#বৈরী_বসন্ত ৩১
লেখা – আয্যাহ সূচনা
ওটিতে পুরোটা সময় দেহ শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিল আরিভ, যেন সে কোনো বরফখণ্ড। যার জীবন থাকতেও সে নির্জীব। একহাত মুষ্টিবদ্ধ, আরেকহাত নাফিয়ার হাতকে আগলে রেখেছে। আরিভের চোখজোড়া বন্ধ ছিল পুরোপুরি। খোলার সাহস পায়নি। কিভাবে পাবে? সামনেই তার প্রিয় মানুষের অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে? কোনো প্রেমিক হৃদয়ের সইবে এই দুর্বিষহ অবস্থা?
হাতে ব্যান্ডেজ করার পর চোখজোড়া খুলল আরিভ। বুকে হাতুড়ি পেটা এখনও থামেনি। থামবে না এখনই। ডাক্তার নিচু গলায় বললেন,
-“অপারেশন সাকসেসফুল। মিস্টার আরিভ, আপনি এখন বাহিরে যান। আমরা মিসেস নাফিয়াকে কয়েক ঘণ্টা অবজার্ভেশনে রেখে বেডে শিফট করব।”
আরিভ নাফিয়ার ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকাল। শিউরে উঠলো সর্বাঙ্গ। তার প্রিয় হাতটা নেই আর। মৃদু স্বরে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলে,
-“আমি থাকি?”
-“না মিস্টার আরিভ। এখন ওনার অবস্থা নাজুক। ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে অল্পতেই। আপনি প্লীজ কো অপারেট করুন।”
আরিভ কিছুতেই চাইছে না নাফিয়ার এই হাতটাও ছেড়ে দিতে। কিন্তু সে নিরুপায়। বাধ্য হয়ে নরম হাতটি ছেড়ে দিল। বলল,
-“ও সেন্সে আসার আগেই আমাকে ডেকে দিবেন দয়া করে। আমি চাইনা ও চোখ খুলে একা অনুভব করুক।”
রক্তিম সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশের বুকে নীলচে আর লাল রঙের আভা। হাসপাতালের করিডোরের শেষ প্রান্তে ঠাঁয় দুজোড়া পা। স্থির দেহের অভ্যন্তরের তুফান কেউ খালি চোখে দেখতে পাচ্ছে না। ক্ষুধার্ত পেট, কিন্তু মন খাওয়ার প্রতি অরুচি দেখাচ্ছে। সকাল থেকে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি পেটে। গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে।
পিঠে হাত রাখল কেউ একজন। ধ্যান ভাঙল আরিভের। পেছনে তাকাতেই মায়ের মুখ দেখে হাসার এক ব্যর্থ চেষ্টা করল আরিভ। তবে ঠিকঠাক হাসি ফুটাতে পারল না।
ছেলের হাত ধরে টেনে করিডোরের পাশে থাকা চেয়ারে বসালেন। হাতে খাবারের বাটি। শিরীন বেগম বললেন,
-“সব কথা রেখেছি তোর, সব কথা শুনেছি। এবার খেয়ে নে।”
-“আম্মা…”
-“চুপ! একদম চুপ। হা কর।”
মায়ের সামনে বাধ্য হয়েই বসলো আরিভ। বেলাশেষে দু লোকমা ভাত মুখে পড়তেই তৃপ্তি পেল আরিভ। মায়ের পরম মমতায় খাইয়ে দেয়া আরও শান্তি দিচ্ছে।
খাওয়া শেষে নিজের শাড়ির আঁচলের কোণ টেনে মুখ মুছে দিলেন শিরীন বেগম। ঠিক ছোটবেলার মত করে।
-“সমাজে অনেক মা আছে যারা ছেলের বউয়ের একটু খুত দেখলে ঘরবাড়ি এক করে ফেলে। আমার সত্যিই গর্ব হয় তুমি আমার মা।”
শিরীন বেগম ধীর কন্ঠে বললেন,
-“স্ত্রীকে ভালোবাসা অপরাধ নয়। আমার আর তোর বাবার পর তোকে তোর স্ত্রীই আগলে রাখবে।”
-“সব ভালোর মধ্যে যে একটা খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে, আম্মা।”
শিরীন বেগম শুধান,
-“মানে?”
-“আম্মা, আমি নাফিকে পুরো সত্যটা জানাইনি। ও শুধু এতটুকু জানে ওর অপারেশন। ওর হাতটা কেটে ফেলা হয়েছে সেটা ও জানেনা।”
হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন শিরীন বেগম ছেলের দিকে। তার শুরুতেই সন্দেহ হয়েছিল। নাফিয়া এত দ্রুত কি করে মেনে নিল অপারেশন করতে? এত স্বাভাবিক আচরণ কেন করছে? ভয়টা সত্যি হল তার।
-“একি করেছিস?”
-“আম্মা আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না।”
-“তাই বলে ওকে অন্ধকারে রাখবি? মিথ্যে বলে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি?”
-“মিথ্যে বলিনি, শুধু অর্ধ সত্যটা জানিয়েছি।”
-“অর্ধ সত্য মিথ্যের চেয়েও বেশি ভয়ংকর, আরিভ।”
অবসন্ন দেহটা নেতিয়ে গেল আরিভের। পরিশ্রান্ত নেত্রপল্লব। জবাবে বলল,
-“জানি…”
শিরীন বেগম উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
-“এর পরিণাম কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে জানিস?”
পরিণতি চিন্তা করা হয়নি। করতে ইচ্ছেও হয়নি। মস্তিষ্ক ভুলভাল বাক্য আওতায়। ভয় দেখায় বারেবারে। আরিভ ভাবতে চায় না। কিছুতেই ভাবতে চায় না এসব। কপালের ঘাম হাতের পিঠে মুছে বলল,
-“নাফির কাছে যাবো, আম্মা। চলো।”
শরীরে অবশিষ্ট নেই কোনো শক্তি। অপারেশন ছোটখাটো ছিল না। নাফিয়ার সর্বাঙ্গ আসাড়। মাথাটুকু নাড়ানোর শক্তি নেই। হাতের দিকে তাকানোর সুযোগ পেল না। নিস্তেজ প্রাণ হয়ে চোখজোড়া দিয়ে দেখল প্রিয় মানুষকে। সে কাছে আসছে। তার দিকে এগোনো কদম জোড়া নাফির ঠোঁটে হাসি ফোটাচ্ছে। খরায় বৃষ্টি বর্ষণ হলো তখনই যখন একজোড়া শুষ্ক ঠোঁটের ছোঁয়া পেল ললাটে। প্রশান্তি নেমে এলো কায়ায়। আর কোনো ব্যাথা নেই।
______
ঔষধ, ব্যাথার প্রভাবে কেটেছে চারটে দিন। নাফিয়ার নড়চড় করা বারণ কঠোরভাবে। সেলাইন চলছে একহাতে। অন্যহাত মোটা ব্যান্ডেজে ঢাকা। বোঝার কায়দা নেই হাতটি সম্পূর্ণ নাকি অসম্পূর্ণ। নাফি হাসছে অনেকদিন পর। সাদিফ জোহানের তর্ক দেখে। দুজন ছোট্ট একটি আপেলের স্লাইস নিয়ে ঝগড়া করছে। আরিভ তাদের বকতে যাচ্ছিল। তার পূর্বেই নাফির রুগ্ন হাসি দেখে থামল। হাসুক মেয়েটি। আর থামালো না দুই ভাইকে।
জমিলা বেগম এসেছিলেন মাঝে। তবে কোনো কথা বলেননি। তার মনে নাতনীর প্রতি মায়া এসেছে কিনা সেটা বুঝতে দেননি। দেখে চলে গিয়েছেন।
নার্স এসে নাফিয়ার বেড সামান্য তুলে দিল। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। একই অবস্থায় চারদিন যাবত। আরিভ ব্যাগ থেকে চিরুনি বির করল। আর নাফির হেয়ার ব্যান্ড নিয়ে এগিয়ে এল। বলল,
-“আসুন ম্যাডাম, আপনার খেদমত করি।”
ব্যাথাকাতর নাফিয়া কথাটুকু স্পষ্ট বলতে পারেনা। তবে মৃদু হাসল। আধো আধো স্বরে বলল,
-“দেখি.. কেমন খেদ.. মত করেন।”
আরিভ এগিয়ে গেল। পাশেই বসে থাকা দুই বাঁদরের উদ্দেশ্যে ঝাঁঝালো সুরে বলল,
-“বিদায় হ তোরা দুজন। আমি আর আমার বউ এখন কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করব। আমাদের রোমান্সে কাবাবে হাড্ডি হয়ে বসে না থেকে প্রস্থান করুন।”
দুজনের মুখ বাংলার পাঁচ এর মত হয়ে যায়। নাফিয়া চোখ গোল গোল করে তাকাল। নিভু নিভু স্বরে বলল,
-“লজ্জা নামক জিনিসটা খোদাতা’আলা আপনাকে দেয়নি।”
আরিভ শুনেও শুনল না কথাটি। সাদিফ একতরফা আশিক হয়ে ঘুরছে। বিষয়টি তার হৃদয়ে গিয়ে লাগল। বুকে হাত রেখেই উদাস মুখে বেরিয়ে গেল ক্যাবিন থেকে। জোহান বড় ভাইয়ের সাথে আঠার মতো চিপকে থাকা ছেলে। ভাইয়ের পিছু নিল সঙ্গেসঙ্গে। যেতে যেতেই বলল,
-“আমাদেরও দিন আসবে। তখন আপনার কোলে তিন চারটে বাচ্চা থাকবে, চুল পেকে বুড়ো হয়ে যাবেন।”
এইটুকু কলেজ পড়ুয়া ছেলের মুখে এসব শুনে হা হয়ে তাকালো আরিভ। নাফিয়া ফিক করে হেসে উঠে। বলে,
-“ভুঁড়ির সাথে, চুলগুলো পেকে গেলে আমি কিন্তু বাপের বাড়ি চলে যাব।”
টিটকারী গায়ে মাখার সময় নেই। আরিভ গুরুত্ব দিল না এসব ভুঁড়ি আর পাকা চুলের কথায়। এসে বসে পড়ল নাফিয়ার ঠিক পেছনে। একবারের জন্যও ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকায়নি। তাকালেই নিজেকে আর সামলানো যাবেনা।
-“চুলগুলো আঁচড়ে বেণী করে দেই, বউ?”
-“পারেন বেণী করতে?”
সত্যিই তো? বেণী কিভাবে করে? সেটাতো জানা নেই। ঠিক তখনই মস্তিষ্কে জ্বলে উঠে। আজকাল ইন্টারনেটের সাহায্যে সব সম্ভব। ফটাফট ফোন বের করে নিল। বলল,
-“ইউটিউব দেখে শাড়ি পড়িয়ে দিতে পেরেছি, বেণীও করতে পারব।”
প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাটি বলেছে আরিভ। কিন্তু করতে গিয়ে ঠিক ততটাই ঝামেলায় পড়ল। বেণী করা ট্রিকি বিষয়। অভ্যাস না থাকলে সহজেই করা যায়না। সুন্দর করে আঁচড়ে নেওয়ার পর আবার জট পাকিয়ে ফেলছে চুলে। হাত ব্যাথা হয়ে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই। কিন্তু বেণী গাথা হলো না। আরিভ বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিতে চাইল। ঠিক তখনই নাফিয়া ঝুঁকে গেল আরিভের বুকে। বলল,
-“থাকুন না, এমন অস্থির হচ্ছেন কেন। চুল বাঁধা লাগবে না।”
আরিভ খুব সাবধানে বামদিকে হাত রেখে কোমর জড়িয়ে ধরল। বলল,
-“অসস্তি হবেনা তোমার? চুল খোলা থাকলে?”
-“আপনার তো আমার খোলা চুলই বেশি পছন্দ।”
আরিভ চুলগুলোর দিকে গাঢ় দৃষ্টিপাত করে। একদম মোলায়েম নাফিয়ার চুল, কালো কুচকুচে। হাত রাখতেই পিছলে পড়ছে। আরিভ কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
-“সম্পূর্ণ তুমিটাকেই আমার ভীষণ পছন্দ।”
_____
সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করে নাফিয়াকে বাড়িতে আনা হয়েছে। দীর্ঘ ছয়দিন পর। এই ছয়দিন আরিভ বড়জোর চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। খাবার দাবারের কোনো হুশ ছিল না যতক্ষণ না শিরীন বেগমের ধমক শুনেছে।
নাফিয়াকে কোলে তুলে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় রাখল। পিঠের পেছনে বালিশ দিয়ে বলল,
-“জ্যুস আনব? খাবে?”
-“উহু।” ছোট্ট করে জবাব দিল নাফিয়া।
-“কেন? এতটা পথ জার্নি করে এসেছো। কিছু একটা খাওয়া উচিত। আমি ফ্রুট জ্যুস করে আনি।”
নাফিয়া জানে লোকটা কথা শুনবে না। খাইয়ে ছাড়বে তাকে। আর কি করার আছে তার এখানে? তাই চুপচাপ মাথা দোলায়। ঠিক তখনই নাফিয়ার চোখ গেল তার হাতের মোটা ব্যান্ডেজের দিকে। আরিভ তখন ঘরের জানালা আটকে পর্দা টেনে দিচ্ছে। নাফিয়া বহু কষ্টে বাম হাত দিয়ে ডান হাতটি তুলল। মিলিয়ে দেখল হাতজোড়া। আচমকা বলে উঠল,
-“ডান হাতটা ছোট লাগছে কেন এমন?”
রুহ উড়ে যাওয়ার মত বাক্যটি। আরিভের হাতে থাকা ফোনটি শব্দ করে জমিনে পড়েছে। ধড়ফড়িয়ে উঠল নাফিয়া। ছোট বড় হাতের আয়তন ভুলে বলে উঠল,
-“একি! এমন ভরকে গেলেন কেন?”
-“হ্যাঁ.. না। কীসব পাগলের মত কথা বলছো! হাত ছোট বড় হবে কেন। তোমার রেস্ট দরকার নাফিয়া। জ্যুস খেয়ে ঘুমাবে।”
নাফিয়া ভেংচি কেটে বলল,
– “আগে দেখেন আপনার ফোন জীবিত আছে কিনা? যে জোরে আওয়াজ হলো।”
আরিভ জমিন থেকে ফোন তুলে নিল। বন্ধ হয়ে গেছে। ফোনটা অক্ষত থাকুক আর না থাকুক তাতে তার কিছুই আসে যায় না। কিন্তু নাফিয়ার সত্য জানার ভয়? যেন খুঁড়ে খুঁড়ে খেতে শুরু করেছে হৃদপিন্ডকে। যতদিন লুকাবে? সত্যিটা নাফিয়া জানবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই।
নাফিয়ার মাথায় আবারও সেই একই চিন্তা ভর করেছে। তার হাতজোড়া সমান নয়। নিজের এসব ভাবনাকে অহেতুক বলে মনে হলেও মস্তিষ্ক শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। ততক্ষণে আরিভ জ্যুসের মগ নিয়ে হাজির হয়ে। নাফিয়ার মুখের সামনে ধরে খাইয়ে দিতে লাগল। খাওয়ানো শেষে বলল,
-“আমি যদি জীবনে খুব বড় ভুল করে ফেলি, তুমি কি আমায় ছেড়ে চলে যাবে নাফি?”
চলবে…..
#বৈরী_বসন্ত ৩২
লেখা – আয্যাহ সূচনা
জীবন উত্থান-পতনের অন্য নাম। কখনও এখানে বসন্তের ঘ্রাণ ভেসে বেড়ায় এদিক ওদিক। ফুলের প্রেমে মাতাল হয় বাতাবরণ। প্রাণীকূলে বয়ে আনে প্রশান্তি। তবে হুট করেই মোড় ঘুরে কখনও কখনও, আচমকা বসন্তের পর প্রাণচঁচল্যে কালবৈশাখীর আগমন ঘটে। বৈরী আবহাওয়া লণ্ডভণ্ড করে দিতে চায় সুখী সেই বসন্তকে। বলে বেড়ায় ঠিক সুখের যতটা অধিকার, তারও ঠিক ততটাই হস্তক্ষেপ থাকবে এখানে।
হাসপাতালের সদ্য উনিশে পা দেওয়া রমণী চিৎকার করে কাঁদছে। কন্ঠে তার আর্তনাদ। আশপাশের মানুষগুলোর দৃষ্টি জিজ্ঞাসু। কেন তার মধ্যে এত হাহাকার। রমণীর পাশে থাকা মানুষটি তাকে সামলাতে পারল না। কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারল না। মেয়েটি চিৎকার করে বলে উঠল,
-“অকেজো হাতটা কি যথেষ্ট ছিল না? এখন আমি বিকলাঙ্গ হয়ে গেলাম!”
সদ্য ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে নাফিয়ার। ড্রেসিং করাতে হবে তাই। নিজের হাতটা দেখে আতঙ্কে কেঁপে উঠে। তাকানো দায় সেখানে। ভয়াবহ অবস্থা। কাঁপতে থাকে তার সর্বাঙ্গ। ঠিক তারপরই শুরু হলো বিলাপ। তাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না আরিভ।
আরিভ বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,
– “নাফি, জান আমার একটু থামো…”
পুরো চেহারায় চোখের পানি লেপ্টে গেছে। চোখগুলোতে যেন রক্ত জমাট বেঁধেছে। সেই চিৎকার থামল। রক্তিম নেত্রদ্বয় দৃষ্টি তুলে তাকাল আরিভের দিকে। তার বুকের অংশের শার্ট খামচে নাফিয়া হাঁপিয়ে প্রশ্ন করে,
-“আপনি বলেছিলেন আমার অপারেশন হবে…. ওরা আমার হাত কেটে ফেলেছে।”
আরিভ জবাবহীন চেয়ে রইল। নাফিয়া বলল,
-“আরিভ, শুনছেন? ওরা আমার হাত কেটে ফেলেছে? ওদের এতবড় সাহস কে দিল? আমিতো দেইনি।”
আরিভ স্থির, নির্বিকার। জবাব দেওয়ার মতো ভাষা নেই। কী বলবে সে? অনুমতি আর কেউ নেই আরিভ নিজে দিয়েছে?
আরিভ ভঙ্গুর স্বরে বলে উঠল,
-“থামো, প্লীজ!”
নাফিয়া আরিভের গলায় মুখ গুঁজলো। হেঁচকি তুলে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল আবারও। সে বোঝাতে পারছে না তার মধ্যে কি চলছে। শুধু কেঁদে চলেছে।
আরিভ দুহাতে নাফিয়ার মুখখানা টেনে আগলে নিল। বলল,
-“কিছু হয়নি তোমার। হাতটি নেই, তো কি হয়েছে? আমি আছিতো। আমি তোমার ডান হাত হয়ে থাকব সবসময়। প্লীজ নাফি, এভাবে কেঁদো না।”
-“আমি কাঁদবো না বলছেন? আপনি বুঝতে পারছেন ওরা আমার কতবড় সর্বনাশ করেছে? ছোট্ট অপারেশনের কথা বলে আমার হাতটা….”
নাফিয়া থামল। তার কথাগুলো আরিভকে বারবার নীরব করে তুলছে। কোনো জবাব নেই তার কাছে। নাফিয়া ফের প্রশ্ন করল,
-“আপনি তো ছিলেন আমার সাথে? আপনি দেখেননি ওরা আমার হাত কেটে ফেলছে? আপনি থামাননি ওদের?”
এই হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি করলে থামবে? কোনো ঔষধ এখানে কাজ করবে না। ঔষধতো কেবল একটা, সামনে থাকা মানুষটির মুখের হাসি। যেটা এই মুহূর্তে অসম্ভব।
আরিভকে এমন থমকে থাকতে দেখে অবাক করা চোখে চেয়ে আছে নাফিয়া। হুট করেই কেমন করে যেন দেখল আরিভের নিষ্পলক চোখ। প্রেমে পড়া মানুষ নাকি চোখ পড়তে জানে। নাফিয়ারও মনে হলো, আরিভের চোখজোড়া কিছু বলছে। নাফিয়া লম্বাটে নিঃশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করল,
-“আপনি জানতেন?”
ব্যাস! এই প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে চায়নি আরিভ। অবশেষে তার ভয় এসে তার সামনে দাঁড়াল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আরিভ নাফিয়ার দিকে তাকায়।
নাফিয়ার সন্দেহ গভীর হয়। আরিভের হাত চেপে ধরে,
-“আপনি জানতেন?”
আরিভ হার মানলো। জবাবে বলে,
– “হুম। আমিই অনুমতি দিয়েছি। কারণ আমি চাইনি তোমাকে হারাতে। পুরোপুরি হারিয়ে ফেলার চেয়ে, কিছু অপূর্ণতা নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছি।”
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না নাফিয়া। চোখের সামনে বসা মানুষটিকে হুট করেই অচেনা লাগতে শুরু করল। কান্না থেমে গিয়ে বিস্ময় নেমেছে মুখে। আরিভ নাফিয়ার চোখে চোখ রাখতে পারল না। অগত্যা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল,
-“ইনফেকশনটা ধীরে ধীরে তোমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। যার পরিণাম ভয়াবহ হতো। তোমার হাতবিহীন আমার জীবন চলবে, তুমি বিহীন চলবে না।”
-“শেষ হয়ে যেতে দিতেন আমাকে!”
আচমকা এমন কথা শুনে রেগে গেল আরিভ সেই মুহূর্তেই। অগ্নিশর্মা হয়ে বলল,
-“এসব কথা আর কক্ষনো যেন তোমার মুখ থেকে না শুনি! মাইন্ড ইট নাফিয়া।”
-“দশটা বছর আরিভ। দশটা বছর আমি এই অকেজো হাত নিয়ে নিজেকে কোলাহল থেকে আড়ালে রেখেছি। আমার উপর দিয়ে কি গেছে শুধু আমি জানি। এখন? এখন বাকিটা জীবনও আমার কষ্ট চলবে? আরও হারাব আমি? আমিই কেন? আমি কেন বারবার কষ্ট পাব? আমি এই কষ্ট ডিজার্ভ করি? তার চেয়ে এই পৃথিবীতে না থাকা ভালো।”
-“চুপ করো নাফি!”
-“আমাকে কেন জানালেন না? কেন আমাকে না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নিলেন? একবার আদর করে বোঝাতেন, আপনার জন্য রাজি হয়ে যেতাম আমি। কিন্তু..”
-“তোমার কান্না দেখতে চাই নি, ভয় দেখতে চাইনি, অপারেশন ডিলে করতে চাইনি।”
নাফিয়া বাম হাতে আরিভের মুখে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরাল। বলল,
-“দেখুন আমিতো এখনও কাঁদছি। আপনি ভাবতে পারছেন আমার ভিতরে কি চলছে? পারছেন না আমি জানি।”
-“পারছি।”
-“পারছেন না, আরিভ। পারবেনও না।”
-“এভাবে কেন বলছো? আমি ছাড়া আর কে তোমাকে অনুভব করে? তোমার কষ্ট আমি বুঝব না? ভালোবাসিতো!”
হুট করেই নাফিয়া চুপ হয়ে গেল। থম মেরে গেল অদ্ভুতভাবে। চোখজোড়াকে পলক ফেলতে যেন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। মূর্তির ন্যায় শক্ত আর নির্জীব তার কায়া। ভাবছে বোধহয় কিছু একটা। কি আশ্চর্য! আজ নাফিয়ার ভাবনা বুঝতে পারল না আরিভ।
গুনে গুনে বিশ মিনিট পর মুখ খুলল নাফিয়া। বলল,
-“আমি বাড়ি যাব।”
গলার স্বর দৃঢ়। আরিভ থতমত খেয়ে যায়। বলে,
-“ড্রেসিং করে যাব।”
নাফিয়া সরু উত্তর দিল,
– “যা করার তাড়াতাড়ি করতে বলুন।”
নাফিয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতা দেখে বিস্মিত আরিভ। মেয়েটি একহাতে দু’গালে লেপ্টে থাকা অশ্রু মুছে নিয়েছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করছে। আচমকা কি হলো? কেন নিজেকে শমিত করে নিল নাফিয়া? আরিভের মনে হাজারো প্রশ্নের ঝড়। উত্তর মিলবে না। তাই তাড়াতাড়ি ড্রেসিং করিয়ে নেয়।
বাইক নিয়ে আসেনি আজ। সিএনজি করেই বাসায় ফিরেছে আরিভ আর নাফিয়া। পুরো পথটুকু একটা বাক্য উচ্চারণ করেনি নাফিয়া। নির্বিকার চেয়ে ছিল বাইরের দিকে। বাড়ির দরজা অব্দি পৌঁছে নাফিয়া বলে উঠল,
-“আমাকে ওবাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেবেন? আমি কিছুদিন একা থাকতে চাই। আমার সহ্য হচ্ছে না কিছু।”
আরিভ নিজের উপর তাচ্ছিল্য করে হাসে। বলে,
-“ভুল বুঝছো আমাকে তাই না?”
-“নাহ!”
-“তোমার কন্ঠে সেটি স্পষ্ট।”
-“আমি নিজেকে সামলে নিতে চাই।”
-“আমি পারতাম না সামলাতে?”
নাফিয়া আরিভের দিকে তাকাল। লোকটি অন্যদিকে ঘুরে তার সাথে কথা বলছে। চোখে চোখ ফেলছে না কিছুতেই। দৃষ্টি একত্রিত হয়নি আজ তাদের। আরিভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দেয়,
-“আটকাবো না, যেতে পারো। তবে ছেড়ে যেও না, তাতেই হবে।”
________
মা ব্যতীত সবচেয়ে ভরসার আশ্রয়স্থল আর হয়না। নাফিয়ার ক্ষেত্রে সেটি যদিও ভিন্ন। তার আরও দুজন আছে, তার স্বামী আর তার বাবা। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হল মায়ের প্রয়োজন তার ভীষণ করে। তার কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে পারলে জীবনের সব দুঃখ ঘুচে যাবে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় নাফিয়ার নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হল, এভাবে আরিভকে ফেলে আসলো সে? কিন্তু পরপরই মনে হল তার হাতটির কথা। একটিবার বলতে পারতো আরিভ, বলেই দেখতো। নাফিয়া হয়তো রাজিও হয়ে যেত। কিন্তু সে বলেনি।
-“ধাক্কাটা সামলে উঠতে সময় লাগবে আমি জানি। কিন্তু আরিভকে ভুল বুঝিস না, মা। ছেলেটা তোকে অনেক ভালোবাসে।”
-“আমিও তাকে খুব খুব ভালোবাসি।” কথাটি স্বশব্দে বলল না নাফিয়া। বরং আনমনে আওড়েছে। গুটিসুটি হয়ে শুয়ে রইল রেশমা বেগমের কোলে।
মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তিনি বলেন,
-“আজকাল মানুষ বড়ই স্বার্থপর। একটু ভুল দেখলে, দশ কথা শোনাতে ছাড়ে না। সেখানে তুই আরিভের কাছে অনেক প্রিয়। এমনকি শিরীন আপা আর ভাইয়ের কাছেও। তুই কতটা ভাগ্যবতী ভাবতে পারছিস?”
-“আমি ভাগ্যবতী, মা?”
-“অবশ্যই।”
-“তাহলে আমার সাথে পরপর দুবার এসব কেন ঘটে গেল? আমি তো কারো ক্ষতি করিনি কখনও।”
-“কিছু হারিয়ে কিছু পেয়েছিস। এটাই নিয়ম।”
-“তাই বলে এত কষ্ট পাব? আশপাশের মানুষকে দেখি ওদের সুখ, শান্তি, সুস্থতা সব আছে, কিছুর কমতি নেই।”
-“আমরা মানুষরা এই ভুলটাই করি। চোখের দেখায় মেনে নেই, কিন্তু যা দেখা যায় সেটি সবসময় সত্যি হয়না। তুই কি জানিস এই হাসিখুশি মানুষগুলো চার দেয়ালের ভেতরে কেমন?”
ভাবনায় পড়ে গেল নাফিয়া। আসলেই তো জানে না সে। কখনও জানতেও চায়নি। শুধু দেখে গেছে তাদের হাসতে। আর আফসোস করে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে এই প্রশ্ন করে, কেন তার জীবনটা সামনের মানুষগুলোর মতো নয়।
-“জানি না।”
-“নিজের ঘরে ফিরে যা।”
হুট করেই কেঁদে উঠল নাফিয়া আরেকবার। নিজের হাতের দিকে তাকাতেই পারছে না। ভয়ানক সেই দৃশ্য দেখেছে সে। সেলাই করা হাতটা, কি ভয়ঙ্কর ছিল!
-“আমাকে সময় দাও না, প্লীজ। আমি পারছি না।”
-“সামলে নেওয়ার সময় অবশ্যই দিব।”
রেশমা বেগমের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে নাফিয়া। ঘুমোয়নি বরং মাকে দেখানোর জন্য অভিনয় করেছে। অনুভব করেছে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেছে বাতি নিভিয়ে। পরপর আরও একজনের উপস্থিতি টের পেয়েছে। সে আর কেউ নয় বরং সিদ্দিক সাহেব। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে, কাঁথা টেনে দিয়ে গেছেন শরীরে।
রাতের গভীরতায় যখন তলিয়ে গেল শহর ঠিক তখনই চোখজোড়া খুলে নাফিয়া। ধীরে পা ফেলে নেমে গেল বিছানা থেকে। বাতি জ্বালিয়ে এসে থামল আয়নার সামনে। নিজেকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে যেন বাঁধ ভাঙল তার। বলল,
-“আমি এমন জীবনের যোগ্য নই! একদম না। আমার ভালোবাসার মানুষগুলো আমার যত্ন করতে করতে ক্লান্ত। আমি কিছুই করতে পারছি না তাদের জন্য। বোঝা হয়ে আছি শুধু।”
অন্যদিকে ব্যালকনির চেয়ারে অলস শরীর এলিয়ে দিয়েছে আরিভ। নিজের মধ্যকার সবটা শূন্য, অনুভূত হচ্ছেনা কিছুই। মস্তিষ্কটা অনবরত চাপ দিচ্ছে তাকে। দোষী, মিথ্যুক বলছে। থামাতে পারল না কিছুতেই এই পীড়া। দৃষ্টি পড়ল পাশের বারান্দায়। এই বারান্দা থেকে শুরু তাদের প্রণয়। আকস্মিক হাসি ফুটলো আরিভের ঠোঁটে। পুরোনো কথাগুলো ভেবে, যে কথাগুলো বেশি পুরোনো নয়। পরপর হাসিটুকু মিলিয়ে গিয়েছে পরিস্থিতির চাপে। আর কিছু ভাবতে পারছে না।
হাতে পেঁচিয়ে আছে নাফিয়ার নীল রঙের ওড়না। এখানে তার শরীরের ঘ্রাণ লেপ্টে আছে। ওড়নাটি দেখল, শুঁকে নিল সেই মোহনীয় ঘ্রাণ।
-“আমার অপেক্ষা দীর্ঘ না হোক।”
চলবে….