#ভাগ্যলিপি(৮)
#মায়মুনা_সালসাবিল
আমি রেশমি ভাবির পিছু পিছু যেতে লাগলাম। কিছুদূর এগোনোর পর হঠাৎ দেখি, তাঁর রিকশাটা
একটি পাঁচতলা বাড়ির সামনে থামল। আমি আমার রিক্সাওয়ালাকেও থামতে বললাম। আরিহানের হাত ধরে ধীরে ধীরে রেশমি ভাবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।আমাকে দেখে রেশমি ভাবি যেনো থমকে গেলেন। অবাক হওয়ারই কথা—পাঁচ বছর পর দেখা। তার চেহারায় সেই আগের উজ্জ্বলতা নেই, চোখে অজানা ক্লান্তি, মুখে কিছুটা বিষণ্ণতা। তার গায়ে কমদামি, সাধারণ কাপড়।কিছুটা বদলে গেছেন তিনি, সময় ও দুর্দশার ছাপ তার উপর স্পষ্ট।
রেশমি ভাবি আমাকে দেখামাত্র আঁকড়ে ধরে বললেন,
—“আরেহ, ঊষা ভাবি! কতদিন পর দেখা!”
আমি সাথে সাথে বললাম,
—“ভাবি, এভাবে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন আপনারা? আপনাদের তো কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছিল না। বাড়িও বদলে ফেলেছেন। আর হাবিব ভাইয়ের ফোনও দেখছি সুইচডঅফ।”
রেশমি ভাবির চোখে অশ্রু জমে গেল। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তিনি বললেন,
—“জানি না, ভাবি… হাবিব এখন কোথায় আছে। অনেক খুঁজেছি, কিন্তু তাকে পাইনি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—“কি বলছেন এসব ভাবি? হাবিব ভাই আবার কই গেছে?
রেশমি ভাবি তখন ধীরে ধীরে বললেন,
—“তুরাব ভাই মারা যাওয়ার পরপরই হাবিব হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল। কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাকে। অফিসে গেলে জানতে পারি, সেদিন হাবিব অফিসেই যায় নি।আমি থানায় মিসিং ডায়েরিও করেছিলাম। কিন্তু আজও তার কোনো খবর পাইনি।”
তিনি কিছুক্ষণ থেমে কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
—“দুই বাচ্চা নিয়ে ভীষণ বিপদের মধ্যে ছিলাম। তাই বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছি। আপনার কোনো খোঁজ খবর নিতে পারিনি, ঊষা ভাবি। এমন পরিস্থিতিতে আমি কী করতে পারতাম?”
রেশমি ভাবির কথা শুনে আমার মন ভীষণ কষ্টে ভরে উঠল। তুরাবকে হারানোর দুঃখ এখনও যেন সাগরের মতো বুকের মধ্যে ঢেউ তুলে,আর হাবিব ভাই এর নিখোঁজের খবর শুনে রেশমি ভাবির জন্য ভীষণ ব্যথা লাগল।
তবুও আমি চেষ্টা করলাম তাকে সান্ত্বনা দিতে।
কিন্তু রেশমি ভাবি যেনো আমার কথা শুনে আরো জোরে কেঁদে উঠলেন, অঝোরে চোখের পানি পড়তে লাগল। চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
—“হয়তো ওকে কেউ মেরেই ফেলেছে, ভাবি। না হলে পাঁচ বছরেও কেন তাকে পাওয়া গেল না?”
অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে রেশমি ভাবি হঠাৎ আরিহানের দিকে তাকালেন।ছোট্ট আরিহান, যে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, বিস্ময় চোখে ভাবছে—“ইনি এতো কাঁদছেন কেনো?”
রেশমি ভাবি অবাক হয়ে বললেন,
—“কে এটা?”
আমি আরিহানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—“আরিহান, আমার আর তুরাবের ছেলে।”
রেশমি ভাবি শোনামাত্রই দু’হাত বাড়িয়ে আরিহানকে কোলে তুলে নিলেন। যেনো অনেকদিনের না দেখা কোনো আপনজনকে পেয়েছেন। তিনি একের পর এক চুমু খেতে লাগলেন ছোট্ট মুখে। তারপর ভেজা গলায় বললেন,
আপনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন ভাবি?কই জানতাম না তো।তুরাব ভাই কি জানতো?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, না।
—“ইশ! তুরাব ভাই যদি বেঁচে থাকতেন! কতই না খুশি হতেন। আমার ছেলে-মেয়েদের দেখে শুধু একটা কথাই বলতেন—কবে যে আমি বাবা হবো!”
ভাবির কথায় বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। চোখ ভিজে এলো অজান্তেই। তুরাব থাকলে আজ কত খুশি হতো তাঁর নিজের সন্তানকে দেখে। ওর যে কতখানি ভালো লাগত ছোট্ট বাচ্চাদের!
রেশমি ভাবি বেশিক্ষণ আমার সাথে কথা বলতে পারলেন না।অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—“ভাবি, আরেকদিন গল্প করবো! এখন কাজে না গেলে চাকরিটাই চলে যাবে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—“কাজে? কোন কাজে ভাবি?”
তিনি লজ্জায় মাথা নিচু করে বললেন,
—“এই বাড়িতেই কাজ করি ভাবি। মানুষের ঘরে ঝি-এর কাজ করি। আর কি করবো? হাবিব নিরুদ্দেশ হওয়ার পর দুই বাচ্চা নিয়ে ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। তখন বাধ্য হয়েই এ কাজ শুরু করেছি। মানুষ তো বলে—ভাগ্যের লিখন কেউ মুছতে পারে না। কপালে যা আছে, তাই ভোগ করতে হয়।”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মনে হলো বুকের ভেতরটা কেউ মুঠো করে চেপে ধরেছে। রেশমি ভাবির কষ্টের মুখ আর ক্লান্ত চোখ যেন আমাকে অস্থির করে তুললো। পাঁচ বছর আগে যে মানুষটা সাজগোজ করে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকতেন, আজ তিনি অন্যের ঘরে কাজ করেন! এ কি তবে জীবনের নিষ্ঠুর পরিহাস?
আমি তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। বললাম,
—“ভাবি, আর কষ্ট করতে হবে না আপনাকে। চলুন আমার সাথে। আমি আপনাকে আর এসব কাজ করতে দেবো না।”
তিনি প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। চোখের কোণে সামান্য আশার ঝলক থাকলেও কণ্ঠে হালকা দ্বিধা। বারবার বলছিলেন,
—“না ভাবি, আপনার ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবো না। আপনি নিজেই স্বামী হারিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন। তার মধ্যে আমাদের তিনজনের বোঝা যদি আপনার কাঁধে দিয়ে দিই, তবে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হবে।”
কিন্তু আমি একরকম জোর করেই তাকে বুঝালাম। বললাম,
—““ভাবি, আপনি ভুল ভাবছেন। আমার কাছে এটি বোঝা নয়, বরং দায়িত্ব। আমরা তো শুধু নিজেদের জন্য বাঁচি না, একে অপরের জন্যও বাঁচি। তাছাড়া আমরা তো আপনাদের আত্মীয়ের চেয়েও বেশি কাছের ছিলাম।
আজ আপনি বিপদে—আমি যদি আপনার পাশে না দাঁড়াই, তবে কে দাঁড়াবে? প্লিজ, ভাবি, চিন্তা করবেন না। আপনার হিয়া আর রিয়ান তো আমারই ছেলে-মেয়ের মতো। ওদের আমি একা ছাড়ছি না।
আজ যদি তুরাব বেঁচে থাকতো, সে একই কাজটি করতো। আর হাবিব ভাই যদি থাকতেন, তিনিও আমাকে আর আরিহানকে একা রাখতেন না।
আজ আমি স্বাবলম্বী হয়েছি ভাবি। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তার মধ্য দিয়েই আমি সামলে নেব। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
শেষমেশ রেশমি ভাবি চোখের জল মুছে, নীরবভাবে আমার সাথেই রওনা হলেন।আরিহানের ছোট্ট হাতটা শক্ত করে ধরে আমরা রিকশায় উঠলাম।
সেই মুহূর্তে মনে হলো, আমি শুধু একজন মানুষকে নয়—বরং আরও এক ভাঙা মানুষকে, তার ভাঙা সংসারকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
রেশমি ভাবিকে নিয়ে আমি আমাদের বাড়ি চলে এলাম।তিনি চারপাশে তাকিয়ে রইলেন—ড্রয়িং রুমের পরিপাটি সাজানো, বইভরা তাক, আরিহানের ছোট্ট খেলনাগুলো ছড়িয়ে আছে।হঠাৎ যেন তার চোখে এক ধরনের প্রশান্তি ভেসে উঠলো।
মিষ্টি হেসে বললেন,
—“ভাবি, সত্যিই অবাক হলাম। এত বড় দুঃখের পরও তুমি নিজেকে এভাবে সামলে নিয়েছো!অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে কত মেয়ে ভেঙে পড়ে, জীবন থেমে যায়। কিন্তু তুমি… তুমি তো কত সুন্দরভাবে সবকিছু মেইনটেইন করছো। তোমার থাকার মতো নিজের বাড়ি হয়েছে, ভাত-কাপড়ের চিন্তা নেই, ছেলেটাকেও ভালো স্কুলে পড়াতে পারছো… আল্লাহ তোমাকে সত্যিই অনেক শক্তি দিয়েছেন।”
আমি তার কথায় অদ্ভুতভাবে কেঁদে ফেললাম। বুকটা হালকা শ্বাসে ভরে উঠল, যেন অনেক চাপ একসাথে ছেড়ে দিয়েছে। চোখ নামিয়ে আস্তে বললাম—
—“শক্তি তো আমি পাই না ভাবি… আমি কেবল চাই আরিহান যেন বঞ্চিত না হয়। তুরাব তো চলে গেছে। বাবাহীন ছেলে যদি সারাক্ষণ আমাকেও কাঁদতে দেখে, তাহলে ওর ছোট্ট মন ভীষণ ভেঙে পড়বে। এজন্যই নিজেই নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছি।অন্তত ছেলেটা যেন ভালো থাকে। ওর জীবনে যেনো কষ্টের ছাঁয়া না পড়ে।
কিন্তু… যখন তুরাবের কথা বেশি মনে পড়ে, আমি সবার আড়ালে চলে গিয়ে গলা ফেটে কেঁদে যাই। কাউকে বুঝতে দেই না যে আমি ভেঙে পড়েছি। জানেন তো ভাবি, ভাঙা মানুষকে মানুষ আরও বেশি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে।”
আমার চোখে জল দেখে রেশমি ভাবি হাত বাড়িয়ে আমার হাত চেপে ধরলেন। তার চোখেও টলমল করে জল গড়িয়ে পড়ছিলো।তিনি বললেন,
—“তুমি একা নও ভাবি। আমি আছি তোমার সাথে।”
পরক্ষণেই ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে তিনি বললেন,
—“আজ যদি আমারও পড়াশোনা থাকতো, তাহলে আমিও কিছু একটা করতে পারতাম। এখন মানুষের বাড়িতে ঝি এর কাজ করি। কি যে কষ্ট লাগে, ভাবি… যখন সবাই চাকর চাকরানি বলে বাজে ব্যবহার করে। মুখে হাসি দিয়ে সহ্য করি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুকটা রক্তাক্ত হয়ে যায়।আজ ও (হাবিব) কাছে থাকলে এরকম কাজ কি করতে হতো? রানীর মতো রাখতো আমাকে… একটুও কষ্ট করতে দিতো না। ওসব কথা মনে হলে মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। ইচ্ছা করে সব শেষ করে দিই, গলায় দড়ি দিই। কিন্তু—”
কথাটা শেষ করতে না পেরে তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে চোখ নামিয়ে ফেললেন।
আমি এগিয়ে গিয়ে তার হাত চেপে ধরলাম। গলা ভারী হয়ে আসছিলো আমারও।আস্তে বললাম,
—“ভাবি, আল্লাহ কাউকে অভুক্ত রাখে না। জীবন যতই কঠিন হোক, তুমি হাল ছাড়তে পারো না। তোমার দুই বাচ্চা আছে—ওদের জন্যই তোমাকে বাঁচতে হবে। তোমার এই কষ্ট একদিন শেষ হবে, ইনশাআল্লাহ।”
আমার কথায় রেশমি ভাবি মুখ তুললেন। ভেজা চোখের কোণে এক চিলতে আশার আলো ঝলসে উঠলো।
তাঁর কাঁপতে থাকা হাতটা আলতো করে চেপে ধরে ধীরে ধীরে বললাম,
—“ভাবি, চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো। আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো আপনাকে হেল্প করতে। হিয়া আর রিয়ানের জন্যও চিন্তা করবেন না ভাবি। আজ থেকে ওদের দায়িত্ব আমার। নিজের ছেলে-মেয়ের মতোই আমি ওদের দেখবো। আমার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু করা সম্ভব, সবই করবো—এটুকু বিশ্বাস রাখুন।”
আমার কথা শুনে রেশমি ভাবি হঠাৎ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। তাঁর কান্নায় আমার কাঁধ ভিজে গেল। আমি নিঃশব্দে আলতো করে তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলাম।ধীরে ধীরে বললাম,
—“কাঁদবেন না ভাবি। সবকিছুই আমাদের ভাগ্যের লিখন। আমরা চাইলেই কি নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি? তবে আমরা চাইলে একে অপরের কষ্টটা একটু হালকা করতে পারি।”
রেশমি ভাবি এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—“আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক ভাবি। তোমার মতো একজন মানুষকে পাশে পাওয়া সত্যিই আমার ভাগ্য।”
সেই দিনের পর থেকে রেশমি ভাবি আর তাঁর দুই সন্তান—হিয়া আর রিয়ান—আমার সাথে আমার বাড়িতেই থাকে। ধীরে ধীরে এই ছোট্ট পরিবারটা যেন আমার নিজের রক্তের পরিবারের মতো হয়ে উঠলো।
হিয়ার বয়স এখন ৯ বছর। তাকে কাছে থাকা একটি ভালো স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি করে দিলাম। মেয়েটা ভীষণ মিষ্টি আর পড়ালেখায় মনোযোগী। বই খোলা মাত্রই মুখ গুঁজে পড়ে থাকে।
রিয়ানের বয়স ৬ বছর। চঞ্চল, দুষ্টু, সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ায়। তবে ওর ভেতরে একরকম সরলতা আছে। ওকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করালাম। প্রথমদিন স্কুলে যাওয়ার সময় ওর ছোট্ট হাত শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরেছিল। সেই মুহূর্তে মনে হলো, আমি যেন সত্যিই ওদের মা।
এখন প্রতিদিন সকালে আরিহান, হিয়া আর রিয়ান—তিনজনকে একসাথে স্কুলে পাঠাই। তাদের হাসি, দুষ্টুমি আর বইয়ের গন্ধে ঘরটা ভরে থাকে।
কেউ যদি আমার উপকার করে, সেই উপকারের কথা আমি কোনোদিন ভুলি না। আমাদের জীবনের সেই অন্ধকার সময়ে, যখন সবাই একে একে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল—তখন হাবিব ভাই আর রেশমি ভাবি ছাড়া কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। তারা শুধু সাহায্যই করেনি, আমাদের কষ্টও নিজেদের কষ্ট মনে করে ভাগ করে নিয়েছিল।
আজ তাঁদের ছেলে-মেয়েদের জন্য কিছু করতে পারছি—এটাই আমার কাছে এক ধরনের শান্তি। মনে হয়, অন্তত তাঁদের সেই ঋণের সামান্যটা শোধ করতে পারছি। কিন্তু তবুও বুকের ভেতরে একটা হাহাকার রয়েই যায়। যদি হাবিব ভাইকে খুঁজে দিতে পারতাম! যদি তাঁকে কোনোভাবে ফিরিয়ে আনতে পারতাম!
কোথায় খুঁজবো? কিভাবে খুঁজবো? যে মানুষ পাঁচ বছর আগে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে গেলেন—তার কোনো হদিস কি এখন পাওয়া সম্ভব?
ভাবতে ভাবতে বুকটা ভার হয়ে আসে। রেশমি ভাবি ভেবেছিলেন—স্বামী হারানো একজন নারী হিসেবে আমি নিজেই প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে আছি, তার উপর তাঁর কষ্ট যদি আমাকে জানান তবে হয়তো আমি ভেঙে পড়বো। তাই তিনি এতদিন আমার কোনো খোঁজখবর রাখেন নি।
সৃষ্টি কর্তার কি অদ্ভুত লীলা!
দুই বন্ধুর মধ্যে এত মিল, এত গভীর সখ্যতা—যেন একে অপর ছাড়া তাদের গল্পই অসম্পূর্ণ।এক বন্ধু পাঁচ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল, আর আরেকজন—পাঁচ বছর ধরে নিখোঁজ।
কখনও কখনও মনে হয়—আচ্ছা, যদি তারা দু’জনেই বেঁচে থাকতো, তাতে কী এমন ক্ষতি হতো?
পরিবারের সাথে একসাথে সুখে-শান্তিতে থাকার ইচ্ছে কি তবে এত বড় অপরাধ? তারা তো কোনো বিলাসী স্বপ্ন দেখেনি, কোনো অবাস্তব আশা করেনি। শুধু সংসার, পরিবার, আর আপনজনদের নিয়ে বাঁচার সহজ ইচ্ছে—এইটুকুই তো ছিলো তাদের আশা।
কিন্তু নিয়তি—সবকিছু কেড়ে নিলো এক ঝটকায়।
তাদের সেই সামান্য চাওয়ার মাঝেই কি কোনো অতিরিক্ত দাবি লুকানো ছিলো? নাকি আল্লাহ মানুষকে মাঝে মাঝে এইভাবেই পরীক্ষা করেন—যেন বাকিরা ধৈর্য শিখে নিতে পারে?
তুরাব…আমার মতো একজন ডিভোর্সিকে বিয়ে করেছিলো শুধুই এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে—
“তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে দেবো না, তোমার জীবনে কোনো দুঃখের ছায়া ফেলতে দিবো না, আমি তোমাকে পৃথিবীর সমস্ত সুখ দেবো।”
সত্যিই সে চেষ্টা করেছিলো।
মানুষের আজেবাজে কথা থেকে আমাকে আড়াল করেছে,তার মায়ের কঠিন কথার আঘাত যাতে আমার কানে না পৌঁছায়—সেজন্য সবার থেকে দূরে নিয়ে গেছে।
কিন্তু তবুও…আমাকে সুখী রাখতে পারেনি তুরাব।
কারণ সুখ তো লিখে আসে কপালে—চাইলেই কি জোর করে সুখী হওয়া যায়?
তবুও আলহামদুলিল্লাহ—আমি নিজেকে আজও সুখী মেয়ে মনে করি,কারণ তুরাব আমার জীবনে এসেছিলো।যে অল্পদিন ছিলো, সে দিনগুলোয় সে আমাকে ভালোবাসার আচ্ছাদনে রেখেছিলো।
আর সেই ভালোবাসার প্রতিদানই হলো—
আমার আরিহান।আমার জীবনের একমাত্র আশ্রয়।
আজ যখন আরিহানের মুখের দিকে তাকাই, মনে হয়—আর কি চাই আমার?ও-ই তো আমার বেঁচে থাকার কারণ।মাঝেমধ্যে ভাবি—যদি আরিহান না থাকতো, তবে কি হতো আমার?হয়তো তুরাবের শোকে দম ফেটে মরে যেতাম আমি।কিন্তু আল্লাহ আমাকে ভেঙে দেননি—
আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আরিহানের জন্য।
★★★
আমি এবার নিজে চেষ্টা করতে লাগলাম হাবিব ভাইকে খোঁজার জন্য।এভাবে একজন জলজ্যান্ত মানুষ কীভাবে নিঁখোজ হতে পারে? পাঁচ বছর হয়ে গেছে—কিন্তু কোনো হদিস নেই।
তুরাবকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারব না। অন্তত রেশমি ভাবির মুখে হাসি ফুটুক—এই ছোট্ট আশা আমাকে প্রতিদিন এগিয়ে রাখছিল।
আমি হাবিব ভাইয়ের বিভিন্ন পরিচিত, পুরনো বন্ধু-বান্ধব, অফিসের লোকজন—সবার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম।কিন্তু খোঁজের পথে আমি এমন এক সত্যের মুখোমুখি হলাম, যা আমি কখনোই আশা করি নি।
চলবে………..