জন্য বসে ছিলাম।”

-“খেয়ে নিতে।”

-“না। আপনি আজ এত দেরি করলেন কেন? বাইকের আওয়াজটাও তো পেলাম না।”

আরিভ নাফিয়াদের বাড়ি যাবে বলেই বাইকের কোনো প্রকার আওয়াজ হতে দেয়নি। সেসব আর বলল না তাকে। কাঁধে হাত পেঁচিয়ে বলল,

-“তাহলে নাস্তা রেডি করো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

নাফিয়ার হাসিমাখা মুখ হৃদপিণ্ড রক্তক্ষরণের ব্যাপকতা বৃদ্ধি করছে। মায়াময় মুখমন্ডল তার, যেখানে দৃষ্টি পড়া মাত্রই সম্মোহনের সাগরে ডুব দেবার ইচ্ছে জাগে। সেসব আজকের দিনে হচ্ছেনা। যতবার তাকে হাসতে দেখছে ঠিক ততবারই আসন্ন বেদনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

আরিভ ফ্রেশ হয়ে মেডিসিনগুলো নিয়ে বেরিয়ে এলো। খাবার ঘরে আসতেই শিরীন বেগম বললেন,

-“সৌভাগ্যবান তুই এমন একটি বউ পেয়েছিস।”

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে কিছুটা অবাক হল। টেবলের দিকে তাকাতেই নানান পদের নাস্তা দেখতে পেল। শিরীন বেগম বললেন,

-“এগুলো সব নাফিয়া আজ নিজ হাতে বানিয়েছে।”

আরিভ জোরপূর্বক হাসল। বলল, -“আমার বউ জানে আমাকে কীভাবে হাতে রাখতে হয়। খাবার আমার দুর্বলতা ঠিক ধরতে পেরেছে।”

-“যাক! এবার আমার আরাম করবার পালা। বউ সংসার সামলে নিবে।”

আরিভ বিড়বিড় করে বলল, -“না।”

শিরীন বেগম ঠিকঠাক শুনতে পেলেন না। জানতে চাইলেন,

-“কি বললি?”

-“হুম? নাহ! কিছুনা।”

আরিভ টেবিলে বসল। খাবারগুলো আদৌ গলা দিয়ে নামবে? কিন্তু নাফিয়া শখ করেই তৈরি করেছে। জোর করে হলেও খেতেই হবে।

-“তোমরা দুজন আমার দুপাশে বসে নাস্তা করো।”

নাফিয়া জবাবে বলল, – “আমি পরে খাব।”

-“নাহ। তোমার মেডিসিন আছে। খেয়ে নাও।”

মেডিসিনের কথা বলতেই মনে পড়ল রিপোর্টের কথা। নাফিয়া হুট করেই প্রশ্ন করে বসে,

-“ডাক্তার কি বলেছে? রিপোর্ট এনেছেন?”

সবে মাত্র খাবার মুখে তুলতেই যাচ্ছিল আরিভ। পথিমধ্যে আটকে গেল। নাফিয়া তার থমকানো মুখটা দেখে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,

-“কি হলো?”

-“না.. হ্যাঁ। রিপোর্ট নিয়েছি, মেডিসিন দিয়েছেন ডাক্তার।”

-“সব ঠি…”

আরিভ তড়িঘড়ি করে জবাব দিল,

-“হ্যাঁ সব ঠিক আছে।”

স্বল্প সময়ের জন্য পরিস্থিতি সামলে কি লাভ? এই ‘সব ঠিক আছে’ বাক্যটি দীর্ঘায়িত হবেনা। খাবার শেষে আরিভ নাফিয়াকে দেখেশুনে ঔষধ দিল। শিরীন বেগমও ঘরে চলে গিয়েছেন। আতাউর সাহেব ফের তার ব্যাবসার কাজে শহরের বাইরে।

আরিভ গিয়ে বসল ব্যালকনিতে। এই জায়গাটা তার প্রশান্তির। কিন্তু শান্তি মিলছে না কিছুতেই। চারিদিকে এক গুমোট ভাব। বাতাসে কোনো প্রাণ নেই। গোমড়া মুখে হলদে বাতির নিচে থাকা মুখখানা উঁকি দিয়ে দেখল নাফিয়া। পা টিপে এসে তর্জনী আঙুল দিয়ে খোঁচা দিল আরিভের বাহুতে। আরিভ তাকাতেই নাফিয়া ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-“কি ব্যাপার? ঘরে বউ থাকতে এখানে একা কি?”

আরিভ মৃদু হাসে। মাথার ঠিক উপরে থাকা সুইচ বোর্ড চেপে নিভিয়ে দিল জ্বলতে থাকা হলদে বাতি। নিমিষেই পুরো ব্যালকনি জুড়ে আঁধার ঘনিয়েছে। চারিদিকে গাছগাছালি। বাড়িঘরের পরিমাণ স্বল্প। আলো আসেনা লতাপাতা ভেদ করে। নাফিয়া আঁধারে হারিয়ে প্রশ্ন করে বসল,

-“বাতি নেভালেন কেন?”

হেঁচকা টান পড়ে হাতে। আতঙ্কিত নাফিয়া নিজেকে আবিষ্কার করল আরিভের কোলে। দুহাতে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে আছে লোকটা। চাঁদের মৃদু আলোয় তার জ্বলজ্বল করা নেত্রদ্বয় যে নাফিয়ার মুখের দিকে আবদ্ধ সেটি বুঝতে ভুল করল না নাফিয়া। ঘনিষ্টতায় মিয়ে গেল লজ্জাবতী গাছের ন্যায়। আরিভ ঘাড়ে মুখ গলিয়ে যেন আরও আড়ষ্ট করল নাফিয়াকে। মেয়েটি কেঁপে উঠল একদফা। পরপর উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করল গলায়। কম্পন আচমকাই থেকে বরফের ন্যায় কঠিন হয়ে গেল কায়া। আরিভ আঙ্গুলের ভাঁজে আঙুল রেখে গোঙানোর সুরে বলল,

-“চাঁদের আলো আমাদের প্রেমের সাক্ষী হোক।”

চলবে….