ভাগ্যলিপি পর্ব-১০

0
2

#ভাগ্যলিপি(১০)
#মায়মুনা_সালসাবিল

একটা কথা আছে—“কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের হওয়া।”ঠিক তেমন ঘটনাই যেন ঘটেছে এই পাঁচ বছর পর।নিখোঁজ হাবিবকে খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে এলো একের পর এক রহস্য, যা কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি।
পাঁচ বছর আগের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেলো, তুরাব কিছু ফাইল হাতে অফিসের দিকে যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই সে থেমে যায়, কারো সাথে কথা বলছে মনে হলো। আশ্চর্যের বিষয়, তুরাব আর অফিসের ভেতরে ঢোকে না।ঠিক সেই সময়ে একটি রিকশা এসে দাঁড়ায় তুরাবের সামনে। রিকশা থেকে নামে তার সহকর্মী শিমুল। তুরাব তার হাতে থাকা ফাইলগুলো শিমুলকে দিয়ে দেয় এবং নিজে সেই রিকশাতেই কোথাও চলে যায়। আর অফিসের গাড়ি নিয়ে সেদিন শিমুল রওনা হয় কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে।
ফুটেজে আরও দেখা যায়, অফিসের গাড়ির পেছনে আরেকটি গাড়ি চলছিল। কিছু দূর যাওয়ার পর সেই গাড়িটি ইচ্ছাকৃতভাবে অফিসের গাড়িটিকে ধাক্কা দেয়, তারপর দ্রুত অন্য রাস্তায় চলে যায়।

আর এই গাড়িটি ছিল শাওনের।শাওন সেদিন আগে থেকেই খোঁজ নিয়েছিল যে তুরাব অফিসের গাড়িতে করে একটি মিটিংয়ে যাচ্ছে। সেই তথ্য জেনেই সে পরিকল্পনা করেছিল এ দুর্ঘটনার।কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যাকে রক্ষা করেন, তাকে শেষ করার ক্ষমতা কারও নেই।

ওসি আকবর নিশ্চিত হলেন—সেদিন অফিসের গাড়িতে তুরাব ছিলো না।ছিলো তুরাবের সহকর্মী শিমুল।

ওসি সাহেব সেজন্য এবার খবর দিলেন শিমুলের পরিবারকে—তারা যেনো আর শিমুলকে খুঁজে না ফেরে।সেদিন গাড়ি দুর্ঘটনায় শিমুলই মারা গিয়েছিলো।লাশ এতটাই পুড়ে গিয়েছিলো যে, কেউ তাকে চিনতেই পারেনি।
সংবাদটা শোনামাত্র শিমুলের স্ত্রী হৃদয়বিদারক চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।নিজের বুকে নিজেই আঘাত করতে করতে তিনি বারবার বলতে লাগলেন,
“এরকম খবর না শোনাই ভালো ছিলো!অন্তত এক বুক আশা নিয়ে বাঁচতাম…ভাবতাম, এই বুঝি শিমুল এসে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলো—
‘দিবা, আমি এসেছি…’”

শিমুলের তখন মাত্র নতুন বিয়ে হয়েছিলো।সেজন্য সে অফিসের কাছাকাছি একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিল, যাতে বউয়ের সঙ্গে একসাথে থাকতে পারে।যেদিন শিমুল নিঁখোজ হয়, সেদিন সে অফিসে যায় নি। বাসাতেই ছিলো।তার বউ, দিবা, তখন বাপের বাড়িতে, নতুন বাসাতে আসবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।তার আগেই শিমুল নিঁখোজ হয়ে গেলো। দিবা দূরে থাকায় ঠিকমতো বলতেও পারে নি—শিমুল আসলে ছিলো কোথায়?

ওসি সাহেবের মাথা এবার চক্কর দিতে লাগলো।
তাহলে, তুরাব আর হাবিব কোথায়?ওসি সাহেব আমাকে আর জানালেন না যে, সেদিন আমরা যাকে তুরাব মনে করেছিলাম, সে আসলে তুরাব নয়।যদি শিমুলের মতো তুরাবেরও মৃত্যু হয়ে থাকে, তাহলে আমি দ্বিতীয় বার আবার নতুন করে আঘাত পাবো।
এজন্য ওসি সাহেব নিজেই একা একা এর রহস্য বের করতে লাগলেন।

এদিকে আমি উদগ্রীব হয়ে আছি, কোনো নতুন তথ্য পাওয়া গেল কি না।ওসি সাহেব জানালেন, এখনো কিছু পাননি।তবে কিছু পাওয়া মাত্র আমাকে জানাবেন তিনি।

★★★

ওসি সাহেব ভালো-মন্দ কোনো খবর না দেওয়ায় আমরা ধরেই নিয়েছিলাম—হাবিব ভাইকে আর পাওয়া যাবে না, আর তুরাব তো মৃতই।
আমি আবার আমার আগের রুটিনে ফিরে এলাম।
রোজ সকাল বেলায় বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে কলেজে যাই।বাড়িতে মা আর রেশমি ভাবি একা থাকেন।

আমার শাশুড়ী আর রিয়ার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছিল। সাধ্য থাকলে ওদের কেও নিয়ে আসতাম বাড়ি। মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করছিল।
তবুও সাহস করে বলেই ফেললাম—“রিয়া, মাকে নিয়ে আমার এখানে চলে আসো।”
কিন্তু রিয়া জানালো না—“ভাবি, আমরা এখানেই থাকি। এমনিতেই মাঝে মাঝে বেড়াতে যাব। তুমি তো এখন জব করো, কলেজে যেতে হয় তোমাকে, এত ঝামেলা নিতে পারবে না।”

আমি আমার এই প্রস্তাব শ্বশুর মশাইকেও দিয়েছিলাম।কিন্তু তিনিও রাজি হলেন না আসতে। আফসোস ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন,

“যেখানে তোমার পাশে আমাদের থাকার কথা, সেখানে তুমিই আমাদের পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছো।তোমার মনটা সত্যিই অনেক বড়, ঊষা।
আমরা ভীষণ ভালো একটা বউমা পেয়েছিলাম, কিন্তু নিজের ভুলের কারণে তোমার মূল্যায়ন করতে পারিনি।তুরাব তোমাকে বিয়ে করে কোনো ভুল করেনি—ভুল করেছি আমরা, তোমাকে চিনতে না পেরে।অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। যদি সম্ভব হয়, আমাদের ক্ষমা করে দিও। আর তোমার শাশুড়িকেও মাফ করে দিও।”
এ কথা বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

আমি শ্বশুর মশাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,
“বাবা, আমার মনে আপনাদের প্রতি কোনো রাগ বা অভিমান নেই। আপনারা গুরুজন। আপনাদের আমি সব সময় সম্মান আর শ্রদ্ধার চোখেই দেখেছি।”

এখন শ্বশুর মশাই মাঝেমধ্যেই আরিহানকে দেখতে আসেন।রিয়াও তার মেয়ে লাবণ্যকে নিয়ে বেড়াতে আসে।শাশুড়ি যেহেতু প্যারালাইজড, তাই তিনি আসতে পারেন না। এজন্য আমি মাঝেমধ্যে শাশুড়িকে দেখতে যাই। ফলমূল নিয়ে যাই, ওষুধ কিনে দেওয়ার দায়িত্বও নিজের কাঁধে নিই।

একদিন শশুর বারণ করলেন এসব করতে কিন্তু আমি হাসিমুখে বললাম—
“ছেলে থাকলে কি করতো না? ভাবেন আমি আপনাদের ছেলে।”
আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে লাগলাম সবাইকে ভালো রাখার জন্য।
আমার সাথে কে কী করেছে, সব ভুলে গেলাম।
যদিও কেউ আঘাত দিলে সেটা সহজে ভোলা যায় না, তবুও ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।

“কুকুর যদি আমাদের কামড় দেয়, আমরা তো আর কুকুরকে কামড় দিতে পারি না।”
কেউ যদি আমাদের আহত করে, আমাদের উচিত তার প্রতি প্রতিহিংসা না করে সহনশীল বা মানবিক হওয়া।
কারণ একটা প্রবাদ আছে—“তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?”

★★★

দেখতে দেখতে আরও কিছু মাস কেটে গেলো।
আমি আর ওসি সাহেবকে হাবিব ভাইয়ের ব্যাপারে বিরক্ত করি না।অন্যদিকে প্রফেসর তুহিন মাঝেমধ্যেই আফসোস করে বলেন,
“ম্যাডাম, আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না।”

আমি তখন হাসিমুখে জবাব দিই—
“অনেক করেছেন স্যার আপনি আমার জন্য। ওসি আকবরের মতো একজন দায়িত্বশীল মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। উনি তো সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়েছেনই। এখন ভাগ্য সহায় না হলে আর করার কী আছে?”
এদিকে রেশমি ভাবিও এখন হাবিবকে মৃত বলেই ধরে নিয়েছে।হাবিব ভাই এর কথা মনে করে দিন রাত কাঁদতে থাকে এখন।

আজ আমি আরিহান, হিয়া আর রিয়ানকে নিয়ে কলেজে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে লেখা—ওসি সাহেব।
ফোন ধরতেই তিনি বললেন—
“ম্যাডাম, রেশমি ভাবিকে নিয়ে দ্রুত থানায় চলে আসেন।”

আমার বুক কেঁপে উঠলো। তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করলাম—
“স্যার… কোনো ভালো খবর পেয়েছেন? হাবিব ভাইকে পাওয়া গেছে নাকি?”

ওসি সাহেবের কণ্ঠে একরাশ স্বস্তি, সাথে একটু চাপা হাসি—
“হুম… হাবিব ভাইকে পেয়েছি। আর শুধু উনি একা নন… সাথে আছে আপনার তুরাবও।”

এরকম একটা নিউজ শুনে আমার আসলে অনুভূতিটা কেমন হবে, আপনারাই ভাবুন এখন। যে মানুষটিকে আজ পাঁচ বছর যাবত মৃত ভেবে এসেছি, যার শোকে কাঁদতে কাঁদতে আজ চোখে আবছা দেখি—সেই মানুষটাকে যদি এখন জলজ্যান্ত সামনে দেখি, আমি কি করবো? আমি কি ঠিক থাকতে পারবো, না খুশির ঠেলায় হার্ট অ্যাটাক করবো? আমার পুরো শরীর ঘামতে লাগলো। ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে ঢকঢক করে খেলাম আগে। তারপর চশমাটা খুলে মুখে-চোখে বাকি পানি দিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। পরে আবার ভাবলাম, এত উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই। যদি আবার ওদের সাথে খারাপ কিছু হয়ে থাকে!

ওদিকে কলে ওসি সাহেব এখনো আছেন।
আমি কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
—“স্যার, ওরা দুইজন ঠিক আছে তো?”

ওসি সাহেব তখন হেসে উঠে বললেন,
—“হ্যাঁ, ঠিক আছে, সুস্থ-সবলই আছে।”

আর কি দেরি করা যায়! বাচ্চাদের নিয়ে আবার ফিরে এলাম বাড়িতে। আর রেশমি ভাবিকে বললাম,
—“দ্রুত চলুন থানায়। ওসি সাহেব আমাদের ডেকেছেন। ওরা দুইজনই বেঁচে আছে এবং সুস্থ-সবল অবস্থায় আছে।”

রেশমি ভাবি তো খুশিতে একদম কেঁদেই ফেললেন। আর আমরা দেরি করলাম না। বাচ্চাদের নিয়েই দ্রুত চলে এলাম থানায়।ওসি সাহেবের মুখে যেনো প্রশান্তির হাসি। আমি একদম থতমত খেয়ে কাছে গিয়ে বললাম,
—“স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। আপনি আমাদের দুইটা পরিবারকে নতুন করে গড়ে দিলেন। আল্লাহ এর বিনিময়ে আপনাকে ভালো কিছু উপহার দিবে। আমি আজীবন দোয়া করব, যাতে আপনি আর আপনার পরিবারের উপর কোনো দুঃখ-দুর্দশা না আসে।”

ওসি সাহেব আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
—“সব সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।এটা আপনাদের ভাগ্যে ছিল, মিস ঊষা। আমি শুধু একটু চেষ্টা করেছি। আপনাদের খুশি দেখে আমারও ভীষণ ভালো লাগছে। আপনাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে আজ আমি আমার এই পেশাক পেয়ে ধন্য বোধ করছি।”

আমি তখন কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
—“ওরা ছাড়া আমরা এবং আমাদের পরিবার এতদিন অসম্পূর্ণ হয়ে ছিলো। আমরা বেঁচে থেকেও যেন মৃত ছিলাম। আজ আমাদের দেহে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে এলো।স্যার, কোথায় ওরা? আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। ওদের সামনে এনে আমাদের আত্মাটা প্লিজ ঠান্ডা করুন।”

ওসি সাহেব তা শুনে বললেন,
—“এতো বছর ধৈর্য ধরে ছিলেন, আর কিছুদিন একটু ধৈর্য্য ধরতে পারবেন না?”

আমি অবাক হয়ে বললাম,
—“কেনো স্যার? কেনো দেখা করতে পারবো না?”

ওসি সাহেব তখন বললেন,
—“ওরা দুইজন আসলে অন্য থানার আন্ডারে জেলে বন্দি আছে। কিছু প্রসেসিং এর কাজ চলতেছে। আমি খুব শীঘ্রই ছাড়িয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো।”

আমি স্তম্ভিত হয়ে বললাম,
—“জেলে আছে?”

—“হ্যাঁ, জেলে।”

ওসি সাহেব তখন বিস্তারিতভাবে বলতে লাগলেন, সেদিন আসলে কি হয়েছিল…

তুরাব কক্সবাজারে অফিসিয়াল সেই মিটিং এ অ্যাটেন্ড করবে বলে তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে অফিসের কাছে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার ফোনে কল আসে তার রাজনৈতিক জীবনের এক বড় ভাই এর থেকে। তিনি তুরাবকে আর্জেন্ট আসতে বলেন।
কিন্তু তুরাব জানায়, সে এখন অফিসের কাজে বের হচ্ছে, তাই যেতে পারবে না।তবে সেই ভাইটি জোর দিয়ে বলেন, “এখন না আসলে খুবই খারাপ হয়ে যাবে।”
তুরাব পড়ে যায় মহা ঝামেলায়। খুব কষ্টে সে ওই জবটা পেয়েছিল। এখন সময়মতো ফাইলগুলো নিয়ে মিটিং এ উপস্থিত হতে না পারলে তার বস ভীষণ রাগ করবেন।
এই জন্য তুরাব হাবিবকে কল দেয়। কিন্তু হাবিব জানায়, সে ইতোমধ্যে সেই রাজনৈতিক দলের নেতা ফুয়াদ ভাই–এর আস্তানায় চলে গেছে। কারণ ফুয়াদও তাকে কল করে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাবিবও অফিসের উদ্দেশ্যেই বের হয়েছিল।
আর পথে হঠাৎ ফুয়াদের ফোন আসে…

তুরাব এখন ফাইলগুলো নিয়ে কাকে পাঠাবে? এ ধরনের বিশ্বস্ত কেউ তো নেই। হঠাৎ তার মনে হলো শিমুল কিছুদিন ছুটিতে আছে। হয়তো ওকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নেওয়া যায়।এই ভাবনা নিয়ে তুরাব শিমুলকে কল করে জানালে, শিমুল তা অস্বীকার করতে পারলো না, কারণ তুরাবের সঙ্গে তার বেশ খাতির ছিল। তাছাড়া শিমুল বাড়িতে বসেই ছিল।

তুরাব বলল,
—“তুমি শুধু ফাইলগুলো নিয়ে উপস্থিত হবে। আমি আজ যেতে পারলে তো ভালো, না হলে আগামীকাল রওনা দিবো।”

শিমুল রাজি হয়ে গেল। রিক্সা নিয়ে অফিসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তুরাব তার হাতে ফাইলগুলো দিয়ে শিমুলের সেই রিক্সাতে চড়ে রওনা দিল।এদিকে সবাই ভেবেছে, লোগো করা অফিসের গাড়িতে তুরাবই আছে, যেহেতু আজ তারই যাওয়ার কথা।
এদিকে শাওনও ফন্দি এঁটেছে। আজ এই সুযোগে সে তুরাবের গাড়ি ধাক্কা দিয়ে তাকে মেরে ফেলবে।

তুরাব ফুয়াদের আস্তানায় যেতেই দেখে, হাবিবকে তারা ইতোমধ্যেই বেঁধে রেখে মারধর করছে। হাবিবের অপরাধ—সে আর দলে যোগ দিতে চায় না।

তুরাব হাবিবকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলে ফুয়াদ তুরাবকেও বলে,
—“তোদের আবার দলে যোগ দিতে হবে, না হলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।”

তুরাব তখন রিকুয়েস্ট করে,
—“ভাই, আমরা আর এসব রাজনীতিতে আগ্রহী নই। আমরা বিয়ে করেছি, সংসার হয়েছে। এজন্য সব ছেড়ে দিয়েছি।”

ফুয়াদ শোনামাত্র বলে ওঠে,
—“এরেও ধরো! আর মারতে থাকো।”

ছেলেপেলে এগিয়ে এলে তুরাব নিজেকে রক্ষার জন্য পাশে থাকা একটি লাঠি নিয়ে বেধম মারতে থাকে। প্রায় সবাই ঘায়েলই হয়েছিল। তুরাব ইচ্ছা করলে পালিয়ে যেতে পারতো, কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ খেয়াল করে হাবিব নেই। ফুয়াদ তাকে কোথাও নিয়ে গেছে।

তুরাব বাইরে বের হয়ে দেখে, ফুয়াদ তার গাড়িতে করে চলে যাচ্ছে। তুরাব তখন কোনো উপায় না দেখে নিজেও একটি গাড়ি নিয়ে ফুয়াদের পিছু চলে যায়। ফুয়াদ হাবিবকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তুরাব কিছুই বুঝতে পারছে না। তবুও সে ওর পিছু ছাড়ে না।

হঠাৎ ফুয়াদ গাড়ি থামিয়ে দেয়, তুরাবও থামায়। তখন তুরাব বুঝতে পারে, আজ তাদের সাথে খারাপ কিছু হতে চলেছে। এবং ঠিক তাই হলো। সেখানে ফুয়াদের অনেক ছেলে-পেলে ছিল, যারা তুরাবকে এটাক করতে আসে।

তুরাব সাধ্যমতো সবাইকে মারলেও হঠাৎ কেউ একজন পিছন থেকে তুরাবের মাথায় আঘাত করে। অন্যদিকে হাবিব তা দেখে চিৎকার করতে থাকে, তুরাবকে ডাকতে থাকে, কিন্তু তুরাব কোনো সাড়া দিতে পারছে না।

ঠিক সেই সময় পুলিশের গাড়ি চলে আসে। গাড়ি থেকে নামে এস আই পল্লব। কিন্তু সে ফুয়াদেরই লোক। এজন্য ফুয়াদ আর তার দলবল একটুও ভয় পায় না। বরং তারা এস আইকে দেখে আরও বেশি মারতে থাকে।

এস আই তখন বলে,
—“আরেহ! থামো। মেরো না আর। এমনিতেই দলের অবস্থা নড়বড়ে।”

ফুয়াদ রেগে গিয়ে বলে,
—“না! এদের আজ আমি খুন করবো। এরা আমাদের দলের হয়ে ছিল আগে, এখন নিশ্চয় অন্য কোন দলে যোগ দিয়েছে। এরা আমাদের গোপন সব তথ্য ফাঁস করবে।”

এস আই পল্লব তখন ফুয়াদকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
—“এদের আমি জেলে নিয়ে যাচ্ছি। গতকাল তোমাদের যে মাদকদ্রব্য সহ ট্রাক ধরা পড়েছে, তার জন্য উপর থেকে প্রচুর চাপ আসছে। এই দুইটার নাম দিয়ে দেবো।আর বলবো পুলিশ এদের কে হাতেনাতে ধরেছে।”

ফুয়াদ তা শুনে বললো,
—“মন্দ হবে না ব্যাপারটা। তবে যেনো শালারা সহজে বের না হতে পারে।”

এস আই পল্লব তখন হাসতে হাসতে বলে,
—“দশ বছরের আগে বের হতে পারবে না। সেই ব্যবস্থাই করবো।”

এই বলে তারা হাবিব আর তুরাবকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। তাদের হুমকি দেওয়া হয়,
—“স্বিকার না করলে তোদের দুইজনের পরিবারকেই চিরতরে শেষ করে দেওয়া হবে।”
নিজের পরিবার বাঁচানোর ভয়ে তুরাব আর হাবিব মেনে নেয় যে তারা ড্রাকস-এর বিজনেস করে। আর পুলিশ যেসব ট্রাকসহ ড্রাকস ধরেছে, সব তুরাব ও হাবিবের নামে লেখা হয়। এই জন্য উপরের মহল থেকে এস আই পল্লব অনেক বাহবাও পায়।

সব কিছু শুনে আমি আর কাঁদতে পারছিলাম না। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল; শুধু ভাবতে লাগলাম, ইস্— কত কষ্ট পেয়েছে তারা দুইজন। বিনা দোষে এতো বছর অন্ধকার কারাগারে কিভাবে কাটিয়েছে? আমরা তবুও বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে ছিলাম। আর তাদের এমনভাবে রাখা হয়েছে যে তারা কারোর সাথে যোগাযোগ করার সুযোগও পায়নি।

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
—“ওসি সাহেব, ওই অমানুষ গুলোকে কি ধরেছেন?”

ওসি আকবর তখন বললেন,
—“এস আই পল্লবকে ধরেছি, কিন্তু ফুয়াদ পালিয়েছে। শীঘ্রই ওকেও ধরবো, ওদের টিমসহ।”

ওসি সাহেব এবার একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—“সবার মৃত্যুর রহস্য যখন পেয়েছি, এবার নিশ্চয় শাওন আর টয়ার হত্যাকারী কেও খুঁজে বের করব।”

আমি তখন বললাম,
—“শাওন তো অপরাধী ছিল। ওকে যে খুন করেছে, সে ঠিক কাজ করেছে। ওর অপরাধীকে ধরতে হবে না।”

ওসি সাহেব সেই কথা শুনে বললেন,
—“অপরাধ তো অপরাধই। সে যেই হোক। আমার দায়িত্ব ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আমি সেটাই করব, মিস ঊষা।”

চলবে……