ভাগ্যলিপি পর্ব-০১

0
3

#ভাগ্যলিপি
সূচনা পর্ব
#মায়মুনা_সালসাবিল

মাত্র চারমাস হয়েছে আমার ডিভোর্সের।এরই মধ্যে শুনলাম,আব্বু-আম্মু নাকি আবার আমার বিয়ের কথা ভাবছেন!ছেলেও দেখেছেন—এখন শুধু দিন-তারিখ ঠিক করা বাকি!আবার বিয়ের কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো…আমি চুপচাপ বিছানার কোণে বসে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম।যেভাবে কেঁদেছিলাম শাওনের সঙ্গে আমার বিয়ের দিন।শাওনের সঙ্গে আমার বিয়েটা কাকতালীয়ভাবে হয়ে গিয়েছিলো।তখন আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে।আমার মামাতো বোনের বিয়েতে প্রথম দেখে আমাকে শাওন।পরের দিনই সে হাজির তার পুরো পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে।শাওন বড় বিজনেসম্যান।পরিপাটি, স্মার্ট, সচ্ছল…আর সবচেয়ে বড় কথা,তার বাবা আমার আব্বুর পরিচিত ছিলেন।এজন্য কেউই আর সময় নষ্ট করলেন না।খুব ধুমধামে আমার বিয়ে হয়েছিল।সবকিছু যেন রূপকথার মতো ছিল তখন।আমার যেহেতু কোনো প্রেম ছিল না,তাই বিয়ের পর থেকেই শাওনই হয়ে উঠলো আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা।আমি তার ভেতরেই গড়তে চেয়েছিলাম আমার নতুন পৃথিবী।শাওন যে ভালোবাসা দিয়েছিলো,তা এতই গভীর, এতই বিশ্বাসজাগানো ছিলো যে আমি কখনো কল্পনাও করিনি,সে আমার সাথে এইরকম প্রতারণা করতে পারে!

কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম…শাওনকে তার এক্স প্রেমিকা টয়ার সাথে এক হোটেলে দেখে ফেলে আমার এক ফ্রেন্ড আর সাথে সাথে পিক তুলে পাঠিয়ে দেয় আমাকে। সেদিন সকালে শাওন আমার কপালে একটা নরম চুমু খেয়ে বুকে টেনে বলেছিলো,
“জান, যাচ্ছি… দুপুরে খেয়ে নিও। আমি আজ বাসায় লাঞ্চ করবো না,অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। তবে ডিনার একসাথেই করবো, হ্যাঁ?”
আমি বিশ্বাস করেছিলাম।অন্ধভাবে, নিঃস্বভাবে।
আমি জানতাম না…সেইটাই হবে আমাদের শেষ আলিঙ্গন।

টয়ার সঙ্গে শাওনের প্রেমটা ছিল প্রায় পাঁচ বছরের।
তাদের সম্পর্কটা অনেক গভীর ছিল,তবুও টয়া হঠাৎ একদিন জার্মানির এক ছেলেকে বিয়ে করে চলে যায় দূরদেশে— নতুন জীবনের খোঁজে।টয়ার বিয়ের এক বছর পরেই শাওন আমাকে বিয়ে করে।আমি জানতাম না, শাওনের অতীত ঠিক কতটা তীব্র ছিল,
বা সে সেই অতীত থেকে আদৌ বের হতে পেরেছে কিনা।আসলে শাওন আমাকে তার অতীত সম্পর্কে কিছুই বলে নি।

আমি তো শুধু একটা নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম তার পাশে।কিন্তু নিয়তি আমার জন্য কিছুই রেখে দেয়নি…বিয়ের বছর খানেক না যেতেই টয়া তালাক নিয়ে ফিরে আসে শাওনের পুরোনো জীবনে।আর শাওন?সে তার সেই পুরোনো প্রেমিকাকে ভুলতে পারেনি,ভুলতে চায়ওনি।বরং তাকে আবার গ্রহণ করে নেয়…একটা নতুন জীবনের মাঝখানে পুরোনো প্রেমকে নিয়ে শুরু হয় তাদের পরকীয়া।

আমি বুঝতেই পারিনি,শাওন দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছে।তার ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি ছিল না…
সে আমাকে সময় দিতো,প্রতিটি সকালে গালে নরম চুমু রেখে ঘুম ভাঙাতো,পছন্দের খাবার বানিয়ে খাওয়াতো,আমার ক্লাস, টিউশন, মুড—সব মনে রাখতো।আমার প্রতি কখনোই উচ্চস্বরে কথা বলেনি,
কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি।একজন আদর্শ স্বামীর সবটুকু ছায়া ছিলো তার আচরণে।

আর ঠিক এইখানেই আমি হেরে গিয়েছিলাম।ভালোবাসার ছায়ায় লুকিয়ে ছিলো এক নির্মম প্রতারণা,যেটা আমার চোখ বুঝিয়ে রেখেছিলো দিনের পর দিন।শাওনের নিজের বাসায়,
সমাজের চোখে, আমি তার বৈধ স্ত্রী হয়ে ছিলাম—
আর সেই সম্পর্কের আড়ালে বিভিন্ন হোটেলের কক্ষে,সে টয়াকে আবার তার প্রেমিকা বানিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছিলো।

কোন স্ত্রী পারে—স্বামীর সম্পর্কে এমন কথা শুনেও চুপচাপ থাকতে?আমি পারিনি। আমি চাইওনি।
খবরটা শোনামাত্রই আমি শাওনের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।ভালোবাসা যেখানে বিশ্বাসঘাতকতায় রূপ নেয়,সেখানে থাকা মানে নিজের আত্মার সঙ্গে বেঈমানি করা।তবে একটা সত্যি কথা বলতেই হয়—
শাওনের মা-বাবা, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি,
অসাধারণ মানুষ ছিলেন।তারা আমাকে অপত্য স্নেহে ভালোবেসেছিলেন,বারবার এসেছিলেন আমাকে ফিরিয়ে নিতে।কিন্তু আমি যাইনি আর।
তাদের ভালোবাসার মর্যাদা দিতে চেয়েছি—কিন্তু
তাদের ছেলের ভুলের বোঝা নিজে আর বইতে পারিনি।

তবে শাওন কখনোই আসেনি।না একবার ফোন করেছে,না পাঠিয়েছে কোনো অনুতপ্ত চিঠি।আর আসবেই বা কীভাবে?কোন মুখ নিয়ে সে আসতো আমার সামনে?যে মুখে সে আমাকে প্রতিদিন ভালোবাসি বলতো,সেই মুখেই ছিলো অন্য নারীর নামের অদৃশ্য চিহ্ন।যে চোখে ছিলো আমার প্রতিচ্ছবি,সেই চোখেই ছিলো টয়ার জন্য চিরচেনা অভ্যেস।আমি জানতাম—সে আসবে না, আসার সাহসও তার নেই।ভালোবাসা দিয়ে ছলনা করলে,
ভাঙা হৃদয়ের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি আর থাকে না।

তবে আমি চেয়েছিলাম,সে অন্তত একবার অনুতপ্ত হোক,একবার বলুক—
“আমি ভুল করেছি, ক্ষমা করো।”
কিন্তু হয়তো ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতাও সে হারিয়ে ফেলেছে।

আমার আর বিয়ে করতে মন চায়নি।মন, শরীর, আত্মা—সব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো একবার ভালোবেসে ঠকে যাওয়ার পর।কিন্তু কথায় তো আছে,
“গরীবের মুখে বায়না মানায় না”।
আমি মধ্যবিত্ত ঘরের এক সাধারণ মেয়ে,যার ইচ্ছার চেয়ে সমাজের সম্মান,আর মা-বাবার মুখ রক্ষা অগ্রাধিকার পায়।তাই জোর করেই তারা আবার বিয়ে দিয়ে দিলো আমাকে।
বললো—
“সময় সব ঠিক করে দেবে। ছেলেটা ভালো, এবার সব ঠিকঠাক হবে।”

কিন্তু আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না এই বিয়েতে?
কেউ একবার ও জানতে চায় নি আমার মনের অবস্থা।বিয়ের দিন আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো জীবনটাই শেষ করে দিই।সব শেষ করে চুপচাপ মরে যাই।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো—
আত্মহত্যা মহাপাপ।
যারা কষ্ট দেয়,তাদের শাস্তি পাওয়ার আগেই আমি যদি হেরে যাই,তবে কি সব অন্যায়ের জবাব রয়ে যাবে অবিচার হয়েই?

আমি নিজেকে সামলালাম,তবে সেদিন…
অনেক কেঁদেছিলাম।নীরবে, অন্ধকারে, সবার চোখ লুকিয়ে।বিয়ের কাবিননামায় সই দেওয়ার সময় হাত কাঁপছিলো,আর মনে হচ্ছিলো
“আমি নিজের প্রতি নিজেই বিশ্বাসঘাতকতা করছি।”

দ্বিতীয় স্বামীর মুখ দেখতেও ইচ্ছে করছিলো না আমার।ভাবতেই শরীর টা শিহরে উঠতে লাগলো—আবার একজন অচেনা পুরুষের কাছে নিজেকে কীভাবে বিলিয়ে দেবো?
ভালোবাসাহীন স্পর্শ,সম্মতির মুখোশ পরে সহ্য করে যাওয়া—এ যেন নিজের অস্তিত্বকে ধ্বংস করে বেঁচে থাকা।নিজেকেই ঘৃণা হতে লাগলো আমার। চিনতে পারছিলাম না আমাকে।

বাসর রাতে দরজা খুলতেই আমি আঁতকে উঠলাম।
নতুন বরের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুক ধক করে উঠলো।
এ তো… তুরাব!আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই।আমি স্তব্ধ। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি।
শরীরের প্রতিটি রক্তকণা যেন থেমে গেছে।
ঘাম জমে কপালে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।
এক পা…
দু’পা…
তুরাব ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো আমার দিকে।
একসময় এসে আমার পাশেই বসে পড়লো।
তার এই কাছাকাছি আসাটা,তার নিঃশ্বাসের গন্ধ,
তার সেই পুরোনো তীক্ষ্ণ চোখ দুটো…আমার শরীরকে ঝাঁকিয়ে দিলো।আমি কাঁপতে লাগলাম ভয়ে, আতঙ্কে, হতবাক হয়ে।
এ আমি কী দেখছি?
কাকে দেখছি?
এ কেমন নির্মম পরিহাস!
মন থেকে একটা অস্পষ্ট প্রশ্ন উঠে এলো—
“সৃষ্টিকর্তা, আপনি আবার কিসের খেলা খেলছেন আমার সঙ্গে?”
তুরাব…যে কিনা একসময় পুরো ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিলো”সন্ত্রাস টাইপ” একজন ছেলে হিসেবে।
ঝগড়া, দম্ভ, ভয় দেখানো,ছাত্র রাজনীতি আর ক্ষমতার দাপট—সব ছিলো তার ছায়ার মতো সঙ্গী।
আর আজ,সে-ই কিনা আমার স্বামী?

চলবে…….