#ব্রেকাপ_নাম্বার_সাতশো_তিন
#রূবাইবা_মেহউইশ
২.
বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকেই প্রথমে মোবাইলটাকে ছুঁড়ে মারলো সেঁজুতি। চিৎকার করে বলল, ‘বালের ফোন।’
কিসের রাগ কিসে মিটাবে সেটাই হয়তো তার বুঝে আসছে না। একবার মনে হচ্ছে রাতে সূর্যকে ব্লক না করলেই তো সে ফোন করে বলতো এখানে এসেছে। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে ওই অসভ্য তাকে ডাইনি বলছে মানে প্রেম ভালোবাসা কিছু না। ও তো তাকে ডাইনি হিসেবে কল্পনা করে। মেজাজ বিগড়ে আর কোন দিক ভাবতে ইচ্ছে করছে না। অনার্স শেষ হওয়ার পর থেকেই বাড়িতে বিয়ে নিয়ে চাপ দিচ্ছে সবাই। রাগের বশে সেঁজুতি মাকে ডেকে বলল, ‘বাবাকে বলো বিয়ে ঠিক করতে আর এক মাসের মধ্যেই আমি বিয়ে করবো।’
কথাটা শুনেই মাথা ভন ভন করছে সেঁজুতির মায়ের। কি বলছে মেয়ে! যাকে গত দু বছর ধরে বিয়ের কথা বললেই কতশত যুক্তিতর্ক নিয়ে ভাইকে সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় সে কিনা বলছে এক মাসের মধ্যে বিয়ে করবে! সন্ধ্যে নাগাদ বাড়িতে একটা হৈ হুল্লোড় লাগিয়ে দিলো তার মা৷ সেঁজুতির মাথা গরম আছে। এখন যেহেতু বলেছে সে বিয়ে করবে তো নিশ্চয়ই করবে যদি তার দেওয়া সময়ের মধ্যে হয়। সাজ্জাদের বিয়েতে তেমন অনুষ্ঠান হয়নি তবুও নিয়ম রক্ষার্থে শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলো সূর্যকে সাথে নিয়েই। সূর্যদের পরিবারটা একটু অগোছালো টাইপের। ছেলে মেয়ে নিজ মন মর্জিতে চলাফেরা করে। বাবা মা তাতে কখনো হস্তক্ষেপ করে না। বড় ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে তাতে পরিবার টু শব্দটি করেনি। এখন সে ছেলে বউ নিয়ে ধানমন্ডি থাকে ফ্ল্যাট কিনে তাতেও তাদের কোন কথা নেই। টাকা পয়সা অনেক আছে ভাগেরটা বুঝিয়ে দিয়েই বাবা মা খালাস। এই যে রেশমির বিয়ে হলো তাতেও বাবা মায়ের চেয়ে সূর্যের ভূমিকা বেশি। রেশমি যেমন যেমনটা আদেশ করেছে সূর্য নিজের লাভের কথা ভেবে সবটা করে গেছে। বাঁধন ছাড়া পরিবারে বড় হওয়া রেশমি শ্বশুর বাড়ি এসে প্রথমেই ঝটকা খেলো শ্বশুরের রাগী আচরণে। সেঁজুতির বিয়ের কথায় সবাই হল্লা করলেও সেঁজুতির বাবা রেগে গেলেন৷ সেঁজুতিকে বকে, ধমকে একের পর এক প্রশ্ন করছেন। সে কি সত্যিই বিয়ে করবে? পাত্র পক্ষ আসার পর কোন ড্রামা করবে নাতো! আর যদি কোন প্রকার সিনক্রিয়েট করেছে তো সেঁজুতিকে ত্যাজ্য করবেন। রেশমি তো ভেবেই পায় না শ্বশুরমশাই একমাত্র মেয়েকে এমন করে ঝাড়ছেন কেন। তার বাবা তো ভুল করেও তার সাথে জোরে কথা বলে না৷
সেঁজুতির রাগ চরম পর্যায়ে থাকায় বাবার সব কথা মেনে নিলো। দুদিনের মধ্যে পাত্রেরও সন্ধান পাওয়া গেল। ছেলে সচিবালয়ে চাকরি পেয়েছে মাত্রই বছর খানেক আগে। সরকারি চাকরি, ভালো স্যালারি সেই সাথে বিশাল এবং সুন্দর একটা ফ্ল্যাট। সব মিলিয়ে লোভনীয় পাত্র অনেকটা লোভনীয় খাবারের মতোই। ঘটককে বলা হলো প্রথম দিন পাত্রের পরিবার সাথে পাত্রকেও থাকতে হবে। এক সপ্তাহ পর পাত্র আর পাত্রের দুই ভাবীসহ এসে হাজির হলো। সেঁজুতিকে সাজিয়ে বসার ঘরে আনতেই তার চোখ পড়লো পাত্রের দিকে। এ্যাশ কালারের স্যুট পরা মেরুন রঙের টাই, মুখটা শ্যাম বর্ণ। আরেকটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই দেখলো মাথায় লোকটার হাতে গুণে কয়েকটা চুল তারওপর ভুঁড়ি বোধহয় শার্ট ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সোফায় বসতে বসতেই সেঁজুতির চোখ, মুখ, কপাল ঘেমে গেল। হ্যাঁ, সে দ্রুত বিয়ে করতে চাইছে তাই বলে এমন পাত্রকে করতে হবে? ‘অসম্ভব!’ বলেই সে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঘরময় উপস্থিত প্রত্যেকেই চমকে তাকালো তার দিকে।
‘কি হলো?’ প্রশ্ন করলো সেঁজুতির বাবা। বাবার কন্ঠ শুনতেই খেয়াল হলো সে মনে মনে ভেবে কথাটা জোরেই বলে ফেলল! কাঁপা স্বরে বলল, ‘কিছু না।’
আবার বসতে হলো। রেশমি শ্বাশুড়ির সাথে মিলে নানা পদের খাবার এনে রাখলো সামনে। ছেলে হঠাৎ বলল তার কিছু প্রশ্ন আছে। রেশমি আগ বাড়িয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই, আমি আপনাদের কথা বলার ব্যবস্থা করছি।’
উপস্থিত শ্বশুরের দিকে না তাকিয়েই রেশমি সেঁজুতিকে ধরে এগিয়ে গেল সেজুতির ঘরে। ছেলেকেও বলল যাওয়ার জন্য। সাজ্জাদ আজ বাড়ি নেই। সাজ্জাদের মা ছেলের বউয়ের কান্ড দেখে ভয়ে আছেন। কখন না শ্বশুর রেশমিকে মেহমানের সামনেই ধমকে উঠেন! তেমন কিছু হলো না। পাত্র ঘরে ঢুকে প্রথমেই প্রশ্ন করলো, ‘পড়ালেখা কতটুকু করেছেন?’
‘যতটুকু জেনে এসেছেন।’ ভেংচি কেটে বলল সেঁজুতি।
‘জ্বী!’
‘জ্বী।’
‘ওহ আচ্ছা, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে কিন্তু’
পাত্র একটা কিছু বলতে সঙ্কোচ বোধ করছে দেখে সেঁজুতি জিজ্ঞেস করলো, ‘কিন্তু কি?’
‘না মানে আমার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো,,’
‘কিহ্! আব্বা, আম্মা দ্যাখো এই ছেলে কি শয়তান। একটা গার্লফ্রেন্ড আছে আবার বলতেছে কিনা বিয়ের পরও থাকবে। আমি যেন এই নিয়ে কিছু না বলি আম্মা শুনছো।’
খুব জোরে চেঁচানো শুরু করলো সেঁজুতি। ভেজানো দরজার ওপাশ থেকে মেয়ের চিৎকারে সবাই হতভম্ব। সাজ্জাদও মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছিলো। সেঁজুতির চিৎকারে সবাই ঘরে ঢুকলো৷ কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাত্রের কলার টেনে তাকে কষে চড় থাপ্পড় মারলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ কিছুই বুঝলো না। শুধু পাত্র যেতে যেতে থ্রেট দিয়ে গেল। কিছু সময় বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করলো। সেঁজুতির বাবা নির্বাক কি হলো কেন হলো কিছুই বুঝতে পারছে না। সাজ্জাদ নিজের ঘরে ঢুকতেই রেশমি কটাক্ষ করলো, ‘খুব ভাইগিরি দেখাও তাই না?’
‘মানে!’
‘ওভাবে লোকটাকে মারলে কেন? সরকারি পদের লোক কখন কি করে বসবে তার ঠিক আছে?’
‘কে ভাবে ওসব নিয়ে। এসব সরকারি লোক চাকরি বাচানোর ভয়েই বাড়াবাড়ি করবে না।’
‘তুমি বেশি বোঝো তাই না! হাদারাম একটা।’৷ চটে গেছে রেশমি। কদিন ধরে কি যে হচ্ছে সব! তার ভাইটা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি এরই মাঝে সেঁজুতির এই আজাইরা জেদ! সেদিনের মত পরিবারে একটা গম্ভীর থমথমে পরিবেশ থাকলো সেঁজুতিদের বাড়ি। যত ঝামেলা শুরু হলো সূর্য আর রেশমির মাঝে। কারো না কারো মাধ্যমে সে খবর পেয়েছে সেঁজুতির জন্য পাত্র খুঁজছে। আর তার বোন তাকে কিছুই জানায়নি। রেশমি শুধু বলল, ‘তুই টেনশন ফ্রী থাক।’
এর বাইরে আর কিছুই বলছে না তাকে। এদিকে একটা সপ্তাহ পার হয়ে গেল সেঁজুতির রাগ কমেনি। সিম থেকে আনব্লক তো করেইনি উল্টো হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক সকল প্রকার সোশ্যাল সাইট থেকেই ব্লক করেছে। পাছার জখমেও তার ঝাঝড়া অবস্থা। চব্বিশ ঘন্টা লুঙ্গি পরে কোন মতে উপুর হয়ে বিছানায় পড়ে থাকছে। চাইলেও সে বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। মেয়েটা যে এত বদরাগী কেন? আর বদরাগী মেয়েটাকেই কেন সে ভালোবাসলো! এখন তো মাথা কুটে নিজেকেই শেষ করতে ইচ্ছে করছে। নিজের অসুস্থতায় এখন চরম পর্যায়ের রাগ হচ্ছে। দেখতে দেখতে আরো পাঁচ দিন কেটে গেল। সূর্য মোটামুটি সুস্থ অন্তত তার পশ্চাৎপদ জিন্সের ধকল সহ্য করার ক্ষমতা পেয়ে গেছে। বিকেল কিংবা সন্ধ্যার পর বন্ধুরা সবাই ক্যাম্পাসে আড্ডা দেয় এখনো। কয়েকজন চাকরি আর ব্যবসায় ঢুকেছে। সূর্য আর রওনক সেদিকে এখনো পা মাড়ায়নি৷ আজ বিকেলে রিফাত আর রওনক ফোন দিয়ে জানালো সেঁজুতি আজও কোন পাত্রের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। সূর্য ফোন দিলো সেঁজুতির নাম্বারে; এখনো ব্লক।
নতুন সিম কিনে সেটা দিয়ে কল দিলো।
‘হ্যালো।’
‘প্রথমে সালাম দিতে হয় ভুলে গেছিস? আসসালামু আলাইকুম। ‘
কথাটা বলেই সূর্য সালাম দিলো। সেঁজুতি সালামের জবাব দিলো খুবই মোলায়েম কন্ঠে। তারপরই বজ্রের মত হুঙ্কার দিলো, ‘তোর সাহস তো কম না আমাকে নাম্বার বদলে কল দিস?’
‘সাহসের তো এখনো কিছু দেখাইনি। বেশি বাড় বেড়েছিস তুই তা কি জানিস?’
‘আমি বেড়েছি না কমেছি সেই খবর তোকে রাখতে হবে না। তুই নিজের খবরই রাখ।’
‘তুই আজ কোন ছেলের সাথে দেখা করতে যাবি না শুধু মনে রাখিস।’
‘তুই বললেই হলো! আমি যাবো, দেখা করবো এবং বিয়েও করবো।’
সূর্যের আর ধৈর্য্য রইলো না। সে ফোন কেটে আবার তার বোনকে কল দিলো।
‘হ্যাঁ বল সূর্য। এখন কি অবস্থা তোর পেছনের।’
‘ফাইজলামি বন্ধ কর আপা। তুই বিয়ে করে ও বাড়ি কেন গিয়েছিলি?’
‘সংসার করতে। এ আবার কেমন প্রশ্ন করছিস।’
‘আপা! তুই আমার জন্য গিয়েছিস না? তুই তো বললি সব ঠিক করে দিবি। আর এখন একের পর এক প্যাচ লাগাচ্ছিস। তোর কারণেই কিন্তু সেঁজুতির সাথে আমার ছয়শো ত্রিশ নাম্বার ব্রেকাপটা হলো। এখন মনে হচ্ছে এটাই লাস্ট ব্রেকাপ।’
‘উফ, মেয়েদের মত এত কথা বলা কবে শিখলিরে! বিকেলে চলে আয় বনশ্রীতে।’
যে রেস্টুরেন্টে পাত্র আসবে দেখা করতে রেশমি সেই লোকেশনটা বলে দিলো সূর্যকে। বিকেল পাঁচটার দিকে রিফাত, রওনক আর সূর্য এসে উপস্থিত হলো যথাস্থানে। মাত্রই সেঁজুতিরা এসে পৌঁছেছিল। পাত্র একাই এসেছে। ডাক্তার পাত্র চোখে মোটা কাঁচের হেভি পাওয়ারের চশমা। দেখতে গোলাপি ফর্সা লোকটা, বয়সও কম। সেঁজুতি পাত্রকে এক পলক দেখেই বলল, ‘এর চুল গুলো ব্লন্ড হলে পুরাই বিদেশি লাগতো। রেশমিও সাথে এসেছে সেঁজুতির। একমাত্র ভাবী বলে কথা, মেয়ের সাথে তাকেই আসতে হবে। দু পক্ষের সাক্ষাৎ আর কুশল বিনিময় হতেই সূর্যরা তিনজন এসে সেঁজুতিদের টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। সূর্যকে দেখে সেঁজুতি একটুও ঘাবড়ালো না উল্টো নিজেই পাত্রকে ডেকে বলল, ‘মিট মাই ফ্রেন্ড সূর্য, রিফাত, রওনক।’
পাত্র ভদ্রতা দেখিয়ে তিনজনকেই হ্যালো বলল। সূর্য বলল, ‘পরিচয় সম্পূর্ণ হয়নি ডাক্তার সাহেব।’
সেঁজুতি ক্ষেপে গেল কিন্তু রেশমি নির্বিকার। সে উল্টো সূর্যদের বলল, ‘তোরাও বস চেয়ার টেনে। আমি খাবার অর্ডার দেই কি বলো সেঁজুতি!’
রেশমি ইচ্ছে করেই চলে গেল। সূর্য সেঁজুতির পাশের চেয়ার টেনে বসলো।
‘মিষ্টার ডক্টর, আমি সূর্য । সেঁজুতির একমাত্র ভাবীর একমাত্র ছোট ভাই। আর সেঁজুতির বয়ফ্রেন্ড।’
‘উহুম, একটু ভুল বললি সূর্য।’
সেঁজুতির কথায় বন্ধুরা প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো সাথে পাত্র নিজেও। সেঁজুতি আবার বলল, ‘ও হচ্ছে আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড আমার হবু বাচ্চাকাচ্চার মামা আর হবু বরের হবু শালা।’
রেগে গেল সূর্য। কিন্তু ডাক্তার পাত্র অতি চতুর হওয়ায় সে ঘটনা আঁচ করতে পারে। তাই বসা থেকে উঠে বলল, ‘মিস সেঁজুতি, আমার পাত্রী পছন্দ হয়েছে। নেক্সট মিট আপনার মতামত পেলে এনগেজমেন্ট ডেটই হবে। আমি আজ আসছি আর হ্যাঁ…’
পাত্র উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে হাজার পাঁচেক টাকা টেবিলে রেখে বলল, ‘এগুলো খুব টেনশনে নিয়ে এসেছিলাম। মনে হচ্ছিলো লাগবে না কিন্তু নাহ্ হবু শ্যালকদের একটা ট্রিট দিতেই পারি। আজ আসি, আল্লাহ হাফেজ।’
ডাক্তার সাহেব চলে যেতেই সূর্য বসা থেকে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তাকে পাত্তা না দিয়ে সেঁজুতি বেরিয়ে গেল। খাবার অর্ডার দিয়ে রেশমি টেবিলের দিকে আসার পথে সেঁজুতির সাথে দেখা হলো।
‘ভাইকে সান্ত্বনা দিতে ওদিকে যাবে নাকি বাড়িতে!’
চলবে