ভয় এবং জয় পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
7

#ভয়_এবং_জয় (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

“কি!”
পারুলের কথায় চমকে উঠে নদীর মা। সে তার কথা একদম বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই বলে,“আপনি ভুল ভাবছেন। আমার মেয়ের ঘাড়ে বিড়ালে আচড় দিয়েছে তার দাগ। আর আপনি সেটার ভুল ব্যাখা বের করছেন।
এই আপনার ডাক্তার হওয়ার নমুনা? আমার বান্ধবী বলেছিলো আপনি অনেক ভালো ডাক্তার। আমার মেয়ের মানসিক সমস্যা দূর করে দিবেন। এই তার নমুনা?”

“প্লীজ আপনি একটু শান্ত হন। উত্তেজিত হবেন না প্লীজ।”
পারুলের কথায় নদীর মা বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকায়। পারুল যথেষ্ট স্বাভাবিক ভাষায় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বেশ কিছুক্ষণ তর্ক বিতর্কের পর নদীর মা বলে,“নদী তো সারাদিন বাসায় থাকে। বাড়িতে তো এমন হওয়ার চান্স নেই। তাছাড়া ওর সাথে যদি এমন দূর্ঘটনা ঘটতো তো আমাকে বলতো না?”

“সেটাই তো। সে আপনাকে বলতে পারছে না। ভয় পাচ্ছে। আপনার মা হিসাবে সন্তানের সেই ভয় দূর করে, তাকে সাহস দেওয়া উচিত।
দেখুন মিসেস শায়লা, আপনার মেয়ে সারাদিন বাড়িতে থাকে এরমানে এটা নয় যে বাড়িতে তার সাথে কোনকিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। হতেই পারে। একজন মেয়ে যেকোন জায়গা যেকোন পরিস্থিতিতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে পারে।
আর হ্যাঁ স্যরি টু সে, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি মা হিসাবে খুবই অযোগ্য একজন মানুষ।”

“মানে?”
নদীর মা রাগান্বিত হলে পারুল শান্ত গলায় বলে,“এটাই সত্যি। একজন মা হয়ে আপনি নিজের মেয়ের গায়ে থাকা নির্যাতনের চিহ্নকে বিড়ালের আচড় হিসাবে ধরে নিলেন। মানে, সিরিয়াসলি? মা হয়ে মেয়ের মনের কথা বুঝছেন না? আসলে বোঝার চেষ্টাই করছেন না। করলে অবশ্যই বুঝতেন।”
নদীর মা এই পর্যায়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। পারুল তাকে বোঝায়, কর্মজীবী মায়েদের এই এক সমস্যা তারা নিজের ক্যারিয়ারে এত ফোকাস দেয় যে সন্তানকে অন্যের ভরসায় ফেলে রাখে। যেটা একদম ঠিক নয়। নিজের কাজ করেও মেয়েকে যথাযথ সময় দেওয়া যায়। মেয়ের সঙ্গে সেই সখ্যতা গড়া যায় যাতে মেয়ে নিজের মাকে তার বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবে ভাবতে পারে। জীবনের সব সমস্যা তার মাকে খুলে বলতে পারে। এজন্য মিসেস শায়লার কাজ শেষে বাড়ি ফিরে কিছুটা সময় নদীকে দেওয়া উচিত ছিলো। হ্যাঁ হয়তো সে তখন ক্লান্ত থাকে, কিন্তু একজন মায়ের নিজের থেকে বেশি সন্তানের কথা ভাবা উচিত। এসব শুনে নদীর মা বলে,“আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি কর্মজীবনে এত ব্যস্ত ছিলাম যে নদীকে সময় দিতে পারিনি। তাকে ছোট থেকে কাজের লোকের ভরসায় ছেড়ে রেখেছি। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না, বাড়িতে ওর সাথে এরকম ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারে? বাড়িতে তো কোন পুরুষ নেই।”

”আপনার স্বামীকে আপনার পুরুষ মনে হয় না?”
পারুলের এই কথা শুনে নদীর মা একদম হতভম্ব হয়ে যায়। সে একদম বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। পারুল একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“আমি জানি আমার এই কথাটি আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। তবে আমি যদি ভুল না হই তবে এসব আপনার স্বামী মিস্টার মাহমুদের কাজ। অর্থাৎ নদীর বাবার।”

“আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?”

“জ্বী হ্যাঁ জানি। আর এটাও জানি মাহমুদ সাহেব নদীর বায়োলজিকাল ফাদার নন। সে আপনার দ্বিতীয় স্বামী। নদীর সৎ বাবা।”
এখানে পারুল নদীর মাকে নানা কথা বলে। যার সারমর্ম হলো, তার সন্দেহ মাহমুদ সাহেবের উপর। সন্দেহ মিথ্যা হতে পারে। কিন্তু নদীর বাড়িতে থাকতে না চাওয়া, তার বাবাকে ভয় পাওয়া। বাবা কাছে আসলে দূরে সরে যাওয়া সবকিছু এসবেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।নিজের মেয়ের সুস্থতা চাইলে মিসেস শায়লার তার সঙ্গ দিয়ে, তার কথামতো নদীর সাথে আচরণ করা উচিত। অবশেষে মিসেস শায়লা নিজের সন্তানের কথা ভেবে পারুলের কথায় রাজি হয়।
___
পারুল নদীর কাছে এসে বসে। এটা নদীর ছোট আন্টির বাসা। নদী এখন এখানেই থাকছে। পারুলের সঙ্গে নদীর মাও এসেছে। পারুল নদীর হাত ধরে বলে,“আমি তোমাকে যে গল্পটা বলছিলাম তাতে কোন মিথ্যা নেই। সেদিন আমার ভয় জিতে গিয়ে আমাকে হারিয়ে দিয়েছিলো। যার ফলস্বরূপ যে আমার অপরাধী তার জয় হয়েছে। অথচ জয় হওয়ার কথা ছিলো আমার। কিন্তু হয়নি।”
একটু থেমে পারুল আবার বলে,“ভয় এবং জয়। এই দুটোর মাঝখানে শুধুমাত্র একটি এবং দাঁড়িয়ে আছে। তুমি যদি ভয়কে কাটিয়ে এবং শব্দটিকে সরিয়ে জয়কে ছিনিয়ে নিতে পারো তাহলে দেখবে তোমার দেখাদেখি সমাজের অনেক মানুষ এগিয়ে আসবে। অনেক মেয়েরা ভয়কে জয় করে তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে। তাই এবার তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তুমি ভয়কে বেছে নিবে নাকি জয়কে ছিনিয়ে নিবে।”
পারুল এভাবে নানা কথা বলে নদীকে বোঝায়। নদীর মায়ও মেয়েকে জড়িয়ে অনেক আশ্বাস দেয়, তার সাথে যা হয়েছে তা বলার জন্য। নদীর মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তারপর বলে,“আমি মা হিসাবে ব্যর্থ। আমি তোর খেয়াল রাখতে পারিনি। কিন্তু মা তুই ভয় পাস না। বিশ্বাস কর তোর মা তোর খারাপ চায় না। সে তোর জন্য সব করবে। তোর সাথে যাই হয়ে যাক না কেন, যেই তোকে ভয় দেখাক না কেন, তুই নির্ভয়ে সবটা বল। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, তোর হয়ে যা করা লাগে সেটা আমি করবো। তোর এই মা তোর জন্য সব করবে।”
এসব শুনে নদী যখন কিছু বলতে যাবে তখন তার বাবা মাহমুদ চলে আসে। তাকে দেখে নদী চুপ হয়ে যায়। ভয় পেয়ে মাকে আকড়ে ধরে। এই প্রথম নদীর এমন আচরণ দেখে নদীর মায়ের পারুলের কথাই সত্যি বলে মনে হচ্ছে। এভাবে কিছুদিন কেটে যায়, নদীর মা এবং পারুল মিলে তাকে নানাভাবে সাহস দেয়। মোটিভেট করে। তবে এসবে মাহমুদ বিরক্ত হচ্ছিলো, সে নদীকে ডাক্তার দেখাতে বারণ করে। এই কাজটি প্রথম থেকেই সে করছিলো। তার কথা নদী সময়ের সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। তার কিছু হয়নি। ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন নেই। তার এসব কর্মকান্ড আগে নদীর মা সন্দেহের নজরে না দেখলেও এখন দেখে। অতঃপর একদিন নদীকে সরাসরি বলে,“মাহমুদ তোর সাথে কিছু করেছে?”
এই কথা শুনে নদী ভয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। তার মা তাকে সত্যি বলার সাহস দেয়। তাকে সব বলতে বলে। অতঃপর নদী তার ভয়কে জয় করে সব বলতে শুরু করে। কিছুদিন যাবত নদী তার মায়ের সঙ্গ পেয়ে তার মা যে তাকে কতটা ভালোবাসে তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তার মা তার জন্যই যে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে সেটাও বুঝতে পারে। এতদিন তো তার মা তাকে সময় দেইনি, তাই নদীর মনে হতো তার মায়ের তার প্রতি টান নেই। তার মা মাহমুদকে ভালোবাসে। তাই তার কথার দাম দিবে না। তাছাড়া যখন ঘটনাটি করে তারপর সে তার মাকে অনেকবার বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার মায়ের তার কথা শোনার সময় হয়নি। আজ যখন তার মায়ের ভরসা, বিশ্বাস সে পেয়েছে তখন তার ভয় কেটে যায়। সে বলে। গত কয়েক মাস ধরে মাহমুদের আচরণ নদীর ভালো লাগে না। সুযোগ পেলেই সে তার গায়ে হাত দেয়। বিশেষ করে যখন থেকে নদীর ঋতুস্রাব শুরু হয়েছে তখন থেকে তার এই আচরণ লক্ষ্য করে নদী। অতঃপর একদিন মাহমুদের নোংরামির শিকার হয় সে। মাহমুদ ফাকা বাসায় তার মায়ের অফিস টাইমে বাসায় এসে নদীর সঙ্গে নোংরামি করে। সেদিন নদী অনেক চিৎকার করছিলো বলে তার বাবা নামক জানো য়ার তার মুখ ওড়না দিয়ে বেধে দিয়েছিলো। সেই ঘটনার পর নদী তার মাকে সবটা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু পারেনি। মাহমুদ তাকে অনেক ভয় দেখিয়েছিলো। যার ফলস্বরূপ দিনের পর দিন মাহমুদ তার সাথে খারাপ করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এসব সহ্য করতে না পেরে নদী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তার নানা মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সে রাতে ঘুমাতে পারে না। ঘুমাতে গেলেও ওসব খারাপ স্মৃতি চলে আসে। সে ভয়ে ছিটিয়ে যায়। হঠাৎ হঠাৎ ওসব ঘটনা ভেবে ভয় পায়। এসব শুনে নদীর মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার অগোচরে এত ঘটনা ঘটে গেছে। যে মানুষটিকে সে নিজের সন্তানের বাবা হিসাবে তার জীবনে নিয়ে আসছে সে এতবড় অমানুষ। এজন্যই বলে সন্তান থাকা অবস্থায় বিয়ে করতে হলে অবশ্যই যাচাই করে নিন সে আপনার সন্তানের যোগ্য বাবা হতে পারবে কি-না। নদীর মাত্র তেরো বছর বয়স। এতটুকু বয়সে তার উপর দিয়ে কি গেল সেটা বুঝতে পেরে নদীর মা কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে সিদ্ধান্ত নেয় মাহমুদকে সে শা স্তি দিবেই। সে থানায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পারুল থামায়। তারপর বলে,“প্রমাণ ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না। উল্টো আপনার মেয়ের সম্মান যাবে, তাকে সমাজে ছোট হতে হবে।”

“আপনি কি বলতে চান, এতকিছু জেনেও আমি চুপ থাকবো?”

“না। এজন্য আপনাকে আগে প্রমাণ যোগাড় করতে হবে। যার জন্য নদীর সাহায্য লাগবে। তাই আপনাকে নদীকে সেই সময়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে।”
পারুল পুরো বিষয়টি খুলে বলে। প্রথমে অবশ্য নদী রাজি হচ্ছিলো না। সে ভয় পায় মাহমুদকে তাই। তবে তার মা তাকে ভরসা দেয়, তার কিছু হবে না। এবার যখন তার মা সব জানতে পেরেছে তখন সে কখনোই মাহমুদকে তার কাছে ঘেষতেও দিবে না। অতঃপর নদী এবং তার মা মিলে মাহমুদকে দিয়ে তার দোষ স্বীকার করা। মাহমুদ একা ঘরে যখন নদীকে সব বলে তাকে ভয় দেখাচ্ছিলো সেই সময়ের সুযোগ নেয় তারা। সবটা তারা ক্যামেরাবন্দি করে। উল্লেখ্য যে এটাই তাদের পরিকল্পনা ছিলো। অতঃপর মাহমুদের নামে মামলা করে দেয় নদীর মা। এসব কাজে পারুল তাদের অনেক সাহায্য করে। পরিশেষে নদী ন্যায় বিচার পায়। সে এবং তার মা নতুন করে নিজেদের জীবন শুরু করে। তাদের এই নতুন জীবনে পারুল শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে অনেক ভূমিকা পালণ করে। পারুলের ডাক্তার হিসাবে অবশ্য এতটা করার কথা ছিলো না। তবুও করেছে। হয়তো নিজের অপরাধীকে শা স্তি দিতে না পারার গ্লানি থেকে করেছে। নাকি সে একজন মেয়ের মা সেজন্য করেছে তা জানা নেই পারুলের। তবে নদীকে সুস্থ স্বাভাবিক এক জীবন দিতে পেরে তার খুব ভালো লাগছে। তাছাড়া নদীর জীবনটাকে উদাহরণ হিসাবে দেখিয়ে পারুল সমাজকে দেখাতে চেয়েছিলো, সমাজের আনাচে কানাচে এমন অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায়। একটু সাহসের অভাবে, ভয় এবং জয়ের মাঝে পড়ে আমরা ভয়কে বেছে নিয়ে জয়কে ছুতে পারি না। সেটা যাতে কেউ না করে না। নদীকে দেখে সাহস পেয়ে অন্তত কেউ একজন মুখ খুলুক তার জীবনের এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিয়ে।

(সমাপ্ত)