#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২২
কুসুমকে ঘিরে বসে আছে ভাবি এবং বোনদের দল। কুসুম যেন সবার মধ্যমনি। সবাই কুসুমকে ঠেলেঠুলে বসেছে কুসুমের বিবাহিত জীবনের কথা শোনার জন্যে। কুসুম নাছোড়বান্দার মত বলছে না কিছুই। এতেই তারা টিপ্পনী কেটে যাচ্ছে। তাদের ধারণা মতে, উচ্ছ্বাস ভীষন রোমান্টিক একটি ছেলে। বউকে সে চোখে হারাবেই। কুসুম নিজেদের রসকষহীন কথা তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। কুসুম মিথ্যা বলছে। তারা সেই মিথ্যাকে সত্য করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। কুসুম একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সত্যকে মিথ্যা করে বলল,,
‘ হয়েছে হয়েছে। আমার জামাই আমাকে চোখে হারায়। সারাক্ষণ স্বামী নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। সে খুব বেশি রোমান্টিক, রোমান্টিকতা তার উপচে পরছে। এবার বিশ্বাস হয়েছে? শান্তি? ‘
মেয়েদের দল এবার খুশিতে হৈ হুল্লোর করে উঠল। এটাই তো শুনতে চেয়েছিল তারা। অযথাই কুসুম মিথ্যা বলেছে। কুসুম কেন যেন এতক্ষণ মিথ্যা বলে তাদেরকে মায়াজালে রাখল। ইশ!
কুসুমকে যখন এটকথা জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল ঊষা বড় বোন হিসেবে সেখান থেকে উঠে গিয়েছিল। বড় বোন হয়ে ছোটবোনের স্বামীর রোমান্টিক ব্যাপার-স্যাপার জানার কোনো প্রয়োজন নেই। ভাবি একজন বললেন,
‘ হ্যাঁরে কুসুম, বাচ্চা কবে নিবি? ‘
কুসুম হঠাৎ এই কথা শুনে মৃদু স্বরে চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ এখনই বাচ্চা? ভাবি, তোমরা কতদূর চলে গেলে। উফ! ‘
আরেক ভাবি কুসুমকে খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘ এমনভাবে বলছিস যেন জীবনেও বাচ্চা নিবি না। নিলে দ্রুত নিবি বুঝলি। এতে তোদের সংসার জীবনেরই মঙ্গল। ‘
এতসব কথা শুনে মাথা ভনভন করতে লাগল কুসুমের। কুসুম কানে দুহাত চেপে ধরে বলল, ‘ ভাবি, লুচ্চামি বন্ধ করো প্লিজ। আমার লজ্জা লাগছে। ‘
মেয়েদের দল কুসুমের কথা শুনে হাসিতে ফেঁটে পরল। কুসুম পুনরায় এক সমুদ্র লজ্জায় ঝাঁপ দিয়ে চোখ খিঁচল। তবে কুসুমকে এই অবর্ণনীয় লজ্জা থেকে বাঁচাতে ঊষা এলো। এসেই সবাইকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্যে তাড়া দিতে লাগল। কুসুম এই কথা শোনার পরপরই হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে ঊষার পেছনে পেছনে চলে গেল। মেয়েদের আসরও ভেঙে গেল।
খাবার খাওয়ার পর্ব শেষ করে, ইয়াহিয়া আর উচ্ছ্বাস সোফায় বসে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। ঊষা এই ফাঁকে কুসুমকে নিজের রুমে টেনে নিল। লাল রঙের ব্লাউজ এবং পেটিকোট হাতে দিয়ে বলল,
‘যা পরে আয়। সাজিয়ে দেই তোকে। ‘
কুসুম সেসব হাতে নিয়ে বলল, ‘এখন সাজব কেন? ঘুমাব না? ‘
ঊষা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলল। কুসুমের মাথায় চাটা মেরে বলল,’ দ্রুত পরে আয় গাঁধী। ‘
কুসুম বুঝতে পারল, সে বড্ড বোকামিপূর্ন কথা বলে ফেলেছে। কুসুম বাথরুমে গিয়ে সেসব পরে এলো। ঊষার হাতে সাদা রঙের, লাল পাড়ের শাড়ি। কুসুম বাথরুম থেকে বের হতেই ঊষা এগিয়ে এলো শাড়ি নিয়ে। তবে বিপত্তি সাজল পেটিকোটে শাড়ি গুজার বেলায়। পেটিকোট অনেক হালকা বাঁধন দিয়ে পরেছে কুসুম। ঊষা একবার বলল, ‘ পেটিকোটের ফিতে একটু টাইট করে বাঁধ। শাড়ি খুলে যাব নাহলে। ‘
কুসুম উত্তর দিল, ‘ হ্যাঁ বাঁধি। তারপর বিয়ের দিনের মত আমার পেটে কাটার মত দাগ বসে যাক। তারপর জ্বলুক ইচ্ছেমত। এভাবেই ঠিক আছে। পরিয়ে দাও। ‘
ঊষা আর কথা বাড়ালো না। সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিল কুসুমকে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে হালকা করে কাজল এঁকে দিল চোখে। ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে দিল। কুসুমকে পুরোপুরি তৈরি করে দিয়ে পাঠিয়ে দিল উচ্ছ্বাসের ঘরে। উচ্ছ্বাস সবে ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়েছে। কুসুম দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই উচ্ছ্বাস মুখ মুছে টাওয়াল সরিয়ে কুসুমের দিকে তাকালো। সঙ্গেসঙ্গে উচ্ছ্বাসের সর্বাঙ্গ থরথর করে কেপে উঠল। সাক্ষাৎ দেবী লাগছে কুসুমকে। কুসুম লজ্জায় মাথা নত করে এগিয়ে এলো।
কুসুম এগিয়ে আসতেই উচ্ছ্বাস গলা কেশে নিজেকে স্বাভাবিক করল। টাওয়াল বারান্দায় মেলে দেবার জন্যে যাবে, কুসুম পেছন থেকে বলল, ‘ আমার কাছে দিন, আমি মেলে দিচ্ছি। ‘
উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে কুসুমের হাতে টাওয়াল ধরিয়ে দিল। কুসুম বারান্দায় গিয়ে টাওয়াল মেলে দেবার জন্যে উদ্যত হল।মেলে দেবার জন্যে একটু উঁচু হতেই উন্মুক্ত হল কুসুমের মেদহীন ফর্সা কোমড়। সঙ্গেসঙ্গে বুকটা ধ্বক করে উঠল উচ্ছ্বাসের। উচ্ছ্বাস ঢোক গিলে ফ্যালফ্যাল চোখে সেদিকে চেয়ে রইল। আজকে কুসুমকে একটু বেশিই আকর্ষণীয় লাগছে না? কুসুম টাওয়াল মেলে দিয়ে নিচু হতেই কোমড় আবারও ঢেকে গেল শাড়ির আঁচলে। উচ্ছ্বাস চোখের পলক ফেলল। গলা কেশে, কপাল চুলকে নিজেকে স্বাভাবিক করল। কুসুম রুমে এলো। বিমোহিত উচ্ছ্বাসের দিকে চেয়ে বলল, ‘ রাত হয়েছে। ঘুমাবেন না? ‘
উচ্ছ্বাস অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘ না…মানে হ্যাঁ। চলো ঘুমাই। তুমি শাড়ি পরে ঘুমাবে? ‘
কুসুম বোকা বোকা চোখে নিজের শাড়ির দিকে চেয়ে বলল,
‘ ঊষা আপু তো সেটাই বললো। বলল আপনি খুলে ঘুমাতে বলল ঘুমাব। নাহলে পরেই ঘুমাতে। ‘
উচ্ছ্বাস মনেমনে হাসল। এ কদিন যতটুকু বুঝতে পেরেছে, ঊষা এবং তার ভাবি দুজনেই মনেপ্রাণে চাইছে কুসুম এবং উচ্ছ্বাস মিলে যায়। তবে তারা এটা জানে না কুসুমের সবে ১৮ হয়েছে। আরো কটাদিন সে নিজেই কুসুমকে সময় দিচ্ছে। যেন দুজন দুজনকে ভালো করে চেনে নিক, জেনে নিক।! তারপর যেন এক হয়। সবাই এতটা অধৈর্য্য কেন তাদের সম্পর্ক নিয়ে? নাকি বয়সের এতটা পার্থক্য দেখে সবাই কিছুটা শঙ্কিত তাদের সম্পর্ক নিয়ে? হতেও পারে।
উচ্ছ্বাস নিজেকে সামলে বলল, ‘ শাড়ি খুলে ফেলো। নরমালি সেলোয়ার কামিজ পরে ঘুমাও না? সেটাই পরে ঘুমাবে। গো নাও। ‘
কুসুম মাথা নাড়ালো। চলে যেতে উদ্যত হলে খানিক পর উচ্ছ্বাস হঠাৎ করে পেছন থেকে বলে উঠল,
‘ ওয়েট! শাড়ি পরে ঘুমাতে তোমার কি খুব অসুবিধা হবে, কুসুম? একদিন দেখো ঘুমাতে পারো কি না। যদি না পারো, দেন নেক্সট টাইম থেকে ত্রি পিস পরেই নাহয় ঘুমাবে। শুধু আজকে একটু দেখো। প্লিজ! ‘
শেষের কথাটা বড্ড অসহায় শোনালো কুসুমের কানে। উচ্ছ্বাস কি নার্ভাস হচ্ছে? কুসুমের তো তাই মনে হচ্ছে। কুসুম হেসে ফেললো। বলল, ‘ আমি শাড়ি পরে ঘুমাতে পারব। চিন্তা নেই। ‘
কুসুম এই কথা বলে বিছানার দিকে যেতেই হুট করে ঝরঝর করে সমস্ত শাড়ি কোমড় থেকে খুলে নিচে পরে গেল। শুধু আঁচলটা পরে রইল শরীরে। আচমকা এমন পরিস্থিতিতে দুইজনেই হতভম্ব হয়ে গেল। উচ্ছ্বাস বড়বড় চোখে কুসুমের উন্মুক্ত পেটের দিকে চেয়ে আছে। কুসুম বোকা বোকা চোখে চেয়ে আছে নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকা নিজের শাড়ির দিকে। যখন বুঝতে পারল নিজের হয়ে আচলটাই শুধু আছে, কুসুম কাদো কাদো চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে চাইল। উচ্ছ্বাস অন্য নজরে চেয়ে আছে দেখে কুসুম এবার লজ্জায় আধমরা অবস্থা। এই কেঁদে দিবে ভাব। উচ্ছ্বাস কুসুমের অবস্থা বুঝতে পেরে সঙ্গেসঙ্গে নিজেকে সামলে ফেললো। চোখ সরিয়ে অন্যদিকে ঠোঁট কামড়ে হাসি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। কুসুম উচ্ছ্বাসকে এভাবে হাসতে দেখে এবার জোরে শব্দ করে চেচিয়ে উঠল, ‘ আমার এই অবস্থায় আপনি হাসছেন? বাজে লোক একটা। ‘
উচ্ছ্বাস আর পারল না। এবার শব্দ করেই হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি আসার জোগাড়। শরীর রীতিমত ঝাঁকিয়ে হাসছে। কুসুম এবার আর সহ্য করতে পারল না। কেঁদে ফেললো। উচ্ছ্বাস কুসুমের কান্নার শব্দ পেতেই চট করে হাসি থামালো। নিজের পেটফাটা হাসি কষ্ট করে নিয়ন্ত্রণ করে এগিয়ে এসে মেঝে থেকে শাড়ির বহর হাতে তুলে বলল, ‘ শাড়ি পরতে পারো? নাকি পরিয়ে দিতে হবে? ‘
কুসুম রেগে এখন আগুন হয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে উচ্ছ্বাসের হাত থেকে শাড়ির নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘ লাগবে না। আমি শাড়ি পড়বই না। ত্রি পিস আছে। সেটাই পরব। সামনে থেকে সরুন। ‘
কুসুম পেছনে ফিরে চলে যেতে নিলে পেছনে থেকে উচ্ছ্বাস কুসুমের আঁচল পেছনে থেকে খপ করে ধরে ফেললো। কুসুম সঙ্গেসঙ্গে থেমে গেল। শাড়ির আঁচল শক্ত করে চেপে ধরল খুলে যাবার ভয়ে। পেছন থেকে উচ্ছ্বাস বড্ড মিষ্টি স্বরে বলল,
‘ শাড়িটা আমি পরিয়ে দেই? ‘
উচ্ছ্বাস এত সুন্দর ভাবে বলল যে কুসুম না চাইতেই সম্মোহিত হয়ে গেল। চুপ করে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। উচ্ছ্বাস বুঝতে পারল, কুসুমের সম্মতি আছে।
সে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো। কুসুমকে সামনে রেখে বেশ সময় নিয়ে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিল। উচ্ছ্বাসের সামনে এভাবে শাড়ি ছাড়া দাড়িয়ে ছিল ভাবতেই কুসুমের যেন পশম দাড়িয়ে যাচ্ছে। তবে নিজের স্বামী ভেবে নিজেকে একটু স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করল। শাড়ি পড়ানোর এক ফাঁকে উচ্ছ্বাস বড্ড আচমকা কুসুমকে জিজ্ঞেস করে বসল,
‘ ইয়াহিয়া ভাই কি ঊষাকে পছন্দ করেন? দেখে মনে হল আমার। তুমি কি এই ব্যাপারে কিছু জানো? ‘
#চলবে
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২৩
শাড়ি পড়ানোর এক ফাঁকে উচ্ছ্বাস বড্ড আচমকা কুসুমকে জিজ্ঞেস করে বসল,
‘ ইয়াহিয়া ভাই কি ঊষাকে পছন্দ করেন? দেখে মনে হল আমার। তুমি কি এই ব্যাপারে কিছু জানো? ‘
কুসুম এই কথা শুনে প্রচন্ড অবাক হয়েছে। চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ ভাইয়া আর ঊষা আপা? ‘
কুসুমের চিৎকারে উচ্ছ্বাস কানে চেপে ধরে চোখ খিচে বলল,
‘ আস্তে কথা বলো। আমি এখানেই, শুনতে পাচ্ছি। আর শেষ উত্তর হ্যাঁ। আমার কাছে মনে হয়েছে। মিথ্যাও হতে পারে এটা। আমি শিউর নই। ‘
কুসুম এখনো হতভম্বের ন্যায় চেয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস মনোযোগ দিয়ে কুসুমকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে শাড়ির আঁচল পিন দিয়ে আটকে দিল। মাথার চুল খুলে বেনি করে দিতে লাগল। কুসুম অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
‘ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এমন কিছু যদি হয়েও থাকে, আমার চোখে কেন পরল না। শুধু আপনার চোখেই পরল? ‘
উচ্ছ্বাস উত্তর দিল, ‘ আমার মনে হচ্ছে, ওরা ঘরের মধ্যে সন্দেহজকভাবে কিছু করে নি। বাইরে ডেইট আউট, এসব হয়ত করেছে। তাছাড়া সেদিন আমি রেস্টুরেন্টে দুজনকে দেখেছি। বেশ ক্লোজলি বসে গল্প করছিল তারা। ঊষাকে দেখে যা হয়, সে এমনি এমনি একটা ছেলের এতটা কাছে ঘেঁষবে না। নিশ্চয়ই এটার মধ্যে লাভ এফেক্ট জড়িত। ‘
কুসুম দাঁত দিয়ে ঠোঁটের একপাশ কামড়ে ধরে রেখে ভাবতে বসে। উচ্ছ্বাস আয়নায় কুসুমের দিকে চেয়ে দেখে। কুসুমকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। উচ্ছ্বাস বেনি করা শেষ হলে কুসুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। চিন্তিত কুসুমকে দেখে নিয়ে বলে,
‘ চিন্তা করছ? ‘
‘ হু। ঊষা আপা আর ভাইয়া। আমার এসব আজব লাগছে। কখনও সেভাবে এদের দুজনকে ভেবে দেখিনি। ‘
উচ্ছ্বাস নিজের দুহাত কুসুমের কাধ ছাপিয়ে গলায় আলগা করে পেঁচিয়ে ধরল। তারপর বলল,
‘ একটু চোখ রাখো ওদের উপর। আমার কাছে মনে হচ্ছে, ঊষা যদি তোমাদের বাড়ির বৌ হবে, ব্যাপারটা খুব দারুন হবে। খালামনি দেখলাম ঊষাকে প্রচন্ড পছন্দ করে। তুমিও ঊষা বলতে পাগল। আর ইয়াহিয়া ভাই তো ভালোবাসেন। জমে ক্ষীর হয়ে যাবে সবকিছু।’
কুসুমকে এখনো চিন্তিত দেখাচ্ছে। সে মাথা নাড়ালো শুধু। উচ্ছ্বাস এটা দেখে বিভ্রান্ত হল। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুমি কি চাইছ না, ঊষা এই বাড়িতে পার্মানেন্ট হোক? কিসের চিন্তা করছ? ‘
কুসুম সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘ এটা হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না। আমি ঊষা আপাকে ছোট থেকেই মান্য করে এসেছি। আপু আমাকে যেভাবে কেয়ার করেন, এই বাড়ির প্রতিটা মানুষকে সেভাবে আপন করে রাখেন, এটা অন্য কেউই পারবে না, আমি জানি সেটা। কিন্তু আমি চিন্তা করছি অন্য…’
‘ কি অন্য চিন্তা? ‘
‘ আসলে আম্মা এটা কিভাবে দেখবেন? তাছাড়া দাদাবাড়ির মানুষজন কি ভাববে! মেয়েকে এখানে পড়তে দিয়েছেন। পড়তে এসে এখানে আমাদের বাড়িতেই প্রেমে জড়িয়ে গেছেন। ফুপু প্রেম ভালোবাসা ততটা পছন্দ করেন না। তাছাড়া ঊষা আপা এসএসসি পড়াকালীন আমেরিকায় ফুপার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক। দুজনের পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে হবে শুনেছি। আর এখন..আমাদের বাড়িতে এসে এসব। আমার মন মানছে না। মনে হচ্ছে এটা নিয়ে বড় এক ঝামেলা হবে। অশান্তি সৃষ্টি হবে। ‘
দেখা গেল উচ্ছ্বাসও চিন্তিত। সে কপাল কুচকে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
‘ এটা আসলেই চিন্তার বিষয়। আচ্ছা সময় আসুক। দেখা যাবে সবকিছু। এখন আপাতত প্রেম করতে দাও তাদের। সময় আসলে আমরা সবাই তোমার ফুপুকে রিকোয়েস্ট করব। আর এত ভালো ফ্যামিলি তোমার ফুপু কেন হাতছাড়া করবেন? ওয়েট করো। এভরিথিং উইল বি ফাইন। ‘
কুসুম এখনো ভেবেই যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস কুসুমকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘অনেক ভেবেছ। চলো ঘুমাবে। রাত অনেক হয়েছে। ‘
_______________________________
সকালে ঘুম ভাঙতেই কুসুম দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ঊষার ঘরের দিকে চলল। ঊষা আপা অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। পড়ছে টেবিলে বসে। কুসুমকে দেখে ঊষা বই বন্ধ করে কুসুমের দিকে হাসিমুখে তাকালো। কুসুম মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে আছে ঊষার দিকে। ঊষাকে এভাবে দেখতে কুসুমের বড্ড ভালো লাগছে। মনের মধ্যে কেমন আনন্দের ফোয়ারা বইছে। ঊষা জিজ্ঞেস করল,
‘ এত সকালে উঠেছিস? উচ্ছ্বাসও উঠেছে? চা খাবি? বানাব? ‘
কুসুম এবার ঊষার সামনে এসে দাঁড়ালো। আরেকটু কাছে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ঊষাকে। ঊষা চমকে উঠল। কুসুম ঊষার কাঁধে মুখ গুঁজে মৃদু স্বরে বলল, ‘ আমি খুব খুশি ঊষা আপা। খুব খুব বেশি খুশি আজকে। ‘
ঊষা বুঝতে পারে না কুসুমের খুশির কারণ। তবুও কিছু বলে না। হাত উঠিয়ে কুসুমের পিঠে হাত রাখে। মুচকি হেসে বলে,
‘ উচ্ছ্বাসের জন্যেই নাকি এই খুশি? ‘
কুসুম জড়িয়ে ধরা অবস্থায় উত্তর দিল, ‘ না, এই খুশি শুধুমাত্র তোমার জন্যে। তুমি খুব ভালো আপা। আমরা সবাই তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি। ‘
ঊষা একের পর এক অবাক হচ্ছে। ঊষাকে এই বাড়ির সবাই খুব ভালোবাসে, এটা ঊষা জানে। তবে কেউই সেটা মুখ ফুটে না বললে, আচরণে সেটা বোঝায়। আজ এই পাগল মেয়ের কি হল কে জানে? ঊষা মৃদু হেসে বলল,
‘ আমি জানি সেটা। আমিও তোদের খুব ভালোবাসি। ‘
কুসুম সরে এলো। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,
‘ চা খাবে? আমি বানাই আজকে? ‘
ঊষা বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। শরীরে ওড়না জড়িয়ে বলল,
‘ আমি বানাব। তুই পাশে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে গল্প করবি, এতেই হবে। চল। ‘
চা বানানোর এক ফাঁকে কুসুম জিজ্ঞেস করল,
‘ আপা, কাউকে ভালোবেসেছ কখনও? ‘
ঊষার হাত থেমে গেল। কুসুমের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ হঠাৎ এই প্রশ্ন করলি যে? ‘
কুসুম হাসলো। হাতে থাকা আপেলে কামড় বসিয়ে হাসিখুশি বলল,
‘ না এমনি মনে হল। বলো না! ভালোবেসেছ কখনো? ‘
ঊষা মৃদু হাসলো। বলল, ‘ ভালোবাসি একজনকে। সময় হলে এমনি জানবি। ‘
কুসুম হাসলো লুকিয়ে। টিপ্পনী কেটে জিজ্ঞেস করল,
‘ আমি কি চিনি তাকে? সে কি আমার খুব আপন কেউ? বলো না আপা। ‘
ঊষা কিছুটা চিন্তিত হল। অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘ খুব আপন কেউ তোর। ‘
কুসুমের বুঝতে বাকি নেই, ঊষা কার কথা বলছে। কুসুমের মন আনন্দে ভরে গেল। ইয়াহিয়া উঠেছে সবে। নিজের রুম ঠেকে চেঁচিয়ে চা দেবার কথা বলছে। ইয়াহিয়া আওয়াজ পেতেই ঊষার মুখ কেমন ঝলমল করে উঠে সেটা কুসুম এই প্রথম লক্ষ্য করল। কুসুম বলল,
‘ আরো এক কাপ লাগবে। ভাইয়া উঠে গেছে ঘুম থেকে। অফিসে যাবে। ‘
ঊষা মুখ লুকানোর চেষ্টা করে বলল, ‘ আমি বানিয়ে দিচ্ছি। তুই দিয়ে আয় গিয়ে। ‘
কুসুম নিজের ভাগের চা হাতে নিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
‘ আমি কেন নিয়ে যাব? আমার কাজ আছে। আমি চা নিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছি। তুমি বানাবে, তুমি নিয়ে যাবে। বাই। ‘
দেখা গেল, কুসুম হেলেদুলে গান গাইতে গাইতে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। ঊষা কুসুমের আজকে সকালের ব্যবহার থেকে যারপরনাই অবাক। ঊষা মনে মনে ভাবছে, কুসুম কি কিছু জেনেছে? এমন অদ্ভুদ আচরণ করছে কেন?
ঊষা কি করবে? চা বানিয়ে ইয়াহিয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ইয়াহিয়া তখন রেডি হয়ে টাই বাঁধছে। ঊষাকে দেখে সে মুচকি হাসলো। ঊষা টেবিলে চায়ের কাপ রাখার ফাঁকে ফিসফিস করে বলল,
‘ আমার মনে হচ্ছে, কুসুম আমাদের ব্যাপারে কিছু জেনেছে। ‘
ইয়াহিয়াও চায়ের কাপ নেবার ফাঁকে খুব সন্তর্পনে উত্তর দিল,
‘ কেন মনে হল এটা? ‘
ঊষা উত্তর দিল,
‘ ও আজ সকাল থেকে খুব খুশি। আমি প্রেম করি কি না জানতে চাইছে। আমার মনে হচ্ছে ও জেনে গেছে। ‘.
ইয়াহিয়া উত্তর দিল,
‘ জানবে না, ডোন্ট ওরি। জানলেও আমি সামলে নেব। কখন ঘুম থেকে উঠেছ? ‘
‘ সাতটায়। ‘
‘ পড়বে এখন? ‘
‘ হু। এক্সাম কদিনের মধ্যে। ‘
‘ ওকে। আম্মা উঠেছে? ‘
‘ না,ঘুমে সবাই।’
‘ আচ্ছা, আমি যাচ্ছি আজকে। মিটিং আছে। তোমার কিছু বলা লাগবে না। আমি আম্মাকে ফোন করে জানিয়ে দেব। গুড বাই। ‘
‘ হুঁ, সাবধানে যেও। ‘
ইয়াহিয়া সুন্দর একটা হাসি দিয়ে অফিস ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। কেউ দেখার আগে ঊষা দ্রুত ইয়াহিয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তবে কেউ না দেখলেও, কুসুমের নজরে ঠিক সবকিছু স্পষ্ট দেখা দিল।
#চলবে