#ভাগ্যলিপি[৪]
#মায়মুনা_সালসাবিল
হঠাৎ শাওন গাড়ির দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো।
চোখে রাগের আগুন, মুখে তীব্র অভিব্যক্তি।এক মুহূর্তের মধ্যে সে তুরাবকে এমন জোরে ধাক্কা দিল যে তুরাব হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল প্রায়।শাওন এবার দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে এল,গলায় বিষ মাখানো গর্জন—
“সেনাগিরি করছিস? যেখানে সেখানে গুন্ডামি করা শিখে দেবো—শালা ছোট*লোকের বা*চ্চা!”
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম।এতটা রাগ, এতটা অপমান—সামান্য কারণে কেউ কি এমনটা করে?না… শাওনের চোখে আমি অন্য কিছু দেখলাম।
ওর গলার স্বর, ভঙ্গি, আর চোখের জ্বলজ্বলে রাগ যেন বলছিল—এটা কেবল হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়।আসলে শাওন ইচ্ছা করেই তুরাবের সাথে ঝামেলা বাঁধাতে চাইছিল।তা না হলে অকারণে এতটা হিংস্র হয়ে উঠবে কেনো?
কিন্তু তুরাব কি বসে থাকার ছেলে?শাওনের ধাক্কার জবাব সে এমন জোরে দিল যে শাওন নিজেও মাটিতে পড়ে গিয়ে মুহূর্তেই রক্তাক্ত হয়ে গেল।তুরাব আবারও ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, আমি তাড়াহুড়ো করে তার হাত ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে শাওন উঠে এসে আবার তুরাবের দিকে আঘাত হানতে চাইলো।তুরাব চোখের পলকে শাওনের হাত পাশ কাটিয়ে ধরে ফেলল।
তার ঠোঁটে কটূ হাসি, গলায় তীব্র গর্জন—
“যার তার সাথে পাঙ্গা নিতে নেই, বুঝলি?আমি জানি, তোর হিংসে হচ্ছে—কারণ তোর প্রাক্তন বউকে আমি বিয়ে করেছি।হিংসায় জ্বলে যাচ্ছিস তাই না! গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ফূর্তি করছিস—কর না, কিন্তু আমাদের মাঝে ভুল করে আসার চেষ্টাও করবি না।একবার ভুল করে এসেছিস আর দ্বিতীয়বার এই সুযোগ পাবি না কোনোদিনই।”
শাওনের মুখে তখন আর কোনো কথা নেই—শুধু বিষ।হঠাৎ সে ভয়ঙ্কর এক আঘাত করল, তুরাবের কোমরের নিচে দিলো এক নির্মম লাথি!ব্যথার চোটে তুরাব সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলো। তুরাব মাটিতে পড়ে গেলে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে শাওনের গালে সপাটে এক চড় বসিয়ে দিলাম।আর চিৎকার করে বলতে লাগলাম,
“কিসের রাগ ঝাড়ছেন, মি: শাওন?আমাকে তুরাব বিয়ে করেছে সেজন্য?না আমরা দুইজন ভালো আছি দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছেন?ভাবছিলেন, আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে?কিন্তু না… সৃষ্টিকর্তা আমাকে আপনার মতো লম্পটের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।আমাকে দিয়েছেন একটি সুন্দর সংসার,
আর দিয়েছেন তুরাবের মতো ভালো একজন হাজব্যান্ড।এজন্য আমি লক্ষ কুটি শুকরিয়া জানাই সৃষ্টিকর্তাকে।”
কথাগুলো বলতে বলতে আমার গলা কেঁপে উঠছিল।কীভাবে শাওনের গায়ে হাত উঠল, বুঝতেই পারিনি—সবার সামনে এভাবে কথা শোনানো, এভাবে চড় মারা—সবকিছু যেন হঠাৎ করেই হয়ে গেল।ভাববার সময়ও পাইনি, কেবল বুকের ভেতর জমে থাকা আগুনটা বেরিয়ে এলো…শাওন চড় খেয়েও কোনো কথা বলল না।আমি এতগুলো কথা শুনিয়ে দিলাম, অথচ তার মুখ থেকে একটি শব্দও বের হলো না।তার চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ফাঁপা, কিন্তু সেই শূন্যতার ভেতরে কাঁটার মতো কিছু লুকিয়ে আছে—স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে শাওন দ্রুত গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল এবং ভেতরে বসে পড়ল।তারপর আমার দিকে একবার তাকাল—সেই দৃষ্টি যেন নিঃশব্দে কিছু বলে গেল।হঠাৎ মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে নিজের গাড়ির গ্লাসে সজোরে আঘাত করল!
টক করে ভেঙে গেল কাচের এক কোণা,আর সেই ভাঙা ধার কেটে দিল তার হাতের চামড়া।পাতলা রক্তের রেখা ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ল তার আঙুল বেয়ে…
টয়া সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল,
“বেবি! কী হয়েছে তোমার? কেন করলে এটা?”
সে তড়িঘড়ি শাওনের হাতটা ধরে রক্ত মুছতে আর বেঁধে দিতে গেল।কিন্তু শাওন তার হাত সরিয়ে দিয়ে হালকা হাসল—
“এ তো সামান্য আঘাত, টয়া…
এর থেকেও বড় রক্তক্ষরণ হচ্ছে আমার বুকে।”
শাওনের কণ্ঠে এমন এক ব্যথার সুর ছিল,যা মুহূর্তেই চারপাশের বাতাসকে ভারী করে তুলল।কিন্তু আমার চোখে তাতে কোনো সহানুভূতি নেই—আমার একটুও মায়া হলো না তার প্রতি।কারণ আমি তাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করি—আজীবন করেই যাবো।
এবার টয়া এগিয়ে এলো আমার দিকে,চোখে স্পষ্ট দ্বন্দ্বের আগুন—মনে হচ্ছিল এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে কথার লড়াইয়ে।কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই,
শাওন হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে এসে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরল।গলায় নরম অথচ দৃঢ় স্বর—
“গাড়িতে গিয়ে বসো… ওকে কিছু বলো না, বেবি।”
টয়ার চোখে তখনো অগ্নিশিখা জ্বলছিল,
তবু শাওনের হাতের দৃঢ়তা যেন তাকে থামিয়ে দিল।
শাওন ধীরে ধীরে টয়ার হাত ধরে আবার গাড়ির দিকে গেল,ভেতরে বসে আর কোনো কথা না বলে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো।
তুরাবের আঘাতটা এতটাই মারাত্মক ছিল যে সে কিছুতেই উঠতে পারছিল না।মুখ বিকৃত হয়ে গেছে যন্ত্রণায়।চারপাশে ভিড় জমে গেছে—সবাই হা করে তাকিয়ে আছে, কেউ আবার মোবাইল তুলে ভিডিও করছে।
আমার ভীষণ রাগ হলো।চিৎকার করে বললাম,
“আপনাদের তামাশা দেখা শেষ হয়ে গেলে প্লিজ সামনে থেকে সরে যান!”
এতোক্ষণ একটা লোকও এগিয়ে আসে নি প্রতিবাদ করতে,শুধু দাঁড়িয়ে থেকে ঘটনাটা দেখল, যেন এটা তাদের বিনোদনের খোরাক।
আমি একা হাতে তুরাবকে তুলতে পারছিলাম না।
তবুও মরিয়া হয়ে টেনে হিঁচড়ে ওঠানোর চেষ্টা করছিলাম।ঠিক তখনই রিকশাওয়ালা মামা ছুটে এসে ধরলেন,তার সাহায্যে কোনো রকমে তুরাবকে দাঁড় করালাম।মাথা নিচু, শরীর কাঁপছে ব্যথায়—
তুরাবকে ধরে আমি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা করে ঔষধ লিখে দিলেন।
রিপোর্ট দেখে বললেন, আঘাতটি খুব সংবেদনশীল জায়গায় করা হয়েছে।
আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম—শাওন ইচ্ছা করেই হিংসার আগ্রাসনে তুরাবের ব্যক্তিগত জায়গায় আঘাত করেছে।এই কারণেই তুরাব তখন আর পালটা আক্রমণ করতে পারেনি।
তুরাব রাগে গিজগিজ করতে লাগলো।একদিকে আঘাতের ব্যথায় কাতরাচ্ছে,অন্যদিকে শাওনের প্রতি ক্ষোভ এত প্রবল যে, তার চোখে আগুন জ্বলে উঠছে।মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
“শালা… শুধু সামনে আসিস আরেক দিন।
তোর ওটা কে*টে কু*কু*রকে খা*ই*য়ে দেবো।”
আমি আজ তুরাবের চোখে-মুখে যে আগুন দেখলাম…সে আগুন নিভে যাবে না এত সহজে।আমার মনে হচ্ছে—যদি কোনো দিন শাওন আবার তুরাবের সামনে আসে,হয়তো সেও একই রকম আঘাত ফিরিয়ে দেবে…।
তুরাব অফিস থেকে কিছুদিন ছুটি নিলো।
কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানি তো বেশিদিন ছুটি দেয়নি।
তুরাব সুস্থ হতে পুরো এক সপ্তাহ সময় লেগে গেলো।
এই কয়েক দিনের মধ্যে তুরাবকে নিয়ম করে ঔষধ খাওয়ানো, সব সময় তার কাছে থাকার ফলে এক অদ্ভুত মায়া তৈরি হলো।মনে হলো, এই ছেলেটি আমার কতটা আপন।অথচ, কিছুদিন আগেও তার প্রতি আমি কতটা বিরক্ত ছিলাম!
তুরাবের জীবনে আসার পর আমি প্রায় আমার অতীত ভুলে যাচ্ছি।মনেই হয় না, আমি কি ভীতিকর অতীতের মুখোমুখি হয়েছিলাম।আসলে, পারফেক্ট জীবনসঙ্গী থাকলে সব কিছু ভুলে যাওয়াই সম্ভব।
কথাই আছে—একজন ভালো হাজব্যান্ড পাওয়া মানে সেই নারীর জন্য দুনিয়ায় বেহেশত,
আর খারাপ দুশ্চরিত্র হাজব্যান্ড মানে তার জন্য দুনিয়ায় নরক।
তুরাব আজ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে হাসিমুখে অফিস গেলেও বাসায় ফিরলো মুখ কালো করে।
তার মুখমন্ডল দেখে আমার হৃদয় যেন কেঁপে উঠলো।এতো বিষন্ন কেন দেখা যাচ্ছে ছেলেটিকে?
আমি ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে গেলাম।হঠাৎ তুরাব আমার মুখমণ্ডলে একের পর এক পাগলের মতো চুমু এঁকে দিল।তারপর আমাকে টেনে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে গভীর কণ্ঠে বলল—
“আজীবন থাকবে তো আমার পাশে?
যত বাধা-বিপত্তিই আসুক না কেন,
আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো… আবার?”
আমি অবাক হয়ে গেলাম।
হঠাৎ এমন করে কেনো কথা বলছে তুরাব?
আমি তুরাবের বুক থেকে উঠতে চাইলে সে আরও শক্তভাবে চেপে ধরে বললো—
“আমার সঙ্গে থেকো, শেষ অব্দি ঊষা।
দেখে নিও, একদিন সব হবে আমার।
দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মেয়ে বানাবো আমি তোমাকে।”
আমি কি উত্তর দেব তুরাবের এমন কথায়?
শুধু চুপচাপ তার বুকের সঙ্গে নিজের মাথাটা গুঁজে নিলাম।
আজকেই প্রথমবার তুরাব আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরল,আর একসাথে এতগুলো ভালোবাসার চুমু এঁকে দিল।তার এমন স্পর্শে একটুও অস্বস্তি লাগল না—বরং মনে হলো, আমার ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকেই আদর পাচ্ছি।
তবু কোথায় যেন এক অজানা ভয় চেপে বসল মনে।
তুরাবের এই আচরণের আড়ালে কি আবার কোনো খারাপ খবর লুকিয়ে আছে?কোথাও কি আবার কিছু ঘটে গেল তার সাথে…?
হ্যাঁ খারাপ কিছুই হয়েছে।
তুরাবের চাকরি টা চলে গেছে।আজ অফিসে পৌঁছতেই ম্যানেজার কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছে
“তোমার আর আগামীকাল থেকে আসা লাগবে না।”
তুরাব চুপচাপ, নীরবে লেটারটা নিয়ে বাড়ি ফিরে চলে এসেছে।
চাকরিটা চলে যাওয়ায় তুরাবের মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।এমনিতেই সে নিজের বাড়ি থেকে চলে এসেছে, থাকার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই এখন।এই অবস্থায় চাকরি টাও চলে গেলো এখন সে বাড়ি ভাড়া দেবে কীভাবে?আর সংসার ই বা সামলাবে কীভাবে?
ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা, এক আতঙ্ক—যা তাকে নিঃশব্দে চেপে ধরে বসেছে, তুরাবের মনে হতে লাগলো যেন পৃথিবী তার পায়ের নিচ থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে…।
তুরাবের বাবা, তারেক মণ্ডল, একজন সরকারি চাকরিজীবী—প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
তুরাব চাইলে আজই সব রাগ-অভিমান ভুলে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারে।
কিন্তু সমস্যা হলো—তুরাব ভীষণ জেদী আর একগুঁয়ে স্বভাবের।তার বাবা-মা আমাকে পছন্দ করেন না।তার ওপর তুরাবকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন তার মা-ই,আর তুরাব রাগ করে চলে আসার পর থেকে একবারও তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেননি কেউ।এই কারণেই তুরাব মনে মনে শপথ নিয়েছে—নিজের ইচ্ছায় আর কোনোদিনও ফিরবে না সেই বাড়িতে,যত কষ্টই আসুক সামনে।
চলবে………