#ভাগ্যলিপি(৫)
#মায়মুনা_সালসাবিল
পরিস্থিতি যেমনই হোক, যতই দুঃখ-কষ্ট থাক না কেন, প্রত্যেক মেয়ের উচিত গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করা। কারণ মানুষের ভাগ্য কখন কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা কেউ জানে না। ভাগ্যের উপর তো কারও হাত নেই—কখন কার আর্থিক অবস্থা কেমন হবে, তা আগে থেকে বলা যায় না।পড়াশোনা সম্পূর্ণ থাকলে অন্তত একটি কেজি স্কুলে শিক্ষকতা করেও কিছুটা কষ্ট লাঘব করা যায়। অথবা বাসায় কয়েকজন বাচ্চাকে প্রাইভেট পড়িয়েও সংসারের কিছুটা চাপ কমানো সম্ভব।
ভাগ্যিস আমার অনার্স সম্পূর্ণ করা ছিল। এজন্য নিকটস্থ একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতার চাকরি নিলাম। যদিও তুরাব এতে রাজি ছিল না, কিন্তু আমি অনেক বুঝিয়ে রাজি করালাম। তবুও সে কিছুটা মন খারাপ করেই থাকল আমার ওপর।
আমি তাকে শান্তনা দিয়ে বললাম, “তোমার ভালো একটা চাকরি হলেই আমি এটা ছেড়ে দেবো।”
বর্তমানের বাসা টা ছেড়ে দিয়ে স্কুলের কাছাকাছি একটি বাসায় উঠলাম। এবার আর কোনো ফ্ল্যাট বাসা নিলাম না। কম ভাড়ার একটি আধাপাকা বাড়ি নিয়ে নিলাম আমরা।
তুরাবের বন্ধু হাবিব অনেক চেষ্টা করছে তার অফিসে একটি চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য। এমন বন্ধু পাওয়া আসলেই ভাগ্যের বিষয়। তুরাবের এই দুঃসময়ে, যেখানে তার নিজের বাবা-মা কোনো খোঁজখবর নিচ্ছেন না, সেখানে বাইরের একজন ছেলে এতটা চেষ্টা করছে—এটা সত্যিই প্রশংসনীয়।
হাবিব চেয়েছিল, তুরাবের চাকরি না হওয়া পর্যন্ত আমরা যেন তাদের বাসায় গিয়ে উঠি। কিন্তু তুরাব রাজি হয়নি। সে আমাকে নিয়ে অন্য কারও বাড়িতে থাকতে একদমই রাজি নয়।
হাবিব তুরাবের বাবা-মাকে জানিয়েছিল যে তুরাবের চাকরিটা চলে গেছে এবং তারা এখন খুব বিপদের মধ্যে আছে। কিন্তু এটা শুনে তারা সাহায্য করতে আসার বদলে উল্টো তার মা আমাকে অলক্ষুণে ও অপয়া বলে গালিগালাজ করেছে। তার মতে, এসব নাকি আমার জন্যই হয়েছে।
হাবিব কথাগুলো আমাকে বলতে বারণ করেছিলো কিন্তু রেশমির কাছ থেকে সব শুনে আমার মন টা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, আমি সত্যিই অলক্ষুণে?এজন্যই বুঝি বিয়ের পরপরই তুরাবের চাকরিটা হারাতে হলো।
আমি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, তাই বাবার বাড়িতে থাকাকালীন অভাব-অনটনের স্বাদ কিছুটা হলেও পেয়েছি। সেই কারণেই আজ এই অভাবের সংসারে আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছে না। আমি সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছি সহজেই।
তবে শাওনের সংসারে অভাবের কোনো ছিঁটেফোঁটাও ছিল না।আমাকে কখনো কোনো কাজ করতে হয়নি—রান্নার জন্য আলাদা রাঁধুনি, ঘরদোর পরিষ্কারের জন্য আলাদা লোক ছিলো।শাওনের যেহেতু বড় ব্যবসা-বাণিজ্য ছিলো, সে আমাকে সত্যিই রাণীর মতোই রেখেছিলো।হয়তো এই কারণেই শাওন ভেবেছিলো—আমি তার পরকীয়ার কথা জেনেও কখনোই এই আরামের জীবন ছেড়ে চলে আসবো না।সেজন্য শাওন বার বার তার বাবা-মাকে পাঠিয়েছিলো আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য।
মানে, বাহিরে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ফুর্তি করবে, আবার আমাকেও আগলে রাখবে—বড়লোক ছেলেদের অদ্ভুত সব শখ থাকে!
শাওন ভেবেছিলো আমি টয়ার মতো তার ঐশ্বর্যের মোহে পড়ে আজীবন তার সব অপরাধ মেনে নিয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে পড়ে থাকবো তার পায়ের কাছে।
এখন যেই দেখলো, আমি তুরাবকে বিয়ে করে সুখে আছি—অমনি শাওনের গায়ে জ্বালা শুরু হয়ে গেছে।আসলে, শাওন চায় আমাকে আবার তার জীবনে ফিরিয়ে নিতে।আর তুরাবের চাকরি হারানোর পেছনে শাওনের হাত আছে।কারণ, তুরাবের কোম্পানির বসের সাথে শাওনের ভালো সম্পর্ক,আর এই সুযোগেই শাওন এই জঘন্য কাজটি করেছে।
শাওনের ধারণা ছিলো—তুরাবের চাকরি না থাকলে,
আমি হয়তো তাকে ছেড়ে চলে আসবো।কিন্তু শাওন হয়তো জানে না—
মেয়েরা অভাবের জন্য স্বামীর সংসার ছেড়ে যায় না,
মেয়েরা সংসার ছেড়ে যায় স্বামীর দুর্ব্যবহার আর খারাপ চরিত্রের কারণে।স্বামী যদি চরিত্রবান হয়,
আর এক নারীতেই মন ও মনোযোগ নিবদ্ধ রাখে,
তাহলে সেই সংসারে যত অভাবই আসুক,মেয়েরা কখনোই তা ছেড়ে চলে যায় না।
আমি, ঊষা, অন্তত তুরাবকে কোনোদিনও ছেড়ে যাবো না।যে ছেলে ভালোবাসার মানুষের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে পারে,ভালোবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে সেই ছেলেকে আমি সারাজীবন আমার বুকের গভীরে আগলে রাখবো—তা যত বাধা-বিপত্তিই আসুক না কেন।
তুরাবের চাকরি চলে গেছে—এ কথা আমি আর বাবা-মাকে জানালাম না।অকারণে তারা দুশ্চিন্তা করুক, সেটা আর চাই না।তাছাড়া তুরাবকে নিয়ে আমার আর কোনো অভিযোগই নেই।তারা এবার আমাকে একজন সত্যিকারের যোগ্য ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছেন।শুধু একটা আয়ের ব্যবস্থা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।এজন্য তুরাবকে মানসিকভাবে শক্ত রাখার চেষ্টা করলাম, বোঝালাম,
“সব ঠিক হয়ে যাবে, শুধু ধৈর্য ধরো।”
আমার এই সান্ত্বনা পেয়ে তুরাবও আর নিজেকে একা মনে করল না।সে একটু পর পর বাচ্চাদের মতো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে,
“আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, ঊষা।
তুমি পাশে থাকলে আমি সব বাধা-বিপত্তি ঠিকই পার হয়ে যেতে পারবো।”
তার কথার উষ্ণতায় আমার বুক যেনো ভরে উঠে।আমি তুরাবকে আরও শক্ত করে নিজের বুকে টেনে নেই শুধু,কেন জানি এখন মনে হয় এই মানুষটার সাথে আমার জন্ম জন্মান্তের সম্পর্ক”
কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করার কারণে কয়েকজন স্টুডেন্টের মা তাদের বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ানোর জন্য আমাকে অনুরোধ করতে লাগলেন। তবে শর্ত ছিল, তাদের বাসায় গিয়ে পড়াতে হবে। সবাই ভালো বেতন দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
কিন্তু তুরাব রাজি হলো না। শোনামাত্রই সে চোখ দুটো বড় করে বলল,
“মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে পড়িয়ে টাকা ইনকাম করে নিয়ে আসবে, আর সেই টাকা আমি বসে থেকে খাবো—না, এটা হবে না কখনোই। স্কুলে শিক্ষকতা করো, এই পর্যন্ত ঠিক আছে।”
কিন্তু বাচ্চাদের মায়েরা বার বার রিকুয়েস্ট করতে লাগলেন। তখন আমি তাদের আমার সমস্যার কথা জানিয়ে দিলাম। বললাম, “আমি কারো বাসায় গিয়ে পড়াতে পারবো না। তবে আমার বাসায় আসতে পারলে পড়াতে পারবো।”
এটা শুনে তিনজন বাচ্চার মা রাজি হয়ে গেলেন। আমি তো মহা খুশি হয়ে গেলাম। আমার এই অভাবের সংসারে কিছুটা হেল্প করতে পারায় নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দিতে লাগলাম।
প্রায় তিন মাস পর তুরাব আবার একটি ভালো চাকরি পেল। খুশিতে তার চোখ ভিজে উঠল, যেন কোনো সোনার খনি পেয়ে গেছে—এতটাই উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছিল তাকে। চাকরি পাওয়ার সাথে সাথেই সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল, এবার থেকে আমাকে আর কোনো চাকরি করতে দেবে না। তার মতে, এখন থেকে তার বেতনে আমাদের সংসার ভালোভাবেই চলবে।
কিন্তু এটা শুনে আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মুখে কিছু বললাম না; শুধু মন খারাপ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তুরাব বুঝতে পেরে চুপচাপ আমার পিছু নিল। বারান্দায় এসে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল—
“তোমার খুশিই আমার খুশি, ঊষা। এভাবে মন খারাপ করে থেকো না, প্লিজ। তুমি যে কাজে আনন্দ পাবে, যে কাজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, সেটাই করবে। আমি কোনো বাধা দেব না তোমাকে। তোমার খুশিটাই আমার কাছে সবার আগে প্রায়োরিটি পাবে।”
তুরাবের এই কথা শুনে আমার খুশির সীমা রইল না। আনন্দে চোখ ভিজে উঠল। আমি মৃদু হেসে বললাম,
“বাচ্চাদের উপর ভীষণ মায়া জন্মেছে আমার। ওদের না দেখলে এখন মনটাই খালি খালি লাগে। প্লিজ, আমাকে আর কখনোই এই কাজ করতে নিষেধ করো না। আমি ওদের ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি।”
তুরাব তা শুনে হেসে বলল,
“তোমার বাচ্চা ভালো লাগে, ঊষা?”
আমি মৃদু স্বরে উত্তর দিলাম,
“হুম…”
সে তখন আমার মুখটা আলতো করে উপরের দিকে তুলে কেমন যেন দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“আমারও ভালো লাগে… ভীষণ ভালো লাগে। ভাবো তো—দুই-তিনটা ছোট্ট বাচ্চা এদিক-সেদিক গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়াবে, ‘আব্বু, আব্বু’ বলে ডাক দেবে… ইসস! শুধু কল্পনাতেই আমার খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
তারপর ধীরে ধীরে আমার চোখে চোখ রেখে নরম স্বরে বলল—
“তুমি কি আমাকে ‘বাবা’ ডাক শুনাতে হেল্প করবে, ঊষা?”
তুরাবের এমন আবদার শুনে আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। যদিও তুরাবের সাথে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি, তবু এই কথা শুনে শরীরটা কেমন হালকা কেঁপে উঠল। আমি কিছু না বলে চুপচাপ অন্য পাশ হলাম।
আমার নীরবতা বুঝে তুরাব মৃদু হেসে বলল—
“ওকে, ম্যাডাম… এত লজ্জা পেতে হবে না। আপনি না চাইলে কিছুই হবে না। আগে পুরোপুরি স্বাভাবিক হন, আমাকে আরও ভালোভাবে জানুন, বুঝুন, ভালোবাসুন… তারপর না হয় এসব বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারে ভাবা যাবে।”
আমি তখন বলেই ফেললাম,
“হ্যাঁ, আমিও এখনই বাচ্চা নিতে চাই। আমার বরাবরই ভীষণ ইচ্ছা ছিল একজন ভালো মা হওয়ার।”
কথাটা শোনামাত্র তুরাব খুশিতে পাগল হয়ে গেল। সে হঠাৎ আমাকে কোলে তুলে নিল, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ সে পেয়ে গেছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে চারপাশে পাগলের মতো ছুটতে লাগল।আমি তার এই পাগলামি দেখে হেসে ফেললাম। কখনো ভাবিনি, ডিভোর্সি হয়েও আমি কারো এত প্রিয়, এত শখের নারী হতে পারব। খুশিতে আমার চোখ ভিজে উঠল।
তুরাব আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে হাসিমুখে বলল,
“আরেহ পাগলি, কাঁদছো কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন।”
তুরাব নতুন জব পেয়েছে, আমি নিজেও শিক্ষকতা করছি—এই দ্বিগুণ খুশিতে তুরাব সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে আমাকে নিয়ে তার বাড়ি গেল। কিন্তু তুরাবের মা আমাদের সাথে একটিও কথা বললেন না।আমাদের দেখে দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে রইলেন।
আমার ভীষণ খারাপ লাগল। তুরাব অনেক অনুনয় করেও মায়ের রাগ ভাঙাতে পারল না। শেষে সে বিরক্ত হয়ে আমাকে সাথে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল।
আমি তখন তুরাবকে বললাম,
“তোমার মা হয়তো অভিমান করে আছেন। সেদিন তুমি আমাকে নিয়ে হঠাৎ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় কষ্ট পেয়েছেন হয়তো। আজ আমরা যাব না, যতক্ষণ না উনার অভিমান ভাঙে। দরকার হলে বাইরে সারারাত কাটিয়ে দেবো। উনি তোমার মা—অবশ্যই তোমার প্রতি তার ভালোবাসা আছে।”
তুরাব আমার কথা শুনল। আমরা আবার বাড়ির ভেতর চলে গেলাম। আশ্চর্যের বিষয়, আজ রিয়া আমার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করছিল। তবে তুরাবের সাথে একটিও কথা বলছিল না।
আমি তখন রিয়াকে বললাম,
“নিজের ভাইয়ের সাথে কেউ এভাবে অভিমান করে থাকে নাকি? কথা বলো ভাইয়ের সাথে। তোমাদের জন্য সে কত কষ্ট পাচ্ছে, যদি জানতে, তাহলে এভাবে রাগ করে থাকতে পারতে না।”
আমার কথা শুনে রিয়া ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে হঠাৎ কেঁদে ফেলল। তুরাবও আবেগে ভেসে গেল। ভাইবোনের মান-অভিমান শেষে আমি রিয়াকে একটা গিফট বক্স দিলাম।
বললাম,
“তোমার জন্য দুইটা ড্রেস আর কিছু কসমেটিকস এনেছি। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা?”
রিয়া বক্স খুলে আমাদের সামনেই সব দেখল। বেশ পছন্দ হয়েছে তার। খুশি হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিলো। আমি হেসে বললাম,
“ভাবিকে পছন্দ হয়নি তো কী হয়েছে? ভাইয়ের বাসায় তো অন্তত বেড়াতে আসতে পারো, কিংবা আমাদের সাথে থাকতেও পারো।”
রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি তো যেতেই চাই, কিন্তু আম্মু রাগ করবে বলে যাই নি। ভাইয়ের জব চলে গেছে শুনে আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল। আমি আর আব্বু যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আম্মু যেতে বারণ করেছিল এজন্য যাই নি।”
চলবে…….