ব্রেকাপ নাম্বার সাতশো তিন পর্ব-০১

0
1

ব্রেকাপ_নাম্বার_সাতশো_তিন
রূবাইবা_মেহউইশ

১.
শেরওয়ানি খোলার প্রস্তুতি নিয়ে বাসরঘরে ঢুকতেই চটাস করে এক থাপ্পড় পড়লো সাজ্জাদের গালে। সদ্য বিয়ে করা বউ তার ফেসিয়াল করা গালটাতে এত জোরেই চড় মেরেছে, যার শব্দ শুনে পাশের ঘরের দরজায় থাকা সেঁজুতি আঁতকে উঠলো। থাপ্পড় পড়া গালে হাত বুলাতে বুলাতে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হলো সাজ্জাদ। দরজার সামনে অন্ধকার করিডোরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে ঝড়ের বেগে নিজের ঘরে ঢুকলো সেঁজুতি। বিছানায় থাকা ফোনটাতে চিলের মত ছোঁ মেরে হাতে নিলো। কল দিলো সূর্যের নাম্বারে।

“হারামি, খবিশ, ইতরের দোস্ত বদমাশ এই তোর প্রস্তাব! তোর বোন কোন উগান্ডা থেকে আসছে রে! তোর কথায়, শুধু মাত্র তোর বুদ্ধিতে আমি আমার নিরীহ ভাইয়ের বউ তোর বোনকে করছি। এই দিন দেখার জন্য শালা! ব্রেকাপ তোর লগে; জীবনে আমারে কল দিবি না। তোরে যদি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখি তবে শিলনোড়া দিয়ে তোর মাথা ফাটাবো।”

একদমে সবটা বলেই কল কেটে দিলো সেঁজুতি। সূর্য কিছু বলবে বা কিছু বলতে চায় কিনা তা বোঝারও সময় নেই তার। সূর্য শুধু ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “ছয়শো ত্রিশ।”

সূর্য আর সেঁজুতির আজ ছয়শো ত্রিশ নাম্বার ব্রেকাপ হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সূর্য ফোনটা রেখে দিলো। চোখের চশমা খুলল কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে ভাবতে লাগলো তার বোন এখন কি করছে! আপুর কথা শুনেই তো সে এই বিয়ের ব্যবস্থা করিয়েছে কত কৌশলে৷ আপু বলেছিলো, “ওই মেয়ে কথায় কথায় তোকে গালি গালাজ করে তবুও কেন তাকেই ভালোবাসতে হবে! আচ্ছা বাসিসই যখন মূল্যও তো পেতে হবে তাই না! সেঁজুতির অবিবাহিত কোন ভাই নেই?”

সূর্য তার বোন রেশমির কথা শুনে প্রথমে অবাক হলেও পরে ভাবলো আপু কিছু একটা তো করবেই!

সূর্য জানালো সেঁজুতির বড় ভাই আছে আর তাঁর জন্য মেয়েও খোঁজা হচ্ছে। ব্যস, রেশমি বুদ্ধি দিলো সূর্য যেন সেঁজুতিকে বলে তার বোনের সাথে নিজের ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করায়। কোন অংশে কম নয় সূর্যের বোন। দেখতে রূপবতী, সুন্দরী, শিক্ষিতা আর পরিবারও তো উচ্চবিত্ত। তাদের ভাই বোনের বিয়ের মাধ্যমে একটা আত্মীয়তা হয়ে গেলে তাদের দুজনের বিয়েতে কোন আপত্তি আসবে না। আপত্তিটা মূলত সূর্য আর সেঁজুতি সমবয়সী বলেই উঠার ছিল। সেঁজুতির পরিবার সমবয়সী বিয়ে পছন্দ করে না। সেই কলেজের শুরু থেকে সেঁজুতি আর সূর্যের বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিতেই প্রেমে গড়িয়েছে। দুই পরিবারে তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে কখনোই বৈরী প্রভাব পড়েনি কিন্তু বিয়ে নিয়ে ঝামেলা বাঁধবে। এটা ভেবেই চিন্তিত ছিলো দুজন বেশ। সেই চিন্তা থেকে মুক্ত করতেই সূর্যের বড় বোন বুদ্ধি দিয়েছে এই বিয়ের। সূর্য অবশ্য বলেছিলো,

“আপু আমার জন্য তুমি এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিবে? সেঁজুতির ভাই কিন্তু একটু মেয়েলি স্বভাবের।”

রেশমি শুধু বলেছে, “তুই এ নিয়ে চিন্তা করিস না। তোর জন্য আমি এটুকু করতে পারবো না! তুই সেঁজুতিকে ভালোবাসিস কিন্তু তোরা সমবয়সী। সেঁজুতির ভাই আমার চেয়েও প্রায় চার – পাঁচ বছরের সিনিয়র। তুই কথা বলে দ্যাখ।”

ব্যস, সূর্যও বোনের কথামত সেঁজুতিকে বলল পরিবারে ভাইয়ার বিয়ের কথা হলে আমার বোনের কথা জানাও। তাই হলো, সূর্য আর সেঁজুতি নিজেদের পরিবারে নিজেরাই ঘটক হয়ে ভাই বোনের বিয়ে ঠিক করলো। অবশেষে সেই বিয়ে আজই সম্পন্ন হলো এবং তার জের ধরে সূর্য সেঁজুতির আবারও ব্রেকাপ।

ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট্ট একটা বারান্দা আছে সূর্যের। সিগারেট হাতে সেখানে বসে আবার ডায়াল করলো সেঁজুতির নাম্বারে। কল ঢুকছে না তার নাম্বার ব্ল্যাকলিস্ট করেছে। এই মেয়েটা এত রাগ নিয়ে কি করে থাকে ভেবে পায় না সে। কথায় কথায় রেগে তেড়ে আসবে সেই সাথে বলবে ‘ব্রেকাপ।’ কি এই ব্রেকাপ! রাগ পড়ে গেলে এক সেকেন্ডও তো থাকতে পারে না সূর্যকে ছাড়া অথচ রেগে গেলে মেয়েটা সূর্য কেন সূর্যের চৌদ্দ পুরুষেরও ক্ষমতা নেই তার রাগ ভাঙানোর। তবুও বৃথা চেষ্টা সে প্রতিবারই করে। ফোনে সময় দেখলো রাত দেড়টা বাজে। কিছু করার নেই এই রাতেই তাকে এখন বনশ্রী যেতে হবে। সেঁজুতিদের নতুন বাড়ি করেছে সেখানে আগে তারা গেন্ডারিয়া ছিলো সূর্যদের বাড়ির পাশাপাশিই। এখন তাদের টাকা বেড়েছে আগের চেয়ে তাই বনশ্রীর প্লটে ফ্ল্যাট করে চলে গেছে। ভেবে কাজ নেই আর বাইক নিয়ে মধ্যরাতের প্রহরী হয়ে ছুটলো বনশ্রীর দিকে। অল্প সময়ের মধ্যেই এসে পৌছুলো সেঁজুতিদের বাড়ির দক্ষিণে। সেঁজুতির ঘরের বেলকোনি এই দিকে। আবারও ফোন করলো নাহ, নাম্বার এখনো ব্ল্যাকলিস্টেই আছে তার। একবার ইচ্ছে হলো ফিরে যায় পরেই মনে পড়লো সেঁজুতির নাক, মুখ ফুলানো মুখটা। এখন যদি সে কোন চেষ্টা ছাড়াই ফিরে যায় তবে আর রক্ষা নেই। যখন রাগ শেষ হয়ে যাবে তখনো এই নিয়ে কথা শোনাবে। মেয়েটা এত্তো পাগল কিসিমের অথচ সূর্যের জান আটকে আছে তার মাঝেই। কিন্তু এই মুহুর্তে ভাবনা তা নয় ভাবনা হলো সেঁজুতির সাথে কথা বলবে কি করে। তিন তলায় থাকে তারা। চিৎকার করে নাম ধরে ডাকতে গেলে পুরো এলাকা জেগে যাবে। বারান্দায় গ্রিল লাগানো হয়নি তাদের কিন্তু উঠার মতও কোন ব্যবস্থাও তো নেই। হতাশ হলো সূর্য, আর যাইহোক সিনেমার হিরোদের মত বাথরুমের পাইপ বেয়ে তিন তলায় উঠা তার সাধ্যে নেই। তারওপর চশমা নিয়ে রিস্কও কিছুটা। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো বাড়ির নতুন করা বাগানে একটা মই আছে। সেটা দেখতেই আনন্দের ঝিলিক দেখা দিলো সূর্যের চোখে, মুখে। ঝটপট সেটা দাঁড় করিয়ে সে আরো বেশি খুশি হয়ে গেল। এত লম্বা মই! দোতলার বারান্দা ছোঁয়। এই মই বেয়ে দোতলার এক বারান্দায় উঠে কোনভাবে পাইপ ধরতে পারলেই হবে। সত্যিই সে মই বেয়ে দোতলার প্রায় কাছে উঠে গেল৷ বাড়ির এপাশে তেমন আলোর ব্যবস্থা নেই। এদিকটায় একটা নারকেল গাছ আছে তাতেই একটা এনার্জি বাল্ব লাগানো৷ যার আলোয় পেছনের সবটা জায়গা আলোকিত করতে পারছে না। মইয়ের শেষ কাঠে পা রাখতেই বুক ধড়ফড় করতে লাগলো সূর্যের। এটা তো নড়বড়ে! আতঙ্কে সে দিকদিশা কিছু ঠাওর করার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেল।

সকালের রোদ বসার ঘরের জানালা দিয়ে সোফায় পড়ছে। সেই সাথে পড়ছে সাজ্জাদের ওপরও। চোখের ওপর রোদটা প্রচণ্ড বিরক্তির কারণ হচ্ছে এই মুহুর্তে। এমনিতেই তো রাতভর নিজের ঘরে ঘুমানোর জায়গা পায়নি। সোফায় শুয়ে পিঠ আর কোমর বেঁকে গেছে প্রায়। সুন্দরী একটা স্ত্রী পেয়েও বাসরঘরে বউয়ের কাছে যেতে পারলো না। এর চেয়ে বড় দুঃখ তো কোমর বাঁকানোতেও লাগছে না। আবার লজ্জাও লাগছে বউকে কাছে পেলেইবা সে কি করতো! ইশ, যা লজ্জা মেয়েদের কাছে যেতে। আবার মন খারাপ হয়ে গেল থাপ্পড়ের কথা মনে পড়তেই৷ কত যত্ন করে ফেসিয়াল করেছিলো সে বিয়ের জন্য৷ জানালার পর্দা সরে সরে রোদ লুটোপুটি খেলছে তার চোখের পাতায়, মুখের ওপর। আর থাকা গেল না তাই শোয়া থেকে উঠে বসলো। কোথাও কোন আওয়াজ নেই তারমানে বাড়ির কেউ এখনো জাগেনি। এটাই মঙ্গল নইলে নির্ঘাত কেলেঙ্কারি হয়ে যেত তাকে এখানে কেউ দেখে ফেললে। ঝটপট গায়ের শেরওয়ানি খুলে রান্নাঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল। কয়েক সেকেন্ডেই আবার ফিরে এসে নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ধাক্কা লাগালো কয়েকবার। তখনি কানে এলো তার মায়ের গলা, “দরজায় কি করিস সাজু?”

কি জবাব দেবে ভাবতে ভাবতেই নতুন বউ দরজা খুলল। সাজ্জাদের মা জোহরা চশমা ছাড়া খুব একটা দেখতে পায় না। তিনি বোধহয় মাত্রই ঘুম থেকে উঠে দরজায় দাঁড়িয়েছেন। রেশমি দরজা খোলার সাথে সাথেই সে বউকে ঠেলে ঘরে ঢুকে বলল, “চা খেতে বেরিয়েছিলাম আম্মা কিন্তু তোমরা তো আজকে চা বানাওনি এখনো।”
________________________________

“আপনার পেছন দিকের অবস্থা তো খুব একটা ভালো না চুরিটুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন নাকি!”

সূর্যের কোমর থেকে একটু নিচের অংশে মেডিসিন লাগাতে লাগাতেই ডাক্তার কথাটা বলল। মাঝ রাতে মই থেকে নিচে পড়ে প্রায় থেতলে গেছে তার পশ্চাৎ দিক। আধমরার মতো পড়েছিলো সেখানেই। জ্ঞান না হারালেও হুঁশ তেমন একটা ছিলো না৷ অনেকটা সময় পর যখন তীব্র ব্যাথায় আর সইতে পারছিলো না তখন বহুকষ্টে পকেট থেকে ফোন বের করলো। ফোনের টাচ ফেটে চুরমার হয়ে গেছে নিচে পড়তেই কিন্তু সৌভাগ্য তার বন্ধ হয়নি। ডায়াল প্যাডে সেঁজুতির পরই ছিলো বন্ধু রওনকের নম্বর। তাকে কল দিতেই সে এসে নিয়ে গেল হসপিটালে। রাত শেষের দিকে হওয়ায় ঝিমুনি ধরা অবস্থা ডাক্তারদের। কোন ডাক্তারই চেকআপে এলো না। এক নার্স এসে ঘুমের ইনজেকশন দিলো। এখন ডাক্তার এলো ততক্ষণে সূর্যের ঘুম হালকা হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার জখমে স্পর্শ করতেই ব্যথায় ককিয়ে উঠলো সে। রসিকতা করারও আর সময় পেল না ডাক্তার সাহেব! মনে মনে এমন বললেও লজ্জা আর ব্যথায় আপাতত তার পটল তোলার ইচ্ছা৷ দশটা নাগাদ সূর্যের বাড়িতে খবর পৌঁছে গেছে সে বাইক এক্সিডেন্ট করেছে৷ সেই খবর অবশ্য সেঁজুতিদের বাড়িতেও পৌঁছেছে। রেশমিকে নিয়ে সাজ্জাদ হাসপাতালে আসতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সেঁজুতি শুনেছে সূর্য বাইক এক্সিডেন্ট করেছে তাতেই সেঁজুতির রাগ পানি হয়ে গেছে। মনে মনে বলল, “শালা নিশ্চয়ই আমার রাগ ভাঙাতেই আসতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করলো।”

তার দুঃখও মুখের গালিতে প্রকাশিত হয়। সে দৌঁড়ে ভাইয়ের ঘরের সামনে দাঁড়ালো।

“ভাইয়া একটু আসবো?”

রেশমি কাঁদছে আর সাজ্জাদ তাকে সান্ত্বনা দিতে ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু বলতে চাইছে। এরই মাঝে সেঁজুতির গলা শুনে বলল, ‘আয়।’

“আমিও হাসপাতালে যাচ্ছি শুনলাম সূর্য এক্সিডেন্ট করেছে!”

‘হ্যাঁ, আমরাও যাচ্ছি কিন্তু তোর ভাবীর তো কান্নাই থামছে না।’

সেঁজুতি একবার তাকালো রেশমির দিকে। মন খারাপ হয়ে গেল তার। ইশ, তার জন্যই সূর্য আজ হাসপাতালে।

আধঘন্টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছেই রেশমি ঢুকলো কেবিনে। সেখানে তার বাবা, মা আর বড় ভাই আর ভাবীও আছে। রেশমির পেছনে পেছনে সাজ্জাদ আর সেঁজুতিও ঢুকলো। সূর্যের পরিবারের সবাই একে একে বাইরে বের হলো। তার ভাই- ভাবী বাড়ি ফিরে গেল। বাবা আর মা নাশতা করতে নিচে গেল সাথে সাজ্জাদও। রেশমি কাঁদতে কাঁদতে ডাকলো, সূর্য!

ঘুমের ঔষধের রেশ কাটেনি সূর্যের তবুও সে জবাব দিলো, ‘কি?’

“কখন এসব হলো? তুই তো রাতে বারোটার দিকেও বাড়িতে ছিলি। আমার সাথে ফোনে কথাও বললি।”

সূর্য উপুর হয়ে শোয়া ঘাড় তার ডান দিকে ফেরানো। সেঁজুতি আর রেশমি আছে বা দিকে৷ সে ঘাড় না ফিরিয়েই জবাব দিলো, “তারপরই তো ডাইনিটার রাগ ভাঙাতে তোদের বাড়ি।”

‘কিহ্!’

বজ্রের মত হুঙ্কার ছেড়ে বলল সেঁজুতি। কি কপাল তার যার রাগ ভাঙাতে এতকিছু তাকেই আবার রাগিয়ে দিলো! পাছার আঘাতে ফিরে শোয়া কিংবা উঠে বসার অবস্থাও তার নেই। সেঁজুতি তো আর ফিরেও তাকায়নি গটগট করে সে বেরিয়ে গেল হাসপাতাল থেকে। রেশমি সবটা বুঝতে পারলেও সাজ্জাদ বোকা বনে রইলো বোনের আচরণে।

চলবে