#বৈরী_বসন্ত ৩৩
লেখা – আয্যাহ সূচনা
দুই দিন কেটে গেছে। নাফিয়ার সঙ্গে আরিভের কোনো কথা হয়নি একবারের জন্যও। কয়েক দিনের ধকল শরীরকে করেছে ক্লান্ত। হৃদয়ের বোঝা থেকে যতদূর সম্ভব নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাইছে সে। কোনো কিছুই ভাবতে চাইছে না। ঠিক করেছিল অফিসে যাবে না, তবুও গিয়েছে। কারণ, নিজেকে ব্যস্ত না রাখলে নাফিয়ার চিন্তা এসে দখল করবে মন-মগজের প্রতিটি কোণ। নিজেকে সামলে উঠতে পারবে না সে। অতিরিক্ত রকমের আসক্তি মেয়েটি। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রওনা হল অফিসের উদ্দেশ্যে।
এই দৃশ্যটি দেখতে নাফিয়া কোনোদিন ভুল করেনা। আজ করবে কি করে? ঠিক দাঁড়িয়েছে প্রিয় মানুষকে দেখার জন্য পর্দার আড়ালে। দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
-“ডাবের পানি খাবে?”
পরিচিত কন্ঠ শুনে ঘুরে তাকায় নাফিয়া। সাদিফ আর জোহান দাঁড়িয়ে। দুজনের হাতে দুটো দুটো করে চারটে ডাব। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে সকাল সকাল হাজির।
নাফিয়ার মুখখানা ফ্যাকাশে। নরম সুরে প্রশ্ন করল,
-“এত সকালে এখানে কি করছিস?”
জোহান জবাব দিল, – “আরিভ ভাইয়ের আদেশ, প্রতিদিন সকালে মোড়ের দোকান থেকে চারটে ডাব যেন তোমার কাছে পৌঁছে যায়। সারাদিন খাবে, সরি! পান করবে।”
শেষ কথাটি নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল জোহান। নাফিয়া বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শুধু জবাব দিল,
-“পরে খাব।”
-“খালি পেটে খেতে বলেছে।”
নাফিয়া দুজনকে এড়িয়ে গেল। বিছানায় এসে পা ঝুলিয়ে বসল। সাদিফের দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল,
-“শুনছি আজকাল দেবদাসের মত ঘুরছো?”
থতমত খেয়ে যায় সাদিফ। এখন অব্দি নোহা আপুর ননদের নাম্বার জোগাড় হয়নি। না পরিচয় হয়েছে। সেই শোকে দিনদিন পাতলা হয়ে যাচ্ছে সে।
-“আমার কাছে কিন্তু তোমার প্রেম রোগের চিকিৎসা আছে।”
একবারের জন্য সাদিফের মন লাফিয়ে উঠলেও পরক্ষণেই দমিয়ে নিল নিজেকে। আরিভের কঠোর আদেশের কথা মনে পড়ল। নাফিকে ডাবের পানি খাইয়েই যেন এদিক ওদিকের আলাপচারিতা করা হয়, তার আগে একটি শব্দও নয়।
সাদিফ বলল, -“আগে ডাবের পানি খাবি, তারপর সব কথা।”
নাফিয়া ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকালো কিছুক্ষণের জন্য। সে দৃষ্টি মোটেও স্বাভাবিক নয়। হুট করেই বলল,
-“হাত নেই দেখছো না? যাও গ্লাসে করে নিয়ে এসো।”
কি স্বাভাবিকভাবেই বলে ফেলল কথাটি। বরং রুক্ষ বাক্যের আড়ালে নিজের কষ্টটা তুলে ধরল নাফি। এত ভারী ডাব আলগে নেওয়ার শক্তি তার মাঝে নেই। জোহানের মুখটা ভোঁতা হয়ে যায়। বলে উঠে,
-“আমরাও পাগল! সরাসরি ডাব নিয়ে হাজির হয়েছি। তুমি এখানেই বসো নাফিপু, আমি এক্ষুনি গিয়ে আন্টির কাছ থেকে কাঁচের সবচেয়ে সুন্দর গ্লাসটায় করে নিয়ে আসছি ডাবের পানি। সাথে স্ট্র, একদম রেস্টুরেন্ট টাইপ ফিল পাবে।”
বোকার মত কথাগুলো বলে চলে গেল জোহান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বৃথা চেষ্টা। নাফি জানে এই দুজন তার মন খারাপ দূর করতে এসেছে। পাঠানো হয়েছে তাদের।
সাদিফ জোহানের খোশগল্প নাফির মুখে সাময়িক হাসি ফোটাতে সক্ষম হলেও পুরোপুরি সেই গভীর ক্ষত সারতে সময় লাগবে। এদিক ওদিকের কথায় নাফিয়া ফের বলে উঠল,
-“সাদিফ ভাই তুমি কিন্তু কথাটা এড়িয়ে গেলে।”
সাদিফ ভ্রু কুটি করে প্রশ্ন করে, -“কোন কথা?”
-“ঐযে নোহা আপুর ননদ।”
সাদিফ ছেলেটা বড় রসিক। কিন্তু এ ব্যাপারে ফিউজ হয়ে যাওয়া লাইটের মতো তার অবস্থা। চুপসে গেল একদমই। নাফিয়া বলল,
-“মেয়েটার নাম রিধি। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ালেখা করছে। আমার কাছে কিন্তু নাম্বারটাও আছে।”
নাম্বারটাও আছে শুনেই চুপসে যাওয়া মুখে জ্যোতি ফুটল। গোলগোল চোখে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে বলল,
-“তোর কাছে নাম্বার আছে? সত্যি?”
নাফিয়া বিছানার হার্ডবোর্ডে আরাম করেই পিঠ এলিয়ে দিল। ভাবলেশহীন হয়ে বলল,
-“আছে। কিন্তু দিব না।”
-“কেন?”
বিদ্যুতের গতিতে প্রশ্ন করে বসে সাদিফ। মৃদু ছটফট করছে ছেলেটি। দেখে বোঝা না গেলেও কিছুটা উপলব্ধি করছে। নাফিয়া বলল,
-“ইচ্ছে আমার।”
সাদিফের ভাব ভঙ্গি বদলে গেল মুহুর্তেই। নাফিয়ার পাশে বসে অদূরে কন্ঠে বলল,
-“বোন আমার, এমন করিস কেন? তুই চাস না তোর ভাইয়ের বউ হোক? তুই তাকে ভাবী বলে ডাক? চাস কিনা বল?”
-“উহু! চাই না। তাছাড়া তুমি যাকে ভাবি বানাতে চাচ্ছো সে আমার সমবয়সী।”
-“তাহলে তো আরও ভালো।”
-“কচু ভালো! নাম্বার দেওয়ার কথা ভাবতে পারি, যদি তুমি আমার একটা কাজ করে দাও।”
-“কি কাজ?” সাদিফ চঞ্চল কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠে।
_______
আজকাল জমিলা বেগম নাফিয়ার ব্যাপারে একেবারেই চুপ। কোনো বাড়তি কথা বলেননা তিনি। নাফিয়ার সামনে হাসেন না, টিটকারী দেন না। হুট করে নীরব হয়ে যাওয়া চোখে লাগছে সিদ্দিক সাহেব এবং রেশমা বেগমের। তারা কয়েকবার ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চেয়েছে কিন্তু লাভ হয়নি।
-“কোথায় যাচ্ছো, মা?”
নিজের ঘর ডিঙিয়ে বারান্দার দিকে যেতেই সিদ্দিক সাহেব বসার ঘর থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন নাফিয়ার উদ্দেশ্যে। নাফিয়ার মধ্যে থাকা এই স্বাভাবিকভাবটা আরও একটি চিন্তার কারণ। নাফিয়া হাসলো। ঠিক আগের মত জবাব দিল,
-“বারান্দায় যাচ্ছি বাবা। বাদবাকি গাছগুলোকে যত্ন করি।”
হুট করেই সিদ্দিক সাহেব আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। বলেন,
-“গাছ!.. আচ্ছা যাও কিন্তু সাবধানে…”
নাফিয়া স্মিত হাসল। বলল,
-“ভয় নেই বাবা। দ্বিতীয়বার ভুল হবেনা।”
নাফিয়ার কথাগুলো অদ্ভুত লাগছে। কেঁদেকেটে নাজেহাল হয়ে যাওয়া মেয়েটি একরাতে কি করে এত স্বাভাবিক? অতি শোকে পাথর হলো নাতো? যদি হয়ে থাকে ধীরেধীরে মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করবে নাফিয়া।
রেশমা বেগমের দিকে চেয়ে সিদ্দিক সাহেব বললেন,
-“আরিভের সাথে কথা বলা উচিত।”
বারান্দায় বসে জমিলা বেগম পান চিবুচ্ছেন। নাফিয়াকে দেখেও যেন দেখলেন না। কিন্তু নাফিয়া নিজের উপস্থিতি স্পষ্ট জানান দিতে বলে উঠল,
-“এখানে একা কি করছেন দাদী?”
জমিলা বেগম স্বাভাবিক সুরে জবাব দিলেন,
-“কিছুনা।”
অন্য হাতে বেশি ওজন নিতে পারবে না নাফিয়া। তাই ছোট গ্লাসে করে অল্প অল্প পানি দিতে শুরু করল। হুট করেই বলল,
-“আপনি খুব খুশি তাই না দাদী? অকেজো, অপয়ার সাথে এখন বিকলাঙ্গ শব্দটাও আপনার ডিকশনারিতে যোগ হবে।”
জমিলা বেগম পান চিবুনো থামালেন। অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন নাফির দিকে। নাফিয়া হাসছে। হাসি মুখে বলল,
-“আজকাল আমার প্রতি বিরক্তি দেখাচ্ছেন না যে? আমাকে কটু কথাও শোনাচ্ছেন না। কি হলো আপনার? নাতনীর প্রতি মায়া জন্মে গেল নাকি হুট করে?”
অস্বাভাবিক তার আচরণ। জমিলা বেগম অব্দি বিস্মিত। যে মেয়েটি তার সামনে কোনো কথাই বলতো না আজ সে পটর পটর করছে। নাফিয়া সেখানেই থামল না। বলল,
-“আপনি আপনার অকেজো, অপয়া এসব কথা চালিয়ে যেতে পারেন। আমার গায়ে লাগেনা। নিজেকে দমিয়ে রাখবেন না। যা বলার বলতে থাকুন, আমার কান খোলা।”
কোনো জবাব নেই জমিলা বেগমের কাছে। সে অবাক করা দৃষ্টি নিয়ে সামনের মেয়েটির দিকে চেয়ে আছে। এই অদ্ভুত আচরণ তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। যে মেয়ে অপমানিত হওয়ার ভয়ে তার আড়ালে থাকত আজ সেই নিজে থেকে অপমানিত হতে চাইছে। জমিলা বেগম কিছু না বলেই স্থান ত্যাগ করলেন। বসার ঘর পেরিয়ে ঘরে যেতে যেতে সিদ্দিক সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তোর মাইয়া পাগল হইয়া গেছে সিদ্দিক। কীসব যা-তা বকে!”
_________
অবসন্ন দেহটা বিছানায় পড়তেই রাজ্যের ঘুম এসে চোখে ধরা দিচ্ছিল। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে শূন্য হয়ে উঠেছিল প্রিয় রমণীর ফিনফিনে ওড়নার স্পর্শে। তার দেহের উষ্ণতা লেপ্টে নেই, আছে শুধু তার নির্জীব ওড়নাটা। এইতো আরিভের স্বস্তির সম্বল। ঘুম অত্যন্ত পাতলা। ঠিক তখনই বিকট আওয়াজে ফোন বেজে উঠল। কাঁচা ঘুম ভেঙে চুরমার নিমিষেই।
নিভু নিভু চোখজোড়া খুলতেই চোখে ভাসে সাদিফের নাম্বার। রিসিভ করে বলল,
-“ হ্যালো…”
-“আরিভ ভাই!”
সাদিফের কন্ঠে অস্থিরতা। মোটেও স্বাভাবিক শোনালো না আরিভ ভাই ডাকটি। আরিভের ঘুম সম্পূর্ণ উবে যায়। উঠে বসল একলাফে। এক অজানা ভয় তাকে সবসময়ই তাড়া করে বেড়ায়।
আরিভ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, – “কি হয়েছে? নাফি…”
-“ভাই নাফি পাগলামো করছে।”
হৃদপিণ্ডের স্পন্দন অনুমতিবিহীন বৃদ্ধি হতে শুরু করল। আরিভ বলল,
-“মানে? পাগলামো করছে মানে? কি হয়েছে?”
-“একা একা এই রাতের বেলা ছাদে গিয়ে বসে আছে।”
-“কিহ!”
-“হ্যাঁ ভাই। ওর বাসায় সবাই ঘুমোচ্ছে। আমি আমাদের বাড়ির ছাদে গিয়েছিলাম কাজে তখনই ওদের বাড়ির ছাদে চোখ গেল। একা ছাদের রেলিং ঘেষে বসে ছিল নাফিয়া। কোনো নড়চড় নেই। ডাকলাম কিন্তু কোনো সাড়া দিল না।”
আর এক মিনিট ব্যয় করেনি আরিভ। সাদিফের কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি একদমই। ফোনটা কাটলো না। উল্টো ফোন বিছানায় অবহেলায় ফেলে বেরিয়ে গেল। জুতো পড়ার সময়ও হলো না। খালি পায়ে নাফিয়াদের বাড়ির দরজা ডিঙিয়ে ছাদে দৌঁড়ে গেলো।
– “নাফি!”
ডাকে কোনো সাড়া মেলেনি। সম্পূর্ণ ছাদটা অন্ধকার। আজ চাঁদও লুকোচুরি খেলছে তাদের সাথে। কোনো আলো নেই, সে লুকিয়ে মেঘের আড়ালে।
-“নাফি কোথায় আছো?”
ফোনটাও ফেলে এসেছে আরিভ। নয়তো ফ্ল্যাশ লাইট অন করা যেত। রাত সাড়ে বারোটায় প্রায় আশপাশ অন্ধকার, নীরব। বেশি বাড়িঘর না থাকায় আলো আসার তেমন কায়দা নেই। চাঁদ একমাত্র ভরসা। তবে নাফিয়াদের বাড়ির ছাদে বাতি ছিল। যেটি এই মুহূর্তে বন্ধ।
আঁধারে হাতড়ে চলতে চলতে রেলিং এর কাছে গিয়ে দাঁড়াল আরিভ। ঠিক তখনই আত্মা বেরিয়ে আসবার উপক্রম। পেছন থেকে কেউ জাপ্টে ধরেছে, একটি হাত বুকের দিকের টিশার্ট চেপে ধরে বলল,
-“আপনার এত এত বিসর্জনের মূল্য দিতে পারিনি, আপনি চাইলেই আমার উপর রেগে থাকতে পারেন।”
আশ্চর্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে আরিভ। বুঝতে পারল না সেই সময় কি প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত। বুকের কাঁপুনি থামেনি তখনও। ঠিক সেই জায়গায় নাফিয়ার হাত।
আরিভ ঘুরে তাকাল। নাফিয়ার মুখোমুখি হতে না হতেই মেয়েটি বুকে ঢলে পড়েছে। প্রতিক্রিয়া শূন্য হয়ে পড়ল আরিভ। ঠিক তখনই তাকে অবাকের সর্বশেষ পর্যায়ে নিয়ে যেতে নিজেকে প্রস্তুত করল নাফিয়া। মুখ উঁচু করে আরিভের গালে চুমু খেয়ে বলল,
-“ শুভ জন্মদিন। ”
জন্মদিন মনে রাখার সময় আছে? বয়স কত হলো তারও হিসাব নেই। আরিভ এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল অনেক সময় পর। নাফিয়া বাহুডোরে লেপ্টে আদুরে দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মুখের দিকে। বলে,
-“আপনার কি আমার আদর সহ্য হচ্ছেনা? চুমু খেলাম ভালো লাগছে না আপনার?”
আরিভের মস্তিষ্ক সজাগ হল তখনই। নাফিয়ার দিকে তাকাল। বলল,
-“কি হয়েছে তোমার? হুট করে…”
অন্যগালটিও বাকি রইল না। সেখানেও নরম অধরের ছোঁয়া লেগে গেল। বলল,
-“আপনাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”
নাফিয়ার আচরণ অদ্ভুত লাগছে। ভীষণ অদ্ভুত লাগছে। স্বাভাবিক দিনগুলোতে এসব বললে হয়তো আরিভ আপ্লুত হয়ে তাকে টেনে নিত কাছে। কিন্তু আজ সেটি আর হচ্ছেনা।
আরিভ নাফিয়ার গাল নিজের দুহাতে আবদ্ধ করল। বলল,
-“কিছু হয়েছে নাফি? এতরাতে ছাদে কেন এসেছো বলো তো? আবার অদ্ভুত ব্যবহার করছো….”
-“চুমু খাওয়া আর ভালোবাসি বলাকে আপনার অদ্ভুত লাগছে?”
-“না না একদমই না। কিন্তু…”
-“আমি কোনো কিন্তু জানি না। আপনার জন্য কেক আনিয়েছি জানেন। আপনি চকলেট কেক পছন্দ করেন না? সেটিই আনিয়েছি, আসুন।”
সত্যিই কেক এনেছে। নাফির পক্ষে কেক আনা সম্ভব নয়। ধীরেধীরে সবটা পরিষ্কার হলো আরিভের কাছে। এটা শতভাগ নিশ্চিত হল, সবকিছু পূর্ব পরিকল্পনা নাফিয়া ও সাদিফ জোহানের। আরিভের কিছুটা রাগ হলো সাদিফের উপর। আরেকটু হলে আরিভ প্যানিক এ্যাটাক করে বসতো।
ছাদে থাকা ভাঙা টেবিলের উপর কেকটি দেখিয়ে নাফিয়া বলল,
-“ সুন্দর না? খোলা আকাশের নিচে, আঁধারে আপনার জন্মদিন পালন করছি। মনে আছে আপনিও ঠিক তাই করেছিলেন।”
-“আছে।”
-“আপনি দেখেছেন আমার স্মৃতিশক্তি কত ভালো?”
-“হুম।”
নাফিয়া আবারও আরিভের দিকে এগিয়ে গেল। মিশে গেল ফের তার দেহের সঙ্গে। চোখে চোখ রেখে বলল,
-“তাহলে কিভাবে ভেবে নিলেন আমাকে বিশেষ অনুভব করানোর জন্য আপনার প্রতিটি চেষ্টা আমি ভুলে যাব? আমাকে দেওয়া ভালোবাসা আমি ভুলে যাব? কিভাবে ভাবলেন আপনাকে ছেড়ে চলে যাব?”
প্রস্নগুলো তীরের মতো গেঁথে যাচ্ছে মস্তিষ্কে। আরিভ নাফিয়ার জ্বলজ্বল করা দৃষ্টি থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারল না। কি অদ্ভুত মায়া জমে আছে এখানে। বশ হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ। তবে হিতাহিত জ্ঞান হারাল না। বলল,
-“আমার নেওয়া সিদ্ধান্ত একপাক্ষিক ছিল।”
-“সিদ্ধান্ত আমার হোক অথবা আপনার, একই কথা।”
-“তারপরও নাফিয়া। তোমাকে জানানো উচিত ছিল।”
-“সেদিন কি বলেছিলেন ভুলে গেছেন?”
-“কি?”
-“তোমার আর আমার বলতে কিছু নেই, যা আছে আমাদের।”
আরিভ আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল,
-“তুমি আমার উপর রেগে নেই?”
-“আজ আমার বাবা আমার জীবনের এতবড় সিদ্ধান্ত নিলে আমি তাকে ছেড়ে যেতাম?”
-“হয়তো না।”
-“সামান্য অভিমান জমেছিল আরিভ। হুট করেই যখন সবকিছু আমার সামনে দাঁড়াল সবটা হযবরল লাগতে শুরু হয়েছিল। আমার মস্তিষ্কে যেন জট পেকে গিয়েছিল। হয়তো তখন আপনার কাছে থাকলে আমি এমন কিছু বলে অথবা করে ফেলতাম যেটায় আপনি কষ্ট পেতেন। দূরে যাওয়া মানে ছেড়ে যাওয়া নয়। আমি নিজেকে বুঝিয়েছি এ ক’টা দিন। আপনি সঠিক ছিলেন আর আমার নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া ভুল। আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না কখনও। কোনোদিন যাব না।”
আরিভ কোনো সময় নিল না। এক তৃষ্ণার্তের মত করে নাফিয়ার কম্পিত ঠোঁটজোড়া দখলে নিয়ে নিল। যেন এতদিন মরুভূমিতে তার বসবাস ছিল। নাফিয়ার মাথার পেছনে হাত রেখে চুলগুলো সামান্য মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। নাফিয়া কুঁকড়ে অনুভব করছে আরিভের ভিন্ন উন্মাদনা। ছটফট করতে থাকা পুরুষ দেহটা তার সাথে এসে লেপ্টে গিয়েছে। নাফিয়াকে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় দিল অনেকটা সময় পর। নিজেকে শান্ত করে তবেই ছাড়া দিল নাফিয়াকে। ঘন নিঃশ্বাস ফেলে কপালে কপাল ঠেকিয়ে আরিভ বলল,
-“মনে হল এক জনম পর আমার তৃষ্ণা মিটেছে। তোমার অভাবে কতটা পুড়েছি আমি, জানো? তোমার ওড়নাকে সঙ্গী করে নিয়েছিলাম। বাড়ি চলো, আমি আর এক মুহূর্ত তোমাকে দূরে রাখতে চাই না। সম্ভব নয়।”
চলবে…
#বৈরী_বসন্ত ৩৪
লেখা – আয্যাহ সূচনা
যে চাঁদ কিছুক্ষণ আগেও মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছিল, সে অকস্মাৎ নিজেকে উন্মুক্ত করলো পূর্ণ মহিমায়। মেঘের দল আর তার সম্মুখে নয়, ভক্তের মতো চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। শুভ্র চন্দ্রিমার অপার্থিব জ্যোতি পৃথিবীর আঁধারকে গ্রাস করে নেবার চেষ্টায় মত্ত।
ছিটেফোঁটা আলো আরিভের পরিপাটি ঘরটাতেও পড়েছে। যেখান থেকে নারী কান্নার মৃদু শব্দ ভেসে আসছে। ভীষণ রকমের ব্যথিত হৃদয়খানা। এ ব্যাথার ঔষধ হিসেবে কাজ করতে চাইছে তার প্রিয় পুরুষটি। কাছে টেনে নিজের মত করেই উপশমের চেষ্টায়। যেন অতীতের সব কালো অধ্যায় ধুয়ে মুছে যায়। সান্নিধ্য তাকে তিক্ত স্মৃতি ভুলিয়ে দেয়।
তমাসাবৃত কক্ষে নাফিয়া তার কানের কাছে ভারী পুরুষালি কন্ঠে ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পেল,
-“তুমি আমার ভালোবাসায় সিক্ত হও, অশ্রু তোমার জন্য নয়।”
কান্না থেমে গেল গাঢ় স্পর্শে। ভেজা গালগুলো আরিভ দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে মুছে দিচ্ছে। নাফিয়া ফোলা চোখগুলো খুলে তাকায়। আরিভ তার অতি নিকটে। তার চোখেগুলো দেখে কেঁপে উঠল কায়া। দ্রুততম সময়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
আরিভ মৃদু হেসে প্রশ্ন করে,
-“তোমার কাছে এই মুহূর্তে কোনটা জরুরী? কান্না নাকি আমি, হু?”
নাফিয়া আচমকা জবাব দিয়ে বসলো,
– “ঘুম.. ঘুম জরুরী..”
আরিভ পুনরায় হেসে উঠে। হাসিটুকু ঝঙ্কার তুলল সারা ঘরে। হাসির তালে তার শরীরটাও কিছুটা কেঁপে উঠেছে। নাফিয়া দেখতে চাইল তার হাসি। ঘুমের অজুহাত পাশে ফেলে পুনরায় ঘুরে তাকিয়েছে তার দিকে।
-“দেখলে, আমাকে দেখার লোভ সামলাতে পারছো না।”
নাফিয়ার কপাল কুঁচকে আসে। লজ্জাটা আড়াল করতে চাইছে মিথ্যে ভনিতার আড়ালে। আরিভ তার মুখে যে নজর গেড়ে আছে সেটিও আড়চোখে দেখে নিয়েছে নাফিয়া।
-“আমার জন্মদিনের উপহার?”
নাফিয়া সময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
– “কেক এনেছি, আপনার কাছে ফিরে এসেছি। আর কি চাই?”
-“আপনাকে।”
‘আপনি’ ডাকটি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর ডাক। প্রিয় মানুষের ডাক পরিবর্তন শ্রবণইন্দ্রিয়তে একটু বেশিই সুন্দর শোনায়। আরিভের ডাকটি সম্মোহিত করছে তাকে। নাফিয়া ঢোক গিলে জবাব দিল,
-“আমি তো আপনার কাছেই আছি… এতে চাওয়া চাওয়ির কি আছে?”
-“কাছে থেকেও দূরে আপনি। আমি চাই আজ মাঝে আমার এমন একটি অভ্যাস তৈরী হোক, যে অভ্যাস আমাদের মাঝে ক্ষণিকের দূরত্বটুকুও আসতে দিবে না।”
নাফিয়া এবার নরম কন্ঠে জবাব দিল,
-“যাব না। কক্ষনো যাব না দূরে। ভুল হয়েছে আমার, সরি।”
-“তুমি সত্যিই মেনে নিয়েছো সবটা?”
লজ্জাকে কিছু সময়ের জন্য দূরে সরিয়ে আরিভের দিকে তাকাল নাফিয়া। কথাটি চোখে চোখ রেখে না বললেই নয়। আরিভ মুখের নয় চোখের ভাষায় আশ্বস্ত হোক।
-“আপনারা পাশে না থাকলে হয়তো মেনে নিতাম না। ভেঙে গুড়িয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতাম। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, একটি অঙ্গ হারানোর শোকে আমি আপনাদের হৃদয় ভঙ্গ করতে পারিনা।”
আরিভ নাফিয়ার কপালে চুমু খেল। বলল,
-“সবে মাত্র উনিশ, এখনই এত বুঝদার হলেন কি করে শুনি?”
-“কথায় আছে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
-“আমার সঙ্গ আপনাকে পাকা বানিয়েছে?”
-“জি।”
-“আরেকটু সঙ্গ না দিলেই নয়…”
-“মানে?” আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল নাফিয়া।
আরিভের ঠোঁট জুড়ে দুষ্টু হাসি। সন্দিহান নাফিয়ার চোখ মুখ। মতিগতি মোটেও সুবিধার নয়। লোকটাকে চেনে নাফিয়া। আরিভ বলল,
-“এখনও অনেককিছু বুঝবার বাকি, আসেন বুঝিয়ে দেই। খুবই পোলাইটলি বোঝাবো। আদর-যত্ন করে। আপনার সকল সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখা হবে, ম্যাম। ডোন্ট ওয়ারি।”
আরিভের মতলব কিছুটা হলেও আন্দাজ করা শেষ। রেহাই পেতে নাফিয়া বলল,
-“কীসব আবোলতাবোল বকছেন!”
-“আপনি এত কথা না বলে, আমাকে অনুভব করুন।”
-“করব না।”
-“এই মুহূর্তে ঝগড়ার মুডে নেই আমি।”
-“আপনি যেই মুডে থাকুন না কেন। এক্ষুনি সরুন, আমি ঘুমাব।”
-“দিচ্ছি না ঘুমোতে।”
-“আমি মা’ কে ডাকব।”
-“ছিঃ!”
কথাটি বলে নাফিয়া নিজেও লজ্জায় পড়ে গেল। কি থেকে কি বলে ফেলেছে! মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আরিভকে শুধু তার মায়ের ভয় দেখানো যায়। তাছাড়া তাকে বাগে পাওয়া যায় না। আজও সেটিই সর্বপ্রথম মাথায় আসে নাফিয়ার।
-“নির্লজ্জ!”
বাক্য শেষ হতেই নাফিয়ার ছটফট করা দেহ ধীরে ধীরে নিস্তেজ এলো, উষ্ণতার আলিঙ্গনে সমস্ত অস্থিরতা বিলীন হতে শুরু করেছে। মস্তিষ্কে এক বিরল শূন্যতা বিরাজ করছে, আগে কখনও এতটা ধ্যান – জ্ঞানহীনতা আসেনি। প্রায় অবশ বাম হাতটি আরিভের গায়ের টিশার্ট চেপে ধরার আপ্রাণ চেষ্টায়। কি হয়েছে তার সাথে? কি হয়েছিল? কোনোটাই আপাতত মনে আসছে না। মোমের মতো নরম হয়ে আরিভের বুকে গলে যেতে লাগল। আরিভের নব্য স্পর্শ যেন সংকল্পবদ্ধ। অতীতের স্মৃতিগুলো মুছে ফেলার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রাগ, অভিমান, কষ্ট কিংবা যেকোনো আঘাতের ঢেউ তাকে যেন ছুঁয়ে দিতে না পারে। দৃঢ় প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে চায় এ দুয়ের মধ্যে। নাফিয়াকে স্পর্শ করার অধিকার একমাত্র তারই হোক।
-“হারানোর হিসেব কষতে শুরু করলে, প্রাপ্তিগুলো অবহেলায় দূরে সরে যায়। তুমি সরাওনি, সঠিক সময়ে ফিরে এসেছো।”
শেষ রাতের আকাশে মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল, যেন প্রকৃতি কোনো স্নিগ্ধ সুরে গীত গাইছে। সেই শীতলতার সঙ্গে আরিভের বুকের উষ্ণতা মিলে এক অদ্ভুত অনবদ্য ভারসাম্য তৈরি করেছে। নাফিয়া গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে ঠিক তখনই, সমস্ত ধ্যানজ্ঞান হারিয়ে। কিন্তু আরিভ জেগে। তার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ নাফিয়ার হাতের দিকে। এ হাতটিতে যেন কোনো ব্যথার ছোঁয়া পৌঁছাতে না পারে। আদর আর সোহাগে ভরিয়ে দিতে গিয়েও যত্নের ছিটেফোঁটাও কমতি হয়নি। বাকিটা রাত সে হাতটি আলতো করে নিজের মুঠোয় আগলে রেখেছিল।
-“গুড মর্নিং।”
আদুরে কন্ঠে সকালের শুরু হলেও তেঁতে উঠল নাফিয়া। ঝুঁকে থাকা আরিভকে বাম হাতে সামান্য ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
-“আমাকে ডাকাডাকি করবেন না। আমি ঘুমোবো।”
ভনিতা শুরু করল আরিভ। বলল,
-“এভাবেই মানুষ ফয়দা নিয়ে ভুলে যায়। এটাই জীবন!”
আরিভের বিশেষ অভিনয়ের খুব একটা গুরুত্ব দিল না নাফিয়া। উল্টো ঝাঁঝাল সুরে বলল,
-“এসব ডায়লগবাজি ঘরের বাহিরে গিয়ে করুন, প্লীজ।”
নাফিয়াকে অনেকটা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে দেখে স্বস্তি পেল আরিভ। কিন্তু এটা ধরে বসে থাকলে চলবে না। স্বাভাবিকতার মাঝেও কিছু একটা অস্বাভাবিক। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে।
-“কোথায় যাচ্ছিস?”
ঘর থেকে বেরোতেই মায়ের ঝাঁঝাল কন্ঠ কানে ভেসে উঠল। সেটিও বহুদিন পর। আরিভ হাস্যোজ্জ্বল মুখে জবাব দিল,
-“কেক আনতে।”
-“কেক?”
-“হ্যাঁ। গতরাতে ছাদে ফেলে এসেছিলাম, সেটাই আনতে যাচ্ছি।”
বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলেন শিরীন বেগম। বউ বাপের বাড়ি যেতে না যেতেই ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? তিনি কাছে এসে প্রশ্ন করলেন,
-“মাথা কি গেছে?”
-“গিয়েছিল মা, ফিরে এসেছে।”
সোজাসাপ্টা কথার ভুলভাল উত্তর শুনে চটে গেলেন শিরীন বেগম। মারতে হাত এগোতেই আবার থেমে যান। আজ নাহয় মারধর থাকুক। ছেলেটার জন্মদিন।
-“ছাদে কেক কি করছে? আর রাতের কেক এখন বাড়িতে এনে কি করবি?”
-“আম্মা তুমিও না! আমি মজা করছিলাম। সারারাত ছাদে পড়ে থাকা কেক আমি এখন কেন আনবো? সেসব জ্বীন ভূত খেয়ে সাবাড় করেছে এতক্ষণে।”
শিরীন বেগম কোমরে হাত রেখে প্রশ্ন করলেন,
-“কেকটা ছাদে গেল কি করে?”
-“তোমার গুণধর বৌমার কাজ এটা। আমি বউকে এনেছি, কেক ফেলে এসেছি। ভালো করেছি না বলো?”
-“নাফি ফিরে এসেছে?” আগ্রহী সুরে জানতে চাইলেন শিরীন বেগম।
-“না এসে যাবে কোথায়?”
শিরীন বেগম মনে মনে ভীষন খুশি হলেন। কিন্তু সেটি মুখে প্রকাশ করেননি। প্রেশার কুকারের সিটি বাজতেই হুশ ফিরল তার। আরিভকে এড়িয়ে রান্না ঘরের দিকে এগোলেন। আজ সবকিছু আরিভের মনমতোই হবে। সকালের নাস্তায় নেহারি তৈরি করেছেন। আরিভের ভীষণ প্রিয়। আরিভ বসার ঘর থেকেই চিৎকার করে বলল,
-“কিছু লাগবে? আমি বাহিরে যাচ্ছি।”
চিৎকার শুনে কানটা ঝাঁ- ঝাঁ করে উঠলো শিরীন বেগমের। সাথে ঘিরে অর্ধ ঘুমে নাফিয়াও বিরক্ত। শিরীন বেগম বললেন,
-“একটা স্কচটেপ আনিস।”
-“কেন?”
-“তোর মুখে লাগাবো।”
______
-“মা।”
ডাকটি কর্ণগোচর হতেই ফিরে তাকালেন শিরীন বেগম। চুলোর তাপে ঘেমে নেয়ে একাকার সে। নাফিয়া দাঁড়িয়ে আছে উদাস মুখে। লম্বা হাসলেন তিনি। নিজের কাছে ডেকে চিবুকে হাত রেখে বললেন,
-“এসেছো?”
নাফির হাতে পানির গ্লাস। শিরীন বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“সরি, মা।”
-“ওমা! কেন?”
-“আমি কাউকে না বলে বেয়াদবের মতো চলে গিয়েছিলাম।”
শিরীন বেগমের পানির প্রয়োজন ছিল। পানির পান করে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“অঙ্গ হারানোর বেদনার চেয়ে আপনজনের দূরত্ব বেশি কষ্টদায়ক, সেটি কি বুঝতে পেরেছো?”
নাফিয়া মাথা নত করে জবাব দিল, – “জি।”
-“তাতেই চলবে। আমি খুশি তুমি সঠিক সময়ে ফিরে এসেছো।”
-“আমি সবসময় শুনেছি শ্বাশুড়িরা বউদের পছন্দ করেনা। আপনি ব্যতিক্রম কেন?”
হেসে ফেললেন শিরীন বেগম হেসে ফেললেন। খুন্তি নাড়তে নাড়তে বললেন,
-“খারাপ এক ঝটকায় হওয়া যায়, ভালো হতে অনেক ঝড়ঝাপটা পেরোতে হয়। সহজে কেউ গ্রহণ করতে পারেনা। যেমন তুমি পারছো না।”
-“আমি পারছি তো মা।”
-“তাহলে এসব কথা বলবে না আর কখনও। আমি দজ্জাল শ্বাশুড়ি নই।”
নাফিয়া কিছু বলল না। তবে মনে উশখুশ ভাবটা রয়ে গেল। কিছুতেই কাটছে না। নাফিয়ার মনে হাজারখানেক প্রশ্ন, শিরীন বেগম কি অনিচ্ছায় তাকে সহ্য করছেন? মেনে নেওয়ার ক্ষমতা এত দৃঢ় কেন তার?
-“নাফি তোমার নেহারি পছন্দ?”
-“জি।”
-“ভালোই হলো। আরিভের জন্য করেছি, আজ ছেলেটার জন্মদিন। তুমিও খাবে চলো।”
-“আমি সার্ভ করি।”
শিরীন দুহাত তুলে না বোধক ইঙ্গিত করে বলেন,
-“একদমই না। তোমার হাতে চাপ দেওয়া ঠিক হবেনা। যতদিন না সুস্থ হচ্ছ আরাম করে নাও। আবারও বলছি সংসারের হাল কিন্তু তোমারই ধরতে হবে।”
আতাউর সাহেবের সাথে সকাল সকাল নতুন মেহমান এসে হাজির হয়েছে। আরিভের ফুপু রত্না। বিয়েতে আসার সুযোগ হয়নি অসুস্থতা জনিত কারণে। তাছাড়াও তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হওয়াতে তেমন কেউই আসেনি। সকলেই ঢাকার বাহিরে থাকেন। ফুপুকে দেখেই আরিভ জড়িয়ে ধরলো। কুশল বিনিময় করলেন শিরীন বেগম। নাফিয়াকে ডেকে বললেন,
-“উনি হচ্ছেন তোমার একমাত্র ফুপু শ্বাশুড়ি।”
নাফিয়া তার দিকে চেয়ে বলল,
– “আসসালামু আলাইকুম।”
রত্না সালামের উত্তরটা নিল কিছুটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে। তার চোখ নাফিয়ার হাতের দিকে। ব্যান্ডেজ করা হাত। দেখে বোঝা যাচ্ছে বড় কোনো অপারেশন হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করলেন,
-“তোমার হাতে কি হয়েছে?”
নাফিয়া কিছুটা হচকচিয়ে যায়। তার পরিবর্তে আরিভ জবাব দিল,
-“সেটা কিছু না ফুপু, সামান্য একটা অপারেশন।”
-“দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
আরিভ হেসে বলল, -“আমার জন্য সামান্যই ফুপু। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, নাস্তা করবে। তোমার ভাবি আজ নেহারি রান্না করেছেন।”
রত্না নাফিয়ার দিকে এক পলক চেয়েই চলে গেলেন। নাফিয়ার বুঝতে পারল বিষয়টি, নিশ্চয়ই তার মনে হাজারখানেক প্রশ্ন। থাকতেই পারে, স্বাভাবিকভাবে নিতে চায় নাফিয়া। আজকাল তার সাথে ঘটা সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
হুট করেই আরিভের চোখে চোখ পড়ে। সে চেয়ে আছে, চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করতে চাইছে। কিন্তু তার বদলে বিগত রাতের কথা মনে পড়তেই অস্থিরতা এসে গ্রাস করল তাকে। ডানে বায়ে না চেয়ে তড়িৎ গতিতে আরিভকে এড়িয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। পেছনে বোকা বনে চেয়ে রইল আরিভ।
-“খেতে আয়।”
ডাকটি শুনেই আরিভ দ্রুত গতিতে চেয়ারে এসে বসল। নাফিয়া ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে। আড়ালে বাম হাতটা ধরে টেনে নিজের পাশে বসালো। ভরকে উঠে নাফিয়া। এদিক সেদিক চেয়ে দেখল কেউ আছে কিনা?
-“এমন আচরণ করছো কেন?”
কানের কাছে ফিসফিসানি শুনে আরেকদফা চমকায় নাফিয়া। তার হাতটি টেবিলের আড়ালে এখনও আরিভের দখলে। নাফিয়া রাগান্বিত স্বরে বলে উঠে,
-“বাবা, মা আছেন এখানে। ফুপুও এসেছেন, এই সময় আপনার হাত ধরে টানাটানি না করলেই না!”
-“আমার বউয়ের হাত আমি ধরেছি।”
-“কিন্তু এখানে কেন?”
-“এখানে ভদ্রতার খাতিরে শুধু হাত ধরলাম। ঘরে আস্ত বউটাকে জড়িয়ে রাখব।”
-“আর ভদ্রতার বাণী ছুঁড়তে হবে না। আপনি কত ভদ্র আমার জানা হয়ে গেছে।”
আরিভ কিছু বলতে যাবে তখনই রত্না এসে হাজির হলেন। শিরীন বেগম খাবারের প্লেট এগিয়ে দিচ্ছেন আতাউর সাহেব ও রত্নার দিকে। অন্যদিকে হাত আটকে বসে আছে নাফিয়া। হাসফাস করছে ছাড়া পেতে। রত্না চেয়ার টেনে বসতে বসতেই বলেন,
-“শ্বাশুড়ি কাজ করছে আর বউ দেখি টেবিলে বসে।”
হাসির ছলে অপমানজনক লাগল কথাটি। কিন্তু নাফিয়া নিশ্চুপ। আরিভ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,
-“বয়স হচ্ছে আর তুমিও অন্ধ হচ্ছো ফুপু। আমার বউ টেবিলে না, চেয়ারে বসে আছে।”
জবাবটি মনমতো হয়নি। আরিভ নাফিয়ার হাতে আলতো চাপ দিল। যেন বোঝাতে চাইল এসবে কান দিতে না। নাফিয়াও ঠিক তাই করল। শিরীন বেগম নেহারি সর্বপ্রথম নাফিয়ার পাতে তুলে দিয়ে বললেন,
-“খাও।”
রত্না এ দৃশ্য দেখে বলেন,
-“বড় পিস সবসময়ই পুরুষদের হক। তারা এ বাড়ির কর্তা।”
রত্না বরাবরই বেশি কথা বলে। সরাসরি মুখের উপর কথা বলে ফেলে। সামনের মানুষ কষ্ট পাবে কিনা সে বিষয়ে তোয়াক্কা না করা সেটা তার আগেকার স্বভাব। আতাউর সাহেব বললেন,
-“এ বাড়ির সবার ছোট নাফিয়া। তাই সবার আগে তার অধিকার।”
আরিভ স্মিত হাসল। কিন্তু নাফিয়া বলল,
-“আমি খাব না মা। আপনি ওনাকেই দিন।”
শিরীন বেগম ঠাট্টার সুরে বললেন,
-“ও খেতে শুরু করলে থামবে না। তুমি ভালো করেই জানো ওর স্বভাব। পরে কিন্তু ভাগে পাবে না।”
-“না মা। ওনাকেই দিন।”
রত্না বলে উঠলেন,
– “আজকাল তো মেয়েরা নিজেদের অধিকার বুঝে নেয়। তোমাকে সেধে সেধে দিচ্ছে আর তুমি নিচ্ছো না? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো বুঝি?”
নাফিয়া মৃদু হেসে বলল,
-“জি না ফুপু, আমি মন থেকে চাই আমার আগে আমার স্বামী ভালো খাবারটা গ্রহণ করুক। এতে কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণই দেখছি না। বরং তাদের উপার্জনের মাধ্যমেই আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটে। এই পরিশ্রমের বিনিময়ে সব সেরা জিনিস তার প্রাপ্য। আমি নিজের ভাগের অংশটুকু তার পাতে তুলে দিতে দ্বিধাবোধ করব না। আমরা কেউ কারো প্রতিযোগী নই, একে অপরের পরিপূরক। সে চাইবে আমার সমস্ত প্রয়োজন মেটাতে, আমি চাইবো তার যত্নে যেন কোনো কমতি না আসে। কখনও যদি এমন হয়, আমরা উভয়েই একে অপরকে সেরা জিনিসটা দিতে চাইছি তখন দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়ে বরং ভাগাভাগি করে নিব। আমার বাবা মাও ঠিক তাই করেন। তাদের দেখেই শিখেছি, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কেউ উঁচু কেউ নিচু না। দুজনেই সমান।”
চলবে…